দ্বিতীয় খণ্ড (আমার গুরু, আমার স্বর্গত পিতাকে)
2 of 6

মাদার টিংচার

অসি ফেলে ধরব বাঁশি

জেনারেশান গ্যাপে যে গ্যাপটা ছিল সেটা প্রায় ভরাট হয়ে এসেছে। বুড়ো-হাবড়া বিরক্তিকর যে-ক’টা প্রাণী ছিল, এই শীতে মনে হয় শেষ হয়ে যাবে। সামনের বছর নয়া জমানা পুরোপুরি শুরু হয়ে যাবে। আর দু-হাজার এক অব্দে বইপত্তর সব নতুন করে লিখতে হবে। ভাষা পালটাতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাক্রম ঢেলে সাজাতে হবে। জীবিকা বদলে যাবে। গ্রাম্য ভাষায় বললে বলতে হয়, ট্র্যাডিশানের ক্যাঁথায় আগুন। এখনও যা-যা করলে আমরা বলি, হিরের টুকরো ছেলে, অমন লোক আর একটি হয় না, সেই-সেই কাজ করলে আর বছরকয়েকের মধ্যেই বলা হবে, ছেলেটা কি লোকটা একটা খাজা। লুজ ক্যারেকটার। মেনিমুখো। কুছ কামকা নেহি হ্যায়। ক্যাবলা, হাবলা, গোবলা। মহাপুরুষের সংজ্ঞা পালটে যাবে। বিগতরা হয়ে যাবেন সব পাগল-ছাগল। ধর্মগুরুদের বলা হবে ঘি-দুধ খেকো ব্যাবসাদার। সমাধিকে বলা হবে হিস্টিরিয়া। পূর্বতন দেশনেতাদের বলা হবে রিঅ্যাকশানারি। বিদেশে যেমন শুরু হয়েছে আর কি! ফেলা-তোলার খেলা। আজ এর সমাধি তুলে এনে বসানো হচ্ছে শহরের মাঝখানে। ম্যস্যলিয়ামে। কাল ওকে তুলে ফেলে দিয়ে আসছে ভাগাড়ে। সেকালের বরেণ্য দেশনেতা একালের রিঅ্যাকশানারি। যেমন একালের শহিদ। ওয়াগন ভাঙতে গিয়ে, গুলি খেয়ে পটল তুলেছে পটলা। পটলা শহিদ। ডাকাতি করে পালাতে গিয়ে মরেছে মগনলাল। মগনলাল শহিদ। শহরের বড় বড় দোকান চাপা পড়ে গেছে ছোট-ছোট ফুটপাথ-স্টলের আড়ালে। দড়া, দড়মা, লাঠি, প্ল্যাস্টিকের ঝুলঝুলির আড়ালে চলে গেছে সুদৃশ্য সব ঝলমলে দোকান। সেই রকম বড় মন্দিরের বদলে গজিয়ে উঠছে মিনি-মন্দির। একটা করে গাছ, তার তলায় তেকোণা একটা ঘুলঘুলি। সেরামিক টাইলসে বড়লোকের বাথরুমের দেওয়াল ঢাকা পড়ে। সেই একই টাইলসে সেজে ওঠে পথমন্দির। বড়ধর্মের চেয়ে ছোটধর্মের দাপট বেশি। ভোলানাথ ছাড়া আর সব দেবদেবী দু-হাজার অব্দে পাত্তা পাবেন কি না সন্দেহ। মহেশ্বর যে কল্কেশ্বর। তিনটানেই সিদ্ধি। চটজলদির যুগ। লণ্ড্রির বাইরে আজকাল লেখা থাকে তিনঘণ্টায় আড়ং ধোলাই ও ডেলিভারি। ব্যাঙ্কে টেলার সিস্টেম মিনিটে চেক ক্লিয়ার। ম্যারেজ রেজিস্টারের অফিসে পাঁচ মিনিটে বিয়ে। তিন মিনিটে তিন কপি কালার ফটো। ইনস্ট্যান্ট কফি, কুইক ফুড। ধরো আর মারোর যুগে সিদ্ধি খেয়ে নিমেষে সিদ্ধি। তাহলে জিনিসটা কী দাঁড়াচ্ছে? সাত হাত অন্তর মহেশ্বর। তার পাশেই একজন শহিদ। বাংলা ভাষা তো ক্রমশই চেহারা পালটাচ্ছে। দু-হাজারে একেবারে অন্য চেহারা নেবে। ছেলে মায়ের কাছে বাপের খোঁজ নেবে এই ভাষায়, ‘মালটা গেল কোথায়?’ আমাদের চেনাজানা সবকিছুর পরিচয় প্রকাশ পাবে এই একটি কথায়, ‘মাল’। প্রাচীন তো একেবারে যাবে না; প্রতিক্রিয়াশীলদের মতো এখান দিয়ে, ওখান দিয়ে ফুঁড়ে বেরিয়ে আসবে। প্রাচীন পন্থীদের ঘাঁটিতে হয়তো সভা হচ্ছে। বক্তা বলছেন, স্বামী বিবেকানন্দ, কি রাজা রামমোহন। লাল টুকটুকে ‘ইমাহা’ চেপে যাচ্ছিল, মানে ‘পাস’ করছিল, দু-হাজার অব্দের নায়ক-নায়িকা। নায়ক প্রশ্ন করলে, ‘মালটা কে ছিল বে’।

ভোকাবালারিতে ‘মাল’ আর ‘বে’ শব্দ দুটোর ব্যাপক অনুপ্রবেশ ঘটবে। সবাই হয়ে যাবে ‘গুরু’। কারণ ‘গুরু ছাড়া অন্য কোনও সম্বোধন থাকবে না। ছেলে বাবাকে ফোন করছে, ‘হ্যাললো গুরু, আড্ডাটা বড়িয়া জমে গেছে। তোমার ক্যাম্পে আজ ফিরতেও পারি, না-ও পারি।’ বাবা অমনি বলবে, ‘ঠিক আছে গুরু’। সমাজতন্ত্রে সব সমান। সবাই গুরু। কেউ চ্যালা নেই। আমরা সবাই রাজা।

স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, বাড়ি থাকবে, ছাত্র-ছাত্রী থাকবে, তবে ক্লাসটালাস কিছু হবে না। মাইক থাকবে। থাকবে লাগাতার বক্তৃতা। আর থাকবে নির্বাচন। যেমন হাসপাতাল আর নার্সিং হোম। সেইরকম ভালো কিছু স্কুল-কলেজ থাকবে, যেখানে মন্ত্রীদের আর বড় বড় ব্যবসায়ীদের ছেলেমেয়েরা পড়বে। তারপর সোজা চলে যাবে বিদেশে। একদল উঠে যাবে হুহু করে ওপরে। তাদের আলাদা একটা সমাজ তৈরি হবে। এরা কন্ট্রোল করবে অর্থনীতি। তৈরি করবে কালচার। যে কালচার বিজ্ঞাপন হয়ে উঠবে টিভির পরদায়।

তারপর একটা অদ্ভুত কাণ্ড হবে। ওরা শিল্প করবে, এরা ধর্মঘট করবে। ওরা কালো টাকার পাহাড় করবে, এরা ডাকাতি করবে। ওরা গাড়ি হাঁকাবে, এরা রাস্তা দেবে না। চাঁদা আদায় হবে এদের জীবিকা। চাঁদা দেওয়াই হবে ওদের বাঁচার রাস্তা। বারোয়ারি যাত্রা আর ফাংশন ছাড়া আর কিছুই করার থাকবে না। এরা টানবে, ওরা ছাড়তে চাইবে না। শুরু হয়ে যাবে টাগ অফ ওয়ার। ওরা চেঁচাবে, পুলিশ, পুলিশ, তারপর সেই গানের মতো, বাঁশি ফেলে ধরব অসি। পুলিশ চোরধরার বাঁশ ফেলে, আড়বাঁশি ধরবে। বাঁকা শ্যাম হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে ট্র্যাফিক দ্বীপে। আর ডাকবে, রাধিকাকে নয়, লরি আও, লরি। লরি মেরা জান। ওপরওয়ালা চেঁচাবে, বাঁচাও বাঁচাও। কে বাঁচাবে? সবই তো তখন গেঁজে গেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *