মানুষের পৃথিবী
পৃথিবী মানুষের। মানুষ পৃথিবীকে বাসোপযোগী করেছে। নিজেদের সুবিধে মতো ভাগ করেছে টুকরো-টুকরো করেছে। সীমানা চিহ্নিত করেছে। রাজ্যপাট সাজিয়েছে। শাসন করেছে। রাজতন্ত্র থেকে উত্তীর্ণ হয়েছে গণতন্ত্রে, সমাজতন্ত্রে। বিজ্ঞানের সাহায্য নিয়েছে। প্রযুক্তিকে নিয়োজিত করেছে উৎপাদনের কাজে। প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। প্রকৃতিকে করেছে বন্ধু। বেঁচে থাকার জৈবপ্রয়োজন মিটে যাবার পর, শিল্প-সংস্কৃতি-আধ্যাত্মিকতার অনুশীলন করেছে। ইতিহাসের দীর্ঘ পথ ধরে সময় আজ চলে এসেছে একবিংশ শতাব্দীর প্রবেশ পথে।
মানুষই সব। কোন মানুষ? একই সঙ্গে যে-মানুষ ভাঙে, গড়ে। যে-মানুষ দেবতা হতে পারে আবার দানবও হতে পারে। মানুষেরই সৃষ্ট বাধা অতিক্রম করে মানুষ এগিয়ে চলেছে। স্বপ্ন ভাঙছে, স্বপ্ন গড়ছে। একজন বা দু-জন মানুষের পৃথিবী নয়। বহু মানুষের পৃথিবী; কিন্তু ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে এক একজন মানুষই সময়ের এক-এক পদে জাতিকে পরিচালনা করেছেন। কখনও তাঁর নাম হয়েছে রাজা, কখনও প্রধানমন্ত্রী। কখনও রাষ্ট্রপতি।
যখন রাজা, তখন তাঁর ব্যক্তিগত চরিত্র নিয়ন্ত্রণ করেছে জাতির ভাগ্য। কখনও তিনি অত্যাচারী, ভোগী, লোভী, আগ্রাসী। গ্রাস করতে চেয়েছেন প্রতিবেশীর রাজত্ব। প্রজাসাধারণকে লিপ্ত করেছেন জনক্ষয়কারী যুদ্ধে। কখনও তিনি বিজেতা, কখনও বিজিত। যখন বিজেতা তখন সাধারণ মানুষ প্রাণের বিনিময়ে সামান্য প্রসাদ হয়তো পেয়েছে ঐশ্বর্যের। যখন বিজিত তখন সাধারণ মানুষ নিগৃহীত হয়েছে, নারীরা ধর্ষিতা হয়েছে। মানুষের বিশেষ করে একজন মানুষের লোভ ও নীতিকে অনুসরণ করে এসেছে যুদ্ধ। মানুষের ইতিহাস হল অসংখ্য যুদ্ধ ও জয় পরাজয়ের ইতিহাস। রাজ্য জয় অথবা রাজ্যক্ষয়। মানুষের নিয়তি লোভ ও হঠকারিতা।
রাজা আর ডিক্টেটারদের পাশাপাশি মাথা তুলেছেন জনপ্রতিনিধি, চিন্তাবিদ, মানবদরদী, কল্যাণকামী বিদ্রোহী। ক্ষমতাশালী স্বেচ্ছাচারীর হাত থেকে মুক্ত করতে চেয়েছেন লক্ষ মানুষের ভাগ্য। পৃথিবীর স্থানে-স্থানে ঘটে গেছে বিপ্লব। কখনও ধর্মগুরুর বিরুদ্ধে, কখনও অত্যাচারী রাজার বিরুদ্ধে। মানুষের অভিজ্ঞতার ভান্ডারে সঞ্চিত হয়েছে চিন্তার ঐশ্বর্য। তৈরি হয়েছে বিজ্ঞাননির্ভর শাস্ত্র। প্রণীত হয়েছে অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি, শিক্ষানীতি। বিজ্ঞান পৃথিবীর মানুষকে কাছে এনেছে। ভৌগোলিক ব্যবধান কমিয়েছে। মহাকাশে হাত বাড়িয়েছে। অসির শক্তিকে খর্ব করে প্রতিষ্ঠা করেছে মসির শক্তি। দেহের সঙ্গে যুক্ত করেছে মন ও মনন। ভোঁতা রাজা কিংবা স্বার্থান্বেষী রাজনীতিক লজ্জা পেতে শুরু করেছেন। পেশীমানবের পাশাপাশি জ্ঞানীমানব শক্তিশালী হয়েছে। রাজন্যবর্গ ঘুমিয়ে পড়েছেন ইতিহাসের পাতায়।
তবু দ্বন্দ্ব ঘোচেনি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হয়েছে। পৃথিবী বিভক্ত হয়েছে ধনতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রে। যুদ্ধ থেমেও থামেনি। দুই তন্ত্রের ঠান্ডা লড়াই যেন একালের পথেঘাটের সস্তা স্লোগান—চলছে চলবে। এসেছে মগজ ধোলাইয়ের যুগ। গণতন্ত্রের বাতাবরণে রাষ্ট্রনেতা নীতির ধোঁয়াশা তৈরি করে জনজীবনকে শৃঙ্খলিত করার চেষ্টা করেছেন কোনও-কোনও দেশে। বিদেশি বহি:শত্রুর জুজুর জয় দেখিয়ে নির্বিচারে বাড়িয়ে গেছেন সমরশক্তি। নিজের দেশের মানুষকে কড়া ঘেরাটোপের মধ্যেরেখে বিভ্রান্ত করেছেন। সঠিক অবস্থা বোঝার সুযোগ দেননি। সরকারি প্রচার মাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে বোঝাতে চেয়েছেন, আমরাই পৃথিবীর একমাত্র শক্তিশালী জাতি। অন্যদিকে ধনতন্ত্রের স্বাধীন হাওয়ায় গণতান্ত্রিক বিশ্ব বহুদূর এগিয়ে গেছে।
তৃতীয় বিশ্বেও মানুষ আজও অশুভশক্তির পদানত। দারিদ্র্য, দুর্ভিক্ষ, বর্ণবৈষম্যের শিকার। বেদান্তের দেশ, অহিংসার দেশ ভারত সর্ব অর্থে জেরবার। ভন্ড, অপদার্থের দল পশুবল সম্বল করে দলীয় উন্মত্ততার তান্ডব চালিয়েছে। ফিরে এসেছে সামন্ততন্ত্র আধুনিক চেহারা নিয়ে। যার অধীনে যত বড় গুন্ডাবাহিনী সে তত বড় নেতা। সম্প্রতি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীবগান্ধির শোচনীয় মৃত্যু প্রমাণ করেছে, ভারতের মানুষ নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে মুষ্টিমেয় উচ্চাভিলাসী সমাজবিরোধীদের দ্বারা।
এই হল মানুষ এই হল মানুষের পৃথিবী। দানব ও দেবতার লীলাভূমি।