2 of 2

মল্লার যেখানে নামে – জয় গোস্বামী

মল্লার যেখানে নামে – জয় গোস্বামী

সেই মেয়েটা। আবার। কবি রাগতে জানেন না। যদিও মাঝে মাঝে তাঁর প্রায়-রাগ গোছের কিছু একটা হয়। এবং তিনি গিলে ফেলেন।

এখনও হল, সেই মেয়েটাকে দেখে। সেই মেয়েটা, মিনিবাসের সামনের দিকে, জানলার ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। দেখা মাত্র রাগ হল। বা প্রায়-রাগ গোছের কিছু একটা। কিন্তু কবি তো রাগতে জানেন না। কী করা যাবে। কবি, কপ করে গিলে ফেললেন। যদিও একদিন মাত্র রেগে গেছিলেন। সেদিন হাত পা থর থর করে কেঁপেছিল, ঘাড় দপদপ করেছিল, চোখ রক্তবর্ণ হয়েছিল, গলা উঠেছিল সপ্তমে।

কিন্তু সে ওই একদিনই। এখন সে সব হবার কথা নয়। হলও না। কিন্তু মেয়েটা নিশ্চয়ই দেখতে পেয়েছে তাঁকে। ভুরু কুঁচকে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকলেও এর কাছে নিস্তার পাওয়া যায় না। এগিয়ে আসবেই। তার উপর কবি আজকে বসার জায়গা পাননি। আর দেরিও হয়েছে বেরোতে, তাই লাইনে দাঁড়িয়ে জায়গা নেওয়ার জন্য অপেক্ষার জো নেই। মিনিবাসের ভ্যাপসা পিছন দিকে হ্যান্ডেল ধরে দাঁড়িয়ে ঝোলা ব্যাগ সামলাচ্ছেন কবি। হে ভগবান, মেয়েটা যেন তাঁর দিকে এগিয়ে না আসে৷ কেননা সারাদিনের মধ্যে এই বাসযাত্রার সময়টুকু, এই ৪৫ মিনিটই, কবির নিজের সময়। বাকিটা অন্যের। গৃহিণীর। কন্যার। আপিসের। ক্লান্তির। ওষুধের। বাজারের। সভা-সম্মেলনের।

লেখার? না। সেটা নেই প্রায়। যা হয় তা মনে মনে। বাড়ি থেকে বেরোনোমাত্র মাথা চালু হয়। অফিসের দরজা পর্যন্ত চলে। এই সময়টা কবি পারতপক্ষে লোক সংসর্গ এড়িয়ে চলেন। ভিড় চারপাশে থাক, ক্ষতি নেই। কিন্তু তাঁকে কথা না বললেই হল। আর, এই সময়টাতেই মেয়েটার সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। আর মেয়েটা এগিয়ে এসে কথা বলে। ও-ই তো আজও এগিয়ে আসতে শুরু করেছে।

—চিনতে পারছেন তো?

—হ্যাঁ, হ্যাঁ। কপ।

—সেদিন জীবনানন্দ বিষয়ে আপনার বক্তৃতা শুনতে গেছিলাম। খুব ভাল লেগেছে আমাদের।

—এই রে। কপ। আমি বক্তৃতা দিতে…অস্বস্তি হয়। খেই হারিয়ে ফেলি। ভুলে যাই।

—ওঃ আর আপনার, ওই ভুলে যাওয়াটা কিন্তু দারুণ।

কপাকপ। কবি গলা ঝাড়লেন। ইচ্ছে করে তো আর কেউ ভুলে যায় না। মঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে ভুলে যাওয়া যে কী জিনিস…আমার সবটা লিখে নিয়ে যাওয়া উচিত ছিল। সময় কোথা যে লিখব।

—আর ওই যে, ‘সমুদ্র’ পত্রিকার কথা বললেন না আপনি…

—হ্যাঁ, সমুদ্র, কাব্যবিচার সংখ্যা…

—হ্যাঁ কাব্যবিচার, ওর প্রতিটি ইস্যুই আমার পড়া।

—সে কী, সে পত্রিকা তো বেরোত বহুকাল আগে, আমরাই তখন স্কুলে পড়ি। তুমি পড়লে কী করে?

—কারণ ওই পত্রিকাটা বার করতেন আমার জেঠু। আমাদের বাড়িতে সবগুলোই আছে।

—তার মানে, নীহারেন্দু সেন? তোমার জ্যাঠামশাই?

—হ্যাঁ।

—তোমার নামটা…যেন কী?

—পারমিতা। পারমিতা সেন। আপনাকে বলেছিলাম।

—কিছু মনে কোরো না। ভুলে গেছিলাম। আজকাল একটুতেই বড় ভুলে যাই। বয়স হচ্ছে তো। মেয়েটি আকাশ থেকে পড়ল, ধেত। মোটেই আপনার কিছু বয়স হয়নি। কবিরা তো একটু ভুলে যাবেই।…তার উপর আপনার মতো কবি।

কপ। কপ। কপ। জনসমক্ষে কবিকে কবি বলার মানেটা কী, এই একফোঁটা মেয়েটা কি সেটা জানে? কানাকে কানা, খোঁড়াকে খোঁড়া বলার চাইতেও খারাপ। সবাই তাকাতে শুরু করেছে কবির দিকে। কবি জানেন, তাঁর মতো ছাপোষা কবির কানাকড়িও মূল্য নেই বাইরের সমাজে। মাঝখান থেকে হাটে রোজ হাঁড়ি ভেঙে যায়। কবি বুঝলেন তার কান গরম হয়ে উঠছে। কবি একটা পাঁচ টাকার নোট পকেট থেকে বার করতে করতে গলা ঝেড়ে বললেন, ‘তুমি যেন কোথায় নামবে!’

—হাজরা। কিন্তু রোজ রোজ আমার টিকিট কাটেন কেন? এটা মোটেই ফেয়ার হচ্ছে না।

বলে কী!—কবি যথাসাধ্য ভারিক্কি হতে হতে বললেন, ধরো তোমার জ্যাঠামশাই যদি তোমার সঙ্গে থাকতেন এখন। তিনি কি তোমাকে টিকিট করতে দিতেন…বাচ্চা মেয়েটার থোঁতা মুখ এবার ভোঁতা করা গেছে মনে করে, কবি একটু স্বস্তি পাচ্ছিলেন কিন্তু মেয়েটি তৎক্ষণাৎ বলে উঠল, মোটেই না। জেঠুর সঙ্গে আপনার একটুকুও মিল নেই। জেঠু খুব গম্ভীর আর সব সময় মোটা মোটা বই পড়ে। আর আপনার লেখা পড়েই বোঝা যায় আপনি মোটেই গম্ভীর নন।

কবি বাঁচবার জন্য, কুটো আঁকড়ালেন। কুটো মানে কন্ডাক্টর। হ্যাঁ ভাই, একটা ডালহৌসি একটা হাজরা।

—অবশ্য জেঠুর কাছেই প্রথম আপনার বই দেখেছিলাম। এখন আপনার সব বই-ই আমার আছে। আচ্ছা, ওই যে বইটা, লুকোও তৃণ, ওই কবিতাগুলো কতদিন আগে লেখা…

—সে সব তো…অনেক দিন আগে…ঠিক, মনে নেই…

কবি পায়ের নীচে জমি পাচ্ছেন না। সব লোক দেখছে হাঁ করে তাঁদের দুজনকে। আবার কুটো আঁকড়ালেন তিনি।…হ্যাঁ, ভাই ৩০ পয়সা খুচরো, হ্যাঁ আছে…

মেয়েটির থামবার লক্ষণ নেই, কী সুন্দর নাম! লুকোও তৃণ। আচ্ছা, তৃণ তো লুকিয়েই আছে। সে তো মিশেই আছে মাটিতে। তা হলে তাকে আবার লুকোতে বলা হবে কেন? প্রেমের কবিতা বলেই কি?

কবি পকেট থেকে রুমাল বার করে কপাল মুছলেন। গড়িয়া থেকে হাজরা যেন অনন্ত পথ মনে হচ্ছে।

—অত কি আর মনে আছে? কবে কি লিখেছি। তা তুমি, তুমি তো দেখছি খুব পড়ো-টড়ো, পড়াশুনো কতদূর করেছ? কবি আবার ভারিক্কি হলেন।

—এবার এম.এ. পরীক্ষা দেব।

—বাঃ। বেশ। পড়ছ তো মন দিয়ে? সাহিত্যটাহিত্য এসব তো আছেই…আগে হচ্ছে লেখাপড়া…ইতিমধ্যে কবি বসবার জায়গা পেয়ে গেছেন। মেয়েটি বসতে চায়নি, কবিও জোর করেননি। সে কবির পাশে দাঁড়িয়ে আছে।

—দ্যাখো না, তোমাকে দেখছি, আর ভাবছি, আমার মেয়েটার কী হবে। কী করবে ও!

—আপনার মেয়ে। আপনার মেয়ে আছে বুঝি?

—আছেই তো।

—ও, কত বড়।

—এই ১০ বছর হল।

মেয়েটি হেসে ফেলে, মোটে ১০ বছর।

—হ্যাঁ, কিন্তু ১০ বছরের তুলনায়, সে খুবই স্বাধীন। সে একেবারেই পড়তে বসে না। এবং তাকে বকতে গেলে সে উল্টে আমাদের বকুনি দিয়ে দেয়।

—বাঃ, কী সুন্দর। আমার এক্ষুনি আপনার বাড়িতে যেতে ইচ্ছে করছে। যাব কিন্তু একদিন। আপনি কখন থাকেন?

—এসো। কপ। কিন্তু আমার তো থাকার ঠিক নেই। কপ। অফিসে ফোন করে দেখতে পার।

সেই বাড়ি আসার প্রসঙ্গ চলে এল। কেন বাড়ি আসা, কবি জানেন। বাড়ি আসবে। লেখার প্রশংসা হবে। তারপর একসময় ঝোলা থেকে বেরোবে একটা বাঁধানো খাতা। কিংবা ডায়েরি। তারপর খুব লাজুক লাজুক মুখে, জানেন, আমিও না একটু একটু লেখার চেষ্টা করি। আপনার সামনে বার করার কথা ভাবাই যায় না। কিছু হয়নি এগুলো। তবু, আপনাকে ছাড়া আর কাকেই বা দেখাতে পারি। তাই, আপনার সময় নষ্ট হবে, তবু, যদি একটু দ্যাখেন…

কবি তখন বলবেন, না না, কী হয়েছে তাতে, দেখি, সময় নষ্ট হবে কেন…

ব্যস, তারপর খাতাভর্তি রাশি রাশি কাঁচা অপাঠ্য দুর্বল কবিতা…

শুনতে শুনতে কান মাথা ভারী করতে হবে…।—রাসবিহারী ছাড়ল বোধ হয়। তুমি এবার একটু একটু করে এগিয়ে পড়ো, কেমন। ভিড় ঠেলতে হবে তো।

—হ্যাঁ, ঠিক আছে। আর একটা কথা, এর মধ্যে কোথাও কবিতা পড়া আছে কি আপনার? কোনও কবি সম্মেলন?

—না না, কিচ্ছু নেই। কিচ্ছু নেই। এখন আর কোথাও যাচ্ছি না।

—না, জানেন আমি যাই। যেখানে কবিতাপাঠ হয়, আমি যাই। কতবার, কত সম্মেলনে আপনার কবিতা শুনেছি। তবু যাই। আচ্ছা, আসি, কেমন?

এসো।

মেয়েটা নেমে গেছে। কিন্তু যা করার করে দিয়ে গেছে। চিন্তাভাবনা একেবারে চটকে দিয়ে গেছে। আজ আর মাথায় কিছু আসবে না। কী মেয়ে রে বাবা। টানা কথা বলে চলবে। আগের দু দিন তো গড়গড় করে কবিতার লাইন অব্দি মুখস্থ বলে যাচ্ছিল। আর, নেহাত বাসের মধ্যে তাই, নইলে কবি মাটিতে মিশে যেতেন। আর এমনভাবে কথা বলে যেন বয়সটা কোনও ব্যাপারই নয়। যেন বন্ধু। কতদিনের চেনা। তার ওপর বলে কি না কবি সম্মেলনে যায়। এ ব্যাপারে একটা ডাহা মিথ্যে বলেছেন কবি ওই বাচ্চা মেয়েটাকে। রবিবারেই আছে একটা। কল্যাণীতে। সেটা অবশ্য বলাও যেত। অত দূর ঠেঙিয়ে নিশ্চয়ই যাবে না মেয়েটা, তবু বলেননি। কবি সম্মেলন। ওই এক ভয়ানক জিনিস। সারাবছর অন্তত ১২৫টা হবে। তার মধ্যে ২৫টায় যেতেই হয়। কবি না বলতে পারেন না। গিয়ে কখন নাম ডাকবে তার জন্য হাঁ করে বসে থাকা। শেষে নিজের পালা এলে দু খানা কবিতা পড়ে ধুঁকতে ধুঁকতে বাড়ি ফেরা রাজ্যের ক্লান্তি আর বিরক্তি মাথায় নিয়ে। এই মেয়ে নাকি আবার সে সব সম্মেলনে গিয়ে বসে থাকে। ছিঃ। ভাবলেই রাগ হয়ে যায়। ঠিক রাগ নয়। প্রায়-রাগ গোছের একটা কিছু হয়। কেননা কবি তো রাগতে জানেন না। রাগ গিলে ফেলেন।

শুধু একদিন গিলে ফেলেননি। উগরে দিয়েছিলেন রাগ। শুধু একদিন। সে দিন শরীরটা ছিটকে উঠে ঝড় তুলেছিল। থরথর করে কেঁপেছিল। চোখে এসেছিল রক্ত। গলা উঠেছিল সপ্তমে। আর তিনদিন অফিস যেতে পারেননি তার জেরে। আর, সেই সবই ঘটেছিল এক কবি সম্মেলনে।

কবির গৃহিণী এ কারণে তাঁকে কম তিরস্কার করেননি। কম মিনতিও করেননি। তবু, সব তো আর মানুষের নিজের হাতে থাকে না। ঘটে যায়। সুতরাং কবি সম্মেলন শব্দটা ভাবলেই ঘাড়ের দপদপানিটা ফিরে আসে আবার। জিভে তেতো লাগে।

সেদিনও তাই ঘটে গেছিল। এক কবিসভায় অনেকের সঙ্গে এক মন্ত্রীও উপস্থিত। সদ্য স্লোগান সর্বস্ব কবিতা লিখতে ও বই ছাপাতে শুরু করা এক মন্ত্রী। কবির সঙ্গে তার পরিচয় ছিল না। সভার শেষে পাকা গোঁফ, চশমা পরা লোকটি নিজেই এগিয়ে এসে কবির হাতে নিজের দু তিনটি বই ধরিয়ে দিয়ে বলল, এগুলো আপনি পড়বেন, আর আপনি তো স্বদেশ পত্রিকায় লেখেন। স্বদেশে এই বইগুলো নিয়ে লিখবেন, বুঝলেন।—গলার স্বরে বেশ একটা কর্তৃত্বের আওয়াজ।

কবি তাঁর স্বভাবসিদ্ধ করুণ করুণ গলায় বললেন, পড়ব নিশ্চয়ই, তবে স্বদেশে রিভিউ করানোর জন্য পত্রিকার দপ্তরে বই জমা দেবেন। ওঁরা ঠিক করবেন রিভিউয়ের ব্যাপারটা কী হবে।

হঠাৎ লোকটি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল, আপনারা ভেবেছেন কী। স্বদেশ পত্রিকা যাকে কবি বলে মনে করবে, সে-ই কবি। আর অন্যরা নয়। আমরা আপনাদের মতো ‘স্বদেশ’ পত্রিকার গোলামি করি না, আমরা মানি না ওসব…

কবি খানিক হকচকিয়ে আবার চেষ্টা করলেন, শুনুন, পত্রিকার সম্পাদক আছেন, সম্পাদকীয় দপ্তর আছে, এসব তাঁদের ঠিক করার কথা।

লোকটি কর্ণপাত না করে চিৎকার করে চলল, দপ্তর দেখাবেন না আমাকে। আপনাদের মতো স্বদেশ পত্রিকায় দালালি করে কবি হইনি। সাধারণ মানুষ আমাদের চেনে। আর আপনারা হচ্ছেন গোলাম, চিরকাল গোলাম হয়েই থাকবেন।

হাত পা ছুড়ে বলতে বলতে এগিয়ে যাচ্ছে লোকটি, হঠাৎ কবির ধৈর্যচ্যুতি হল—এক মিনিট, ভাল করে শুনুন, এক নম্বর, স্বদেশ পত্রিকায় কী বই রিভিউ হবে এবং কে করবে, সেটা ঠিক করবেন সেই পত্রিকার সম্পাদক, আপনি নয়। দু নম্বর, আমি কোন পত্রিকায় কী লিখব সেটাও ঠিক করব আমি। আপনি নয়। বুঝতে পেরেছেন?

