মেঘদূত

মেঘদূত

জ্যৈষ্ঠ মাসের অপরাহ্ণে ব্রতীন মাঠ ভাঙিয়া গ্রামের দিকে চলিয়াছিল। সূর্য প্রায় অস্তোন্মুখ হইয়াছে বটে কিন্তু তাহার চোখের রক্ত-রাঙা ক্রোধ এখনও নিভিয়া যায় নাই।

রৌদ্রে পোড়া চারণভূমি; ঘাস যে দু’চার গাছি ছিল জ্বলিয়া খড় হইয়া গিয়াছে। মাঠে জনপ্রাণী নাই। সম্মুখে প্রায় মাইলখানেক দূরে গ্রামের খোড়ো ঘরগুলি দিগন্তরেখাকে একটু অসমতল করিয়া দিয়াছে। তাহারই কাছাকাছি একটা নিঃসঙ্গ তালগাছ শূন্যে গলা উঁচু করিয়া যেন দূরের কোনও দৃশ্য দেখিবার চেষ্টা করিতেছে; অবসন্ন মূর্ছাহত দিগন্তের ওপারে শীতলতার কোনও আশ্বাস আছে কিনা তাহারই সন্ধান করিতেছে। ঐ তালগাছটা ব্ৰতীনের বাড়ির কাছেই।

তপতীর কথা ব্রতীনের মনে হইল; তপতী হয়তো জানালায় দাঁড়াইয়া তাহার পথ চাহিয়া আছে। ব্রতীন আরও জোরে পা চালাইল। একে তো ঘরমুখো বাঙালী; তার উপর ক্যাম্বিসের জুতার তলা ভেদ করিয়া মাটির উত্তাপ তাহার পায়ের চেটো পুড়াইয়া দিতেছে। সমস্ত দিনের অগ্নিক্ষারণ মাটির কটাহে সঞ্চিত হইয়া টগবগ করিয়া ফুটিতেছে।

ব্রতীন ভদ্রসন্তান; শহরের আবহাওয়ায় লেখাপড়া শিখিয়া সে মানুষ হইয়াছিল। জীবনে বেশী উচ্চাশা তাহার ছিল না; গতানুগতিকভাবে চাকরি-বাকরি করিয়া সংসার পাতিয়া সুখে স্বচ্ছন্দে জীবন কাটাইয়া দিবে এইরূপ একটা ভাসা-ভাসা অভিপ্রায় তাহার মনে ছিল। কিন্তু সহসা একদিন ভাব-বন্যার দুর্নিবার টানে তাহার ঘাটে-বাঁধা খেয়াতরী ভাসিয়া গিয়াছিল তারপর বহু আঘাটা ঘুরিয়া অবশেষে তাঁহার জীর্ণ তরী এক যুগাবতার মহাপুরুষের আশ্রম-বন্দরে গিয়া ভিড়িয়াছিল।

আশ্রমে মহাপুরুষের সান্নিধ্যে থাকিয়া ব্রতীন শান্তি পাইয়াছিল, জীবনের একটি সুনির্দিষ্ট পন্থা দেখিতে পাইয়াছিল, মনুষ্যত্বের নিঃসংশয় মূল্য কোথায় তাহা অনুভব করিয়াছিল। ক্রমে আশ্রমের নিঃস্বার্থ ফললিপ্সাহীন কর্মের মধ্যে সে ডুবিয়া গিয়াছিল।

এই আশ্রমেই তপতীর সহিত তাহার পরিচয় হয়। তপতীও ব্রতীনের মতো নোঙর-ছেঁড়া নৌকা। দু’জনের দু’জনকে ভাল লাগিয়াছিল; আশ্রমের বহু যুবকযুবতীর মধ্যে ইহারা পরস্পরকে বিশেষভাবে কাছে টানিয়া লইয়াছিল। এই প্রীতির মধ্যে জৈব আকর্ষণ কতখানি ছিল বলা যায় না, তাহারা সজ্ঞানে কিছুই অনুভব করে নাই।

কিন্তু মহাপুরুষ তাহাদের মনের অবস্থা অনুভবে বুঝিয়াছিলেন। একদিন তাহাদের নিভৃতে ডাকিয়া স্মিতমুখে বলিলেন, ‘তোমাদের মনের কথা আমি জানি। বিয়ে করবে?

দু’জনে গুরুর সম্মুখে পাশাপাশি বসিয়াছিল, তাঁহার কথা শুনিয়া চমকিয়া উঠিল; পুলকিতচিত্তে ভাবিল, গুরু কি অন্তযামী? তাহাদের অন্তরের গুঢ়তম আকাঙক্ষা তিনি জানিলেন কি করিয়া?

তাহাদের মুখের ভাব দেখিয়া গুরু আবার হাসিলেন, বলিলেন, ‘বেশ, তোমাদের আমি বিয়ে দেব। কিন্তু একটি শর্ত আছে। যতদিন ভারতবর্ষ স্বাধীন না হয় ততদিন ব্রহ্মচর্য পালন করবে।’

শর্তের কথা শুনিয়া দু’জনেই লজ্জা পাইয়াছিল; একটু কৌতুকও অনুভব করিয়াছিল। মাছকে যদি বলা হয়, তুমি সারা জীবন জলে বাস করিবে তাহা হইলে সে কি দুঃখিত হয়? ব্রতীন ও তপতী এতাবৎ অনায়াসে অবহেলাভরে ব্রহ্মচর্য পালন করিয়াছে, কখনও গুরুতর চিত্ত-চাঞ্চল্য ঘটে নাই। তবে যে আজ তাহারা পরস্পরকে কামনা করিয়াছে, সে তো মনের প্রতি মনের আকর্ষণ; সান্নিধ্যের বাসনা আত্মসমর্পণের আনন্দ। তাহারা পরস্পরের হইতে চায়, ইহার বেশী আর কিছু নয়।

নত মুখে ঘাড় নাড়িয়া তাহারা গুরুর শর্ত সর্বান্তঃকরণে স্বীকার করিয়া লইয়াছিল। অতঃপর মহাপুরুষ স্বয়ং তাদের বিবাহ দিয়াছিলেন।

বিবাহের কিছুদিন পরে মহাপুরুষ বলিয়াছিলেন, ‘এখানকার কাজ তোমাদের শেষ হয়েছে। এখন গ্রামে গিয়ে বাস কর; তোমাদের আদর্শে গ্রামবাসীকে গড়ে তোলো।’

ব্রতীনরা তিনপুরুষ আগে জমিদার ছিল। এখনও গ্রামে তাহাদের ভাঙা ভদ্রাসন ও কয়েক বিঘা জমি পড়িয়া ছিল। ব্রতীন তপতীকে লইয়া ভাঙা ভদ্রাসনে গিয়া উঠিল।

তদবধি গত কয়েকমাস ধরিয়া এই গ্রামে তাহাদের জীবনযাত্রা শান্ত ধারায় বহিয়া চলিয়াছে। ব্রতীন জমিজমা দেখে, গ্রামের ছেলেবুড়োকে পড়ায়; তপতী গৃহকর্ম করে, গ্রামের মেয়েদের সেলাই শেখায়, সুতা কাটিতে শেখায়। এমনিভাবে শীত বসন্ত কাটিয়াছে, জ্যৈষ্ঠও শেষ হইতে চলিল।

আজ সকালে ব্রতীন পাশের গ্রামে গিয়াছিল একজোড়া বলদ কিনিবার জন্য। বর্ষা নামিতে আর দেরি নাই, এখন হইতে চাষবাসের ব্যবস্থা করিতে হইবে। নিদাঘের কঠোর পৌরুষ কখন সংযম হারাইয়া সঞ্জীবনী ধারায় পৃথিবীকে নিষিক্ত করিবে তাহার স্থিরতা নাই, রৌদ্রঋতুস্নাতা ধরিত্রী প্রতীক্ষা করিয়া আছে।

পাশের গ্রামটি ক্রোশ দুই দুরে; সেখানে দ্বিপ্রহর কাটাইয়া ব্রতীন বাড়ি ফিরিতেছিল। বলদ দুটি তাহার পছন্দ হইয়াছে, দরদামও ঠিক হইয়াছে—কাল সকালে তাহার লোক গিয়া তাহাদের লইয়া আসিবে।

