মরণ দোল

মরণ দোল

পয়লা মাঘ ১৩৪০; সন্ধ্যাকাল। মুঙ্গের শহর বলিয়া যাহা এতকাল পরিচিত ছিল তাহারই একপ্রান্তে আমাদের ক্লাবের বিধ্বস্ত বিমথিত ঘরখানার বাহিরে আমরা কয়েকজন ক্লাবের সভ্য বসিয়া ছিলাম। সকলেরই আপাদমস্তক গৈরিক ধূলা ও সুরকিতে আবৃত। কাহারও পায়ে জুতা নাই। বরদার গায়ে কেবল একটা গেঞ্জি—বাহুর একটা স্থান কাটিয়া ধুলায় রক্তে মাখামাখি হইয়া শুকাইয়া ছিল। সে থাকিয়া থাকিয়া হি হি করিয়া কাঁপিয়া উঠিতেছিল।

বেলা দু’টা বাজিয়া বারো মিনিটের সময় ভূমিকম্প হইয়া গিয়াছে; কিন্তু আকাশ এখনো রক্তাভ ধুলায় আচ্ছন্ন হইয়া আছে। নীচে, উইঢিবির উপর উইয়ের মতো অসংখ্য লোক ইটের স্তূপের উপর ঘুরিয়া বেড়াইতেছে, প্রিয়জনের নাম ধরিয়া ডাকিতেছে, উচ্চৈঃস্বরে চিৎকার করিয়া কাঁদিতেছে। আমরা ক্লান্ত অবসন্ন দেহে বসিয়া ধুঁকিতেছিলাম। অভিশপ্ত শ্মশানীভূত শহরের উপর অলক্ষিতে শীতরাত্রির অন্ধকার নামিয়া আসিতেছিল।

সকলেই স্ব স্ব চিন্তায় মগ্ন ছিলাম; তাই মাঝে মাঝে যা দু’একটা কথা হইতেছিল তাহাও ছাড়া ছাড়া অসংলগ্ন বোধ হইতেছিল। শচীন হঠাৎ বলিয়া উঠিল, ‘একটা কোদাল পেলে হয়তো দাশুটাকে বাঁচাতে পারতুম। ইট আর সুরকির তলা থেকে তার কাতরানি শুনতে পাচ্ছিলুম; কিন্তু শুধু হাত দিয়ে পঞ্চাশ টন ইট সুরকি সরানো—’

দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া শচীন চুপ করিল। শুধু হাতেও যে সে পঞ্চাশ টন ইট-সুরকি সরাইবার চেষ্টা করিয়াছিল, তাহার রক্তমাখা ক্ষতবিক্ষত আঙুলগুলা তাহার সাক্ষ্য দিতেছিল।

বরদা দন্তবাদ্য কোনোমতে থামাইয়া বলিল, ‘আজ টেম্‌পারেচার কত বলতে পার? ফ্রিজীং পয়েন্টের নীচে নেমে গেছে নাকি?’

অমূল্য এতক্ষণ ক্লাবঘরের ভাঙা বরগা, জানালার কাঠ ইত্যাদি সংগ্রহ করিয়া আগুন জ্বালিতে প্রবৃত্ত ছিল; এখন বলিল, ‘এস, ঘিরে বসো। আজ রাত্রি যাপনের ব্যবস্থা কি?’

সকলে আগুন ঘিরিয়া বসিলাম। বরদা বলিল, ‘আমার গোয়াল ঘরটা দাঁড়িয়ে আছে—সেইখানেই সকলে মিলে গুঁতোগুঁতি করা যাবে।’

অমূল্য জিজ্ঞাসা করিল, ‘আর আহার?’

বরদা মাটির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া বলিল, ‘ঘাস। আজ আর বিচিলিও পাচ্ছ না।’

অমূল্য হাসিয়া বরদার পিঠ চাপ্‌ড়াইয়া বলিল, ‘কুচপরোয়া নেই। গোয়ালেই যখন থাকতে হবে তখন ঘাসে আপত্তি করলে চলবে কেন?’

নন্দ’র একটা পা ভাঙিয়া গিয়াছিল। সে কোট প্যান্টালুন পরিহিত অবস্থায় চিৎ হইয়া ঘাসের উপর শুইয়া সিগারেট টানিতেছিল। মাথায় একটা ব্যান্ডেজ জড়ানো ছিল; একটা পা প্যান্টালুনের উপরেই লাঠি দিয়া সোজা করিয়া বাঁধা ছিল। আমরা তাহাকে চ্যাংদোলা করিয়া আনিয়া আগুনের পাশে শোয়াইয়া দিলাম। নন্দ’র মাথার চোট খুব গুরুতর নয়; কিন্তু সে কেমন যেন ঝিমাইয়া পড়িতেছিল। নিজের মনেই সিগারেট টানিতে টানিতে বিড়্‌ বিড়্‌ করিয়া বলিল, ‘দোতলার অফিস রুমে বসে টেবিলের ওপর পা তুলে দিয়ে সিগারেট ফুঁকছিলুম; প্রথম আধ মিনিট বুঝতেই পারলুম না যে ভূমিকম্প হচ্ছে। গঁদের শিশিটা টেবিলের ওপর থেকে নাচ্‌তে নাচ্‌তে যখন মাটিতে পড়ে গেল তখন বুঝলুম। ঘর থেকে বেরিয়ে পালাতে যাব, খিলেন থেকে একটি এগারো ইঞ্চি খসে মাথায় পড়ল। মুখ থুব্‌ড়ে পড়লুম সেইখানেই—তারপর পায়ের ওপর পড়ল একটা বীম!….হামাগুড়ি দিয়ে পালাবার চেষ্টা করলুম—সিঁড়ি পর্যন্ত পৌঁছুতে না পৌঁছুতে সমস্ত বাড়িখানাই মাথার ওপর ভেঙে পড়ল।’

অমূল্য বলিল, ‘নন্দ, তুই পেল্লাদ-মার্ক ছেলে। এতেও যখন মরিসনি তখন আর তোর ভাবনা নেই।’

নন্দ নিজমনে বলিয়া চলিল, ‘জ্ঞান যখন হয়, দেখলুম নাকের ফুটো সুরকিতে বন্ধ হয়ে গেছে—হাঁ করে নিশ্বাস নিচ্ছি। সর্বাঙ্গের ওপর এর অসহ্য চাপ; মনে হচ্ছে ইট-পাথরের চাপে পাঁজরাগুলো এখনি প্যাঁকাটির মতো মট্ মট্ করে ভেঙে যাবে। চোখ খুলে চাইবার উপায় ছিল না, ধুলোয় চোখ বন্ধ। কিন্তু কান দুটো খোলা ছিল। অনেক রকম আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলুম। আমার বাঁ পাশে অফিসের দপ্তরী হায়দার মিঞা ‘পানি লাও’ ‘সরবৎ লাও’ ‘হালুয়া লাও’ বলে নানারকম ফরমাস করছিল—বোধ হয় তার মাথায় চোট লেগেছিল। ডান দিক থেকে একজনের কাশির আওয়াজ আসছিল, কেউ রক্তবমি করছিল। ক্রমে দু’দিকের শব্দই থেমে গেল। আমার শরীরের ওপর চাপ যেন আরো বেড়ে উঠ্‌তে লাগ্‌ল—কান ভোঁ ভোঁ করতে লাগল। তারপর আর মনে নেই। —তোরা কখন আমায় বার কর্‌লি?’

পৃথ্বী দক্ষিণ হস্তের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ মুখে পুরিয়া চুষিতেছিল—সে ডাক্তার। অঙ্গুষ্ঠ বাহির করিয়া বলিল, ‘সাড়ে চারটের সময়। উপুড় হয়ে পড়েছিলি; ভাগ্যে একটা বীম কোণাচে ভাবে তোর ওপর পড়েছিল—নইলে—’ আমার দিকে ফিরিয়া মৃদুকণ্ঠে বলিল, ‘হাসপাতালের অবস্থা কি রকম কিছু জানো? নন্দ’র জন্যে অন্তত একটা splint আর কিছু টিংচার আয়োডিন চাই-ই। মাথায় জখমটা বিশেষ কিছু নয় কিন্তু পায়ে copound fracture of the tibia—যদি গ্যাংগ্রীন set in করে—’

প্রমথ বলিল, ‘উপায় নেই। হাসপাতাল দেখে এসেছি—ধুলো হয়ে উড়ে গেছে!’

কিছুক্ষণ সকলে নীরব রহিলাম। আমাদের অঙ্গারগর্ভ ধুনী আরক্তভাবে জ্বলিতে লাগিল। সেইদিকে তাকাইয়া শচীন বলিয়া উঠিল, ‘আড়াই মিনিটের মধ্যে সাত শতাব্দীর কীর্তি একটা শহর তাসের বাড়ির মতো ধূলিসাৎ হয়ে গেল। উঃ! কী ভীষণ শক্তি! আমার বিশ্বাস, জার্মান হাউইট্‌জার দিয়ে বারো ঘন্টা বোম্বার্ড করলেও এমনটা করতে পারত না। কত লোক মরেছে কেউ আন্দাজ করতে পারো?’

অমূল্য বলিল, ‘ছ’সাত হাজারের কম নয়।’

প্রমথ মাথা নাড়িল, ‘আমি সমস্ত শহর ঘুরে দেখে এসেছি—মোট দশ বারো হাজার লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাকী লোক গেল কোথায়?’

নন্দ জিজ্ঞাসা করিল, ‘বাঙালী ক’জন মরেছে?’

তখনো সম্পূর্ণ খবর জানা যায় নাই; যতদূর জানা গিয়াছিল নন্দকে বলিলাম। শুনিয়া নন্দ জিজ্ঞাসা করিল, ‘তোদের বাড়ির সবাই বেঁচে আছে? কেউ যায়নি?’

ভাগ্যক্রমে আমাদের কয়জনের আত্মীয় পরিজন রক্ষা পাইয়াছিল। ঘরবাড়ির অবশ্য কাহারো চিহ্ন ছিল না; কিন্তু সকলে যে প্রাণে প্রাণে বাঁচিয়া গিয়াছে এই সৌভাগ্যের আনন্দে সর্বস্ব হারানোর দুঃখও লঘু হইয়া গিয়াছিল। রাজেন সেই কথাই বলিল, ‘বাড়িঘর গিয়েছে যাক গে, বেঁচে থাকলে আবার হবে। কি বলিস? কিন্তু ভেবে দ্যাখ দেখি, যদি মণি’র মতো অবস্থা হত!’

আমরা মনে মনে শিহরিয়া উঠিলাম। মণি’র স্ত্রী পুত্র মা ছোটভাই—অর্থাৎ পৃথিবীতে আপনার বলিতে যে-কয়জন ছিল সকলেই চাপা পড়িয়াছিল, কেবল সে একা বাঁচিয়া ছিল।

অনেকক্ষণ কোনও কথা হইল না; তার পর চুনী মৃদুকণ্ঠে হাসিতে লাগিল। মণি’র দুর্ভাগ্যের কথা ভাবিয়া হাসিতেছে না তাহা বুঝিলাম। এতগুলা ভয়ঙ্কর ঘটনা এত অল্পকালের মধ্যে চক্ষের সম্মুখে ঘটিয়া গিয়াছিল যে, মন একটা ঘটনাকে ধরিয়া বেশীক্ষণ স্থির থাকিতে পারিতেছিল না—আলোর ধাঁধায় দিগ্‌ভ্রান্ত চামচিকার মতো এ-দেয়াল হইতে সে-দেয়ালে আছাড় খাইয়া ফিরিতেছিল। আলোচনার ধারাও তাই বিচিত্র রকমের স্বৈরাচারী হইয়া উঠিয়াছিল।

চুনী বলিল, ‘অমূল্য আজ এক কুকুরের প্রাণ রক্ষা করেছে।’

অমূল্য যে কুকুরগতপ্রাণ, একথা আমরা সকলেই জানিতাম; তাই ব্যাপারটা জানিবার জন্য উৎসুক হইয়া উঠিলাম। চুনী বলিল, ‘সবেমাত্র ভূমিকম্প থেমেছে—আমি ছুটেছি স্কুলের দিকে, ছেলেটার কি হল দেখবার জন্যে। বড়বাজারের চৌমাথার ওপর এসে দেখি, অমূল্য একটা প্রকাণ্ড লোহার বীম নিয়ে টানাটানি করছে। কিন্তু বীম নড়বে কেন? একে তো সেটা নিজেই বিশ মণ ভারী, তার ওপর আবার পঞ্চাশ টন ডেব্রি পড়েছে তার ঘাড়ে। আমাকে দেখে অমূল্য উন্মাদের মতো হাত নেড়ে ডাক্‌লে; তার মুখের ভাব দেখে মনে হল হয়তো বা একটা মানুষ বীমের নীচে চাপা পড়েছে। নিজের ছেলের সন্ধান ছেড়ে ছুটে গেলুম। গিয়ে দেখি, বীমের এক প্রান্তে একটা কুকুর পিছু ফিরে বসে আছে আর তারস্বরে চেঁচাচ্ছে! জিজ্ঞাসা করলুম, ‘এ কি!’ অমূল্য কাঁদো কাঁদো হয়ে বললে, ‘ভাই, ওর ল্যাজ চেপে গেছে, কিছুতে ছাড়াতে পারছি না।’

‘কি রকম রাগ হয় বল তো? রেগে চলে যাচ্ছিলুম, অমূল্য হাত চেপে ধরলে। কি করি—ভয়ও হল। পরের সন্তানকে বিপদে ফেলে নিজের সন্তান খুঁজতে যাচ্ছি, হয়তো ভগবান দাগা দেবেন। দু’জনে মিলে বীম ধরে ঠেলাঠেলি আরম্ভ করলুম। কিন্তু বৃথা চেষ্টা, বীম একচুলও নড়ল না। অমূল্য কাঁদতে কাঁদতে বললে, ‘কি করি ভাই!’

‘তখন আমার মাথায় এক বুদ্ধি গজালো। জিজ্ঞাসা করলুম, ‘ছুরি আছে?’ অমূল্য পকেট থেকে ছুরি বার করলে। আমি বললুম, ‘আর দেরি নয়, ওর ল্যাজ কেটে ফ্যালো।’ অমূল্য বুঝলে ও ছাড়া গতি নেই, দ্বিরুক্তি না করে ল্যাজ কেটে ফেল্‌লে।

‘কুকুরটা ছাড়া পেয়ে মারলে টেনে দৌড়। একবার পিছু ফিরে তাকালে না; অমূল্যকে একটা ধন্যবাদ পর্যন্ত দিল না। এই তো কুকুরের কৃতজ্ঞতা!’

অমূল্য গল্পের মধ্যে দু’একবার বাধা দিবার চেষ্টা করিয়াছিল, এখন লজ্জিতমুখে বলিল, ‘চুনীটা ভারী মিথ্যেবাদী। আমি কেঁদেছিলুম?’

‘কাঁদিস নি?’

‘শচীন বলিল, ‘ল্যাজ কাটার কথায় মনে পড়ল। আমি একটি পতিতা নারীকে উদ্ধার করেছি। তবে সম্পূর্ণ নয়।’

‘কি রকম?’

‘বাজারের ও-অঞ্চলে একটি বাড়িও খাড়া নেই দেখেছ বোধ হয়। কেবল ইটের পাহাড়। তারই ওপর ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে হঠাৎ দেখলুম—একটা পা গোছ-পর্যন্ত বেরিয়ে আছে। চুট্‌কি পরা স্ত্রীলোকের পা। হাঁকাহাঁকি করে দু’চারজন লোক জড় করলুম, তারপর সবাই মিলে ইট কাঠ সরাতে লাগলুম। মনে হল, পা যখন বেরিয়ে আছে তখন হয়তো মরেনি। অনেক কষ্টে ধড়টা বার করা গেল—ধড়টা বেশ অক্ষত। তারপর গলার কাছে পৌঁছে দেখি—আর কিছু নেই! মুণ্ডুটা সাফ্ ছিঁড়ে বেরিয়ে গেছে। —হাত দশেক দূরে মাথাটা পাওয়া গেল।’

কিয়ৎকাল চুপ করিয়া থাকিয়া শচীন আবার বলিল, ‘আজ যে-সব দৃশ্য দেখেছি কখনো ভুলতে পারবো বলে বোধ হয় না। গণেশলালকে চেনো? বেহারী উকিল? সে কোর্টে ছিল, পাগলের মতো ছুটতে ছুটতে এসে দেখলে, তার স্ত্রী বাড়ির সামনে রাস্তার ওপর মরে পড়ে আছে!—গণেশ এখনো স্ত্রীর মৃতদেহ কোলে করে রাস্তার ওপর বসে আছে।’

একটু থামিয়া বলিল, ‘কি ভাগ্য দেখ। মেয়েটি বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিল, কিন্তু রাস্তায় নামতেই আর একজনের বাড়ি তার মাথার ওপর ভেঙে পড়ল। নিজের বাড়ি থেকে না বেরুলে হয়তো মরত না।’

বরদা বলিল, ‘ওটা তোমার ভুল। মৃত্যু তাকে ডাক দিয়েছিল; যেখানেই থাকুক তাকে যেতে হত।’

চুনী বলিল, ‘আমি তো এক সেকেন্ডের জন্যে বেঁচে গেছি। ডেপুটির কোর্টে একটা কেস্ আরম্ভ করেছিলুম, হঠাৎ হাকিমটা এক লাফ মেরে আমার ঘাড়ের ওপর পড়ল। দু’জনে জাপ্‌টাজাপ্‌টি করে নাচতে নাচতে ঘর থেকে যেই বেরিয়েছি অমনি ঘরের ছাদ ধ্বসে পড়ল।’

বরদা বলিল, ‘পরমায়ু থাকতে কেউ মরতে পারে না, এই হচ্ছে চরম সত্য। নইলে আমি বেঁচে আছি কি করে?’

অমূল্য বলিল, ‘খুব খাঁটি কথা। তুমি বেঁচে আছ কি করে সেটা আমরা সকলেই জানতে চাই। তুমি তো দোতলার ঘরে খিল দিয়ে গৃহিণী সমভিব্যাহারে দিবানিদ্রা দিচ্ছিলে। তুমি বাঁচলে কি করে বল তো শুনি?’

বরদা বলিল, ‘সে কথা বললে তোমরা সবাই আমায় অবিশ্বাস করবে। একে তো আমার একটা বদনাম আছে—’

অমূল্য বলিল, ‘তোর গল্প যত আষাঢ়েই হোক আজ আমরা শুনব। আজকের দিনে যদি তুই মিথ্যে গল্প বানিয়ে বলতে পারিস তাহলে বুঝব তোর মতো পাপী নরকেও নেই।’

বরদা বলিল, ‘ভাই, আমি কখনো মিথ্যে গল্প বলিনে। হয়তো একটু আধটু রঙ চড়িয়ে বলি, কিন্তু আজ আর তাও নয়। —নির্জলা সত্যি কথা বলব—সাক্ষী ভগবান।’

তারপর বরদা বলিতে আরম্ভ করিল, ‘অমূল্য ঠিক ধরেছে—দিবানিদ্রাই দিচ্ছিলুম, গিন্নীও পাশে শুয়ে ঘুমোচ্ছিলেন। হঠাৎ গিন্নীর ঠেলা খেয়ে ঘুম ভেঙে গেল, দেখি খাটখানা ঘরময় পিছলে বেড়াচ্ছে। ঘরটা দুলছে, ঠিক যেন কেউ দু’হাতে ধরে সেটাকে ঝাঁকানি দিচ্ছে। আর, এক হাজার জাঁতা একসঙ্গে ঘোরালে যে-রকম শব্দ হয় তেমনি একটা শব্দ মাটির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে।

‘আমি খুব সাহসী লোক নই; অন্তত মৃত্যুকে ভয় করি না এমন কথা বললে মিথ্যে কথা বলা হবে। কিন্তু আশ্চর্য—আমার একটুও ভয় হল না; বুদ্ধিও ঘোলাটে হয়ে গেল না। বোধ হয় বিপদটা হঠাৎ এসে উপস্থিত হয়েছিল বলেই ভয়-বস্তুটা মনের মধ্যে ঢোকবার অবসর পায়নি। বিদ্যুৎ চমকের মতো আমার মাথায় খেলে গেল—আজ জীবন মরণের সমস্যা; হয় এস্‌পার নয় ওস্‌পার!

‘আজ তোমাদের কাছে বলতে লজ্জা নেই, বিপদের গুরুত্ব উপলব্ধি করার সঙ্গে সঙ্গে একটা কথা মনে মনে স্থির করে নিয়েছিলুম—মরি তো একসঙ্গে মরব, কেউ কাউকে ছেড়ে দেব না। গিন্নীও আমার বাঁ হাতখানা এমনভাবে চেপে ধরেছিলেন যে ইহজন্মে সে হাত ছাড়ানো সম্ভব ছিল না।

‘দু’জনে একসঙ্গে খাট থেকে নামলুম। তখন ছাদ থেকে টাইল ভেঙে পড়ছে, মেঝে এত দুলছে যে দাঁড়িয়ে থাকা কঠিন। একটা আলমারি ঠিক পায়ের কাছে উপুড় হয়ে পড়ে চুরমার হয়ে গেল।

‘দরজা খুলে ঘর থেকে বের হলুম। দোতলায় আর যারা ছিল তারা ভূমিকম্প হবার সঙ্গে সঙ্গে নীচে নেমে গিয়েছিল—আমরা যে ঘুমোচ্ছি তা তারা জানত না। সুতরাং দোতলায় কেবল আমরা দু’জনেই রয়ে গিয়েছিলুম।

‘বুদ্ধিটা পরিষ্কার ছিল, আগেই বলেছি। তাই কি করতে হবে সে বিষয়ে সন্দেহ ছিল না। ঘর থেকে বার হয়ে ঠিক বাঁ-হাতে নীচে নামবার সিঁড়ি। সিঁড়ি দিয়ে নেমে কোনোমতে একবার খোলা জায়গায় পৌঁছুতে পারলেই নিরাপদ।

‘আমরা সিঁড়ি দিয়ে নামতে গেলুম; এক ধাপ নেমেও ছিলুম—এমন সময় মনে হল কে যেন পিছন থেকে আমাদের টেনে ধরল।

‘গিন্নীর চাবি বাঁধা অ্যাঁচলটা মাটিতে লুটোচ্ছিল, দেখলুম চাবির গোছা দরজার ফাঁকে আটকে গেছে। মুহূর্তের জন্য মনে হল—আজ আর রক্ষা নেই, স্বয়ং যম পিছনে থেকে টেনে ধরেছে!

‘কুকুরের ল্যাজ-কাটার উদাহরণটা তখন জানা ছিল না; তাছাড়া গিন্নী সে অবস্থাতেও বস্ত্র বর্জন করতে সম্মত হলেন না। ফিরে গেলাম। বাড়িখানা তখন কাঁপছে ঠিক ম্যালেরিয়া রুগীর মতো, হাড় পাঁজরা তার খসে খসে পড়ছে। ভূমিকম্পের বেগ এত বেড়ে গেছে যে মনে হচ্ছে এখনি সব ওলট-পালট হয়ে যাবে—মহাপ্রলয়ের আর দেরি নেই।

‘চাবিটা দরজা এবং চৌকাঠের ফাঁকে এমনভাবে আটকে গিয়েছিল যে ছাড়ানো দুষ্কর—তার ওপর গিন্নী একটি হাত চেপে ধরে আছেন। মাথার ওপর এক চাপ্‌ড়া প্ল্যাস্টার খসে পড়ল, তবু অ্যাঁচল ধরে টানাটানি করতে লাগলুম। তারপরেই দোরের খিলেন ভেঙে হাতের ওপর পড়ল। হাতটা ভাগ্যক্রমে ভাঙ্‌লো না, কেবল থেঁতলে গেল। তখন অ্যাঁচল ধরে প্রাণপণে মারলুম এক টান! অ্যাঁচলের খুঁট ছিঁড়ে গেল। চাবিটা দরজার ফাঁকেই আট্‌কে রইল।

‘আবার ছুটে গেলুম সিঁড়ি দিয়ে নামবার জন্য। কিন্তু নামা হল না। ঠিক সিঁড়িতে পা দিয়েছি এমন সময় সেই হাজার জাঁতা ঘুরানোর শব্দের ভেতর থেকে কে যেন প্রচণ্ড স্বরে বলে উঠল—‘ওদিকে যাস্‌নি’।’

এই পর্যন্ত বলিয়া বরদা থামিল, হাত দু’টা আগুনের দিকে প্রসারিত করিয়া দিল। দেখিলাম, তাহার রোমশ বাহুর উপর চুলগুলা কণ্টকিত হইয়া উঠিয়াছে।

বরদা আবার আরম্ভ করিল, ‘মতিভ্রম বলতে হয় বল, কিন্তু সে আজও এখনো আমার কানে বাজছে। মেঘের মতো আওয়াজ—ওদিকে যাস্‌নি! কে একথা বললে জানি না, তখন অনুসন্ধান করবারও সময় ছিল না—তবে এ হুকুম অমান্য করা যে উচিত হবে না, তা বুঝতে পারলুম।

‘কিন্তু যাব কোন্‌দিকে? এখানে থাকলে তো মৃত্যু নিশ্চিত। চারিদিকে দেওয়ালগুলো চোখের সামনে ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। ছাদটা ধ্বসে পড়ল বলে। সিঁড়ির ছাদ মুহুর্মুহুঃ হাঁ হয়ে আবার জোড়া লেগে যাচ্ছে।

‘আমাদের দোতলার ঘরগুলোর মাঝখানে একটা ছোট চৌকশ খোলা ছাদ আছে—সেইদিকে গিন্নীকে টেনে নিয়ে চললুম। গিন্নীর হাঁটু তখন জবাব দিয়েছে, তাঁকে একরকম বগলে করে নিয়েই ছুটলুম। ভাবলুম, যদি বাঁচতে হয় তবে ঐ খোলা ছাদটাই একমাত্র ভরসা।

‘খোলা জায়গায় এসে পৌঁছুতে একটা বিরাট হাসির শব্দ কানে ঢুক্‌লো—এটা এতক্ষণ শুনিনি। ঠিক যেন একটা পাগলা দৈত্য হা হা করে হাসছে আর শহরময় দাপাদাপি করে বেড়াচ্ছে। চেয়ে দেখলুম, আকাশ সুরকির লাল ধুলোয় ছেয়ে গেছে, আর তারই ভেতর দিয়ে বড় বড় বাড়িগুলো ঘাড় মুচ্‌কে ভেঙে ভেঙে পড়ছে।

‘বলতে অনেক সময় লাগে, কিন্তু মাত্র আড়াই মিনিটের তো ব্যাপার। তখন বোধ হয় দেড় মিনিট কেটেছে। আমি ছাদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি। গিন্নী আমার হাঁটু দুটো জড়িয়ে ধরে বসে পড়েছেন। চারিধারে এই প্রলয়ঙ্কর ব্যাপার চলছে। এই সময় ভূমিকম্পের বেগ বেশ একটু কমে এল—মনে হল বুঝি থেমে আসছে। কিন্তু সে সেকেন্ড দশেকের জন্যে। তারপর যা আরম্ভ হল তার বর্ণনা বোধ হয় হোমার কিংবা বাল্মীকিও দিতে পারতেন না।

তুফানের মাঝখানে ডিঙ্গির মতো পৃথিবী দুলতে লাগল। এতক্ষণ চারিদিকের দৃশ্য ঘোলাটে ভাব দেখতে পাচ্ছিলুম, এখন একটা গাঢ় লাল ধোঁয়ায় সমস্ত ঢাকা পড়ে গেল। কেবল চতুর্দিকে থেকে সেই পৈশাচিক হাসি আর বাড়ি ঘর ভেঙে পড়ার হুড়মুড় শব্দ শুনতে লাগলুম।

‘আমাদের বাড়িখানা আমার চারপাশে ভেঙে ভেঙে পড়ছে বুঝতে পারলুম কিন্তু চোখে দেখতে পেলুম না। প্রতি মুহূর্তে প্রতীক্ষা করতে লাগলুম, এইবার ছাদ ফাঁক হয়ে আমাদের গ্রাস করে নেবে, নয়তো পাশের একটা দেয়াল মাথার ওপর ভেঙে পড়বে।

‘মৃত্যুকে আজ তোমরা সকলেই মুখোমুখি দেখেছ, কিন্তু আমার মতো সজ্ঞানে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে তার জন্যে প্রতীক্ষা বোধ হয় কেউ করনি। মৃত্যু-দেবতার করাল মুখের পানে আমি একদৃষ্টে চেয়ে দেখেছি কিন্তু তবু আমার চোখের পলক পড়েনি—আজ সর্বস্ব হারানোর দিনে এইটুকুই আমার লাভ।

‘যাহোক, পৃথিবীতে সব জিনিসেরই যখন একটা শেষ আছে, তখন প্রাকৃতিক নিয়মে ভুমিকম্পও শেষ হতে বাধ্য। আড়াই মিনিটের প্রলয় মাতনের মতো ভূমিকম্প থামল।

‘ধুলোর অন্ধকার যখন একটু পরিষ্কার হল তখন দেখলুম বাড়ির চিহ্নমাত্র নেই—শুধু একটা থামের মাথায় একহাত চৌকশ জায়গার ওপর আমি আর আমার স্ত্রী দাঁড়িয়ে আছি—যেন স্তম্ভের মাথায় পাথরের দু’টি পুতুল! ব্যাপারটা বুঝেছ? সমস্ত বাড়ির মধ্যে কেবল ঐ থামটি দাঁড়িয়ে আছে, আর সব ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। আমরা যদি নীচে নামকুম তাহলে আর বেরুতে পারতুম না, জাঁতা-কলে ইঁদুরের মতো চাপা পড়ে থাকতুম।’

বরদা অনেকক্ষণ চুপ করিয়া রহিল; তারপর কতকটা নিজমনে বলিল, ‘কিন্তু কে সে—যে গর্জন করে আমাদের সাবধান করে দিলে? আমি শুধু তাই ভাবছি। আমাদের পরমায়ু ছিল তাই বেঁচে গেলুম একথা সত্যি। কিন্তু ‘ওদিকে যাস্‌নি’ বলে মানুষের গলায় হুঙ্কার দিয়ে উঠ্ল কে?*

২ ফাল্গুন, ১৩৪০

* এই গল্পের অধিকাংশ ঘটনাই সত্য ও লেখকের প্রত্যক্ষীকৃত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *