মানবী
কাহিনীর সূত্রপাত আজ হইতে পঞ্চাশ বছরেরও আগে। বিংশ শতাব্দীর বয়স তখন অনুমান ছয় বৎসর।
বাগবাজার নিবাসী কৃষ্ণকান্ত দাসের গৃহে উৎসবের ধুম লাগিয়া গিয়াছে। তাঁহার একমাত্র পুত্র রাধাকান্তের বিবাহ। কৃষ্ণকান্ত বিত্তবান ব্যক্তি, কাগজের ব্যবসা করিয়া তিনি ভাগ্যলক্ষ্মীকে প্রসন্ন করিয়াছেন। তাঁহার লক্ষ্মীশ্ৰী দিনে দিনে বাড়িতেছে। কিন্তু তিনি বিপত্নীক। বয়স এখনও পঞ্চাশ পূর্ণ হয় নাই।
বিবাহ উপলক্ষে আত্মীয়-কুটুম্বে ঘর ভরিয়া গিয়াছে। রসুনচৌকি বাজিতেছে। আজ বর-বধূ গৃহে আসিবে। বাড়ির সদর উঠানে আলপনা পড়িয়াছে; ফটকের মাথায় তোরণমাল্য। কন্যাপক্ষ কলিকাতারই বাসিন্দা, এখনি বর-কনে আসিবে। বাড়িতে স্ত্রীলোকের সংখ্যাই বেশী, কারণ পুরুষ আত্মীয়েরা সকলেই বরযাত্র গিয়াছে।
রসুনচৌকির মিঠা আওয়াজ চাপা দিয়া মোড়ের মাথায় গোরার ব্যান্ড শোনা গেল। দমাদম শব্দে চারিদিক সচকিত করিয়া শোভাযাত্রা আসিয়া পড়িল। সামনে ব্যান্ড বাজাইতে বাজাইতে পদাতিক গোরার দল, পিছনে দীর্ঘ বিসর্পিত ঘোড়ার গাড়ির সারি। প্রথমেই একটি পুষ্পমাল্যমণ্ডিত ল্যান্ডো গাড়ি, তাহাতে বর ও বরকর্তা শোভা পাইতেছেন। অনন্তর পিছনে মখমলের ঘেরাটেপ ঢাকা পালকি; ইহার মধ্য আছেন নববধু। অতঃপর নানাজাতীয় যানবাহনের মধ্যে বরযাত্রীর দল।
বাড়ির বর্ষীয়সী মেয়েরা ফটকের বাহিরে উকি মারিয়া উত্তেজিত স্বরে বলিতে লাগিল— ‘ঐ আসছে—ঐ বর-কনে আসছে!’
শোভাযাত্রা বাড়ির সম্মুখে থামিল, গোরার বাদ্যও নীরব হইল। কৃষ্ণকান্ত লাফাইয়া ল্যান্ডো হইতে নামিয়া পড়িলেন, পিছন পিছন রাধাকান্তও নামিল। রাধাকান্তের মাথায় জরিদার টুপি, আগাপাস্তলা লাল মখমলের পোশাক। তাহার বয়স বারো বছর।
কৃষ্ণকান্ত একটু ব্যস্তবাগীশ লোক, গাড়ি হইতে নামিয়াই উচ্চকণ্ঠে হাঁকাহাঁকি শুরু করিলেন— ‘কোথায় গেল সব! বর-কনে নিয়ে এলুম, সবাই হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছিস! চন্দ্রমুখী কৈ? কেষ্টমণি!— ওরে, শিগ্গির ঘড়ায় করে জল নিয়ে আয়— মঙ্গলঘট—কনে বৌ-এর পালকির সামনে জল ঢাল—’
দুইজন সধবা স্ত্রীলোক কাঁখে কলসী লইয়া আগাইয়া আসিল এবং পালকির সামনে জল ঢালিয়া দিল। কৃষ্ণকান্ত তখন সগর্বে গিয়া পালকির ঘেরাটোপ তুলিয়া দিলেন এবং পালকির ভিতর হইতে একটি মেয়েকে টানিয়া কোলে তুলিয়া লইলেন। মেয়েটির বয়স বড়জোর সাত বছর, সোনার গহনায় সর্বাঙ্গ মোড়া। কৃষ্ণকান্ত মহানন্দে বলিলেন—‘দ্যাখো, দ্যাখো, কেমন বৌ এনেছি দ্যাখো! যেমন দেখতে তেমনি নাম— দেবী! সাক্ষাৎ দেবী— সাক্ষাৎ মা জগদ্ধাত্রী! কৈ রে রাধাকান্ত, কোথায় গেলি! শিগ্গির আয়, আমার পাশে এসে দাঁড়া।’
রাধাকান্ত দ্রুত আসিয়া বাপের পাশে বুক ফুলাইয়া দাঁড়াইল। কৃষ্ণকান্ত হাঁকিলেন— ‘আরে, ফটোগ্রাফার কোথায় গেল? শিগ্গির শিগ্গির ফটো তুলে নাও—’
কালো কাপড়ে মুখ ঢাকা ফটোগ্রাফার ত্রিপদবিশিষ্ট ক্যামেরা সম্মুখে লইয়া অগ্রসর হইল, ক্যামেরা কৃষ্ণকান্তের সম্মুখে রাখিয়া ঘোমটা হইতে মুখ বাহির করিল, বলিল— ‘স্থির হয়ে দাঁড়ান…কেউ নড়বেন না…খুকি, একটু হাসো তো—!’
ফুলশয্যার রাত্রি। একটি ঘর ফুল দিয়া সাজানো হইয়াছে। পালঙ্কে ফুলের বিছানা। মৃদু আলো জ্বলিতেছে। রাধাকান্ত ও দেবীকে দুই হাতে ধরিয়া কৃষ্ণকান্ত প্রবেশ করিলেন। কয়েকটি পুরাঙ্গনা দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়া কৌতুক-কৌতূহলী চক্ষে এই দৃশ্য দেখিতে লাগিল।
কৃষ্ণকান্ত বর-বধূকে পালঙ্কের কাছে লইয়া গিয়া বলিলেন— ‘আজ তোমাদের ফুলশয্যা। জীবনে সবচেয়ে সুখের রাত্রি। নাও, দু’জনে বিছানায় শুয়ে পড়।’
পালঙ্কটি বেশ উঁচু। রাধাকান্ত উঠিয়া লম্বা হইয়া শুইয়া পড়িল, কিন্তু দেবী উঠিতে পারিল না। কৃষ্ণকান্ত তখন তাহাকে ধরিয়া খাটে তুলিয়া দিলেন, সনিশ্বাসে বলিলেন— ‘আহা, আজ যদি গিন্নী বেঁচে থাকতেন!’
দেবী রাধাকান্তের পাশে বালিশে মাথা দিয়া শয়ন করিল। কৃষ্ণকান্ত দুইজনকে পরম স্নেহে নিরীক্ষণ করিয়া বলিলেন— ‘আচ্ছা, এবার তোমরা ঘুমোও। —রাধাকান্ত, মনে রেখো, দেবী তোমার স্ত্রী, তোমার সহধর্মিণী। ওর সঙ্গে ঝগড়া কোরো না।’
কৃষ্ণকান্ত দ্বারের কাছে কৌতূহলী মেয়েদের দেখিয়া বলিলেন— ‘তোরা এখানে কেন? যা সব পালা! খবরদার, আড়ি পাতবি না।’
মেয়েরা হাসিতে হাসিতে সরিয়া গেল। কৃষ্ণকান্ত ঘরের দ্বার ভেজাইয়া দিয়া ক্ষণেক কান পাতিয়া রহিলেন, যেন ঘরের ভিতরের কথাবার্তা শুনিবার চেষ্টা করিতেছেন।
খাটের উপর রাধাকান্ত ও দেবী পরস্পরকে নিরীক্ষণ করিতেছে, তাহাদের দৃষ্টিতে অনুরাগের চেয়ে বিরাগই বেশী প্রকাশ পাইতেছে। অবশেষে রাধাকান্ত বলিল— ‘আমি তোমার স্বামী, আমার সঙ্গে ঝগড়া করবে না।’
দেবী তৎক্ষণাৎ জবাব দিল— ‘আমি কারুর সঙ্গে ঝগড়া করি না। আমি লক্ষ্মী মেয়ে।’
রাধাকান্ত তাহার দিকে একটা পা ছড়াইয়া দিয়া বলিল— ‘তুমি আমার বৌ। পা টিপে দাও।’
দেবী সতেজে বলিল— ‘টিপবো না। আমি কি তোমার চাকর?’
রাধাকান্ত বলিল— ‘তবে তুমি লক্ষ্মী মেয়ে নয়। আমি তোমার সঙ্গে কথা কইব না।’
দেবী বলিল— ‘আমিও কথা কইব না। কাল আমি বাপের বাড়ি চলে যাব।’
দু’জনকে দু’দিকে মুখ ফিরাইয়া শুইল।
কৃষ্ণকান্ত দ্বারের বাহির দাঁড়াইয়া নব-দম্পতির প্রণয়-সম্ভাষণ শুনিতেছিলেন, মৃদু মৃদু হাসিতে হাসিতে প্রস্থান করিলেন।
পরদিন প্রভাতে কৃষ্ণকান্ত আবার আসিয়া দেখিলেন, বর-বধূ নিঃসাড়ে ঘুমাইতেছে। একজনের মাথা পশ্চিম দিকে, অন্যের মাথা দক্ষিণ দিকে। দেবীর পদযুগল পতিদেবতার বক্ষের উপর স্থাপিত। কৃষ্ণকান্ত গভীর স্নেহে ঘুমন্ত দেবীকে কোলে তুলিয়া লইলেন; গদ্গদ স্বরে বলিলেন— ‘মা! মা জননী! ওঠো, তোমার বাবা তোমাকে নিতে এসেছেন।’
সেদিন দেবী পিতৃগৃহে ফিরিয়া গেল। তারপর নয় বৎসর স্বামীর সঙ্গে তাহার আর কোনও সম্পর্ক রহিল না। দেবী পিতৃগৃহে রহিল। কৃষ্ণকান্ত প্রতি সপ্তাহে একবার দুইবার গিয়া দেবীকে দেখিয়া আসেন। কিন্তু রাধাকান্তের পত্নীর সহিত দেখাসাক্ষাৎ করিবার হুকুম নাই। কৃষ্ণকান্ত স্থির করিয়াছেন, ছেলে-বৌ বয়ঃপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত তাহাদের মিলন ঘটিতে দিবেন না।
একুশ বছর বয়সে রাধাকান্ত পরম কান্তিমান যুবাপুরুষ হইয়া দাঁড়াইয়াছে। সে কলেজে পড়ে, এবার বি. এ. পরীক্ষা দিবে।
পড়ার ঘরে টেবিলের সামনে বসিয়া সে অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে লিখিতেছে; দেখিলে মনে হয় খুব মন দিয়াই লেখাপড়া করিতেছে। কিন্তু যদি সন্তর্পণে তাহার কাঁধের উপর দিয়া উঁকি মারা যায়, দেখা যাইবে সে যাহা লিখিতেছে তাহার সহিত আসন্ন পরীক্ষার কোনও সম্বন্ধ নাই। তাহার লিখনটি এইরূপ—
‘প্রিয়তমাসু,
দেবী, তোমার জন্যে আমার মন সর্বদা ছটফট করছে। তোমাকে ছেড়ে আমি আর থাকতে পারছি না। এবার জামাইষষ্ঠীর সময় তোমাদের বাড়িতে নেমন্তন্ন খেতে গিয়ে তোমাকে একবারটি দেখেছিলাম। তাও দূর থেকে, মুহূর্তের জন্যে। আশা মিটল না।
বাবা এত নিষ্ঠুর কেন? শ্বশুরমশাই এত নিষ্ঠুর কেন? কেন আমাদের দূরে রেখেছেন? আমি যে আর থাকতে পারছি না। তোমার কি আমাকে দেখতে ইচ্ছে করে না?
আচ্ছা, লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা করলে কেমন হয়? বেশ মজা হয়, না? তুমি যদি রাজী থাকো আমি লুকিয়ে তোমার সঙ্গে দেখা করব। কেউ জানতে পারবে না। তুমি চিঠি লিখো।
আমার একটা ফটোগ্রাফ এই সঙ্গে পাঠালাম। তোমার ফটোগ্রাফ আমাক পাঠিও। ভালবাসা নিও। অনেক অনেক ভালবাসা নিও। ইতি—
তোমার রাধাকান্ত।’
চিঠি শেষ করিয়া রাধাকান্ত নিজের একটি ক্ষুদ্র ফটোগ্রাফ লইয়া চিঠির সঙ্গে খামের মধ্যে পুরিয়া খাম বন্ধ করিয়াছে, এমন সময় দ্বারের বাহিরে পিতার ফট্ ফট্ চটির শব্দ শুনিয়া চক্ষের নিমেষে খামখানি পকেটে লুকাইল। তারপর একটি বই খুলিয়া একাগ্র চক্ষে তাহার পানে চাহিয়া রহিল।
কৃষ্ণকান্ত এই কয় বছরে আর একটু বৃদ্ধ হইয়াছেন; পদসঞ্চার ও বাচনভঙ্গি মন্থর হইয়াছে। তিনি কক্ষে প্রবেশ করিতেই রাধাকান্ত সসম্ভ্রমে উঠিয়া দাঁড়াইল— ‘কি বাবা?’
কৃষ্ণকান্ত বলিলেন—‘কিছু নয়, এই দেখতে এলাম। পড়াশুনো বেশ হচ্ছে তো? পরীক্ষার আর মাত্র তিন মাস বাকি—’
রাধাকান্ত বলিল— ‘হ্যাঁ বাবা।’
কৃষ্ণকান্ত বলিলেন— ‘এই বি. এ. পরীক্ষাটা পাস করে নাও, তারপর আর তোমাকে পড়তে বলব না। অবশ্য তোমাকে পেটের দায়ে চাকরি করতে হবে না। তবে কি জানো বাবা, বি. এ. ডিগ্রিটা হচ্ছে জীবনযুদ্ধে একটা বড় হাতিয়ার। ওটা হাতে থাকা ভাল।’
রাধাকান্ত বলিল— ‘হ্যাঁ বাবা।’
কৃষ্ণকান্ত বলিলেন— ‘আজ কি তোমার কলেজ নেই।’
রাধাকান্ত বলিল— ‘আছে বাবা। এখনি যাব।’
‘হ্যাঁ। চটপট খাওয়া-দাওয়া সেরে বেরিয়ে পড়। কলেজ কামাই করা ঠিক নয়। আর এই তিনটে মাস বৈ তো নয়। পরীক্ষা হয়ে গেলেই ব্যস্— নিশ্চিন্দি। তখন বৌমাকে ঘরে আনব। তিনটে মাস দেখতে দেখতে কেটে যাবে।’ কৃষ্ণকান্ত ধীরে ধীরে চলিয়া গেলেন।
রাধাকান্ত বসিয়া পড়িল। দুই হাতে মাথা চাপিয়া সনিশ্বাস বলিল— ‘তি-ন মা-স!’
ওদিকে দেবীর কাছে রাধাকান্তের চিঠি পৌঁছিয়াছিল। দেবী এখন পূর্ণযুবতী, রূপে, রসে, লাবণ্যে যেন টলমল করিতেছে।
চিঠি দেখিয়া দেবী প্রথমটা বুঝিতে পারিল না, কে লিখিয়াছে। তাহাকে তো কেহ চিঠি লেখে না। একটু অবাক হইয়া সে খাম ছিঁড়িল। অমনি রাধাকান্তের ফটো বাহির হইয়া পড়িল। তখন সে সচকিতে চারিদিকে চাহিয়া দেখিল কেহ দেখিয়াছে কিনা। তারপর আঁচলের মধ্যে চিঠি লুকাইয়া নিজের ঘরে গিয়া দ্বার বন্ধ করিল।
স্পন্দিত বক্ষে সে খাম হইতে ফটো বাহির করিয়া দেখিতে লাগিল। অধরে কখনো একটু হাসি খেলিয়া যায়, চোখদুটি কখনো বাষ্পচ্ছন্ন হইয়া ওঠে। জামাইষষ্ঠীর সময় দেবীও রাধাকান্তকে চকিতের ন্যায় দেখিয়াছিল, কিন্তু অতটুকু দেখায় কি মন ভরে? ছবিটা তবু সে কাছে পাইয়াছে, যতবার ইচ্ছা দেখিতে পারিবে।
অবশেষে ছবিখানি বুকের মধ্যে লুকাইয়া রাখিয়া দেবী চিঠি পড়িল। বুক দুরুদুরু করিতে লাগিল, মুখ তপ্ত হইয়া উঠিল। রাধাকান্ত যেন দেবীর মনের কথাই দেবীকে লিখিয়াছে। দেবী যেমন স্বামীকে চায়, স্বামীও তেমনি দেবীকে পাইবার জন্য পাগল।
কিন্তু এত আবেগ-বিহুলতার মধ্যেও দেবী স্থিরভাবে চিন্তা করিবার ক্ষমতা হারায় নাই। সে স্বামীর চিঠিখানি মুঠিতে লইয়া অনেকক্ষণ চিন্তা করিল, তারপর বুকের তলায় বালিশ দিয়া বিছানায় শুইয়া চিঠির উত্তর লিখিতে প্রবৃত্ত হইল। চিঠিতে সলজ্জ অপটু ভাষায় দেবীর মনের ভাব প্রকাশ পাইল—
‘শ্রীচরণকমলেষু,
তোমার ছবি আর চিঠি পেয়েছি। আমার আর এখানে থাকতে ইচ্ছে করে না, তোমার কাছে থাকতে ইচ্ছে করে। কবে তুমি আমাকে নিয়ে যাবে? বাবা দুপুরবেলা অফিসে যান, বাড়িতে ঝি-চাকর ছাড়া কেউ থাকে না। তুমি আমার প্রণাম নিও। ইতি—
তোমার দেবী।’
চিঠির মধ্যে নিজের একটি ফটো দিয়া দেবী ঝিয়ের হাতে চিঠি ডাকে পাঠাইয়া দিল।
চিঠি পাইয়া রাধাকান্ত একেবারে মাতিয়া উঠিল। চিঠিতে কথা বেশী নাই, কিন্তু মনের ভাব সুস্পষ্ট। রাধাকান্ত স্বভাবতই একটু ভাবপ্রবণ, একটু হঠকারী, অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা করিয়া কাজ করা তাহার স্বভাব নয়। সে মনে মনে এক প্রচণ্ড সংকল্প করিয়া বসিল— দেবীকে সে চুরি করিয়া লইয়া পলাইবে।
সঙ্কল্প কার্যে পরিণত করিতে বিলম্ব হইল না। পরদিন দুপুরবেলা ছ্যাকড়া গাড়ি চড়িয়া রাধাকান্ত শ্বশুর-ভবনে উপস্থিত হইল। দ্বারের কড়া নাড়িতেই দেবী দ্বার খুলিয়া দিল। যেন দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়া প্রতীক্ষা করিতেছিল।
প্রথম সমাগমের লজ্জা কাটিতে একটু সময় লাগিল। রাধাকান্ত হৰ্ষরোমাঞ্চিত, দেবী বিনতভুবনবিজয়ীনয়না। ক্রমে ভাব হইল, চুপিচুপি ফিসফিস কথা হইল। রাধাকান্ত দেবীর হাত ধরিয়া নিজের বুকের উপর রাখিল— ‘তোমাকে ছেড়ে আর আমি থাকতে পারছি না। চল, দু’জন মিলে পালিয়ে যাই।’
দেবী চমকিয়া চোখ তুলিল—‘পালিয়ে যাবে? কোথায় পালিয়ে যাবে?’
রাধাকান্ত বলিল—‘যেদিকে দু’চক্ষু যায়। বাবাদের অত্যাচার আর সহ্য হয় না।’
দেবী ক্ষণেক চিন্তা করিল। পালাইয়া যাইবে! কিন্তু স্বামীর সঙ্গে পালাইয়া যাইতে দোষ কি? সীতা রামের সঙ্গে বনবাসে গিয়াছিলেন, সুভদ্রা—
একটি সিল্কের চাদর গায়ে জড়াইয়া লইয়া দেবী বলিল—‘চল।’
কেহ জানিল না, দুইজনে ছ্যাকড়া গাড়ি চড়িয়া কোথায় চলিয়া গেল।
দেবীর বাবা হরিমোহন বৈকালে অফিস হইতে ফিরিয়া দেখিলেন দেবী গৃহে নাই, ঝি-চাকরেরা কিছু জানে না। হরিমোহন ভয় পাইয়া বেহাই-এর কাছে ছুটিলেন।
ওদিকে কৃষ্ণকান্তের গৃহে রাধাকান্তও অনুপস্থিত। সে কলেজে যাইবে বলিয়া বাহির হইয়াছিল, আর ফিরিয়া আসে নাই। ব্যাপার বুঝিতে বৈবাহিক যুগলের বিলম্ব হইল না। তাঁহারা অবিমৃশ্যকারী যুবক-যুবতীর উপর অতিশয় ক্রুদ্ধ হইয়া চারিদিকে তল্লাস আরম্ভ করিলেন।
চেনা পরিচিত কাহারো ঘরে ফেরারীদের পাওয়া গেল না। হোটেলেও তাহার যায় নাই। এদিকে রাত্রি হইয়া গিয়াছে, টিপিটিপি বৃষ্টি পড়িতেছে। অবশেষে রাত্রি দশটার সময় নগরের প্রান্তে একটি নির্জন পার্কে তাহাদের পাওয়া গেল। একটি বেঞ্চির উপর দু’জনে পাশাপাশি বসিয়া আছে, দেবীর সিল্কের চাদরটি দু’জনের গায়ে জড়ানো। অবস্থা অতি করুণ।
কৃষ্ণকান্ত অপরাধীদের তিরস্কার করিতে গিয়া হাসিয়া ফেলিলেন। অপরাধীরা লজ্জায় অধোবদন হইয়া রহিল। কৃষ্ণকান্ত হাসি থামাইয়া বলিলেন— ‘এই যদি তোদের ইচ্ছে ছিল, আমাদের বললেই পারতিস। চল, এখন ঘরে চল।’
ছেলে-বৌ লইয়া কৃষ্ণকান্ত গৃহে ফিরিলেন।
রাত্রে দেবী ও রাধাকান্ত এক শৰ্য্যায় শয়ন করিল। বিবাহের নয় বৎসর পরে তাহাদের প্রকৃত ফুলশয্যা হইল।
বলা বাহুল্য, রাধাকান্ত পরীক্ষায় ফেল করিল। কৃষ্ণকান্ত নিরাশ হইলেন বটে, কিন্তু বলিলেন— ‘আমি জানতাম। যাহোক আর পড়াশুনোয় কাজ নেই, এবার কাজে ঢুকে পড়। আমার বয়স হয়েছে, কবে আছি কবে নেই; তুমি এইবেলা কাজকর্ম শিখে নাও। পৈতৃক ব্যবসাটা যাতে বজায় থাকে।’
রাধাকান্ত পৈতৃক কাজে লাগিয়া গেল। সে বুদ্ধিমান ছেলে, কাজে উৎসাহ আছে। অল্পকাল মধ্যেই সে কাগজের ব্যবসার মারপ্যাঁচ বুঝিয়া লইল। কৃষ্ণকান্তের শরীর অল্পে অল্পে জীর্ণ হইতেছিল, তিনি আর অফিসে যান না, তাঁহার বদলে রাধাকান্ত অফিসের কাজ দেখে। কৃষ্ণকান্ত বাড়িতে থাকেন; বাড়ির নীচের তলায় কাগজের গুদাম, তাহারই দেখাশুনা করেন।
এদিকে দেবী সন্তান-সম্ভবা। কৃষ্ণকান্ত পৌত্রমুখ দর্শনের আশায় অত্যন্ত আহ্লাদিত হইয়াছেন। খুব ঘটা করিয়া পুত্রবধূর সাধ দিলেন।
তারপর একদিন কাজ করিতে করিতে কৃষ্ণকান্ত হঠাৎ অজ্ঞান হইয়া পড়িয়া গেলেন। ডাক্তার আসিয়া পরীক্ষা করিলেন। বলিলেন— ‘হৃদযন্ত্রের দুর্বলতা। কাজকর্ম বন্ধ করে দিন। খুব সাবধানে থাকতে হবে।’ ঔষধের ব্যবস্থা করিয়া দিয়া ডাক্তার চলিয়া গেলেন।
দেবী শ্বশুরের শয্যাপাশে বসিয়া উদ্বেগভরা চোখে তাঁহার পানে চাহিয়া ছিল, কৃষ্ণকান্ত তাহার প্রতি সস্নেহ দৃষ্টিপাত করিয়া বলিলেন— ‘নাতির মুখ দেখে যদি যেতে পারি, তাহলে আর আমার কোনও দুঃখ নেই।’
দেবী শ্বশুরের পায়ে হাত বুলাইয়া দিতে দিতে অঝোরে কাঁদিতে লাগিল। শ্বশুরকে সে সত্যই ভালবাসিয়াছিল।
কৃষ্ণকান্ত দু’চার দিনে একটু সুস্থ হইলেন। কিন্তু বেশী চলাফেরা করেন না, বাড়ির উপর তলায় অল্পস্বল্প ঘুরিয়া বেড়ান। নাতির মুখ দেখিবার জন্যই যেন বাঁচিয়া আছেন।
তারপর একদিন দেবী একটি পুত্রসন্তান প্রসব করিল। কৃষ্ণকান্ত আনন্দে আত্মহারা হইলেন। বাড়িতে নহবৎ বসিল। আত্মীয়-বন্ধুগণের গৃহে মিষ্টান্ন বিতরিত হইল।
আঁতুড়ঘরে প্রবেশ করিয়া কৃষ্ণকান্ত নাতির মুখ দেখিলেন। বলিলেন—‘চাঁদের মতো ছেলে হয়েছে। ওর নাম রইল চন্দ্রকান্ত।’ তারপর শয্যায় শয়ান পুত্রবধূর হাতে চাবির গোছা দিয়া বলিলেন— ‘তুমি ছেলের মা হয়েছ, আজ থেকে তুমি এ বাড়ির গৃহিণী। লোহার সিন্দুকের চাবি তোমার কাছে রইল। চিরায়ুষ্মতী হও।’
সেই রাত্রে নিদ্রাবস্থায় কৃষ্ণকান্ত পরলোকে গমন করিলেন।
আরও পাঁচটি বছর মহাকালের নীল সমুদ্রে মিশিয়াছে।
রাধাকান্ত এখন বাড়ির কর্তা; তিনটি সন্তানের পিতা। প্রথম দুটি পুত্র, চন্দ্রকান্ত ও সূর্যকান্ত, তৃতীয়টি কন্যা, নাম গৌরী। প্রথম মহাযুদ্ধের বাজারে কাগজের ব্যবসা ফাঁপিয়া উঠিয়াছিল, রাধাকান্ত বিলক্ষণ লাভবান হইয়াছে। তাহাতে এখন রীতিমত বড়মানুষ বলা চলে।
দেবীর দেহমনও এই কয় বছরে পরিণতি লাভ করিয়াছে। সে আর এখন প্রণয়ভয়ভঙ্গুর তরুণী নয়, তিনটি সন্তানের জননী, ঘরের ঘরণী। দেহের যৌবন যেমন অটুট আছে, তেমনি চরিত্র আরও শান্ত-ধীর ও দৃঢ় হইয়াছে। বিষয়বুদ্ধিতে সে স্বামীর সমকক্ষ, রাধাকান্ত অনেক সময় বিষয়কর্মে স্ত্রীর সহিত পরামর্শ করিয়া কাজ করে। রাধাকান্তের চরিত্রে যে অবিমৃশ্যকারিতা আছে দেবী তাহা সংযত করিয়া রাখে।
আজ দেবী ও রাধাকান্তের জীবনের একটি স্মরণীয় দিন। মোটরগাড়ি কেনা হইয়াছে, রথের মতো উঁচু প্রকাণ্ড একটি মিনার্ভা গাড়ি। এতদিন ঘোড়ার গাড়িতেই কাজ চলিতেছিল। কিন্তু এখন দিনকাল বদলাইয়া যাইতেছে। মোটরগাড়ি না থাকিলে মান-মর্যাদা রক্ষা হয় না। একজন ড্রাইভার রাখা হইয়াছে, সে জগমগে পোশাক পরিয়া গাড়ি চালাইবে।
সকালবেলা গাড়ি আসিয়াছে, বাড়ির সামনের উঠান আলো করিয়া দাঁড়াইয়া আছে। তিনটি ছেলেমেয়ে সকাল হইতে গাড়ির মধ্যেই বাস করিতেছে। ঝি, চাকর পরম কৌতুহলের সহিত গাড়ি প্রদক্ষিণ করিতেছে। জগমগে পোশাক-পরা ড্রাইভার মাঝে মাঝে ঝাড়ন দিয়া গাড়ির ধুলা ঝাড়িতেছে।
দশটার সময় রাধাকান্ত ও দেবী দোতলা হইতে নামিয়া আসিয়া মোটরগাড়িতে উঠিল, চাকর এক চ্যাঙারি খাবার গাড়িতে তুলিয়া দিল। ছেলেমেয়েরা আগে হইতেই গাড়িতে ছিল, তাহারা কলহাস্য করিয়া করতালি দিয়া আনন্দ জ্ঞাপন করিল। রাধাকান্ত ও দেবী পরস্পরের পানে চাহিয়া পরম তৃপ্তির হাসি হাসিল। তারপর গম্ভীর স্বরে ড্রাইভারকে বলিল— ‘চলো, শিবপুর বটানিকাল গার্ডেন।’
আজ মোটরগাড়ি কেনার প্রথমদিনে তাহারা বন-ভোজনে যাইতেছে।
সারাদিন ভারি আনন্দে কাটিল। সন্ধ্যার সময় ক্লান্ত দেহ ও তৃপ্ত মন লইয়া তাহারা গৃহে ফিরিয়া আসিল।
তারপর অনাড়ম্বর গতানুগতিক সুখের দিনগুলি একে একে কাটিতে লাগিল।
একদিন সন্ধ্যার সময় রাধাকান্ত মোটরে চড়িয়া অফিস হইতে বাড়ি ফিরিতেছিল; একটি অপেক্ষাকৃত নির্জন রাস্তায় তাহার মোটরের এঞ্জিন গোলমাল আরম্ভ করিল। ড্রাইভার মোটর থামাইয়া গাড়ির বনেট খুলিয়া ঠুকঠাক আরম্ভ করিল। গাড়ি আবার চালু হইতে সময় লাগিবে দেখিয়া রাধাকান্ত বাহিরে আসিয়া ফুটপাথে পায়চারি করিতে লাগিল।
সামনেই একটা চায়ের দোকান। এই অবকাশে এক পেয়ালা গরম চা সেবন করিয়া লইবার উদ্দেশ্যে রাধাকান্ত দোকানে প্রবেশ করিল। দোকানে খদ্দের বেশী নাই; রাধাকান্ত চা ফরমাশ করিয়া একটি টেবিলের সামনে বসিল।
ঘরে এখনো আলো জ্বলে নাই। চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে রাধাকান্ত লক্ষ্য করিল— ঘরের কোণে টেবিল ঘিরিয়া বসিয়া চারজন লোক নিবিষ্টমনে তাস খেলিতেছে।
নির্জন ঘরে ক্রীড়ারত ওই লোকগুলা তাহাকে আকর্ষণ করিতে লাগিল। চায়ের পেয়ালা শেষ করিয়া সে তাহাদের টেবিলের পাশে গিয়া দাঁড়াইল; লোকগুলা কেহ তাহাকে লক্ষ্য করিল না, আপন মনে খেলিয়া চলিল।
প্রেমারা খেলা চলিতেছে। জুয়া খেলা। কিন্তু ইহারা বেশী বড় দান দিয়া খেলিতেছে না, দু’ চার আনা দিয়া খেলিতেছে। এ খেলা রাধাকান্তের পরিচিত; সে আগ্রহ সহকারে দেখিতে লাগিল।
হঠাৎ খেলোয়াড়দের মধ্যে একব্যক্তি মুখ তুলিয়া রাধাকান্তের পানে চাহিল, মৃদু হাসিয়া বলিল—‘এ খেলা কি দেখছেন বাবু, নেহাত ছেলেখেলা। যদি সত্যিকার ‘বাঘের খেলা’ দেখতে চান, ঐ ঘরে যান।’ বলিয়া পাশের একটি ভেজানো দরজা দেখাইল।
রাধাকান্ত একটু ইতস্তত করিল, তারপর দরজা ঠেলিয়া ঘরে প্রবেশ করিল।
ঘরটি ছোট, আলো জ্বলিতেছে। গদি-পাতা মেঝের উপর বসিয়া পাঁচ-ছয় জন লোক জুয়া খেলিতেছে। প্রত্যেকের সম্মুখে টাকার স্থূপ।
রাধাকান্তকে দেখিয়া কেহ বিস্ময় প্রকাশ করিল না। একজন বলিল— ‘আসুন, বসে যান।’
রাধাকান্তের পকেটে দুইশত টাকা ছিল। সে বসিয়া গেল।
ওদিকে দেবী উদ্বেগে বাড়িময় ছটফট করিয়া বেড়াইতেছে। রাধাকান্ত কোনদিন অফিস হইতে বাড়ি ফিরিতে দেরি করে না। তবে আজ কি হইল?
রাত্রি সাড়ে আটটার সময় রাধাকান্ত বাড়ি ফিরিল। মুখ শুষ্ক, অপরাধ-লাঞ্ছিত। সে দেবীর কাছে বিলম্বের সত্য কারণ লুকাইবার চেষ্টা করিল, কিন্তু পারিল না। শেষ পর্যন্ত সব কথাই প্রকাশ পাইল। সে জুয়া খেলার লোভ সামলাইতে পারে নাই; পকেটে যে দুশো টাকা ছিল, তাহা গিয়াছে।
শুনিয়া দেবী ভয়ে আতঙ্কে দিশাহারা হইয়া গেল। দুশো টাকা গিয়াছে যাক, কিন্তু জুয়ার নেশা সর্বনেশে নেশা। এ পথে চলিলে বিষয়-সম্পত্তি মান-মর্যাদা কয়দিন থাকিবে। দেবী কাঁদিয়া ফেলিল— ‘ওগো, এ তুমি কি করলে! জুয়া খেললে যে লক্ষ্মী ছেড়ে যায়।’
রাধাকান্ত অধোমুখে রহিল। দেবী তখন চোখ মুছিয়া বলিল— ‘দিব্যি কর, আর কখনো জুয়া খেলবে না।’
রাধাকান্ত শপথ করিল। দেবীর কিন্তু প্রত্যয় জন্মিল না। মেজ ছেলে সূর্যকান্ত ঘরের মেঝেয় খেলা করিতেছিল, দেবী তাহাকে কোলে তুলিয়া আনিয়া স্বামীর সম্মুখে দাঁড়াইল— ‘ছেলের মাথায় হাত দিয়ে দিব্যি কর।’
রাধাকান্ত চার বছরের ছেলে সূর্যকান্তের মাথায় হাত দিয়া শপথ করিল জীবনে আর কখনো জুয়া খেলিবে না।
একটি একটি করিয়া বছর কাটিয়া যায়। ছেলেমেয়েরা বড় হইয়া উঠিতে থাকে। রাধাকান্তের প্রভাব-প্রতিপত্তি সামাজিক প্রতিষ্ঠা বর্ধিত হয়; তাহার রগের কাছে চুলে একটু পাক ধরে। দেবীর শরীরও একটু ভারী হইয়াছে; কিন্তু মনের সজাগ সাবলীলতা অক্ষুণ্ণ আছে। সংসারের চারিদিকে তাহার সতর্ক মমতা।
বড়ছেলে চন্দ্ৰকান্তের বয়স এখন উনিশ, সে সরল ধীর প্রকৃতির ছেলে, কলেজে বি. এ. পড়ে। সূর্যকান্তের বয়স সতরো, স্বাস্থ্যবান, একটু উগ্র প্রকৃতি; খেলাধূলার দিকে মন; লেখাপড়ায় মন নাই; স্কুল ও কলেজের মধ্যবর্তী উচু বেড়া পার হইতে পারে নাই। সর্বকনিষ্ঠা গৌরী, বয়স চৌদ্দ, মায়ের মতো লাবণ্যবতী নয়, কিন্তু যৌবনের তোরণদ্বারে আসিয়া তাহার আকৃতি বেশ একটি কোমল কমনীয়তা লাভ করিয়াছে। এই গৌরীকে সূত্র ধরিয়া যে সংসারে মহা-বিপর্যয় প্রবেশ করিবে, তাহা কেহ জানে না। কিন্তু সে পরের কথা।
চন্দ্রকান্ত লুকাইয়া প্রেমে পড়িয়াছিল, পাশের বাড়ির মেয়ে অমিয়ার সঙ্গে। অমিয়া সদ্বংশের মেয়ে, কিন্তু তাহার বাবার অবস্থা ভাল নয়; কোনও রকমে দিন চলে। দুই পরিবারের মধ্যে মুখ-চেনাচিনি থাকিলেও সামাজিক মেলামেশা নাই। চন্দ্ৰকান্তের শয়নঘরের জানালা দিয়া অমিয়ার শয়নঘরের জানালা দেখা যায়, মাঝখানে দশ-বারো হাত ব্যবধান। এই জানালা পথেই ভালবাসা জন্মিয়াছিল। প্রথমে চোখাচোখি হইলে সলজ্জে মুখ ফিরাইয়া লওয়া, তারপর চোখে চোখ মিলাইয়া হাসি, তারপর চাপাগলায় দুটি একটি কথা। ‘তোমার নাম কি?’ ‘অমিয়া।’ আমার নাম চন্দ্রকান্ত।’ ‘জানি।’ তারপর ক্রমে হাতমুখ নাড়িয়া ইশারা ইঙ্গিতে প্রেম নিবেদন। প্রেম নিবেদনটা চন্দ্ৰকান্তের পক্ষেই বেশী, অমিয়া তাহার নাটুকে অঙ্গভঙ্গি দেখিয়া হাসে।
একদিন সকালবেলা চন্দ্রকান্ত জানালার সম্মুখে দাঁড়াইয়া অঙ্গভঙ্গি সহকারে অমিয়াকে প্রাত্যহিক প্রেম নিবেদন করিতেছিল। দুঃখের বিষয়, আজ সে ঘরের দরজা বন্ধ করিতে ভুলিয়া গিয়াছিল। দেবী কোনও একটা সাংসারিক কাজের উপলক্ষে ঘরে প্রবেশ করিয়া থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িল, তারপর নিঃশব্দে জানালার দিকে অগ্রসর হইল। চন্দ্রকান্ত মাকে দেখিতে পায় নাই, অন্য জানালা হইতে অমিয়া দেখিতে পাইয়াছিল। সে চট করিয়া সরিয়া গেল।
চন্দ্রকান্ত ফিরিয়া দেখিল— মা! মায়ের চোখে আগুন ঠিকরাইয়া পড়িতেছে। সে ভয়ে জড়সড় হইয়া পড়িল।
দেবী কঠিন স্বরে বলিল— ‘চন্দ্রকান্ত! তুই—তুই পাশের বাড়ির মেয়েকে ইশারা করছিলি! তোর এতদূর অধঃপতন হয়েছে?
চন্দ্রকান্ত ঠোঁট চাটিয়া বলিল—‘মা—আমি—’
দেবী তীব্র র্ভৎসনার কণ্ঠে বলিয়া উঠিল— ‘ছি ছি ছি চন্দ্রকান্ত, তোর এই কাজ। এ বংশে কেউ কখনো এ কাজ করেনি। আমার ছেলে হয়ে তুই গেরস্তঘরের মেয়ের দিকে নজর দিলি!’
চন্দ্রকান্ত মায়ের পদতলে পড়িয়া ব্যাকুল স্বরে বলিল— ‘মা, তুমি আমাকে ভুল বুঝো না। আমি— আমি অমিয়াকে— বিয়ে করতে চাই—’
দেবীর উগ্র ক্রোধ থমকিয়া গেল, মুখের ভাব একটু নরম হইল— ‘কি বললি?’
‘মা— আমি—অমিয়া—মানে—আমি ওকে বিয়ে করব।’
দেবী তাহার চুল ধরিয়া নাড়িয়া দিল।
‘হতভাগা! ওঠ। বিয়ে করবি তো আমাকে বলিসনি কেন?’
চন্দ্রকান্ত উঠিয়া করুণস্বরে বলিল— ‘ওরা বড় গরিব, অমিয়ার বাবার একটিও পয়সা নেই। তাই বলিনি। বাবা শুনলে রাগ করবেন।’
দেবীর ঠোঁটের কোণে একটু হাসি দেখা দিল— ‘ওরা গরিব, আর তোর বাপ বুঝি নবাব? মেয়েটা দেখতে শুনতে তো ভালই। সত্যি ওকে বিয়ে করতে চাস্?’
বিগলিত হইয়া চন্দ্রকান্ত বলিল— ‘হ্যাঁ মা, তুমি বাবাকে রাজী কর।’
‘আচ্ছা আচ্ছা, সে তোকে ভাবতে হবে না। আমি আগে মেয়ে দেখব। যদি দেখি ভাল মেয়ে, তখন যা করবার করব।’—
দুপুরবেলা রাধাকান্ত অফিস হইতে আহার করিতে আসিলে দেবী তাহাকে কথাটা শুনাইয়া রাখিল। রাধাকান্ত ইতিমধ্যে গৌরীর বিবাহের ব্যবস্থা প্রায় পাকাপাকি করিয়া আনিয়াছিল, বলিল—‘বেশ তো। মেয়ে যদি তোমার পছন্দ হয়, দুটো বিয়ে একসঙ্গে লাগিয়ে দাও।’
অপরাহ্নে দেবী গায়ে চাদর জড়াইয়া পাশের বাড়িতে গেল। পাশাপাশি দুই বাড়ি, কিন্তু দেবী এই প্রথম অমিয়াদের বাড়িতে পদার্পণ করিল।
অমিয়ার মা বর্ষীয়সী মহিলা, অমিয়া তাঁহার শেষ সন্তান। দেবীকে দেখিয়া তিনি কৃতার্থ হইয়া গেলেন, তাহার হাত ধরিয়া বলিলেন— ‘বোন, দূর থেকে তোমাকে দেখেছি, কাছে যেতে কখনো সাহস হয়নি। আমার ভাগ্যি, আজ সাক্ষাৎ লক্ষ্মী আমার ঘরে পা রাখলেন।’ তিনি দেবীকে শয়নকক্ষে লইয়া গিয়া মাদুর পাতিয়া বসাইলেন।
দু’চার কথার পর দেবী বলিল— ‘আপনার মেয়ে অমিয়াকে একবার ডেকে দিন। তার সঙ্গে দুটো কথা বলব।’
গৃহিণী কন্যাকে ডাকিলেন। অমিয়া দ্বিধায় জড়িত পদে কম্প্রবক্ষে আসিয়া দেবীকে প্রণাম করিল। দেবী তাহাকে পাশে বসাইয়া গৃহিণীকে বলিল— ‘আপনি কাজকর্ম করুন গিয়ে, আমি অমিয়ার সঙ্গে গল্প করি।’
গৃহিণী মনে মনে ঈষৎ শঙ্কিত হইয়া সরিয়া গেলেন। চন্দ্রকান্ত ও অমিয়ার প্রণয়কাহিনীর খবর তিনি কিছুই জানিতেন না।
এটা সেটা গল্প করিতে করিতে দেবী অমিয়াকে লক্ষ্য করিতে লাগিল। অত্যন্ত লাজুক মেয়ে, প্রগল্ভা মুখরা নয়, দু’বার ঢোক গিলিয়া একটা কথা বলে। তার উপর ভয় পাইয়াছে। দেবী বুঝিল, প্রণয় ব্যাপারের জন্য মূলত চন্দ্রকান্তই দায়ী, অমিয়া ছলাকলা দেখাইয়া তাহাকে প্রলুব্ধ করে নাই। মেয়েটিকে তাহার পছন্দ হইল। সে তাহার চিবুক ধরিয়া তুলিয়া বলিল— ‘চন্দ্রকান্ত তোমাকে বিয়ে করতে চায়। তোমার মাকে তাহলে বলি?’
অমিয়া চক্ষু মুদিয়া নিস্পন্দ হইয়া রহিল। দেবী তখন হাসিয়া বলিল— ‘আমি কিন্তু ভারি দজ্জাল শাশুড়ি, উন থেকে চুন খসলেই বকুনি খাবে।’
তারপর দেবী উঠিয়া গিয়া অমিয়ার মাকে বলিল— ‘আমি আপনার মেয়েটিকে নিলুম আমার বড় ছেলের জন্যে।’
অমিয়ার মা স্বর্গ হাতে পাইলেন। অশ্রু গদ্গদ কণ্ঠে বলিলেন— ‘বোন, এ আমার স্বপ্নের অতীত। কিন্তু আমার যে আর কিছু নেই।’
দেবী বলিল— ‘আর কিছু তো চাইনি। শুধু মেয়েটি চেয়েছি—’
মাসখানেক পরে মহা ধুমধামের সহিত একজোড়া বিবাহ হইয়া গেল। চন্দ্ৰকান্তের সহিত অমিয়ার এবং গৌরীর সহিত লালমোহন নামক একটি ধনীসন্তানের।
লালমোহন বনিয়াদী বংশের দুলাল। মোটর ছাড়া এক পা চলে না। যেমন তাহার মেদ-সুকুমার দেহ, তেমনি তাহার রাজাউজীর-মারা বাক্যচ্ছটা। সে নিজেকে মস্ত একজন ব্যায়ামবীর ও স্পোর্টসম্যান বলিয়া মনে করে।
বিবাহের পরদিন সকালবেলা বরকন্যা বিদায়ের পূর্বে রাধাকান্তের বৈঠকখানায় তরুণবয়স্কদের আসর জমিয়াছিল। নূতন জামাই লালমোহনই আসর জমাইয়াছিল। তাহার সঙ্গে ছিল সমবয়স্ক কয়েকজন বন্ধু, বাড়ির পক্ষ হইতে সূর্যকান্ত উপস্থিত ছিল। চা সহযোগে বিপুল প্রাতরাশের সদ্গতি হইতেছিল।
তাহার তিনটা রাইফেল আছে; সে ঘোড়ায় চড়িয়া বাঘ শিকার করিতে পারে, পোলো খেলাতেও সে নিতান্ত অপটু নয়, লালমোহন এইসব কথা বলিতে বলিতে বন্ধুদের চিমটি কাটিতেছিল! শ্রোতাকে চিমটি কাটিয়া কথা বলা তাহার অভ্যাস। শুনিতে শুনিতে সূর্যকান্তের গা জ্বালা করিতেছিল। তাহার ধৈর্য একটু কম, এ ধরনের নির্লজ্জ বড়াই সে সহ্য করিতে পারে না। কিন্তু নূতন ভগিনীপতিকে কিছু বলাও যায় না। অনেকক্ষণ নীরবে সহ্য করিয়া সে বলিল— ‘আপনি তো ভারি বাহাদুর। আমার সঙ্গে পাঞ্জা লড়তে পারেন?’
‘পাঞ্জা!’ লালমোহন অবজ্ঞায় নাক তুলিয়া বলিল— ‘ও সব ঘোটলোকের খেলা আমি খেলি না।’
সূর্যকান্তও খোঁচা দিয়া বলিল— ‘গায়ে জোর আছে কিনা পাঞ্জা লড়লে বোঝা যায়।’
লালমোহন বলিল— ‘আমার গায়ের জোরের দরকার নেই। যত বড় পালোয়ানই আসুক, তাকে শায়েস্তা করবার ক্ষমতা আমার আছে!’
‘তাই নাকি! গায়ে জোর না থাকে কি দিয়ে শায়েস্তা করবেন?’
‘এই দিয়ে’ বলিয়া লালমোহন পকেট হইতে একটি রিভলবার বাহির করিয়া দেখাইল— ‘যন্তরটি দেখতে ছোট, কিন্তু এই দিয়ে তোমার মতো ছ’জন গুণ্ডাকে শুইয়ে দিতে পারি।’
সূর্যকান্ত অত্যন্ত ক্রুদ্ধ ও মর্মাহত হইল, কিন্তু বিতণ্ডা আর বেশীদূর অগ্রসর হইতে পাইল না। রাধাকান্ত এবং আরো লোকজন আসিয়া পড়িল। বরকন্যাকে বিদায় করিবার সময় উপস্থিত।
লালমোহন বধু লইয়া গৃহে ফিরিয়া গেল। কিন্তু এই ক্ষুদ্র ঘটনাটি তাহাদের দুজনের মনে প্রচ্ছন্ন বিদ্বেষের বীজ বপন করিল।
অতঃপর সুখে স্বচ্ছন্দে কয়েকমাস কাটিয়া গেল। দেবী অমিয়াকে বধুরূপে পাইয়া পরম তৃপ্ত, সে যেমনটি চাহিয়াছিল তেমনটি পাইয়াছে। কিন্তু যতই দিন যাইতে লাগিল, একথাও ধীরে ধীরে স্পষ্ট হইয়া উঠিতে লাগিল, যে, গৌরীর দাম্পত্য-জীবন সুখের হয় নাই। প্রথম সমাগমের আবেগ-মাধুর্য ক্রমে ক্রমে শিথিল হইয়া আসিতেছে। গৌরীর শ্বশুরবাড়ি কলিকাতাতেই, সে মাঝে মাঝে বাপের বাড়ি আসে, তখন তাহার শুষ্ক মুখে করুণ হাসি দেখিয়া দেবীর বুকে শেল বিদ্ধ হয়। গৌরীকে প্রশ্ন করিলে সে প্রশ্ন এড়াইয়া যায়। তাহার স্বামী যে মদ্যপান করে, বন্ধু-বান্ধবদের লইয়া ঘোড়দৌড়ের মাঠে যায়, তাহার পৈতৃক বসত-বাড়ি বন্ধক পড়িয়াছে—এ সব কথা সে নিজের মায়ের কাছেও বলিতে পারে না।
কিন্তু একদিন কিছুই আর ঢাকা রহিল না। দুপুরবেলা গৌরী কাঁদিতে কাঁদিতে বাপের বাড়ি ফিরিল। তাহার দেহে একটিও গহনা নাই। সে মায়ের গলা জড়াইয়া কাঁদিতে লাগিল। লালমোহন অনেকদিন হইতেই তাহার সহিত দুর্ব্যবহার করিতেছে। আজ ব্যাপার চরমে উঠিয়াছে। গৌরীর বিবাহের যৌতুক আন্দাজ বিশ হাজার টাকার গহনা ছিল, এতদিন লালমোহন তাহাতে হাত দেয় নাই; আজ সে সেই গহনা চাহিয়া বসিল। গৌরী গহনা দিতে রাজী হইল না, তখন লালমোহন তাহাকে মারধর করিয়া সমস্ত গহনা কাড়িয়া লইয়াছে, এমন কি গায়ের গহনাগুলাও ছাড়ে নাই। তারপর বন্ধুদের লইয়া কোথায় চলিয়া গিয়াছে।
বাড়ির সকলেই গৌরীর কাহিনী শুনিল। রাধাকান্ত আহার করিতে আসিয়া শুনিল, তারপর অগ্নিশর্মা হইয়া লালমোহনের সন্ধানে ছুটল। আজ সে দেখিয়া লইবে, এত বড় আস্পর্ধা!
লালমোহন বাড়ি ফেরে নাই। চাকর বলিল, বাবু রেস খেলিতে গিয়াছেন, সন্ধ্যার সময় ফিরিবেন।
রাধাকান্ত রেসকোর্সে গেল। কান ধরিয়া জামাইকে ঘরে ফিরাইয়া আনিবে। স্ত্রীর গয়না বেচিয়া রেস খেলা!
রেসকোর্সে লোকারণ্য। রাধাকান্ত পূর্বে কখনো ঘোড়দৌড়ের খোয়াড়ে প্রবেশ করে নাই। সে ব্যাপার দেখিয়া চমৎকৃত হইয়া গেল। আধঘণ্টা অন্তর একদল ঘোড়া ছুটিতেছে, দর্শকেরা গগনবিদারী চিৎকার করিতেছে; হাজার হাজার টাকা হাতে হাতে লেনদেন হইতেছে। রাধাকান্তের রক্ত চনমন করিয়া উঠিল। সে এদিক-ওদিক জামাইকে তল্লাস করিল, কিন্তু অত ভিড়ের মধ্যে কোথায় জামাই? তখন সে রেলিং-এর পাশে দাঁড়াইয়া ঘোড়দৌড় দেখিতে লাগিল।
অনিবার্যভাবেই একজন দালাল আসিয়া জুটিল।
‘উর্বশী ধরেছেন?’
‘উর্বশী!’
‘সামনের রেসে দৌড়ুবে। ঘোড়া নয় পক্ষিরাজ, আকাশে উড়ে চলে।’
‘তাই নাকি! তা কি করে ধরতে হয়?’
‘আপনার দেখছি এখনও হাতেখড়ি হয়নি। আসুন আমার সঙ্গে।’
রাধাকান্তের সঙ্গে শ’তিনেক টাকা ছিল, তাই দিয়া সে বাকি সব ক’টা রেস খেলিল। রেসের শেষে দেখা গেল সে পঞ্চাশ টাকা জিতিয়াছে। সে উত্তেজিত মনে ভাবিতে লাগিল, সঙ্গে যদি আরও টাকা থাকিত, তাহা হইলে সে আরও জিতিতে পারিত।
সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরিয়া সে রেসের কথা উচ্চারণ করিল না, বলিল, লালমোহনকে কোথাও খুঁজিয়া পায় নাই। দীর্ঘ পারিবারিক আলোচনার পর স্থির হইল, লালমোহন উচ্ছন্ন যাইতে চায় যাক, গৌরী বাপের বাড়িতে থাকিবে।
পরের শনিবার রাধাকান্ত আবার রেস খেলিতে গেল। দেবী কিছুই জানিল না। এইভাবে চুপি চুপি জুয়া খেলা চলিতে লাগিল। রাধাকান্তের রক্তে জুয়ার প্রচণ্ড নেশা ছিল; সে শপথ ভুলিয়া গেল, তাহার সহজ বিষয়বুদ্ধিও লোপ পাইল।
শীতের শেষে ঘোড়দৌড়ের মরসুম যখন শেষ হইল, তখন রাধাকান্তের ব্যবসায়ের তহবিলে যত টাকা ছিল সব গিয়াছে, উপরন্তু আকণ্ঠ দেনা।
রেসের শেষ দিনে সন্ধ্যাবেলা রাধাকান্ত বাড়ি ফিরিল না। দেবী জানিত রাধাকান্ত অফিসে আছে, তাই বিশেষ উদ্বিগ্ন হয় নাই। কিন্তু রাত্রি ন’টা বাজিয়া যাইবার পরও যখন সে ফিরিল না এবং অফিসে টেলিফোন করিয়াও কোনও খবর পাওয়া গেল না তখন দেবী দুই ছেলেকে লইয়া রাধাকান্তের অফিসে গেল।
শুন্য অফিসে রাধাকান্তের মৃতদেহ পড়িয়া আছে। সে বিষ খাইয়া আত্মহত্যা করিয়াছে। মৃত্যুকালে নিজের সমস্ত অপরাধ স্বীকার করিয়া দেবীকে একটি চিঠি লিখিয়া গিয়াছে।
এই মর্মান্তিক আঘাতে দেবী প্রায় ভাঙিয়া পড়িল। কিছুদিন সে শয্যা ছাড়িয়া উঠিল না। তারপর উঠিয়া যন্ত্রের মতো গৃহকর্ম করিয়া বেড়াইতে লাগিল। অবসর কালে শয়নকক্ষে রাধাকান্তের ফটোগ্রাফের সামনে দাঁড়াইয়া একদৃষ্টে চাহিয়া থাকিত— মনে মনে প্রশ্ন করিত— কেন এ কাজ করতে গেলে? টাকাই কি বড়? আমরা কি কেউ নই?
কিন্তু তাহার মাথার উপর নিয়তির খড়্গ যে এখনো উদ্যত হইয়া আছে, তাহা সে জানিত না।
শ্বশুরের মৃত্যুসংবাদ জানাজানি হইবার পর হঠাৎ লালমোহন কোথা হইতে আসিয়া উপস্থিত হইল। কোনও রহস্যময় উপায়ে আবার তাহার অবস্থা ফিরিয়া গিয়াছে। মুরুব্বিয়ানা চালে মোটর হইতে নামিয়া শ্বশুরগৃহে প্রবেশ করিল, গ্রাম্ভারি মুখে সকলকে সান্ত্বনা দিয়া বলিল— ‘আমি আছি, তোমাদের কোনও ভয় নেই।’
গৌরী দীর্ঘকাল পরে স্বামীকে দেখিয়া বোধ হয় আনন্দিত হইল, কিন্তু সূর্যকান্ত তাহার লম্বা লম্বা কথায় জ্বলিয়া উঠিল। কথা কাটাকাটি আরম্ভ হইতে বিলম্ব হইল না। সূর্যকান্ত বলিল— ‘তোমার জন্যে বাবা আত্মহত্যা করেছেন। তুমি দায়ী।’
লালমোহনও গরম হইয়া উঠিল— ‘ডেঁপোমি কোরো না। ইস্কুলের ছেলে, লেখাপড়া কর গিয়ে।’
গৌরী ও চন্দ্রকান্ত উপস্থিত ছিল, তাহারা ঝগড়া থামাইবার চেষ্টা করিল, কিন্তু নিয়তির লিখন কে খণ্ডাইবে? ঝগড়া চরমে উঠিল। সূর্যকান্ত বলিল—‘বেরিয়ে যাও এখান থেকে।’
লালমোহন বলিল— ‘তোমার হুকুম নাকি? যাব না। এটা আমার শ্বশুরবাড়ি, আমারও হক আছে।’
সূর্যকান্ত ছুটিয়া গিয়া তাহাকে ধাক্কা দিল, লালমোহন পকেট হইতে পিস্তল বাহির করিয়া সূর্যকান্তের বুকে গুলি করিল। চক্ষের নিমেষে একটা ভয়ঙ্কর ব্যাপার ঘটিয়া গেল।
বন্দুকের আওয়াজে ঝি-চাকর যে যেখানে ছিল ছুটিয়া আসিল। হাহাকার পড়িয়া গেল। দেবী আসিয়া যখন পুত্রের রক্তাক্ত দেহ কোলে তুলিয়া লইল, তখন সূর্যকান্তের প্রাণ বাহির হইয়া গিয়াছে। লালমোহন পিস্তল হাতে দাঁড়াইয়া আছে।
অল্প শোকে কাতর, অনেক শোকে পাথর। দেবী ছেলের মৃতদেহ বুকে জড়াইয়া মেয়ে-জামাইয়ের পানে চোখ তুলিল, অকম্পিত স্বরে বলিল— ‘চলে যাও তোমরা, দু’জনেই চলে যাও। আর কখনো আমাকে মুখ দেখিও না।’
লালমোহন খুনের দায়ে দায়রা সোপর্দ হইল। মামলা কিন্তু টিকিল না। দেবী আদালতে গিয়া সাক্ষ্য দিল যে, খেলাচ্ছলে হাত-কাড়াকাড়ি করিতে করিতে আচমকা লালমোহনের পকেটের বন্দুক ফায়ার হইয়া গিয়াছিল।
আদালতে সকলেই উপস্থিত ছিল। লালমোহন খালাস পাইবার পর গৌরী আসিয়া মায়ের পা জড়াইয়া ধরিল। দেবী কিন্তু তাহার পানে চাহিল না, কঠিন স্বরে বলিল— ‘আমার সঙ্গে তোমাদের কোনও সম্পর্ক নেই। যাও, আর আমার কাছে এস না। যতদিন বেঁচে থাকব, তোমাদের মুখ দেখব না।’
রাধাকান্তের মৃত্যুর পর হইতেই তাহার গৃহে মহাজনেরা যাতায়াত আরম্ভ করিয়াছিলেন। তাঁহারা অনেক টাকা ধার দিয়াছিলেন, রাধাকাস্তের সম্পত্তি হইতে সে টাকা উদ্ধার করা যাইবে কিনা এই চিন্তা তাঁহাদের উদ্বিগ্ন করিয়া তুলিয়াছিল। এবং যতই দিন যাইতেছিল, তাঁহাদের ব্যবহার ততই কড়া হইয়া উঠিতেছিল।
এদিকে দেবীর হাতে যে নগদ টাকা আছে, তাহাতে কোনমতে সংসার চলে, মহাজনের ধার শেষ করা যায় না। চন্দ্রকান্ত পৈতৃক ব্যবসায়ের কিছুই জানে না। তবু সে প্রাণপাত করিয়া ব্যবসাকে আবার দাঁড় করাইবার চেষ্টা করিতেছে। কিন্তু একা নিঃসহায় অবস্থায় সবদিক সামলাইতে পারিতেছে না। ফুটা নৌকার মতো দেবীর সংসার ধীরে ধীরে মজিবার উপক্রম করিতেছে।
এই বিপর্যয়ের মধ্যে অমিয়া একটি পুত্রসন্তান প্রসব করিয়াছে। অন্ধকারের শিশু, তাহার জন্মকালে নহবৎ বাজে নাই, মিষ্টান্ন বিতরিত হয় নাই। কিন্তু এই নাতিকে কোলে পাইয়া দেবী যেন নবজীবন লাভ করিয়াছে। সে এখন আর সংসারে কাজ দেখে না, নাতিকে কোলে লইয়া বসিয়া থাকে আর চিন্তা করে। অমিয়া নিঃশব্দে সংসারের সমস্ত ভার নিজের মাথায় তুলিয়া লইয়াছে।
একদিন দেবী চন্দ্রকান্তকে ডাকিয়া বলিল— ‘পাওনাদারদের সকলকে খবর দে, তারা যেন কাল সকালে আসে। আমি তাদের সঙ্গে কথা বলব।’
চন্দ্রকান্ত চমৎকৃত হইয়া মায়ের মুখের পানে চাহিল। এতদিন সে সংসারসমুদ্রে হাবুডুবু খাইতেছিল, এখন তাহার বুক নাচিয়া উঠিল। আর ভয় নাই, মা তাহার পাশে আসিয়া দাঁড়াইয়াছেন।
পরদিন সকালে পাঁচ-ছয় জন পাওনাদার আসিয়া বৈঠকখানায় বসিলেন। তারপর দেবী নাতিকে কোলে লইয়া তাঁহাদের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। বিধবার শুভ্র বেশ, মুখে শান্ত গাম্ভীর্য; সকলে সসম্ভ্রমে উঠিয়া দাঁড়াইলেন।
দেবী ধীর কণ্ঠে বলিল— ‘আপনারা বসুন। আমি কুলস্ত্রী আজ লজ্জা ত্যাগ করে আপনাদের সামনে দাঁড়িয়েছি। আমার কথা আপনাদের শুনতে হবে।’
একজন বলিলেন— ‘বলুন বলুন, কি বলবেন বলুন।’
দেবী বলিল— ‘আমার স্বামী আপনাদের কাছে টাকা ধার করেছিলেন। আমার স্বামীর ঋণ আমি শোধ করব; এক পয়সা বাকী রাখব না। কিন্তু আমাকে একটু সময় দিতে হবে।’
পাওনাদারেরা চুপ করিয়া রহিলেন।
দেবী আবার বলিল— ‘আমি আজই আপনাদের পাওনা শোধ করতে পারি। আপনাদের আদালতে যেতে হবে না, ডিক্রিজারি করতে হবে না। আমার এই বাড়িখানা আছে, আরও কিছু স্থাবর সম্পত্তি আছে, গায়ের গয়না আছে; সে সব বিক্রি করে আপনাদের টাকা চুকিয়ে দিতে পারি। কিন্তু তাতে, আমার ছেলেপিলে খেতে পাবে না, আমার এই নাতি এক ঝিনুক দুধ পাবে না। আপনারা কি তাই চান?
একজন তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিলেন— ‘না, না, সে কি কথা? আমরাও ছেলেপিলে নিয়ে ঘর করি, আপনাকে কষ্ট দেওয়া আমাদের উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু—’
দেবী বলিল— ‘তবে আমাকে এই অনুগ্রহটুকু করুন। আমি আমার এই নাতির মাথায় হাত দিয়ে দিব্যি করছি, আপনাদের টাকা আমি শোধ দেব, আমার স্বামীর ঋণ আমি রাখব না। আমাকে দয়া করে এক বছর সময় দিন।’
দেবীর কথা মহাজনদের মর্মস্পর্শ করিল, তাঁহারা এক বছর অপেক্ষা করিতে সম্মত হইলেন।
পরদিন হইতে দেবী কাজে লাগিয়া গেল। লজ্জা-সঙ্কোচ ত্যাগ করিয়া রীতিমত অফিস যাইতে লাগিল। চন্দ্রকান্ত সঙ্গে থাকিত, দেবী স্বামীর আসনে বসিয়া কাজকর্ম পরিচালনা করিত। পুরনো বিশ্বাসী কর্মচারীরা একে একে ফিরিয়া আসিল, সমব্যবসায়ী কয়েকজন বন্ধু বিধবাকে সাহায্য করিবার জন্য অগ্রসর হইয়া আসিলেন। রাধাকান্তদের বিলাত হইতে অনেক কাগজ আমদানী হইত, মাঝে বন্ধ হইয়া গিয়াছিল, বিলাতি কাগজওয়ালাদের সঙ্গে আবার সম্বন্ধ স্থাপিত হইল। দেখিয়া-শুনিয়া পুরাতন গ্রাহকরাও ফিরিয়া আসিতে লাগিলেন।
এক বৎসর হাড়ভাঙা খাটুনির পর ব্যবসা আবার দাঁড়াইয়া গেল। চন্দ্রকান্ত ইতিমধ্যে কাজকর্ম শিখিয়া লইয়াছিল। তাহাকে অফিসে বসাইয়া দেবী বলিল— ‘এবার তুই চালা। কাল থেকে আমি আর আসব না।’
পরদিন পাওনাদারদের ডাকিয়া দেবী তাঁহাদের টাকা চুকাইয়া দিল। তাঁহারা ধন্য ধন্য করিতে করিতে টাকা লইয়া প্রস্থান করিলেন।
দেবী কিন্তু ভিতরে ভিতরে জীবনে বীতস্পৃহ হইয়াছিল; তাহার কাজ শেষ হইয়াছে, আর বাঁচিয়া থাকিবার প্রয়োজন নাই।
নাতিটি ইতিমধ্যে দেড় বছরের হইয়াছে। দেবী তাহার নাম রাখিয়াছে ঊষাকান্ত। তাহার এখন পা হইয়াছে, সে সারাক্ষণ ঠাকুরমার আঁচল-চাপা থাকিতে রাজী নয়। খেলা করিতে করিতে সিঁড়ি দিয়া নীচে নামিয়া যায়, উঠানে ছুটাছুটি করিয়া খেলা করে।
একদিন এক কাণ্ড হইল। বাড়ির নীচের তলায় কাগজের গুদাম; ঊষাকান্ত গুদামের দ্বার খোলা পাইয়া ভিতরে প্রবেশ করিয়াছিল। তারপর কেমন করিয়া কাগজের গুদামে আগুন লাগিয়া গেল। শিশুকৈ কেহ গুদামে প্রবেশ করিতে দেখে নাই, অথচ বাহিরেও তাকে পাওয়া যাইতেছে না।
দেবী তখন সেই জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে প্রবেশ করিয়া শিশুকে উদ্ধার করিয়া আনিল। তাহার নিজের দেহ পুড়িয়া ক্ষতবিক্ষত হইয়া গেল, কিন্তু ঊষাকান্তের গায়ে আঁচ লাগিল না।
তারপর দমকল আসিয়া আগুন নিভাইল। আর্থিক ক্ষতি বেশী হইল না বটে, কিন্তু দেবী সর্বাঙ্গে দহনক্ষত লইয়া শয্যাগ্রহণ করিল।
ডাক্তার পরীক্ষা করিয়া বিশেষ ভরসা দিতে পারিলেন না; জীবনের আশা খুবই কম। তিনি যন্ত্রণা লাঘবের প্রলেপ দিয়া চলিয়া গেলেন।
রাত্রে দেবী অমিয়ার আঁচলে নিজের চাবির গোছা বাঁধিয়া দিয়া বলিল— ‘আমি চললুম। আজ থেকে তুমি এ বাড়ির গিন্নী।’ চন্দ্রকান্তও উপস্থিত ছিল, দুইজনে অঝোরে কাঁদিতে লাগিল।
গৌরীর শ্বশুরবাড়িতে বিলম্বে খবর পৌছিয়াছিল। দুপুর রাত্রে গৌরী আসিল, মায়ের বুকের উপর মাথা রাখিয়া কাঁদিতে লাগিল। দেবী কিন্তু চোখ খুলিয়া মেয়ের পানে চাহিল না। গৌরী কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, ‘মা, একবার কথা বল। বল আমাদের ক্ষমা করেছ।’
দেবী কিন্তু কথা কহিল না, চোখ মেলিয়া চাহিলও না। তারপর তাহার ডান হাতখানা ধীরে ধীরে উঠিয়া গৌরীর মাথার উপর স্থাপিত হইল; আঙুলগুলি গৌরীর চুলের মধ্যে একটু খেলা করিল।
তারপর তাহার অবশ হাত গৌরীর মাথা হইতে খসিয়া পড়িল।
দেবীর জীবনলীলা শেষ হইয়াছে।
২০ জ্যৈষ্ঠ ১৩৬৭