ব্রতীন ভাবিতে ভাবিতে চলিয়াছিল—বলদ দুটি তপতীর নিশ্চয় খুব পছন্দ হইবে। গোলগাল গড়ন, দুধের মতো সাদা—যেন দুটি যমজ ভাই। ব্রতীন তাহাদের নাম রাখিবে কার্তিক গণেশ—না—গৌর নিতাই। তপতী তাহাদের না দেখা পর্যন্ত উত্তেজনায় ছটফট করিয়া বেড়াইবে—রাত্রে ঘুমাইতে পারিবে না। তপতীর একটা অভ্যাস কোনও বিষয়ে অধিক কৌতুহল হইলে সে বাঁ হাত দিয়া ডান হাতের তর্জনী মুঠি করিয়া ধরিয়া দুই হাত একসঙ্গে নাড়িতে থাকে এবং অনর্গল প্রশ্ন করে। আজও তেমনি ভাবে দুই হাত নাড়িতে নাড়িতে জিজ্ঞাসা করিবে,—বলনা কেমন দেখতে? কত বয়স? শিং খুব বড় বড়—?

চিন্তাস্মিত মুখে চলিতে চলিতে ব্রতীন সহসা অনুভব করিল তাহার চারিদিকে আলোর উগ্রতা যেন ম্লান হইয়া গিয়াছে। সে চকিতে চোখ তুলিয়া আকাশের পানে চাহিল; তারপর থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িল। তাহার হর্ষোৎফুল্ল চোখে নীল কপিশ মেঘের ছায়া পড়িল। নৃত্য-পাগল বাউলের বিস্রস্ত জটা ছড়াইয়া পড়িয়াছে—সূর্যের চোখে গাঢ় মেঘের অঞ্জন। প্রবল বাতাসের ফুৎকারে ফুৎকারে মেঘের দল ছুটিয়া আসিতেছে—তাহাদের খাঁজে খাঁজে নীল বিদ্যুতের চাপা আগুন। বায়ুমণ্ডলে একটা শব্দহীন স্পন্দন উঠিতেছে—ঝনন্ ঝনন্—

ব্রতীন দাঁড়াইয়া প্রকৃতির এই হর্ষোন্মাদনা দেখিতে লাগিল। দূরে তাহার বাড়ির পাশের তালগাছটা নিশ্চল হইয়া দাঁড়াইয়া ছিল, এখন হঠাৎ যেন কোনও অপ্রত্যাশিত আনন্দ-সংবাদ পাইয়া বাহু আস্ফালন করিয়া উন্মত্ত বেগে নাচিয়া উঠিল। দেখিতে দেখিতে বিদ্যুৎ-কশাহত মেঘের দল আসিয়া পড়িল, মাঠের রৌদ্রদগ্ধ তৃণদল থরথর বেগে কাঁপিয়া কাঁপিয়া ঝড়ের আবেগে সাড়া দিল। ব্রতীনের হাতে মুখে তপ্ত বাতাসের স্পর্শ লাগিল।

কিছুক্ষণ ঝড়ের মাতামাতি চলিবার পর বর্ষণ নামিল। বড় বড় ফোঁটা; প্রথমে অশ্রুজলের মতো আতপ্ত, তারপর বরফের টুকরার মতো ঠাণ্ডা। শীতলতা! কি অপূর্ব শীতলতা! চারিদিক বৃষ্টিধারায় ঝাপসা হইয়া গেল; দুর্মদ বাতাস বৃষ্টিধারাকে মথিত করিয়া ছুটাছুটি করিতে লাগিল। সিক্তভূমি হইতে ঝাঁঝালো সোঁদা গন্ধ উঠিল—

ব্রতীন যখন বাড়ি ফিরিল তখন তাহার সর্বাঙ্গ দিয়া জলের স্রোত বহিতেছে। তপতী তাহাকে জানালা দিয়া দেখিয়াছিল, সে বারান্দায় উঠিতেই ছুটিয়া আসিয়া তাহার হাত ধরিল, হাসিভরা অনুযোগের কণ্ঠে বলিল, ‘বা রে, তুমি কেমন ভিজলে, আমি ভিজতে পেলুম না!’

ব্রতীন অঙুল দিয়া নিজের মুখের জল চাঁছিয়া লইয়া তপতীর মুখে তাহার ছিটা দিয়া বলিল, ‘এই তো, ভেজো না।’

পাখির কুহরণের মতো ছোট একটি হাসি তপতীর কণ্ঠ হইতে বাহির হইল।

‘ও বুঝি আবার ভেজা! বিষ্টিতে দাঁড়িয়ে না ভিজলে কি মজা হয়?’

ব্রতীন সিক্ত খদ্দরের পাঞ্জাবিটি খুলিয়া ফেলিতে ফেলিতে বলিল, ‘বেশ তো, তাই ভেজো। আমি ভেবেছিলুম এসে দেখব তুমি দিব্যি ভিজে বসে আছ।’

‘ইচ্ছে কি হয়নি? কিন্তু ভয় হল তুমি এসে যদি বকো—! ভিজি তাহলে?’ নিমেষ মধ্যে আঁচলটা গাছকোমর করিয়া বাঁধিয়া সে তৈয়ার হইয়া দাঁড়াইল।

ব্রতীন স্নিগ্ধহাস্যে তাহার পানে তাকাইল। তাহার মনে হইল তপতী যেন হঠাৎ বদলাইয়া গিয়াছে, তাহার এ-রূপ তো সে আগে কখনও দেখে নাই। তপতীর দেহের যৌবন যেমন বস্ত্রের শাসন লঙ্ঘন করিয়া সহজে ধরা দেয় না, তাহার মনের ছেলেমানুষীও বাহিরের সংযত গাম্ভীর্য দিয়া ঢাকা থাকে, সহসা চোখে পড়ে না। কিন্তু আজ যেন বাহিরের সমস্ত আবরণ ফেলিয়া দিয়া তাহার ভিতরের চপলা তরুণীটি কলহাস্যে বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইল। ব্রতীন বিবাহের এতদিন পরে তাহার একটা নূতন পরিচয় পাইল।

ভিজা পাঞ্জাবিটা খুলিয়া মেঝেয় ফেলিতেই ব্রতীনের নগ্ন ঊর্ধ্বাঙ্গের উপর তপতীর দৃষ্টি পড়িল। বিস্তৃত বক্ষ, বলিষ্ঠ দুই বাহু; বুকের মাঝখান দিয়া বিরল রোমশতার একটি রেখা নামিয়াছে। তপতী চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া ক্ষণেক চাহিয়া রহিল। ব্রতীনকে নগ্নদেহে সে ইতিপূর্বে দেখে নাই।

এই সময় শীকরসিক্ত বাতাসের একটা ঝাপটা আসিয়া তপতীর গায়ে লাগিল; তাহার বুকে গলায় রোমাঞ্চ সঞ্চার করিয়া সারা দেহে শিহরণ জাগাইয়া দিয়া চলিয়া গেল। এই অনাহূত হর্ষের লজ্জা চাপিবার জন্যই যেন সে ব্ৰতীনের হাত ধরিয়া টানিয়া বলিল, ‘চল, তোমাকেও ছাড়্‌ব না—দু’জনে মিলে ভিজব—’

দু’জনে উঠানে গিয়া ভিজিল। তারপর মাঠে গিয়া বৃষ্টির মধ্যে ছুটাছুটি করিল। তপতী একবার পা পিছলাইয়া পড়িয়া গিয়া কাদায় মাখামাখি হইল; ঝড়ের গর্জনের সঙ্গে তাহাদের মিলিত হাস্যরব মিশিল। সন্ধ্যার নিস্তেজ আলোতে ঘন ধারাবর্ষণের কুজ্ঝটিকার মধ্যে তাহাদের এই উচ্ছ্বসিত ঋতু-সম্বর্ধনা কেহ লক্ষ্য করিল না।

অবশেষে ভিজিবার সাধ আকণ্ঠ পূর্ণ করিয়া তাহারা বাড়ি ফিরিয়া আসিল। বারান্দায় দু’জনে হাসিমুখে দু’জনের দিকে ফিরিল।

‘কেমন, মন ভরেছে এবার—?’ সকৌতুকে পরিহাস করিতে গিয়া ব্রতীনের গলার কথাটা আটকাইয়া গেল, যেন কে তাহার গলা চাপিয়া ধরিয়াছে। বৃষ্টির মধ্যে হুড়াহুড়ি করিবার সময় সে এমন করিয়া তপতীর সিক্তবাস-দেহটি লক্ষ্য করে নাই,—এ যেন ভরা-পুকুরে প্রায়-ডুবিয়া-যাওয়া একটি কুমুদ ফুল ফুটিয়াছে; নারীত্বের গৌরবে তাহার যৌবন-শ্রী যেন উদ্ভিন্ন হইয়া পড়িয়াছে। ব্রতীন ক্ষণেক নিশ্বাস রোধ করিয়া রহিল, তারপর চক্ষু ফিরাইয়া লইয়া বলিল, ‘যাও, আর দেরি কোরো না, ভিজে কাপড় ছেড়ে ফেল।’ বলিয়া নিজের ঘরে প্রবেশ করিল।

রাত্রি হইয়াছে। বায়ুর বেগ ও মেঘের গর্জন অনেকটা শান্ত হইয়াছে বটে কিন্তু বৃষ্টিধারা তেমনি অবিশ্রাম ঝরিয়া চলিয়াছে। মাঝে মাঝে অল্প বিদ্যুৎ চমকিতেছে—যেন পরিতৃপ্ত মুখের হাসি।

তপতীর শয়নঘরে খোলা জানালার সম্মুখে ব্রতীন ও তপতী পাশাপাশি দাঁড়াইয়া ছিল। ঘরের কোণে রেড়ির তেলের প্রদীপ—ঘরটি ছায়াময় স্বপ্নকুহকপূর্ণ। একপাশে তপতীর সঙ্কীর্ণ শুভ্র শয্যা অস্পষ্ট দেখা যাইতেছে।

জানালার বাহিরে বৃষ্টির রোমাঞ্চবিদ্ধ অন্ধকার। মাথার উপর তালগাছটা গদ্‌গদকণ্ঠে অর্থহীন কথা বলিতেছে। কিন্তু যথার্থই কি অর্থহীন কথা? কান পাতিয়া শুনিলে যেন তাহার অর্থ বোঝা যায়—আদর-সোহাগ-প্রীতি মিশ্রিত রতিরসার্দ্ৰ কলকুজন। ব্রতীন অনুভব করিল, মাটির তলায় অসংখ্য শুষ্ক বীজ সঞ্জীবিত হইয়া উঠিতেছে—অঙ্কুরিত হইতেছে, তাহাদের কণ্ঠেও এই রসার্দ্র শীৎকার, গাঢ় গদভাষণ। ধরিত্রীর দেহ হইতে একটি সুমিষ্ট গন্ধ বাহির হইয়া আসিতেছে, যেন সম্ভুক্তা বধূর নিবিড় দেহ-সৌরভ।

তপতী শান্তভাবেই ব্রতীনের পাশে দাঁড়াইয়া ছিল, কিন্তু তাহার মনের ভিতরটা কেমন যেন অশান্ত হইয়া উঠিয়াছিল। সে পাশের দিকে তাকাইল, আবছায়া-আলোতে ব্ৰতীনের মুখ ভাল দেখা গেল না। নিরুৎসুক কণ্ঠে তপতী জিজ্ঞাসা করিল, ‘বলদ কেমন দেখলে?’

‘ভাল।’ ব্রতীন তপতীর দিকে ফিরিয়া দাঁড়াইল, একটু করুণ হাসিয়া বলিল, ‘আজ কি খেতে ইচ্ছে করছে জানো? মসুর ডালের খিচুড়ি আর ডিম ভাজা।’

‘আমারও!’ প্রবল উচ্ছ্বাসের সহিত কথাটা তপতীর মুখ দিয়া বাহির হইয়া আসিল। তারপর দু’জনেই একসঙ্গে হাসিয়া উঠিল। কিন্তু হাসির পিছনে অনেকখানি ব্যর্থতা ছিল। দু’জনেই জানে মসুর ডাল এবং ডিম নিষিদ্ধ খাদ্য—গুরুর নিষেধ।

তপতীর চোখ ছলছল করিয়া উঠিল—সে ব্রতীনের একটু কাছে সরিয়া আসিয়া তাহার হাতের উপর হাত রাখিল। ব্রতীন চমকিয়া উঠিল। তপতীর হাতের স্পর্শ তপ্ত—তাহার যেন জ্বর হইয়াছে।

ব্রতীন ধীরে ধীরে নিজের হাত সরাইয়া লইল, তারপর জানালার দিকে ফিরিয়া বাহিরের মসীলিপ্ত দুরবগাহ রহস্যের পানে চক্ষু মেলিয়া রহিল।

আজ বর্ষাগমের সঙ্গে সঙ্গে ব্রতীনের রক্তে ছন্দের একটা দোলা লাগিয়াছিল। এই ছন্দ মৃদঙ্গের মতো তাহার মাথার মধ্যে বাজিতে আরম্ভ করিয়াছিল। মন্থর লয়ে আরম্ভ হইয়া ক্রমে তাহার গতি দ্রুত হইতে দ্রুততর হইয়া এখন এমন এক স্থানে পৌঁছিয়াছিল যেখানে সব সঙ্গীত পরিণতির চরম সমে গিয়া পরিসমাপ্তি লাভ করে; অন্তঃপ্রকৃতির হর্ষাবেগ বহিঃপ্রকৃতির সহিত ওতপ্রোত একাকার হইয়া যায়। ব্রতীনের স্নায়ুশিরার এই পরমোৎকণ্ঠা দুর্নিবার হইয়া উঠিয়াছিল।

ঘরের কোণে প্রদীপের সোনালী শিখাটি অল্প অল্প নড়িতেছে, যেন একটি স্নিগ্ধ অথচ সতর্ক চক্ষু ব্রতীন ও তপতীর উপর দৃষ্টি রাখিয়াছে। ব্রতীনের নাভি হইতে একটি সুদীর্ঘ নিশ্বাস বাহির হইয়া আসিল, সে তপতীর দিকে ফিরিল। তপতীর একটা হাত জানালার উপর রাখা ছিল, ব্রতীন তাহার উপর হাত রাখিয়া মৃদুকণ্ঠে ডাকিল—‘তপতী।’

এবার তপতী হাত টানিয়া লইল। উচ্চকিত জিজ্ঞাসায় ব্রতীনের মুখের পানে চোখ তুলিয়া তপতীর সারা দেহ যেন ঝাঁকানি দিয়া কাঁপিয়া উঠিল; ব্রতীনের মুখের দর্পণে তপতীর মনের প্রতিবিম্ব পড়িয়াছে। তপতীর বুকের ভিতরটা অসহ্য স্পন্দনে ধড়ফড় করিতে লাগিল, সে দু’হাতে বুক চাপিয়া ধরিল।

ব্রতীন আরও কাছে সরিয়া আসিয়া আবার ডাকিল, ‘তপতী।’

ব্যাকুল চক্ষে চাহিয়া তপতী বলিয়া উঠিল, ‘একটা কথা তোমায় বলা হয়নি। আজ গুরুদেবের চিঠি এসেছে।’

পাথরের মূর্তির মতো ব্রতীন দাঁড়াইয়া রহিল। কতক্ষণ দাঁড়াইয়া রহিল সে নিজেই জানে না। তারপর মনের অতল হইতে উঠিয়া আসিয়া সে দেখিল জানালার উপর মুখ রাখিয়া তপতী নিঃশব্দে স্থির হইয়া আছে।

নীরস কণ্ঠে ব্রতীন বলিল, ‘আজ রাত্রে কিছু খাব না—ক্ষিদে নেই।’ বলিয়া নিজের শয়নঘরে গিয়া মাঝের দরজা বন্ধ করিয়া দিল।

মধ্য রাত্রি। বর্ষণের ধারা এখনও থামে নাই—কিন্তু তাহার সুর বদলাইয়া গিয়াছে। ক্লান্ত দেহে বিস্রস্ত কুন্তলে সে যেন গুমরিয়া গুমরিয়া কাঁদিতেছে, মাটিতে মাথা কুটিতেছে—

পাশাপাশি দুই অন্ধকার ঘরে দুইটি স্ত্রী-পুরুষ ঊর্ধ্বমুখ হইয়া শুইয়া আছে—তাহাদের অপলক চক্ষু অন্ধকারের রহস্য ভেদ করিতে পারিতেছে না। তাহাদের জীবনে ইহা পরম সিদ্ধি অথবা চরম ব্যর্থতা—তাহা কে বলিবে?

১৩ অগ্রহায়ণ ১৩৫৩

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *