পতিবিয়োগে নারীজাতিকে চারি মাস দশ দিন বৈধব্যব্রত প্রতিপালন করিতে হয়। সামান্য বস্ত্র পরিধান করিয়া নিয়মিতাচারে মৃত্তিকায় শয়ন করিতে হয়, সুগন্ধতৈলস্পর্শ, চিকুরে চিরুণী দান, মেহেদি কি অন্য কোন প্রকারের অঙ্গরাগ শরীরে লেপন, যাহাতে স্ত্রীসৌন্দর্য বৃদ্ধি করে, তৎসমুদায় হইতে একেবারে বর্জিত থাকিতে হয়। জয়নাবের বৈধব্যব্রত এখনও সম্পন্ন হয় নাই, পরিধানে মিলন বসন। আব্রু অর্থাৎ চক্ষু ও কর্ণের মধ্যস্থিত উভয় পার্শ্ব হইতে কপোল ও ওষ্ঠের নিন্ম দিয়া সমুদায় স্থানকে আব্রু কহে। এই আব্রুস্থান অপর পুরুষের চক্ষে পড়িলেই শাস্ত্রানুসারে মহাপাপ! স্ত্রীলোকের পদতলের উপরিস্থ সন্ধিস্থান উলঙ্গ থাকিলেও মহাপাপ! সমুদায় অঙ্গ বস্ত্রে আবৃত করিয়া যদি উপরি উক্ত স্থানদ্বয় অনাবৃত রাখে, তাহা হইলে তাহাকে উলঙ্গ জ্ঞান করিতে হয়। স্থূল কথা, মনিবন্ধ হইতে পায়ের গুলফ পর্যন্ত এবং নির্দিষ্ট আবরুস্থান বস্ত্রাবৃত না থাকিলে জাতীয় ধর্মানুসারে তাহাকে উলঙ্গ জ্ঞান করিতে হয়। এই প্রকারে বস্ত্রের ব্যবহার করিতে না পারা সত্ত্বেও আমাদের দেশে ‘জানানা’ রীতি প্রচলিত হইয়াছে। আবার কোন কোন দেশে শাস্ত্রের মর্যাদা রক্ষা ও স্ত্রীস্বাধীনতায় বাধা দেওয়া অনুচিত বিবেচনায় ‘বোর্কা’ অর্থাৎ শরীরাবরণ বসনের সৃষ্টি হইয়াছে। উক্ত প্রদেশে সচরাচর প্রকাশ্য স্থানে বাহির হইতে হইলে বোর্কা ব্যবহৃত হইয়া থাকে। জয়নাব শাস্ত্রসঙ্গত বৈধব্য অবস্থায় শুভ্রবেশ পরিধান করিয়া ঈশ্বরের উপাসনায় দিনযামিনী যাপন করিতেছেন। হস্তে তস্বি (জপমালা), সংসারের সমুদায় কার্য পরিত্যাগ করিয়া অদৃষ্টের লিখন অখণ্ডনীয় বিবেচনাতেই আন্তরিক দুঃখ সহ্য করিয়া কেবলমাত্র ঈশ্বরের প্রতিই নির্ভর করিয়া আছেন। এত মলিনভাব, তথাচ তাঁহার স্বাভাবিক সৌন্দর্য ও রূপমাধুর্যে মানুষমাত্রেই বিমোহিত।
মোস্লেম যথাসময়ে জয়নাবের ভবনে উপস্থিত হইলেন। স্বাধীন দেশ, স্বাধীন প্রকৃতি, নিজের ভাল মন্দ নিজের প্রতিই নির্ভর। বিশেষ পূর্ণবয়স্ক হইলে বিবাহবিষয়ে স্বেচ্ছাচারিতা হইয়া থাকে, নিজের বিবেচনার প্রতিই সমস্ত নির্ভর করে। জয়নাব পিতার বর্তমানে ও দেশীয় প্রথানুসারে এবং শাস্ত্রসঙ্গত স্বাধীনভাবেই মোস্লেমের সহিত কথা কহিতে লাগিলেন। তাঁহার পিতা অদূরে দণ্ডায়মান থাকিয়া উভয়ের কথোপকথন আকর্ষণ করিতে লাগিলেন।
মোস্লেম বলিলেন, “ঈশ্বরের প্রসাদে পথশ্রম দূর হইয়াছে। সত্যি! যে উদ্দেশ্যে আমি দৌত্য কর্মে নিযুক্ত হইয়া আসিয়াছি, একে একে নিবেদন করি, শ্রবণ করুন। যদিও আপনার বৈধব্যব্রত আজ পর্যন্ত শেষ হয় নাই, কিন্তু প্রস্তাবে অধর্ম নাই। আমাদের দামেস্কাধিপতি হজরত মাবিয়ার বিষয় আপনার অবিদিত কিছুই নাই; তাঁহার রাজ-ঐশ্বর্য সকলই আপনি জ্ঞাত আছেন, সেই দামেস্কাধিপতির একমাত্র পুত্র এজিদের বিবাহ পয়গাম লইয়া আমি আপনার নিকট আসিয়াছি। যিনি এজিদ্কে স্বামিত্বে বরণ করিবেন, তিনিই দামেস্করাজ্যের পাটরাণী হইবেন। রাজভোগ ও রাজপরিচ্ছদে তাঁহার সুখের সীমা থাকিবে না। আর অধিক কি বলিব, তিনিই সেই সুবিশাল রাজ্যের অধীশ্বরী হইবেন। আর একটি কথা। পথে আসিতে আসিতে প্রভু মোহাম্মদের প্রিয় পারিষদ আক্কাস আমাকে কহিলেন, তিনিও আপনার প্রার্থী। ঈশ্বর তাঁহাকে সৃষ্টি করিয়া পুরুষ জাতির সৌন্দর্যের অতুল আদর্শ দেখাইয়াছেন। তিনি অতুল বিভবের অধীশ্বর। তিনিও আপনার অনুগ্রহ প্রার্থনা করেন। অধিকন্তু প্রভু মোহাম্মদের কন্যা বিবি ফাতেমার গর্ভজাত হজরত আলীর ঔরস-সম্ভূত-পুত্র মদিনাধিপতি হজরত হাসানও আপনার প্রার্থী কিন্তু এজিদের ন্যায় তাঁহার ঐশ্বর্য সম্পদ নাই, সৈন্য সামন্ত নাই, উজ্জ্বল রাজপ্রাসাদও নাই। এই সকল বিষয়ে সম্ভ্রমসম্পদশালী এজিদের সহিত কোন অংশেই তাঁহার তুলনা হয় না। তাঁহার দ্বারা ইহকালের সুখ সম্ভোগের কোন আশাই নাই, অথচ সেই হাসান আপনার প্রার্থী। এই আমার শেষ কথা। বিন্দুমাত্রও আমি গোপন করিলাম না-কিছুমাত্র অত্যুক্তি করিলাম না। এক্ষণে আপনার যেরূপ অভিরুচি।”
আদ্যোপান্ত সমস্ত শ্রবণ করিয়া জয়নাব অতি মৃদুস্বরে সুমধুর সম্ভাষণে বলিলেন, “আজ পর্যন্ত আমার বৈধব্যব্রত সম্পন্ন হয় নাই। ব্রতাবসানে অবশ্যই আমি স্বামী গ্রহণ করিব। কিন্তু এ সময় যে বিষয়ে আলোচনা করিলেও আমার মনে মহা কষ্টের উদ্রেক হয়। কি করি, পিতার অনুরোধে এবং আপনার প্রস্তাবে অগত্যা মনের কথা প্রকাশ করিতে হইল। ঈশ্বর যে উদ্দেশ্যে আমাকে সৃজন করিয়াছেন, সে উদ্দেশ্যের গুহ্য কারণ কেবল তিনিই জানেন। আমি তাঁহার যে উদ্দেশ্য সিদ্ধির উপকরণ, তাহা আমার জানিবার বা বুঝিবার ক্ষমতা নাই। আমি ক্ষুদ্র জীব, আমি কেন-অনেকে আপন আপন মূল্যের পরিমাণ বুঝিতে অক্ষম। দয়াময় ঈশ্বর আমাকে যে উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করিয়াছেন, যে প্রকারে জীবনযাত্রা নির্বাহ করিতে নিয়োজিত করিয়াছেন, বিধাতা অদৃষ্টফলকে যাহা যাহা অঙ্কিত করিয়াছেন, তাহা অখণ্ডনীয় এবং অনিবার্য। কাজেই সকল অবস্থাতেই সেই সর্বশক্তিমান্ ঈশ্বরের নিয়োজিত কার্যে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করিয়া তাহাতেই পরিতৃপ্ত থাকা সর্বতোভাবে কর্তব্য। জীবন কয় দিনের? জীবনের আশা কী? এই চক্ষু মুদ্রিত হইলেই সকল আশা-ভরসা ফুরাইয়া যাইবে। তবে কয়েক দিনের জন্য দুরাশার বশবর্তী হইয়া অমূলক উচ্চ আশায় লালায়িত হইবার ফল কী? ধন, সম্পত্তি, রাজ্য বা রূপের আমি প্রত্যাশী নহি। বড় মানুষের মন বড় আশাও বড়; তাঁহাদের সকল কার্য আড়ম্বরবিশিষ্ট, অথচ কিছুই নহে। বিশ্বাসের ভাগ অতি অল্প। স্থূল কথা, বিষয়বিভব, রাজপ্রাসাদ এবং রাজভোগের লোভী আমি নহি। সে লোভ এ জীবনে কখনোই হইবে না। মনের কথা আজ অকপটে আপনার নিকট বলিলাম।”
মোস্লেম কহিলেন, “ইহাতে তো আপনার মনোগত ভাব স্পষ্ট বুঝিতে পারিলাম না?”
“ইহা অপেক্ষা স্পষ্ট আর কি হইতে পারে? যিনি ঐহিক পারত্রিক উভয় রাজ্যের রাজা, তিনি যখন আমাকে দাসীশ্রেণীর মধ্যে গ্রহণ করিতে ইচ্ছা করিয়াছেন, তখন আমার ন্যায় সৌভাগ্যবতী রমণী অতি কমই দেখিতে পাইবেন। আর ইহা কে না জানে যে, যাঁহার মাতামহের নিমিত্তই জগতের সৃষ্টি; আদিপুরুষ হযরত আদম জ্ঞানপ্রাপ্ত হইয়াই ঈশ্বরের নিকট কৃতজ্ঞতাসূচক সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করিয়া মস্তক উত্তোলন করিয়াই সেই দয়াময়ের আসনের শিরোভাগে যাঁহার নাম প্রথমেই দেখিয়াছিলেন, তিনি সেই প্রভু হজরত মোহাম্মদের দৌহিত্র। তিনি যখন জয়নাবকে চাহিয়াছেন, তখন জয়নাবের স্বর্গসুখ ইহকালেই সমাগত। পাপীর পাপের প্রায়শ্চিত্ত কোথায় না আছে? কিন্তু সাধু পুরুষের পদাশ্রিত হইতে পারিলে পরকালের মুক্তিপথের পাপকণ্টক বিদূরিত হইয়া স্বর্গের দ্বার পরিষ্কার থাকিবে। তাঁহারা যাহার প্রতি একবার সস্নেহ নয়নে দৃষ্টিপাত করিবেন, সেই ব্যক্তি নরকাগ্নি হইতে মুক্ত হইয়া প্রধান স্বর্গ জান্নাতে নীত হইবে। আর অধিক কী বলিব, আমার বৈধব্যব্রত পূর্ণ হইলেই প্রভু হাসান যে সময়ে আমাকে দাসীত্বে গ্রহণ করিবেন, আমি মনের আনন্দে সেই সময়েই সেই পবিত্র চরণে আত্মসমর্পণ করিব। অন্য কোন প্রার্থীর কথা আর মুখে আনিব না।”
মোস্লেম বলিল, “জয়নাব! তুমিই জগতে পবিত্র কীর্তি স্থাপন করিলে। জগৎ বিলয় পর্যন্ত তোমার এই অক্ষয়কীর্তি সকলের অন্তরে দেদীপ্যমান থাকিবে। ধনসম্পত্তি-সুখবিলাসের প্রত্যাশিনী হইলে না, রূপমাধুরীতেও ভুলিলে না, কেবল অনন্তধামের অনন্ত সুখের প্রত্যাশাতেই দৃঢ় পণ করিয়া পার্থিব সুখকে তুচ্ছজ্ঞান করিলে। আমি তোমাকে সহস্র বার অভিবাদন করি। আমার আর কোন কথা নাই। আমি বিদায় হইলাম।”
মোস্লেম বিদায় হইলেন। যথাসময়ে প্রথমে ইমাম হাসান, পরিশেষে আক্কাসের নিকট সমুদয় বৃত্তান্ত প্রকাশ করিয়া অপূর্ব চিন্তায় নিমগ্ন হইয়া দামেস্কাভিমুখে যাত্রা করিলেন।