মাদাম কুরি (১৮৬৭–১৯৩৪) – সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহিলা বিজ্ঞানী
জীবনের একেবারে শুরুতেই দুঃখ-দারিদ্র্য আর প্রিয় ব্যক্তিকে কাছে না পাওয়ার মর্মবেদনায় যিনি আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলেন, বলেছিলেন, “এই ঘৃণিত পৃথিবী থেকে আমি বিদায় নিলে ক্ষতি খুব সামান্যই হবে” সেই অভিমানী তরুণীই নিজের প্রচেষ্টায় পরবর্তীকালে হয়েছিলেন জগদ্বিখ্যাত বিজ্ঞানী এবং বিশ্বের সর্বকালের সেরা মানুষদের একজন। তিনিই একমাত্র বিজ্ঞানী যিনি বিজ্ঞান গবেষণার স্বীকৃতিস্বরূপ দু-দুবার নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। উল্লেখ্য, নোবেল পুরস্কারের আর কোনো বিভাগেই এযাবৎ আর কেউ, তিনি পুরুষ কি মহিলা, দু’বারের মতো এই বিরল সম্মানের অধিকারী হতে পারেননি। ভাঙতে পারেননি তাঁর রেকর্ড।
এই প্রাতঃস্মরণীয় বিজ্ঞানী মাদাম মারি কুরির (Madam Marie Curie) জন্ম পোল্যান্ডের ওয়ারশ শহরে ১৮৬৭ সালের ৭ নবেম্বর। তাঁর বাল্যনাম ছিল মানিয়া (Manya)। মানিয়ারা ছিলেন মোট পাঁচ ভাইবোন। বড় বোনের নাম জোসিয়া, তারপর ভাই জোসেফ, তারপর ব্রোনিয়া এবং ব্রোনিয়ার পর হেনা।
পিতা ভ্লাডিশ্লাভ স্লোডোভস্কি ছিলেন একজন শিক্ষক। মাও ছিলেন স্থানীয় মেয়েদের একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষয়িত্রী ও পরিচালিকা।
এই সময় পোল্যান্ড ছিল জারশাসিত রাশিয়ার একটি ঔপনিবেশিক রাজ্য। তাই স্বাভাবিকভাবেই অত্যাচারী শাসকদের হাতে সীমাহীন নির্যাতনের শিকার হতেন দেশটির সাধারণ মানুষ। ফলে পরাধীন পোল্যান্ডবাসীর মনে ছিল মুক্তির প্রবল আকাঙ্ক্ষা, আর ছিল অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে চরম ঘৃণা।
এই ঔপনিবেশিক শাসনের বেড়াজাল থেকে দেশকে স্বাধীন করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা যাঁদের মনে ছিল, তাঁদের অন্যতম ছিলেন মারির পিতা। এর পরিণামে যা হবার তা-ই হয়েছিল। ১৮৬৩ সালে দেশদ্রোহিতার অপরাধে স্কুল থেকে তাঁর চাকরি চলে যায়। ফলে আরও তীব্র অর্থসংকটের শিকার হয় কুরিদের পরিবার।
এই অবস্থায় মারির বাবা পাঁচ পাঁচটি সন্তানকে বাঁচানোর জন্য একটি বোর্ডিং স্কুল খুলে বসলেন। কিন্তু এর মধ্যেই ঘটল আরও বড় ধরনের একটা দুর্ঘটনা। মারির যখন দশ বছর বয়স, তখনই যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর মায়ের মৃত্যু হলো। এবার আরও এলোমেলো হয়ে গেল তাঁদের পরিবার।
মারি বাল্যকাল থেকেই ছিলেন অসম্ভব মেধাবী। অবশ্য এই পরিবারের প্রত্যেকেই পড়াশোনায় ছিল অত্যন্ত ভালো। ১৮৮৩ সালে স্কুল ফাইনাল পরীক্ষায় মারি লাভ করেন স্বর্ণপদক।
বয়সের দিক দিয়ে ক্লাসে সে সকলের ছোট অথচ পড়াশোনায় সকলের ওপরে। একবার যা পড়ে, অমনি সেটা তাঁর মুখস্থ হয়ে যায়।
একবার তাঁদের স্কুলে হয়েছিল একটা মজার কাণ্ড। ক্লাসে শিক্ষয়িত্রী পোলিশ ভাষায় পোল্যান্ডের ইতিহাস পড়াচ্ছিলেন। পড়ানো শেষ করে ছোট্ট মারি অর্থাৎ মানিয়াকে প্রশ্ন করলেন শিক্ষয়িত্রী, অমনি সে ঝরঝর করে দিয়ে গেল সব উত্তর।
অথচ এ-রকম ব্যাপার ছিল নিষিদ্ধ। রাশিয়ার জার শাসনামলে স্বদেশের ইতিহাস ক্লাসে শিক্ষা দেওয়া ছিল দেশোদ্রোহিতার সামিল। আর ঠিক সেই সময় কি না সোজা তাদের ক্লাশরুমে ঢুকলেন স্কুল ইনস্পেক্টর মঁসিয়ে হরনবের্গ। ঢুকেই তিনি সবার মুখের দিকে তাকালেন। আকস্মিক এই ঘটনার মুখে ক্লাসের শিক্ষয়িত্রী তুপস্কাও ভয় পেয়ে গেলেন।
হরনবের্গের সন্দেহ হল, ক্লাসে অন্যরকম কিছু একটা হচ্ছিল। তাই তিনি সরাসরি শিক্ষকাকেই জিগ্যেস করলেন—ক্লাসে আপনি কী পড়াচ্ছিলেন?
–ক্রিলভের একটি রূপকথার গল্প।
–ডাকুন তো ছাত্রীদের।
ডাক পড়ল মানিয়ার। তাকেই প্রশ্ন করা হলো। সেও অবশ্য ততক্ষণে ব্যাপারটি বুঝে গিয়েছিল। কারণ মানিয়ার বয়স কম হলেও বুদ্ধিতে ছিল বেশ প্রখর।
মানিয়াকে প্রশ্ন করা হলো, বলো তো রাশিয়ার সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী কে?
মানিয়া কৌশলে উত্তর দিল, রাশিয়ার মহামান্য জার।
ইনস্পেক্টর খুশি হলেন। বেঁচে গেলেন দেশপ্রেমিক শিক্ষিকা তুপস্কা। ইনস্পেক্টর চলে গেলে এই চমৎকার উপস্থিত বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেয়ার জন্য শিক্ষিকা আনন্দে জড়িয়ে ধরলেন মানিয়াকে।
এই ঘটনার মাত্র কিছুদিন আগে মায়ের মৃত্যু হয়েছে। তাই বাবার মনে ভয়, মানিয়াও যদি ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে! তাই তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় গ্রামের বাড়িতে। সেখানে তাঁকে নাচগান শেখার ব্যবস্থা করে দেওয়া হলো। নাচ খুব ভালো ব্যায়ামও বটে। ব্যায়াম করলে শরীর সুস্থ থাকবে। রোগ-বালাই তাহলে দূরে থাকবে। তাই এই ব্যবস্থা।
দেশের বাড়িতে মানিয়া প্রায় বছরখানেক ছিলেন। কিন্তু নাচ তাঁর মোটেও ভালো লাগল না। মন পড়ে ছিল গণিতের বইয়ের পাতায়। তাই তিনি আবার ওয়ারশয় ফিরে এসে কলেজে ভর্তি হবার চেষ্টা করতে লাগলেন। কিন্তু তখন তাঁর পিতার আর্থিক অবস্থা মোটেও ভালো ছিল না। পাঁচটি সন্তানের একসাথে লেখাপড়ার খরচ চালানোর সামর্থ্য ছিল না তাঁর
কিন্তু পড়াশোনা যে তাঁকে করতেই হবে। তাঁকে বড় হতেই হবে। কিন্তু কেমন করে? কী আর করা, অনেক ভাবনা শেষে মানিয়া আর তাঁর বড় বোন ব্রোনিয়া দুজনে বসে তাঁদের ভবিষ্যৎ জীবন সম্পর্কে একটা পরিকল্পনা এঁটে ফেললেন।
দু’জনের মধ্যে এই মর্মে চুক্তি হলো, মানিয়া প্রথমে চাকরি নেবে, আর বড় বোন ব্রোনিয়া প্যারিসের বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে ভর্তি হবে। মানিয়া চাকরি করে তাঁর পড়ার খরচ চালাবে, তারপর ব্রোনিয়ার পড়া শেষ হলে সে নিজে চাকরি নিয়ে মানিয়াকে পড়াশোনার সুযোগ করে দেবে।
এই চুক্তি অনুসারেই মানিয়া চাকরি নিল একজন অভিজাত রুশীয়ের বাড়িতে। কিন্তু এই রুশীয় আইনজীবী ভদ্রলোকের বউটা ছিল ভয়ানক বদমেজাজি। ফলে এখানে বেশিদিন টিকে থাকা মানিয়ার পক্ষে সম্ভব হলো না।
পরে সে চাকরি নিল অন্য একটা বাড়িতে। এখানে সে তিন বছর পর্যন্ত গভর্নেসের চাকরি করে। চাকুরি করতে করতেই গৃহকর্তার ছেলের সঙ্গে তাঁর অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কিন্তু ছেলের মা একজন গভর্নেসের সঙ্গে ছেলের বিয়ে দিতে রাজি হলেন না। ফলে মানিয়া অর্থাৎ ভবিষ্যতের মারি কুরি মানসিক ভাবে দারুণ আঘাত পান এবং জীবনে নেমে আসে ঘোর হতাশা। এই সময় তাঁর লেখা এক চিঠিতে তাঁর সেই গভীর হতাশারই ছবি ফুটে উঠেছে এইভাবে। “এই ঘৃণিত পৃথিবী থেকে আমি বিদায় নিতে চাই। এতে ক্ষতি হবে খুব সামান্যই।’
এদিকে ব্রোনিয়া ডাক্তারি পাস করে তাঁরই এক ক্লাসফ্রেন্ডকে বিয়ে করে বসেন।
আর মানিয়া হতাশা কাটিয়ে নিজের কিছু জমানো টাকা আর ব্রোনিয়ার আশ্বাসের ওপর ভরসা করে প্যারিসের সারবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ভর্তি হলেন বিজ্ঞান বিভাগে। জীবনকে পরিপূর্ণ ভাবে গড়ে তোলার জন্য নামলেন একান্ত সাধনায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান গবেষণাগারের নির্জন পরিবেশে কাটাতে লাগলেন দিনের পর দিন।
চলছিল ভয়ানক অর্থকষ্টও। বড় বোন যা দিতেন, পরিমাণ ছিল খুবই সামান্য। তাই প্রায় প্রতিদিনই তাঁকে কেবল রুটি-মাখন খেয়ে আধপেটা হয়ে কাটাতে হতো। এই কঠোর পরিশ্রম, উপরন্তু খাদ্যের অভাবজনিত অপুষ্টি। এর জন্য তাঁর স্বাস্থ্য খুব দ্রুত ভেঙে পড়তে থাকে। কিন্তু গবেষণায় তাঁর ক্ষান্তি নেই।
১৮৯৩ সালে তিনি পদার্থবিজ্ঞানে প্রথম স্থান অধিকার করে Master of Science ডিগ্রি লাভ করেন এবং পরের বছর পদার্থ বিজ্ঞানেরই অপর আরেকটি শাখায় অধিকার করেন দ্বিতীয় স্থান।
১৮৯৮ সালে প্যারিসে সফররত তাঁর পূর্বপরিচিত পোলিশ অধ্যাপক কোভ্যালস্কির মাধ্যমে ফরাসি তরুণ বিজ্ঞানী পিয়েরে কুরির (Pierre Curie) সঙ্গে তিনি পরিচিত হন। এই সময় মারির বয়স ছিল ২৭ এবং পিয়েরের বয়স ৩৫ বছর।
পিয়েরে কুরিও ছিলেন পদার্থবিজ্ঞান এবং রসায়নবিজ্ঞানের প্রতিভাবান বিজ্ঞানী। ইতিমধ্যেই চৌম্বকত্ব ও পদার্থবিজ্ঞানের শাখায় তিনি মৌলিক গবেষণায় অবদান রেখেছেন। তিনি তাঁর ভাই জ্যাক-এর সাথে একত্রে কাজ করে আবিষ্কার করেছেন পিজো বিদ্যুতের সূত্র।
কোভ্যালস্কির বাড়িতে মানিয়াকে প্রথম দেখে এবং তাঁর সঙ্গে বিজ্ঞানের নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা শেষে খুবই খুশি হন পিয়েরে। এতদিন তাঁর ধারণা ছিল, মেয়েরা স্বল্পবুদ্ধিসম্পন্ন এবং তারা বিজ্ঞান-শিক্ষা ও গবেষণাকাজের জন্য একেবারেই অনুপযোগী। কিন্তু মানিয়ার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ আর আলাপেই পিয়েরে কুরির সেই পুরনো ধারণা পালটে গেল। এই স্বর্ণকেশী সুন্দরী এবং বিরল প্রতিভার অধিকারিণীর রূপ আর গুণের পরিচয়ে তাঁর মুগ্ধতার আবেশ যেন কাটতেই চায় না।
এর পর থেকেই মানিয়া অধ্যাপক শুজেন বার্জারের গবেষণাগারে তরুণ বিজ্ঞানী পিয়েরে কুরির সঙ্গে একত্রে গবেষণা করার অনুমোদন লাভ করেন। এই একত্র কাজ করার মধ্য দিয়েই পিয়েরের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পায়। তাঁদের দুজনের মধ্যে গড়ে ওঠে একটি নিবিড় সম্পর্ক। এর এক বছরের মধ্যে অর্থাৎ ১৮৯৫ সালে মানিয়া পিয়েরের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এরপর থেকে তিনি স্বামীর নাম ব্যবহার করে মানিয়ার পরিবর্তে পরিচিত হয়ে ওঠেন মাদাম মারি কুরি নামে। বিশ্ব জুড়ে আজ এ নামেই তাঁকে একডাকে চেনে। বিয়ের অব্যবহিত পর থেকে মারি একান্তভাবে স্বামীর সঙ্গে চুম্বক ও বিদ্যুতের সমস্যাবলি নিয়ে গবেষণায় আত্মনিয়োগ করেন।
১৮৯৬ সালে মারি কুরি প্রথম হয়ে ফেলোশিপ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এই সময় বিজ্ঞানী অরি বিক্কুয়েরেল (Henri Becquerel) ইউরেনিয়াম নিয়ে পরীক্ষা করতে গিয়ে লক্ষ্য করেন, সূর্যের আলো ছাড়াই ইউরেনিয়াম এক নতুন ধরনের আলোকরশ্মি বিকিরণ করছে। ঘটনাটা আকস্মিকভাবেই ঘটেছিল। একদিন তিনি অন্ধকার ঘরে ফটোগ্রাফি প্লেটের ওপর কাগজে কিছু ইউরেনিয়াম যৌগ রেখে যান। খানিকক্ষণ পরে এসে দেখেন, কোনোরকমের আলো ছাড়াই ইউরেনিয়াম যৌগ থেকে বিকীর্ণ রশ্মি প্লেটের ওপর ছবি এঁকে দিয়েছে। তিনি এই নতুন রশ্মির নাম দেন বিক্কুয়েরেল রশ্মি। তিনি বুঝতে পারেন, ইউরেনিয়ামের নিজস্ব গুণের মাধ্যমেই এমনটা হচ্ছে। কিন্তু এক পর্যায়ে তিনি তাঁর গবেষণা নিয়ে সমস্যার সম্মুখীন হলে তাঁর সাহায্যে এগিয়ে আসেন কুরি দম্পতি। উদ্ভূত সমস্যা পর্যবেক্ষণ করে কুরির ধারণা হলো, অপরিশোধিত খনিজ পদার্থ ইউরেনিয়াম পিচব্লেন্ডের (Uranium Pitch Blaende) ভেতর ইউরেনিয়াম ছাড়াও নিশ্চয়ই অন্য আর কোনো পদার্থও আছে। তাই তিনি শুরু করলেন পিচব্লেন্ড খনিজ পদার্থ নিয়ে গবেষণা। কিন্তু এই মূল্যবান খনিজ পদার্থ পিচব্লেন্ড একমাত্র অস্ট্রিয়া ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যায় না। তাই অনেক চেষ্টা-চরিত্রের পর অস্ট্রিয়া থেকেই সংগ্রহ করে আনা হলো পিচব্লেন্ড খনিজ পদার্থ।
এরপর কুরি দম্পতি লেগে গেলেন এই অপরিশোধিত খনিজ পদার্থ শোধনের কাজে। একটানা দীর্ঘ দুবছর কঠোর পরিশ্রমের পর তাঁরা আবিষ্কার করলেন ‘বিসমার্থ’ যৌগিক উপাদান। আর বিসমার্থকে আরও শোধন করতে গিয়েই তাঁরা পেয়ে যান তাঁদের কাঙ্ক্ষিত বস্তু।
১৮৯৮ সালের জুলাই মাসে কুরি দম্পতি ঘোষণা করলেন তাঁদের নতুন আবিষ্কৃত উপাদানের কথা। এর তেজষ্ক্রিয়তা ইউরেনিয়ামের চেয়ে ৪০০ গুণ বেশি। এর নাম রাখা হলো পোলোনিয়াম (Polonium)। কিন্তু কুরি দম্পতি তাতেও খুশি হলেন না। ফলে তাঁদের গবেষণা চলতেই থাকল। অবশেষে এর কিছুদিন পর পাওয়া গেল আরও অত্যাশ্চর্য কিছু নতুন উপাদানের। তাঁরা এই নতুন পদার্থটির নাম দিলেন রেডিয়াম (Radium)।
এই রেডিয়াম সত্যিকারভাবেই অদ্ভুত এক উপাদান। এটা ইউরেনিয়ামের থেকেও দশ লক্ষ গুণ তেজস্ক্রিয়তাসম্পন্ন। আর এর পরিমাণও খুবই কম। যেমন এক টন পিচব্লেন্ড, পঞ্চাশ টন জল আর ছয় টন রাসায়নিক পদার্থ শোধন করলে, পাওয়া যায় ভাগ্য ভালো হলে, মাত্র এক গ্রেন পরিমাণ রেডিয়াম।
এই অত্যাশ্চর্য আবিষ্কারের জন্য ১৯০৩ সালে লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটি কুরি দম্পতিকে ‘ডেভি পদক’-এ ভূষিত করে এবং একই বছর মাদাম কুরি বিজ্ঞানী অরি বিকুয়েরেল (Henri Becquerel) এবং তাঁর স্বামী পিয়েরে কুরির সাথে একত্রে লাভ করেন নোবেল পুরস্কার।
কুরি দম্পতির প্রথম কন্যাসন্তানের জন্ম হয় ১৮৯৭ সালে। নাম রাখা হয়েছিল ‘ইরেন’ (Irene)। তাঁদের দ্বিতীয় সন্তান ‘ইভ’ (Eve)-এর জন্ম হয় ১৯০৪ সালে।
১৯০৬ সালে মাদাম কুরির জীবনে ঘটে যায় চরম শোকাবহ ঘটনা। স্বামী পিয়েরে কুরি এক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। এই দুর্ঘটনায় মেরির হৃদয় সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে। কিন্তু বিজ্ঞান গবেষণা তাঁর অব্যাহত থাকে। তিনি ১৯১০ সালে একক প্রচেষ্টায় বিশুদ্ধ অবস্থায় রেডিয়ামকে পৃথক করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। এই কৃতিত্বের জন্য তিনি এককভাবে দ্বিতীয়বারের জন্য ১৯১১ সালে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
১৯১৩ সালে তিনি নিজের দেশ পোল্যান্ডের ওয়ারশ শহরে একটি রেডিয়াম ইনস্টিটিউট স্থাপন করেন। ১৯১৪ সালে তিনি প্যারিসের নবপ্রতিষ্ঠিত রেডিয়াম ইনস্টিটিউটের তেজস্ক্রীয় গবেষণাগারের প্রধান নির্বাচিত হন।
এরপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তিনি গবেষণার কাজ ছেড়ে আর্তমানবতার সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। তিনি মেডিকেল সার্ভিসে যোগ দেন। গঠন করেন ইউনিয়ন অব উইমেন অব ফ্রান্স।
১৯২১ সালে তিনি ৫৪ বছর বয়সে আমেরিকা সফরে যান। এসময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট তাঁকে এক গ্রাম রেডিয়াম উপহার দেন। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের মহিলা সংগঠনও তাঁকে সমপরিমাণ রেডিয়াম উপহার দেয়। তিনি এগুলো নিয়ে আসেন নিজের দেশে এবং ওয়ারশ হাসপাতালে চিকিৎসাকাজে ব্যবহার করেন।
১৯২৯ সালে দ্বিতীয়বারের মতো তিনি যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন।
এদিকে স্বামীর শোক এবং দীর্ঘ দিনের একটানা পরিশ্রমে মাদাম কুরির শরীর ভেঙে পড়ছিল। ১৯৩৪ সালের মে মাসে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং এর দুমাস পরে জুলাই মাসে এই মহীয়সী বিজ্ঞানীর মৃত্যু হয়। জানা যায়, রেডিয়ামের তেজস্ক্রীয়তাই ছিল তাঁর মৃত্যুর কারণ।