ছয়
শুক্রবার। বিকেল পাঁচটা।
আগামী দু’দিন পুরো ছুটি। তাই ওয়াশিংটন ডি.সি. হয়ে উঠেছে ভুতুড়ে শহর।
এইমাত্র নুমা হেডকোয়ার্টারে কনফারেন্স রুমের বাতি জ্বেলে যে যার সিটে বসেছে মাসুদ রানা, সোহেল আহমেদ, আসিফ রেজা ও তার স্ত্রী তানিয়া রেজা।
গত ক’রাত দুশ্চিন্তায় ঘুমাতে পারেনি রানা ও আসিফ তাই চেহারা বিধ্বস্ত।
‘রাত জাগতে হলে লাগবে কফি,’ বলল রানা।
ক্যাপিটল হিল থেকে নুমা অফিসে ফিরে সামান্য বিশ্রাম নেয়ার পর, বিকেল হতে না হতেই আবারও শুরু হচ্ছে মিটিং। ফাইল ভরা নোট বের করছে আসিফ ও তানিয়া। চেয়ার ছেড়ে কফিমেকারের কাছে গেল সোহেল।
‘সত্যিই গলছে না গ্লেসিয়ার?’ জিজ্ঞেস করল তানিয়া। ‘এমন কী দক্ষিণ মেরুতেও না?’
‘ওখানে এখন শীত,’ বলল রানা, ‘তবুও আলাপ করেছি ম্যাকমার্ডো স্টেশন চিফের সঙ্গে। শূন্যের পঞ্চাশ ডিগ্রি নিচে অ্যান্টার্কটিকার তাপমাত্রা।’
‘তা হলে কেউ বলতে পারবে না, কেন বাড়ছে সাগরের পানি,’ হতাশ হয়ে বলল তানিয়া
‘অন্য কারণে হতে পারে,’ বলল রানা। ‘কিন্তু সেটা কী, তা খুঁজে বের করতে হবে।’
‘হয়তো বুঝলি, কিন্তু ঠেকাতে পারলি না, হতে পারে না?’ মন্তব্য করল সোহেল। ‘আর তারপর নিজ থেকেই সব সামলে নিল পৃথিবীর প্রকৃতি। আগে এমন হয়েছে বহুবার। ত
‘হলে ভাল, তবে সে আশায় বসে থাকলে চলবে? চেষ্টা করতে হবে না?’ বলল রানা।
সবার জন্যে কফি নিয়ে এল সোহেল।
শুরু হলো ডেটা নিয়ে আলাপ। একপর্যায়ে তানিয়া ও আসিফ জানাতে লাগল, কীভাবে সাগরের নিচে তলিয়ে যেতে পারে মহাদেশ।
‘ভলকানিক অ্যাক্টিভিটির জন্যে সাগরের পানি বাড়তে পারে,’ বলল তানিয়া, ‘উদ্গীরণ হলে প্রচুর পানি বেরিয়ে আসে আগ্নেয়গিরি থেকে।’
‘রানা যখন গ্রিনল্যাণ্ডে ছিল, আমরা দু’জন ওই সম্ভাবনা চেক করেছি,’ বলল আসিফ। ‘গত এক বছরে কমেছে আগ্নেয়গিরির উদ্গীরণ।’
‘বৃষ্টি বেশি হচ্ছে, তাই বাড়ছে সাগরের পানি,’ সহজ পথ ধরল সোহেল। ‘বাইবেলে আছে, নুহ নবীর আমলে চল্লিশ রাত-দিন বৃষ্টি পড়ে তলিয়ে গিয়েছিল প্রায় সব জমিন।’
‘কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান বলে, প্রচুর বৃষ্টি হলেও তলিয়ে যাবে না পৃথিবী,’ বলল রানা।
চওড়া হাসি দিল সোহেল। ‘কত জোরে বৃষ্টি পড়ছে, তার ওপর নির্ভর করে।’
‘সারা পৃথিবী জুড়ে তো বৃষ্টি পড়ছে না,’ গম্ভীর চেহারায় বলল তানিয়া। ‘আপাতত খরা চলছে ভারত উপমহাদেশে। গ্রীষ্মের গরমে ভাজা হচ্ছে ইউরোপের লোক। তা ছাড়া, বৃষ্টি পড়া মানেই, বাষ্পায়িত হবে পানি। প্রকৃতি এভাবেই সব ব্যালেন্স করে।’
‘আমাদের প্রিয় সোহেল ভায়া চাইছে খড়কুটো ধরে ভেসে থাকতে,’ মন্তব্য করল আসিফ।
‘তবে আমাদের হিসাবে ভুল হলে?’ বলল তানিয়া। ‘জোয়ার, স্রোত আর বাতাসের জন্যে খুব কঠিন সাগর-সমতল মেপে নেয়া। এমন কী স্থলভূমির মহাকর্ষীয় টানেও নানারকমের হতে পারে সাগর-সমতল।’
‘নানা মেথড ব্যবহার করে তিনবার পরীক্ষা করেছি,’ জানিয়ে দিল রানা। ‘ভুল নেই ডেটায়। অথচ সাগর উঠে প্লাবিত করছে নিচু এলাকা।’
‘হয়তো পানি আসছে মহাশূন্য থেকে,’ বলল সোহেল।
কঠোর চোখে ওকে দেখল আসিফ ও তানিয়া।
করুণ দৃষ্টিতে প্রিয় বন্ধুকে দেখছে রানা। ‘তুই কি সিরিয়াস হবি?’
‘আমি খুব সিরিয়াস,’ ভুরু কুঁচকে ফেলল সোহেল। ‘ধূমকেতুর মধ্যে থাকে নোংরা বরফ। বিজ্ঞানীদের অনেকে ভাবেন, পৃথিবীর সাগরের পানি এসেছে শত শত ধূমকেতু থেকেই। এটা ঘটেছে প্রথম দুই বিলিয়ন বছর ধরে।
সোহেলের থিয়োরি ঠিক। ছাতের দিকে তাকাল রানা। ‘গত আড়াই মাস আকাশে কোনও ধূমকেতু দেখিনি।’
‘কে তোকে বলেছে যে ওগুলোকে হ্যালির ধূমকেতুর মত বড় হতে হবে?’ বলল সোহেল। ‘হয়তো এতই ছোট, দেখাই যায় না। অথবা বড় কোনও ধূমকেতু ভেঙে তৈরি হয়েছে হাজার হাজার কোটি কণা। ক’দিন আগে পড়লাম আইসন নামের ধূমকেতু ভেঙে মিলিয়ে গেছে মহাশূন্যে। ওটার লেজও হাওয়া। নাসা ওখানে পেয়েছে কোটি কোটি কণা। হয়তো পৃথিবী চলেছে মহাশূন্যের তেমনই কোনও ধূমকেতুর কণার মাঝ দিয়ে। কিছুই টের পাচ্ছি না আমরা। অথচ, পৃথিবীর সাগর ও জমিতে পড়ছে হাজার হাজার কোটি গ্যালন পানি। …কী বুঝলি?’
‘হতে পারে,’ স্বীকার করল রানা। ‘তবে ধূমকেতুর কোটি কোটি কণার মাঝ দিয়ে পৃথিবী গেলে, তা ধরা পড়ত নাসার বিজ্ঞানীদের কাছে। তা ছাড়া, সাগর-সমতল উঠে আসতে হলে চাই শত শত ধূমকেতু।’
মাথা নাড়ল সোহেল। ‘আমার থলের সব বের করে দিয়েছি। এবার তোরা খুঁজে বের কর কী ঘটেছে।’
চুপ করে থাকল রানা, আসিফ ও তানিয়া। পরের তিন ঘণ্টা মাথা ঘামিয়ে উঠে দাঁড়াল রানা। অতিরিক্ত মগজ খাটিয়ে লালচে হয়ে গেছে সবার চোখ।
‘মিটিং আপাতত শেষ?’ জানতে চাইল তানিয়া।
‘কফি ব্রেক।’ কফিমেকারের সামনে গেল রানা। ওখান থেকে বলল, ‘আমরা কিন্তু এগোতে পেরেছি। এক এক করে বাদ পড়ছে সম্ভাবনাগুলো। তার মানে, খুব কাছেই কোথাও আছে উত্তর।’
‘হুঁ, তুই যখন বলছিস,’ মন খারাপ করে বলল সোহেল।
কফিতে ক্রিম বা চিনি নিল না রানা। চেয়ে আছে টেবিলের দিকে। খেয়াল করেছে, তানিয়া আর সোহেল নানা বিষয়ে আলাপ করলেও প্রায় চুপ থেকেছে আসিফ। কী যেন ভাবছে সে। এমনিতেই পারতপক্ষে কথা বলে না শান্ত দানব।
কফিতে চুমুক দিয়ে রানা দেখল, প্যাডে খস্ খস্ করে কী সব হিসাব কষছে আসিফ। কোনও দিকে হুঁশ নেই। গিয়ে ওর কাঁধের ওপর দিয়ে তাকাল রানা।
পৃষ্ঠা ভরে গেছে ক্যালকুলেশনে। মাঝে এক প্যারা ভরা মন্তব্য। পাশে আঁকা পাখির ঠোঁটে কী যেন।
‘কী ভাবছিস, আসিফ?’ মুখ খুলল রানা। ‘বসে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে গেছিস?’
‘হ্যাঁ, সম্ভব…’ আনমনে বলল জিয়োলজিস্ট। ‘কিন্তু… ঠিক জানি না…’
‘কাগজটা দে তো?’ হাত বাড়িয়ে প্যাডের পৃষ্ঠা নিল রানা। ওখানে একটা কাক। ঠোঁটে পাথর। কাছেই কলসি। ওটা আধ ভরা। পাশেই ক্যালকুলেশন। নিচে একটা নাম।
‘ইয়োশিরো শিমেয়ু,’ জোরে জোরে পড়ল রানা। ‘কী রে, কার্টুনিস্ট হয়ে উঠেছিস?’
মাথা নাড়ল আসিফ রেজা।
‘তো বলে ফ্যাল কী হয়েছে,’ তাড়া দিল রানা। খানিকটা অপরাধবোধ কাজ করছে মনে। কিছু নিখুঁত না হলে মুখ খোলে না আসিফ। তার আগে পরীক্ষা করে শত দিক থেকে।
‘একটা কথা ভাবছি,’ বলল আসিফ। ‘তবে বললে তোরা হাসাহাসি করবি।’
‘জানি, আমাদের প্রিয় সোহেলের ধূমকেতুর চেয়ে খারাপ হবে না তোর থিয়োরি,’ মন্তব্য করল রানা।
‘আরে, এসব কী!’ আপত্তি তুলল সোহেল। ‘তুই-ই তো বললি মনের জানালা খুলে দিতে। তাই তো আকাশের মত বিশাল এই উদার মনের ঘরের জানালা-দরজা, সিন্দুক, আলমারি, শেষে অ্যাটাচ্ড় বাথরুমটা পর্যন্ত খুলে দিয়েছি।’
‘আপাতত তোর জং-ধরা গরম মগজটাকে একটু বিশ্রাম দে,’ বলে আসিফের দিকে তাকাল রানা। জিজ্ঞেস করল, ‘পাখি নিয়ে কী ভাবছিস তুই?’
বড় করে দম নিল আসিফ। ‘ঈসপের গল্পের কথা মনে আছে তোদের? ওই যে, কলসি থেকে পানি তুলেছিল একটা কাক?’
রানা বুঝে গেল, কী বলছে ব্রিলিয়ান্ট জিয়োলজিস্ট।
‘কলসির ভেতর পানি দেখল তৃষ্ণার্ত কাক,’ বলল আসিফ, ‘কিন্তু চঞ্চু দিয়ে তুলতে পারবে না। তখন একটা একটা করে পাথর এনে কলসিতে ফেলল কাক। পাথরের কারণে ওপরে উঠল পানি। শেষে প্রাণভরে তৃষ্ণা মিটিয়ে নিল চালাক পাখি।’ আনমনে মাথা দোলাল জিয়োলজিস্ট। ‘এখন কথা হচ্ছে, দুই মেরুর বরফ না গলে থাকলে, ধূমকেতুর কণা যদি না থাকে, তো ধরে নিতে হবে, ওপর থেকে পানি যোগ হচ্ছে না সাগরে। সেক্ষেত্রে আগে থেকেই যে পানি রয়ে গেছে, সেটাই উঁচু হয়ে উঠছে পৃথিবীর সব মহাসাগরে।’
চুপ করে আছে রানা, তানিয়া আর সোহেল।
সবাইকে দেখে নিল আসিফ। ‘মনে করা যাক, পানিতে ভরে নেয়া হয়েছে বাথটাব। এরপর কেউ নেমে পড়ল ওখানে। উপচে পড়বে না পানি?’
‘উপচে পড়বে,’ বলল রানা।
‘দারুণ বলেছিস, চালিয়ে যা,’ উৎসাহ দিল সোহেল।
মুচকি হাসল তানিয়া। ‘এ ধরনের আইডিয়া গজালে বাড়ি ফিরে দেখব, তর্কে হেরে যাচ্ছি ওর সঙ্গে।’
‘কিন্তু সাগরে আসছে কোথা থেকে পানি?’ মূল কথা থেকে সরল না রানা।
‘সাগরেই ছিল,’ বলল আসিফ, ‘মনে পড়ছে ক’বছর আগে ইয়েলোস্টোন লেক উপচে পড়ল। অথচ, ওদিকে বৃষ্টি হয়নি। বন্যা তো দূরের কথা। পরে দেখা গেল, লেকের তলে ভূমিকম্পের জন্যে ঢিবির মত হয়ে উঠেছে মাটি-পাথর। পরের কয়েক বছরে আবার নেমে গেল তলদেশ। লেকের পানি আগের সমানই থাকল। ছোট জায়গায় ওটা ধরা পড়েছিল। কিন্তু মহাসাগরে কোথায় কী হচ্ছে, জেনে নেয়া কঠিন।’
‘কিন্তু, তা হলে কেউ না কেউ টের পেত, উঠে এসেছে সাগরতল,’ বলল সোহেল।
‘আগে খেয়াল তো করতে হবে,’ বলল আসিফ। ‘নুমা বা’ এ ধরনের এজেন্সি নিয়মিত সাগর স্ক্যান করে।’ দূরের দেয়ালে ঝুলন্ত টপোগ্রাফিক ম্যাপ দেখাল। ‘সাগরের অগভীর এলাকা, বন্দর বা জাহাজ চলাচল রুটে নিয়মিত চলে স্ক্যান। কিন্তু গভীর সাগরে স্ক্যান করা হয় অন্যভাবে। হয়তো রিডিং নিল উত্তর আমেরিকার অরল্যাণ্ডের সাগরে, তারপর আবারও স্ক্যান হলো স্যান্টা মনিকায়। তাতে ধরে নেয়া হয়, মাঝের সাগরতল আগের মতই আছে। সত্যি সাগরের নিচে পাহাড় গজিয়ে উঠলে, জানার কথা নয় কারও।’
‘তা ছাড়া, বেশিরভাগ গভীর সাগরের ডেটা এক যুগের চেয়েও বেশি পুরনো,’ বলল তানিয়া, ‘এর ভেতর নিচে কী ঘটেছে, আমরা কেউ জানি না।’
‘হাওয়াই দ্বীপের মত দ্বীপ গজিয়ে উঠতে শুরু করলে লাখ লাখ কোটি গ্যালন পানির চাপ পড়বে মহাসাগরে,’ বলল আসিফ। ‘অথচ, ওই দ্বীপ হয়তো এখনও জেগেই ওঠেনি।’
‘ওটা হয়তো আগ্নেয়গিরি,’ বলল তানিয়া। ‘আঠারো শত তিরাশি সালে বিস্ফোরিত হয়ে তলিয়ে গেল ক্রাকাতোয়া, তারপর উনিশ শ’ ত্রিশ সালে ওখানেই উঠল আরেকটা আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ। নাম হলো আনাক ক্রাকাতোয়া।’
‘এসব দ্রুত বেড়ে ওঠে,’ সায় দিল আসিফ। ‘আনাক ক্রাকাতোয়া পর্বতের উচ্চতা এখন অন্তত এক হাজার ফুট। অবিশ্বাস্য বেগে ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশের সাগরে।’
‘হাওয়াই দ্বীপের একটু দূরে গজিয়ে উঠছে এমপেরর সিমাউণ্ট,’ বলল তানিয়া। ‘ওরা নাম দিয়েছে লোইহি। গত বছর সার্ভে করেছি আমরা। উনিশ শ’ ছিয়ানব্বুই সালের পর থেকে খুব দ্রুত উঠে আসছে।’
‘ওগুলো তৈরির জন্যে লেগেছে মিলিয়ন মিলিয়ন বছর, আর আমরা দেখছি গত ছয় মাসে উঠেছে সাগর-সমতল, বলল সোহেল।
‘কথা ঠিক,’ বলল আসিফ। ‘আমরা দ্বীপ বা সিমাউণ্ট খুঁজব না’। চোখ রাখব পৃথিবীর টেকটোনিক প্লেটের কিনারায়। সেসব জায়গায় হয়তো উঠছে ঢিবি। প্রথমে মনে হবে তৈরি হচ্ছে নতুন পর্বত। এমনই আছে প্রশান্ত মহাসাগর বা অস্ট্রেলিয়ান প্লেটের কাছে। এসব ঢিবি সরিয়ে দিয়েছে কোটি কোটি গ্যালন পানি। এ ক্ষেত্রেও বোধহয় তেমনই হচ্ছে। উঠে আসছে সাগর-সমতল।’
‘কিন্তু প্রমাণ কোথায়?’ বলল রানা, ‘পাহাড় বা দ্বীপ উঠলে সাইসমিক অ্যাকটিভিটির জন্যে তা আমরা জানতে পারতাম।’
‘অবশ্যই, ঠিকই বলেছিস,’ মাথা দোলাল আসিফ। ‘তা হলে?’ ভুরু নাচাল রানা।
‘এটা ঠিক, অস্বাভাবিকতা চোখে পড়েনি,’ স্বীকার করল জিয়োলজিস্ট। ‘আন্তর্জাতিক কোনও সাইসমিক নেটওঅর্কে কিছুই বলা হয়নি। কিন্তু একজন বলেছিলেন, অস্বাভাবিক কম্পন ধরা পড়েছে তাঁর যন্ত্রে।’
‘ইয়োশিরো শিমেযু,’ আসিফের নোট দেখে নিয়ে বলল রানা।
মাথা দোলাল জিয়োলজিস্ট। ‘জাপানি বিজ্ঞানী। তিনি আবিষ্কার করেছেন সাইসমিক ওয়েভ ধরার অন্যরকম যন্ত্র। এসব কম্পনের নাম দিয়েছেন যি-ওয়েভ। গত এগারো মাসে হাজার হাজার কম্পন পেয়েছেন প্রশান্ত মহাসাগরীয় প্লেটের কাছে। কিন্তু হইচই করেননি। অন্য বিজ্ঞানীরা পাত্তাও দেননি তাঁকে। তাঁর যন্ত্র সত্যিই যি-ওয়েভ ধরতে পেরেছে কি না, তা নিয়েও মাথা ঘামাননি কেউ।’
‘তো তাঁর কথা জানলি কোত্থেকে?’ জিজ্ঞেস করল রানা।
‘টেলিগ্রামে যোগাযোগ আছে,’ বলল আসিফ।
কপালে চোখ তুলল সোহেল। ‘টেলিগ্রাম? কী রে, বাবা, আমরা কি ফিরে গেলাম আঠারো শ’ সালে?
কফিমেকারের কাছে গিয়ে মৃদু হাসছে তানিয়া।
‘শুনলে অবাক হবি,’ বলল আসিফ। ‘ইয়োশিরো শিমেযু খুব অপছন্দ করেন বর্তমান টেকনোলজি। তাঁর আছে একটা কাল্ট। প্রচার করেন, দুনিয়া ভরা ইলেকট্রনিক্সের কারণে ধ্বংস হচ্ছে ঐতিহ্যময় জাপান। তাঁর দলের কেউ ব্যবহার করে না ফোন। ই-মেইল, টেক্সট বা ভিডিয়ো কনফারেন্স তাঁর কাছে হারাম। কিছু দিন আগে হাতে চালানো ছাপা মেশিন দিয়ে ছাপিয়ে বই বের করেছেন।’ তানিয়ার এনে দেয়া কফিতে চুমুক দিল আসিফ। ‘ইয়োশিরো শিমেষু বলছেন, জাপান সরকার আর টেকনোলজিস্টরা প্রাণে মেরে ফেলতে চাইছে তাঁকে। এদিকে অপরপক্ষ বলছেন: ‘ওই লোক মাথা খাচ্ছে তরুণ-তরুণীদের। ইচ্ছের বিরুদ্ধে আটকে রাখছে তাদেরকে।’
‘আসলে কী হচ্ছে, সে ব্যাপারে কিছু জানিস?’ জানতে চাইল রানা।
‘আগে নামকরা জিয়োলজিস্ট ছিলেন,’ বলল আসিফ। ‘তারপর হঠাৎ গুটিয়ে নিলেন নিজেকে। যাক গে, এগারো মাস আগে যি-ওয়েভ শুরু হলে আর্টিকেল লেখেন জাপানি পত্রিকায়। ছয় মাস আগে আরও বেড়ে গেছে যি-ওয়েভ। তারপর গত একমাসে আরও বেড়েছে ওটা।’
সাগর-সমতল উঁচু হওয়ার সঙ্গে সম্পর্ক আছে কয়েক ধাপে যি-ওয়েভ বেড়ে যাওয়ার, বুঝে গেছে রানা, সোহেল ও তানিয়া।
কফির মগের দিকে তাকাল রানা।
চুপ হয়ে গেছে সবাই।
কিছুক্ষণ পর বলল রানা, ‘তো এটাই আমাদের সূত্র?’
‘বলতে পারিস খুব সরু একমাত্র সূত্র,’ বলল সোহেল।
‘কথা বলব অ্যাডমিরাল জর্জ হ্যামিলটনের সঙ্গে, বলল রানা, ‘তিনি আপত্তি না তুললে, দু’ঘণ্টা পর নুমার জেট বিমানে করে রওনা হব আমরা জাপানের উদ্দেশে।’
‘ব্যাপারটা কিন্তু বুনো হাঁসের পেছনে ছোটার মত,’ বলল তানিয়া। মাথা দোলাল আসিফ।
‘ঠিকই বলেছে তানিয়া,’ বলল সোহেল। ‘অ্যাডমিরাল জর্জ হ্যামিলটন আগ্রহী না হলে, তখন কী করবি তুই?’
কাঁধ ঝাঁকাল রানা। ‘ভাড়া নেব চার্টার প্লেন। বস্ বলে দিয়েছেন, জরুরি এই অ্যাসাইনমেন্টে বাংলাদেশ ব্যাঙ্কের যে- কোনও অঙ্কের টাকা খরচ করতে পারি। নুমার জেট বিমান হোক বা চার্টার্ড বিমান, আমরা যাচ্ছি জাপানে।’