এই কথাগুলো বলতে বলতে কবির গলা সপ্তমে পৌঁছল। কান-মাথা আগুন হল। হাত পা কাঁপতে লাগল। এমনকী ওই মন্ত্রী লোকটিও একটুক্ষণের জন্য থমকে গেল। লোকজন ছুটে এল, আরে, কাকে কী বলছেন। আস্তে আস্তে।

কবি দেখলেন, লোকটি পুনরায় তর্জন করতে করতে ফ্ল্যাগ আঁটা একটি সরকারি গাড়িতে উঠে পড়ছে। আর কবির চেনা লোকেরা যেন কিছুই হয়নি এমন উদাসীনভাবে আকাশ গাছপালা দেখছেন।

গৃহিণী বলেন, বোকার মতো কেউ মন্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া করতে যায়? কী ঘটালে বলো তো।

কবি বলেন, ঝগড়া তো করিনি আমি। ও-ই তো এসে স্বদেশে রিভিউ করার জন্য আমাকে হুকুম করছিল। এ তো অন্যায়।

গৃহিণী বলেন, অন্যায়, কিন্তু কেউ তো প্রতিবাদ করল না। অত বড় সব কবি, সাহিত্যিক, অত আমলা, আবৃত্তিকার সবাই তো ছিল। কেউ তো আপত্তি করেনি।

—একজন করেছিলেন। শুভেন্দু চৌধুরি। উনি ওকে বলেছেন আপনি অন্যায় করেছেন। পরের দিন বলেছেন। আমি শুনেছি।

আঃ হা—ওই একজনের প্রতিবাদটাই দেখলে আর অত বড় বড় লোকের চুপ করে থাকাটা দেখলে না। কী নেই তাদের। বাড়ি আছে, গাড়ি আছে। নাম-খ্যাতি আছে। তোমার কী আছে। মাথা গোঁজার জায়গাটা অব্দি নেই! কী আছে তোমার, বলো।

কবি বলেন—আমার শব্দ আছে।

—রাখো। যারা ছিল ওখানে, তাঁদের কাউকে ভাড়া বাড়িতে থাকতে হয় না। বউয়ের অসুখ কিংবা মেয়ের ইস্কুল ভর্তির জন্য টাকা ধার করতে হয় না। তাদের কাউকে নার্সিং হোমের বেয়ারা অপমান করে না তোমার মতো। তাও তারা কিছু বলতে যায়নি। তারা নিজেকে বাঁচাতে জানে। আর শব্দ? সে তো ওই বানিয়ে বানিয়ে লেখা কতকগুলো প্রেমের কবিতা। কী দাম আছে তার।

—দেখি দাদা, নামব।

কবির চটকা ভাঙল। পাশের লোকটি উঠে গেল। কবি জানলা পেলেন। এলগিন রোডে মস্ত জ্যাম। লোকে নেমে যাচ্ছে।

কবি ভাবলেন, গৃহিণী ঠিকই বলেছেন। বানিয়েই লেখা। ওই মেয়েটা একটু আগে জানতে চাইছিল, লুকোও, তৃণর কবিতাগুলো কবে লেখা। তখন কবির ২৪/২৫ বছর বয়স। তখন কবি গালে হাত দিয়ে ভাবতেন, কেউ আসবে। একটি নারী। যার সঙ্গে সাত পা হাঁটতে পারা যাবে। যার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকা যাবে কয়েক পলক। সারা দিন, মনে মনে কথা বলা যাবে যার সঙ্গে। লেখা যাবে লম্বা লম্বা চিঠি। কেউ আসবে।

কেউ আসেনি। সে কোথাও ছিলও না। তবু সে আসবে মনে করে লেখা হয়ে গেছে গোছা গোছা কবিতা। তাই নিয়েই ওই লুকোও তৃণ বই। বানিয়েই লেখা। ঠিকই।

তারপর একসময় মেয়েরা এল। কবি তালকানার ভেসে চললেন। শেষে গৃহিণী তাঁকে জল থেকে ডাঙায় তুললেন জামা ধরে। চালাঘর বেঁধে থিতু করালেন। নইলে যে কী হত।

এখন প্রেম নিভে গেছে। শরীরও নিস্তার দিয়েছে। কেননা, টাকার কথা ভাবলে আর যৌনতা থাকে না। এখন এসব দিক দিয়ে কবি নিশ্চিন্ত। প্রেম নেই, তার পুড়িয়ে দেওয়াও নেই। বাসনা নেই, তার রক্তবর্ণ অশান্তিও নেই। দিবারাত্রি কোথাও কিছু ছাই হয় না এখন। কোথাও কিছু ধিকি-ধিকি জ্বলে না। আঃ, শান্তি। এখন পৃথিবীর দিকে তাকানো যায় সহজে। জানলার বাইরে তাকালেন কবি, লম্বা মিছিল চলেছে। ট্রাফিক থেমে আছে। টুপটাপ লোক নেমে বাস হাল্কা হচ্ছে। কন্ডাক্টর একটা ফাঁকা সিটে বসে বিড়ি ধরাল।

কিন্তু, প্রেম চলে গেছে বলে, চিত্তচাঞ্চল্য ঘটেনি তা নয়। দু দু বার ঘটেছে। বাসেই একবার সামনে দাঁড়ানো একটি মেয়ের কপালে কেবলই চুল এসে পড়ছে। হঠাৎ কবি ভাবলেন, আঙুল দিয়ে কপাল থেকে চুলটা সরিয়ে দিলে কেমন হয়। ভেবেই, ভয়ে হিম হয়ে গেলেন। আর একদিন অবশ্য মুখ নয়, হাত। হাতও নয়, আঙুল। সিটে বসে কবি দেখলেন, সামনের সিট ধরে আছে একটি ফরসা হাত। তার কড়ে আঙুলটা কাঁপছে। কবি, ওই কড়ে আঙুলের দিকে তিনবার তাকিয়ে ফেলেছিলেন। এবং মরমে মরে গিয়েছিলেন। ওই দু দিনই। আর হয়নি।

সামনে মিছিল সমাপ্ত প্রায়। রৌদ্রক্লান্ত লোকগুলির হাঁটা কিছু ধীর। কন্ডাক্টর বাসের ক্লিনারকে বলল, হাঁটছে দ্যাখ! যেন তাজবেঙ্গল থেকে খেয়ে দেয়ে বেরোল।

সম্প্রতি এক শিল্পপতির লেখা উপন্যাসের প্রকাশ উৎসব ছিল তাজ বেঙ্গলে। ঘোর পান-ভোজন ছিল। কবির যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। পরে ঝোলা কাচতে গিয়ে সস্ত্রীক নিমন্ত্রণপত্র দেখে গৃহিণীর বিলাপ হল এই; এই, বললে না! তাও তাজ বেঙ্গলে যাওয়া যেত। নিজে তো আর কখনও নিয়ে যেতে পারবে না।

একজন যেমন মন্ত্রিত্বের জোরে কবি, আর একজন তেমনি টাকার সুত্রে লেখক। কিন্তু শিল্পের দেবী এদের কৃপা করেননি। অন্য দিকে, একদা শত দারিদ্রের মধ্যেও মাথায় কবিতা এলেই খুশি থাকতেন কবি। টাকাপয়সা থাকা না-থাকা বিষয়ে সমাজ কী বলল, তা নিয়ে মাথা ঘামাতেন না। আজ সেই সমাজ ঢুকে পড়েছে বাড়িতে। এ হল নিজের কাছে হার। শব্দ? শব্দ আছে। কিন্তু শব্দ হাতে নিয়ে কি তাজ বেঙ্গলে ঢোকা যায়? এইসব গ্লানি থেকে বাঁচবার উপায় কী? মল্লার যেখানে নামে সেইখানে চলে যাওয়া। মল্লার কোথায় নামে? তা তো কবি জানেন না। কিন্তু তিনি যেতে পারেন। বাঁচবার জন্য মাঝে মাঝে যান।

১০ বছরের মেয়েটা কেবল ফিল্মের গান করে সারাদিন। মাইক থেকে শোনা গান। যাতে মেয়ের কানে একটু ভাল জিনিস ঢোকে, তাই নানান ক্যাসেটের মধ্যে বাড়িতে আনা হয়েছে গান শিখি গান গাই। ছোটদের শেখানোর জন্য, কয়েকটি রাগের বশে তান সরগম ছাড়া ছোট করে গেয়ে দেখানো হয়েছে এখানে। তারই একটি হল মিয়াঁ কি মল্লার। অরুণ ভাদুড়ির গলা। কথাগুলি নিতান্ত সাধারণ। আকাশের মাদল ধম ধম বাজছে—আর বাদল নটবর ছমছম করে নাচছে। ক্ষণপ্রভা অর্থাৎ বিজলি হল নর্তকীর আঁচল। কোনও কবিত্ব নেই এতে। কিন্তু যেই সুরে পড়ল, আর তাকে চেনা যায় না। বা-জে ধমোধমোএখানে মল্লার নেমে যায়। কিন্তু, কোথায় কোন কোন পর্দায় তা জানার দরকার নেই। কারণ কবি সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পান, রাত্রির আকাশ বৃষ্টিতে নিরন্ধ্র। মল্লার নেমে যাচ্ছে আর পাহাড়ের অতল থেকে উঠে আসছে পৃথিবীর হৃৎপিণ্ডের শব্দ: বাজে ধমোধমো। পাতাল থেকে উঠছে, আর অন্তরায়, তার সপ্তকের চূড়ার কাছে চমকাচ্ছে ক্ষণপ্রভা। ভূগর্ভ থেকে মহাকাশ পর্যন্ত একটি ঋজু শিরদাঁড়ায় ভুবনকে যুক্ত করে ওঠা-নামা করছে মল্লার। এই সময় জগৎ ভুলে চোখ ছাপিয়ে জল পড়তে থাকে কবির। কবি মিনতি করতে থাকেন; হে পৃথিবী, আমিও সাধারণ, বাইরে থেকে যেমনতেমন লোক আমিও, আমাকে সুরে পড়তে দাও, আমাকে সুরে ফেলো, দেখো, আমিও অসাধারণ হয়ে উঠতে পারি। আমিও ধারণ করতে পারি জগৎ।

মেয়ে ছুটে আসে, কী হল, কী হল, তুমি কাঁদ কেন! মেয়ের মা ছুটে আসে, কী গো, শরীর খারাপ লাগছে না তো!

ঘোর ভেঙে যায়। দিনের আলো আর রোদ ফিরে আসে। মুছে যায় মল্লার আর রাত্রি।

বাস আবার চলতে শুরু করেছে। কবি কিছুটা গিয়ে, ময়দানের মুখে নেমে পড়লেন। দুপুরের ময়দান। আজ আর অফিস নয়। আজ নিজের সঙ্গে থাকতে হবে।

আলি আকবর খাঁসাহেব কিছু দিন আগে, কাগজে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে, রাগ আয়ত্ত করতে গেলে স্বর আয়ত্ত করতে হয়। আর একটা স্বর আয়ত্ত করতে ১০/১২ বছর সময় লাগে। সাতটা স্বর আছে। তার মানে, একজন মানুষ তার জীবৎকালে ৪/৫টার বেশি স্বর আয়ত্ত করতে সাধারণত পারে না।

কিন্তু যদি সে দীর্ঘায়ু হয়।

তা হলেও, ৭কে ১২ দিয়ে গুণ করো, ৮৪। সেই বয়সে শরীর জরার কবলে চলে যাবে। ইচ্ছে করলেও আর পারফর্ম করা যাবে না। সংগীত অধরাই থেকে যাবে। তা সত্ত্বেও মানুষ রেওয়াজ করে চলে। স্বরকে আয়ত্তে আনতে। ৭ স্বর।

আর, সম্প্রতি এক তরুণ গায়ক তার সাক্ষাৎকারে বলেছেন তিনি আজকাল রেকর্ডিং ও প্রোগ্রাম নিয়ে এত ব্যস্ত থাকেন যে, তালিম রেওয়াজ, এ সবের আর সময় পান না। এই গায়কের গোল্ড ডিক্স হয়েছে।

কবি দেখলেন, একটি সোনার চাকতি আকাশ থেকে ছুটে আসছে গায়নরত তরুণের দিকে, তার শিরচ্ছেদ করে চলে যাচ্ছে, কর্তিত গলা থেকে রক্তফোয়ারা উঠছে, আর শ্রোতাদের করতালিতে বধির হয়ে গিয়ে মাটিতে গড়ানো গায়কমুণ্ড এর কিছুই খেয়াল করছে না।

তবু, কী করে হয় এমন? হয়, কেননা খানিকটা জন্মগত ক্ষমতা থাকেই কারও কারও। সুর ধরবার ক্ষমতা। কিন্তু, সেই ক্ষমতাকে রেওয়াজের মধ্যে দিয়ে একটু একটু করে তুলে নিয়ে যাওরা তো অনেক পরিশ্রম। অনেক কষ্ট। তার চেয়ে অনেক কম কষ্ট, প্রচার, বিজ্ঞাপন, যোগাযোগ ব্যবস্থার দিকে মন দেওয়া। মার্কেটিং ইত্যাদিতে অভিজ্ঞ অভিভাবক সংগ্রহ করা। ১২ ঘণ্টা ধরে একটাই তান ঘর বন্ধ করে অভ্যাস করার চেয়ে অনেক কম পরিশ্রম তাতে। সাফল্য এতে চট করে আসে। শুধু, শূন্যস্থানে ভরে দিতে হবে নিজেকে। ঠিক মতো স্পেস দেখলেই ডোনেট করতে হবে নিজেকে। আর কিছু নয়।

কবি দেখলেন, মঞ্চে গড়ানো গায়কমুণ্ড এবার গানের বদলে কথা বলছে। আর গ্রহণ করছে হর্ষধ্বনি।

কিন্তু, লেখার ক্ষেত্রেও তো ঘটতে পারে এমন। ঠিক এইরকম। ভয়ে শিউরে উঠলেন কবি।

লিখতে গেলে, শব্দের সঙ্গে থাকতে হয়। দিনের পর দিন। ভাষাকে দিয়ে সংবাদের বেশি কাজ করাতে গেলে, তার সঙ্গে জীবন কাটাতে হবে। কবি তরুণ বয়সে নিজের কাছে সংকল্প নিয়েছিলেন, শব্দের সঙ্গে থাকব। জীবন কাটাব। কেননা, যে ভাষায় তুমি কবিতা লিখছ, সেই ভাষা বয়সে তোমার চেয়ে কয়েকশো বছরের বড়। এবং এখনও সে প্রতিদিন জন্মে চলেছে। তার তো একটা চাপ আছে। সে তোমায় ছাড়বে কেন। ভাষা তো চাইবে তোমাকে নিজের দিকে টেনে আনতে। তুমি আবার ভাষাকে নিজের দিকে টানবে। এই টানা পোড়েনের মধ্যে থেকে, কখনও ভাষা তোমার ভেতর থেকে ঠিক কথাটা বলিয়ে নেবে, কখনও বা ভাষাকে দিয়ে বলিয়ে নেবে তুমি। এই যুদ্ধ আর বোঝাপড়া চলবে। আমরণ।।

তার জন্য তো, ওই স্বরের মতোই শব্দকে আয়ত্ত করতে হবে। তার রং। তার নানা রকম ছায়া। তার বিভিন্ন দিকে আলো পাঠানোর ক্ষমতা। জানতে হবে। জানতে জানতে ফুরোবে আয়ুষ্কাল।

সেই সংকল্পের এখন কী অবস্থা! যেহেতু কবি আজ যা লিখবেন, তা-ই ছাপা হবে, তাই লেখার সময়টাই সবচেয়ে কম। সময় শুধু সংসারের। দপ্তরের। সম্মেলনের সেমিনারের। উপরোধ রক্ষার। সৌজন্য বহনের। অন্যকে অসন্তুষ্ট না-করার। লেখা ছিল বলেই একদিন তৈরি হয়েছিল এইসব সৌজন্য সম্পর্ক। আজ এই সৌজন্যগুলোই বেড়ে চলেছে। লেখার সঙ্গে সম্পর্ক নেই।

লেখা তবু ছাড়ে না। সে হানা দেবেই। সে হল জড়বুদ্ধি সন্তানের মতো। কিছু বুঝবে না, কিছু শুনবে না। অফিসে কাজ করছ। হঠাৎ টেবিলের তলা থেকে একটা হাত বেরোল। দাও। অন্য কেউ দেখতে পাবে না, তুমি দেখতে পাবে। ভিড় বাসে দু হাতে হ্যান্ডেল ধরে টাল রাখছ, হঠাৎ পিঠ বেয়ে উঠে কাঁধের কাছে কামড়ে ঝুলছে: দাও। ঝাঁকি দিলে পড়বে না। সারা দিনের পরিশ্রমের পর, রাত্রে সবে ঘুম আসছে, বুকের উপর হাঁটু গেড়ে বসে বলবে-দাও, দাও, দাও। লেখা এমন জিনিস, সে দিন মানবে না, রাত্রি মানবে না। যখন খুশি এসে বলবে, লেখো, আমাকে লেখো, আমাকে লেখো। তখন তাকে না লিখে নিস্তার নেই।

গৃহিণী বলেন, অত বড় প্রফেসর, তোমার লেখা ইংরিজি করবে বলে তোমায় ডেকে পাঠাল। তুমি গেলে না। অত গুমর কীসের।

—গুমর না, গিন্নি, আত্মসম্মান। মুখের আলাপটুকুও নেই ওঁর সঙ্গে। হঠাৎ…

—ইংরেজি করলে হয়তো কিছু টাকা পয়সা দিত। টাকা পয়সা না থাকলে আত্মসম্মান কীসের। সম্পর্কগুলো রাখতে হয়। এটুকু না করলে লেখো কীসের জন্য।

—আমি নিজের জন্য লিখি।

—ঢং। তবে ছাপতে দাও কেন। ছাপিয়ে কেউ পয়সা দিলে হাত পেতে নাও কেন, শুনি। অত যদি আত্মসম্মান…

ঠিকই তো। এই দুপুরের ময়দানের দিকে তাকিয়ে কবি ভাবলেন। আমি তা হলে কীসের জন্য সত্যিই লিখি! অন্য কবিদের জন্য? না। সমালোচকদের জন্য? সাহিত্যিকদের জন্য?—না।

অন্য কবিরা সব জানেন। সমালোচকরা জানেন। আমার তো কত কিছু জানা হয়নি আজও। তাঁদের জানাবার জন্য তবে লিখব কেন আমি।

কেন লেখো, কেন লেখো, কেন?

কবি বললেন, তুমি কখনও হয়তো বুঝবে না, গিন্নি, আর ওই অধ্যাপক যিনি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন অনুবাদ করবার জন্য তিনিও হয়তো বুঝবেন না, তবু বলি, আমি পারি না বলে লিখি। আর, যদি অনুমতি করো, তবে এও বলি, আমি পারি বলেই লিখি। জানি যে, আমার শব্দ ছাড়া অন্য কিছু নেই। জানি যে, শব্দেরও কোনও ক্ষমতা নেই। তবু অন্য কোনও বিদ্যা আমি শিক্ষা করিনি জীবনভর। তাই এর জন্য কেউ অর্থ দিলে, আমি হাত পেতে তা গ্রহণ করি। সংসার প্রতিপালনের জন্য গ্রহণ করি। যদিও জানি, যে রত্নাকরের পাপের ভাগ কেউ নেবে না।

প্রচণ্ড রৌদ্রের মধ্যে ছাতি হাতে ঝোলা কাঁধে হাঁটতে হাঁটতে কবি ময়দানের গাছেদের দিকে তাকালেন: বলো তো, বলো তো দুপুরের গাছেরা, আমি এই গ্রীষ্মের মাঠে, ঘুরে বেড়াচ্ছি কেন আজ।

দুপুরের গাছেরা বলল, লিখবে বলে! লিখবে বলে!

কবি বললেন, বলো তো, আমাকে বলল তো গাছেরা, আমি কার জন্য লিখব? আমি কার জন্য লিখি!

দুপুরের গাছেরা বলল, যে তোমার মতোই রোজ একটু একটু করে শেখে, তার জন্য। তাদের জন্য। তুমি তাদের সঙ্গেই নিজেকে ভাগ করে নাও। তুমি তাদের জন্যই লেখো। যাদের সঙ্গে তোমার এখনও দেখা হয়নি।

সকালের কল্যাণী লোকালে বসে আছেন কবি। জানলার ধারে। প্রায় ফাঁকা ট্রেন। রবিবার। খড়দা ছেড়েছে। বাইরে গাছ, পুকুর, মাঠ সরে সরে যাচ্ছে। আজ বিকেলে ওখানে বইমেলায় কবিতাপাঠ। কবি একা যাচ্ছেন ট্রেনের সময়টা একা পাবেন বলে। গৃহিণী পইপই করে বলে দিয়েছেন, খবরদার কারও সঙ্গে মাথা গরম করবে না। নিজেকে বাঁচিয়ে চলতে শেখো। পশুপাখিরা পর্যন্ত আত্মরক্ষা করতে পারে। তুমি করতে পারো না।

কবি ভাবলেন, একটা পাখির সঙ্গে পতঙ্গ কি কখনও যুদ্ধ করতে পারে? বদলে সে কী করতে পারে? সে নিজের গায়ের রংটা ঘাসের মতো করে ফেলতে পারে।

কবি দেখলেন, বড় একটা জলা ঘাসজমি। একটা মস্ত হাতারে পাখি এসে বসল সেখানে। পাখির মাথাটা মানুষের। চশমা পরা, পাকা গোঁফ। দুরে দুরে কনস্টেবলের টুপি পরা ছোট ছোট পাখি। কিছু দূরে ঘাসের মধ্যে কাঠির মতো একটা পোকা নিশ্চল হয়ে আছে। বড় পাখিটা উড়ে যেতেই কাঠি থেকে একটা মুখ বেরোল। সকালে উঠে এই মুখটাই রোজ আয়নায় দেখেন কবি।

এই তো, পেয়েছি। বাব্বাঃ। কবি দেখলেন, সেই মেয়েটা। নীরেন্দ্র সেন যার জ্যাঠা। ট্রেন একটা স্টেশনে থেমেছে।

—কল্যাণী যাচ্ছেন তো! জানি। আমাকে বলেননি কিন্তু। খবর পেয়েছি।

—ও, তুমি এদিকে কোথায়!

—আমিও কল্যাণী। মাসির বাড়ি যাব। রাতে থাকব। বিকেলে আপনার কবিতা শোনা হবে।

ঈশ্বর! কবি হতাশ হতেও ক্লান্ত বোধ করলেন। পুরো রাস্তাটা মাটি।

—স্টেশনে দেখলাম আপনি হন হন করে ঢুকে গেলেন গেটে। আমার তখন টিকিট কাটা হয়নি। পরে প্ল্যাটফর্মে আসতেই ট্রেন সিটি দিল। উঠে পড়লাম পেছনের দিকে। তারপর প্রত্যেকটা স্টেশনে থামছে, আর আমি ছুটে ছুটে এগিয়ে যাচ্ছি। শেষে ধরে ফেললাম।

মেয়েটি তার আঁচল দিয়ে মুখ মুছল।

এ কি পাগল! আজ ট্রেনে লোক নেই। কেউ তেমন খেয়াল করবে না এ সব কথাবার্তা, এটাই বাঁচোয়া।

—প্রোগ্রাম তো বিকেলে। কোথায় উঠবেন। চলুন আমার মাসির বাড়িতে বিশ্রাম নেবেন।

কবি ধীরে ধীরে বললেন, সেটা করার উপায় নেই, কারণ, আমার বন্ধু থাকেন জুলিয়েন ডে স্কুলের সামনে। ওঁরা অপেক্ষা করবেন।

জুলিয়েন ডে। সে তো চিনি। আচ্ছা একটা কথা, আমি কি ওই পর্যন্ত আপনার সঙ্গে একটু যাব?

কবি না বলতে পারেন না। হাল ছেড়ে বললেন আচ্ছা যেয়ো। এবং তারপর আবার কুটো আঁকড়ানোর মতো বললেন—হ্যাঁ, আমি কিন্তু স্টেশন থেকে পুরোটা হেঁটে যাব। ভাবতে ভাবতে যাব তো। অনেকটা পথ কিন্তু।

আপনার ভাবনায় আমি মোটেই বাধা দেব না। কথা বলব না। শুধু সঙ্গে সঙ্গে যাব। আপনার সঙ্গে সাত পা হাঁটাই অনেক।

কবি থমকালেন, সাত পা হাঁটা মানে?

—বলে না, সাত পা হাঁটলে বন্ধু হয়। সেই আর কী! তা ছাড়া ভিড় বাসে তো মুখের দিকে তাকানো যায় না। মুখের দিকে না তাকালে কি কথা বলতে ইচ্ছে করে? চোখের দিকে না তাকালে?

মেয়েটি অপলক চেয়ে আছে। সোজা। কবির মেয়েটির কোনও ভাষাই বুঝতে পারে না।

—আজ কিন্তু আপনি লুকোও তৃণ থেকে কবিতা পড়বেন।

—ও বইটা আনিনি।

—আমি এনেছি। এই প্রথম লেখাটা পড়বেনই পড়বেন। মেয়েটি ব্যাগ থেকে বই বার করে পাতা খোলামাত্র বই থেকে দু তিনটে বাসের টিকিট আর একটা ভাঁজ করা কাগজ ঝরে পড়ে। মেয়েটি ঝাঁপিয়ে উড়ে যাওয়া বাসের টিকিট কুড়োতে থাকে।

কবি বাধা দেন—আঃ, ধুলোর মধ্যে থেকে ওই টিকিট কুড়োচ্ছ কেন। নোংরা ওখানে। টিকিট তো কাজে লাগবে না। এই নাও এই কাগজটা রাখো। পড়ে গেছিল।

মেয়েটি টিকিটগুলো ব্যাগে রেখে বলল, এগুলো মামুলি বাসের টিকিট নয়। তিনটে আছে। যে তিন দিন আপনার সঙ্গে বাসে দেখা হয়েছে আপনি কেটে দিয়েছিলেন!

তুমি কি উন্মাদ! এগুলো কেউ রাখে?

—হ্যাঁ রাখে। আর যে ভাঁজ করা কাগজটা আমার হাতে দিলেন, এটা কী জানেন?

কী?

—একটা চিঠি। এই বই পড়ে লেখা!

—এই বই!

—হ্যাঁ কোনও লেখা পড়লে লেখকের সঙ্গে মনে মনে কথা বলতে হয় তো। সারাদিন ধরে কথা চলে। মনে মনে। তর্ক। আপত্তি পছন্দ। চলে তো? তারই কিছু লিখে রাখা। পোস্ট করতাম না। কী আশ্চর্য দেখুন, ঠিক কীভাবে এই চিঠিটা আপনার হাতে পড়ে গেল। আপনার হাত ছুঁয়ে ফিরে এল। দেখতে চাইবেন না কিন্তু।

কবি শুধু কোনওক্রমে বলতে পারলেন, তুমি কি লেখো? কবিতা লেখো কি তুমি?

মেয়েটি হাসল, বলল, না না লিখি না। লিখতে পারি না আমি। কবিতা পড়ি। কবিতা শুনি। মানুষ যেমন গান শোনে, তেমনি। কবিতার মধ্যে দিয়ে নিজেকে যেভাবে বুঝতে পারি, পৃথিবীকে যেভাবে বুঝতে পারি, আর কিছুতেই তেমন পারি না। সব কবিতাই তেমন হয় না ঠিকই। কিছু কিছু হয়। আপনার এই প্রথম কবিতাটা তেমন। পড়বেন তো। বলুন আজ পড়বেন তো?

পাতাটা খুলে বইটা এগিয়ে ধরল মেয়েটি।

কবি দেখলেন, মেয়েটির কপালে উড়ে পড়ছে একটা চুলের গুচ্ছি। কবি দেখলেন, তাঁর বইয়ের মলাটে কাঁপছে মেয়েটির ফরসা কড়ে আঙুল।

এবং কবি দেখলেন, মল্লার নামছে! বাইরে রোদুর, ছুটে চলা ট্রেন। তার যাত্রীদল, সব মুছে গেছে। চারিদিক শুধু রাত্রির আকাশ প্রবল বৃষ্টিতে নিরন্ধ্র। মল্লার নামছে। অরুণ ভাদুড়িকে বারণ করছেন কবি। অরুণ ভাদুড়ি শুনছেন না। পাহাড়ের অতল খাদ থেকে উঠে আসছে পৃথিবীর হৃৎপিণ্ডের শব্দ। ধম ধম ধ্বনি। চূড়ার কাছে চমকাচ্ছে ক্ষণপ্রভা। ভূগর্ভ থেকে মহাকাশ পর্যন্ত যুক্ত করে দিচ্ছে একটি চলন্ত শিরদাঁড়া। মল্লার। মল্লার।

আর মেয়েটি দেখল, কবির চেয়ে কুড়ি বছরের ছোট মেয়েটি দেখল, ‘পড়বেন তো, বলুন,’ আর একবার বলামাত্র মেয়েটি দেখল—কবি উঠে দাঁড়িয়েছেন। কবির চোখে লেগেছে রক্তের ছিটে, কবির হাত পা থরথর করে কাঁপছে, কবি উন্মাদের মতো চিৎকার করে বলছেন, আর একটা কথা বললে তোমার জিভ ছিড়ে নেব আমি। যখন আমার পঁচিশ বছর বয়স ছিল তখন কোথায় ছিলে? কোথায় ছিলে তুমি!

১৬ এপ্রিল ১৯৯৫

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *