মিট্টাগড়ের রহস্যময়ী
ঘটনাটা আমাদের শুনিয়েছিলেন পূর্ণিয়ার ভাট্টাবাজারে একটা হোটেলের কামরায় বসে বনবিহারীলাল পাণ্ডেজি। আমি আর আমার বন্ধু দেবরাজ তখন পুরোনো, দুষ্প্রাপ্য বইয়ের সন্ধানে বিভিন্ন মফসসল শহরে ঘুরে বেড়াতুম। জমিদার-তন্ত্রের তখন শেষ দশা। অনেক অভিজাত, বনেদি জমিদারবাড়ি ভেঙে পড়েছে। তা পড়ুক, তা নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা ছিল না।
কিন্তু ওইসব বাড়ির লাইব্রেরিতে অনেক দামি-দামি দুর্লভ বই অবহেলায় পড়ে নষ্ট হচ্ছিল। সেইসব বইয়ের পড়ুয়া তো কেউ ছিলই না, শরিকদের মধ্যে মামলা-মোকদ্দমার কারণে বইগুলি। বিক্রি করার অধিকারও কারুর ছিল না। বইগুলি নষ্ট হতে দেওয়ারও কোনও মানে হয় না। আমরা ছলে-বলে-কৌশলে যে-কোনও ভাবেই হোক সেইসব বই সংগ্রহ করে আনতুম।
পূর্ণিয়া গিয়েছিলুম সেই উদ্দেশ্যেই।
এই কাজে বেশ ধৈর্য লাগে। নতুন জায়গায় গিয়ে প্রথম দু-তিনদিন চুপচাপ বসে থেকে পরিবেশটা বুঝে নিতে হয়। স্থানীয় লোকজনদের কাছ থেকে জমিদার বাড়ির বর্তমান উত্তরাধিকারীদের সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে হয় যতদূর সম্ভব। এই ব্যাপারে কয়েক জায়গায়। আমাদের বেশ মজার অভিজ্ঞতাও হয়েছে। জমিদারদের অনেককেই রাজা বলা হত। এমনও হয়েছে, আমরা কোনও জমিদারি এস্টেটে গিয়ে দেখছি যে, বর্তমান বংশধররা এমনই গরিব হয়ে গেছে যে রাজামশাই সাইকেলে চেপে সদর কোর্টে মামলা লড়তে যান।
পূর্ণিয়াতে এসে আমরা একটা হোটেলে উঠেছিলুম। এই অঞ্চলে একটি জমিদারবাড়িতে যে অনেকগুলি ভালো-ভালো বই আছে সে ব্যাপারে পাকা খবর আমরা নিতে এসেছি। বর্তমান জমিদার-বংশের অনেক শাখাপ্রশাখা। ঠিক কোন পথ ধরে আমরা অন্দরমহলে ঢুকব সেই ব্যাপারে জল্পনা-কল্পনা করছিলুম।
আমাদের হোটেলের পাশের ঘরেই ছিলেন বনবিহারীলাল।
পূর্ণিয়া শহরে আমাদের কেউে চেনে না। সারাদিন এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি করলেও সন্ধের পর আর কিছু করার নেই। দেবরাজ হোটেলের ম্যানেজারের সঙ্গে গল্প করছিল। এদিকের অনেকেই খানিকটা বাংলা বোঝে। অথবা আমাদের ভাঙা-ভাঙা হিন্দিতে কাজ চলে যায়। দেবরাজ নতুন। লোকের সঙ্গে আলাপ জমাতে পারে চট করে, আমি আবার ওটা পারি না। আমি একটা পুরোনো খবরের কাগজ পড়ছিলুম।
এই সময় হঠাৎ একজন পেছন থেকে দেবরাজের কাঁধে চাপড় মেরে বলল, আরে মজুমদার দাদা, আপনি এখানে?
এইসব অভিযানে বেরিয়ে আমরা চেনাশুনো লোকদের এড়িয়ে চলি। আমাদের পরিকল্পনাটা আগে থেকে জানাজানি হয়ে গেলে কাজের অসুবিধে হয়। কিন্তু চেনা কেউ হঠাৎ মুখোমুখি পড়ে গেলে তো কথা বলতেই হয়।
লোকটির নাম শহীদুল হক। এর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল মুর্শিদাবাদে। বেশ আমুদে ধরনের মানুষ। এদের পুরুষানুক্রমে কাঠের কারবার। বেশ সঙ্গতিসম্পন্ন পরিবার, বাড়িতে ডেকে নিয়ে আমাদের খুব একচোট খাইয়েও ছিল একদিন। শহীদুল হকের বয়েস বেশি নয়, তিরিশের নীচেই হবে, বেশ সুশ্রী চেহারা, মাজা-মাজা গায়ের রং, ছিপছিপে লম্বা।
শহীদুল হক আমার দিকে ফিরে বলল, গাঙ্গুলি সাহেব, আপনিও রয়েছেন? এদিকে কী করতে এসেছেন?
আমি অল্প হেসে বললুম, এমনিই বেড়াতে।
দেবরাজ কৃত্রিম উৎসাহ দেখিয়ে বলল, হক সাহেবের এদিকেও কাঠের কারবার আছে নাকি? তাহলে আমাদের একটা জঙ্গল দেখাবার ব্যবস্থা করুন!
আমরা আগেই ঠিক করে নিয়েছিলুম যে, এখানে কেউ আমাদের আগমনের উদ্দেশ্যের কথা জিগ্যেস করলে আমরা জঙ্গল-ভ্রমণের কথা বলব। দুর্লভ বই সংগ্রহের ব্যাপারটা অনেকেই। বুঝতে পারে না। কেউ-কেউ সন্দেহ করে, আমরা বুঝি বই চুরি করতে এসেছি। আসলে অবহেলিত বা অমনোযোগে ফেলে রাখা রত্ন উদ্ধার করাই যে আমাদের ব্রত সেকথা অন্যদের সহজে বোঝানো যায় না!
বিভূতিভূষণের আরণ্যক উপন্যাসের পটভূমি তো এই পূর্ণিয়াতেই। সুতরাং লবটুলিয়া বৈহারের জঙ্গল সম্পর্কে একটা রোমান্টিক আকর্ষণও ছিল আমাদের। এখানে এসে তাই জঙ্গল দেখবার সাধ প্রকাশকরা অতি স্বাভাবিক। পরে অবশ্য জানতে পেরেছিলুম, আরণ্যকের সেই গহন। জঙ্গলের অস্তিত্ব আর নেই এদিকে। হয়তো বিভূতিভূষণ পুরো জঙ্গলটাই কল্পনা করেছিলেন।
শহীদুল হক হা-হা করে হেসে বললে, আরে দাদা, জঙ্গল তো দেখবেনই। এদিকে আর কী-কী দেখবেন বলুন? এই খরার দেশে আপনারা বেড়াতে এসেছেন? এই হোটেলেই উঠেছেন নাকি?
দেবরাজ বলল, হ্যাঁ। এই হোটেলের খাওয়াদাওয়া বেশ ভালো। ম্যানেজারবাবু আমাদের খুব যত্ন করছেন।
শহীদুল হক বলল, আমি তো প্রত্যেক মাসে একবার এখানে আসি। চলুন, আমার ঘরে বসবেন চলুন!
দেবরাজ আমার দিকে চোখাচোখি করল। আমি বললুম, আমাদের যে একবার ভাদুড়িজিদের বাড়িতে যাওয়ার কথা আছে!
শহীদুল হক বলল, যাবেন-যাবেন, সে পরে যাবেন। আপনাদের দেখা পেয়েছি, একটু আড্ডা মারা যাক। পাণ্ডেজির সঙ্গে আপনাদের আলাপ হয়েছে?
—না তো! কে পাণ্ডেজি?
—এই হোটেলে আছেন আর পাণ্ডেজিকে চেনেন না? পাণ্ডেজি যখন এই হোটেলে ওঠেন, তখন অন্য সব বোর্ডাররা কমপ্লেন করে যে-কোনও বেয়ারাকে ডাকলে পাওয়া যায় না। সব। বেয়ারাগুলো হরদম পাণ্ডেজির ফাই-ফরমাস খাটতে ছোটে। কী ম্যানেজার সাহেব, ঠিক বলিনি?
হোটেলের ম্যানেজার বলল, এ-মাস থেকে দুজন এক্সট্রা ছোকরাকে কাজে লাগিয়েছি। এখন আর অন্য বোর্ডারদের অসুবিধে হবে না।
পাণ্ডেজির পরিচয় পেলেও তাঁর সঙ্গে আলাপ করার কোনও উৎসাহ হল না। কোনও-কোনও হোটেলে এরকম দু-একজন লোককে দেখা যায়। যারা প্রচুর টাকা ছড়িয়ে নিজেদের আরাম ও প্রয়োজনের ব্যাপারটাই বড় করে দেখে। দোতলার কোণের ঘরটায় গতকাল অনেক রাত পর্যন্ত হইহল্লা আর ফুর্তির আওয়াজ শুনেছি। সেটাই সম্ভবত পাণ্ডেজির ঘর।
শহীদুল হক বলল, চলুন, আলাপ করলে ভালো লাগবে, খুব মজাদার লোক। এদিকে যে কুঁয়ারীপুর এস্টেট আছে, পাণ্ডেজি সেই জমিদারের ভাগ্নে। শহরে ওদের অনেক বড় বাড়ি আছে। কিন্তু পাণ্ডেজি শহরে এলে এই হোটেলেই উঠবে। ম্যানেজারবাবু এখানে এমন চুম্বক রেখে দিয়েছেন— শিকারি বেড়ালের মতন আমার আর দেবরাজের গোঁফ খাড়া হয়ে উঠল। আমরা আবার চোখাচোখি করলুম।
দেবরাজ জিগ্যেস করল, কোন এস্টেট?
শহীদুল হক বলল, কুয়ারীপুর। নাম শুনেছেন?
যাতে বেশি উৎসাহ না প্রকাশ পায়, সেইজন্য দেবরাজ সিগারেট ধরাবার জন্য মুখ নীচু করে নিল। হ্যাঁ, নাম শুনেছি। বেশ বড় রাজবাড়ি।
আমরা ওই কুঁয়ারীপুর (আসল নামটা বদলে দিতে হল) রাজবাড়ির লাইব্রেরিতে হানা দেওয়ার উদ্দেশ্য নিয়েই এসেছি। সুতরাং পাণ্ডেজির এই পরিচয়টা শুনে আমরা আর দ্বিরুক্তি করলুম না।
দেবাজ বলল, চলুন তাহলে আলাপ করেই আসি।
দোতলার কোণের ঘরে এসে ঢুকলুম আমরা। খাটের ওপর শুয়েছিল একজন পাজামা আর একটা আধময়লা পাঞ্জাবি পরা। লোকটিকে দেখে প্রথমেই আমি নিরাশ হয়ে পড়লুম। কোনও রাজবাড়ির ভাগনে বলে মনেই হয় না। অতি সাধারণ চেহারা, মুখে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি। ঘরটাও বেশ অপরিষ্কার, এখানে-সেখানে জামাকাপড় ছড়ানো। টেবিলের ওপর দুটো প্লেটে মাংসের হাড়, ছেঁড়া রুটি আর একটা মদের গেলাস।
শহীদুল হককে দেখে লোকটি বলল, আরে হক, তুম ইতনা লেট কিয়া, তুমহার জন্যে আমি বসে বসে থকে গেলাম!
শহীদুল হক বলল, পাণ্ডেজি, আমার দুজন দাদাকে নিয়ে এসেছি আপনার সঙ্গে আলাপ করবার জন্য। এনারা এদিকে নতুন এসেছেন—
পাণ্ডেজি উঠে বসে যেন আন্তরিক ভাবেই বলল, বৈঠিয়ে-বৈঠিয়ে। আপনাদের তো দেখেই মালুম হচ্ছে কি পড়ে-লিখে আদমি। আমি তো ইংলিশ-মিংলিশ কুছ জানি না। আপনাদের সঙ্গে হামি কি আলাপ করব!
দেবরাজ হেসে বলল, আমরা কি মশাই ইংরেজিতে কথা বলার জন্য পূর্ণিয়া এসেছি? তা ছাড়া, আমরাও ভালো ইংরেজি জানি না। ইংরেজির চেয়ে হিন্দি বেশি জানি।
পাণ্ডেজি বলল, আমি বাংলা জানি। তবে দেখেছি কি, বাঙালি লোক বাংলা বাতচিত করবার সময়েও বহুত ইংলিশ বলে। হে-হে-হে!।
দোজ বললে, তা ঠিক বলেছেন। যারা ইংরিজি ভালো জানে না, তারাই বেশি ইংরিজি শব্দ ব্যবহার করে।
পাণ্ডেজি বলল, আরে হক, দো-তিনটে নোকরকো বোলাও। ঘর সাফ করুক। কুছু খানা আনুক। সোডা আর গিলাস মাঙাও। আউর এক কিলো চানাচুর। বাঙালি বাবুরা চানাচুর ভালোবাসে!
তারপর আমাদের দিকে ফিরে জিগ্যেস করল, আপনারা কী খাবেন? বেরাণ্ডি, রম, হুইস্কি! যা পোসোন্দ হয় বলুন, সব মিলবে এখানে।
সেই আধময়লা পাঞ্জাবির পকেট থেকে পাণ্ডেজি একতাড়া একশো টাকার নোট বার করল।
একটুক্ষণের মধ্যেই বেশ ভাব জমে গেল পাণ্ডেজির সঙ্গে। শহীদুল হকের সঙ্গে মেজাজের মিল আছে, এই লোকটিও খুব দিলদরিয়া। লোকজনদের খাওয়াতে ভালোবাসে। কথায়-কথায় জানতে পারলুম যে পাণ্ডেজিরও কাঠের কারবার। পাণ্ডেজি জঙ্গল কাটার ইজারা নেয় আর শহীদুল হক আসে ওয়াগন বোঝাই করে মাল ডেলিভারি নিতে। এইসব লোকদের কাছে প্রচুর কাঁচা পয়সা থাকে। আমাদের ভাগ্য ভালো, প্রায় জায়গাতেই এইরকম দু-একজন পৃষ্ঠপোষক জুটে যায়।
যারা সবসময় কাজকর্মে আর টাকাপয়সা রোজগারের ধান্দায় মত্ত থাকে তারা যদি দ্যাখে কোনও লেখাপড়া জানা শক্তসমর্থ চেহারার মানুষ বিনা উদ্দেশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে, জঙ্গল বা পাহাড় দেখার জন্য সময় কাটাচ্ছে, তখন তারা খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। একেবারে বিপরীত চরিত্রের মানুষদের তারা বেশ খাতির করে।
পাণ্ডেজি আমাদের জন্য প্রচুর খাবার আনল এবং দু-তিনটে মদের বোতল। আমাদের কোনও আপত্তিই সে শুনবে না, জোর করে খাওয়াবেই। খানিক বাদেই বোঝা গেল যে, পাণ্ডেজিদের। নিজেদের বাড়িতে এখনও মাছ-মাংস ঢোকে না, মদও নিষিদ্ধ। তাই শহরে কাজের জন্য এলে সে হোটেলেই ওঠে।
তিন-চার গেলাস মদ ওড়াবার পর আমাদের সকলের মধ্যে বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেল। আপনি থেকে তুমি-তে নেমে এলুম।
দেবরাজ তখনও আসল উদ্দেশ্য ভোলে না। কথাবার্তা অন্যদিকে চলে গেলেও সে আবার কৌশলে নিজের দিকে টেনে আনে। পাণ্ডেজিকে যখন পাওয়া গেছে তখন এর সূত্র ধরেই আমাদের কুঁয়ারীপুর রাজবাড়িতে ঢুকতে হবে।
একসময় দেবরাজ বলল, পাণ্ডেজি, তোমার মামাবাড়িতে তো একটা খুব প্রাচীন বিষ্ণুমন্দির আছে, না? একদিন আমাদের সেই মন্দিরটা দেখার ব্যবস্থা করে দাও না।
পাণ্ডেজি বলল যে, সে মন্দির কী দেখবে? এখন তো কিছুই নেই। সব ভেঙেচুড়ে গেছে, মন্দিরের মধ্যে জঙ্গল হয়ে গেছে–।
দেবরাজ আমার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, আমার এই বন্ধুটি ওইসব পুরোনো মন্দির দেখতে ভালোবাসে। খবরের কাগজে ও এইসব মন্দির নিয়ে প্রবন্ধ লেখে।
পাণ্ডেজি বলল, তুমাদের যো দিন মর্জি চলে যাও, আমার গাড়ি দিয়ে দেব। পুরা দিনভর ঘুরে এসো।
তারপর আমার দিকে ফিরে জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে বলল, তুমি দাদা আখবরে লেখ? তব উয়ো পুরানা মন্দিরকা বাৎ ছোড়ো! যেখানে আমাদের জঙ্গল সাফ হচ্ছে, সেখানে একঠো-দোঠো। মন্দির আছে, সেই মন্দির দেখবে চলো। আপনা আঁখসে দেখ কর তুমি সব কথা লেখো। সারা দুনিয়া তাজ্জব বনে যাবে।
শহীদুল হক বলল, সত্যি দাদা, নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস হবে না তোমাদের। ভাবলেও আমার গায়ে কাঁটা দেয়!
পাণ্ডেজি বলল, কখনও শুনেছ কি, মন্দিরের মধ্যে পাথরের মূরত ইংলিশে কথা বলে? একটা চৌদা বরষের লেড়কি, যে পড়া-লিখা কুচ্ছু জানে না, সে-ও ওই মন্দিরের কাছে গেলে ইংলিশে ঠাকুরের সঙ্গে বাতচিত করে।
দেবরাজ হাহা করে হেসে উঠল।
পাণ্ডেজি বলল, হাঁসছ? বিশওয়াস হচ্ছে না? আমি আপনা আঁখসে দেখেছি!
শহীদুল হক বলল, আমিও নিজের কানে শুনেছি।
দেবরাজ বলল, ধুৎ, ওসব ভূতের গল্প বাদ দাও! কুঁয়ারীপুর রাজবাড়িতে কবে যাব—বলো বলো!
দেবরাজের ভূতের গল্প সম্পর্কে আগ্রহ না থাকলেও আমি উৎসাহ দেখিয়ে বললুম, না-না, শুনি গল্পটা! বলো তো পাণ্ডেজি!
পাণ্ডেজি উত্তেজিতভাবে বলল, গোল্পে? হামি গোপো বানাতে পারি না। পড়া-লিখা শিখিনি…হামার জঙ্গলের ডেরাতে নিজের আঁখসে দেখেছি।
পাণ্ডেজি এরপর যে কাহিনি বিবৃত করল তা হল এই:
এখানে থেকে পঁচিশ মাইল দূরে মিউিগড় নামে একটা জায়গা আছে। সেখানে একসময় বোধহয় কোনও দুর্গ ছিল, এখন তার অস্তিত্ব নেই। জলাজংলা অঞ্চল। যে জঙ্গল আছে তাও খুব গভীর। নয়। পাণ্ডেজি সেই জঙ্গল সাফ করার ইজারা নিয়েছে।
গাছ কাটার সময় ইজারাদার তাঁবু ফেলে। আশেপাশে কোনও জনবসতি নেই। মজুররা আর। কন্ট্রাকটর-বাবুরা তাঁবুতেই থাকে। প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে ওই মিউিগড়ে গাছ কাটার কাজ চলছে।
ওই জঙ্গলের মধ্যে একটা ছোট্টখাট্টো মন্দির আছে। মন্দিরটা অতি সাধারণ, ভেতরে একটা পাথরের মূর্তি আছে, কিন্তু কীসের মূর্তি তা চেনা যায় না। কুলিকামিনরা বলে বগলা মন্দির। জনশ্রুতি এই যে, একসময় এক ভিনদেশি তান্ত্রিক এসে ওই মন্দির বানিয়েছিল, তারপর সেই তান্ত্রিক মারা যাওয়ার পর আর কেউ ওখানে পুজো করে না। মন্দিরটার দেওয়ালে গাছপালা জন্মে গেছে। একটা অশ্বত্থ গাছে এর মধ্যেই শিকড় চালিয়ে মন্দিরটা খানিকটা ফাটিয়ে ফেলেছে।
কুলিকামিনদের ধারণা, জঙ্গলের মধ্যে কোনও মন্দির থাকলে সেখানে পুজো না দিয়ে গাছ কাটতে নেই। তাহলে দেওতা রাগ করেন। পাণ্ডেজি পূজোর জন্য কিছু টাকা বরাদ্দ করে দিয়েছে।
গাছ কাটা শুরু হওয়ার দিনসাতেক বাদে এক সন্ধ্যেবেলা পাণ্ডেজি নিজের তাঁবুতে বসে দুজন সঙ্গীকে নিয়ে টাকাপয়সার হিসেব করতে করতে সুরা সেবন করছিল, এমনসময় একদল। কুলিকামিন হইহই করে ছুটে এল সেখানে, তারা একটা অত্যাশ্চর্য কথা জানাল। তারা কাজ শেষ করে বগলা মন্দিরে পুজো দিতে গিয়েছিল, এমনসময় মন্দিরের দেওতা হঠাৎ ইংরেজিতে কথা বলে উঠেছে।
ইংরিজি ভাষার ওপর পাণ্ডেজির খুব রাগ। নিজে ইংরিজি জানে না বলেই অন্য কেউ তার সঙ্গে ইংরিজিতে কথা বললে সে বিরক্ত হয়। ফরেস্টারবাবু, রেলের বাবু, সরকারি লোকজন হিন্দি জানা সত্বেও যখন পাণ্ডেজির সঙ্গে ইংরিজি মিশিয়ে কথা বলতে যায়, তখন পাণ্ডেজি তাদের
পাঁচকথা শুনিয়ে দেয়। তোমরা মায়ের দুধ খাওনি? মা তোমাদের হিন্দি বোলি শিখায়নি? যারা পাণ্ডেজির সঙ্গে এইরকম ইংরিজি বলে, তাদের সে ঘুষ দেয় না কক্ষনো।
কুলিকামিনদের কথা শুনে পাণ্ডেজি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছিল। এই জঙ্গলের মধ্যে পাথরের মূর্তির মুখে ইংরিজি? রোজ যে পুজোর জন্য বিশ টাকা করে সে দিচ্ছে, তা ঘুষ ছাড়া আর কী!
হুংকার দিয়ে সে তাঁবু থেকে বেরিয়ে এসে বলেছিল, আমার সঙ্গে বুজরুকি? চল, আমি এখনি যাচ্ছি।
কুলিরা কেউ ভয়ে যেতে চায় না। সন্ধে হয়ে গেছে। মন্দিরের দেবী জাগ্রত, তারা বিপদের আশঙ্কা করছে।
পাণ্ডেজি তখন বলেছিল, যদি কেউ এখনই তার সঙ্গে গিয়ে পাথরের মূরতের মুখ দিয়ে শুধু একটা ইংরেজি বোলি শুনাতে পারে, তাকে সে একশো টাকা দেবে।
যে সময়কার কথা হচ্ছে, তখন একশো টাকা মানে যথেষ্ট টাকা। একজন কুলির সারা মাসেও এত রোজগার হয় না। তখন ভয় কাটিয়ে অনেকেই পাণ্ডেজির সঙ্গে যেতে রাজি হল।
পাণ্ডেজির এমনিতেই ঠাকুর-দেবতার ওপর খুব একটা ভয়-ভক্তি নেই। তার ওপর সেদিন চোখে খানিকটা নেশা ছিল। তাই সে বগলা মন্দিরের সামনে গিয়ে হইহল্লা শুরু করে দিল। হিন্দুর ঠাকুর ইংলিশে কথা বলে! তাহলে আর কলিকালের বাকি রইল কী? কোথায়—ঠাকুরের সাহস থাকে বলুক তো পাণ্ডের সামনে ইংলিশ?
বলাই বাহুল্য, পাথরের ঠাকুর চুপ করে রইল। ইংরেজি দূরের কথা, হিন্দি-বাংলা-সংস্কৃত কোনও ভাষাতেই পাথরের ঠাকুর কথা বলল না। কুলিরা তবু কয়েকজন বলতে লাগল যে, খানিক আগে তারা নিজেদের কানে শুনেছে, তখন পাণ্ডেজি তাদের বলল, দূর হয়ে যা তোরা আমার সামনে থেকে! তোরা সব কটা হচ্ছিস বগলা ভকত (বক ধার্মিক)।
সেদিনকার মতন ব্যাপারটা চুকে গেলেও কিন্তু ঘটনা সেখানে থামল না।
ব্যাবসার কাজে পাণ্ডেজিকে কয়েকদিনের জন্য যেতে হয়েছিল পাটনা। সেখান থেকে ফিরে দ্যাখে কুলিদের মধ্যে দারুণ হইহই চলছে। কাজকর্ম প্রায় বন্ধ, সবাই সারাক্ষণ বসে থাকে বগলা মন্দিরের সামনে। বগলা মন্দিরের জাগ্রত আংরেজি মাই-কে দেখবার জন্য কাছাকাছি গ্রাম থেকেও লোক আসছে।
কাঠ কাটা মজুরদের মধ্যে সর্দারশ্রেণীর দু-তিনজনকে ডেকে পাণ্ডেজি কড়া গলায় জিগ্যেস করল, এসব কী ব্যাপার চলছে? মজুরি বাড়াবার ধান্দা? চাবকে সে ওদের পিঠের ছাল তুলে দেবে!
