মদমত্ত
কয়েক বছর আগে মাতালের কাণ্ডজ্ঞান পাঠ করে এক সরল প্রকৃতির মদমত্ত পাঠক আমাকে প্রকৃত সুরাবিলাসী ধরে নিয়ে বিশেষ বিপাকে ফেলেছিলেন। সে কাহিনী অন্যত্র লিখেছি।
কয়েক সপ্তাহ আগে এই বিদ্যাবুদ্ধির পৃষ্ঠায় আবার ‘ইঁদুর ও মদিরা’ লিখে একটু অসুবিধায় পড়ে গেছি। মদ যে খায় এবং মদ যে খায় না উভয়েরই মদের গল্পের প্রতি আসক্তি অতি প্রবল এবং সকলেরই জানা আছে অন্তত একটি না একটি কাহিনী, যেটা তাদের ধারণা মাতাল বিষয়ে শ্রেষ্ঠ গল্প।
একটা খুব ভাল কাহিনী শুনিয়েছেন এক প্রবীণ, সম্ভ্রান্ত ভদ্রলোক, অবসরপ্রাপ্ত বিচারক। তাঁর আদালতে অনেকদিন আগে এক প্রৌঢ় ভদ্রলোককে তিনি পেয়েছিলেন। আগের দিন রাতে রাস্তায় মদ খেয়ে মাতলামি করার দোষে পেটি কেসে পুলিশ পরদিন সকালে আদালতে চালান দিয়েছে।
ধুতিতে, পাঞ্জাবিতে ধুলো-কাদা মাখা, চোখের চশমার কাচ ভাঙা, কপালের কাছে কিছুটা ছড়ে গেছে কিন্তু আসামি অত্যন্ত নিরীহ ও ভদ্রপ্রকৃতির। হাতজোড় করে দোষ কবুল করলেন আসামি। আরও অন্যান্যদের সঙ্গে তাঁরও পঁচিশ টাকা জরিমানা হল।
আদালতের নির্দেশ শুনে আসামি বিনীতভাবে প্রশ্ন করল, ‘হুজুর, এই যে পঁচিশ টাকা দেব, এর একটা রসিদ পাব তো ?’
বিচারক একটু বিস্মিত হয়েছিলেন এই প্রশ্নে। তিনি বললেন, ‘তা পাবেন না কেন ? নিশ্চয়ই পাবেন।’ তারপর একটু থেমে জানতে চেয়েছিলেন, ‘কিন্তু আপনি এই রসিদটা দিয়ে কী করবেন ? কী কাজে লাগবে আপনার রসিদটা ?’
আসামি ভদ্রলোক অধিকতর বিনীত হয়ে বললেন, ‘বাড়িতে নিয়ে বউকে দেখাব।’ বিচারক আরও বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনার স্ত্রীকে আদালতের রসিদ দেখিয়ে কী করবেন ?’ আসামি এবার পরিষ্কার করে বললেন, ‘বউকে রসিদটা দেখালে সে বুঝতে পারবে যে সব টাকাই মদ খেয়ে উড়িয়ে দিইনি। কিছু টাকা অন্য কাজেও ব্যয় হয়েছে।’
সুরাপায়ীর জগৎ অত্যন্ত লম্বা এবং চওড়া। প্রাসাদ থেকে পর্ণকুটির, রাস্তাঘাট, বাজারহাট সর্বত্র তার অবস্থিতি। দিন ও রাতের যে কোনও সময়ে তাকে যে কোনও স্থানে আশা করা যেতে পারে। হয়তো সে সাতসকালেই মদ খায়নি কিন্তু গত রজনীর খোঁয়ারি সকালেও চলছে এবং বেলা বাড়তে বাড়তে সুরাবিলাসীর সংখ্যা রাত দুপুর নাগাদ তুঙ্গে পৌঁছাচ্ছে।
আদালতের কাঠগড়ায় প্রকাশ্য দিবালোক থেকে আমরা এবার একবার হাসপাতালের ওয়ার্ডে গভীর রজনীতে ঘুরে আসি। এক গুরুতর অসুস্থ রোগী বিছানায় চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে রয়েছেন। তিনি আজকেই একটু আগে এই ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে ভর্তি হয়েছেন। দু’দিক থেকে দু’জন ডাক্তার তাঁকে দেখতে ঢুকেছেন। দু’জনারই নৈশ ডিউটি, কিঞ্চিৎ টলছেন। টলতে টলতে রোগীর বিছানার দু’পাশে এসে দু’জনে দাঁড়িয়েছেন। তারপর দু’জনেই প্রায় একসঙ্গে রোগীর চাদরের নীচে হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন নাড়ি দেখার জন্যে। রোগীর হাত চাপা পড়ে রয়েছে তার কাত হয়ে থাকা শরীরের নীচে। যা হোক একটু এদিক ওদিক করে দুই ডাক্তার চাদরের নীচে পরস্পরের কবজির সন্ধান পেলেন এবং একজন অন্যজনের নাড়ি ধরে বসলেন নিজেদেরই অজান্তে।
তারপর দু’জন ডাক্তার চাদরের নীচে পরস্পরের নাড়ি ধরে এ রকম কথোপকথন করলেন—
‘দারুণ মাতাল দেখছি।’
‘খুব মদ খেয়েছে আজ।’
‘সাত আট পেগ মদ খেয়েছে অন্তত।’
‘তার চেয়েও বেশি হতে পারে।’
‘যত সব মাতালের কাণ্ড।’
‘যত সব মাতালের কাণ্ড।’
এর পরের উপাখ্যানটি নির্জলা প্রভাত কালের, এক সরল মদ্যপের। ভদ্রলোকের সেদিন অফিস যাওয়া হয়নি। অবশ্য দোষ তাঁর নয়। একটা ছোট গোলমালের জন্য তিনি কাজে যেতে পারেননি।
আগের রাতে খুব মদ খেয়েছিলেন ভদ্রলোক, সকালবেলায়ও বেশ নেশা ছিল কিন্তু তবুও ঘুম চোখে অভ্যাসবশত অফিস যাওয়ার জন্যে তৈরি হতে লাগলেন। প্রথমেই দাড়ি কামানো। দাড়ি কামাতে গিয়ে গোল আয়নাটা তুলে নিয়ে তিনি দেখলেন আয়নায় নিজেকে দেখতে পাচ্ছেন না, নিজের কোনও ছায়া পড়ছে না। তখন তাঁর ধারণা হল নিশ্চয়ই তিনি অফিসে চলে গিয়েছেন। বেলাও বেশ বেড়ে গেছে, এতক্ষণ তো অফিসে চলে যাওয়ারই কথা, আর সে জন্যেই আয়নায় নিজেকে দেখতে পাচ্ছেন না। তবে অধিক বেলায় তাঁর এই ভ্রম সংশোধন হয়েছিল, যখন তাঁর মনে পড়ল যে দাড়ি কামানোর আয়নার কাচটা আগের দিনই ফ্রেম থেকে খুলে পড়ে ভেঙে গিয়েছে।
অন্য এক সম্ভ্রান্ত মদ্যপকে জানি, যাঁর ভীষণ আত্মসম্মান বোধ। নতুন একটা পাড়ায় বাড়ি করে উঠে এসেছেন। আগের পাড়ায় মাতাল বলে তাঁর কুখ্যাতি ছিল। প্রতিদিন সন্ধ্যার পরে টলতে টলতে বাড়ি ফিরতেন। পাড়ার লোক টিটকিরি দিত।
নতুন পাড়ায় এসে ভদ্রলোক ঠিক করলেন আর টিটকিরি নয়, আর ধরা দেবেন না। এখনও তিনি সন্ধ্যার অনেক পরে, অনেকদিনই মধ্যযামে নেশাতুর অবস্থায় বাড়ি ফেরেন কিন্তু এ-পাড়ার লোকে আর তাঁকে মাতাল বলে টিটকিরি দেয় না। ভদ্রলোক একটা চমৎকার বুদ্ধি বার করেছেন লোকে যাতে টলটলায়মান পায়ের ভিতরে পা অবস্থাটা ধরতে না পারে। নিজের গলির মুখে এসেই তিনি উলটোমুখ হয়ে যান। এবার পিছন দিকে পা ফেলে ফেলে সন্তর্পণে বাড়ি ফেরেন। তাঁর এই পিছুহাঁটার ব্যাপারটা নতুন পাড়ার লোকেরা কয়েকদিনের মধ্যেই ধরে ফেলে। কিন্তু তারা তাঁকে মাতাল বলে টিটকিরি দেয় না, পাগল কিংবা উচ্চাঙ্গের রসিক ভেবে হাসাহাসি করে। নতুন পাড়ার অল্পবয়েসিরা ভদ্রলোককে আজকাল রসিকদা বলে ডাকে। তিনিও বিনা বাক্যব্যয়ে নতুন নামকরণ মেনে নিয়েছেন।
এই রসিকদা সম্পর্কে আরও একটু বিস্তৃত করে বলা দরকার। রসিকদার বিয়ের কিছুদিন পরেই রসিকদার স্ত্রী তাঁর স্বামীর গভীর মদ্যাসক্তির ব্যাপারটা অনুধাবন করেন। তারপরে যথারীতি ‘তুমি আর মদ খাবে না,’ ‘তুমি আবার মদ খেয়ে বাড়ি এলে আমার মরামুখ দেখবে,’ ইত্যাদি নানা দেয়াল রসিদাকে টপকাতে হল। সহস্র অনুনয় বিনয়, রাগ-গোঁসা-ক্রোধ ইত্যাদি উপেক্ষা করে রসিকদা নিয়মিত গভীর রাতে টলটলে অবস্থায় বাড়ি ফিরতে লাগলেন।
তখন রূপালি পর্দায় সাহেব-বিবি-গোলাম সিনেমার খুব রমরমা চলছে। রসিকদার স্ত্রী অর্থাৎ রসিকবউদি পাড়ার মহিলাদের সঙ্গে সিনেমাটি কয়েকবার দেখেছেন। এবং এই সিনেমা থেকেই তাঁর মাথায় একটু চমৎকার বুদ্ধি খেলে গেল। সাহেব-বিবি-গোলামের নায়িকার মতো তিনিও মদ খাওয়া ধরবেন, স্বামীকে বাড়িতে আটকিয়ে রাখা যাবে। মদ খাওয়ার জন্যে আবার শিক্ষাও দেওয়া হবে। ঘরের বউ মাতাল হলে যদি লোকটার হুঁশ ফেরে, মদ খাওয়া ছেড়ে দেয়, তা হলে তো ভালই।
রসিকদা এক বাক্যে রাজি হয়ে গেলেন। সেই দিনই অফিস থেকে ফেরার পথে এক বোতল দু’ নম্বর ধেনো মদ কিনে আনলেন। সন্ধ্যাবেলা ঘরের মেঝেতে শীতলপাটি বিছিয়ে রসিকদা রসিকবউদিকে মদ্যপানে হাতে খড়ি দিতে প্রস্তুত হলেন। মোড়ের পানের দোকান থেকে এক কেজি বরফ, দু’ বোতল সোডা ওয়াটার এনে স্বামী-স্ত্রী বেশ জমিয়ে বসলেন। রসিকদা খেয়াল করে রসিকবউদিকে দিয়ে কয়েকটি বেগুনি ভাজিয়েছেন।
কিন্তু এক চুমুক মুখে দিয়েই রসিকবউদি প্রচণ্ড একটা হেঁচকি তুললেন, তারপরে ক্রমাগত হিক্কা, হিক্কা আর হিক্কা। রসিকবউদি ক্ষেপে গিয়ে বললেন, ‘সর্বনাশ, এই সাংঘাতিক জিনিস কী করে খাও তুমি ? আমার বুক জ্বলছে, মাথা ঘুরছে, বমি আসছে। তুমি কী আনন্দে এটা খাও। এই ছাঁইপাঁশ গেল।’ রসিকদা তখন মুখ খুললেন, ‘তা হলে ভেবে দেখো। তুমি ভাবো আমি মদ খেয়ে খুব আনন্দে থাকি। তোমার এক চুমুক খেয়েই এই অবস্থা আর আমাকে দিনের পর দিন কত কষ্ট করে গেলাসের পর গেলাস এই জিনিস খেয়ে যেতে হচ্ছে।’