মাপ
এ কী! হাতল দুটো এরকম করলেন?
আঁজ্ঞে?
কী যে সবসময় আঁজ্ঞে আঁজ্ঞে করেন নিলুবাবু! আপনাদের কি আক্কেল বলে কিছু নেই?
আঁজ্ঞে?
আবার আঁজ্ঞে? দেখছেন যে, কীরকম মোটা হয়ে গেছি। পা দুটো জোড়া করে দিনে দশ ঘণ্টা বসে থাকা যায় মশাই?
না, আঁজ্ঞে।
কমন সেন্স, যা হচ্ছে গিয়ে সবচেয়ে আনকমন; তাই-ই নেই মশাই আপনাদের একটুও।
আঁজ্ঞে।
এই হাতল দুটো অনেক ছোটো করতে হত, যাতে পা দুটো একটু ছড়িয়ে বসতে পারি। কতবার বোঝালাম আপনাকে, তবুও আপনি বুঝলেন না?
আঁজ্ঞে। কিন্তু কারিগরের স্ত্রীর মেয়েলি অসুখ হয়েছে। সে তো পনেরো দিনের ছুটি নিয়ে ডায়মণ্ডহাবরাতে চলে গেছে।
জাহান্নামে যাক মশাই। আপনাদের মতো বুড়ো-হাবড়াদের দিয়ে আমার কাজ চলবে না। কাজের লোক তার অফিসে, তার চেয়ারে বসেই জীবনের তিন-চতুর্থাংশ সময় কাটিয়ে দেয়। সেই চেয়ারাটাই যদি একটু আরামের না হয় তা হলে—
আঁজ্ঞে। আমি পনেরো দিন পরে আবার আসব হাত দুটো ছোটো করে কেটে দেব।
থ্যাঙ্ক ইউ। আপনাকে আর আসতে হবে না। ততদিনে আমার দুটি ঊরুতে ফাংগাস গজিয়ে যাবে মশাই। আপনি এবারে আসুন।
আঁজ্ঞে।
হরিপদ। বলে, ডেকেই, বড়োবাবু কলিং বেল টিপলেন।
হরিপদ এল ঘরে।
কী? তোমাদের ব্যাপারটি কী?
কী স্যার?
কী স্যার? একটা চেয়ার নিয়ে আর কতদিন ধস্তাধস্তি করব বলতে পারো? যে চেয়ারে বসে কাজ, যে চেয়ারটিই সব; সেটিকেই ঠিকমতো করে দিতে পারছ না। এই দেখো, এই যে! বলেই বড়োবাবু যেই সজোরে বসতে গেলেন অমনি রিভলভিং চেয়ারের পায়ার নীচের একটি ক্রোমিয়াম-প্লেটেড লোহার বল গড়গড়িয়ে চলে গেল টেবিলের নীচে। বড়োবাবু কাত হয়ে পড়লেন ডান পাশে। চেয়ারটা সামান্য হেলে গেল। ডানে। মাই গুডনেস!
বলেই উনি লাফিয়ে উঠলেন চেয়ার ছেড়ে।
তাঁর সঙ্গে সঙ্গে হরিপদও লাফিয়ে উঠল।
অফিসের সবাই বলে যে, হরিপদ বড়োবাবুর ছায়া। বড়োবাবু লাফালে হরিপদও লাফায়, বড়োবাবু রেগে গেলে হরিপদ রাগে; বিষণ্ণ হলে বিষণ্ণ। হরিপদরই মতো অনেক সাফারি-স্যুট পরা বড়ো বড়ো অফিসারও আছেন এই মস্ত কোম্পানিতে। তাঁরাও বড়োবাবুকে দেখে ওইরকমই করেন অনেকটা। মোসোহেবির শিল্পে তবু হরিপদ এক দারুণ শিল্পী। বড়োবাবু সেটা জানেন। এবং জেনেও পুলকিত হন। প্রত্যেক মূর্খ বড়োবাবুই মোসাহেবির শিকার হয়ে থাকেন। স্বয়ং ভগবানই হন, বড়োবাবুরা তো কোন ছার!
কিন্তু চেয়ারটা?
বড়োই ব্যতিব্যস্ত বড়োবাবু একবছর হল এই চেয়ার নিয়ে। মনের মতো, নিজের জন্য আরামসই একটা চেয়ার; কিছুতেই জোগাড় করতে পারছেন না তিনি।
এসব নিলুবাবু ফিলুবাবুকে দিয়ে হবে না হরিপদ। বাঙালির এইজন্যই ব্যাবসা হয় না। সেলসম্যান যদি যে জিনিস বিক্রি করছেন নিজে সেই জিনিস সম্বন্ধে হাতে-কলমের জ্ঞান না রাখেন, তা হলে সেলসম্যান-শিপে আর প্রোডাক্ট-এর মধ্যে একটা ফাঁক থাকতে বাধ্য। মালিক আর সেলসম্যানরা খালি কথার তুবড়ি ফোটাচ্ছেন, আর কাজের বেলায় ডায়মণ্ডহাবরার যদু ছুতোর। ছ্যা: ছ্যা:।
হরিপদ!
স্যার!
চীনে মিস্ত্রি নেই এ-পাড়ায়?
টেরিটিবাজারে আছে।
শোনো। মিস সেনকে বলো এক্ষুনি পার্ক স্ট্রিটে ফোন করবে। বেয়ারাদের কাউকে পাঠাও চেয়ারের লিটারেচার নিয়ে আসবে।
স্যার।
চীনে ছুতোরের কাছেও যাও। মাপমতো একটা চেয়ার এনে দিতে পারলে না তোমরা। ওয়ার্থলেস সব। যে কোম্পানির বড়োসাহেবের চেয়ার ঠিক থাকে না, তা উঠে যেতে বাধ্য। লালবাতি জ্বলে যাবে।
বলেই, ঘরের লালবাতির সুইচ টিপে দিলেন। ঘরে এখন কারোরই ঢোকা মানা। অত্যন্ত আপসেট তিনি। চেয়ারে বসলেই ডাইনে কাত হয়ে যাচ্ছে চেয়ারটা। ডিসগ্রেসফুল। মনে মনে তিনি একজন লেফটিস্ট। ইনটেলেকচুয়াল মানুষ তো! ডাইনে এমন কেতরে বসে থাকতে দেখলে লোকে কী বলবে? ছ্যা:।
ঘণ্টাখানেকের মধ্যে হরিপদ পার্ক স্ট্রিট থেকে ছবিটবি আঁকা লিটারেচার নিয়ে এল। একজিকিউটিভ চেয়ার। সিংহাসনের মতো। এত উঁচু যে, তাতে বসে, তাঁর টেবিলের সামনে উলটোদিকে যাঁরাই বসবেন, তাঁদেরই পিগমি বলে মনে হবে। মডার্ন ম্যানেজমেন্টের এও একটা ভাঁওতা। মানুষের ভেতরের জিনিস যতই কমছে তার চেয়ারের উচ্চতা ও প্রস্থ ততই বাড়ছে।
না:। বড়োসাহেবের চেয়ারটা বেঁটেখাটো গোলগাল। ওই চেয়ারে বসলে তিনি নিজেই চেয়ারটার পটভূমিতে বেপাত্তা হয়ে যাবেন। চলবে না।
হরিপদ।
স্যার।
চীনে মিস্ত্রি!
স্যার।
চীনে মিস্ত্রি এল ঘণ্টাখানেক পর। দর্জিকে যেমন করে ট্রাউজারের মাপ দেন তেমন করে তাঁর পশ্চাৎদেশ, ঊরু, কোমর, ঘাড় ইত্যাদির মাপ দিলেন বড়োবাবু। মিস্টার চুং ফিংকে বলে দিলেন যে, এমন একটা চেয়ার তিনি চান, যে চেয়ারে বসে চাকরি-জীবনের বাকি আটটা বছর নিশ্চিন্তে, আরামে কাটিয়ে দিতে পারেন।
থ্যাঙ্ক ইউ। বলে, ফিং চলে গেলেন।
২
আজ চুং ফিং কোম্পানির চেয়ার আসবে। সকালে দাড়ি কামাতে কামাতেই উত্তেজিত বোধ করতে লাগলেন বড়োবাবু। চাপা উত্তেজনা; পরকীয়া প্রেমে যেমন হয়।
অফিসে যেতেই, সেক্রেটারি মিস সেন বললেন, গুড মর্নিং স্যার। বিহারের ডিলারদের সঙ্গে কনফারেন্স আছে এগারোটায়।
কনফারেন্স রুমে বসিয়ে কফিটফি খাওয়াতে বলবেন ওঁদের। আই মে বি আ লিটল লেট।
নিজের ঘরে ঢুকেই দেখলেন চেয়ারটাকে। বা:! ঝরাপাতার মতো ফিকে হলুদ রং। ফোম-লেদারের কুশান। ক্রোমিয়াম প্লেটেড পায়া, হাতল, পায়ার নীচের চারটে বল। রিভলভিং চেয়ার তো? ঠেলে দেখলেন একটু পেছনে হেলিয়ে। বা:। বসে বসে স্বপ্নও দেখা যায়, এমন চেয়ারে।
ইনটারকম চিঁ চিঁ করে উঠল হঠাৎ।
শাট আপ।
চেঁচিয়ে উঠলেন বড়োবাবু। লালরঙা রিসিভারটা তুলে মিস সেনকে বললেন, আধ ঘণ্টা কোনো কল দেবেন না আমাকে। নট ইভিন ইন্টারনাল কলস।
ঠাক করে রিসিভারের গর্তে রিসিভারটাকে নামিয়ে রেখে আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলেন চেয়ারটার দিকে। এমনভাবে, চেয়ারটা যেন ফুলশয্যার রাতের বউ-ই!
চেয়ারটার সামনে অ্যাটেনশানে দাঁড়ালেন একবার, মনে মনে স্যালুট করলেন। তার পর ঘুরে আস্তে আলতো করে পশ্চাৎদেশ নামালেন; হাঁস তার শরীরকে যেমন করে জলে নামায়।
আটকে গেছেন বড়োবাবু। চেয়ারটায় একেবারেই আটকে পড়েছেন। অক্টোপাসের মতো চীনে-চেয়ারটা একেবারে কামড়ে ধরেছে তাঁকে। নড়তে-চড়তে পারছেন না পর্যন্ত। এ কী চক্রান্ত মিস্টার চুং ফিং-এর? বেল টিপলেন পাগলের মতো। ঝড়ের মতো হরিপদ এসে ঢুকল।
স্যার!
আমাকে ওঠাও।
স্যার?
আমাকে চেয়ার থেকে তোলো। চেয়ারের সঙ্গে আটকে গেছি আমি।
হ-রি-প-দ।
স্যার।
বলেই, রোগা-সোগা হরিপদ আপ্রাণ চেষ্টা করল বড়োবাবুকে চেয়ার থেকে ছাড়াতে। কিন্তু পারল না। মনে হল, জীবনের মতো আটকে গেছেন।
বড়োবাবুর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। বললেন, চেয়ারটা ঘুরিয়ে দাও তুমি। জানলার দিকে মুখ ফিরিয়ে দাও আমার। হ-রি-প-দ।
হরিপদ সামান্য গায়ের জোরের সমস্তটুকু খরচ করে ঘুরিয়ে দিল চেয়ারটাকে। সহজেই ঘুরে গেল সেটা।
যাও হরিপদ।
হরিপদ চলে যাচ্ছিল ঘর ছেড়ে। বড়োবাবু ডাকলেন, বললেন, শোনো, কাউকে কিন্তু বোলো না।
স্যার।
কাউকেই বোলো না যে আমি আটকে গেছি আমার চেয়ারে।
না স্যার!
রুম-এয়ারকণ্ডিশানারের ফিসফিস শব্দ আসছিল। অনেক নীচে ক্যামাক স্ট্রিট দেখা যাচ্ছে। গাড়ি যাচ্ছে সারি দিয়ে। লোহালক্কড়, শেয়ার, ফাউন্ড্রি, চা ও মার্বেলের এক্সপোর্ট। অনেকই ব্যাবসা এই কোম্পানির। অনেক মাইনে বড়োবাবুর। পারকুইজিটস। দালালি, কমিশন, খাতির, উপরি, ডানে এবং বাঁয়ে। বড়োই আঠা।
আকাশে চিল উড়ছে। এই ঘরে বসে চিলের কান্নাও শোনা যায় না।
কলকাতার আকাশে এখনও অনেক নীল। মানুষের দেখারই সময় নেই শুধু।
নিজেই তো মাপ দিয়ে বানালেন চেয়ারটাকে। এই চেয়ারের চেয়ে নিজের মাপটা বোধ হয় বড়ো বলে ভেবেছিলেন উনি।