মুখে বলি ‘হরি’
পরীক্ষা দু-রকমের—থিওরিটিক্যাল আর প্র্যাকটিক্যাল। আমি পড়েছি, জেনেছি, ‘শিখেছি, তত্ত্ব ও তথ্য আমার অধিগত হয়েছে। না, সেটাই যথেষ্ট নয়, এবার আমাকে হাতেনাতে করে দেখাতে হবে। ধর্ম হলো করে দেখানোর জিনিস—লোকদেখানো নয়, নিজেকে দেখানো। পরীক্ষক আমি নিজে। আমার ‘কাঁচা আমি’ ‘পাকা আমি’ হয়েছে কিনা, আমি ছাড়া কে জানতে পারছে! আমি মুখে ‘হরি’ বলছি—সে কোন্ ‘হরি’! ঠাকুর মজা করে বলছেন, সেই যে সেকরাদের গল্পে আছে—একজন বলছে ‘কেশব’, একজন বলছে ‘গোপাল’, একজন বলছে ‘হরি’, একজন বলছে ‘হর’। সে ‘গোপাল’-এর মানে গরুর পাল! সবই হেঁয়ালির ভাষায় প্রশ্ন। কে সব? প্রশ্নকারী ভিতরে। প্রদীপ জ্বেলে টুকটুক করে সোনার কাজ করছে। টের পেয়েছে, একদল খদ্দের ঢুকেছে। তারা কারা? বাইরে বসে আছে কর্মচারী। সে বলছে, গোপাল—গরুর পাল এসেছে। তাহলে ‘হরি’? সোনাদানা মারি? ভিতর থেকে অনুমতি এল, সে আর বলতে! ‘হর হর’। মেরে ফাঁক করে দাও। অনেকে হাই তোলার সময় আড়ামোড়া ভেঙে বলে, হা মা। ওটা মাকে ডাকা নয়। একটা আক্ষেপ, বিক্ষেপও বলা চলে। বাতাস টানার মুদ্রা। অনেকে দেখা হলেই বলেন, ‘জয় ঠাকুর’! অভ্যাস, মুদ্রাদোষ। ভিতরে খেলা করছে অন্য ভাব। হয়তো কারো সর্বনাশ করতেই যাচ্ছেন। কোর্টে যাচ্ছেন মামলা দায়ের করতে। মুখে বলছেন ‘জয় ঠাকুর’। যে মারতে যাচ্ছে সেও বলছে, ‘জয় ঠাকুর’। যে মরতে যাচ্ছে সেও বলছে, ‘জয় ঠাকুর’! এখন ঠাকুর কাকে সাহায্য করবেন!
ঈশ্বর মন দেখবেন। মুখের কথায় কিছু হবে না। ‘আমি’ না ‘তুমি’! আমি করছি? না, তুমি করাচ্ছ বলে আমি করছি। নীচ আমি, অহং আমি চলে গেলে নিজের কর্ম বলে আর কিছু থাকবে না। “তোমার কর্ম তুমি কর মা লোকে বলে করি আমি।” যিনি জেনেছেন, তিনিই জ্ঞানী। ঠাকুর একেবারে সাফ কথা বলছেন, ‘আমি, আমার’–এইটা অজ্ঞান। ‘তুমি, তোমার’–এইটা জ্ঞান। যে জ্ঞানী সে জানে, দৃঢ়ভাবে জানে—আমি নয় তুমি। সে জানে, ‘এক আধার থেকে গ্যাস আসছে, নানা জায়গায় নানা বাতি জ্বলে উঠছে।’ ঠাকুর বলছেন, সেই ঈশ্বরই হলেন এক অখণ্ড চেতনা, অনন্ত জ্ঞানসমুদ্র, দেশে দেশে, জনে জনে তাঁর প্রকাশ। ভাল-মন্দের বিচারের প্রশ্ন নেই। প্রয়োজনও নেই। তাঁর সৃষ্টিতে সবই থাকবে। সৎ, অসৎ, সাধু, তস্কর। মনে রাখতে হবে, মানুষ যেন বালিশের খোল। কোনটা সাদা, কোনটা কালো, কোনটা রাঙা, কিন্তু সব খোলের ভেতরেই সেই এক তুলো। কিন্তু এও মনে রাখতে হবে, জল মাত্রই নারায়ণ হলেও নর্দমার জল পান করা যায় না। পবিত্র জলই পানের যোগ্য। নিজের দিকে তাকাও। ঠাকুর বলছেন, ছিদ্র আবিষ্কার কর। অন্যের ছিদ্র নয়, নিজের ছিদ্র। একজন সারাদিন ধরে তার আখের খেতে জল সেঁচলে। সন্ধ্যাবেলা দেখলে, এত কাণ্ড করেও সামান্য একটুও জল দাঁড়ায়নি। ব্যাপারটা কি হলো! খোঁজপাতি করে দেখা গেল, গোটা তিন-চার বড় বড় গর্ত দিয়ে সব জল বেরিয়ে গেছে। খুব সাধন-ভজন করছি, আমার ধারণা; কিন্তু কই! কিছুই তো হচ্ছে না, জল দাঁড়াচ্ছে না কেন? ঠাকুর তো বলেছেন, লক্ষণ ফুটবে। নিশ্চিত লক্ষণ। যেমন বসন্ত হলে গুটি বেরোয়। ঠাকুর বলেছেন, এটা করলে ওটা হবে। ন্যাকড়ার পুতুল জলে পড়লে ভিজবে, নরম হয়ে যাবে। পাথরের পুতুলের কিছু হবে না। আর নুনের পুতুল হলে জলে গুলে যাবে। পাথরের পুতুল হলো বদ্ধজীবের উপমা। শত ধর্মকথাতেও মন ভেজে না। মুলো খেয়ে বসে আছে। সন্দেশ খেলেও সেই মুলোর ঢেঁকুর! রসুনের বাটি, যা রাখা যাচ্ছে তাইতেই বিষয়ের গন্ধ ধরে যাচ্ছে। ঈশ্বরও যেন পরাস্ত। হবে না তো হবেই না। ন্যাকড়ার পুতুল হলো মুমুক্ষু সংসারীর উপমা। সচ্চিদানন্দ-সলিলে পড়লে ভিজে থসথসে হয়, অবশ্য আকার বা বাঁধন হারায় না—সংসারীই থাকে, কিন্তু ভিজে থাকে। চুর হয়ে থাকে। আর নুনের পুতুল হলো মুক্ত জীবের উপমা। সে গলে যায়। তার আর পৃথক কোন সত্তা থাকে না। এবার মেলাতে বসি। নিজেকে মেলাই। জল কি দাঁড়িয়েছে! সত্তা কি ভিজেছে! গলে গেলে তো আর বিচার থাকবে না। হলো কি হলো না। আমি নেই, বিচারও নেই। আমি তোমাকে চাই—যতক্ষণ এই বোধ ততক্ষণ ‘আমি’ আছে, বিচার আছে, বিশ্বাস-অবিশ্বাস আছে। নিজের সামান্য জ্ঞান দিয়ে তাঁর অস্তিত্বকে স্বীকার-অস্বীকারের টানাপড়েন আছে। ভক্তি আর যুক্তির লাঠালাঠি আছে। অহং একটা বড় ছেঁদা কাম আর কাঞ্চনে আসক্তি আরো বড় ছেঁদা। ‘আমি’টা তবু সাধনের কাজে লাগে। ভক্ত আমি, দাস আমি, কিন্তু বাকি দুটো! সবচেয়ে বড় শত্রু। মুখে বলা সহজ, কাম-কাঞ্চন বিজয়ী। প্রকৃত হওয়া খুব শক্ত। আবার এটা নাহলে ওটা হবে না। এদিক থেকে মন না তুললে ওদিকে মন যাবে না। এক আনা দু-আনা নয়, তিনি ষোল আনা চান! নিজের কাছে কিছু রাখলে চলবে না। সবটা তাঁকে দিতে হবে। দিয়ে রিক্ত হতে হবে। ঠাকুর বলছেন, সবচেয়ে বড় সাধনা হলো রোদন। আকুল কান্না। ভীষণ একটা অভাববোধ। একটা শূন্যতা। মানুষ যাকে বলে সব, সেসব থেকেও আমার কিছু নেই।
সংসারী ও বিষয়ী মানুষের সঙ্গ ত্যাগ করতে হবে। দুধ আর জল পাশাপাশি থাকলে মিশে যাবেই। যতক্ষণ না মাখন হচ্ছি ততক্ষণ সংসারে থাকব অথচ ভেসে থাকব—সেটি হচ্ছে না। তাহলে নির্জনে, নিরালায় সরে যাও। ঠাকুর বলছেন, দই পাততে হবে। নাড়ানাড়ি হলে দই বসবে না। সংসারী লোক, বিষয়ী লোক, অবিশ্বাসী লোক মন নাড়িয়ে দেবে। ভাবের দম্বল বৃথাই হবে। দই বসবে না। দই না বসলে ঘোল হবে না। ঘোল মন্থন করলে তবেই মাখনের দলা ভেসে উঠবে। সাধন, কোথায় হবে? মনে, বনে, কোণে। ঠাকুর বলতে চাইছেন, অন্ধকারের ধর্মই খাঁটি ধর্ম, আলোকের ধর্ম প্রকৃত ধর্ম নয়। যদি কেউ নির্জন স্থানে সুন্দরী যুবতীকে দেখে ঈশ্বরভয়ে তাঁর প্রতি কুদৃষ্টি না করেন, তিনিই যথার্থ ধার্মিক। কিন্তু যে-ব্যক্তি প্রকাশ্যে ধর্মাড়ম্বর করে, তাকে ঠিক ধার্মিক বলা যায় না। ঠাকুর বলছেন, একটা নরুন দিয়ে আত্মহত্যা করা যায়। অন্যকে মারার জন্যে ঢাল, তরোয়ালের প্রয়োজন হয়। নিজেকে মারার জন্যে একটা নরুনই যথেষ্ট। অন্য লোককে ধর্মশিক্ষা দিতে অনেক শাস্ত্রীয় বচন ও যুক্তির প্রয়োজন, কিন্তু নিজের জন্যে একটি সত্য সাধন করলেই হতে পারে।
নির্জনে নিরালায়, সাবধানে, সন্তর্পণে এগিয়ে চল। চল বিষয়ের কাঁটাবন, শর ও হোগলার বন দুহাতে সরাতে সরাতে। আর চাই সাধুসঙ্গ। সাধুসঙ্গ হলো চালধোয়া জল। চালধোয়া জলে নেশা ছুটে যায়। সেইরকম সাধুসঙ্গে সংসারমদে মত্ত লোকের নেশা বিদূরিত হয়।