দ্বিতীয় খণ্ড (আমার গুরু, আমার স্বর্গত পিতাকে)
2 of 6

মাদার টিংচার

মাদার টিংচার

গগনচুম্বিতা থেকে পৌরাণিক ছায়াচিত্রে যেভাবে লক্ষ্মী জনার্দন কিম্বা হরপার্বতী স্বর্গ থেকে মেঘলোকের মধ্যে দিয়ে সাঁ করে সপরিবারে মর্ত্যে নেমে আসেন সেইভাবে নেমে এলেন লাহেড়ি দম্পতি। লিফটে চালক ছাড়া আরও চারজন ওঠা-নামা করতে পারেন। শ্রী ও শ্রীমতী লাহেড়ি আয়তনে ফোর ইজ টু টু। লিফটম্যান নেপালি। ফোলা-ফোলা গাল, গুলি-গুলি চোখ, তার ছ-সাত বছরের শিশুটি নীচের তলায় একপাশে দাঁড়িয়ে অবাক চোখে যন্ত্রের ওঠা নামা দেখে। অন্ধকার মতো জায়গায় লিফটের মাথার ওপর একফালি জায়গায় আলোর সংকেত জ্বলে আর নেবে, বারো, এগারো, দশ।

লিফটটা যতক্ষণ নামতে থাকে ততক্ষণ বোঝার উপায় নেই—কি নামছে, হাতি নামছে কি ঘোড়া নামছে। ফুস করে যেই দরজা খুলে যাবে, তখনই দারুণ মজা। কত রকমের জিনিস যে বেরোতে থাকে, যাদুকরের টুপি থেকে যেমন বেরোয়। কোনও প্রাণী বেঁটে মোটা, কোনও প্রাণী লম্বা রোগা। কোনও প্রাণী থলথলে, ঢলঢলে। কোনও প্রাণী দরকচা। কেউ বুলেটের মতো। ক্রিকেট বলের মতো ছিটকে বেরিয়ে আসেন। কেউ আসেন ধীরে-ধীরে হেলে দুলে। কেউ আসেন খড়খড় করে কাঁকড়াবিছের মতো লাফাতে-লাফাতে। কেউ এত উদাস, এত তন্ময়, একপাশে পিঠ লাগিয়ে দাঁড়িয়েই থাকেন, তারপর এক সময় দূরনিয়ন্ত্রিত পুতুলের মতো গুটিগুটি বেরিয়ে চলে যান। কেউ ভোলেবাবা, কেউ হালুম বাঘা। কারুর মুখ কালিমপঙের মুখোসের মতো, কারুর মুখ পাথরের মতো। গগনচুম্বিতার মনুষ্যশালায় এইসব বড় মানুষ, বড়িয়া মানুষরা থাকেন। বীরবাহাদুর সকাল থেকে সন্ধে যতক্ষণ সে জেগে থাকে, স্বর্গ থেকে মাঝে মাঝেই নেমে আসা এই সব দেবদেবীদের দ্যাখে। আর একটু বেশি রাতে যা ঘটে, তার সাক্ষী পাহাড়ি লিফটম্যান। লিফটের রবার টাইলস বসানো মেঝেতে শ্রীমতী ভরদ্বাজ যখন হাঁটু মুড়ে দোয়ানি খোঁজেন শ্রীভরদ্বাজ তখন জড়ানো গলায় বলতে থাকেন, বি স্টেডি মাই ডার্লিং অর আই উইল কিক ইউ-কিকি। মি: সেনগুপ্তকে যখন চ্যাংদোলা করে এককোণে মালের মতো জড়ো করে দিয়ে যায়, সিকসথ ফ্লোরে রাত বারোটার সময় চালান সই করে সেই মূল্যবান মালটিকে ডেলিভারি নেওয়ার কেউ থাকে না।

দরজা খুলে যেতেই মি: লাহেড়ি ভস করে আগে বেরোতে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ মনে হল, উঁহু, সায়েবি রীতিতে বলে লেডিজ ফার্স্ট, গিন্নি ফার্স্ট। পেছিয়ে এলেন সঙ্গে-সঙ্গে। তার এই হঠাৎ পেছোনোর জন্যে শ্রীমতী লাহেড়ি প্রস্তুত ছিলেন না। একটু মাকো-মাকো ধাক্কা হল দু-তাল পুডিং-এ। শ্রীমতী একটু সকরুণ আর্তনাদ করে কয়েকটি নেটিভ শব্দ ব্যবহার করে ফেললেন। বাতের ব্যথায় লাহেড়ির পদক্ষেপ। লাহেড়ি সঙ্গে-সঙ্গে বললেন, ক্যাবলা চণ্ডী। বলেই খুব লজ্জা পেলেন। উত্তর কলকাতার সাবেকি অভ্যাস। সঙ্গে-সঙ্গে সংশোধন করে বললেন, ও সরি, মাই ডিয়ার। অত:পর ডিয়ারের বগলের তলা দিয়ে একটা হাত চালিয়ে দুজন পাশাপাশি বেরোবার চেষ্টা করলেন। মুখপোড়া লিফট কোম্পানি পাশাপাশি স্বামী-স্ত্রীর মাপ জানে না। ফাঁদের তুলনায় চাঁদ বড়। অতএব কর্তা আগে, হাতে-ঝোলা গিন্নি পিছে বেরিয়ে গেলেন। টুলে বসে বাহাদুর তামাশা দেখে বেজায় খুশি।

শ্রীমতী লাহেড়িকে বিদেশি কায়দায় বগলদাবা করে বেরোতে-বেরোতে লাহেড়ি কেবলি শকুন্তলা সেনের কথা ভাবছিলেন। আহা, যেন লাউডগা। আহা, যেন টাট্টু ঘোড়া। এই বেতো তোলা উনুনটিকে নিয়ে জীবনের শেষ মাইল পোস্ট অবদি যেতে হবে। ও গড। দোতলা জুতো পরে হাঁটছে দ্যাখো। এই বুঝি মুখ থুবড়ে পড়ে। তখনি বারণ করেছিলুম, ওসব জিনিস যৌবন থেকে অভ্যাস করতে হয় বাছা। টুলো পণ্ডিতের মেয়ে ছেলেবেলা থেকেই শুনে আসছ অনভ্যাসের ফোঁটা কপাল চড়চড়। এই যেমন আমার পাইপ।

পাইপের কথা মনে পড়তেই লাহেড়ি বাঁ-হাতটা স্ত্রীর হাতের তলা থেকে মুক্ত করে নিলেন। উ:, ঘেমেছে দ্যাখো। কতদিন বলেছি সিনথেটিক ছেড়ে তাঁত ধরো। যা ধাতে সয়, তাই করো। দেহাতী ভুঁড়ি বের করে এই বয়েসে কার মনে আর বসন্তের কোকিল জাগাবে। একমাত্র ঘৃতব্যবসায়ীদের নজর পড়তে পারে। মেদের তিনটি সুপুষ্ট ভাঁজ হ্যামের মতো কেটে নিলে একদিন ভালো মটকির ঘি হতে পারে। আর কি তোমার সে শরীর আছে, ভদ্রে, যে শরীর পাবলিকের সামনে কালোয়াতের মত খেলানো যায়।

পাইপ ধরাতে গিয়ে লাহেড়ির সেই সমস্যা। নিজের ওপরই রাগ ধরে যায়। নীচে থেকে ওপরে উঠলে এই রকমই হয়। যখন ক্লার্ক ছিলে, সিগারেট টেনেছ। জুনিয়ার অফিসার হয়ে চুরুট। এই অবধি বেশ ছিল। ম্যানেজমেন্ট র‌্যাঙ্কে গিয়েই হয়েছে জ্বালা। জাত সাহেবদের ধরনই আলাদা। মুখে ত্যারছা করে ধরা পাইপ। ভসভস ধোঁয়া। একটু আড় হয়ে মোটরের স্টিয়ারিং হুইল ধরেছে। ক্লাচ আর ব্রেকের ওপর পা খেলছে না তো, বেগম আখতারের আঙুল খেলছে হারমোনিয়ামের রিডের ওপর। ধ্যুৎ তেরিকা। থামের আড়ালে সরে গেলেন লাহেড়ি। আধ বাকসো দেশলাই শেষ। ভিজে বারুদের মতো পাইপের তামাক আর ধরতেই চায় না। আশ্চর্য ব্যাপার। চারদিক নিথর, নিস্তব্ধ। গাছের একটা পাতাও হাওয়ায় কাঁপছে না। পাইপ ধরাতে যাও, সঙ্গে-সঙ্গে সাইক্লোন। পাইপোক্র্যাসি বড় শক্ত জিনিস।

শ্রীমতী লাহেড়ি পর্বতের মতো হাওয়া আড়াল করে স্বামীকে পাইপ ধরাতে সাহায্য করলেন। ফোলা-ফোলা মুখে আদুরে গলায় বললেন, একেবারে ল্যাদাডুস। দ্যাখোনি নোভালজিন সাহেব কীরকম একটা কাঠিতে পাইপ ধরাত। যেমন চেহারা তেমনি ফুসফুসের জোর। একটানেই ব্লপ। তোমার এই এতখানি ভুঁড়ি আর চাকাপানা মুখটাই আছে, কাজের বেলায় ঢ্যাঁড়স।

ঠোঁটের ডগায় পাইপের মসৃণ স্পর্শ পড়তেই লাহেড়ি পাইপোক্র্যাটি। তখন দুনিয়াটা তার অফিস। সকলেই তার অধস্তন। রবিবারের সকালে মেজাজ এমনিই সপ্তমে চড়ে থাকে। মার্কেটিং ডে। লাহেড়ি বলেন, মর্কটের দিন কাজের চেয়ে অকাজের জিনিস কেনা হবে বেশি। স্ত্রী কখনও কলা দেখে দৌড়াবেন, মুলো দেখে হামড়ে পড়বেন। শাড়ি দেখে ভিরমি খাবেন। লাহেড়ি তখন অবাধ্য ঘোড়ার সওয়ার। কেবলই লাগাম টানছেন। ঘোড়া সামনের দুটো পা তুলে চিঁহি চিঁহি করছে আর ছিটকে ফেলে দিতে চাইছে। স্ত্রীর কথা শুনে লাহেড়ির ইচ্ছে করছিল এখুনি চার্জশিট দিয়ে ডিসচার্জ করে দিতে। হাটাও। তেজি ঘোড়ার চাঁট সহ্য হয়। বেতো ঘোড়া বেআদবি করলে সঙ্গে-সঙ্গে দাওয়াই। রাখো তোমার ইংলিশ এটিকেট। রাখো তোমার ভারতীয় বৈদিক সংস্কৃতি। গার্গী, মৈত্রেয়ী নিশ্চয় নিউমার্কেটে মার্কেটিং করতে যাওয়ার মতো মর্কট ছিলেন না। জনসমক্ষে ভুঁড়ি তুলে অপমান। অডাসিটি। তুমি জানো আমার কত রূপ। আমি বিশ্বরূপ। পাইপ খুলে নিয়ে লাহিড়ি দাঁতাল হলেন।

বেতো রুগি তুমি আর মুখ নেড়ো না। পায়ের জয়েন্ট মোড়ে না, ডবলডেকার জুতো পরে হাঁটছে যেন বক। সাজপোশাক দেখলে মেয়েছেলেও লজ্জা পাবে। হতে দিলে সাত ছেলের মা হতে, গাল বেয়ে কলারড ঘাম নামছে। সাজতেও শেখোনি, কথা বলতেও শেখোনি। কালচার শিখতে হলে শকুন্তলার কাছে যাও। লাহিড়ি এক ঝলক ঝেড়ে পাইপ গুঁজে মুখ বন্ধ করলেন।

শকুন্তলা তোমার মতো শকুনিকে বাঁ-পায়ে কিক করে। সে হল সানিপার্কের মেয়ে। তার যেমন লিকার, তেমনি ফ্লেভার। ওসব মেয়ে রুদ্রাক্ষ সেনের মোটর বাইকের পেছনেই মানায়। নিজে তো জীবনে ভয়ে সাইকেলেই উঠতে পারলে না। ওই তো বেঁটে-বেঁটে ধনুকের মতো পা। তিনি আবার ঘোড়ায় চড়ার স্বপ্ন দেখেন। শ্রীমতী লাহিড়ি বেশ মনের মতো করে কথাগুলো গুছিয়ে বলতে পেরে পেট খোলসা করার আনন্দ পেলেন।

দাঁতে পাইপ চেপে লাহিড়ি বললেন, মুখ সামলে হৈম। ঐকারটাই কাল হল। দাঁতে পাইপ চেপে ইংরেজি বলা যায়; বাংলার একার, ঐকার, ওকার, ঔকার ঠোঁট ফাঁক করে দেয়। যেমন বিড়িফোঁকা জাত, তার তেমনি ল্যাঙ্গুয়েজ। পাইপটা খুলে পড়ে যাচ্ছিল, তাড়াতাড়ি হাত দিয়ে ধরে ফেললেন।

হৈম বললেন, তোমার ওই হলদে হলদে জনডিসের চোখ তোমার জুনিয়ারদের দেখিও। সান্নালের মেয়ে লাহিড়ির পায়ের স্যান্ডেল হয়ে থাকবে না। চলে যাব জামাইয়ের কাছে, জামাই আদরে রাখবে। সোনার চাঁদ ছেলে। সুইডেনে সি এ। দুটো গাড়ি। তোমার মতো শ্বশুরকে একহাতে কিনে আর একহাতে বেচতে পারে। জীবনে সুইডেন দেখেছ! না দেখবে!

তুমহারা সাথ মার্কেটিংমে নেহি যায়েগা।

নেহি যায়েগা তো হামারা কচু পোড়া। স্ত্রী ফড়কে চলে গেলেন লিফটের দিকে। একে উঁচু জুতো তায় পায়ে বাত, তার ওপর ফসফসে শাড়ি। লাহিড়ি মনে-মনে বললেন, টাল খেয়ে একবার পড়ে মুটকি। তেজ বেরিয়ে যাবে। আমার ধমমো পত্নীরে।

নীচেটা গ্যারেজ। গাড়ি আসা-যাওয়ার জায়গা। একপাশে লম্বাফালি ফুল গাছের কেয়ারি। বিশাল বিশাল থাম। কোথাও থইথই নীল আলো, কোথাও নীল-কালো অন্ধকার। অনেকটা দূরে হোস পাইপে জল দিয়ে মেঝে পরিষ্কার করছে। নেভা পাইপ ঠোঁটে চেপে লাহিড়ি লিফটের দিকে এগিয়ে গেলেন। লিফট উঠে যাচ্ছে ওপর দিকে। এক পাশে বীরবাহাদুর টুলে বসে আছে। অন্য সময় হলে লাহেড়ি গ্রাহ্য করতেন না। এখন তিনি স্ত্রী-পরিত্যক্তা। মনটা ভীষণ চিড়বিড় করছে। হাসি-হাসি মুখে ছেলেটির দিকে তাকালেন। হাত বাড়িয়ে বীরবাহাদূরের মাথার সোনালি চুল ঘেঁটে দিলেন। ছেলেটি ভয়ে টুল থেকে নেমে চোঁ করে দৌড়।

অফিস, বাড়ি, উন্নতি, পরিবার ছাড়া দীর্ঘকাল অন্য কিছু ভাবা হয়নি। এক সময় আমারও শৈশব ছিল, ওই ভাবেই খরগোশের মতো দৌড়োতে পারতুম, জলে ঝাঁপাতুম, গাছে চড়তুম, আর আজ! শৈশবটাকে কোনও অলৌকিক কায়দায় যদি শৈশবেই ধরে রাখা যেত চির বসন্তের মতো! লিফট নামছে। সাত, ছয়, পাঁচ। বয়েসটাকেও যদি ওইভাবে নামানো যেত, পঞ্চাশ, উনপঞ্চাশ, আটচল্লিশ। জীবনটাকে আবার শুরু থেকে শুরু করতুম। অন্ধকার কোণ থেকে কে যেন হেঁকে উঠল, লাহিড়ি সাব। পাইপ ফিরে গেল দাঁতে, মুখের ভাঁজ মিলিয়ে গেল নিমেষে। ঘুরে দাঁড়ালেন। কে ডাকছে! অবাঙালির গলা। কে? আমাকে তুমি দেখতে পাবে না, আমি কৃষ্ণ। এই কৃষ্ণকালো জায়গাটায় মিশে আছি আর একবার রিপিট করছি, শোনো।

ক্লৈব্যং মাস্ম গম: লাহিড়ি নৈতৎ ত্বয্যুপপদ্যতে।

ক্ষুদ্র হৃদয়দৌর্ব্বল্যং ত্যক্তোত্তিষ্ঠ বোকাপাঁঠা।।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *