ধর্ম ও দর্শন
বিজ্ঞান
সাহিত্য
1 of 2

মার্টিন লুথার (১৪৮৩-১৫৪৬) – ধর্মের সংস্কারক এবং ‘প্রটেস্টানিজম’ মতবাদের স্রষ্টা

মার্টিন লুথার (১৪৮৩-১৫৪৬) – ধর্মের সংস্কারক এবং ‘প্রটেস্টানিজম’ মতবাদের স্রষ্টা

ষোড়শ শতাব্দীতে ইউরোপসহ সমগ্র খ্রিস্টান বিশ্বের ধর্মীয় পুনর্গঠনের পাশাপাশি প্রোটেস্টানিজম (Protestanism) মতবাদের যিনি অভ্যুদয় ঘটিয়েছিলেন, সেই মহাপুরুষের নাম মার্টিন লুথার। তিনি তাঁর মুক্তনির্ভর রচনা আর কাজকর্মের মাধ্যমে এমন ব্যাপক আন্দোলনের সৃষ্টি করেছিলেন যে, তার ফলে খ্রিস্টান সমাজে কেবল একটি ধর্মীয় বিপ্লবই নয়, সমগ্র পাশ্চাত্য সভ্যতার ধর্মীয়, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও সাধিত হয়েছিল এক ব্যাপক পরিবর্তন।

মার্টিন লুথারের আবির্ভাবের আগে গোটা বিশ্বের খ্রিস্টান সম্প্রদায় ছিল রোমের গির্জার আওতাভুক্ত। তাদের সর্বময় কর্তা ছিলেন রোমে অবস্থানকারী মহামান্য পোপ। তখন পোপের এমন ক্ষমতা ছিল যে, ধর্মীয় ব্যাপারে যাবতীয় চূড়ান্ত মত দেবার অধিকার ছিল একমাত্র তাঁর এবং তাঁর অনুমোদিত ধর্মযাজকদের হাতে। এর ফলে ধর্মযাজকদের মধ্যে দেখা দিয়েছিল নানারকম দুর্নীতি এবং অনাচার।

মার্টিন লুথারই প্রর্বপ্রথম প্রতিবাদ জানালেন ধর্মযাজকদের বিরুদ্ধে। শুধু তা-ই নয়, তিনি বাইবেলেরও সরল অনুবাদ ও ব্যাখ্যা করে দেখিয়ে দিলেন যে, এই পুণ্য গ্রন্থের কোথাও লেখা নেই যে, পোপের ক্ষমতা ধর্মবিষয়ে চূড়ান্ত বলে গ্রহণ করতে হবে।

মহান ধর্মসংস্কারক ও সন্ন্যাসীপুরুষ মার্টিন লুথারের জন্ম হয়েছিল ১৪৮৩ সালের ১০ নভেম্বর জার্মানির থুরিনজিয়ান স্যাক্সনির অন্তর্গত ইসলেবেন নামক এক গ্রামে। পিতার নাম ছিল হ্যান্স লুথার এবং মা ছিলেন মার্গারেট লুথার। বাবা প্রথম জীবনে চাকরি করতেন ম্যান্সফিল্ডের এক দস্তার খনিতে। কিন্তু পরে তিনি খনির চাকরি ছেড়ে দিয়ে ১৪৯১ সালে ম্যান্সফিল্ড শহরের কাউন্সিলার হয়েছিলেন।

মার্টিন লুথারের বাল্যকাল কেটেছে খুব সুশৃঙ্খলভাবে। পিতার কড়া শাসন আর তত্ত্বাবধানে তাঁর প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শুরু হয় ম্যান্সফিল্ডেরই ল্যাটিন স্কুলে। এরপর ম্যাগডেবার্গের এক স্কুলে পড়েছিলেন কিছুদিন।

লুথার ১৪৯৮ সালে জার্মানির সর্বাপেক্ষা প্রাচীন ও ছাত্রবহুল বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিভার্সিটি অব এরফুর্ট স্কুল শাখা থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাস করেন।

লুথার বাল্যকাল থেকেই ছিলেন খুবই চিন্তাশীল এবং গুরুগম্ভীর প্রকৃতির। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় সবাই তাঁকে ডাকত দার্শনিক বলে। আসলেও তিনি ছিলেন দার্শনিক।

শুধু চিন্তশীলই নন, ছাত্র হিসেবেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। তিনি কৃতিত্বের সাথে ১৫০২ সালে বি. এ. এবং ১৫০৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসের মোট ১৭ জন প্রতিদ্বন্দ্বী ছেলের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে এম. এ. ডিগ্রি লাভ করেন।

এভাবে তিনি বাবা-মায়ের আশা পূরণ করলেন। তাদের স্বপ্ন, ছেলে অনেক বড় ডিগ্রি নিয়ে উচ্চশিক্ষা লাভ করবে। তাই তাঁর বাবা তাঁকে আইন পড়তে বললেন। কারণ, এ-সময় দেশে আইনজীবীদের ছিল খুবই সম্মান আর অর্থ। তাই বাবা চাইছিলেন লুথারও আইন পড়ুক। কিন্তু কোথা থেকে কী যেন হয়ে গেল। আইন পড়তে গিয়েও তাঁর আর আইন পড়া হলো না। বাপ-মায়ের একান্ত বাধ্য ছেলে লুথার কাউকে না জানিয়ে একদিন আইন পড়া ছেড়ে দিয়ে ভর্তি হলেন এরফুর্টের অগাস্টিয়ান হারমিট নামের ধর্মীয় স্কুলে।

তিনি কেন আইন পড়া ছেড়ে দিয়ে সহসা ধর্মযাজক হতে গেলেন, সে সম্পর্কে পরবর্তীকালে তিনি তাঁর টেবিল টক (Table talk) গ্রন্থে বলেছেন : সে ছিল ১৫০৫ সালের ২ জুলাই তারিখের কথা। তিনি বাবা-মায়ের সাথে সাক্ষাৎ করে ফিরে আসছিলেন। পথে পড়ে গেলেন এক মারাত্মক ঝড়ের কবলে। ঝড় ঠেলতে ঠেলতে তাঁকে নিয়ে এল স্টোটার্নহেইম নামের একটি গাঁয়ে। সেখানে তিনি আশ্রয় নিলেন এক গির্জায়। রাতে এক ভয়ংকর স্বপ্ন দেখে তিনি আতঙ্কে আর ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলেন, আমাকে বাঁচাও, সেন্ট অ্যান আমি ধর্মযাজক হবো। আমাকে বাঁচাও 1

ঘটনার মাত্র দিন পনেরো পরেই অর্থাৎ ১৭ জুলাই (১৫০৫ খ্রি.) তিনি এসে ভর্তি হলেন যাজকদের স্কুলে এবং ১৫০৬ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে পুরোপুরি যাজকের পেশা গ্রহণ করলেন। তিনি জনসমক্ষে প্রথম ধর্মীয় বক্তৃতা শুরু করেন ১৫০৭ সালের এপ্রিল মাসে।

এই সময় তাঁর জীবনে ঘটল এক মোড়-ফেরানো ঘটনা।

একদিন লুথারের বাবা তাঁর কয়েকজন বন্ধুকে সাথে নিয়ে এলেন ছেলের সাথে সাক্ষাৎ করতে। লুথার পিতার সাথে কথা বলতে বলতেই ধর্মালোচনা শুরু করলেন। শুরু করলেন রোমের তখনকার পোপের নানা অনাচার-অবিচারের কথা।

বাবা তখন রেগে গিয়ে বললেন, তোমার ধর্মগ্রন্থে অনেক কথা লেখা আছে; কিন্তু এসব কিছুতো লেখা নেই; কেমন করে পিতা-মাতাকে শ্রদ্ধা করে কথা বলতে হয়, তাও বুঝি জানো না?

লুথার আর কিছু বলতে পারলেন না। নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। এরপর বাবার সাথে তাঁর খুব একটা সম্পর্ক ছিল না।

এর কিছুকাল পরেই তিনি রোম সফরে গেলেন। রোমে এসে নিজের চোখে পোপ এবং যাজকদের সীমাহীন অধর্মাচার ও তাদের নানা উচ্ছৃঙ্খলতা দেখে তিনি শুধু মর্মাহতই হলেন না, গভীরভাবে ক্ষুব্ধও হলেন তার মন বিদ্রোহীও হয়ে উঠল। রোম থেকে তিনি জার্মানি ফিরে আসেন ১৫১১ সালে। জার্মানি এসে ধর্মশাস্ত্রে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন এবং গুটেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার কাজে যোগদান করেন। তিনি বক্তৃতার পর বক্তৃতা দিতে লাগলেন তাঁর বক্তৃতায় আকৃষ্ট হতে লাগল বিপুলসংখ্যক ছাত্র ও জনতা। ক্রমে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ল সারা বিশ্ববিদ্যালয়ে।

এই সময়ই ঘটল আরও একটা ঘটনা। গুটেনবার্গে টেটসেল নামে জনৈক রোমান ক্যাথলিক ধর্মযাজক মানুষের পাপমুক্তির জন্য অর্থের বিনিময়ে সার্টিফিকেট বিতরণ করতে শুরু করেন। তিনি কাজ করতেন আর বলতেন, এই সার্টিফিকেট বা সনদের জোরেই তারা স্বর্গবাসী হবে। তাদের সকল পাপমোচন হয়ে যাবে। লোকজন ল্যাটিন ভাষায় লিখিত বাইবেলের শ্লোকের কোনো অর্থ না বুঝেই ওগুলো কিনে নিত।

এই অনাচার লুথারের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। মানুষের পাপমুক্তির জন্য যাজকরা কেমন করে সনদ দান করতে পারে? তিনি ভাবলেন, নিশ্চয়ই ল্যাটিনের মতো দুর্বোধ্য ভাষায় বাইবেল লেখা বলেই তারা কিছু জানতে পারছে না। বুঝতে পারছে না তারা কী কিনছে। কারণ বাইবেলে কোথাও এমন কথা লেখা নেই যে, এই শ্লোক পয়সা দিয়ে কিনে নিলেই তাগের পাপমোচন হয়ে যাবে। তখনই তিনি শুরু করলেন কাজ। তিনি জার্মান ভাষায় বাইবেলের ৯৫টি টীকা ও সমালোচনা লিখে দেখালেন—বাইবেলের কোথাও এমন কথা লেখা বা বলাও নেই। এগুলো সব অনাচার, যাজকদের কারসাজি। তিনি তাঁর লিখিত থিসিস গুটেনবার্গ চার্চে টাঙিয়ে দিলেন, যাতে তা ধর্মযাজকেরা দেখতে পারেন।

তখন চার্চের ছিল দোর্দণ্ড ক্ষমতা। চার্চের কার্যকলাপের সমালোচনা করার ক্ষমতা কারও ছিল না। অবশ্য চার্চের সমালোচনা করার ইচ্ছে লুথারেরও ছিল না। তিনি শুধু বিষয়টির প্রতি চার্চের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছিলেন; চেয়েছিলেন কিছু অনাচারের প্রতিকার।

এরপর তিনি তাঁর থিসিস জার্মান ভাষায় প্রকাশ করে বিলি করতে লাগলেন। সারা দেশের মানুষ—বিশেষ করে তরুণসমাজ তাঁর নতুন মতবাদ ও ব্যাখ্যায় বিপুলভাবে সাড়া দিল। সারা দেশে গড়ে উঠল আন্দোলন——চার্চের অনাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন। তারপর কেটে গেল আরও তিনটি বছর। এই তিন বছরে লুথার তাঁর মতবাদ ও আন্দোলনের পক্ষে আরও ব্যাপক গবেষণা চালান এবং তৈরি করেন আরও কিছু গবেষণাধর্মী গ্রন্থ।

প্রথম প্রথম পোপ ব্যপারটিকে খুব একটা পাত্তা দেননি। কিন্তু আন্দোলন যখন ব্যাপক আকার ধারণ করল, তখন তাঁর টনক নড়ল। ১৫২০ সালে মহামান্য পোপ মার্টিন লুথারকে সমাজচ্যুত করার জন্য এক ডিক্রি জারি করলেন। লুথারও পোপের এই অন্যায় আদেশের তীব্র প্রতিবাদ করে তার সমস্ত যুক্তি খণ্ডন করলেন।

এর পরের বছর অর্থাৎ ১৫২১ সালে পোপ রোমান সম্রাট পঞ্চম চার্লসকে এই মর্মে নির্দেশ জারি করার অনুরোধ করলেন যে, চার্চ-বিরোধী মার্টিন লুথারকে যেন কোনো রকম আইনের আশ্রয় না দেওয়া হয়।

তখন পোপের অনুরোধে রাজা চার্লস জার্মান প্রিন্সকে তাঁর দেশেই লুথারের বিচার করার নির্দেশ দিলেন। জার্মানি তখন ছিল রোমান সাম্রাজ্যের অধীনস্থ। ফলে জার্মান প্রিন্স বাধ্য হয়েই মার্টিন লুথারের বিচারের ব্যবস্থা করলেন।

কিন্তু এই বিচার-অনুষ্ঠানেও খুব সুবিধা হলো না। বিচারসভায় স্যাক্সনিদের সমর্থনে মার্টিন লুথার মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়ে গেলেন।

শুধু তাই নয়, জার্মানিতে রোমান ক্যাথলিক চার্চের অধীনে যে বিশাল স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ছিল, তার সবটাই বাজেয়াপ্ত করা হলো। আর এমনি করে উত্তর, দক্ষিণ ও কেন্দ্রীয় জার্মানির গোটা অংশই চলে এল লুথার-সমর্থকদের দখলে। গোটা খ্রিস্টান সমাজ হয়ে গেল দুই প্রধান অংশে বিভক্ত। মার্টিন লুথারের সমর্থকরা হলেন প্রতিবাদী দল বা প্রোটেস্টান্ট, আর যারা পুরনো পোপের দলে রইল তারা হলেন রোমান ক্যাথলিক। এই বিভক্তি আজও আছে খ্রিস্টানদের মধ্যে।

মহাপুরুষ মার্টিন লুথার দেহত্যাগ করেন ১৫৪৬ খ্রিস্টাব্দে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *