মিছিমিছি

মিছিমিছি

ভাইফোঁটার পরে স্কুল খুলেছে বেশ কিছুদিন হল। মডার্ন স্কুল ফর ওল্ড বয়েজ। বারুইপুরের এক মস্ত বাগানবাড়িতে নানা মহীরুহমণ্ডিত পুকুরওয়ালা পুরোনো দিনের দোতলা বাড়ি লিজ নিয়ে নামি ব্যবসায়ী এবং প্রোমোটার মহিম মুখার্জি এই স্কুলটি খুলেছেন তিন বছর হল। সকলেই স্বীকার করেন যে ঠিক এই ধরনের স্কুল বঙ্গভূমে আর একটিও নেই। ভারতে আছে কি না, সে কথাও জানা নেই।

মহিমবাবু প্রথমে ভেবেছিলেন একটি ওল্ড এজ হোম করবেন। তারপর মত বদলে ওল্ড বয়েজ স্কুল করেছেন। যেসব পুরুষ ও নারী একেবারেই একা এবং অসহায় তাঁদের জন্যে তো ওল্ড এজ হোম অনেকই হয়েছে। এবং ভবিষ্যতে আরও অনেক হবেও। তাই এই স্কুলের পত্তন করা হয়েছিল মুখ্যত কিছু উচ্চবিত্ত, আলোকপ্রাপ্তা ও আধুনিকা বউমাদের অনুরোধে। যেসব বয়স্ক এবং অবুঝ শ্বশুর ছেলে-বউমার সঙ্গেই থাকেন তাঁদের আধুনিক জীবনযাত্রার পথের কাঁটা হয়ে, তাঁদের সকাল নটা থেকে বিকেল পাঁচটা অবধি কোথাও আটকে রাখার জন্যেই নার্সারি স্কুলে অথবা ক্রেশ-এ যেমন ছোটো বাচ্চাদের আটকে রাখা হয়) এই উদ্যোগ। বেয়াড়া শ্বশুর ছঘন্টা স্কুলের কঠোর নিয়মানুবর্তিতাতে অভ্যস্ত ও বিধবস্ত হবার পরে বাড়ি ফিরে নিস্তেজ হয়ে যান এবং সন্ধ্যে-সন্ধ্যেতেই কিছু মুখে দিয়ে ছেলে-বউমাকে নিশ্চিত করে শয্যা নেন। পরদিন সকাল হতে না-হতেই তো স্কুলের জন্যে তৈরি হতে হবে। অনেক ক্ষেত্রেই ছেলে বা বউমা অফিস যাবার। সময়ে তাঁদের স্কুলে নামিয়ে দিয়ে যান। এই স্কুলের কোনো ইউনিফর্ম নেই। অনেক ছাত্রকে নিতে স্কুলের বাসও আসে। অধিকাংশ ছাত্ৰই বালিগঞ্জ বা যোধপুর পার্ক বা যাদবপুরে থাকেন। সল্টলেক-এর বাসিন্দারাও কিছুদিন হল মহিম মুখার্জির কাছে ওই অঞ্চলে এই স্কুলের একটি শাখা খোলার জন্যে জোরদার দাবি তুলছেন। সল্টলেকে এমন মস্ত বড়ো হাতাওয়ালা বাড়ি। পাওয়া যাচ্ছে না তাই এখনও শুরু করা যায়নি। তবে চাপ যেমন ক্রমশই বাড়ছে তাতে মনে। হচ্ছে শুরু না করেও উপায় নেই। অগত্যা বাগান ছাড়া ফ্ল্যাট বাড়িতেই সেই স্কুল করতে হবে।

সাম্প্রতিক অতীতে, মানে, বছরখানেক হল আরও একটা ঘটনা ঘটেছে। সেই বিপজ্জনক ঘটনাও প্রচণ্ড চাপে পড়েই ঘটাতে হয়েছে। স্কুলটি আর শুধুমাত্র ওল্ড বয়েজ স্কুল নেই।

কো-এড হয়ে গেছে। অবাধ্য শ্বশুরদেরই মতো অবাধ্য শাশুড়ি এবং মায়েদেরও আধুনিক ছেলে বউমা বা মেয়ে-জামাইরা এসে ভরতি করে দিয়ে যাচ্ছেন। আরও একটি বৈশিষ্ট্য মডার্ন স্কুল ফর ওল্ড বয়েজ-এর, এখানের হেডমিস্ট্রেস থেকে শিক্ষিকারা সকলেই মহিলা, যুবতী এবং ডানাকাটা পরি। ওই স্কুলে কোনো অ্যাডমিশন টেস্ট বা বৎসরান্তের পরীক্ষাও নেই। নানারকম কাজকর্ম এবং খেলা, গান, নাটক ইত্যাদিতে ছাত্র-ছাত্রীদের ব্যস্ত রাখা হয়। বেশ ভালো একটি লাইব্রেরিও আছে। হোম ভিডিয়োতে ডিভিডি চালিয়ে ইংরেজি ও বাংলা ছবিও দেখানো হয়। বারোটাতে লাঞ্চ এবং বিকেল চারটেতে চা দেওয়া হয় সব ছাত্র-ছাত্রীকে। লাঞ্চ-এ সবরকম রান্না হয় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। কন্টিনেন্টাল, চাইনিজ, দিশি ও মোগলাই খানা বানাবার জন্যে ভালো ভালো রাঁধুনি রাখা হয়েছে। ওড়িশাবাসী পাচক থেকে ফাইভ স্টার হোটেলের রিটায়ার্ড শেফদের আনা। হয়েছে। বিকেলে চায়ের সঙ্গে আলু বা মাংস বা মাছের সিঙাড়া, মোচার, আঁচড়ের এবং থোড়ের চপ, গোকুল পিঠে, পাটিসাপটা…নানা পেস্ট্রি এবং প্যাটিসও দেওয়া হয়, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। এই স্কুলের মাস মাইনেও অনেক। তবুও ভরতির নতুন আবেদনের পাহাড় জমেছে কিন্তু যেহেতু ছাত্র ছাত্রীরা কেউই পাশ করে স্কুল ছেড়ে যান না, নতুন ছাত্র-ছাত্রী তেমন নেওয়া যায় না। কেউ মারা গেলে বা ছেলে-বউমা বা মেয়ে জামাই কলকাতা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেলেই সিট খালি হয়। অ্যাডমিশনের সময়ে পঞ্চাশ হাজার নেওয়া হয় কিন্তু যেহেতু সিট খালি হলেই সেই সিটের জন্যে প্রচণ্ড ডিম্যান্ড থাকে, মহিম মুখার্জি দু-লাখ অন মানি নেন অফিসিয়াল পঞ্চাশ হাজারের উপরে। তবুও ওই স্কুলে অভিভাবকদের ভরতি করানোর জন্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। দু-লাখের এক লাখ নিজে নেন। পঞ্চাশ হাজার হেডমিস্ট্রেসকে দেন আর পঞ্চাশ হাজার পাঁচ জন টিচারকে দশদশ করে দেন। মহিম মুখার্জি সি পি আই করেন। মানুষটা সাম্যবাদী। স্কুলের নাম এখন হয়েছে ডে স্কুল ফর এজেড পার্সনস।

২.

হেডমিস্ট্রেস, সাইকোলজিস্ট ময়না মিত্তিরের ঘরে তনিমা জোয়ারদার, এ সেকশন-এর ক্লাস টিচারের ডাক পড়েছে। তনিমা হোম ভিডিয়োতে ফ্রম হিয়ার টুইটার্নিটি চালিয়ে দিয়ে তার সেকশনের বুড়ো-বুড়িদের সেখানে ঢুকিয়ে দিয়ে, হেডমিস্ট্রেসের ঘরে গেলেন। ওই স্কুলে চারটিই সেকশন। প্রতি সেকশন-এ পঞ্চাশজন করে ছাত্র-ছাত্রী। হেডমিস্ট্রেস ছাড়া পাঁচজন টিচার।

গুড মর্নিং ম্যাম।

গুড মর্নিং। বোসো তনিমা।

তনিমা যাদবপুরের তুলনামূলক সাহিত্যের স্নাতক। তারপর কিছুদিন একটি বহুজাতিক বিজ্ঞাপন সংস্থাতে কপি রাইটারের কাজ করেছিলেন। বিয়েও করেছিলেন পাঁচ বছর আগে কিন্তু তিন বছর হল ডিভোর্স হয়ে গেছে। সেই চাকরিতে বড্ড ঘোরাঘুরি ছিল তাই ছেড়ে দিয়ে এই স্কুলে জয়েন করেছেন। দেখতে খুবই সুন্দরী। হেডমিস্ট্রেস থেকে অন্যান্য সব শিক্ষিকাই খুবই সুন্দরী। আগেই বলা হয়েছে। সকলেরই বয়স ত্রিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে। প্রত্যেকেই অত্যন্ত ভালো মাইনে পান এবং নিজের নিজের কাজ খুবই উপভোগ করেন।

ম্যাম, ডেকেছিলেন আপনি আমাকে?

হ্যাঁ। ক্লাস কামাই করে আপনার সেকশনের গোকুল সেন, স্কুলের পুকুরে মাছ ধরেন কেন তনিমা?

উনি মাছ ধরতে খুব ভালোবাসেন। রিটায়ারমেন্টের পরে নানা জায়গাতে মাছ ধরেই বেড়াতেন। ছেলে-বউমা এখানে ভরতি করে দেবার পর মাছ ধরতে পারেন না তেমন, তাই মনে খুবই দুঃখ। যাতে আনন্দে থাকেন তাই ওঁকে অ্যালাও করেছি।

মাছ ধরে কি বাড়ি নিয়ে যান?

না, সে সাহস নেই। তাছাড়া, ছেলে-বউমা দুজনেই শুধুমাত্র বোনলেস ফিসই খান–চিংড়ি মাছ, ভেটকির ফিলে, তাও চিজ বেকড, নয়তো ফ্রাই, উইথ টার্টার সস। মাছ, বাড়িতে গিয়ে নিজেই রান্না করে খাবেন বলে একদিন নিয়ে গেছিলেন। বাড়িতে কুরুক্ষেত্র হয়েছিল। পরদিন ওঁকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে যাবার সময়ে বউমা আমাকে ডেকে খুব বকাঝকাও করেছিলেন। আপনার মনে আছে হয়তো।

মনে আছে। কিন্তু ডিটেইলস জানতাম না।

ওঁর বউমার নাম কী?

মেঘনা সেন।

কী করেন?

একটি নামি আর্কিটেক্ট ফার্ম-এর পার্টনার। নিজেও আর্কিটেক্ট। এই বিল্ডিং বুম-এর দিনে এ প্রফেশনের খুবই রমরমা।

মিস্টার সেন কী করেন? মানে, ওঁর স্বামী?

এম বি এ। আই সি আই সি আই ব্যাঙ্কে আছেন খুব উঁচু পদে। সেখানেও রমরমা। সেনসেক্সও যে আর কত উঁচুতে উঠবে তা কে জানে!

তা আজও কি গোকুল সেন মাছ ধরছেন?

হ্যাঁ। আজও। দারোয়ানকে টাকা দিয়ে চার কিনিয়ে এনেছেন।

আজ যদি মাছ ধরতে পারেন তাহলে কী হবে? মানে মাছটা?

একটা ধরলে আমাকে দেবেন। দুটো ধরলে একটা দারোয়ানকে দেবেন।

কী মাছ?

অধিকাংশই রুই অথবা কাতলা। তবে এক দেড় কেজির বেশি বড়ো নয়।

তোমাকে দেবেন কেন?

বলেন, তুমি মা আমার কন্যাসমা। আমার বউমা যদি তোমার মতো হত, অমন দজ্জাল না হত, তবে কী সুখই না হত।

ওঁর স্ত্রী নেই?

না, উনি উইডোয়ার।

ওঁর ধরা মাছ তোমার কি নেওয়া উচিত? এতে স্কুলের ডিসিপ্লিন নষ্ট হচ্ছে না?

ওই মাছ ওঁর নির্দেশমতো রান্না করি রবিবারে। রবিবার সকালে মর্নিং ওয়াক-এ বেরিয়ে আমার বাড়িতে চলে আসেন। মাছের কালিয়া চেটেপুটে খান তৃপ্তি করে। অনেক সময়ে দুপুরটাও কাটিয়ে যান।

তোমার মা-বাবা আপত্তি করেন না।

মা-বাবা তো কুনুরে থাকেন। মাঝে মাঝে আমার বিধবা পিসিমা এসে থাকেন। আমার মনে হয় তাঁর প্রতিও একটু দুর্বলতা আছে।

পিসিমা কি খুব সুন্দরী?

খুব সুন্দরী নন, কিন্তু ভারী মিষ্টি স্বভাব। হয়তো গোকুলবাবুর স্ত্রী দজ্জাল মহিলা ছিলেন। সে জন্যেই পিসিমাকে ওঁর অত ভালো লাগে।

প্রতিদানে কী দেন?

পয়লা বৈশাখে আর পুজোতে কনিষ্ক থেকে শাড়ি কিনে নিয়ে আসেন। দামি শাড়ি। পিসিমার জন্যেও আনেন। গত পুজোতে তানিশক থেকে একটি গয়নাও কিনে এনেছিলেন। রুবি বসানো একটি পেনডেন্ট। বলেছিলেন, তোমার আগুনের মতো রং তোমাকে মানাবে ভালো।

আগুনে পুড়ে মরার ইচ্ছে হয়েছে বুঝি? এই বুড়োগুলো বড়ো ঝামেলা করে। এর চেয়ে যুবকদের ম্যানেজ করা সোজা।

তারপর একটু থেমে বললেন, কিন্তু তনিমা, এসব কি তোমার ঘুষ খাওয়া হচ্ছে না? গ্রাটিফিকেশন?

ম্যাডাম। ঘুষ হচ্ছে না এই জন্যে যে, আমি তো আর নম্বর বাড়িয়ে প্রেমোশন দিচ্ছি না। সে বালাই তো নেই এই স্কুলে। ওঁদের আনন্দে রাখাটাই তো আমাদের কাজ। যে ভাবে আনন্দ দিতে পারি।

হু-ম-ম। তাই-তো বলছি। ঘুষের প্রতিদান এবং আনন্দ দেওয়ার তো আরও অনেক রকম আছে।

ছিঃ ম্যাম। আমার কি ইয়াং হ্যান্ডসাম বন্ধুর অভাব আছে? ডেটিং করার?

তুমি তো একা থাক? এক জন পুরুষের সঙ্গে এই ভাবে একা বাড়িতে সময় কাটানো কি তোমার উচিত? তনিমা?

অনুচিতই বা তা বলব কেন? তা ছাড়া, আমার কোনো ক্ষতি করেন সেই ক্ষমতাই তো ওঁর নেই। বয়স পঁচাত্তর হয়েছে। উনি কি আর পুরুষ আছেন? লোকে তো স্রেফ কোম্পানিও চায়। তা ছাড়া, ঘরে তো শান্তি নেই। ওঁর ছেলে-বউমা ওঁকে কীভাবে ট্রিট করেন আপনি জানেন না। আমি একদিন গেছিলাম ওঁকে পৌঁছে দিতে। কুকুর বেড়ালকেও মানুষ এর চেয়ে ভালোভাবে ট্রিট করে।

বাট হোয়াই? উনি তো ওঁদের বোঝা নন।

সেটাই তো দুর্বোধ্য। বুঝি না। উনি ভয় পান ওদের দুজনকেই। ঠিক কীরকম ভয় পান নিজে চোখে দেখেছি বলেই জানি। ভেরি স্যাড।

উনি অপত্য স্নেহ ছাড়া আমার প্রতি অন্য কোনো অনুভূতিরই প্রকাশ ঘটাননি আজ পর্যন্ত। অবশ্য ভবিষ্যতের কথা জানি না। তবে বুড়ো বেশ রসিক আছেন।

মানে?

প্রতিবারই আমাকে শাড়ি দিয়ে বলেন, তনিমা, একদিন শাড়িটি পরে দেখিও, আরেক দিন, না পরে।

স্পিনস্টার হেডমিস্ট্রেস ময়না মিত্তিরের চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেল এই বাক্যটি শুনে, উত্তেজনায়। মোটা বল পয়েন্ট পেনটা কামড়াতে কামড়াতে বললেন, ভেরি নটি ইনড্ডি।

অধিকাংশ বুড়োরাই একটু নটি হন। বিশেষ করে ওয়েল-অফফ বুড়োরা।

দেখো তনিমা, হ্যান্ডল হিম উইথ কেয়ার। গার্জেনরা এসব জানতে পারলে স্কুলের বদনাম হবে।

আমার হাতের রান্না খেয়ে ভারি তৃপ্তি পান গোকুলবাবু। যেদিন ছেলে-বউমার পার্টি-টার্টি থাকে উইকএন্ডে, তখন নিজেই লাল রঙা মারুতি এইট হান্ড্রেড চালিয়ে চলে আসেন বিকেল বিকেল। রাত দশটা এগারোটা অবধি থাকেন। কখনো সন্ধ্যেবেলাতে এসে রাত এগারোটা অবধিও থাকেন। গ্রেগরি পেক আর বার্ট ল্যানকাস্টারের ছবি দেখেন। অন্য ফিল্মও দেখেন। বার্গম্যান, আন্তোনিওনি, কুরোসাওয়া, ল্যাটিন অ্যামেরিকান ছবি। একদিন বলেছিলেন সফট পর্ণো দেখবেন।

বলো কী তনিমা? হাউ ডেঞ্জারাস!

হ্যাঁ, আমাকে ডিভিডি আনিয়ে রাখতে বলেছিলেন। আমি তো ওসব রাখি না, দেখিও না। উনি বললেন, ইন্টারনেটে ছেলে-বউমা দেখে কিন্তু বাড়ি থেকে বেরুনোর সময়ে লক করে দিয়ে বেরোয় তারা, পাছে গোকুলবাবু দেখেন।

অনেক আশি বছরের পুরুষও মেয়েদের প্রেগন্যান্ট করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। তা ছাড়া আজকাল ভায়াগ্রা-টায়াগ্রা কত কী বেরিয়েছে না? ওসব ছবি দেখে চেগে গিয়ে কী না কী করে বসেন তার ঠিক কী?

উনি প্রায়ই বলেন ওঁর উইল করবেন এবং আমাকে ওঁর সব সম্পত্তি দিয়ে যাবেন।

বলো কী? সন্দেহজনক ব্যাপার। কত সঞ্চয় আছে?

খুব বেশি নয়, তবে যা শুনেছি, লাখ পঁচিশেক। কমিয়েও বলতে পারেন। বাড়িয়েও। এডুকেশন লাইনে ছিলেন, ভাইস চ্যান্সেলার নাকী যেন। মহা মিথ্যেবাদী। বলেন, ওঁর ছেলে-বউমাকে কিছুই দেবেন না। হাড় জ্বালানো সব। উনি মাঝে মাঝেই আমাকে নিয়ে লং-ড্রাইভে যেতে চান। আমি আজ অবধি রাজি হইনি।

না না, এসব তো অত্যন্তই ডেঞ্জারাস কথাবার্তা। জানাজানি হলে স্কুলের খুবই বদনাম হয়ে যাবে তনিমা। মহিম স্যার চাকরিই খেয়ে দেবেন।

চিন্তিত মুখে ময়না মিত্তির বললেন।

গোকুলবাবু বড়ো দুঃখী মানুষ। স্কুলের দশ হাজার মাইনের টাকাও বউমা গোকুলবাবুর নিজের সেভিংস অ্যাকাউন্ট থেকে চেক কাটিয়ে দেওয়ান প্রতি মাসে।

যিনি অত ওয়েল-অফফ তিনি আলাদা থাকেন না কেন? ইনসিকিওরড ফিল করেন। বয়স হলে মানুষের সাহস কমে যায়।

সফট পর্নো দেখার সাহস, শাড়ি না পরে দেখানোর অনুরোধ করার সাহস তো থাকে! তারপরই ময়না বললেন, উনি শুঁটকি মাছ খান?

শুঁটকি খেতে খুবই ভালোবাসেন। কিন্তু আমি শুঁটকি মাছের গন্ধই সহ্য করতে পারি না, খাইও না, রাঁধিও না। রাঁধতে জানিও না।

আমাদের বাড়ি ছিল কুমিল্লাতে। এখন বাংলাদেশ। আমরা খাই। মায়ের কাছে রান্না শিখেছিলাম, লইট্যা, চিংড়ি, ইলিশ এবং সিঁদল। ওঁকে একদিন আমার বাড়ি নিয়ে এসো তনিমা। আশমিটিয়ে শুঁটকি খাওয়াব। তবে ব্যাপারটা সিক্রেট রাখবে, ময়না মিত্তির বললেন।

শুধু শুঁটকিই নয়, উনি মুটকি খেতেও ভালোবাসেন। কোনো অনুপান ছাড়াই।

মানে? বুঝলাম না। খোলসা করে বলো।

আমার কাজের মেয়ে, জয়নগর মজিলপুরের মাধবীলতা একটু হৃষ্টপুষ্ট। তাকে নাকি খেতে চেয়েছিলেন একদিন। মাধবীলতা চোখ-মুখ লাল করে রিপোর্ট করেছিল আমাকে।

ওমা! এ যে দেখি বিড়ালের মতো ছুকছুকে।

তাই? তবে তো…

না, চিন্তার কিছু নেই। ভালো শুঁটকি পেলে মুটকি আর খেতে চাইবেন না নিশ্চয়ই। দেশভাগের আগে ওঁদের বাড়ি ছিল নোয়াখালিতে।

তাই যদি হয় তবে তো মানুষটার বয়স আশি হতে পারে না।

আশি তো নয়। পঁচাত্তর।

অ। ময়না মিত্তির বললেন, মোটা ডট পেনটা চিবোতে চিবোতে।

হেডমিস্ট্রেস ময়না মিত্তিরও পরমা সুন্দরী। অক্সফোর্ড-এ পড়া বিদুষী। কিন্তু অতি বড়োবরণী না পায় বর, অতি বড়ো ঘরণী না পায় ঘর কেস। খুবই চাপা মহিলা। এখনও মেনোপজ হয়নি। ওই সব মহিলার নানা ইডিওসিনক্রেসিজ থাকে। শ্রীশ্রীবাবা লোকনাথের খুবই ভক্ত। পারলেই চাকলাতে ছোটেন গাড়ি নিয়ে। বাইরে খুব শক্ত কিন্তু ভেতরের শাঁস খুব নরম। কোনো দুর্বল ক্ষণে যে কী করে বসবেন তা অন্তর্যামীই জানেন। হয়তো কোনো ওঁচা বেকার ছেলেকেই বিয়ে করে বসবেন।

তার পরই প্রসঙ্গ বদলে ময়না বললেন, তনিমা, এবারে সরস্বতী পুজোর প্রসাদে কোনো ত্রুটি যেন না থাকে। গত বছর পরি ঠাকুর বেগুনিটা কাঁচা কাঁচা রেখেছিল। খিচুড়িতেও ঘি কম দিয়েছিল, টোম্যাটোর চাটনিটাও জুতসই হয়নি। খুবই এমব্যারাসিং ব্যাপার হয়েছিল, অত গেস্টস এসেছিলেন। এবারে কিন্তু তুমি নিজে দায়িত্ব নেবে।

নেব ম্যাম। কিন্তু ওই পরি ঠাকুরকে ট্যাকল করা খুব কঠিন কাজ। ওড়িশার বামরাতে বাড়ি। গতবার তার বাজারের ফর্দর শেষ আইটেমটা কী ছিল মনে আছে ম্যাম?

না। মনে নেই। কী ছিল?

শরীর মেরামতি খাতে পঁচিশ টাকা।

ব্যাপারটা কী?

আফিং-এর খরচ। তার নিজের এবং দু-জন হেল্পারের। রাঁধুনি বামুনদের আফিং খাওয়াটা প্রয়োজন। গনগনে আগুনের সামনে কাজ তো।

তাহলে খিচুড়ি ইত্যাদির দায়িত্ব মুনশাইন ক্যাটারারকে দিয়ে দিলে কেমন হয়?

ভালো দেখাবে না। পুজোর প্রসাদ বলে কথা। প্যান্ট-শার্ট-টাই পরা লোকেরা সরস্বতী পুজোর খিচুড়ি পরিবেশন করবেন এটাতে স্টুডেন্টদের আপত্তি থাকতে পারে। গার্জেনরাও ভালো চোখে দেখবেন না, যদিও অধিকাংশই সাহেবিভাবাপন্ন।

সেটা ঠিক। তবে অতই যদি সাহেবিভাবাপন্ন তাহলে সরস্বতী পুজোতে বিনি পয়সাতে খিচুড়ি খেতে আসা কেন।

তারপর বললেন, সরস্বতী পুজোর পরই তো বসন্তোৎসবের কথা নিয়ে ভাবতে হবে। ওয়েল-ইন টাইম। সেসব স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশান ইতিমধ্যেই ভেবে রেখেছে। ছেলেরা, মানে, বুড়োরা ফাল্গুনী করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বুড়িরা ফিমেল রোল নেই বলে আপত্তি জানিয়েছেন। ওঁরা ঠিক। করেছেন গান আবৃত্তি ওসব হবে। একটি স্কিটও করবেন। যাঁরা যাঁরা পার্টিসিপেট করতে চান তাঁরা নামও দিয়ে দিয়েছেন। গার্জেনরা এবং তাঁদের গেস্টরা সবাই আসবেন। প্রায় শদুয়েক লোক হবে। দুপুরে দোল খেলা। রাতে গান-বাজনা। ঘন্টা ঘোষ গিটার বাজাবেন, অসীম রুদ্র সিনথেসাইজার বাজাবেন। সবই রবীন্দ্রসংগীত। সরস্বতী পুজোর দিন পনেরো পর থেকে রিহার্সাল শুরু হয়ে যাবে হোম সিনেমার ঘরে।

বাংলা ব্যান্ড কেঁচেগণ্ডুষকে বলার কথা হচ্ছিল কিন্তু তারা চল্লিশ হাজার চাইছে। আমাদের বাজেট তো অত নয়। তা ছাড়া গলাতে তো সুরই লাগে না অধিকাংশ গায়কদের। জিনস পরে আর দাড়ি নিয়ে গিটার হাতে নাচানাচি করা গান শোনার জন্যে অত অর্থদণ্ডের কী দরকার?

তোমার মনে আছে তনিমা, গত বছর সি সেকশানের রূপক রুদ্র মিনারাল ওয়াটারের বোতলে জলের সঙ্গে ভদকা মিশিয়ে খেয়ে মাতাল হয়ে বি সেকশানের মণিদীপা গুহর খোঁপা খুলে দিয়েছিলেন। এবারে দোলের আগেই কড়া করে সার্কুলার দিতে হবে। ওসব বেয়াদবি সহ্য করা হবে না।

বুড়োরা তো ওরকম একটু-আধটু করতেই পারেন। আজকাল কলেজের ছাত্ররাই যখন করে। কিন্তু বি সেকশানের কৃষ্ণা সেন যে বাজারের থলেতে করে থাম্পস-আপের বোতল আর ব্ল্যাক লেবেল বিয়ার নিয়ে এসেছিলেন। নিজে খেয়ে এবং অন্য ছাত্রীদের খাইয়ে সে কী উদ্দাম নাচ আর গান।

হ্যাঁ হ্যাঁ মনে আছে। আজি দখিন দুয়ার খোলা। আমার সেকশানের অনিন্দিতা ব্যানার্জির তো শাড়িই খুলে গেছিল। অবশ্য অধিকাংশরাই সালোয়ার কামিজ পরে এসেছিলেন, তাই রক্ষা।

কী দিনকাল হল! বসন্তোৎসবে সালোয়ার কামিজ! ভাবা যায় না।

তাও ভালো যে, জিনস আর টপ পরে আসেননি।

অবশ্য ওঁদের কত কষ্ট, কত দীর্ঘশ্বাস। নইলে কী আর এই স্কুলে ভরতি হন। আমাদের এখানে যদি একটু আনন্দে কাটান অন্তত দিনের কিছু সময়, তাহলে বাধা দিতেও ইচ্ছে করে না। আসলে, ওঁদের একটু আনন্দে রাখাই তো আমাদের উদ্দেশ্য।

পঙ্কজ মল্লিকের সেই একটা গান ছিল না? প্রমথেশ বড়ুয়ার মুক্তি ছবিতে? ঘরেও নহে পারেও নহে যে জন থাকে মাঝখানে, সন্ধ্যেবেলায় কে ডেকে নেয় তারে। আমার মা, বাবার এক প্রচণ্ড বড়লোক এন আর আই বন্ধুর সঙ্গে বাবাকে ছেড়ে পাড়ি দেবার পরে বাবা প্রায়ই এই গানটা গাইতেন। ওঁদের সকলেরই তো সেই অবস্থাই। দিনের শেষে ঘুমের দেশে ঘোমটা পরা ঐ ছায়া

আরও কীসব ছিল। বাবার কথা বড়ো মনে পড়ে। …হি ওয়াজ আ ভেরি নাইস পার্সন। মা, বাবাকে বুঝতেই পারল না।

ওই তো। বোঝাবুঝিটাই তো সব। বাঙালি মেয়েরা আজকাল ফরেনে যাওয়া, ফরেন জিনিস ব্যবহার করার জন্যে হামলে পড়ে যে কেন জানি না?

এবারে আমি আসি ম্যাম? এতক্ষণ ক্লাসে, মানে হোম ভিডিয়োর ঘরে অনুপস্থিত থাকলে আনরুলি এলিমেন্টসরা ঝামেলা বাধাবে।

তারপর বললেন, গতবারের দোলের রাতে পেয়ারা গাছের ডালে মণীশ রায় আর ট্যাঁপা সেন। হুইস্কি খেয়ে সেদিন দু-জনে দুলেছিল বনে গাইতে গাইতে ডাল থেকে নীচে পড়ে গেছিলেন, মনে আছে? তারপর ফিমার বোনে ফ্র্যাকচার। এখন তো লাঠি নিয়ে চলেন। এবারে কিন্তু আগে থাকতে প্রিকশান নিতে হবে। প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিওর।

ঠিক তাই।

৩.

ময়না মিত্তির নিজের চেম্বারে চলে আসেন রোজই সাড়ে আটটার মধ্যে। স্কুলের বাগানে একটু পায়চারি করেন। বড়ো বড়ো গাছ বহু আছে কিন্তু সিজনাল ফুলেরও চর্চা করা হয়। দুজন মালি আছে। করপোরেশনের জল তো আছেই একটি ডিপ টিউবওয়েলও আছে। প্রচুর জল। বর্ষার পরে পরেই নিজেই পার্ক স্ট্রিটের সাটনস-এ গিয়ে নানা ফুলের বীজ কিনে লাগিয়েছেন। প্রতি বছরই লাগান। শীতকালে ফুলে ভরে যায় বাগান। স্টুডেন্টরা শীতকালে ফুলের মধ্যে লন-এ বসে থাকে। সেখানেই ক্লাস নেওয়া হয়। কখনো গীতা পাঠ হয়। বাবা রামদেবের এক শিষ্য এসে প্রাণায়াম শিখিয়ে যান সপ্তাহে দু-বার। একজন মহারাজ মিশন থেকে এসে বেদ ও উপনিষদের উপরে আলোচনা করেন। মহিমবাবুর অনেক ডোনেশন আছে মিশনে। কিন্তু অধিকাংশ বুড়ো-বুড়িই উত্তম-সুচিত্রারবই, নয় অমিতাভ-শাহরুখ খানের বই দেখতে চান, রানি মুখার্জি, ঐশ্বর্য রায়, ক্যাটরিনা কাইফদের ছবিও।

সেদিন তনিমা চলে যাবার পরে ময়না মিত্তির বাগানে এক চক্কর হেঁটে আসবার জন্যে বেরুলেন। পরিচারিকা পূর্ণিমাকে বললেন, অফিসে ফিরে এলে এক কাপ গরম কফি খাওয়াতে, দুধ-চিনি দিয়ে।

বেশ কিছুটা এগিয়ে জগিংট্র্যাকে একটি বাঁক নিতেই দেখেন মস্ত উঁচু আর ঝুপড়ি হওয়া জাম গাছটার নীচে যে কাঠের বেঞ্চটি পাতা আছে বিশ্রাম ও গল্পগাছার জন্যে, সেখানে ডানদিকে হাতের লাঠিটা হেলান দিয়ে রেখে চ্যাটার্জিসাহেব দূরের পুকুরের দিকে একমনে চেয়ে বসে আছেন। তাঁর কোলের উপরে একখানি বাংলা বই আধখোলা আছে। স্কুলের লাইব্রেরিরই বই।

চ্যাটার্জিসাহেব পাক্কা সাহেব। পুরোনো দিনের আই এ এস। যাঁদের মধ্যে আই সি এস-দের আদল ছিল। বহুদিন রিটায়ার করেছেন উনি। একসময়ে ফরেন সার্ভিসেও গেছিলেন ডেপুটেশন এ। তখন নাকি দিল্লির চিত্তরঞ্জন পার্কে অত্যন্ত সস্তাতে জমিও পেয়েছিলেন কিন্তু সারাজীবন সারা ভারতবর্ষ ও বিদেশে ঘুরে অত্যন্ত হোমসিক ফিল করতেন। মানে, কলকাতার জন্যে হোমসিক। তাঁর স্ত্রী কুমুদিনীরও খুব ইচ্ছে ছিল কলকাতাতেই থিতু হবার। কিন্তু রিটায়ার করার পরে। শান্তিনিকেতনে পূর্বপল্লিতে দু-বিঘা জমির উপরে একটি পুরোনা বাড়ি কিনে তাকে রিনোভেট করে সুন্দর বাগান করে দু-জনে নীড় বেঁধেছিলেন। বাড়ির নামও দিয়েছিলেন নীড়। গেটের দু পাশে দুটি বটল ব্রাশ গাছ লাগানোই ছিল। আগের মালিকের গাছের খুব শখ ছিল। অস্ট্রেলিয়ান জ্যাকারান্ডা, আফ্রিকান টিউলিপ, রবীন্দ্রনাথ যে গাছের নাম দিয়েছিলেন অগ্নিশিখা। মাদার এবং জারুল গাছও ছিল। দু-তিন রকমের শিরীষ ছিল। বসন্তী, শিউলি, ম্যাগনোলিয়া গ্রান্ডিফ্লোরা, শিমুল, পলাশ, অশোক, স্থলপদ্ম। কুমুদিনী খুবই খুশি হয়েছিলেন। চ্যাটার্জিসাহেবের আই এ এস, আই পি এস কলিগরা অধিকাংশই সল্টলেকে বাড়ি করে একতলা ভাড়া দিয়ে দোতলাতে থাকতেন। নিজের ব্যাঙ্ক ব্যালান্সের দিকে তাকিয়ে চ্যাটার্জিসাহেব ভাবতেন, সঞ্চয় যা আছে তাতে বুড়োবুড়ির বাকি জীবন হেসে-খেলে চলে যাবে। তা ছাড়া, তখন শান্তিনিকেতনের কস্ট অফ লিভিং অত্যন্তই কম ছিল।

কিন্তু ম্যান প্রোপোজেস, গড ডিসপোজেস। গৃহপ্রবেশ করার দু-বছরের মাথাতেই কুমুদিনীর হঠাৎই এক রাতে হার্ট-অ্যাটাক হল। শান্তিনিকেতনে এত নামিদামি বিশ্ববিখ্যাত মানুষদের বাস অথচ তখনও একটিও ভালো হাসপাতাল ছিল না। শুনতে পান যে, আজও নেই। প্রণব মুখার্জির নিজের এলাকা, পাণ্ডববর্জিত সিয়ান-এ কাস্টমস-এর বিরাট কমপ্লেক্স গড়েছেন

তাতেও যে হাসপাতাল আছে সেটিও নাকি অ্যান অ্যাপলজি ফর আ হসপিটাল। সেখানে যে আই সি ইউ আছে সেটিও নাকি লোক দেখানোই। অধিকাংশ রোগীই বেঁচে ফেরে না। তবে কুমুদিনীর যখন হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল মাত্র চৌষট্টি বছর বয়সে, তখন সিয়ানের সেই প্রেতপুরীও তৈরি হয়নি। কিছুই করা যায়নি কুমুদিনীর জন্যে। সেই রাতেই কুমুদিনী চলে গেছিলেন বিনা চিকিৎসাতে। প্রফিটেবল হবে না বলে আজও শান্তিনিকেতনে একটিও ভালো নার্সিং হোম নেই।

ছেলে এবং মেয়ে দু জনেই তখন বিদেশে। তাদের ফোন করা হয়েছিল। কিন্তু তারা জানালো। তারা দুজনেই হলিউডে আছে। একজন বাহামাতে আরেকজন হাওয়াইতে। এবং এমন এমন জায়গাতে আছে যে সেখান থেকে বড়ো এয়ারপোর্টে পৌঁছে প্লেন ধরে কলকাতাতে সাতদিনের আগে কোনোমতেই পৌঁছোতে পারবে না কেউই। হলিডে সিজন-এ টিকিট পাওয়াও মুশকিল। হরপ্রসাদ চ্যাটার্জির বুকে বড়ো বেজেছিল। তাই ডেডবডি কলকাতাতেও আর নিয়ে যাননি। ছেলে-মেয়ে যদি বলত যে ডেডবডি মরচুয়ারিতে রেখে দাও তাহলেও কথা ছিল। নিজের সন্তানেরাই যদি না দেখল তবে মৃতদেহ অন্যদের দেখার দরকার কী? শান্তিনিকেতনের। কঙ্কালীতলার মন্দিরে যাবার পথে যে শ্মশান আছে, চাঁদ শ্মশান যার নাম, সেখানেই নিজেই মুখাগ্নি করে কুমুদিনীকে দাহ করে দিয়েছিলেন। প্রবল অভিমান হয়েছিল ছেলে-মেয়ের উপরে। তবে সে অভিমান জোলো হয়ে গেছিল পরে চেনা পরিচিত আরও অনেকের জীবনেই এই ঘটনা ঘটতে দেখে।

চিকিৎসার এই চরম অব্যবস্থা হৃদয়ঙ্গম করে বৃদ্ধ চ্যাটার্জিসাহেব কলকাতার এক প্রৌঢ় ব্যারিস্টারকে সে বাড়ি বিক্রি করে কলকাতাতে ছোটো বোনের বাড়িতে মাসখানেক থেকে এখন বালিগঞ্জে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া করে আছেন। একটি কমবাইন্ড হ্যান্ড রেখেছিলেন। বয়স অল্প। মেদিনীপুরের লোক। চালাক-চতুর ছিল। সেটাই কাল হল। একটি উইকএন্ডে ভগ্নীপতির সঙ্গে বকখালি গেছিলেন যখন তখন সব কিছু চুরি করে সে পালায়। নাম ঠিকানা থানায় দেওয়া ছিল। কিন্তু দেখা গেল সে ঠিকানা মিথ্যে।

গিনিপিগের মতো মানুষ বাড়লে পুলিশ কী করবে! আর এই টিভি! নিরন্তর কোমর-দোলানো নাচ, উচ্চকিত গান আর সীমাহীন এবংকৈফিয়তহীন বৈভবের ছবি দেখে দেখে সাধারণ, গরিব অশিক্ষিত এবং অর্ধশিক্ষিত মানুষের মনে লোভ তো জাগবেই। তাই সারা দেশের গরিব ও সাধারণ মানুষ, আগে যারা অতি অল্পে সন্তুষ্ট থাকত, যারা সৎ ছিল, যাদের মূল্যবোধ ছিল, ভগবানে বিশ্বাস ছিল, যাদের অনেক অভাবের জীবনেও শান্তি ছিল তারা সকলেই চোর ডাকাত অসৎ ধর্ষক লোভী মূল্যবোধহীন হয়ে উঠেছে। এই রোগ সর্বস্তরের ভারতীয়দের বড়ো গভীরে পৌঁছে গেছে। একে উৎখাত করতে গেলে ভিতর থেকে করতে হবে। বাইরে থেকে আর করা যাবে না।

ভারতে গণতন্ত্রের জমি তৈরি না করেই যেমন সহজে ভোট বাগানোর জন্যে সকলের জন্যে গণতন্ত্র চালু করা হয়েছিল এবং যে কারণে আজও সেই গণতন্ত্র অশিক্ষিত ভোটারদের কাছে এক প্রহসন হয়েই রয়ে গেছে। বিশ্বায়ন করে, এত ভোগ্যপণ্য আমদানি করার আগে যে মানুষেরা এই সব ভোগ্যপণ্যর বাজার, তাদের একটা ন্যূনতম উন্নত আর্থিক অবস্থাতে তুলে আনা অবশ্যই উচিত ছিল। তা হয়নি বলেই সিফিলিস, গনোরিয়া বা এইডস-এরই মতো ভোগ্যপণ্যর বিষ, সমাজের সবক্ষেত্রে এইরকম ভাবে ফুটে বেরুচ্ছে। চ্যাটার্জিসাহেব ভাবেন কিন্তু এই সব নিয়ে ভাবেন দেশের ক-জন? ভাবনাচিন্তার বালাই নেই আর। মোবাইলের বোতাম টেপো, নয়তো কম্পুটারের–

BABA TUMI KEMON ACHHO?

WE ARE FINE. TOMAR TAKAR DORKAR ACHHE KI? JANIO. PROTI MASE JE EKSHO DOLLAR PATHACHHI, PACHHO TO? RUMNIO TO SHUNI PACHATTAR DOLLAR PATHAY. ER UPARE JA LAGBE CHEYE NEBE, KONOI SANKOCH KORONA. AFTAR ALL YOU ARE OUR DAD.

BHALO THEKO, TAKE CARE
RAKESH

এই মেল পড়তে পড়তে চ্যাটার্জিসাহেবের মুখটি বিকৃত হয়ে ওঠে। চাইবেন না, ছেলে-মেয়ের কাছে কোনোদিনও চাইবেন না কিছু। পাঠায় তো, ছাতার এক-শো পঁচাত্তর ডলার। তাতে কী হয়? পেনশন আর সঞ্চয়েই চলে যায় দিন তাঁর। ছেলে-মেয়ের কাছে যেন কখনো হাত পাততে না হয়। মরে গেলেও নয়। অনেক অভিমান জমা আছে তাদের উপরে তাঁর।

এই স্কুলে ভরতি হবার পরে সপ্তাহে পাঁচদিন সময়টা কেটে যায়। অনেকের সঙ্গে কথা হয়, নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়, ভালোই লাগে। নিজের একাকিত্বর বোঝাটা একটু হালকা হয়। যদিও স্কুলটা খুবই এক্সপেনসিভ। তবে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাঙ্কের চার্চ লেন ব্রাঞ্চেত্র দেবী রায় বেশ কিছু টাকা নানা মিউচুয়াল ফান্ডে ইনভেস্ট করে দেওয়াতে এখন তিনি বেশ সচ্ছল। মেয়েটি যেমন। সুন্দরী তেমনই ভলো৷ রিস্ক একটু থাকে। তবে কথাতেই বলে, নো রিস্ক নো গেইন। জীবনের শেষে এসে ওঁর প্রয়োজনও সব ফুরিয়ে গেছে। কোনোক্রমে দিন কেটে গেলেই হল। কুমুদিনী চিরদিন বলতেন, তোমাকে আগে রওয়ানা করিয়ে দিয়ে তারপরে যাব আমি। তুমি যে

ছেলেমানুষের চেয়েও বাড়া। রান্নাঘরে গ্যাসটা পর্যন্ত জ্বালতে পার না। বড়ো চিন্তা হয় তোমার জন্যে। কে জানে, কুমুদিনী কেমন আছেন? কোথায় আছেন? তাঁর জন্যে এখনও চিন্তা করছেন কি না।

কুমুদিনী হরপ্রসাদবাবুর জীবনে কল্যাণী হয়ে এসেছিলেন। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, বাড়ি ঘর, বাগান সবকিছু Spic and Span। মাদার টেরিজা বলতেন ক্লিনলিনেস ইজ গডলিনেস। মুণ্ডারি ভাষাতে একটা কথা আছে রিঙ্গিচিঙ্গি চিকনপিণ্ডা। তার মানেও তাই। সাসানডিরি আর গামহারডুংরি উপন্যাসে এই শব্দ দুটি পড়েছিলেন তিনি।

চ্যাটার্জিসাহেব হেসে বলতেন, তুমি না থাকলে এবং ভালো কোনো কাজের লোক পাওয়া না গেলে, মুড়ি খেয়েই কাটাব। একা নিজের জন্যে অত ঝামেলা আমার দ্বারা হবে না। আর তাইই খেয়ে থাকতে হচ্ছে এখন।

কী করছেন চ্যাটার্জিসাহেব এখানে একা বসে?

ময়না মিত্তিরকে দেখে ঘোরভঙ্গ হল চ্যাটার্জিসাহেবের। চমকে উঠলেন। ময়নার শাড়ি-জামার স্তনসন্ধির পারফুমের গন্ধে ভরে গেল জামতলি, চ্যাটার্জিসাহেবের নাক, এবং মনও।

একটু হেসে বললেন, আর একা। একাকিত্বই তো এখন জীবনের সব।

ময়না অবাক গলাতে বললেন, এ কী! এখানে এতবড়ো একটা মই এনেছে কে?

স্কুলের মালিরাই এনেছে নিশ্চয়ই। কালও দেখেছিলাম, উপরের দিকের ডালগুলো ছাঁটছে। ছোটো মালি তো কাল এ গাছ থেকেই পড়ে গেছিল।

অদ্ভুত লোক তো এরা। কাজ হয়ে গেলে স্টোরে তো রেখে আসবে।

আজও বোধ হয় কাজ করবে। তাই ওদের সুবিধের জন্যে হয়তো রেখে গেছে।–চ্যাটার্জিসাহেব বললেন।

কেমন আছেন আপনি চ্যাটার্জিসাহেব?

আমি? ফার্স্ট ক্লাস।

ময়না মিত্তির ভাবছিলেন, এই হচ্ছে চ্যাটার্জিসাহেবের সঙ্গে অন্য দশজনের তফাত। অন্য কোনো বৃদ্ধকে কেমন আছেন জিগগেস করলেই, তিনি বলবেন, ভালো নয়। ব্লাড সুগার খুব বেড়েছে, ইনসুলিনের ডোজ বাড়িয়ে দিয়েছেন ডাক্তার, পেসমেকার বসাতে বলছেন, প্রোস্ট্রেটও গণ্ডগোল করছে। হাঁটুর ব্যথাও অসম্ভব। মনে হচ্ছে, মালাইচাকি বদলাতে হবে। ড. মুখার্জি ফার্স্ট ক্লাস। করেছেন আমার শ্যালকের অপারেশান। ঠিক করেছি, ওই ডাক্তারকে দিয়েই বদলাব। ইত্যাদি, ইত্যাদি, ইত্যাদি।

ময়না ভাবেন, পঁচাত্তর-আশিতে পৌঁছেও কি সবাই কন্দর্পকান্তি থাকবেন? ভিমের মতো পালোয়ন থাকবেন? এই মানুষগুলোর কোনো সেন্স অফ প্রোপোরশান…! প্রত্যেকেই এক একজন বোর। কিন্তু চ্যাটার্জিসাহেব একসেপশান।

চ্যাটার্জিসাহেব, আপনার ডাক্তার কে?

আমার কোনো ডাক্তার নেই। যখন বিপদে পড়ি তখন কাউকে দেখাই। কলকাতাতে কি ডাক্তার আছে না কি? বিশেষ করে জি.পি.। তাঁদের মর্জি হলে আসেন, নয়তো নয়। ডাক্তারদের সঙ্গে কালোয়ারদের আর বিশেষ তফাত নেই। টাকাই এখন মানবধর্ম সারাৎসার। অধিকাংশই তো জল্লাদ। ঈশ্বর করুন, তাঁদের কারো সাহায্য ছাড়াই যেন এক স্নিগ্ধ শীতের ভোরে পটল তুলতে পারি।

এতক্ষণে ওঁর হাতের বইটার দিকে নজর পড়ল হেডমিস্ট্রেস ময়না মিত্তিরের। বললেন, কী বই পড়ছিলেন চ্যাটার্জিসাহেব? বাংলা বই? বাঃ, বাংলা বই পড়া তো এখন অশিক্ষিতের লক্ষণ। ছেলে-বুড়ো সকলেই তো বাংলা বইকে ত্যাগ করেছে।

তাই? তা যদি করে থাকে, করে ঠিক করেনি।

কী বই পড়ছিলেন? লাইব্রেরির বই তো বাঁধানো। উপর থেকে নাম দেখা যায় না।

হুঁ। পড়ছিলাম বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেবযান।

তাই? দেব্যান! আপনি কি বিশ্বাস করেন যে পরলোক আছে?

আমি? না। আমি ঠিক বিশ্বাস করি না। যখন আমার বয়স সত্তর ছিল তখনও বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু এই সাতাত্তরে পৌঁছে অতখানি নিঃসন্দেহ আর নই। পড়তে ইচ্ছে করে, সাধুসঙ্গ করতে ইচ্ছে করে, জানতে ইচ্ছে করে পরলোক সত্যিই নেই কী না! এই বয়সে পৌঁছে মনে নানা প্রশ্ন জাগে মিস মিত্তির। আপনার যা বয়স তাতে এসব কথা বুঝবেন না, তা ছাড়া বোঝার দরকারও নেই।

তারপর বললেন, বড়োলোকদের পাড়ায় সব ডেডবডি নিঃশব্দে কাচের গাড়িতে ফুল-চাপা অবস্থাতে ধূপের আর ফুলের গন্ধ উড়িয়ে চলে যায়, শ্মশানে বা কবরখানাতে। কিন্তু যখন উত্তর কলকাতাতে থাকতাম তখন নিশুতি রাতে শববাহকেরা যখন বলহরি হরিবোল বলতে বলতে দড়ির খাঁটিয়াতে শবদেহ বয়ে নিয়ে যেতেন তখন বুকের মধ্যেটা ছ্যাঁৎ করে উঠত। ভাবতাম, কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন ওঁরা মৃতদেহকে। দু-ঘন্টাতে ছাই হয়ে যাবার জন্যেই কি এত দীর্ঘদিন ধরে এত যতনে, এই সাধের শরীরকে লালনপালন করা? এত কামনা-বাসনা, আশা-আকাঙক্ষা,

মান-অভিমান বুকের মধ্যে বয়ে বেড়ানো? মিছিমিছি? মিছিমিছিই কি এখানে আসা? দীর্ঘদিন থাকা? তারপর একদিন ছাই হয়ে যাওয়া। মিছিমিছিই যদি, তবে এখানে আসাই-বা কেন?

একসঙ্গে এতগুলো কথা বলে ফেলে হরপ্রসাদ চ্যাটার্জি লজ্জিত হলেন। আফটার অল, ময়না মিত্তির তো বলতে গেলে যুবতীই, তাঁর মেনোপজ-এর সময়ও তো আসেনি এখনও। ওঁকে বা ওঁর কাছে মৃত্যু ভাবনার কথা বলাটা শুধু অনুচিতই নয়, অশোভনও। একথা মনে হওয়ামাত্রই চুপ করে গেলেন উনি।

আমি তাহলে এগোই? ময়না মিত্তির বললেন।

হ্যাঁ, হ্যাঁ। আপনি এগোন ম্যাম। শ্রীবিন্দু এখুনি এসে পড়বে।

শ্রীবিন্দু কে?

শ্রীবিন্দু চৌধুরী। কেলেগঙ্গার দুর্গা মায়ের মন্দিরের পূজারি বংশর।

উনি? যিনি ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন?

না না, উনি কিছুই ছিলেন না। ওঁকে চেনেন আপনি। সি সেকশানে আছেন। বেঁটেখাটো। মন্দিরে যা প্রণামী পড়ে প্রতিদিন, তাতেই পুরো গুষ্টি রসে-বসে জীবন কাটিয়ে গেল। জীবিকা হিসেবে কোনো কিছুই করতে হয়নি এঁদের। এঁদের আগের দু-তিন পুরুষও তাই গেছে, পরের কত পুরুষ যে তাই-ই যাবে, তা কে জানে। এঁরা সব সমাজের প্যারাসাইট। জনগণের পয়সাতে বসে খেতে এঁদের আত্মসম্মানেও একটুও বাধে না। অথচ গুমোর ভরা কোলাব্যাঙ সব।

কিন্তু উনি আমাদের স্কুলে ভরতি হলেন কেন? এতই যদি ওয়েল-অফফ।

ম্যাম, যেখানে ফালতু পয়সা, যে-পয়সা স্বোপার্জিত নয়, সেখানেই কুকুরের মতো খেয়োখেয়ি করে মানুষ। তা ছাড়া সে তো বিয়ে-থাও করেনি। ও-ই করেনি, না ওকে কেউ করেনি তা অবশ্য বলতে পারব না। চরিত্র দোষও ছিল। এবং আছে। অবশ্য চরিত্র কাকে বলে সে সম্বন্ধেই ওর কোনো ধারণা নেই। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনের স্ত্রীদের উত্ত্যক্ত করেছে চিরদিন। প্রেমপত্র। লিখেছে। একদিন হাতেনাতে ধরা পড়ায় পাড়ার লোকে খুব ঠেঙিয়েছিল। তখন শরিকেরা তাদের ইজ্জত-এর কারণে শ্রীবিন্দুকে এজমালি বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলে। পরগাছাদেরও আবার ইজ্জত। প্রতিমাসের এক তারিখে রেশনের ব্যাগে করে হাজার, পাঁচ-শো, এক-শো টাকার বান্ডিল বান্ডিল নোট নিয়ে যায় মন্দির থেকে। মন্দিরের ট্রাস্টিদের মধ্যে ও একজন। ওর সব খরচ মিটিয়েও প্রতিমাসেই জমে যায় বেশ কিছু টাকা। টাকার ওর কোনো অভাব নেই। অভাব অন্য জিনিসের।

কীসের? ময়না মিত্তির বললেন।

সম্মানের। সম্রান্ততার এবং আরও অনেক কিছুরই।

এবারে আমি এগোই। বলে ময়না মিত্তির চলে গেলেন।

বলব না বলব না করেও এতগুলো কথা বলে ফেলার জন্যে লজ্জিত হলেন চ্যাটার্জিসাহেব। তা ছাড়া, জামতলিতে বসে দেবযান পড়তে পড়তে যে এক উচ্চমার্গে উঠে গেছিলেন তিনি, সেখান থেকে হঠাৎই ভূতলে পতিত হয়ে নিজের কাছেই নিজে ছোটো হয়ে গেলেন।

জাম গাছের ডালে ডালে পাখিরা কিচিরমিচির করছে। গতকালই ছোটোমালি এই গাছ থেকে পড়ে গিয়ে কাঁধের হাড় ভেঙেছে। তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়েছিল। হাড় জোড়া হয়তো লেগে যাবে কারণ বয়স কম। তবে সময় লাগবে অনেকই।

ভাবছিলেন, এই স্কুলের পরিবেশটি ভারি ভালো। গাছগাছালি, পুকুর, বাগানের এই দিকটা বিশেষ করে খুবই ফাঁকা। নির্জনতা ছমছম করে। তাই এখানেই বেঞ্চে বসে বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটান চ্যাটার্জিসাহেব। প্রায় প্রতিদিনই। কুমুদিনীর কথা ভাবেন, নিজের ভবিষ্যতের কথা ভাবেন। ভাবেন কঙ্কালীতলার কাছের চাঁদ শ্মশানে গেলে কি হঠাৎ দেখা হয়ে যাবে কুমুদিনীর সঙ্গে?

ফ্ল্যাটবাড়িতে আর থাকা যায় না। দম বন্ধ হয়ে আসে। শান্তিনিকেতনের বাড়িটা বিক্রি করে খুবই ভুল করেছেন। এখন বোঝেন। এখন নাকি পূর্বপল্লির জমির কাঠার দামই লক্ষাধিক টাকা হয়ে গেছে। দু-বিঘা তো জমিই ছিল। বাড়ির জন্যেও কম খরচ করেননি। পরিশ্রম আর ভালোবাসার তো কোনো অর্থমূল্য নেই। সবাই ভাবে, নেই। সবই ভোগ করছে এখন অন্য মানুষে জলের দরে কিনে নিয়ে।

শান্তিনিকেতনে ডাক্তার পাওয়া যায় না কিন্তু কলকাতায়ও কি পাওয়া যায়? মাঝে মাঝেই চ্যাটার্জিসাহেবের মনে হয়, নকশাল ছেলেগুলোর ফিরে আসা দরকার কিছু কিছু ডাক্তারদের শিক্ষা দিতে।

৪.

দূর থেকে শ্রীবিন্দুকে আসতে দেখা গেল। চ্যাটার্জিসাহেবের মনটা বিরক্তিতে ভরে গেল। ওর। সঙ্গে কিছুক্ষণ কাটালে মনে হয় নিজের চরিত্র, ব্যক্তিত্ব, সব কিছুরই অবনমন হল। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অনেকেরই থাকে না কিন্তু সামান্য হলেও কিছু পড়াশোনা তো থাকতে পারে। কিন্তু আনন্দবাজার পত্রিকা পড়া ছাড়া আর কিছু পড়ে না শ্রীবিন্দু। তাই আনন্দবাজার পড়ে যতটুকু বিদ্বান হওয়া যায় তা-ই হয়েছে। অথচ কথাবার্তাতে পণ্ডিতি ঝরে পড়ে।

গতবছরে সে একদিন এই স্কুল পালিয়ে দুপুরবেলা সোনাগাছিতে চলে গেছিল। সেখানে ঝামেলা করে পুলিশের হাতে পড়ে। পুলিশ থেকে স্কুলে ফোন করে ময়না মিত্তির হেডমিস্ট্রেসকে। তিনি ক্যাশিয়ার ব্রজবাবু আর বড়ো দারোয়ানকে গাড়ি দিয়ে পাঠান শ্রীবিন্দুকে উদ্ধার করে আনতে। ছোটো দারোয়ানকে ঘুষ দিয়ে স্কুল থেকে পালিয়েছিলেন শ্রীবিন্দু চৌধুরী। ওঁর সঙ্গে কথাই বলতে চান না চ্যাটার্জিসাহেব অথচ উনিই গায়ে পড়ে এসে চ্যাটার্জিসাহেবের পাশে বসে। ক্রিকেট, হিন্দি সিনেমা, রাজনীতি ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করেন। অথচ চ্যাটার্জিসাহেবের কোনোই উৎসাহ নেই ওসব বিষয়ে। যাদের রোজগারের পুরোটাই বাঁ-হাতি, তাদের বাঁ-হাতি খরচ করতেও কোনো অসুবিধে থাকে না। মন্দিরের অন্য ট্রাস্টিরাই ওকে জোর করে এই স্কুলেভরতি করে দিয়েছে যাতে মন্দিরের সুনাম বিঘ্নিত না হয়।

প্রত্যেক মানুষেরই দুর্বলতা থাকে। স্বয়ং ঈশ্বরেরও দুর্বলতা থাকে। দুর্বলতা বলতে চ্যাটার্জিসাহেবের একটাই দুর্বলতা! রবীন্দ্রসংগীত গাওয়া। অনেকগুলি ক্যাসেটও বের করে ফেলেছেন ইতিমধ্যে সাজনা কোম্পানিকে দিয়ে। চাকরিতে থাকাকালীন সাজনার ধুরন্ধর মালিক জগৎ রায়কে অনেক সুযোগসুবিধা করে দিয়েছিলেন। তারই ফায়দা ওঠাচ্ছেন এখন। অথচ উনি ওঁর সততা নিয়ে খুবই বড়াই করেন এবং বিশ্বাস করেন যে উনি সত্যিই সৎ। আসলে মানুষটি খারাপ নন। তবে বৈষয়িক বুদ্ধি একটু কম। দুঃখের বিষয় এই যে, ওঁর রবীন্দ্রসংগীত উনি নিজে ছাড়া আর কেউই শুনতে চান না। সাকুল্যে পাঁচ কপি করে হয়তো বিক্রি হয়। এবং খুব কম মানুষই ওঁকে গায়ক বলে স্বীকার করেন। তাতে অবশ্য ওঁর কিছু আসে যায় না। উনি কস্তুরী। মৃগের মতো নিজগন্ধে নিজে কুঁদ হয়ে থাকেন। স্কুলের বাগানের নির্জনে নিজের মনে গুনগুন করে রবীন্দ্রসংগীত গান।

মানুষ তো ভালোতে মন্দতে মিলিয়েই হয়। নিখাদ ভালো অথবা নিখাদ খারাপ আর কে হয়।

সল্টলেকে রিটায়ার্ড আই এ এস, আই পি এস-রা অনেকেই বাড়ি করেছেন। তাঁদের মধ্যেও অনেকেরই চ্যাটার্জিসাহেবেরই মতো গানের শখ আছে। তাঁদেরই কারো বাড়ির আসরে চ্যাটার্জিসাহেবের ডাকও পড়ে গান গাইবার জন্যে। কখনো কখনো সেই সব আসরে। চ্যাটার্জিসাহেব প্রচুর মাথা নেড়ে নেড়ে গান গান। শ্রোতাদের মধ্যেও তাঁরই মতো বোদ্ধা অনেকেই আছেন সল্টলেকে। তাই সেই সব আসর জমে ওঠে।

শ্রীবিন্দু একটু পরেই ট্রাউজারের হিপ পকেট থেকে হুইস্কির পাঁইট বের করে চুমুক দিল। দিনে রাতে দু-বেলাই সে হুইস্কি খায়।

চলবে না কি? এক ঢোঁক দু-ঢোঁক?

নাঃ। হুইস্কি আফটার সান-ডাউন ওনলি। চ্যাটার্জিসাহেব বললেন।

ঠিক আছে। শ্রীবিন্দু বলল।

তা ছাড়া, চ্যাটার্জিসাহেবের মতো দুঁদে এবং অত্যন্ত সিনিয়র পোস্ট থেকে রিটায়ার করা

আই এ এস অফিসার শ্রীবিন্দুর মতো আজেবাজে লোকের সঙ্গে ড্রিঙ্ক করা একেবারেই পছন্দ করেন না। তার উপরে আজেবাজে হুইস্কি। অঢেল পয়সা থাকলে কী হয়? স্কচ খাওয়ার দিলই নেই।

একটু পরেই শ্রীবিন্দু উঠে গেল। বলল, রোদটা এখন বড়ো মিঠে। পুকুরপাড়ে বসি গিয়ে। দেখি গোকুল সেন কী মাছ ধরল। জীবনের পুকুরে তো কোনো মাছই ধরতে পারেনি এখন এই পুকুরে কী ধরে দেখি।

যাও। চ্যাটার্জিসাহেব বললেন।

৫.

মন্দিরা সেন আর অদিতি রায় তাড়াতাড়ি লাঞ্চ শেষ করে বাগানে এসে বেঞ্চে বসলেন। কাল রাত থেকে জোর উত্তুরে হাওয়া ছেড়েছে একটা। রোদে পিঠ দিয়ে বসে থাকতে ভারি ভালো লাগে। মন্দিরার হাতে সবুজ রঙের উলের বল আর কাঁটা। নাতির জন্যে সোয়েটার বুনছেন। আজকাল হাতে-বোনা সোয়েটার কেউ পরেই না। কিন্তু মন্দিরা সেনকে নাতির ফরমাসে প্রতিবছরই একটি করে সোয়েটার বুনতেই হয়। নাতির বয়স হল পনেরো বছর। মেয়ে-জামাই নাগপুরের ছোটো ধানতলিতে থাকে। জামাই ভারত ইলেকট্রিক্যালস-এর ইঞ্জিনিয়ার। অনেকদিন হল তারা নাগপুরেরই বাসিন্দা। মারাঠিদের মতোই মারাঠি বলে। পড়াশুনো সব নাগপুরেই। তাদের বাড়ির কাছেই সুপ্রিম কোর্টের জজসাহেব বিকাশ সিরপুরকারের বাড়ি। তাঁর স্ত্রী কুমকুম বাঙালি। তিনি নিজেও বড়ো উকিল। নাগপুর বার অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট।

তিনবছর আগে মন্দিরা একবার নাগপুরে গেছিলেন পুজোর সময়ে। ওখানকার বাঙালিরা বড়ো করে পুজো করেন। বড়ো লাইব্রেরিও আছে। কটা দিন খুবই আনন্দে কেটেছিল। তাঁর মেয়ে জামাই তাঁকে খুবই ভালোবাসে। সপ্তাহে দু-তিন দিন ফোন করে। নাতি-নাতনির সঙ্গেও কথা হয়। তাদের পরিবার যৌথ, তাই মেয়ে মন্দিরাকে নাগপুরে নিয়ে গিয়ে রাখতে পারে না। একদিক দিয়ে ভালোই। সবসময়ে সঙ্গে থাকলে সম্পর্কটা এমন মধুর হয়তো থাকত না।

স্বামী চিদানন্দ চলে গেছেন বছর কুড়ি। তখনও মেয়ে সীমার বিয়ে হয়নি। চিদানন্দর মৃত্যুর। একবছর পরেই সম্বন্ধ করে বিয়ে হয় সীমার। প্রবুদ্ধরা মানুষ খুবই ভালো এবং অত্যন্ত সচ্ছলও। তার বাবা-মা কাকা-কাকিমা সকলকে নিয়ে ভরা সংসার। প্রবুদ্ধর মা অনেকবার বলেছেন। মন্দিরাকে নাগপুরে গিয়ে তাঁদের সঙ্গেই থাকতে। প্রবুদ্ধর দাদা অনিরুদ্ধ বিয়ে করেনি। সীমা তাদের সকলেরই খুব আদরের। যোধপুর পার্কে একটা ছোটো ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকেন মন্দিরা। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের নতুন ফ্ল্যাটের কাছেই। একটা কাজের মেয়ে আছে চবিবশ ঘন্টার। তার সঙ্গে গল্প করে আর টিভি দেখে এবং বই পড়ে দিন কেটে যায় তাঁর। সম্ভবত এই স্কুলে তিনিই একমাত্র ছাত্রী, যাঁকে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত এখানে আটকে রাখবার জন্যে ছেলে-বউ বা মেয়ে-জামাই পাঠাননি।

এমন অবস্থা কিন্তু অদিতি রায়ের নয়। তাঁর মেয়ে-জামাই ছেলে-বউমা সকলেই কলকাতায়ই থাকে। কিন্তু তারা এত হাই সোসাইটির যে তাদের কোম্পানির ফ্ল্যাটে তিনি অকুলান। তার বউমার আবারও বাচ্চা হবে। হলে, তাঁকে হয়তো বিনি-পয়সার আয়া হিসেব গিয়ে থাকতে হতে পারে ছেলের ফ্ল্যাটে। বউমার মা-বাবা নেই। ভাই-বোনেরা সকলেই এন আর আই। এবং বিদেশের পাসপোর্ট-হোল্ডার। তারা কেউই আর দেশে ফিরবে না। ছেলে-বউমা দুজনেই

এম বি এ। ব্যাঙ্কে কাজ করে। দু-জনেই লাখ টাকার উপরে মাইনে পায়। মেয়ে-জামাই দু-জনেই চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। তারাও বড়ো চাকরি করে। কোম্পানির ফ্ল্যাটে থাকে। এই স্কুলেও হয়তো অদিতির আর বেশিদিন নেই। বেহালার একটি ওল্ড এজ হোম-এ তাঁকে পাঠিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ছেলে ও মেয়ে। তবে ঠিক কবে তাঁকে যেতে হবে এখনও তা ঠিক হয়নি। সম্ভবত সেখানে সিট খালি নেই এখন। তবে শিগগির হবে।

মন্দিরা বললেন, চোখে আজকাল ভালো দেখি না। বুনতে কষ্ট হয়।

অদিতি বললেন, ছানি পড়েছে?

একবার কাটিয়েছি। আবার বোধহয় কাটাতে হবে। কিন্তু নাতির আবদার। কী করা যাবে।

তাও তো আবদার করার কেউ আছে তোমার জীবনে মন্দিরা। এও এক সৌভাগ্য।

তা ঠিক।

তুমি কোন ডাক্তারকে দেখাও চোখ? আমার চোখ দুটো তো প্রায় গেছেই বলতে গেলে।

ডা. আশিস ভট্টাচার্য। তাঁর স্ত্রীও চোখের ডাক্তার।

কী নাম?

স্বাতী। কারোরই বেশি বয়স নয়। ভালো ডাক্তার তো বটেই, মানুষও খুবই ভালো দু-জনেই।

একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে দিতে পার?

নিশ্চয়ই। আমি নিজে নিয়ে যাব তোমাকে। কবে যাবে বলো?

আমার তো কোনো কাজ নেই। তুমি যখন বলবে তখনই যাব।

ঠিক আছে। আমি আজই রাতে আশিসকে ফোন করব।

বেশ।

বাগানের দিকে চেয়ে অদিতি বললেন, শীতের বেলা, কীরকম তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যায়, না? গাছেদের ছায়াগুলো কত লম্বা হয়ে পড়েছে দেখেছ? অথচ সন্ধ্যে হতে এখনও কত দেরি।

মন্দিরা উল-কাঁটা থেকে একবার চোখ তুলে বাগানের দিকে চেয়ে বললেন, হুঁ।

তারপর স্বগতোক্তি করলেন, আমাদের জীবনেরই মতো। ছায়ারা দীর্ঘ হল। মনে হচ্ছে সন্ধ্যে হতে দেরি, আসলে দেরি আর বেশি নেই আমাদের।

এখন বেলাশেষের গান গাইবার সময় হয়েছে।

তোমার মাঝে মাঝে মনে হয় না যে, এই জীবনকে টেনে চলার আর কোনো মানে নেই। যাদের জীবনে করার মতো কিছুই নেই এবং যাদের জীবনে সম্মানও নেই, যারা অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে বাঁচে, তাদের বেঁচে থাকার কোনো মানেই হয় না। প্রশ্বাস নেওয়া আর নিঃশ্বাস ফেলা আর বেঁচে থাকা তো সমার্থক নয়। অবশ্য তোমার অবস্থা তো আমার মতো নয়। তোমার এরকম মনে নাও হতে পারে। তোমার জীবন তো পূর্ণ জীবন। সেকথা অবশ্য অস্বীকার করতে পারি না। আমার মেয়ে-জামাই নাতি-নাতনির কাছে আমার এখনও কিছু মূল্য আছে।

আমার নেই। এ পৃথিবীতে কারো কাছেই আমার মূল্য নেই এককণাও।

মন্দিরা বোনা থামিয়ে আড়চোখে অদিতির দিকে চেয়ে বললেন–কেন? চ্যাটার্জিসাহেবের কাছে?

কোন চ্যাটার্জিসাহেব?

কেন? হরপ্রসাদ চ্যাটার্জি।

হঠাৎ পশ্চিমের কমলা রোদ-মাখা সুন্দরী, শীর্ণা, অদিতি রায়ের পাণ্ডুর মুখে একঝলক রং এল। লাজুক হাসি হেসে বললেন, ঠাট্টা কোরো না মন্দিরা।

তারপর বললেন, মানুষটা বড়ো একা। এবং দুঃখীও। মানুষটার জন্যে কষ্ট হয়।

এই যে অন্য একজনের জন্যে, বিশেষ করে বিপরীত লিঙ্গ কারোর জন্যে কষ্ট–এইটাই তো প্রেম। এইটাই তো বেঁচে থাকার পাথেয়।

কী জানি! হয়তো তাই-ই। মনে হয়, জীবনের বিভিন্ন সময়ে প্রেমের সংজ্ঞা বদলে যায়। কখনো কখনো প্রেমকে চিনে নেওয়া ভারি মুশকিল হয়। চিনতে চিনতেই বেলা যায়। অথচ প্রেমহীন জীবন তো জীবন নয়, বিশেষ করে মানুষের জীবন।

তুমি হয়তো ঠিকই বলছ।

একজোড়া শালিখ এসে বসল ঘাসের উপরে। ডাকল, চিড়িক চিড়িক করে। মন্দিরা চেয়ে। রইলেন শালিখদুটোর দিকে। ওয়ান ফর সরো, টু ফর জয়। মেয়েবেলাতে যখন নিচুক্লাসে পড়তেন তখন শিখেছিলেন।

এখন কলকাতা শহর থেকে শালিখ চড়াই সব হারিয়ে গেছে। আরও কত কীই যে প্রতিনিয়ত হারিয়ে গেছে, হারিয়ে যাচ্ছে, এখনও মানুষ তা বুঝে উঠতে পারেনি। যখন বুঝবে, তখন বড়োই দেরি হয়ে যাবে।

একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন অদিতি।

আর কি এসেছিলেন চ্যাটার্জিসাহেব? তোমার কাছে? অদিতি? তুমি কিন্তু মানুষটিকে আর একটু দয়ার সঙ্গে দেখলেও দেখতে পারতে।

অদিতি বললেন, আমার দয়া দিয়ে কী হবে? উনি তো আমার দয়া চান না, তোমার দয়াই চান।

মন্দিরা বললেন।

বলেই বললেন, সেই গানটা একবার শোনাবে অদিতি? বড়ো ভালো গাও গানটি তুমি।

এখন ভাবি, কোনো কিছুই কি ভালো করে করলাম? কখনোই? এখন তো মনেই পড়ে না। গাও গাও। গানটা গাও।

প্রশান্ত চলে যাবার আগে এই গানটি বারবার শুনতে চাইত। কেন? কে জানে? তারই জন্যে বারবার গাইতাম।

গাও। আজ আমার জন্যেই একবার গাও–

দয়া দিয়ে হবে গো মোর জীবন ধুতে।
নইলে কি আর পারব তোমার চরণ ছুঁতে।
তোমায় দিতে পূজার ডালি বেরিয়ে পড়ে সকল কালি,
পরাণ আমার পারি নে তাই পায়ে থুতে।।
এত দিন তো ছিল না মোর কোনো ব্যথা,
সর্ব অঙ্গে মাখা ছিল মলিনতা।
আজ ওই শুভ্র কোলের তরে ব্যাকুল হৃদয় কেঁদে মরে
দিয়ো না গো দিয়ো না আর ধুলায় শুতে।।

গোকুল সেনের ফাতনাতে আন্দোলন উঠল। পুকুরের জলে তরঙ্গ উঠল। বড়ো মাছ গেঁথেছে। বোধ হয় বঁড়শিতে। বড়ো মালির লাল-রঙা লেজ-কাটা কুকুরটা গোকুল সেনের গা-ঘেঁষে বসে ছিল। ফাতনা নড়া দেখে সে তড়াক করে লাফিয়ে উঠল।

গোকুল সেনও বোধহয় তন্ময় হয়ে নীচু স্কেলে গাওয়া অদিতির সুরেলা গলার গান শুনছিলেন। রিফ্লেক্স ঢিলে হয়ে যাওয়ায় ছিপে টান লাগাতে সম্ভবত সামান্য দেরি হয়ে গেল। মাছ পালিয়ে গেল। ছিপের মাথাতে শূন্য বঁড়শি উঠে এল।

গোকুল সেন স্বগতোক্তি করলেন, দুসস শালা।

মাছটাই শালা, না গানটাই, না ছিপটাই ওঁদের দুজনের কেউই বুঝতে পারলেন না।

গোকুল সেন আবার টোপ গেঁথে বঁড়শি ফেললেন জলে। মালির কুকুরটার উত্তেজনা প্রশমিত হতে সেও আবার নরম রোদে শুয়ে পড়ল বাগানের ঘাসে। গোকুল সেনের পাশে।

বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মন্দিরা বললেন, ভারি ভালো গাও তুমি অদিতি। তুমি যে এই স্কুলের অনুষ্ঠানে গাও না, বেশ করো। এই দঙ্গলে তোমাকে মানায় না। গান তো গায় কত মানুষেই। কিন্তু পুরো সুর লাগে ক-জন গায়ক-গায়িকার গলাতে? সকলকেই যে গান কেন। গাইতেই হবে, তা ভেবে পাই না আমি!

অদিতি চুপ করে শীতের শেষবেলার বাগানের শীতার্ত গাছগাছালির দিকে চেয়ে বসে রইলেন।

কয়েক মিনিট পরে মন্দিরা আবারও বললেন, আর কি এসেছিলেন চ্যাটার্জিসাহেব তোমার কাছে? বললে না তো।

এসেছিলেন, গত শনিবারেই। অটোতে করে এসেছিলেন। লাঠি হাতে অটো থেকে নামতে গিয়ে রাস্তাতে পড়ে গেছিলেন। হাঁটুটা ছড়ে গেছিল। আমি ডেটল লাগিয়ে দিয়েছিলাম এ টি এস-ও। নিতে বলেছিলাম। পথে পড়ে যাওয়া। জানি না, নিয়েছিলেন কিনা।

কী বললেন?

কিছু তো বলেন না। চুপ করে বসে থাকেন আমার মুখের দিকে চেয়ে। গত শনিবারে আমি সেই সময়ে রান্নাঘরে ছিলাম। রান্নাঘরের দরজার সামনে উনি মোড়া পেতে বসেছিলেন।

বললাম, দুপুরে এখানে খেয়ে যান।

কী রাঁধছিলেন? উনি জিগগেস করেছিলেন।

কী আর রাঁধি? ফুলকপির ডালনা, মুগের ডাল আর পোস্তর বড়া। খেতে ইচ্ছেই করে না। নিজের জন্যে রান্না করতেও। নেহাত কিছু খেতে হবেই, তাই রান্না করা। আপনি কবে খাবেন বলুন, সেদিন ভালো-মন্দ রান্না করব। কী মাছ খেতে ভালোবাসেন বলবেন, সেই সব মাছ আনাব।

বাঃ। বহুদিন পোস্তর বড়া খাইনি। পোস্তর বড়া দিয়ে এক কাপ লিকার চা খাব। এই যথেষ্ট। আমারও ভালোবাসাবাসির দিন শেষ। শুধুমাত্র জীবনধারণের জন্যেই খাওয়া। খেতে হবে বলেই খাওয়া। তা ছাড়া যা ভালোবাসি তা বেঁধেই বা দেয় কে? বাঁচার মধ্যে আর কোনোই আনন্দ নেই।

ছেলে-মেয়ে আপনাকে তাদের কাছে গিয়ে থাকতে বলে না?

তা বলে, কিন্তু আমার যেতে ইচ্ছে করে না।

দুপুরে খেয়ে যাবেন আজ?

নাঃ। বাড়ির খাবার নষ্ট হবে।

হলই না হয়। কত মানুষের সারাটা জীবনই তোনষ্ট হয়। একবেলার খাবার না হয় আপনার নষ্টই হল।

কী বললেন উনি? মন্দিরা জিগগেস করলেন।

কিছুই বললেন না। পোস্তর বড়া আর চা খাবার পরে বললেন, আপনি অতুলপ্রসাদের গান জানেন না?

জানি। তবে বেশি নয়।

শোনানই না, একটা কি দুটো গান।

আমি গাইলাম, আমারে ভেঙে ভেঙে করো হে তোমার তরী। তারপরে গাইলাম, বিফল সুখ আশে জীবন কি যাবে।

উনি গান শুনে অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন।

আমি বললাম, আপনি এবারে শোনান।

ওঁর গান কি তোমার সত্যিই ভালো লাগে? ওঁর গলাতে তো সুরই লাগে না পুরো।

মন্দিরা দ্বিধাগ্রস্ত গলাতে বললেন।

জানি। কিন্তু উনি গান ভালোবাসেন খুব। ঈশ্বর সকলের গলাতে পুরো সুর দেন না কিন্তু তা বলে গানের প্রতি তাঁদের ভালোবাসাটা তো মিথ্যে হয়ে যায় না। গান ছাড়াও তো মানুষটির অনেকই গুণ আছে। সবচেয়ে বড়ো কথা উনি একজন ভালো মানুষ। তা ছাড়া, ওঁর গলাতে সুর যে পুরো লাগে না একথা বেচারি নিজেই জানেন না। হয়তো দুঃখ পাবেন বলে কেউ বলেওনি ওঁকে।

তাই? মন্দিরা বললেন।

তাই তো মনে হয় আমার।

জান মন্দিরা, মানুষটি যে কাঙালের মতো আমার সামনে চুপ করে বসে থাকেন এক ঘন্টা দু-ঘন্টা আমার মুখের দিকে চেয়ে, তাতে বড়ো কষ্ট লাগে আমার। কষ্ট তো আমারও কম হয় না। কিন্তু ওঁকে দেবার মতো আমার তো কিছুই নেই। আমি যদিও নারী কিন্তু আমার শরীরে তো নারীত্বের কিছু আর অবশিষ্ট নেই–যাতে একজন পুরুষ, তা তিনি যতই বয়স্ক হোন না কেন, আকৃষ্ট হতে পারেন।

শরীরই কি সব? মনটা কি কিছুই নয়?

না। মনটাই তো সব। তা তো জানিই। মন ছাড়া ওঁকে দিতে পারি এমন কিছু তো আজ নেইও আমার। তবে সব পুরুষের কাছেই মেয়েদের শরীরটাও প্রার্থনার। প্রশান্ত বেঁচে থাকলে তাকেও দিতে পারতাম না। বড়ো হীনমন্য বোধ করি। মানুষটি যদি আমার কাছে কাঙালপনা করতেন। তবে স্বস্তি পেতাম। উনি তো কিছুই চান না, মাধুকরী-করা সন্ন্যাসীর মতো চুপ করে মুখ নামিয়ে বসে থাকতেন।

তারপরে অদিতি একটু চুপ করে থেকে বললেন, যেসব কথা মুখে বলে ফেলা যায়, তা বলে ফেলতে পারলে, তার ভার অনেকই কমে যায়। কিন্তু যা বলা হয় না বা বলা যায় না, তার গভীরতা অনেকই বেশি হয়। কল্পনার ঘের দেওয়া থাকে সেই নৈঃশব্দ্যে। সেই সব সময়ে মনে হয়, নৈঃশব্দ্যের চেয়ে বাজয় বোধহয় আর কিছুই নেই।

মন্দিরা উল বোনা থামিয়ে চুপ করে অদিতির মুখে চেয়ে রইলেন অনেকক্ষণ।

একজন নারীর কাছ থেকে যা পেলে একজন পুরুষ সবচেয়ে সুখী হন তার কিছুমাত্রই তো দেবার ক্ষমতা আমাদের নেই এই বয়সে। অধিকাংশ পুরুষই খুবই বোকা হন। নারীর শরীরের দাম। তাঁদের কাছে সবচেয়ে বেশি অথচ নারীমাত্রই, অন্তত আমাদের বয়সি সব নারীরাই জানেন যে শরীর তুচ্ছ। আমাদের যৌবনেও আমরা তাই-ই জানতাম। নারী, যে-পুরুষকে মন দিতে পারে বা দেয়, তাকে তার শরীরটা সে অবহেলেই দিতে পারে। অথচ অধিকাংশ পুরুষই নারীর মনের দাম বুঝে শরীরটাকেই দামি মনে করে। তবে চ্যাটার্জিসাহেব কিন্তু অন্যরকম পুরুষ। শরীরসর্বস্ব পুরুষ নন, মন-সর্বস্ব পুরুষ।

তাই? বোনা থামিয়ে বললেন মন্দিরা।

তারপর বললেন, চলো অদিতি, এবার একবার ক্লাসে গিয়ে হাজিরা দিতে হবে। ছুটির সময় তো হয়ে যাবে একটু পরই।

চলো। হালকা খয়েরি রঙা শালটি গায়ে জড়িয়ে নিয়ে উঠলেন বেঞ্চ থেকে অদিতি। তারপর মন্দিরার সঙ্গে স্কুল বাড়ির দিকে এগোলেন।

গোকুল সেন তখনও এক দৃষ্টিতে অনড় ফাতনার দিকে চেয়ে বসে রইলেন প্রায় অন্ধকার নেমে আসাদুরের পুকুর পাড়ে। সেদিকে চেয়ে অদিতির মনে হল উনিও একজন গোকুল সেন। হয়তো উনি একাই নন, মন্দিরাও। জীবনের পুকুরে সুগন্ধি চার ছড়িয়ে বসে তো থাকেন প্রায় সকলেই ছিপ ফেলে, কিন্তু সন্ধ্যে নামার আগে ফাতনা নড়ে ওঠে আর ক-জনের?

৬.

পায়জামা পাঞ্জাবি পরে বসার ঘরে টিভির সামনে হিস্ট্রি চ্যানেল খুলে সোফাতে বসেছিলেন চ্যাটার্জিসাহেব। আর্নেস্ট হেমিংওয়ের জীবনী দেখাচ্ছে টিভিতে। হেমিংওয়ের বন্ধু এ ই হচনার এবং হেমিংওয়ের দুই ছেলের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। দুই বউয়ের দুই ছেলে। আরও বউ ছিল হেমিংওয়ের।

হেমিংওয়ের লেখার খুবই ভক্ত চ্যাটার্জিসাহেব। ওঁর দুটি জীবনীই চ্যাটার্জিসাহেব কতবার যে পড়েছেন তার ইয়ত্তা নেই। একটি ওই হচনার সাহেবের লেখা, পাপা হেমিংওয়ে আর অন্যটি খুবই স্কলাস্টিক এবং অথেনটিক লেখা, প্রফেসর কার্লোস বেকারের। কত অগণ্য মানুষের সাক্ষাৎকার যে নিয়েছিলেন বেকার সাহেব, কত মানুষকে লেখা অজস্র চিঠি যে পড়েছিলেন সেই জীবনী লেখার আগে, তা জেনে আশ্চর্য হতে হয়।

হেমিংয়ের বাবা ডাক্তার ছিলেন। তিনি এবং হেমিংওয়ে পরিবারের অনেকেই আত্মহত্যা করেছিলেন। ডা. হেমিংওয়ে ডায়াবেটিক ছিলেন। তাঁর পায়ে একটি ঘা হয়েছিল–তাঁর মনে ভয় ধরেছিল যে সেই ঘা গ্যাংগ্রিন হয়ে যাবে। সেই ভয়েই বেশ অল্প বয়েসেই তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন।

অনেকের ধারণা ইনকাম ট্যাক্সের ভয়ে শঙ্কিত হয়ে আর্নেস্ট হেমিংওয়ে আত্মহত্যা করেন। কিন্তু হচনারের বইয়ে চ্যাটার্জিসাহেব অন্য কথা পড়েছিলেন। হেমিংওয়ের স্বাস্থ্য আর আগের মতো ছিল না। উনি অ্যালকোহলিক হয়ে গেছিলেন।

অ্যালকোহলের কথা মনে পড়াতে সোফা ছেড়ে উঠে শোওয়ার ঘরে গিয়ে আলমারি খুলে ফরেন সার্ভিসের রুদ্রাংশু তাঁর জন্যে কানাডা থেকে আসার সময়ে যে এক বোতল জনি ওয়াকার ব্লু লেবেল হুইস্কি নিয়ে এসেছিলেন সেটি নিয়ে এলেন। ফ্রিজ খুলে দেখলেন সোড়া নেই। তবে বরফ আছে, কিন্তু দু-দিন হল ভালো ঠান্ডা পড়েছে কলকাতাতে, একটা হাওয়াও দিচ্ছে কনকনে উত্তরের দিক থেকে। তাই বরফ আর নিলেন না। জলের বোতল নিয়ে এলেন একটা আর। রান্নাঘর থেকে একটা গ্লাস।

তাঁর জন্যে পিণ্ডি রান্না করে মদন চলে যায়। সকালে আটটাতে আসবে আবার। তাঁকে ব্রেকফাস্টের জন্য কিছু একটা বানিয়ে দিয়ে নিজে রান্না সেরে টিভি দেখবে উনি স্কুল থেকে বাড়ি ফেরা পর্যন্ত। স্কুলের মিনিবাস এসে ওঁকে নিয়ে যায়। অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রীরাই ছেলে অথবা। মেয়ের গাড়িতে করেই যাতায়াত করেন। তাঁর একটা মারুতি ৮০০ ছিল। বিক্রি করে দিয়েছেন সোমবারেই। ড্রাইভারদের যা মাইনে হয়েছে ড্রাইভার রাখার সামর্থ্য নেই আর। চোখেও আর ভালো দেখেন না তাই নিজেও চালাতে পারেন না। ট্যাক্সিও অ্যাফোর্ড করতে পারেন না, যা ভাড়া হয়েছে আজকাল। স্কুল ছাড়া বিশেষ কোথাও যানও না। যদি যান তো অটো নিয়ে যান। গত শনিবারে যেমন গেছিলেন অদিতির বাড়ি। তবে শেয়ার-অটোতে চড়েন না। আভিজাত্যে লাগে। জানেন যে, যাঁদের সামর্থ্য নেই তাঁদের এই বোকা-বোকা আভিজাত্যের কোনো মানে হয় না। তবু…

গ্লাসে হুইস্কি ঢেলে একটু জল মেশালেন। ভারি সুথ হুইস্কি। অনেকদিন পরে খেলেন। আজকাল খান না, একা একা ভালোও লাগে না। লোকজনও ভালো লাগে না–অধিকাংশ লোকই তো। শ্রীবিন্দুরই মতো। কথা বলা যায় না। আজেবাজে মানুষের সঙ্গে সময় কাটানোর চেয়ে হিস্ট্রি চ্যানেল, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেল বা ডিসকভারি চ্যানেল দেখা ভালো।

হেমিংওয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন বড়ো করুণ কারণে। হচনার সাহেবের বইয়ে আছে।

এ জীবনে বেঁচে থেকে কী লাভ? বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে শিকারে যেতে পারি না, তাদের সঙ্গে জমিয়ে কোনো বার-এ বা রেস্তোরাঁতে মদ্যপান করতে পারি না, কোনো নারীকে বিছানাতে তৃপ্ত করতে পারি না, সবচেয়ে বড়ো কথা, চেষ্টা করেও কিছু লিখতে পারি না-তাহলে বেঁচে থেকে আর কী লাভ!

হেমিংওয়ে আভা গার্ডনার এবং আরও অনেক বিখ্যাত অভিনেত্রী ও অভিনেতার সঙ্গে শিকারে যেতেন, ফেদার্ড গেমস শিকারে। আফ্রিকার হোয়াইট হান্টার ফিলিপ পার্সিভাল এবং তার ছেলের সঙ্গে বিগ-গেমস শিকারেও যেতেন আফ্রিকাতে। স্লেজ অফ কিলিমানজারো, গ্রিন হিলস অফ আফ্রিকা ইত্যাদি বই সেই সব শিকার যাত্রার ফসল। মেন উইদাউট উইমেন বা ডেথ ইন দ্যা আফটারনুন ওঁর অন্যরকম বই। স্প্যানিস সিভিল ওয়ারের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা ফর হুম দ্য। বেল টোলস ওঁর একটি প্রধান উপন্যাস।

চ্যাটার্জিসাহেবের মাঝে মাঝেই মনে হয়েছে যে কিছু লেখেন। ইংরেজিটা উনি খুব ভালো বলতেন এবং লিখতেনও। ডিবেটেও খুব সুনাম ছিল তাঁর। ইংরেজি গানও ভালো গাইতেন। কুমুদিনী তাঁর এই বহুমুখীনতা নিয়ে ঠাট্টা করতেন। কিন্তু কুমুদিনীই তাঁর অনুপ্রেরণা ছিলেন। হঠাৎ করে কুমুদিনী চলে যাওয়াতে তাঁর জীবনের সব আলো যেন দপ করে একই সঙ্গে নিভে গেল। একেবারেই নিষ্প্রদীপ হয়ে গেল তাঁর জীবন। কিছু করতেই আর ভালো লাগে না। শুধুমাত্র অদিতিকে ভালো লাগে। অদিতির বয়স এখন বাহাত্তর আর ওঁর সাতাত্তর। এই সম্পর্কের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। এই বর্তমানের সম্পর্কও টলটলায়মান, পদ্মপাতায় জলেরই মতো, কখন যে গড়িয়ে পড়ে হারিয়ে যাবে, কেউ জানে না।

প্রতি রাতেই একা ঘরে একা বাড়িতে শুতে যাবার সময়ে ভয় হয়, রাতে হঠাৎ হার্ট বা সেরিব্রাল অ্যাটাক হবে না তো? ডাক্তারের ফোন নাম্বারটা হাতের কাছেই থাকে কিন্তু উনি জানেন যে। মাঝরাতে ফোন করলে (যদি ওঁর ফোন করার মতো অবস্থা আদৌ থাকে) ডাক্তার আসবেন না, বলবেন, অ্যাম্বুল্যান্স-এ ফোন করে দিচ্ছি আপনি সোজা নার্সিংহোমে চলে যান। মেডিক্লেইম-এর কার্ডটা নিয়ে যাবেন, ক্যাশ তো লাগবে না। আমি উডল্যান্ডস-এ বলে দেব। সকালে আমি নিজে যাব।

বড়ো অসহায় লাগে একদিনের দোর্দণ্ডপ্রতাপ হরপ্রসাদ চ্যাটার্জির। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কোলবালিশটা জড়িয়ে কুমুদিনী আর অদিতির কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমের বড়ি খেয়ে চোখ দুটি বুজে ফেললেন উনি।

৭.

ময়না মিত্তির মহিমবাবুর সঙ্গে বসে আগামী বছরের বাজেটটা ফাইনাল করছিলেন। মহিমবাবু খুবই ব্যস্ত মানুষ। প্রোমোটারের ব্যবসার সঙ্গে আরও অনেক ব্যবসা আছে ওঁর। এই স্কুলের ব্যবসার কথা তাঁর মাথাতে যখন এসেছিল তখন ভেঞ্চারটা যে এত প্রফিটেবল হবে একবারও ভাবেননি। এই বাড়িতে আর এক্সপ্যানশনের সুযোগ নেই, অন্য আর দু-টি বাড়ি দেখেছেন, যদিও এত জায়গাওয়ালা বাড়ি পাওয়া যায়নি। তবে এ বাড়িতেও তিনি মাল্টিস্টোরিড বাড়ি প্রোমোট করবেন। পুকুরটা রেখেই করবেন-ইউনিক প্রোজেক্ট হবে। বাড়ির মালিককে মোটা অ্যাডভান্সও দিয়ে দিয়েছেন। এই স্কুল অন্যত্র শিফট করাতে পারলেই বাড়ি ভাঙা শুরু হবে আগামী গ্রীষ্মে। তবে এসব কথা কাউকেই বলেননি। ময়না মিত্তিরকেও নয়।

ইতিমধ্যে কফি এল।

ময়না বললেন, সিঙাড়া খাবেন স্যার। স্কুলের গেটের বাইরেই মিষ্টির দোকানে ফুলকপির সিঙাড়া করে। চমৎকার। বলেন তো আনাই।

মহিমবাবু বললেন, আমি ইন-বিটুইন মিলস কিছুই খাই না দু-এক কাপ চা-কফি ছাড়া।

এমন সময়ে বড়ো মালি আর তনিমা দৌড়োতে দৌড়োতে ময়নার ঘরে এসে উপস্থিত।

তনিমা বললেন, শিগগিরি পুলিশে ফোন করুন ম্যাম।

কেন? পুলিশ কেন? গোকুল সেন কি পুকুরে পড়ে গেছেন? ডুবে মরেছেন? কতদিন সাবধান। করেছি সাঁতার জানেন না অথচ পুকুরে মাছ ধরার এত শখ। কী? বঁড়শিতে গাঁথা মাছ ওঠাতে গেছিলেন?

তনিমা বললেন, গোকুল সেন নন, চ্যাটার্জিসাহেব।

তাঁর আবার কী হল?

সুইসাইড।

এ কী হ্যাপা। নিজের বাড়িতে মরতে পারলেন না। মরতে আমার স্কুলে আসতে হল।-মহিমবাবু অত্যন্ত বিরক্তির সঙ্গে বললেন।

মরলেন কী করে? ময়না মিত্তির বললেন।

ততক্ষণে অন্য টিচারেরা এবং কিছু বুড়ো-বুড়ি ছাত্র-ছাত্রীও হেডমিস্ট্রেসের ঘরে ঢুকে পড়লেন।

তনিমা বললেন, নাইলনের দড়ির ফাঁস গলায় লাগিয়ে জাম গাছ থেকে ঝুলে পড়েছেন।

জাম গাছে উঠলেন কী করে?

মইটা লাগানো ছিল। তা দিয়েই উঠেছেন।

ময়না উত্তেজিত হয়ে বললেন, ছোটো মালি। ছোটো মালি। তাকে আমি সাসপেন্ড করব। পুলিশকে বলব, অ্যাবেটমেন্টের কেস দিতে। এত বড়ো ইরেসপনসিবল। কালকে আমিও দেখেছি মইটা গাছে লাগানো আছে।

মহিমবাবু শান্ত গলাতে বললেন, আগে থানাতে ফোন করুন। আমি যাচ্ছি। আমার একটা কনফারেন্স আছে।

আপনি যাচ্ছেন স্যার? আমি এখন কী করব? বলেই, ময়না ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেললেন।

আপনারা এতজন আছেন। ব্যাপারটা ট্যাক্টফুলি হ্যান্ডল করুন। ওঁর আত্মীয়দের খবর দিন।

ওঁর ছেলে আর মেয়ে দু-জনেই তো স্টেটস-এ।

অন্য কেউ নেই?

নট নোন টু আস। পুলিশকে কী বলবেন? গার্জেন কেউ নেই? এই ছাত্রকে অ্যাডমিট করেছিলেন কী করে? কে ভরতি করালো?

নিজেই ভরতি হয়েছিলেন এসে, কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে।

খুব ঝামেলা হবে। আমি আর থাকতে পারছি না। আমাকে যেতেই হবে। ঘড়ির দিকে চেয়ে বললেন, আমার খুব দেরি হয়ে গেছে।

এমন সময় শ্রীবিন্দু ঘরে ঢুকে বললেন, থানাতে ফোন করুন। ওসি-কে আমি চিনি। পুলিশ কমিশনার এবং লোকাল এম এল এ-কেও চিনি। কেলেগঙ্গার মাদুন্নার মন্দিরে ওঁরা প্রায়ই যান। খুবই জাগ্রত দেবী যে! চাটুজ্যেসাহেবকে কত্তদিন বলেছি একবার যেতে আমার সঙ্গে। ওঁর মতিগতি কিছুদিন ধরেই ভালো ঠেকছিল না। মায়ের কাছে একবার গেলেই মন প্রশান্ত হয়ে যেত।

অদিতি আর মন্দিরা জাম গাছতলায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। চ্যাটার্জিসাহেবের পরনে উরসটেড ফ্লানেলের একটি খয়েরি ট্রাউজার আর খয়েরি কর্ড-এর একটি কোট, খয়েরি শু্য-পরা পা দুটো দুলছে উত্তুরে হাওয়াতে জাম গাছেদের পাতার মধ্যে মধ্যে। বড়ো মালির লেজকাটা কুকুরটা। উপরের দিকে মুখ করে মাটিতে থেবড়ে বসে আছে। মানুষের সমাজের এই অবস্থাগতিক দেখে সে যেন একেবারে ভ্যাবাচ্যাকা মেরে গেছে।

হরিনারায়ণ সেন বললেন, সুইসাইড নোটটা ঠিক কোটের পকেটে পাওয়া যাবে। সুইসাইড নোট না রেখে মরার মতো এতবড়ো ইরেসপনসিবল চ্যাটার্জিসাহেব কখনোই হতে পারেন না। এসো মালি, বডিটা নামাই আমরা ধরাধরি করে।

শ্রীবিন্দু ততক্ষণে গাছতলাতে পৌঁছে গেছেন। বললেন, খবরদার নয়। পুলিশ আসার আগে বডিতে কেউ হাত দেবেন না।

যদি প্রাণ থেকে থাকে? অদিতি অরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন।

অদিতিকে ধমকে শ্রীবিন্দু বললেন, মাথা কি খারাপ আপনার? কখন মরে ভূত হয়ে গেছে। তারপরেই দার্শনিকের মতো বললেন, বেঁচে গেল মানুষটা! মরে, বেঁচে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *