মহামহিম
জয়দেব পাল এবং মহিমাময় রায়চৌধুরীর কথা বার বার লেখার কোনও মানে হয় না। তা ছাড়া এদের এখন বয়েস হয়েছে, দুজনেই বেশ কিছুদিন হল পঞ্চাশ পার হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের কীর্তিকলাপ করার ক্ষমতা এদের এখন খুবই কমে গেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এরা এখানে মাঝে মধ্যে এমন কিছু অঘটন ঘটিয়ে বসেন যার তুলনা শুধু খোজা নাসিরুদ্দিনের গল্পে অথবা আরব্য উপন্যাসে কচিৎ মিলতে পারে।
জয়দেবের কুখ্যাতি বহুপ্রচারিত এবং সর্বজনবিদিত। আমি নিজেই কতবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেসব উপাখ্যান লিখেছি। কিন্তু মহিমাময় মিটমিটে শয়তান। আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, এমনকী বন্ধুবান্ধব সহকর্মীরা তাকে কখনও সন্দেহ করেনি। সে চিরদিন ডুবে ডুবে কিংবা তলে তলে জল খেয়েছে এবং শুধু জল নয়, জলের সঙ্গে প্রায় সমান পরিমাণ হুইস্কি, রাম কিংবা ডবল পরিমাণ বাংলা মদ।
মহিমাময়ের ওজন যে গত তিন বছরে ষাট কেজি থেকে আশি কেজিতে পৌঁছেছে, সে ওই রাম-টাম অথবা বাংলার কল্যাণে।
পাড়া-প্রতিবেশী, শুভানুধ্যায়ী, আত্মীস্বজন মহিমাময়কে ফুলকো লুচির মতো ফুলে যেতে দেখে নানা রকম ভয় দেখায়। শুভানুধ্যায়ীরা বলে, সাবধান, এ বয়েসে এত মোটা হওয়া উচিত নয়। ব্লাডপ্রেসার বাড়ে, ডায়াবেটিস হয়, হার্টের ওপর চাপ পড়ে। সেরিব্রাল বা করোনারি হতে পারে, পক্ষাঘাত এমনকী মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
এসব শুনে মহিমাময় খুবই ভয় পায়। তবে সে রসিক ব্যক্তি, ওই করোনারি অ্যাটাক কথাটা শুনে তার অনেকদিন আগের একটা কথা মনে পড়ে যায়। শিবরাম চক্রবর্তীর বিখ্যাত ও জনপ্রিয়। অল্পবিস্তরের কলমে এক শোকাহত ভাগিনেয় তার মামার মৃত্যুসংবাদ জানিয়েছিল, লিখেছিল যে তার মামা কিছুদিন আগে করোনারিতে মারা গিয়েছে। শিবরাম তার স্বভাবসিদ্ধ অতুলনীয় কৌতুকী ভঙ্গিতে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন, কী আর বলব ভাই, সকলের মামাই এরকম ভাবেই মারা যায়– করোনারি রোগে অথবা পরনারী রোগে।
সে যা হোক, ব্যাপারটা হাসি-ঠাট্টা বা রঙ্গ-রসিকতার পর্যায়ে আর নেই। কুড়ি কেজি ওজন বেড়ে যাওয়া সামান্য ব্যাপার নয়। মহিমাময় মাঝে মাঝেই নিজের মনে দুশ্চিন্তা করে।
অসুবিধাও নানা রকম দেখা দিয়েছে। সব সময়ে কেমন হাঁসাস লাগে। দমবন্ধ ভাব। একটু হাঁটলেই দাঁড়িয়ে পড়তে হয়, জোরে জোরে নিশ্বাস পড়ে, ঘাম হয়। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গেলে তো কথাই নেই, দু-চার ধাপ উঠেই মহিমাময় হাঁপাতে থাকে।
এ ছাড়া আরও অনেক ধরনের অসুবিধা দেখা দিয়েছে। পুরনো প্যান্ট-শার্টগুলো আর ফিট করে। দামি, দামি প্যান্ট ছিল মহিমাময়ের। বছর চারেক আগে কাঠমাণ্ড বেড়াতে গিয়ে বেশ কয়েকটা ভাল বিলিতি কাপড়ের প্যান্ট বানিয়েছিল মহিমাময় আর সেই সঙ্গে দু-জোড়া সাফারি স্যুট।
মহিমাময়ের প্রাণের বন্ধু জয়দেব অবশ্য সাফারি স্যুটের ঘোরতর শত্রু। একদিন জয়দেবের সঙ্গে সন্ধ্যাবেলা একটা বারে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল মহিমাময়ের। বেশ কিছুদিন আগের কথা, তখনও মহিমাময় এত গোলাকার ধারণ করেনি। সেই নেপালি সাফারি স্যুটে বিভূষিত হয়ে মহিমাময় বারে পৌঁছানোর পরে তাকে দেখে জয়দেবের কী ক্রোধ, কী রাগারাগি, কী গঞ্জনা!
মহিমাময় বারে ঢুকে যেই জয়দেবের টেবিলে বসতে যাচ্ছেন, জয়দেব তাকে বলল, তুই কি কোনও কোম্পানিতে ড্রাইভারের চাকরি নিয়েছিস, নাকি দারোয়ানের?
মহিমাময় অবাক হয়ে বলল, মানে?
জয়দেব বলল, তা না হলে এই দারোয়ানের ইউনিফর্ম কোথায় পেলি?
কথাটা মহিমাময়ের মনে ধরেছিল। সত্যিই বুঝি সাফারি স্যুটের মধ্যে কোথায় একটা অন্ত্যজ অনভিজাত ব্যাপার আছে, কেমন যেন দারোয়ানি দারোয়ানি গন্ধ।
সেদিন অবশ্য গোলমালটা সঙ্গে সঙ্গে চুকে গিয়েছিল। এবং গভীর, গভীরতর রাতে প্রচুর, প্রচুরতর মদ্যপানের পর ফুটপাথ বদল হওয়ার আগের মুহূর্তে জামা বদল করেছিল জয়দেব আর মহিমাময়।
মহিমাময়ের বহু আহ্লাদের সাফারি স্যুটের ঊর্ধ্বাংশ এবং জয়দেবের অতিপ্রিয় নীল স্পোর্টস গেঞ্জি, যার বুকে ও পিঠে অকথ্য ইঙ্গিতপূর্ণ একটি ইয়াংকি স্লোগান লেখা আছে, বিনিময় হয়েছিল সেই মধ্যরাতে।
ফলে একটা সাফারি স্যুট সেদিনই খণ্ডিত হয়ে গিয়েছিল। দ্বিতীয়টাও আর বিশেষ পরেনি মহিমাময়। পরার সুযোগও ছিল না।
শুধু সাফারি স্যুট কেন, প্রত্যেকটি প্যান্ট-শার্ট, গেঞ্জি ইত্যাদি পুরনো কিছুই আর মহিমাময় এখন তার শরীরে চড়াতে পারে না। প্যান্টগুলো, বিশেষ মায়াবশত, কোনও রকমে বেল্ট বেঁধে বোম লাগিয়ে পরা যেত কিন্তু এখন তাও সম্ভব নয়। আর শার্ট? পুরনো শার্টগুলোর বুকের বোতাম লাগানো দূরের কথা, তার মধ্যে হাত গলানো পর্যন্ত অসম্ভব এখন।
তাই ধুতি আর ঢোলা পাঞ্জাবি পরা শুরু করেছে মহিমাময়। যতটা মোটা হোক, ধুতি ছোট হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। লম্বা হলে হয়তো ঝুলের ধুতি লাগে, কিন্তু পাশে বেড়ে গেলে সে সমস্যা নেই, কোঁচার কাপড় কিছু কম পড়তে পারে, তা পড়ুক, তাতে কিছু আসে যায় না। আর চওড়া হাতা ঢোলা পাঞ্জাবিও সর্বংসহা। তার ভিতরে দু-চার-দশ কেজি মেদবৃদ্ধি অনায়াসেই চাপা দেয়া যায়।
কিন্তু সে তো সাময়িক ব্যাপার। বাসায় সব সময় তো ঢোলা পাঞ্জাবি পরে থাকা যায় না। বাসায় খালিগায়ে হলে নিজের স্ফীতোদরের দিকে তাকিয়ে লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে যায় মহিমাময়ের। স্নান সেরে উঠে দেয়াল-আয়নার সামনে খালিগায়ে দাঁড়িয়ে নিজের মেদ ও চর্বি প্লাবিত বৃষস্কন্ধের দিকে দৃষ্টিপাত করে মহিমাময় শিউরে ওঠে।
এর কি কোনও প্রতিকার নেই? ডাক্তার সমেত যাকেই জিজ্ঞাসা করা হয়, সে ভোজন কমাতে বলে। মহিমাময়ের নিয়মিত গোপন মদ্যপানের সংবাদ অনেকেই রাখে না। যে দুয়েকজন রাখে, তারা বলে, পান-ভোজন কমাও। কিন্তু ভোজন একটু আধটু কমাতে পারলেও মহিমাময় পান কমাতে পারছে না। পানীয়ের চেয়েও বিপজ্জনক পানীয়ের সঙ্গে চাট। মহিমাময় আগে লুচি খেত। অন্তত আট-দশটা ছুটির দিনের সকালবেলায় জলখাবার, সেই সঙ্গে আলুর দম বা পরিমাণমতো আলুপেঁয়াজ ভাজা। আর দুটো মিষ্টি। স্কুল ব্যক্তির পক্ষে এসব নাকি বিষ। এরকম নিয়মিত খেলে মাসে এক কেজি ওজন বেড়ে যাবে।
এসব জানার পর থেকে মহিমাময় ছুটির দিনে সকালে জলখাবার খায় স্রেফ তিনখানি রুটি আর একটু ডাল কিংবা বেগুনভাজা।
অন্যান্য খাবার ব্যাপারেও যথেষ্ট ধরাবাঁধার মধ্যে এসেছে সে। সকালের চায়ে চিনির বদলে স্যাকারিন খায়। সঙ্গে আগে চারটা বিস্কুট খেত এখন একটা তাও সেটা থেকে এক টুকরো ভেঙে বাড়ির পোষা কুকুরটাকে দেয়। কুকুরটা মহিমাময়ের ছেলের আগে কখনও মহিমাময়কে দেখে জীবনে একবারও লেজ নাড়েনি। এখন বিস্কুটের সামান্য ভাগ পেয়ে অল্প অল্প লেজ নাড়ে।
দুপুরেও মহিমাময় ভাত দুমঠো কম খায়। ভাত খেতে বসার আগে পর পর দু গেলাস জল খেয়ে নেয় যাতে পেটে বেশি জায়গা না থাকে। ভাতের সঙ্গে ঘি, ভাজা-টাজা, ডিম-মাংস এসব বন্ধ করেছে, ডাল, তরকারি আর ছোটমাছ। দুপুরে অফিসে টিফিন নিয়ে যায় সে। আগে চার-পাঁচখানা রুটি নিত, এখন ঠিক দুটো রুটি, সঙ্গে সামান্য তরকারি। বাড়ির বাইরে চা খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। যদি খেতেই হয়, বড় জোর চিনি ছাড়া চা।
খাদ্যে ক্যালোরির পরিমাণ এবং সেই সঙ্গে মেদবৃদ্ধি সংক্রান্ত বাজার চলতি বেশ কয়েকটি বই আগাগোড়া মন দিয়ে পাঠ করেছে মহিমাময়। বলতে গেলে এ বিষয়ে সে এখন একজন অথরিটি। ক্যালোরি ব্যয়ের হিসাবের খুঁটিনাটিও এখন তার মুখাগ্রে। সিঁড়ি দিয়ে নামলে কত ক্যালোরি ব্যয় হয়, সিঁড়ি দিয়ে উঠলে কত, হাঁটলে কত, ছুটলে কত, বসে থাকলে কত, শুয়ে থাকলে কত সব মহিমাময় জেনে গেছে।
সে জেনে গেছে দৈনিক সকালে একঘণ্টা হাঁটলে এক বোতল বিয়ার বা দু-পেগ রামের ক্ষতিপূরণ হয়। তিন কাপ চায়ে সাড়ে চার চামচে চিনি খাওয়া হয়, সেটা এক গেলাস বাংলা খাওয়ার সমান।
সব জেনে গেছে মহিমাময়। সকালে বহু সাধের সুখনিদ্রা ফেলে সে মাঠে গিয়ে তরতর করে ছোটে। তারপর সারাদিন সবরকম লোভ দমন করে যথাসাধ্য কম খেয়ে সে দিনযাপন করে। সে রাবড়ি খেতে ভালবাসত। মোগলাই পরটা খেতে ভালবাসত। তেলেভাজা বেগুনি ফুলুরি খেতে ভালবাসত–মোটা হওয়া কমানোর জন্যে সে সব ছেড়ে দিয়েছে।
কিন্তু তাতে লাভ কী? সারাদিন মহিমাময় কত কষ্ট করে লোভ দমন করে থাকে। রাস্তায় তার প্রিয় চিকেনরোল ভাজা হচ্ছে, আলুর চপের গন্ধে বাতাস ভুরভুর করছে, দলে দলে লোক সেসব কিনে খায়, কিন্তু মহিমাময় কখনও এসব লোভ করে না, অন্তত সূর্যাস্ত পর্যন্ত।
সূর্যাস্তের পরে ধীরে ধীরে, অতি ধীরে ধীরে, মহিমাময়ের প্রতিরোধ ক্ষমতা কমতে থাকে। সাড়ে সাতটা নাগাদ সে বরফ-সোডা আর সামান্য একটা পানীয় নিয়ে বসে। তখনই সর্বনাশের শুরু হয়। একটু পান করার পরে সে গায়ে পাঞ্জাবি পায়ে চটি গলিয়ে রাস্তায় গিয়ে এক টাকার খোসা ছাড়ানো চিনেবাদাম আর দেড় টাকার চানাচুর নিয়ে আসে। পানীয় কম থাকলে মোড়ের মাথায় দত্তের দোকানে গিয়ে একটা বোতল কেনে। তারপর সারাদিনের ত্যাগ ও পরিশ্রম জলে ভেসে যায়। আধ বোতল পানীয়, সঙ্গে চানাচুর-বাদাম, তারপরে নৈশ আহারে বসে মহিমাময়ের খাওয়ার রোখ চেপে যায়। আরও ভাত, তরকারি চেয়ে চেয়ে খায়, ঝোল থেকে বেছে বেছে চামচে দিয়ে আলু তুলে নেয়। মহিমাময়ের স্ত্রী মহিমাময়ের মোটা হওয়া নিয়ে মোটেই মাথা ঘামায় না। সুতরাং কোনও দিক থেকে কোনও বাধা নেই। সারাদিন যা খেয়েছে, শুধু এক সন্ধ্যায় সে তার চারগুণ খেয়ে ফেলে। চানাচুর বাদাম, আধবোতল মদ চোখে দেখে বোঝা না গেলেও ডাক্তারি মতে মোটা হওয়ার ব্যাপারে বিয়েবাড়ির বিরিয়ানি-মাংস-ফিশফ্রাই দই মিষ্টি খেজুরের চাটনির লম্বা ভোজের সমান।
সুতরাং মহিমাময়ের আরও, আরও মোটা হওয়া, ক্রমাগত স্কুল থেকে স্থূলতর হয়ে যাওয়া জগৎসংসারে কেউ ঠেকাতে পারবে না।
শরীরের চর্বি তাড়াতাড়ি পোড়ানোর কী এক বিলিতি ট্যাবলেট বেরিয়েছে বাজারে, খুব দাম, স্থূলাঙ্গিনী বণিকবধূরা দুবেলা মুঠো মুঠো খাচ্ছে। মহিমাময়ের এক বন্ধু তাকে ওই ট্যাবলেট খেতে বলল। ট্যাবলেট কিনতে গিয়ে মহিমাময় ফিরে এল। এক শিশি একশো আশি টাকা। এর ডবল পরিমাণ পানীয়ের পাঁইটের দাম বড়জোর চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ টাকা। এ ওষুধ খেতে গেলে এমনিই রোগা হয়ে যাবে, কারণ তাহলে মদ বা খাবারের পয়সা আর জুটবে না। এ ব্যবস্থা মহিমাময়ের পছন্দ হল না।
আর তা ছাড়া মহিমাময় মনে মনে জানে যে ওষুধ-ফষুধে কিছু হবে না। পান-ভোজন না কমালে কোনও গতি নেই।
জয়দেবের সঙ্গে একদিন এ নিয়ে আলোচনা করছিল সে। জয়দেবের ওপরে ঈশ্বরের আশীর্বাদ আছে, যতই খাক সে তার গায়ে গত্তি লাগে না। এই চুয়ান্ন বছর বয়েসেও সে বাইশ বছরের ছিপছিপে চেহারা রাখতে পেরেছে। অথচ সে মহিমাময়ের চেয়ে পানভোজন কম তো করেই না, বরং যথেষ্টই বেশি করে।
জয়দেবই পান করতে করতে মহিমাময়কে পরামর্শটা দিল। সে বলল, দ্যাখ মহিমা, আমার শরীরের মধ্যে বিদ্যুতের আগুন আছে। ভালমন্দ যা খাই জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাইভস্ম করে দেয়। তোর তো আর সে ক্ষমতা নেই। তোকে খাওয়া বন্ধ করতে হবে আর এ জিনিসটাও। বলে নিজের গেলাসটা আদর করে আলতো করে ছুঁল।
মহিমাময় করুণ মুখে বলল, কিন্তু কী করে বন্ধ করব? অনেক চেষ্টা করলাম কিন্তু কিছুতেই ছাড়তে পারলাম না।
জয়দেবের বেশ নেশা হয়েছিল, এক চোখ টিপে চালাকের মতো মুখ করে বলল, আমার কাছে বুদ্ধি আছে, খুব ভাল বুদ্ধি।
মহিমাময়েরও যথেষ্ট নেশা হয়েছিল। আজ শনিবার। পার্ক স্ট্রিটের শেষপ্রান্তের এই বারটায়, প্রত্যেক শনিবার সন্ধ্যায়, ঝড় হোক, বৃষ্টি হোক, ভূমিকম্প হোক, দাঙ্গা বা গোলমাল যাই হোক জয়দেব আর মহিমাময় দুজনেই চেষ্টা করে আসতে, বহুদিনের অভ্যেস। অবশ্য মহিমাময় কখনও কখনও জয়দেবকে এড়িয়ে এড়িয়ে চলে, নানা কারণে, তখন যোগাযোগটা বাদ পড়ে।
সেসব পুরনো কথা। আজ জয়দেবের কথা শুনে মহিমাময় ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাল, জয়দেবের কাছে কী বুদ্ধি আছে কে জানে। কুড়ি বছর আগে জয়দেবের পরামর্শে এবং উসকানিতে মহিমাময় এক পুলিশের জমাদারকে পেছন থেকে ল্যাং মেরে ফেলে দিয়েছিল, তার বিষময় পরিণাম এখনও তার মনে আছে।
তারও আগে আরেকবার জয়দেব তাকে হোমিওপ্যাথিক গুলি সাইজের কালো মতন বড়ি কাগজে মুড়ে এনে একদিন দেয়, বলে, খেয়ে দ্যাখ। বুদ্ধি তাজা হবে।সরল বিশ্বাসে মহিমাময় সেই বড়ি একবার খেল। তখন জয়দেব বলল, আরেকটু খা।
মহিমাময় আরও একটু খেয়ে বলল, কেমন, মরা পেঁয়ো পিঁপড়ের মতো মনে হচ্ছে।
জয়দেব টেবিল চাপড়িয়ে বলেছিল, এই তো, বেশ বুঝতে পারছিস। বুদ্ধি খুলছে। ঠিক ধরতে পেরেছিস। মরা পেঁয়ো পিঁপড়েই এগুলো।
মহিমাময়ের মুখের দিকে তাকিয়ে জয়দেব সব অনুমান করতে পারল, বলল, এত ভয় খাচ্ছিস কেন! এবার খুব সোজা বুদ্ধি দেব–জলের মতো সোজা।
মহিমাময় বলল, কী বুদ্ধি?
জয়দেব গম্ভীর মুখে বলল, সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে অল্প একটু জলখাবার খেয়ে তারপর দুটো ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়বি। ঘুম ভাঙবে সেই রাত কাবার হয়ে। রাতের বেলা পানভোজন আর কিছু দরকার হবে না।
জয়দেবের উপদেশ তখনকার মতো হেসে উড়িয়ে দিলেও, পরের দিন সকালবেলা ঠান্ডা মাথায় পার্কে হাঁটতে হাঁটতে ব্যাপারটা খুব ভাল করে ভেবে দেখল মহিমাময়। মাতালের পরামর্শ বটে কিন্তু ঠিক ফেলে দেওয়া যাচ্ছে না।
সত্যিই তো, মেদবৃদ্ধির পথে সবচেয়ে গোলমেলে ওই সন্ধ্যাবেলার কয়েক ঘণ্টা। সারাদিন কষ্ট করে তারপর তখনই ধুম পড়ে খাওয়া-দাওয়ার। খাওয়া আর দাওয়া দুইয়ে মিলে ডুবিয়ে দেয় আপ্রভাত ত্যাগ ও পরিশ্রম।
তবে ঘুমের ওষুধ কেনা সোজা কাজ নয়। প্রেসক্রিপশন লাগবে। ডাক্তারখানা অনেকের কাছে প্রেসক্রিপশন ছাড়াই ঘুমের বড়ি বেচে, কিন্তু মহিমাময়ের চেহারা বা হাবভাবে বোধহয় সম্ভাবনাপূর্ণ আত্মহত্যাকারীর আদল আছে। সে দোকানে গিয়ে ঘুমের ওষুধ চাইলেই দোকানকর্মচারীরা গলা নামিয়ে নিজেদের মধ্যে ফিসফাস কী সব আলোচনা করে, তার দিকে টেরিয়ে টেরিয়ে দেখে, তারপর বলে, এখন হবে না। স্টক নেই।
অবশেষে পাড়ার ডাক্তারের কাছে গেল মহিমাময়। আসল কথা না বলে তাকে বলল, ডাক্তারবাবু, রাত্রে ভাল ঘুম হচ্ছে না। আমাকে একটু ঘুমের ওষুধ দিন।
সদাশয় ডাক্তারবাবু মহিমাময়কে ঘুমের ওষুধ খাওয়ার অপকারিতা এবং অপ্রয়োজনীয়তা বিষয়ে দীর্ঘ এক বক্তৃতা দিলেন, তারপর হজমের ওষুধের একটা প্রেসক্রিপশন দিয়ে বললেন, এটা খান। হজম ভাল হলেই ঘুম ভাল হবে। সাবধান, ঘুমের ওষুধ খাবেন না।
দশটাকা ভিজিটটা জলে গেল। ডাক্তারের ঘর থেকে রাস্তায় বেরিয়ে প্রেসক্রিপশনটা কুচি কুচি করে হাওয়ায় উড়িয়ে দিল মহিমাময়। হজমের ওষুধ না খেয়েই এই স্বাস্থ্য, হজমের ওষুধ খেলে তো শরীরের মেদসমুদ্র আরও উথাল-পাতাল হয়ে উঠবে। এখন তবুও ঘাড়ে মাথা আছে, তখন। ঘাড়ে-গর্দানে এক হয়ে যাবে।
সেই সপ্তাহের শনিবার সন্ধ্যায় জয়দেবকে তার সমস্যার কথা বলল মহিমাময়। প্রথমে জয়দেবের মোটেই মনে ছিল না, সে প্রশ্ন করল, ঘুমের ওষুধ দিয়ে কী করবি? তারপর উত্তর পাওয়ার আগেই পরামর্শ দিল, বেশি করে মদ খাবি, তাহলেই ঘুমের ওষুধ লাগবে না। বিছানায় শুতে না শুতে ঘুমিয়ে পড়বি।
এবার মহিমাময় আগের সপ্তাহের কথাবার্তা মনে করিয়ে দিতে জয়দেবের মনে পড়ল। সে বলল, কী বলছিস, ডাক্তার ঘুমের ওষুধ দিল না? তারপর টেবিল থেকে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে পাশের ফার্মেসি থেকে দশটা ঘুমের বড়ি এনে মহিমাময়কে দিয়ে বলল, যেকোনও দোকানে গিয়ে চাইলেই পেতিস, ডাক্তারের কাছে গেলি কেন?
মহিমাময় জয়দেবকে এ কথা আর বলল না যে ডাক্তারখানায় তাকে ঘুমের ওষুধ দিতে চায়নি। জয়দেব একটু পরে বলল, নেশা করে কখনও ঘুমের ওষুধ খাবি না। হঠাৎ বিপদ হতে পারে।
ওষুধটা বুকপকেটে রাখতে রাখতে মহিমাময় ভাবল, নেশা করে ঘুমের ওষুধ খেতে যাব কেন, নেশা না করার জন্যেই ঘুমের ওষুধ খাব।
পরের দিনই মহিমাময় ব্যাপারটা পরীক্ষা করে দেখল। সন্ধে সাড়ে সাতটায় যখন কারণবারির জন্যে জিব শুকিয়ে এসেছে মহিমাময় দুটো ঘুমের ট্যাবলেট এক গেলাস জল দিয়ে খেয়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। বউকে বলে গেল, আজ থেকে রাতে খাব না, ঘুম থেকে ডেকে তুলো না।
এবং সত্যিসত্যিই রাত আটটার মধ্যে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গেল সে।
ঘুম ভাঙল সেই রাত তিনটেয়। খিদেয় পেট চো চো করছে, গলা শুকিয়ে কাঠ, দুচোখে তখন কেমন একটা ভারি ভারি, ঘুম ঘুম ভাব, সারা শরীরে জড়তা। কোনওরকমে ঘুম থেকে উঠে বাথরুম হয়ে খাওয়ার ঘরে গেল সে। গিয়ে দেখল সতীসাধ্বী সহধর্মিণী রাতে খেতে ডাকেনি বটে, কিন্তু রাতের খাবার টেবিলে একটা বড় থালা দিয়ে ঢেকে রেখেছে।
খাবার দেখে মহিমাময় প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ওপর, যা কিছু ছিল সব গোগ্রাসে খেয়ে নিল। তারপর দু গেলাস জল ঢক ঢক করে খেল। তবুও কেমন খালি খালি, একটা অপূর্ণ ভাব, তার মনের মধ্যে কীসের জন্যে কেমন একটা আকুলি-বিকুলি।
রাত্রির তৃতীয় প্রহর সদ্য অতিক্রান্ত হয়েছে। এখন অন্ধকার সবচেয়ে গাঢ়। খাওয়ার ঘরের জানলা দিয়ে বাইরে আকাশের দিকে তাকাল মহিমাময়, দু-এক টুকরো ছেঁড়া মেঘ তারই ফাঁকে ফাঁকে তারাগুলো জ্বলজ্বলে। কিছুক্ষণ আগে বোধহয় বৃষ্টি হয়েছে। এখনও জলের ফোঁটার ক্ষীণ শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। বাতাসে জোলো গন্ধ। মোড়ের মাথায় পুরনো শিমূলগাছটায় কী একটা খুব কর্কশ চেঁচাচ্ছে।
ঢং ঢং করে রাস্তা দিয়ে একটা রিকশা চলে গেল। নিশ্চয়ই কোনও লেট মাতাল বাড়ি ফিরছে।
মহিমাময়ের মনের মধ্যে কেমন যেন আরও বেড়ে গেল আকুলি-বিকুলি। সে ধীরপায়ে উঠে সন্তর্পণে বউকে না জাগিয়ে শোয়ার ঘরের আলমারির পিছন থেকে পানীয়ের বোতলটা বের করে আনল, প্রায় আধ বোতল আছে। ফ্রিজ থেকে খাওয়ার জল বের করে খাওয়ার টেবিলে বসল। তারপর একটু ভাবল, মদ খেয়ে ঘুমের ওষুধ খাওয়া নিষেধ, কিন্তু ঘুমের ওষুধ খেয়েও কি মদ খাওয়া নিষেধ!
তারপর আর ভাবল না।
সকালবেলা মহিমাময়ের বউ ঘুম থেকে উঠে দেখল স্বামী খাওয়ার টেবিলে হাত মাথায় দিয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। পাশে শূন্য বোতল, শূন্য গেলাস।