1 of 2

মীমাংসা – মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

মীমাংসা – মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

রাত নটার সময় গম্ভীর চিন্তিত মুখে পঙ্কজ বাড়ি ফেরে।

আজ আর কাগজের অপিসে বসে থাকতে ইচ্ছা হল না। এত আশা করে বেরিয়েছিল যে টাকার ব্যবস্থা বোধ হয় হয়ে যাবে, সম্ভব হবে সঙ্কট কাটিয়ে উঠে কাগজটা চালু রাখা।

ভূদেবের মুখ দেখেই সে অনুমান করেছিল, আশা তার পূর্ণ হবে না। টাকার জন্য ভূদেবের যে চেষ্টা সফল হবে মনে হচ্ছিল, সেটা নিশ্চয় ভেস্তে গেছে।

ভূদেব প্রথমে বলেছিল, এ পার্টি টাকা দিতে রাজি আছে। ভূদেবের মুখ আর বলার ভঙ্গি দেখে তবু পঙ্কজ আশা করতে ভরসা পায় নি।

ভূদেবের পরের কথায় জানা গেল যে, তার আশঙ্কাই সত্য। ঈশ্বরলাল টাকা দিতে রাজি আছে, কিন্তু কেবল তাদের শর্তে নয়, আরও একটা শর্ত সে চাপাতে চায়। কাগজের পলিসি সে খানিকটা নিয়ন্ত্রণ করবে।

এই শর্তে আর টাকা নেওয়া যায় কি করে! আজ তিন বছর যে নীতি অনুসরণ করে তারা দুই বন্ধু প্রাণপণ চেষ্টায় কাগজটা চালিয়ে এসেছে, সেই নীতিই যদি বদল করতে হয়, তার চেয়ে কাগজ বন্ধ করে দেওয়াই ভাল।

তার মুখ দেখে ছোট বোন কল্যাণী একটু ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করে, টাকার ব্যবস্থা হল না দাদা?

—নাঃ। দেশের স্বার্থের বদলে ওদের স্বার্থ দেখবার পলিসি নিলে টাকা দেবে।

জামা-কাপড় ছেড়ে চান করে পঙ্কজ সবে বাথরুম থেকে বেরিয়েছে, কল্যাণী বলে, বিভাদি একটা চিঠি দিয়ে গাড়ি পাঠিয়েছে দাদা।

পঙ্কজ খাম খুলে চিঠি পড়ে। দু’লাইন চিঠি, বিভার বড় বিপদ, পঙ্কজ যেন এখুনি একবার যায়।

—বিভাদি কি লিখেছে?

পঙ্কজ চিঠিখানা তার হাতে দেয়। চিঠি পড়ে কল্যাণী বলে, নিশ্চয় গুরুতর কিছু ঘটেছে। খোঁড়া মেয়েটার কথা ভাবলে এমন কষ্ট হয়!

পঙ্কজ বাইরে গিয়ে বিভার বাবা নগেনের ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করে, বিভার কি হয়েছে?

বিপিন বলে, কিছু তো হয় নি। আমায় চিঠি দিয়ে আপনার কাছে আসতে বললেন। আমি কাগজের অপিস হয়ে আসছি। দিদিমণি আপনাকে নিয়ে যেতে বলেছেন।

পঙ্কজ বলে, আজ আমি যেতে পারছি না। দিদিমণিকে গিয়ে বোলো, কাল সময় করে যাব।

কল্যাণী যেন স্তম্ভিত হয়ে যায়।

—একটা খোঁড়া মেয়ে এমন করে বিপদের কথা লিখে যেতে বলেছে, তুমি যাবে না দাদা?

—কাল গেলেও চলবে। জরুরি হলে কি বিপদ, সেটা খুলে লিখত।

—চিঠিতে লেখা যায় না, এমন বিপদ হতে পারে তো! মেয়েদের কত কি হয়।

পঙ্কজ বোনের মুখের ভাব দেখে একটু হেসে বলে, মেয়েরা আবার সামান্য কারণে উতলাও হয়।

খেয়ে উঠে পঙ্কজ সিগারেট টানে, আর তাদের কাগজটা বাঁচিয়ে রাখার উপায়ের কথা ভাবে। ভূদেবও টাকা দিয়েছে, খেটেছে কাগজটার পিছনে, কিন্তু তার মত প্রাণপাত করে নি। কাগজটা তুলে দেবার কথা ভাবলে জীবনটা যেন শূন্য হয়ে যাবে মনে হয়।

কত মানুষের কত টাকা অকেজো হয়ে পড়ে আছে, কিন্তু তার কাগজটা চালু রাখার জন্য কিছু টাকা লাগাতে সবাই নারাজ। বিভার বাবা নগেনেরও কত টাকা, খোঁড়া কুৎসিত একটা মেয়ে ছাড়া তার কেউ নেই, কিন্তু কাগজটার জন্য টাকা ধার চাইলে বা কাগজের অংশ কিনে নিতে বললে সে ঘাড নাড়বে।

ঘুম আসবে না, তবু শুয়ে পড়ার কথা ভাবছে। তাকে আশ্চর্য করে দিয়ে বিভা নিজেই এসে হাজির হয়। কষ্টে গাড়ি থেকে নেমে লাঠি ধরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ভেতরে আসে।

—আপনি তো গেলেন না, আমি নিজেই এলাম। বয়স হবে তেইশ-চব্বিশ, দুটি পায়ের পাতাই তার দুমড়ানো। মুখখানা লাবণ্যে কমনীয় মনে হতে পারত, কিন্তু অতিরিক্ত কালো রোমের জন্য সব লাবণ্য মাটি হয়ে গেছে।

পঙ্কজ বলে, এতই জরুরি ব্যাপার?

—বিপদে পড়েছি, জরুরি, নয়?

কল্যাণী জিজ্ঞাসা করে, কি হয়েছে, বিভাদি?

বিভা বলে, তুই পরে শুনিস ভাই। পঙ্কজদার সঙ্গে আমি একটু পরামর্শ করে নিই।

কল্যাণী ভিতরে চলে গেলে বিভা কোনরকম ভূমিকা না করেই সোজাসুজি তার বিপদের কথা পাড়ে। বলে, বাবা আবার আমার বিয়ের ব্যবস্থা করছে। বাবার আপিসেই কাজ করে, আপনি বোধ হয় চেনেন— নাম হল রমেশ সরকার।

পঙ্কজ বলে, চিনি। ছেলেটির স্বভাব ভাল।

—ছাই ভাল! টাকার লোভে বড়লোকের খোঁড়া কুৎসিত মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে, সে আবার ভাল! এদের চেয়ে হীন অমানুষ আর হয়?

রাগ সামলে বিভা কাঁদ-কাঁদ হয়ে বলে, আপনি আমায় বাঁচান পঙ্কজদা। কালকেই বোধ হয় আশীর্বাদ করতে আসবে।

—নগেনবাবুকে জোর করে বল না তোমার অনিচ্ছার কথা?

বিভা একটু হতাশার হাসি হাসে।

—বলতে বাকি রেখেছি নাকি? রেগে কেঁদে কতরকমভাবে কতবার বলেছি। বাবা আমার সব কথা শোনে, বিয়ের ব্যাপারে শুনবে না। আপনিই তো বললেন ছেলেটার স্বভাব ভাল, স্বাস্থ্য ভাল, দেখতে-শুনতে ভাল—এ সুযোগ বাবা কিছুতেই ছাড়বে না।

একটু থেমে বিভা মুখ বাঁকিয়ে বলে, বাবার কি হয়েছে আমি জানি। বাবার মনে ভয়ানক আতঙ্ক—বয়স হয়েছে, আমি পাছে কিছু করে বসি। বিয়ে হলে আমার সাধআহ্লাদও মিটবে, আবার কিছু যদি করেও বসি আসবে-যাবে না।

বিভা তীব্র জ্বালাভরা হাসি হাসে।

—ভাল ভাল ছেলে কিনে আনবে, তবু আমি বিয়ে করতে চাই না, এতে আরও বেশি ভয় হয়েছে বাবার। নিশ্চয় কিছু গোলমাল আছে ভেতরে। আমায় যে বিয়ে করবে, সে টাকার জন্যই করবে, এরকম লোকের কথা ভাবলেও যে আমার ঘেন্না হয়, গা ঘিনঘিন করে, বাবা এটা বুঝবে না।

পঙ্কজ বলে, কি করে বুঝবেন? উনি তো জানেন টাকার জন্যই মানুষ সব করে। তুমিও বুঝতে না, কেনা বর পেয়ে খুশিই হতে, কলেজে পড়ে পাঁচজনের সঙ্গে মিলেমিশে তোমার মাথাটা বিগড়ে গেছে।

—শুধু সেজন্য নয়। আপনার কাছে পড়ার জন্যেও। আপনার কাছেই শিখেছি, খোঁড়া হলে কুৎসিত হলেই কারো জীবন ব্যর্থ হয় না, জীবনটা সার্থক করার, সুখী হবার অনেক উপায় আছে।

পঙ্কজ খানিকক্ষণ তার মুখের দিকে চেয়ে থেকে বলে, শিখেছো অনেক কিছু শুধু মনের জোরটা শিখতে পার নি। পারলে এরকম পাগলের মত ছুটে আসতে হত না।

বিভা নীরবে চেয়ে থাকে।

পঙ্কজ বলে, এই বয়সে তোমার মত মেয়ের বিয়ে জোর করে কোন বাবা দিতে পারে? এদিকে বিয়েটাকে বলছ ভয়ানক বিপদ, বিয়ে হলে তোমার সর্বনাশ হয়ে যাবে—অথচ সেটা ঠেকাবার জন্য একটু কাঁদা-কাটার বেশি কিছু করতে পার না। বিপদ কঠিন হলে কঠিন ব্যবস্থা করতে হবে না?

বিভা চেয়েই থাকে।

পঙ্কজ সিগারেট ধরায়। বিভা লক্ষ করছিল আজ সে ঘন ঘন সিগারেট ধরাচ্ছে।

—বাবাকে জানিয়ে দাও, বুঝিয়ে দাও যে, বিয়ে তুমি কিছুতেই করবে না, মরে গেলেও নয়। সেজন্য যা করা দরকার করতে প্রস্তুত হও।

—কি করব?

পঙ্কজ এবার হাসে।

—এখনও জিজ্ঞেস করছ কি করবে? কত কি করার আছে। কিছুদিনের জন্য বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে, আত্মীয় বা বন্ধুর বাড়ি কিংবা হোটেলে গিয়ে থাকবে। নগেনবাবু যতক্ষণ না কথা দেবেন যে, তোমার বিয়ের চেষ্টা করবেন না, বাড়ি ফিরতে রাজি হবে না।

—ও !

—তুমি সত্যি বিয়ে করবে না, এটা টের পেলে কি আর নগনেবাবু চেষ্টা করবেন? কিন্তু তোমাকেই শক্ত হয়ে সেটা বুঝিয়ে দিতে হবে তো ওঁকে।

বিভা বলে, বুঝেছি। ভাগ্যে আপনার কাছে এসেছিলাম।

ভিতরে গিয়ে বিভা মেয়েদের সঙ্গে কথা বলে। পঙ্কজের মার প্রশ্নের জবাবে জানায় সে খেয়ে এসেছে।

কল্যাণীর কাছে পঙ্কজের কাগজের সমস্যার কথা শুনে আপসোস করে বলে, ইস্‌, বাবা যদি একটু কম কৃপণ হত! কাগজটাগজের ব্যাপার বোঝে না কিনা, এদিকে টাকা লাগাতে তাই ভয় পায়।

একটু আনমনা মনে হয় বিভাকে। মেয়েদের খাওয়া হয়ে যাবার পরেও সে উঠবার নাম করে না।

খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বাথরুম থেকে ঘুরে এসে কল্যাণীকে বলে, তুই কোন্ বিছানায় ঘুমাস ভাই।

কল্যাণী তার বিছানা দেখিয়ে দিলে, সে একেবারে শুয়ে পড়ে।

বলে, আমি আজ তোর কাছে ঘুমোব। ড্রাইভারকে বলে আয় তো গাড়ি নিয়ে চলে যাক। বলিস কালকেও গাড়ি নিয়ে আসবার দরকার নেই।

কল্যাণী খুশি হয়ে বলে, তুমি থাকবে আমাদের বাড়ি। কি ভাগ্যি!

ঘণ্টাখানেক পরে অবশ্য গাড়ি আবার ফিরে আসে, নগেনকে নিয়ে।

অন্য ঘরের আলো নিবে গিয়েছিল, আলো জ্বলছিল শুধু পঙ্কজের ঘরে।

সে বাইরে গিয়ে দরজা খুলে নগেনকে ভিতরে আনতে আনতে অন্য ঘরের আলোও জ্বলে ওঠে। নগেন রেগেছে টের পাওয়া যায়।

পঙ্কজকে সে বলে, কি বুদ্ধি মেয়েটার! কাল সকালে আশীর্বাদ করতে আসবে, আজ রাত্রে ও এখানে থেকে গেল। আবার বলে দিয়েছে, কালকেও গাড়ি আনবার দরকার নেই।

পঙ্কজ বলে, বিভা কল্যাণীর সঙ্গে শুয়েছে। আপনি ও-ঘরেই চলুন।

কল্যাণী আর বিভা দু’জনেই উঠে বসেছিল।

নগেন ভূমিকা না করেই বলে, কাল সকালে আশীর্বাদ হবে, তুই এখানে থেকে গেলি কি রকম?

বিভা বলে, কাল আশীর্বাদ বলেই থেকে গেলাম।

নগেন প্রাণপণে নিজেকে সংযত রেখে বলে, পাগলামি কোরো না। আমার সঙ্গে ফিরে চলো। তোমার মা ওদিকে উতলা হয়ে আছেন।

বিভা বলে, আমি যাব না। তুমি বুঝতে পারছ না। আমি ছেলেমানুষ নই, ছেলেমানুষি করেও তোমায় বারণ করি নি। বলছি আমার বিয়েটিয়ে হতে পারে না, আমি মরে গেলেও হতে দেব না, তুমি কিছুতে শুনবে না আমার কথা। অগত্যা কি করি, বাড়িই ছাড়তে হল আমাকে।

নগেন বাক্যহারা হয়ে থাকে।

বিভা বলে, তুমি যদি রাগ করে আমায় ত্যাগ কর, করবে। আমি নিজের ব্যবস্থা করে নেব। আমি গায়ে বিষ্ঠা মাখতে পারব, কিন্তু তোমার কেনা মানুষকে বিয়ে করতে পারব না।

নগেন রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলে, তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে।

বিভা বলে, হলে কি করব? আমার মাথা নিয়েই চলতে হবে তো আমাকে।

রাগারাগি করে নরম হয়ে বুঝিয়ে অনেকক্ষণ মেয়ের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করে নগেনকে অগত্যা ফিরেই যেতে হয়।

বিভার ঘুম আসে না। কল্যাণীরও নয়।

বিভা বলে, আমার নয় মাথা গরম হয়েছে, বুক ধড়ফড় করছে, ঘুম আসছে না, তোর কি হল?

কল্যাণী বলে, মাঝরাতে দাদা ছাতে পায়চারি করছে। কি না করেছে দাদা কাগজটার জন্য। এমন একটা খাঁটি কাগজ, টাকার অভাবে তুলে দিতে হবে।

বিভা বলে, সত্যি। ভাবলেও কষ্ট হয়।

সকালে চা খাবার সময় পঙ্কজের মুখে রাত জাগার ছাপটা স্পষ্টই দেখা যায়, কিন্তু দুশ্চিন্তার ছাপটা যেন কম মনে হয়।

চা খাওয়া হলে পঙ্কজ বলে, কল্যাণী, তুই একটু ও-ঘরে যা তো, বিভার সঙ্গে আমার একটু দরকারি কথা আছে।

কল্যাণী চলে গেলে পঙ্কজ বলে, আমিও এক বিপদে পড়েছি জান তো? কাগজটা নিয়ে? বিভা বলে, শুনলাম। ঠিক এই সময়টা বাবার সঙ্গে ঝগড়া হয়ে গেল, নইলে অন্তত চেষ্টা করে দেখতাম।

পঙ্কজ শান্তভাবে বলে, তুমি আমার কাগজটাকে বাঁচাতে পারো।

বিভা আশ্চর্য হয়ে চেয়ে থাকে।

পঙ্কজ বলে, টাকার জন্য তোমায় যদি বিয়ে করতে দাও।

বিভার মুখ হাঁ হয়ে যায়। সে কথা বলতে পারে না।

পঙ্কজ বলে, তোমার জন্য ঠিক প্রেম হয়তো আমার নেই, কোনদিন কোন মেয়ের জন্য থাকবে বলেও মনে হয় না। তোমাকে আমি স্নেহ করি। এই মমতা তুমি পাবে।

বিভা কাতরভাবে বলে, আপনি আমায় বিয়ে করবেন?

—দোষ কি? তোমার বাবাও খুশি হবেন।

—কিন্তু আপনার যে খোঁড়া-কুচ্ছিত বউ হবে!

পঙ্কজ বলে, তা হোক না। কাগজটা বাঁচাতে পারলে খোঁড়া বউয়ে আমার আপত্তি নেই।

বিভা মাথা নত করে থাকে।

পঙ্কজ ধীরে ধীরে বলে, তবে একটা খুব গুরুতর কথা আছে। আমার ওপরে তোমার ঘেন্না জন্মাবে কি না।

বিভা মাথা তুলে বলে, না। টাকার লোভে তো নয়, কাগজটার জন্য, আদর্শের জন্য। আমার বরং—

কথাটা তার গলায় আটকে যায়।

—তোমার বরং?

—আমার বরং ভক্তিই বেড়ে যাবে।

বিভা একটু হাসে।

১৩৫৯(১৯৫২)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *