মনের মতো পাগল পেলাম না
পাগল বলতে আমরা কি বুঝি? পাগল তো শ্রদ্ধেয় কিছু চরিত্র নয়, কিন্তু না—ঠাকুর রামকৃষ্ণ বলতেন, যে, যাঁরা তাঁর দিকে এগোন তাঁরা একটু পাগলাটেই হন, তাঁদের কোনকিছুর আকঢাক থাকে না তার কারণ তাঁরা কিছু নিজের করে জড়িয়ে ধরতে চান না, জড়িয়ে ধরতে পারেন না। তার কারণ, এই নশ্বর সংসারের সমস্ত জিনিস এতই তুচ্ছ যে এই নিয়ে নাড়াচাড়া করা মানে মনে হয় যেন একটা বাচ্চা মেয়ে, অবোধ মেয়ে পুতুল খেলা খেলছে। তা এই বোধটি জাগিয়ে দেবার জন্যে সমস্ত সাধকই তিনটে জিনিসের ওপর খুব জোর দিয়েছেন। বেশি জোর দিয়েছেন বাউল সন্ন্যাসীরা।
বাউল মানে কে? যাঁরা জীবনের সঙ্গে খুব গভীরভাবে জড়িয়ে আছেন। যেমন আমরা আজকে তো এত সাহিত্য করি সংস্কৃতি করি, গান গাই। কিন্তু লালন কে হতে পেরেছে? যদি কেউ প্রকৃত কিছু রচনা করে থাকেন, তাহলে লালন ফকিরের মতো ফকির। তার কারণ হচ্ছে যে তিনি আমাদের জনজীবনের আর্তি আর বেদনার কথা এত সহজ করে বলতে পেরেছেন যা আমরা কেউ কোনদিন পারব না। তার কারণ আমরা যখনই কথা বলি তখনই একটা অহঙ্কারের ভাব আসে। আমি বক্তা, আপনারা শ্রোতা, আমি লেখক, আপনারা পাঠক। তা এই অহঙ্কার বস্তুটাই কিন্তু আমাদের সত্যবস্তু থেকে সরিয়ে রাখে। সেইজন্য সমস্ত সাধকের একটি কথা—আগে অহঙ্কারের পর্দাটিকে সরাও, অহঙ্কারকে না সরানোর ফলে সৎকামী মানুষ তাদের দেখতে পাবে না এবং তাদের যদি আমি দেখতে না পাই তাহলে আমি নিজেকেও দেখতে পাব না। তার কারণ হচ্ছে মানুষই মানুষের দর্পণ, সেই কারণে সমস্ত বাউল তিনটি জিনিসের ওপর জোর দিয়েছেন। একটি জিনিস তাঁরা বলেছেন যে, সবসময় মনে রাখবে যে তোমার এই নশ্বর ইন্দ্রিয়ের খাঁচাটি একদিন ভেঙে যাবে, আর ভেঙে গেলে কি হবে? না এর ভেতর যে প্রাণপাখিটি বসে এই জনমভোর কিচির মিচির করে গেল এটি উড়ে চলে যাবে। তো সেটি উড়ে চলে গিয়ে কোথায় যাবে? সে তো জানিনা—পাখি এমনি করেই আসে আর এমনি করেই উড়ে যায় তা এই যে পাখি—অচিন পাখি-এ কমনে আসে কমনে যায় এ আমরা জানি না। তা এর আশ্রয়ই হচ্ছে, এই নরদেহ, এই খাঁচা এবং এই খাঁচাটি কিসের তৈরি? না, রিপু আর ইন্দ্রিয়। তা এই যে ইন্দ্রিয় আর রিপু এটা কি করছে? পাখি বসে আছে ঠিকই, সে করছে কি, চালনা করছে। অষ্টপাশে বন্ধন করে ফেলেছে, লোভ-মোহ-মদ-মাৎসর্য ইত্যাদি দিয়ে। এটা আমার, ওটা তোমার, ওটা আমার এইটা আমার এই করে সে সারাটা জীবন শুধু কচর মচ করে যাচ্ছে। ইন্দ্রিয়ের কিচির মিচির। তার ফলে সেই প্রাণপাখি যে সেই বিশ্বস্রষ্টার গুণগান করছে তার কথাটি কিন্তু সে শুনতে পাচ্ছে না। সেই কারণে ঠাকুর বলছেন, মনে রেখো মৃত্যু-স্মরণ হও। তুমি আজ আছ কাল নেই, তাই মৃত্যু স্মরণ হলে কি হবে? মৃত্যু একটা মস্ত বড় ভয়। হে মৃত্যু, তুমি আমাকে সরিয়ে নিও না এই ভোগের জগৎ থেকে, তাহলে আমার অনেক আশা অপূর্ণ থেকে যাবে। দেহ দিয়ে আমি বহু কিছু ভোগ করতে চাই। আবার এই ভয় যে, আমি আছি, সব আছে কিন্তু আমার লিভার নেই। পিলে বড় হয়ে গেছে। তাহলেও চলবে না, যেমন আমি একজন বড়লোককে জানতাম তিনি পাঁচজনকে ডেকে এনে খুব খাওয়াতেন আর নিজে বার্লি খেতেন। তা আমি জিজ্ঞেস করলাম, এই অবস্থা হলো কেন? বললেন, ভাইরে, আমার লিভার গেছে, পিলে গেছে, গলব্লাডার গেছে—সব গেছে, খোলটা আছে। তোমরা খাও আমি দেখি আর দীর্ঘশ্বাস ফেলি। আমি বললাম, আপনার এই বেঁচে থাকার কি অর্থ? বললেন, এই তোমরা খাও আমি দেখি। তা ঐ ভয়, ঐ ভয় যে, সময় আমার ওপরে হাত বুলিয়ে যাচ্ছে। যে যন্ত্র নিয়ে আমি জন্মেছিলাম ছেলেবেলায়, একেবারে যেন প্যাকেট খোলা হলো—যেমন বলে না, সিল খুলে ট্রানজিস্টর রেডিও বেরল, সব পার্টস নতুন ঝকঝক করছে। তারপরে চানাচুর খেলুম, আলুকাবলি খেলুম, ফুচকা খেলুম, ধীরে ধীরে আমার যন্ত্রপাতি সমস্ত বিকল হতে লাগল, সার্জেন যেটুকু পারলেন কেটে ছেঁটে সেলাই জোড়াই করে দিলেন কিন্তু বললেন, দেখ বাপু, তুমি পুরনো হচ্ছ, তোমার যন্ত্রপাতিও পুরনো হচ্ছে নতুন তো হবে না বাপু। তখন একটা সমঝোতায় আসতে হয়। কিছু কিছু মানুষ আছেন সকালবেলা প্রবলবেগে ভ্রমণ করছেন, কেউ হাফ-প্যান্ট পরে দৌড়চ্ছেন, কেউ ডন বৈঠক করছেন, কেউ বারবেল ভাঁজছেন। কি ব্যাপার মশাই, এরকম করছেন কেন? জনসেবা করবেন বুঝি মানবহিতের জন্য? বললেন, না মানবহিত নয়, আমি একটু বেশি বাঁচতে চাই। আবার যে যত বড়লোক সে বেশি বাঁচতে চায় কারণ তার ভোগ বেশি। সমস্ত মানুষেরই একটা ভয়—মৃত্যু আসছে। আর এই পঞ্চাশ বছর বয়সের পর থেকে মৃত্যুভয়টা ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করে। আবার মৃত্যুভয়ের সঙ্গে একালে যোগ হয়েছে মৃত্যুরও বাছবিচার। কেউ কেউ ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেন, হে ভগবান থ্রম্বোসিস-এ নাও যেন এক ধাক্কায় চলে যাই, ক্যান্সার দিও না তাহলে তিন মাস বিছানায় পড়ে চ্যাঁ চ্যা করতে হবে। মৃত্যুরও দেখা যাচ্ছে নানারকম আছে। আর শমন থেকে নিষ্কৃতি পাবার উপায় কি! না মৃত্যুকে উত্তীর্ণ হতে হবে। মৃত্যু থেকে কে আমাকে রক্ষা করবেন? না, মা কালী, তারা, শক্তি। আমি তাঁকে ধরি, আমি তাঁর হাত ধরে আছি। আচ্ছা এইবার যদি মৃত্যু আসে যন্ত্রণা আসে তাহলে আমার কি হবে? আমার কিছুই হবে না। ঠাকুর বলতেন যে, বাঁদরের ছানা সে তার মাকে আঁকড়ে ধরে থাকে। সেইজন্য তার ভয় যদি হাত খুলে যায়। তাই আমার হাতটি তুমি ধর তাহলে তো আমার ভয় নেই কারণ তাঁকে ধরিয়ে দিয়েছি আর তো আমার কিছু করার নেই। তিনি আমাকে আলের পথে, খালের পথে যেখান দিয়েই নিয়ে যান আমি জানি তিনি আমার হাত ধরে আছেন। তিনি তো আমাকে ফেলবেন না। সেইজন্য ঠাকুর বলছেন, হবি তো বেড়ালের ছানাই হ, কারণ বেড়ালের মা করে কি? তাকে নড়া ধরে কখনো খাটে শোয়াচ্ছে কখনো প্যাকিং বাক্সে রাখছে, কখনো রকে ফেলছে। যেখানে মা নিয়ে যাচ্ছে সেইখানেই পড়ে মিউ মিউ করছে। সেই কারণেই বলছেন যে তুমি তোমার হাতটি তাঁকে ধরিয়ে দাও। আবার সমস্ত বাউলের কথা হচ্ছে যে সেই প্রাণপুরুষকে সেই মহাপুরুষকে সেই তোমার স্রষ্টার কাছে তুমি নিজেকে নিবেদন কর তারপরে দেখ না কি হয়। একজন মহাপুরুষের কাছে গিয়ে আমি আমার কোষ্ঠীর ছক ফেলে বললাম, স্বভাবতই গৃহী মানুষ, ভীষণ ভয়। তার কারণ হচ্ছে, আপনি জানবেন যে আমাদের সবচেয়ে বড় ভয়, হারানোর ভয়। কি হারানোর ভয়? না, বেশ একটা বাড়ি আছে, একটা জীবিকা, আছে মাস গেলে একটা মাইনে। এগুলো যদি চলে যায় তাহলে কি হবে! আমেরিকায় একজন ধনকুবের কোটিপতি, তিনি সাততলা থেকে লাফিয়ে পড়লেন। পকেট থেকে একটা চিরকুট বেরল। কি ব্যাপার! না আমার সকালবেলা মনে হলো যদি গরিব হয়ে যাই তাই আত্মহত্যা করলাম। গরিব হয়ে যাবার ভয়ে আত্মহত্যা করলেন। ঐজন্য বাউলরা বলছেন যে, সব ছাড় তবে সব পাবে, সব ছাড়। কি ছাড়? এই ঐহিক, জাগতিক যাকিছু আছে সব ছেড়ে দাও। একটা কথা বলি সময় খুব কম আর জানেন তো, কথার একটা নেশা আছে। “হরতি নিমেষাৎ কালঃ সর্বং।” কাল আমাদের ওপর দিয়ে ক্রীড়া করে যাচ্ছে, ক্ষণকালের ওপর দিয়ে মহাকাল চলে যাচ্ছে। সেই কারণে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন যে, এই মহাবিশ্বে মহাজীবন থেকে একটি একটি করে পাতা খসে পড়ে যাচ্ছে, আবার তিনি প্রশ্ন করছেন আমরা জন্মেছি কি শুধু মরার জন্য, আমি কি আমার জীবনকে মৃত্যুর পায়ে উৎসর্গ করে দিয়ে যাব? না, তাঁর শেষ উত্তর আছে আমাদের ভারতের আধ্যাত্মিকতায়। আজকে একটা কথা খুব বড় করে শোনা যাচ্ছে, কে মৌলবাদী আর কে অমৌলবাদী। যাঁরা ইন্টেলেকচুয়াল তাঁরা এখন এইরকম কথা বলেন, আপনি তো মৌলবাদী, আপনি নিশ্চয়ই সতীদাহ সমর্থন করেন? মৌলবাদ জিনিসটা কি? মৌলবাদ মানে মন্দির মসজিদ নয়। মৌলবাদ হচ্ছে আমি মৌলিক কোন সত্তা থেকে উদ্ভূত হয়েছি এবং সেই সত্তাটিকে স্বরূপে রাখা। হিন্দুধর্ম কি? হিন্দুধর্ম হচ্ছে তিনটি জিনিসকে স্মরণে রাখা। আমি এসেছি, আমি চলে যাব। আমি কোথা থেকে এসেছি কোথায় চলে যাব। এই প্রশ্ন। আমি কোথা থেকে এসেছি কোথায় চলে যাব এইটাই হচ্ছে মস্তবড় দর্শনের উদ্ভবভূমি। পৃথিবীর সমস্ত প্রান্তের মানুষ, সে হিন্দুই হোক, মুসলমান হোক, যেই হোক তার কাছে এই প্রশ্ন যে আমি কেন এসেছি কি করতে এসেছি, কোথায় চলে যাব? এই প্রশ্নের থেকেই ধর্মের উদ্ভব অর্থাৎ আমি এসেছি কোন্ জায়গা থেকে। আমি মাঝে মাঝে বসে বসে ভাবি যে, যদি অদ্ভুত কোন একটা এ্যাক্সিডেন্ট থেকেই মানুষ আর এই জীবজগৎ তৈরি হয়ে থাকে তাহলে আপনারা ভেবে দেখুন, একটা গরু, একটা ছাগল, একটা বেড়াল, একটা বাঘ, একটা কুকুর, চারটে পা, সারা গায়ে লোম, কারোর লোম আছে, কারোর লোম নেই। আচ্ছা মানুষ কেন এমন বিচিত্র হলো? আমি বসে বসে ভাবি মানুষের কোথাও চুল নেই কিন্তু মাথাতে কি দরকার ছিল, মাথার তালুতে, এমন সুন্দর এক খামচা চুল করে দেবার? আবার ঠোঁটের ওপর একটু সরু গোঁফ হয়ে গেল। কেন বাঘের মতো হলো না? সারা গায়ে লোম বনমানুষের মতো? আমাদের সৃষ্টির একটা প্যাটার্ন আছে। হিসেব আছে। উদ্দেশ্য আছে। পরিকল্পনা আছে।
Chance combination of Atom, Hydrogen and Carbon আজকালের যারা অমৌলবাদী, যাঁরা নাস্তিক তাঁরা তো বলছেন ভগবান-টগবান কিছু নেই, সৃষ্টি হয়েছিল এইভাবে-হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন, কার্বন এই তিনটে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, প্রচণ্ড উত্তাপে তিনটি কাছাকাছি এল ধুপ করে। একটা বাঘ হলো, বনমানুষ হলো, হায়না হলো, মানুষ হলো। একথা কিন্তু এখনকার বড় বিজ্ঞানীরাও স্বীকার করছেন না, বলছেন, না হে বাপু এত সহজ! মানুষের মাথায় একটা মস্তিষ্ক আছে, মানুষের একটা ভাবনা আছে, মানুষ বিচার করে প্রশ্ন তোলে, সেই প্রশ্ন হচ্ছে কতকগুলি মৌলিক প্রশ্ন, আমি কেন এসেছি, কোথায় যাচ্ছি কতদিন থাকছি এবং মৃত্যু আমার পেছনে পেছনে তাড়া করছে, কোন্টা আমার কোটা তোমার বা কোন্টা ক্ষণকালের কোন্টা সর্বকালের কোটা অমর, কোন্টা নশ্বর—এই মৌলিক প্রশ্ন যে করে সেই হচ্ছে মৌলবাদী। আর আমাদের যাঁরা পাগল বলেন তাঁরা কিন্তু এই প্রশ্নের সমাধানের খুব কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছেছেন যার ফলেই তাঁরা বলছেন পাগল। কেন পাগল? না তিনি জেনে গেছেন। আর জেনে গেলে কি হচ্ছে? জেনে গেলে তাঁর কাছে এই ইহসংসারের সমস্ত ভোগ্যবস্তু সমস্ত মানুষের আচার-আচরণ দেখে মনে হচ্ছে, এরা কি করছে? ইয়ে কেয়া কর রহা হ্যায়—এই প্রশ্ন। তাঁরা সেইজন্য সমস্ত কিছু ছেড়ে একটু কিরকম ফ্যালফ্যালে হয়ে যান, একটু অন্যরকম হয়ে যান। ঠাকুর তো বলতেন, যাঁরা যোগী তাঁদের চোখ দেখলেই বোঝা যায় যেন পাখি ডিমে তা দিতে বসেছে, চোখ দুটো ফ্যালফ্যাল করছে। তাঁরা কোন কিছুতে অংশগ্রহণ করতে পারেন না, তাঁরা, ‘আপনি নাচে, আপনি গায় আপনি দেয় মা করতালি।’ কিসের জন্য করতালি দেয়? হা ঈশ্বর তুমি আমায় পাঠিয়েছ, কেন পাঠিয়েছ দ্বৈত-আস্বাদনে, তুমি আর আমি, আমি যদি মানবদেহ ধারণ না করতাম তাহলে তুমি ঈশ্বর কোথায় থাকতে? তোমার কথা কে গ্রামে-গঞ্জে হাটে-বাজারে সভায়-মঞ্চে বলে বেড়াত? তা তুমি তোমার কথা শুনবে বলে আমাকে সৃষ্টি করে এখানে বসিয়েছ। এই প্রশ্নের থেকেই উদ্ভব হয়েছে ধর্ম আর এর সমাধান আছে মৌলবাদে অর্থাৎ মৌলিক প্রশ্নের উত্তর যারা দিতে পারে তারাই মৌলবাদী। মন্দিরে নেই, মসজিদে নেই, ন বহুধাশ্রুতেন, ন মেধয়া কোন শাস্ত্রে নেই। এই প্রশ্নের উত্তর আছে। শুধুমাত্র নিজে চুপটি করে বস। আর গুরুর প্রয়োজন তার কারণ হচ্ছে গুরুই আপনাদের দেবেন জ্ঞান-সহায়, তিনি মহান্ধকার দূর করবেন, তিনি পথ দেখিয়ে দেবেন, কি করিস সারাটা দিন, কিসে কাটালি। যেমন বাবা বলেন, সারাটা দিন মাঠে খেলে এলি। একটু পড়লি না। গুরু আরো বড় কথা বলবেন, ‘আমি আমি’–এইটা হলো অজ্ঞান ‘তুমি তুমি’ সেইটা হলো জ্ঞান। আমি আর তুমি, তুমি আর আমি। হ্যাঁ এটাই হলো বিজ্ঞান। সেইজন্য মূল বিজ্ঞানের কথাই হলো যে, আমি তুমি সমস্ত এক, সেই উদ্ভবভূমি এক। এক থেকে এই বহু হয়েছে। এই কথাই বলছেন তাঁরা। আমাদের সহজ করে বলছেন বাউলরা এবং তাঁদের সমস্ত কথার মধ্যেই আছে যে, এই রিপুর বন্ধন থেকে বেরিয়ে এস, শমন স্মরণ হও। শমন হলো মৃত্যু। যে কোনদিন ছোঁ মেরে ঈগল পাখির মতো তুলে নিয়ে যাবে, যেটুকু সময় আছে আনন্দে রহো, আনন্দে গান কর, আনন্দে তাঁর কথা শোন, আনন্দই কিন্তু সবচেয়ে বড় বস্তু, আমরা যাকিছু করি রসগোল্লা খাই আনন্দ পাবার জন্য, আমরা ভোগ করি আনন্দ পাবার জন্য, ভাল বিছানায় শুই আনন্দ পাবার জন্য, বেড়াতে যাই আনন্দ পাবার জন্য, সমস্ত আনন্দের কিন্তু একটা নিরানন্দ আছে। কিছুকাল পরে মনে হয় এতে হচ্ছে না সেই পরম আনন্দ। ভবার একটি গান আছে—”সেই পরমানন্দ সাগরে ডুবতে শেখ।” ডুবতেই যদি না শিখলি তবে তোর কি হলো। ডুবতে শেখ, কোথায় ডুবতে শেখ? আনন্দসাগরে। বলেছেন আমাদের পাগল। বড় সুন্দর কথা একটি চেতবাণীর মতো। বারে বারে আর আসা হবে না, মানুষ জনম তো আর পাবে না, ভেবেছ মনে এই ভুবনে, তুমি যাহা করে গেলে কেউ জানে না। দেখবেন আমরা যা যা করছি মনে হচ্ছে ও বেটা তো দেখেনি ও যখন দেখেনি তখন আমি বেশ আছি। সবকিছু করে যাচ্ছি। ওরে গোপাল বাবা না দেখুন কেউ না দেখুন, একজন তো ঠিক দেখছেন। তুমি যাহা করে গেলে আসিয়া হেথা, চিত্রগুপ্ত লিখি ভরিল খাতা। বিচার করিবেন সেই বিধাতা, ফাঁকিঝুঁকি তাঁর কাছে চলে না। সেইজন্য ঠাকুর বলতেন, “মনে মুখে এক কর।” ঠাকুর রামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বরে বলতেন যে, ঐসব তিলক ফিলক কেটে ‘জয়রাম’ ‘জয়রাম’ করলে কিছু হবে না। মন আর মুখ এক কর। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে পবিত্র হও–দেহে পবিত্র, চিন্তায় পবিত্র, মনে পবিত্র। একজন মস্তবড় সাধককে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ধ্যান জপ করলে মশাই কি হয়? তা তিনি বললেন, ধ্যান জপ করলে তোমার মধ্যে একটা ভীষণ বিশ্বাস আসে, যে আমি তিন কোটিবার জীবনে জপ করেছি তুই ব্যাটা আমার কি করবি? এই যে একটা বিশ্বাস, এই যে একটা জেদ—এই জেদই হচ্ছে সবচেয়ে বড় জিনিস। যুদ্ধ করতে গেলে সৈনিক সেও বলে তার বিশ্বাস ওয়া গুরুজি কী ফতে। তবেই সে যুদ্ধ করতে পারে। একটা ভারি জিনিস তুলতে গেলে দেখবেন জয়গুরু বলে আমরা তুলি। কোথা থেকে একটা শক্তি এসে যায়। তা এই শক্তি এই দেহের মাসলে নেই, এই শক্তি পেশীতে নেই, এই শক্তি ভিটামিন-এ নেই, এই শক্তি আছে একমাত্র মনের অন্তর-শক্তিতে। এই অন্তর-শক্তি জাগে শুধু ধ্যান আর জপে আর তাঁর চিন্তায় তাঁর সঙ্গে আমি যুক্ত আছি। আমার কে কি করবে, কেউ তো কিছু করতে পারবে না। সেইজন্য বাউলের গানেই আছে যে, শ্যামা নামের গণ্ডি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি, আয় তুই। একি ছেলের হাতের মোয়া যে তুই কেড়ে নিবি আমার হাত থেকে। এ-যে মোক্ষফল, একি ছেলের হাতের মোয়া!
তাই বলি—
“আমি মনের মতো, পাগল পেলাম না।
আমি তাইতো পাগল হলেম না—তাইতো পাগল হলেম না
নকল পাগল সকল দেখি—আসল পাগল দেখি না
শিব যে ছিল পাগলেরই সার, সুধা ত্যেজে গরল যার আহার
দালানকোঠা ফেলে দিয়ে শ্মশানে বৈঠকখানা
আমি মনের মতো পাগল পেলাম না কলিকালের পাগল গৌরাঙ্গ
একটুখানি ছেলে ভবে করল কি রঙ্গ
জয় রাধে বলে ঐ কালো জলে ডুবল আর উঠল না।”