সর্দারেরা হাতজোড় করে জানাল যে, তাদের সেরকম কোনও মতলোব নেই। লোকজনদের বাগ মানানো যাচ্ছে না কিছুতেই। বগলা মন্দিরের ঠাকুর সত্যিই আংরেজিতে কথা বলেন। তবে সবসময় বলেন না। গুড়িয়া নামে একটি মেয়ে উপস্থিত থাকলেই এরকম হয়। বহু লোক নিজের কানে শুনেছে।
পাণ্ডেজি বলল, এক্ষুনি ডেকে আনো গুড়িয়া নামের মেয়েটিকে। নিয়ে চলো তাকে আমার সঙ্গে। আমিও নিজের কানে শুনব।
আবার একটা বড় দল এসে হাজির হল বগলা মন্দিরের সামনে। সেদিনও সন্ধে হয়ে এসেছে। কারা যেন একটা মশাল জ্বালিয়ে রেখেছে সেখানে। এত লোক এসেছে, কিন্তু কারুর মুখে কোনও কথা নেই। জঙ্গল একেবারে স্তব্ধ। শুধু শোনা যাচ্ছে একটা রাতপাখির ডাক।
একজন সর্দারের বউ হাত ধরে একটি মেয়েকে নিয়ে এসে বসল মন্দিরের দরজার কাছে। মেয়েটির বয়েস তেরো-চোদ্দো হবে। একটা লাল রঙের ফুল-ফুল ছাপাশাড়ি পরা, মাথার চুল খোলা। মেয়েটি একটুক্ষণ বসে থাকার পর হাউহাউ করে কেঁদে উঠল। সেখান থেকে সে উঠে পালাতে চাইল, কিন্তু কোনও অদৃশ্য শক্তি যেন তাকে বেঁধে রেখেছে। কাঁদতে-কাঁদতে মেয়েটি চিৎকার করে কীসব বলতে লাগল, সবই ইংরিজিতে! মাঝে-মাঝে সে থামছে, যেন কারুর প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে।
সব কুলিকামিনরা এই সময় জয় বগলা মাঈ বলে ধ্বনি দিতে লাগল। পাণ্ডেজি এগিয়ে এসে গুড়িয়া বলে মেয়েটিকে ধরার চেষ্টা করতেই দেখল সে অজ্ঞান হয়ে গেছে।
কাহিনি মাঝপথে থামিয়ে পাণ্ডেজি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি তো দাদা আখবরে লেখো। একঠো ক্যামেরা দিয়ে তুমি ওই গুড়িয়া নামের মেয়েটির ফটো নিয়ে নাও, তারপর দুনিয়ার মানুষকে দেখাও। গুড়িয়াকে না দেখলে তুমি ব্যাপারটা বুঝতে পারবে না।
শহীদুল হক মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বলল, সত্যি, ঠিক যেন কয়লাখনির মধ্যে একখানা হীরে! না দেখলে আমিও বিশ্বাস করতুম না।
ওই গুড়িয়াও ওখানে পাতা বাছাইয়ের কাজ করে। তার বাবা আর মা-ও রয়েছে সেখানে। কিন্তু আর পাঁচটা কুলিকামিনের মেয়ের তুলনায় গুড়িয়ার চেহারা একেবারে আলাদা। তার রং ধপধপে ফর্সা, তার চুলের রং সোনালি, তার চোখের মণি নীল। পাণ্ডেজি আগে দু-একবার যাওয়া-আসার পথে গুড়িয়াকে কাজ করতে দেখেছে, কিন্তু বিশেষ মনোযোগ দেয়নি। সে ভেবেছিল, ও মেয়েটার বুঝি শ্বেতি রোগ আছে। বাঁকুড়া পূর্ণিয়া অঞ্চলে এরকম দু-একটা শিশু দেখা যায়, জন্ম থেকেই যাদের গায়ের রং সাদা—চুলও সাদা।
কিন্তু গুড়িয়ার দিকে ভালোভাবে নজর দিয়ে তাকিয়ে, তার চেহারা একেবারে মেমসাহেবদের মতন। বালো করে স্নান করে না, গায়ে-মুখে পুরো একপোঁচ ধুলোর আস্তরণ, কিন্তু ঠিক যেন। ছাইচাপা আগুন! তার চোখের মণিদুটো বেড়ালের মতন ঘন নীল।
গুড়িয়ার বাবা আর মাকে তাঁবুতে ডেকে এনে পাণ্ডেজি জিগ্যেস করল, কী রে, আসল কথাটা এবার বল! নিশ্চয়ই কোনও আংরেজি সাহেব এ-মেয়ের জন্ম দিয়েছে।
গুড়িয়ার মা প্রায় ষাট বছরের বুড়ি। সে পাণ্ডেজির পায়ে পড়ে কাঁদতে-কাঁদতে বলল, হুজুর, অনেকেই আগে একথা বলেছে। কিন্তু আপনি বিশ্বাস করুন, আমার আর সাত ছেলেমেয়ের বাপও যে, গুড়িয়ার বাপও সে।
গুড়িয়ার বাবা বুড়ো রামধারী সিং মিটিমিটি হাসছিল। যেন দারুণ একটা মজার ব্যাপার পেয়েছে সে। একটা বেশ চমৎকার খেলা, যাতে বাবুভাইয়াদের ঠকানো যায়।
রামধারী সিং যা বলল, তাও অবিশ্বাস করা যায় না। তাদের মোট আটটি ছেলেমেয়ে। আর সব কটি ছেলেমেয়েই যেরকম গ্রামের অন্য ছেলেমেয়ে হয় সেইরকম। গুড়িয়া সব চেয়ে ছোট। গুড়িয়া যখন জন্মায় তখনই তার মা বুড়ি হয়ে গেছে, তাছাড়া একটা অসুখে ভুগে সেসময় তার। চেহারা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। সেইরকম একটা অসুস্থ বুড়ির সঙ্গে কোনও আংরেজি সাহেব শোবে কেন? তা ছাড়া, তাদের গ্রামের আশেপাশেদশ-বিশখানা গ্রামের চৌহদ্দির মধ্যে আংরেজি সাহেব কোথায়?
গ্রামের অন্য ছেলেমেয়েদের মতো গুড়িয়াও অল্পবয়েস থেকে ক্ষেতির কাজ আর বর্ষার আগে জঙ্গলের কাজ করেছে। কোনওদিন ইস্কুল পাঠশালার মুখ দেখেনি। ইংরেজি জানবে কী করে?
দেবরাজ জিগ্যেস করল, জব্বর ভূতের গপ্পো জমিয়েছ পাণ্ডেজি! এবারে সাফসুফ বলো তো, তুমি নিজের কানে পাথরের মূর্তিকে কথা বলতে শুনেছ? ভাঁওতা মারার আর জায়গা পাওনি? আমাকে কেটে ফেললেও আমি এই গাঁজাখুরি গল্প বিশ্বাস করব না।
পাণ্ডেজি খানিকটা রেগে গিয়ে বলল, শোনো দাদা, তোমাকে ভাঁওতা মেরে কি আমার দশ-বিশ টাকা রোজগার হবে? আগেই তো বলেছি, আমি কহানি বনাতে জানি না। আমার কথা বিশ্বাস না হয় তুমি তোমাদের এই বাঙালি হক ভাইয়াকে জিগ্যেস করো। না, আমি পাথরের মূরতের মুখে আংরেজি বোলি কেন কোনও বোলিই শুনিনি। সেকথা তো আগেই বলেছি। কিন্তু আমি তিন-চার দিন গিয়ে দেখেছি, ওই মন্দিরের সামনে বসলেই গুড়িয়া নামের মেয়েটি ভয় পেয়ে কাঁদতে শুরু করে আর আংরেজি বোলি শুরু করে দেয়। তার কথা শুনলেই মনে হয়, ভেতর থেকে কে যেন। তাকে ধমকাচ্ছে আর সে উত্তর দিচ্ছে। তাতেই লোকে ভাবে যে ভেতর থেকে পাথরের ঠাকুরও কথা বলছে। আমি মন্দিরের মধ্যে ঢুকে দেখেছি ভেতরে কেউ লুকিয়ে নেই। কিন্তু গুড়িয়া যে। আংরেজি বলে, তা একদম আংরেজি মেমসাহেবকি তারিফা! গ্যাট, ম্যাট, ফ্যাট, গুড মানিং।
দেবরাজ শহীদুল হককে জিগ্যেস করল, তুমি শুনেছ মেয়েটার কথা? কী বলে সে?
শহীদুল হক বলল, ঠিক বোঝা যায় না। মেয়েটার গলা সে সময় স্বাভাবিক থাকে না, সে মৃগী রুগির মতন ছটফট করে আর তার গলার স্বর পাখির মতন হয়ে যায়। আমি যেটুকু বুঝতে। পেরেছি, তা হল প্লিজ ফরগিভ মি! আই অ্যাম অ্যাফরেড! নো, আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু গো উইথ ইউ!
দেবরাজ হকের জামা খামচে ধরে জিগ্যেস করল, শালা, তুমি নিজের কানে শুনেছ?
হক দৃঢ় গলায় বলল, আমার মায়ের দিব্যি! সত্যি আমি নিজের কানে শুনেছি। একেবারে অশিক্ষিত মেয়ে, কিন্তু গোটা একটা ইংরেজি সেন্টেন্স সে বলতে পারে!
দেবরাজ বলল, চলো, কালকেই যাব তোমাদের জঙ্গলে। আমি নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করব না।
পাণ্ডেজি বলল, আলবাত কাল যাবে। নিজে দেখবে, ফটো খিচবে, তারপর আখবরে লিখবে! তার আগে আর একটু শুনে নাও। আমি গুড়িয়া সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে লাগলুম, তারপর হঠাৎ জানতে পারলাম, গুড়িয়া আমার বোন হচ্ছে।
আমি আর দেবরাজ একসঙ্গে চমকে উঠে বললুম, অ্যাঁ?
পাণ্ডেজি বলল, আগে একটা পুরোন কিসসা শোনা। কুঁয়ারীপুর রাজবাড়ি তোমরা দেখতে চেয়েছিলে। ওই কুঁয়ারীপুর যখন আসল জমিদারি ছিল তখন সেখানকার জবরদস্ত জমিদার ছিল রায়বাহাদুর রঘুবীর সিং।
দেবরাজ বলল, জানি। রঘুবীর সিং শুধু জবরদস্ত জমিদার ছিলেন না, লেখাপড়াও জানতেন। পড়াশুনো করতে বিলেত গিয়েছিলেন। তাঁর আমলেই কুয়ারীপুর রাজবাড়িতে লাইব্রেরি হয়, সেখানে অনেক বই কেনা হয়।
পাণ্ডেজি বলল, এত জানো, তবে এটা জানো কি যে ওই রঘুবীর সিং লন্ডন থেকে দুটো আসলি। মেমসাহেব এনেছিলেন রক্ষিতা করার জন্য? প্রথমে একটা মেমসাবে আনলেন, সেটা একমাসের মধ্যে মরে গেল। তারপর আর-একটা মেমসাহেব আনালেন। রঘুবীর সিং-এর দশ-বারো খানা রক্ষিতা ছিল, তার মধ্যে একটা বাঙালিনও ছিল। হে-হে-হে! বড় ভালো সময় ছিল তখন। দ্যাখো না, এখন আমার একটাও রক্ষিতা নেই!
দেবরাজ বলল, মেম রক্ষিতা? ও বুঝেছি…
পাণ্ডেজি ধমক দিয়ে বলল, কিছুই বোঝোনি! জমিদার হলেও রঘুবীর সিং-এর গায়ের রং ছিল ছাতার কাপড়ের মতন কালো। কুঁয়ারী পুরের রাজবাড়ির সবাই কালো। সে কালো রঙের এমনই তেজ যে মেমসাহেবের পেটে তিনখানা বাচ্চা জন্মালো—তারাও সব ঝিরকুটে কালো। কালো জাম দেখেছ তো, ঠিকই সেইরকম কালোকালো মেয়ে। সেই তিনটে বাচ্চাকে ফেলে পাখি উড়ে গেল একদিন। সেই মেমসাহেব আর-এক সাহেবের সঙ্গে ভিড়ে লন্ডন পালিয়ে গেল একদিন।
দেবরাজ জিগ্যেস করল, তোমার মা-ও তো ওই জমিদারবাড়ির মেয়ে! তুমি ও-বাড়ির ভাগ্নে যখন–
পাণ্ডেজি বলল, হ্যাঁ, কিন্তু সব শোনাব। জমিদার রঘুবীর সিং-এর দু-খানা ধরমপত্নী ছিল। তাদের একজনের এক ছেলে, আর-একজনের এক মেয়ে, ব্যস। আর রক্ষিতাদের ছেলেমেয়ে পাঁচ গণ্ডা। রঘুবীর সিং যেই মারা গেল, অমনি তার ধরমপুত্র রক্ষিতাদের সব কটাকে, ছেলে-মেয়েশুদ্ধ। ভাগিয়ে দিল একেবারে। দু-চারটাকে মেরে ফেলেছিল একেবারে। আর ওই পালিয়ে যাওয়া মেমসাহেবের যে কালো জামের মতন তিনটে বাচ্চা, তাদের নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। গাঁওবস্তিতে। চাষারা তাদের পেয়ে ক্ষেতির কাজে লাগিয়ে দিল, বড় হয়ে উঠলে শাদি করল।
দেবরাজ জিগ্যেস করল, তাহলে ওই গুড়িয়ার মা যে বুড়িটা, সে মেমের মেয়ে?
পাণ্ডেজি বলল, নেই, নেই। ওই বুড়িটার যে মা ছিল, সে ছিল মেমসাহেবের লেড়কি! এবারে বুঝলে, আমার মা-ও রঘুবীর সিং-এর বংশধর, আর ওই গুড়িয়ার মা-ও তো তাই। তাহলে গুড়িয়া আমার সম্পর্কে বহিন হল না? ভগবানের কী আশ্চর্য লীলা! অ্যাত্তদিন পর সেই মেমসাহেবের গায়ের রং ফিরে এসেছে গুড়িয়ার মধ্যে।
আমি বললুম, ভগবানের লীলা তো বুঝলুম, কিন্তু গুড়িয়া ইংরিজি বলতে শিখল কী করে? আর বগলা দেবীর মূর্তিই বা তার সঙ্গে ইংরিজিতে কথা বলবে কেন?
পাণ্ডেজি বলল, সে আপনারা লেখাপড়া জানেন, আপনারা বুঝবেন। লণ্ডন থেকে মেমসাহেবের প্রেত এই ফরসা মেয়েটিকে তার নিজের দেশে নিয়ে যেতে এসেছে।
গল্পে-গল্পে অনেক রাত হয়ে এসেছিল। বোতলও প্রায় শেষ, বাইরে প্রবল বেগে বৃষ্টি পড়ছে। আমরা শুতে চলে গেলুম। ঠিক হল তার পরের দিনই আমরা মিটিগড় জঙ্গলে যাব।
কিন্তু এ-কাহিনি এখানেই শেষ। মিউিগড় জঙ্গলে আমাদের যাওয়া হয়নি। পরের দু-দিন সাংঘাতিক ঝড়বাদল চলল। তার মধ্যে জিপ চালানোর কোনও প্রশ্নই ওঠে না। তারই মধ্যে খবর পাওয়া গেল যে, একটা ব্রিজ ভেঙে রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে।
তৃতীয় দিনে মিট্টিগড় থেকে পায়ে হেঁটে পাণ্ডেজির ম্যানেজার এসে উপস্থিত হল আমাদের হোটেলে। মজুরদের সপ্তাহের টাকা দিতে হবে, নইলে তারা কাজ করবে না। বৃষ্টির জন্য দু তিনটে তাঁবুও নষ্ট হয়ে গেছে।
ম্যানেজার সাহেব আরও জানাল যে, পুরুলিয়া থেকে এক পাদ্রি সাহেব এসেছিলেন গুড়িয়াকে দেখতে। গুড়িয়ার মুখে ইংরেজি কথা শুনে তিনি তাকে নিয়ে গেছেন। গুড়িয়ার বাবা-মা আপত্তি করেনি। তাদের ধারণা, গুড়িয়াকে জিনে ধরেছে। পাদ্রিসাহেবের চিকিৎসায় ভালো হয়ে যাবে।
গুড়িয়াকে দেখা যাবে না জেনে আমাদের আর মিউিগড়ে যাওয়ার উৎসাহরইল না। তবে পাণ্ডেজির সঙ্গে পরিচয় হওয়ায় আমাদের বিশেষ লাভ হয়েছিল। তার সূত্রেই আমরা কুঁয়ারীপুর রাজবাড়িতে প্রবেশ করে আমাদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করেছিলুম।