আটান্ন
উপসাগর থেকে পাথুরে সৈকতে উঠেই পা থেকে ফিন খুলল রানা ও সোহেল। নরম তালুতে পাথরের কুচির খোঁচা খেতে খেতে ছুটল ট্রায়াথলনের দুই প্রতিযোগীর ভঙ্গিতে। সৈকত পেরিয়ে উঠে এল রাস্তায়। বেশিক্ষণ লাগল না কাছের পার্কিং লটে পৌছুতে। পছন্দমত গাড়ির কাঁচ ভাঙল ওরা। ট্যা-ট্যা শব্দ শুরু করল গাড়ির অ্যালার্ম। তবে মাত্র তিন সেকেণ্ডে ওটার মুখ বন্ধ করে দিল সোহেল। পরের পাঁচ সেকেণ্ডে তার ছিঁড়ে ইঞ্জিন চালু করল রানা। দেরি না করে রওনা হয়ে গেল দুই বন্ধু।
হাতে সময় নেই।
উপসাগরীয় সড়কে ঝড়ের বেগে চলেছে ওদের গাড়ি। ড্রাইভ করছে রানা। তিক্ত সুরে বলল, ‘সইয়ের অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগেই পৌছুতে হবে ফ্রেণ্ডশিপ প্যাভিলিয়নে।’
‘পুলিশের কাছে গেলে কেমন হয়?’ বলল সোহেল।
‘গিয়ে কী বলব?’ মাথা নাড়ল রানা। ‘আমাদের মত দেখতে কয়েকটা রোবট গুলি করে খুন করবে আপনাদের প্রধানমন্ত্রীকে? ডাক্তার ডেকে এনে ঘুমের কড়া ওষুধ দিয়ে অচেতন করে সোজা পাঠিয়ে দেবে হাসপাতালে।’
‘তাতে অ্যালিবাই থাকবে আমাদের,’ বলল সোহেল। ‘যদি হাসপাতালেই থাকি, তো আমরা খুন করব কী করে প্রধানমন্ত্রীকে?’
‘তাতে বাঁচাতে পারব না প্রাইম মিনিস্টারকে,’ বলল রানা। ‘ধরাও পড়বে না লো হুয়াং। কিন্তু আমরা চাই দুই কাজই হোক একইসময়ে।’
‘তা কী করে করবি?’
‘অপরাধের সময়ে ধরতে হবে হুয়াংকে। এদিকে টিভি ক্যামেরার সামনে খুলে দিতে হবে রোবটের মুখোশ।’
‘বুঝলাম,’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল সোহেল। ‘কিন্তু আমরা একটা মিনিট দেরি করলে…..
‘জানি,’ বলল রানা। সামনে গাড়ির জ্যাম। গিয়ার বদলে ইঞ্জিনের গোঁ-গোঁ আওয়াজে গাড়ি উড়িয়ে নিয়ে চলল ও। ‘ভুল হলে খুন হব আমরা।’
এক মাইল যাওয়ার পর বন্ধ এক বড় দোকানের সামনে গাড়ি থামাল রানা। দোকানের তালা ভেঙে শাটার তুলে ভেতরে ঢুকল ওরা। মাত্র তিন মিনিট ব্যয় করল র্যাক থেকে নিজেদের পছন্দের পোশাক নিতে। আরও কিছু জিনিসপত্র খুঁজতে লাগল দুই মিনিট। সব নিয়ে গাড়িতে উঠে রওনা হয়ে গেল ওরা।
‘আমাদের দেখলে ভীষণ লজ্জা পাবে ডাকাতদল,’ বলল সোহেল। ‘প্রথমে চুরি করেছি বোট, তারপর একটা গাড়ি, তারপর পোশাক আর নানান জিনিসপত্র। সবই চব্বিশ ঘণ্টার ভেতর। এভাবে চালাতে পারলে উবোন হিমুরা দাবি করবে, তার কথাই ঠিক— জাপানের বেশিরভাগ অপরাধের পেছনে আছে বিদেশিরা।’
‘আশা করি এসব বলার সুযোগ পাবে সে,’ বলল রানা। ‘আর আমরা খুন হলে কে কী বলল তাতে কী যায় আসে?’
কিছুক্ষণ পর অসম্ভব হলো যাওয়া। প্যাভিলিয়নের আশপাশে গিজগিজ করছে দর্শক, মিডিয়ার লোক ও সিকিউরিটি টিমের সদস্যরা। প্রতিটি রাস্তার মুখে ব্যারিকেড অথবা হলদে ফিতা দিয়ে আটকে দেয়া হয়েছে পথ।
‘গাড়ি ফেলে চল,’ পরামর্শ দিল সোহেল। ‘হেঁটে যাই।’
গাড়ি পার্ক করে নামল ওরা। একটু পর দাঁড়াতে হলো লাইনে। সবাইকে যেতে হচ্ছে মেটাল ডিটেক্টরের মাঝ দিয়ে। নইলে ঢুকতে পারবে না কেউ প্যাভিলিয়নে।
এত কড়া পাহারা, ঢুকবে কী করে রোবট?’ প্রায় ফিসফিস করে রানার কাছে জানতে চাইল সোহেল।
‘পেছন দরজা দিয়ে,’ বলল রানা, ‘তাতে কাজে আসবে উবোন হিমুরার আইডি কার্ড।’
‘পাব কোথায় ওদেরকে?’
‘অন্যদের কথা জানি না, তবে আমার নকল থাকবে সইয়ের সময় কাছেই কোথাও,’ বলল রানা। ‘যাতে সবাই দেখতে পায় গুলি করে প্রধানমন্ত্রীকে খুন করছে মাসুদ রানা। অন্যরা বোধহয় খুলে রাখবে বেরিয়ে যাওয়ার পথ। এখন প্রথম কথা, আমরা ওদেরকে ঠেকাব কীভাবে? এসব রোবট আমাদের চেয়ে শক্তিশালী। বলতে পারিস প্রায় বুলেটপ্রুফ।’
নির্মল হাসল সোহেল। ‘রোবটের সঙ্গে তোকে লড়তে গিয়ে হারতে দেখেছি। তখন থেকেই ওই কথা বারবার ভাবছি।’
‘তারপর? কী ভেবে বের করলি?’
‘তোর মনে আছে, শিমেয়ুর দুর্গে আমাদের ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রের বারোটা বাজিয়ে দিল বড় এক ইলেকট্রোম্যাগনেট ব্যবহার করে? ওই একই জিনিস প্রয়োগ করতে পারি আমাদের রোবট যমজের ওপরে।’
সোহেলের কথা শুনে হেসে ফেলল রানা। ‘চট করে তৈরি করতে পারবি?’
‘না পারার কী আছে? লাগবে বড় পেরেক বা পিন, লম্বা কর্ড আর একটা প্লাগ। বিদ্যুৎ চালু আছে এমন আউটলেট পেলেই কেল্লা ফতে!’
.
খুব সমারোহের সঙ্গে আয়োজন করা হয়েছে দু’দেশের চুক্তি সম্পাদনের অনুষ্ঠান। বেশিরভাগ পলিটিকাল প্রোগ্রামের মতই, বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে সংবাদ মাধ্যমকে। নির্দিষ্ট জায়গায় টিভি ক্যামেরা, ট্রাইপডসহ তৈরি ফোটোগ্রাফাররা, সামনের মেঝেতে ইকুইপমেন্ট। পরের সারিতে রিপোর্টাররা কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে চালু করছে রেকর্ডিং ডিভাইস।
জড় হওয়া হাজারো দর্শকের ওপর চোখ বোলাল লো হুয়াং লিটন। কিছুক্ষণ পর খুন হবেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী। বিজয়ীর বেশে চিনে ফিরবে সে। এটা ভাবতে গিয়ে খুশিতে হাসি চলে এল তার।
এইমাত্র পৌচেছেন জাপানি প্রধানমন্ত্রী ও চিনা রাষ্ট্রদূত। পুরো তিরিশ সেকেণ্ড ধরে একে অপরের হাত ঝাঁকিয়ে দিলেন তাঁরা। ছবি তো তুলতে দেয়ার সুযোগ দিতে হবে। দপদপ করে নানাদিকে জ্বলে উঠছে দামি সব ক্যামেরার ফ্ল্যাশলাইট।
পডিয়ামে উঠে সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা দিলেন চিনা দূত। তিনি পিছিয়ে আরামদায়ক চেয়ারে বসার পর পালা এল জাপানি প্রধানমন্ত্রীর। দীর্ঘ বক্তব্য দিতে লাগলেন তিনি। তাঁর পেছনে দাঁড়িয়ে আছে গর্বিত লো হুয়াং লিটন। একটু পর শেষ হবে এই খেলা।
রাজনৈতিক নেতাদের ওপর চোখ বোলাতে গিয়ে বারবার ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় চোখ কুঁচকে ফেলছে হুয়াং। মনে মনে খুঁজছে মাসুদ রানার রোবটটাকে। আসলে তিনটে রোবট কাজ করছে স্বয়ংক্রিয়ভাবে। রানার মেশিনটা চিৎকার করে বলবে জাপান কখনও চিনের বন্ধু হবে না। পরক্ষণেই পিস্তল দিয়ে গুলি করবে সে। সই হয়ে যাওয়ার আগেই হবে ওটা।
পেছনের করিডোরে অপেক্ষা করবে উবোন হিমুরার চেহারার রোবট। পাহারা দেবে ওদিকে। সাহায্য করবে রানার রোবটকে পালিয়ে যেতে। এদিকে সোহেল আহমেদের রোবটকে দেখা যাবে মাত্র ক’মুহূর্তের জন্যে। তবে ক্যামেরায় ধরা পড়বে তার চলাচল। কাজটা বোধহয় এরই ভেতর হয়ে গেছে। সেক্ষেত্রে উবোন হিমুরার কাছ থেকে পাওয়া পুলিশের গাড়ির ড্রাইভিং সিটে ফিরবে ওটা। অন্যদুটো রোবট এলেই রওনা হবে গন্তব্যের দিকে।
গুছিয়ে নেয়া হয়েছে সব। কোথাও কোনও খুঁত নেই।