“মন্মনা ভব মদ্ভতো”
সন্ধ্যা হয়ে আসছে। দিনের পাখি এইবার ডানা মুড়ে রাতের কোলে বসতে চলেছে। গঙ্গার পশ্চিম আকাশে দিনের সাধনার হোমকুণ্ডের নির্বাপিত শেষ আভা। সৌম্য একটি নৌকার মন্থর কালো ছায়া ধীরে ধীরে ভেসে চলেছে উত্তর থেকে দক্ষিণে। সব কোলাহল ক্রমে স্তব্ধ হয়ে আসছে। একটি-দুটি আলোর বিন্দু লাফিয়ে উঠছে এখানে ওখানে। পুবের আকাশে দীপ-হাতে এসেছেন বৃহস্পতি। চিংচিং ছোট ঘণ্টার শব্দ। শিবমন্দিরে মহাদেবের আরতি শুরু হলো। মা ভবতারিণী সন্ধ্যার সাজে সাজছেন। রাসমণির মন্দিরপ্রাঙ্গণে ব্যস্ত কর্মচারিরা সেজ-হাতে আসা-যাওয়া করছেন। ঝাড়ের প্রদীপ একে একে জ্বলছে। দীপমালায় আরতি শুরু হবে ক্ষণপরেই।
দক্ষিণের বারান্দায় ফরাস আলো জ্বালা শেষ করে পশ্চিমের গোলবারান্দায় আলোটি জ্বেলে দিল। ঠাকুরের ঘরের প্রদীপটি জ্বালা হলো। ধুনুচির টিকেয় ফুঁ পড়ল। আগুনের হাসি। ধুনোর ধোঁয়া ধূমাবতীর এলোচুলের মতো উড়ছে।
দেওয়ালে দীর্ঘ হয়ে আছে উপবিষ্ট এক মহামানবের ছায়া। সেই ছায়া আজো আছে। যদিও সময় চলে গেছে শতাধিক বর্ষ অতীতে। ছায়ার নশ্বর কায়াটি লীন হয়ে গেছে মহাকালের মহানিলয়ে। তবু ভক্ত যদি ভক্তির ভাবে ধ্যানস্থ হয়ে থাকেন কিছুক্ষণ, ছায়া আবার কায়া হবে। সময় আবার ফিরে আসবে। ফিরে আসবেন সব চরিত্র, ধ্বনি, দীপের আলো, আলুলায়িত ধুনোর ধোঁয়া।
ঐ তো খাটো ধুতি-পরা ফরাস দক্ষিণের দীর্ঘ সোপানশ্রেণী বেয়ে নেমে চলেছে রাধাগোবিন্দের মন্দিরের দিকে। সেরেস্তার দিক থেকে আসছেন হৃদয়। হাজরামশাই পুজোয় বসেছেন।
দীপের শিখা মৃদুমৃদু কাঁপছে। আসনে সোনার বরণ এক সাধক। দৃষ্টি অর্ধনিমিলিত, নাসিকাগ্রে নিবিষ্ট। মৃদুস্বরে মায়ের নাম করছেন, মাতৃচিন্তায় বিভোর। অদূরে স্থাণু হয়ে আছেন আরো কয়েকটি মূর্তি—মাস্টারমশাই, প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় ও তাঁর আত্মীয় যুবক হরি। একপাশে আমিও নাহয় বসলাম।
কালের ছবি মহাকালে ভেসে গেলেও মনের ছবির কালাকাল নেই।
ঠাকুর এই মুহূর্তেই মুখ তুলে তাকালেন। আলো দেখলেন। অনুমান করে নিলেন, ভবতারিণীর মন্দিরে আরতির এখনো কিছু বিলম্ব আছে। ভক্তদের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন। আমার মনে হচ্ছে, আসনে বসে আছেন শীতল এক মহাদেব। মাস্টারমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন : “যে নিশিদিন তাঁর চিন্তা করছে, তার সন্ধ্যার কি দরকার!”
বাতাসে যেন বাঁশির সুর-
“ত্রিসন্ধ্যা যে বলে কালী, পূজা-সন্ধ্যা সে কি চায়।
সন্ধ্যা তার সন্ধানে ফেরে, কভু সন্ধি নাহি পায়।।
দয়া ব্রত, দান আদি আর কিছু না মনে লয়।
মদনেরই যাগযজ্ঞ ব্রহ্মময়ীর রাঙা পায়।।”
সেই সঙ্গীতে ধুনোর ধোঁয়া পর্যন্ত থমকে গেছে। গঙ্গার অবিরল স্রোতোধারা সেই সঙ্গীতে নিস্তরঙ্গ হয়েছে। গান শেষ করে অল্পক্ষণ ভাবস্থ রইলেন ঠাকুর। ঘর এতটাই নিস্তব্ধ যে, গঙ্গার স্রোতোধারার শব্দ কানে আসছে। কানে আসছে ধুনুচিতে টিকে পোড়ার পুটপুট শব্দ। বাতাসে আগুনের আভা বাড়ছে কমছে। ঘরে যাঁরা বসে আছেন তাঁরা যেন ভাবসমুদ্রের গভীরে ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছেন। ঠাকুর বলছেন : “সন্ধ্যা গায়ত্রীতে লয় হয়, গায়ত্রী ওঁকারে লয় হয়।”
উত্তরণের কথা, সাধকের ক্রমপ্রবেশের কথা। এগিয়ে যাও কাঠুরে। প্রয়াস। একটি আরেকটিতে মিশে যাবে। সন্ধ্যা নিয়ে এগোও, গায়ত্রীকে পাবে। তিনি হাত ধরে ওঁকারে তুলে দেবেন।
ঠাকুর পরক্ষণেই বলছেন : “একবার ওঁ বললে যখন সমাধি হয়, তখন পাকা।”[১]
[১. কথামৃত, উদ্বোধন সং, ১৯৮৬, পৃঃ ৭২৫]
নিমেষে এঘর থেকে ওঘর। প্রণবের এক ঝঙ্কারে আরোহণ। তখন পথ খুলে গেছে। সংসারের অভ্যাসে মরচে-ধরা তালায় তেল পড়েছে। অবিচ্ছিন্ন তৈলধারার মতো ধ্যানে, নিবাত নিষ্কম্প দীপশিখার মতো অচঞ্চল মনে একটিমাত্র অনুরণনে মহাসংযোগ।
এ তো মুণ্ডক উপনিষদ্-এর তত্ত্ব। একালের উন্নাসিক বুদ্ধিজীবীরা ঠাকুর সম্পর্কে কোন প্রসঙ্গ করার সময় অবশ্যই একটি গৌরচন্দ্রিকা করবেন— ‘কামারপুকুরের সেই নিরক্ষর ব্রাহ্মণ’, যা শুনলে গাত্রদাহ হয়। ঠাকুর কি জ্ঞানী? জ্ঞান তো অতি নিচের তলার অবস্থা। ঠাকুর যে বিজ্ঞানী। টমাস আ কেম্পিস তাঁর ‘দ্য ইমিটেশন অফ ক্রাইস্ট’-এ সারকথাটি বলেছেন, যা আমাদের ঠাকুর সম্পর্কে প্রযোজ্য—”How happy a man is when the Truth teaches him directly, not through symbols and words that are soon forgotten, but by contact with itself.” কেম্পিস আরো বলছেন : “As a man grows in inward unity and simplicity, he finds that more and more deep truths are made plain to him without any effort, because a heaven-sent light brings him understanding.”
কলেজে পড়া বিপুল শিক্ষিতদের বৃথা অহঙ্কার ঠাকুর নিমেষে চূর্ণ করে দিতেন তাদের মঙ্গলের জন্যই। শ্রীম-র কলেজী জ্ঞানের অহঙ্কার দর্শনের দ্বিতীয় দিনেই চুরমার করে দিয়েছিলেন। প্রশ্ন করলেন : “তোমার পরিবার কেমন? বিদ্যাশক্তি না অবিদ্যাশক্তি?”
মাস্টারমশাই বললেন : “আজ্ঞা ভাল, কিন্তু অজ্ঞান।
ঠাকুর অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বললেন : “আর তুমি জ্ঞানী?”
মাস্টারমশাই ধন্দে পড়ে গেলেন—”তিনি (নিজে) জ্ঞান কাহাকে বলে, অজ্ঞান কাহাকে বলে, এখনো জানেন না। এখনো পর্যন্ত জানিতেন যে, লেখাপড়া শিখিলে ও বই পড়িতে পারিলে জ্ঞান হয়। এই ভ্রম পরে দূর হইয়াছিল। তখন শুনিলেন যে, ঈশ্বরকে জানার নাম জ্ঞান, ঈশ্বরকে না জানার নামই অজ্ঞান। ঠাকুর বলিলেন, ‘তুমি কি জ্ঞানী!’ মাস্টারের অহঙ্কারে আবার আঘাত লাগিল।”
এই যে সত্য, যার অপর নাম বিশেষ জ্ঞান, তা যুগে যুগে সব দেশের সব মানুষের কাছেই সত্য। সূর্য স্পেনেও সূর্য, ঘুঘুডাঙাতেও সূর্য! দ্যাট ওয়ান ওয়ার্ড—ওঁ! কেম্পিস তা নাহলে কেমন করে ঠাকুরের কথারই প্রতিধ্বনি করেন : “If the eternal Word speaks to a man he is delivered from many conjectures. That one Word is the source of all things and all things speak of that Word. That Word is the Beginning, and that Word speaks to us.”
ঠাকুর বসে আছেন তাঁর ছোট্ট তক্তপোশে। ভক্তদের বোঝাচ্ছেন : “সন্ধ্যা গায়ত্রীতে লয় হয়, গায়ত্রী ওঁকারে লয় হয়।”
এ তো সেই উপনিষদের দর্শন, অনুভূতি, সত্য, পথ, লয়, বিলয়—
“প্রণবো ধনুঃ শরো হ্যাত্মা ব্রহ্ম তল্লক্ষ্যমুচ্যতে।
অপ্রমত্তেন বেদ্ধব্যং শরবত্তন্ময়ো ভবেৎ।।” (মুণ্ডক উপনিষদ্, ২।214) —ওঙ্কারই ধনু, জীবাত্মাই বাণ এবং ব্রহ্ম উক্ত বাণের লক্ষ্য। অপ্রমত্ত হয়ে সেই লক্ষ্যকে ভেদ করতে হবে। লক্ষ্যভেদের পর শরের মতোই তন্ময় হবে অর্থাৎ ব্রহ্মের সঙ্গে একীভূত হবে। ব্রহ্মের অনুভূতি, ব্রাহ্মীস্থিতি হলে কি হবে! দুটো শিং বেরবে কি! না। দুটো নতুন চোখ হবে—প্রেমের চোখ, একটা নতুন হৃদয় হবে—প্রেমের হৃদয়, একটা নতুন শরীর হবে—আনন্দের শরীর। বিশ্বের সঙ্গে যোগ হবে। ভেঙে মোর ঘরের চাবি, অনন্ত আমাকে ছোঁ মেরে নিয়ে যাবে উদার মুক্তিতে। তখন আমি বুঝতে পারব, আনন্দই ব্রহ্ম, ব্ৰহ্মই আনন্দ।
তখন রবীন্দ্রনাথ—
“আনন্দধারা বহিছে ভুবনে,
দিনরজনী কত অমৃতরস উথলি যায় অনন্তগগনে।।”
ঠাকুর উদাহরণ দিচ্ছেন ভক্তদের : “হৃষীকেশে একজন সাধু সকালবেলায় উঠে ভারী একটা ঝরনা তার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। সমস্ত দিন সেই ঝরনা দেখে আর ঈশ্বরকে বলে—’বাঃ বেশ করেছ! বাঃ বেশ করেছ! কি আশ্চর্য!’ তার অন্য জপতপ নাই। আবার রাত্রি হলে কুটিরে ফিরে যায়।”[২]
[২. কথামৃত, উদ্বোধন সং, ১৯৮৬, পৃঃ ৭২৫]
ঠাকুর এইবার উপনিষদের জগৎ থেকে ভক্তির ঘরে ফিরছেন। সেখানে যোগ নেই, আছে ভক্তির অশ্রুজল। তোমাদের একটা কথা বলি : “তিনি নিরাকার কি সাকার সেসব কথা ভাববারই বা কি দরকার? নির্জনে গোপনে ব্যাকুল হয়ে কেঁদে কেঁদে তাঁকে বললেই হয়—হে ঈশ্বর, তুমি যে কেমন, তাই আমায় দেখা দাও!”
ভক্তি এলে বিশ্বাস আসবে, বিশ্বাস এলে ভক্তি আসবে। এ এক অদ্ভুত বৃত্ত! অতীত থেকে একটি সুন্দর কথা চয়ন করি—”In faith Columbus found a path across untried waters.” কথাটি মার্টিন ফারকুহার টাপারের।
সেই বিশ্বাসকে আজ সন্ধ্যায় জোরদার করতে চাইছেন ঠাকুর। কারণ, “Faith lights us through the dark to deity.” ঠাকুর বলছেন : “তিনি অন্তরে বাহিরে আছেন।”
সে কেমন? বাতাসের মতো! নাকি জলে বসানো পাত্রের মতো। বাইরেও জল ভিতরেও জল। ভক্তি ও বেদান্ত মিশিয়ে ঠাকুর অনবদ্য এক ব্যাখ্যা দিচ্ছেন : “অন্তরে তিনিই আছেন। তাই বেদে বলে ‘তত্ত্বমসি’ (সেই তুমি)। আর বাহিরেও তিনি। মায়াতে দেখাচ্ছে, নানা রূপ; কিন্তু বস্তুত তিনিই রয়েছেন।”[৪]
[৪. কথামৃত, উদ্বোধন সং, ১৯৮৬, পৃঃ ৭২৬]
কিরকম জান! ঠাকুর তাঁর নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার কথা বলছেন :
“একটি বেদান্তবাদী সাধু এসেছিল। মেঘ দেখে নাচত, ঝড়বৃষ্টিতে খুব আনন্দ। ধ্যানের সময় কেউ কাছে গেলে বড় চটে যেত। আমি একদিন গিছলুম। যাওয়াতে ভারী বিরক্ত। সর্বদাই বিচার করত, ‘ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা’। মায়াতে নানারূপ দেখাচ্ছে, তাই ঝাড়ের কলম লয়ে বেড়াত। ঝাড়ের কলম দিয়ে দেখলে নানা রঙ দেখা যায়—বস্তুত কোন রঙ নাই। তেমনি বস্তুত ব্রহ্ম বই আর কিছু নাই, কিন্তু মায়াতে, অহঙ্কারেতে নানা বস্তু দেখাচ্ছে।”[৫]
“তাই সব নাম রূপ বর্ণনা করবার আগে, বলতে হয় ওঁ তৎ সৎ।”[৬]
[৫. ঐ, পৃঃ ৩২৬-৩২৭
৬. ঐ, পৃঃ ৭২৬ ৭ ঐ]
ঠাকুর এইবার কঠিন ছেড়ে সহজে আসছেন। মায়াকে নাহয় সত্যই ধরলাম, কিন্তু সেই মায়া থেকে আমাকে ব্রহ্মে যেতেই হবে। সেইটাই জীবের শেষ আকাঙ্ক্ষা হওয়া উচিত। তা নাহলে আমি মারের পর মার খাব। সংসার আমাকে খাবলে খুবলে শেষ করে দেবে। ঘরে যাঁরা বসে আছেন, সকলেই পড়াশোনা- করা যুবক। ঠাকুর জানেন সে-কথা; আবার এও জানেন, কলকাতার লোক তর্ক করতে ভালবাসে। মৃদু হেসে সকলের দিকে তাকিয়ে বলছেন : “দর্শন করলে একরকম, শাস্ত্র পড়ে আরেক রকম। শাস্ত্রে আভাস মাত্র পাওয়া যায়। তাই কতকগুলো শাস্ত্র পড়বার কোন প্রয়োজন নাই। তার চেয়ে নির্জনে তাঁকে ডাকা ভাল।”
কি কি চাই! পাহাড়ে উঠতে গেলে সাজসরঞ্জাম চাই। সমুদ্র পাড়ি দিতে হলে জাহাজ চাই। শুধু জাহাজে হবে না, সামুদ্রিক ম্যাপ চাই, কম্পাস চাই। সত্যস্বরূপ ঈশ্বরকে পেতে হলে কিচ্ছু চাই না, চাই ব্যাকুলতা। ব্যাকুলতা না এলে কিছুই হয় না। ব্যাকুলতা আসবে কি করে! সাধুসঙ্গে। সাধুসঙ্গ করতে করতে ঈশ্বরের জন্য প্রাণ ব্যাকুল হয়। যেমন বাড়িতে কারো অসুখ হলে সর্বদাই মন ব্যাকুল হয়ে থাকে—কিসে রোগী ভাল হয়। আবার কারো যদি কর্ম যায়, সে-ব্যক্তি যেমন অফিসে অফিসে ঘুরে বেড়ায়, ব্যাকুল হতে হয়— সেইরূপ। যদি কোন অফিসে বলে—কর্ম খালি নেই, আবার তার পরদিন এসে জিজ্ঞাসা করে—আজ কি কর্ম খালি হয়েছে?
আরেকটি উপায় আছে-ব্যাকুল হয়ে প্রার্থনা।
“I do not ask for any crown
But that which all may win;
Nor try to conquer any world
Except the one within.
Be thy my guide until I find
Led by a tender hand.
The happy kingdom in myself
And dare to take command.” [Louisa May Alcott]
ডাকতে হবে। আঁকুপাঁকু করে ডাকতে হবে। ভিতরে যেন গামছা নিংড়ায়।
কী সুন্দরভাবে ঠাকুর বলছেন : “তিনি যে আপনার লোক, তাঁকে বলতে হয়—তুমি কেমন, দেখা দাও। দেখা দিতেই হবে—তুমি আমাকে সৃষ্টি করেছ কেন? শিখরা বলেছিল, ‘ঈশ্বর দয়াময়’; আমি তাঁদের বলেছিলাম, দয়াময় কেন বলব? তিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে আমাদের মঙ্গল হয় তা যদি করেন সে কি আর আশ্চর্য! মা-বাপ ছেলেকে পালন করবে, সে আবার দয়া কি? সে তো করতেই হবে, তাই তাঁকে জোর করে প্রার্থনা করতে হয়। তিনি যে আপনার মা, আপনার বাপ! ছেলে যদি খাওয়া ত্যাগ করে, বাপ-মা তিন বৎসর আগেই হিস্যা ফেলে দেয়। আবার যখন ছেলে পয়সা চায়, আর পুনঃপুনঃ বলে, ‘মা, তোর দুটি পায়ে পড়ি, আমাকে দুটি পয়সা দে,’ তখন মা ব্যাজার হয়ে তার ব্যাকুলতা দেখে পয়সা ফেলে দেয়।”[৮]
[৮. কথামৃত, উদ্বোধন সং, ১৯৮৬, পৃঃ ৩৮]
তৃতীয় পথ, তৃতীয় অস্ত্র কি? সাধুসঙ্গ। তাঁর দিকে যেতে হলে, তাঁকে পেতে হলে অস্ত্র-শস্ত্র বিশেষ কিছুরই প্রয়োজন নেই; কিন্তু ভয়ঙ্কর তিনটি সূক্ষ্ম অস্ত্রের প্রয়োজন, সেই অস্ত্রের অস্ত্রাগার আমাদের অন্তরেই আছে। প্রকোষ্ঠটির নাম ইচ্ছা। সেই ইচ্ছার লৌহকপাট কে খুলবে! নিজেকেই খুলতে হবে। চাবি যার যার নিজের কাছেই আছে। সমস্যা একটাই, ইচ্ছার দিকে ইচ্ছাই যেতে দেবে না। ইচ্ছাই করবে না ইচ্ছা করতে। পারস্যের সুফি কবি রুমি যা বলেছেন : “You are the unconditioned spirit trapped in conditions, like the Sun in eclipse.”
কেম্পিস বলছেন : “We must lay the axe to the root of the Tree. So that we may be cleansed from our passions and possess a mind at peace.” তিনি আরো বলছেন : “If we were utterly dead to self, and if our hearts were stripped of encumbrance, then we could get a glimpse of the things of God, and experience something of heavenly contemplation.”
রাজা যেখানে যায়, রাজছত্রটিও সেখানে যায়। আদর্শ বাইরে না-ই বা রইল, নিজেকে আদর্শ করে তোলাই তো মূলকথা। আমার ছাতার তলায় আমি আছি। কলের মুখে ফিল্টার লাগাই পরিশ্রুত জল পাব বলে। মনেও তেমনি সদসৎ বিচারের ফিল্টার লাগাই। পাব কোথায়? সাধুসঙ্গ।
ঠাকুর বলছেন : “সাধুসঙ্গ করলে আরেকটি উপকার হয়। সদসৎ বিচার। সৎ—নিত্য পদার্থ অর্থাৎ ঈশ্বর। অসৎ অর্থাৎ অনিত্য। অসৎ পথে মন গেলেই বিচার করতে হয়। হাতি পরের কলাগাছ খেতে শুঁড় বাড়ালে সেইসময় মাহুত ডাঙশ মারে।”
জেনে রাখ—”তাঁর জগতে সকল রকম আছে। সাধু লোকও তিনি করেছেন, দুষ্ট লোকও তিনি করেছেন, সদ্ধি তিনিই দেন, অসদ্বদ্ধিও তিনিই দেন।”[৯]
[৯. কথামৃত, উদ্বোধন সং, ১৯৮৬, পৃঃ ৩৮]
“Help yourself and Heaven will help you.
Everyone should sweep before his own door.”
এইবার মা ভবতারিণীর মন্দিরে শুরু হবে আরতি। বাইরে অন্ধকার আরো ঘন হয়েছে। পঞ্চবটী, বেলতলা আঁধারে রহস্যময় হয়েছে। গঙ্গার জল আর দেখা যাচ্ছে না, শুধু স্রোতের শব্দ। দূরে কার উদাত্ত আহ্বান—মা!
ঠাকুর উঠছেন, উঠতে উঠতে বলছেন : “গীতা সমস্ত না পড়লেও হয়। দশবার গীতা গীতা বললে যা হয় তাই গীতার সার। অর্থাৎ ‘ত্যাগী’। হে জীব, সব ত্যাগ করে ঈশ্বরের আরাধনা কর—এই গীতার সার কথা।[১০]
[১০. ঐ, পূঃ ৭২৬]
“মন্মনা ভব মদ্ভক্তো মদ্যাজী মাং নমস্কুরু।
মামেবৈষ্যসি সত্যং তে প্রতিজানে প্ৰিয়োঽসি মে।।” (গীতা, ১৮।৬৫)
-–আমাতে হৃদয় অর্পণ কর, আমার ভক্ত হও, আমার পূজনশীল হও, আমাকেই নমস্কার কর। আমি সত্য প্রতিজ্ঞা করে বলছি, তাহলে তুমি আমাকেই পাবে, কেননা তুমি আমার প্রিয়।
উঠানের পথ ধরে ভক্তদের সঙ্গে নিয়ে ঠাকুর চলেছেন মন্দিরে। আরতি দর্শন করবেন। ধাপে ধাপে উঠছেন। শঙ্খ-ঘণ্টা-বাদ্য-বাজনার ঐকতান। পঞ্চপ্রদীপ মহাদেবের মতো মায়ের সামনে ঘুরে ঘুরে নৃত্য করছে। ধূপ আর ধুনোর সৌরভ। মায়ের সামনে জোড়হস্তে ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ। সাপের ফণার মতো ঈষৎ দুলছেন। সুরা নয়, সুধা। মাতাল হয়েছেন। ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম আর সম্ভব নয়। ভক্তদের ওপর দেহভার রেখে নামছেন। কোথায় পা পড়ছে দিশা নেই। যেন বলছেন—তোমার বিশ্বাসের পাথরটি যেন এত ভারী হয় যে, তুমি শ্রদ্ধার সমুদ্রে একেবারে তলিয়ে যাও।
ঐ যে চলে যাচ্ছেন তিনি সপার্ষদ নিজের ছোট্ট ঘরটির দিকে। কে বলেছে তিনি নেই। এই টালমাটালের বিপন্ন সময়ে তিনি আরো নিবিড় হয়ে আছেন—
“মন্মনা ভব মদ্ভক্তো মদ্যাজী মাং নমস্কুরু।”