মাপো আর জপো
“যার আছে সে মাপো, যার নেই সে জপো”–শ্রীশ্রীমায়ের কথা। যার আছে অর্থাৎ যার বিষয়-সম্পত্তি জমি-জিরাত আছে সে সারাজীবন কি করে? কত ধানে কত চাল, সারাটা জীবন ঐ করে যায়। কোথায় টাকা খাটালে কত সুদ, তার হিসাব কষে। সিন্দুক-ভর্তি কোম্পানির কাগজ রোজ বার করে। আর রোদ খাওয়ায়। ডিভিডেন্ডের হিসাব কষে।
শ্রীশ্রীমা বলেছেন : “ঈশ্বরের কৃপায় যার বিষয়-সম্পত্তি আছে সে ‘মাপুক’ অর্থাৎ দান করুক।”
আবার এ মানেও হতে পারে, ভিতরে যদি আধ্যাত্মিকতার উন্মেষ হয়ে থাকে তাহলে পরিমাপ কর, রোজই তা বাড়ছে কিনা! মানুষের দু-রকমের চলন। এক চলা বাইরের—কলকাতা থেকে কানপুর চলে গেল। আরেক চলা ভিতরের। মন-পথিক! তুমি কতটা এগোলে? সংসার থেকে তোমার দূরত্ব কতটা বাড়ল! তোমার দেহ থাক তোমার মন কি বেরতে পেরেছে? তুমি কি ‘বাবুর বাড়ির দাসী’র মন পেয়েছ? মুখে বলছে বটে আমার কানু, আমার গোপাল, মন পড়ে আছে দেশের বাড়িতে। সেখানে আছে তার নিজের ছেলেমেয়ে, নিজের সংসার। তোমার মন কি নষ্ট-নারীর মতো হয়েছে? সে কি রকম? হেঁসেলে সব কাজই করছে, মন উসখুস করছে, কখন ভেসে আসবে সেই পরপুরুষ—প্রাণের মানুষটির শিস। তখন আমার ঘরেই থাকা দায়।
‘পড়ে থাক মনের বোঝা ঘরের দ্বারে-
যেমন ওই এক নিমেষে বন্যা এসে
ভাসিয়ে নে যায় পারাবারে।।”
সেইরকম আমিও ভেসে যাই ‘পান্থজনের সখা’র হাত ধরতে। তখন আমি সকলেরই অনেক পর। কে তোমরা? পুত্র, কন্যা, পিতা, মাতা। ঠাকুর বলেছেন, সংসার যদি করতেই হয় তো করবে বাইরে থেকে। ‘বাবুর ফুলবাগানের মালি’র মন নিয়ে। আমার পুকুর, আমার আমগাছ। এই দেখুন কেমন ফুলের বাহার লাগিয়েছি। যেদিন বাবু দূর করে দেবেন ঘাড় ধরে, সেদিন গেট পেরিয়ে এসে নিজের ফেলে যাওয়া পোঁটলাটিও নেবার উপায় থাকবে না। মানুষকে জীবন-বাগানে যিনি বহাল করে গেলেন, তাঁর হাতে কিন্তু ডিসচার্জের ক্ষমতা নেই। এই বাগানের মালিক হলেন মৃত্যু। তাঁর সেরেস্তায় জীবের নিয়োগ-খাতা। চাকরির মেয়াদের হিসাব তিনিই রাখছেন। তিনিই সই করছেন ডিসচার্জ নোটিশ।
ঠাকুর বলছেন, আমি, আমার—এইটি হলো অজ্ঞান। তুমি, তোমার—এই হলো বিজ্ঞান। তাহলে মাপো, সেই জ্ঞান তোমার কতটা হলো! যদি দেখা যায় আসক্তি আছে, তাহলে বুঝতে হবে কষ্টও আছে। ঠাকুর বলছেন, বলদ হাম্বা হাম্বা করে। হাম-বা। আমি, আমি। চাষা তাকে লাঙলে জুতছে, কলু তাকে দিয়ে ঘানি ঘোরাচ্ছে। পিটছে, কষ্ট দিচ্ছে, গাড়ি টানাচ্ছে। বলদ কেবল হাম্বা, হাম্বা করছে। একদিন তার মৃত্যু হলো, নাড়ি-ভুঁড়ি থেকে তৈরি হলো তাঁত। চড়ল গিয়ে সারেঙ্গিতে, একতারাতে। শব্দ বেরল তুঁহু তুঁহু। তখন সে উদ্ধার পেয়ে গেছে। জীব জীবনেই যদি ক্লেশমুক্ত হতে চায় তাহলে তাকে ঐ তুঁহু মন্ত্ৰ নিতে হবে—’তুঝসে হামনে দিলকো লাগায়া, যো কুছ হ্যায়, সো তুহি হ্যায়। সব তুমি। এখন মেপে দেখ, সত্যিই সব ব্যাপারে এই বোধ তোমার পাকা হয়েছে কিনা। মন দেখ! মুখে মানুষ অনেক কথা বলতে পারে। তার কোন মূল্য নেই। নিজেকেই নিজে ফাঁকি দিলে কিছু করার নেই। ঠাকুর বলতেন : “এক- আনা দু-আনা নয়—ষোল আনা বিশ্বাস চাই।” সেই বিশ্বাস তুমি মাপো; যদি দেখ নেই, তাহলে?
সত্যিই কি নেই! ঠাকুর গল্প বলছেন : “মাঝরাতে বাবুর ঘুম ভেঙেছে। ইচ্ছা হয়েছে—একটু তামাক খাবেন। সবই আছে—কল্কে, তামাক, টিকে, ঠিকরে। নেই কেবল চকমকি পাথর। টিকে ধরাবেন কিসে! প্রবল বাসনা, তামাক একটু খেতেই হবে। লণ্ঠন হাতে বেরিয়ে পড়লেন চকমকি পাথরের সন্ধানে। প্রতিবেশীকে ঠেলে তুললেন। তিনি অবাক হয়ে বললেন, ‘সে কি! চকমকি পাথর! আরে আগুন তোমার হাতে! তোমার লণ্ঠনে।”
এই হলেন গুরু! “যা চাবি তা বসে পাবি খোঁজ নিজ অন্তঃপুরে।” দর্পণে দেখ নিজের মুখ। কাঁচ অপরিষ্কার! ঝাপসা দেখাচ্ছে। তাহলে কাঁচের কাছে মুখ এনে একবার হা কর। তারপর মোছ, সব পরিষ্কার। এই ‘হা’ হলো জীবের হাহাকার। মার্জনা হলো সৎকর্ম। ঠাকুর বলছেন, গীতায় কি আছে? তাগী, তাগী, তাগী। দশবার বললেই গীতা হয়ে গেল। ত্যাগই আসল। বাইরে ত্যাগ নয়, মনে ত্যাগ। তোমার দু-হাত দিয়ে যা ধরে আছ, যা ধরার চেষ্টা করছ, ছেড়ে দাও। তাঁকে ধরতে দাও তোমার হাত। তিনি ধরলে আলের পথে তোমার আর পড়ার ভয় নেই!
শ্রীশ্রীমা বললেন, তুমি জপো। তোমার ঘোলা জলে জপের নির্মলি ফেল। বালতির জলের তলায় একটি স্বর্ণকান্তি মোহর আছে। জল ঘোলা তাই দেখতে পাচ্ছ না। নির্মল হলেই দেখতে পাবে। ছোট ছোট ঢেউ খেলছে, কামনা- বাসনার ঢেউ, তাই বিম্ব ধরা পড়ছে না। তুমি জপো। মন স্থির কর। জপতে জপতে তৈরি হবে জপের শরীর। তখন তুমি সূক্ষ্মকে ধরতে পারবে। সূক্ষ্মেই সেই বিশালের বিচরণ। অবিশ্বাসী সংসারী মানুষ থেকে, বিষয়ীর কাছ থেকে দূরে থাক। বিশ্বাস পাকা হয়ে গেলে আর কোন ভয় থাকে না।
তবে একটা কথা, খুব রোখ চাই। ভোগের নামমাত্র থাকলে তাঁর সঙ্গে যোগ হবে না। জীব ছুঁচ, ঈশ্বর চুম্বক। তিনি টানবেনই; কিন্তু ছুঁচে যদি মাটি লেগে থাকে! চুম্বক টানবে না।
তাহলে জপো। জপে বিশ্বাস। জপে অশ্রু। অশ্রুধারায় নির্মল। কাঠ যতক্ষণ ভিজে ততক্ষণ আগুন জ্বলবে না। সোঁ সোঁ শব্দ, ধোঁয়া। যেই ধরে গেল তখন লকলকে শিখা। জপে সেই সংসার-রস মরবে। আধ্যাত্মিকতায় ঝনঝনে খনখনে হবে।
তাই যার নেই সে জপো। “লাগি লগন মীরা হোগই মগন।।“