1 of 2

মজারাম্পুরায় গর্জন – তারাপদ রায়

মজারাম্পুরায় গর্জন – তারাপদ রায়

মজারাম্পুরার রাজধানীও মজারাম্পুরা।

মজারাম্পুরার একটা ম্যাপ ছিল শশকের কাছে। সেই ম্যাপটা ছোটরাজা রামকর্পূর চিঠির সঙ্গে গর্জনকে পাঠিয়েছিলেন, আর সেইসঙ্গে পথের নির্দেশ। জামশেদপুর থেকে বাসে চাইবাসা যেতে হলুদপুকুর থেকে সাড়ে ন’ মাইল উত্তর-পশ্চিমে চুণা নদী। নদী নয়, খাল। চূণা নদীর দু-দিকে পরগনা, মানে সাঁওতাল পরগনার উলটোপালটা জঙ্গল। সেই জঙ্গলের মধ্যে মজারাম্পুরা-মৌজা, সেটলমেন্টেও ওই নাম রয়েছে। তবে রাজ্য কথাটা না লিখে মৌজা লেখা হয়েছে, আর সেই মৌজার কোথাও ছোটরাজা রামকর্পূর থাকেন এমন একটা জায়গায়, যেখানে জায়গার নাম ওই মৌজার নামেই।

মজারাম্পুরার ছোটরাজা রামকর্পূর দাঁত তুলতে এসেছিলেন কলকাতায়, ডক্টর জি. কে. বসু, মানে গর্জনকুমার বসু, মানে গর্জন গোয়েন্দার কাছে। গর্জন বি. ডি. এস. পাশ ডেন্টিস্ট। যখন পসার জমেনি, তখন শখ করে কিছু গোয়েন্দাগিরি করেছিল, আর সেই গোয়েন্দাগিরির গল্প ফলাও করে লিখে তার অ্যাসিস্ট্যান্ট, শশক যতটা পয়সা নিয়েছে নিজে, তার চেয়ে অনেক বেশি খ্যাতিমান করেছে গর্জনকে। ‘ধর্মযুগ’-এ গর্জনকে নিয়ে লেখা শশকের একটা গল্পের হিন্দি অনুবাদ পড়েছিলেন ছোটরাজা রামকর্পূর। তারপরে যখন চেম্বারে এসে কী করে জেনে ফেলেন, ডাঃ জি. কে. বসুই গর্জন, তখন সদ্য তোলা তিনটে কাঁচা দাঁতের শোক আর যন্ত্রণা ভুলে গিয়ে বিস্ময়ে আকুল হয়ে পড়েন।

‘কী তাজ্জব বাত! আপনি গোর্জন গোয়েন্দা!’

প্রচণ্ড শোকের মধ্যেও হেসেছিলেন ছোট-রাজা ‘দাঁতকা ডাগদার ভি আছেন, গোয়েন্দা ভি আছেন। আপনাকে আমার দোরকার হবে।’

সেই দরকার যে দাঁত তুলে যাওয়ার তিন সপ্তাহের মধ্যেই হবে, সেটা কিন্তু তখন বোঝা যায়নি।

প্রথমে এল টেলিগ্রাম কাম শার্প, লেটার ফলোস। এক্সপ্রেস টেলিগ্রাম একেবারে। লেটার ফলো করতে দু-দিন দেরি হল, তবে সেটাও এক্সপ্রেস।

চিঠি পড়ে কিন্তু ঘটনা কিছুই বোঝা গেল না। শুধু পথের নির্দেশ, রাজ্যের মানচিত্র আর দুশো টাকার একটা চেক যাতায়াত খরচ বাবদ, সেই সঙ্গে সানুনয় অনুরোধ। গর্জন শশককে ডেকে বলল, ‘তাহলে চলো, যাওয়া যাক মজারাম্পুরায়।’

‘কিন্তু স্যার, চেম্বার বন্ধ থাকবে!’ শশক মাথা চুলকিয়ে বলে। যদিও তারও যাওয়ার ইচ্ছে কিছু কম নয়, অনেকদিন একটা গল্পও লেখা হয়নি।

গর্জন শশককে একবার আগামী তিনদিনের এনগেজমেণ্ট লিস্টটা দেখতে বলল।

শশক সব দেখেশুনে বলল, ‘তেমন ইম্পর্টেন্ট কিছু নেই, শুধু পরশুদিন বিকেলে মিস মার্কণ্ডেয় আসবেন।’

‘মিস মার্কণ্ডেয়? পরশুদিন বিকেলেই আসবে? তাহলে তো চেম্বার বন্ধ করতেই হয়। দাঁত তুলে ছাপ্পান্ন বছরের মিসের মুখশ্রী ফেরানো আমার দ্বারা হবে না। নাও, বাক্স-বিছানা বাঁধো, আর একটা নোটিশ দিয়ে যাও দরজায়। অনিবার্য কারণে চেম্বার সাতদিনের জন্য বন্ধ থাকিবে।’

অনিবার্য কারণে চেম্বার সাতদিনের জন্যই বন্ধ রইল। জামশেদপুরে চাইবাসা যাওয়ার বাসস্ট্যান্ডে বাসের জন্য অপেক্ষা করতে-করতে শশক পকেট থেকে মজারাম্পুরার ম্যাপটা বের করে দেখছিল, আর গর্জন আপনমনে হিতোপদেশের সেই শ্লোকটা, সেই ‘বুদ্ধির্যস্য বলং তস্য….শশকেন নিপাতিত’ ‘চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে’ গানের সুরে গুনগুন করে গাইছিল।

একটা বাস এল—চাইবাসা মার্কা মারা। গর্জন আর শশক উঠতে যাচ্ছিল, হঠাৎ তিনজন লোক বাধা দিল, ‘পেছনে এক্সপ্রেস আসছে, সেটায় আসুন। এটা অনেক ঘুরে, অনেক থেমে-থেমে যাবে। এ-বাসে গেলে বাঙালিবাবুদের খুবই কষ্ট হবে।’

‘এক্সপ্রেস কতক্ষণ পরে?’ শশক জানতে চাইল।

বাস থেকে দুজন কন্ডাক্টরসুদ্ধ একসঙ্গে দশ-এগারোজন চেঁচিয়ে বলল, ‘এই একটু পেছনে—।’

একটু পিছনে মানে পাকা পৌনে চার ঘণ্টা। সকাল থেকে দাঁড়িয়ে বেলা বারোটা বেজে গেল—আর বাসের সাক্ষাৎ নেই। এক্সপ্রেস হোক, প্যাসেঞ্জার হোক, একটা বাসেরও আর দেখা নেই।

ডিসেম্বর মাসের রোদ যে কত চড়া, সেটা জামশেদপুর বাসস্ট্যান্ডে সুটকেস-বিছানা বগলে নিয়ে ঘণ্টাচারেক দাঁড়িয়ে সাড়ে সাত আনা করে চানাচুর না খেলে বোধহয় বোঝা সম্ভব নয়, অন্তত তাঁদের পক্ষে তো নয়ই, যাঁরা এই সময়ে কলকাতার বাড়ির বারান্দায় আলতো করে চাদর জড়িয়ে হালকা রোদে বসে ‘রোমাঞ্চ’ পাঠ করেন।

সোয়া বারোটা নাগাদ সত্যি-সত্যি বাস এল। শশক আর গর্জন পোঁটলা-পুঁটুলি নিয়ে পা-দানিতে যেই পা দিয়েছে, পা-দানির ওপরে তিনটে লোক একসঙ্গে মুখ হাঁ করতেই শশক বলল, ‘একটু পেছনেই এক্সপ্রেস বাস রয়েছে না?’

‘একদম খালি এক্সপ্রেস আছে পেছনেই।’ তিনজনই একসঙ্গে জানাল।

শশক ধীরে-সুস্থে ভিতরের সিটে গিয়ে মালপত্র গুছিয়ে নিয়ে বসে বলল, ‘তাহলে এটাতেই যাব।’

গাড়ি ছাড়তে শশক ফিসফিস করে বলল, ‘স্যার, এরা—।’

গর্জন বলল, ‘তুমি ভাবছ বুঝি এরা রামকর্পূরের বিরুদ্ধ দলের লোক, আর আমাদের চেনে! সেসব কিছু নয়। এরা আসলে শৌখিন মিথ্যেবাদী সব। মিথ্যে কথা বলে আনন্দ লাভ করে। অনেকটা আমার সেই পেশেন্ট গুহমশাইয়ের মতো।’

‘ও, সেই গুহমশাই, যিনি বলেন যে, পন্ডস কোল্ড ক্রিমের ফর্মুলা তিনিই বের করেছিলেন!’ শশক বলে।

কথা বলতে-বলতে হলুদপুকুর এসে যায়।

হলুদপুকুরে রামকর্পূরের লোক একটা একঘোড়ার টমটম নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। কোচম্যান ছাড়া গাড়িতে দুজনের মাত্র জায়গা হয়, সুতরাং রামকর্পূরের প্রতিনিধি গাড়ির সঙ্গে পায়ে হাঁটতে লাগল, আর গর্জন ও শশক গাড়িতে।

রামকর্পূরের লোকটির নাম জানা যায়নি। জানা গেলেও তার সঙ্গে বাক্যালাপ সহজ ছিল না। কেননা এ-গাড়ির ঘোড়াটা কেমন যেন, হাড়-জিরজিরে রোগা, ছুটতেই পারে না। লোকটা পায়দলে ঘোড়ার গাড়ির থেকে অনেকটা এগিয়ে গেল। গর্জন ভাবল কোচম্যানের সঙ্গে কথাবার্তা বলে ঘটনাটা কী একটু জেনে নিতে পারলে ভালো হয়। কোচম্যানকে কী-একটা কথা জিজ্ঞাসা করতেই ঠোঁটে আঙুল দিয়ে ফিসফিস করে তাকে ইঙ্গিতে চুপ করতে বলল, আর ঘোড়াটা ভীষণ খেপে গিয়ে উলটোপালটা এলোপাতাড়ি ছুট লাগল। কলকাতায় বাসের হ্যান্ডেল ধরে ঝুলে যাওয়া অভ্যেস আছে বলেই শশকের কিছু হল না, কিন্তু গর্জন একটু নাদুসনুদুস প্রকৃতির, সে ছিটকে গিয়ে পড়ল পাশের একটা বাজরা খেতের ভেতরে।

প্রায় দুই ফার্লং দূরে রামকর্পূরের লোক হাঁটছিল, সে ছুটে এল। শশক লাফিয়ে পড়ল চলন্ত টমটম থেকে, কোচম্যান অনেক চেষ্টা করে একটু দূরে গাড়িটাও দাঁড় করাতে পারল। সবাই মিলে ধরাধরি করে গর্জনকে তুলল। গর্জনের পিঠের ধুলো-টুলো ঝাড়া হয়ে গেলে রামকর্পূরের লোক কোচম্যানকে মারতে উঠল। কোচম্যান হাত জোড় করে বলল, ‘আমি কী করব, আমার ঘোড়াটা গাড়ির মধ্যে কথা হলেই কীরকম ভড়কে যায়। আমি তো বাবুদের ওই কথাই বলতে যাচ্ছিলাম। ঘোড়াটা গেল খেপে।’

‘ঠিক আছে, তুমি মালপত্র নিয়ে গাড়িতে যাও, আমরা হেঁটেই যাব।’ এই বলে গর্জন আর শশক সেই লোকটার সঙ্গে হাঁটা শুরু করে দিল।

একটু পরেই কথাবার্তা চালু হল। কিন্তু গর্জন সরাসরি কিছু জিগ্যেস করল না লোকটাকে, অর্থাৎ সুখনলালকে, (এতক্ষণে নাম জানা গিয়েছিল তার) কেননা ব্যাপারটা রাজপরিবারের বিশেষ কোনও গোপন ব্যাপারও হতে পরে; যদি সুখনলাল কিছু জানেও সেটা একটু বাজালেই বোঝা যাবে।

সুখনলালের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে যেটুকু জানা গেল, তার সারাংশ হল যে,

এ-বছর এ-অঞ্চলে গম ভালো হয়নি। রামকর্পূরের এক ভাইপো বিলেতে মেম বিয়ে করেছে। রামকর্পূরের বিধবা বুড়ি বউদি, অর্থাৎ বড় রানি, ছাড়া আর সবাই সেটা জানে। সুখনলালের নাতনি, এখন যার মাত্র সতেরো দিন বয়েস, সে বড় হলে মেয়ের মতো দেখতে হবে। রামকর্পূরের মামা ছোট শিমতলার গজেন্দ্রভানু পঞ্চায়েত ইলেকশানে হেরে গিয়ে বাড়িতে বিরাট শত্রুনিধন যজ্ঞ করেছে, সেখানে পরশুদিন একহাজার একশো আটজন সন্ন্যাসী খেয়েছে। সুখনলালের ঘোরতর সন্দেহ, এর মধ্যে একশো আটজনও খাঁটি সন্ন্যাসী কিনা।

চূণা নদী এসে গিয়েছিল, নদী পেরোতে হবে। কথা থামিয়ে শশক বলল, ‘আজকাল আর আসল সন্ন্যাসী দেখাই যায় না।’

চূণা নদী পেরোনো তেমন কিছু কঠিন নয়। দুটো শালগাছ পাশাপাশি ফেলে অস্থায়ী সাঁকো বানানো হয়েছে। এই শীতের সময় জল খুবই কম, এপার-ওপার বড়জোর কুড়ি হাত হবে, আর গভীরও কিছু নয়। টমটম গাড়িটা জলের মধ্য দিয়ে পার হয়ে গেল।

প্রথমে সুখনলাল, মধ্যে গর্জন আর শেষে শশক। গুটিগুটি সবাই পেরিয়ে গেল। শশক একবার মনে-মনে ভেবেছিল এই শীতের অবেলায় স্যার যদি একবার ঠান্ডা জলের মধ্যে পড়ে যান, তবে গল্পটা এখানে বেশ জমানো যায়। আসল ঘটনা তো এখনও ঢুঁ-ঢুঁ, যদি এইখানে একটু কায়দা করা যায়—এ ছাড়া সেই বাজরা খেতের ব্যাপারটা তো আছেই। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তেমন কিছুই ঘটল না।

সন্ধ্যা হয়ে গেছে। সাঁওতাল পরগনার এই অঞ্চলে ডিসেম্বর মাসে যেরকম কুয়াশা আর সেইরকম শীত। কুয়াশা হলে নাকি শীত হয় না! কুয়াশায় একটাও দূরের মানুষ দেখা যাচ্ছে না আর ঠান্ডায় চোখের পাতা খোলা যাচ্ছে না, তা ছাড়া এতটা পথ হেঁটে গর্জনের হাঁটুতে ভীষণ ব্যথা হয়ে গেছে, সেইসঙ্গে পিঠে গাড়ি থেকে পড়ে গিয়ে। কোনওরকমে তারা দুজনে যখন রামকর্পূর সিংয়ের প্রাসাদে পৌঁছল, তখন দুজনে না হলেও গর্জন প্রায় অথর্ব।

বেশ বড় দোতলা বাড়ি। চারদিকে ঘেরা বারান্দা। বারান্দায় অল্প দূরে-দূরে পুরোনো আমলের চৌকো বিলিতি কাচের লন্ঠন, টিমটিম করে জ্বলছে। ভিতরে বাঁধানো উঠোন জুড়ে আলো করে রয়েছে একটা অতিকায় ডেলাইট।

উঠোনের ডান পাশের বারান্দা দিয়ে উঠে দুটো পাশাপাশি ঘর, ঘরের মধ্য দিয়ে দরজা রয়েছে। একটায় শশক আর একটায় গর্জনের স্থান হয়েছে। বন্দোবস্ত ভালোই। তবে লেপ নেই—কম্বল, আর কম্বল গায়ে দিলে শশকের গা বড় কুটকুট করে।

শশক গরম জল চেয়ে নিয়ে স্নান করল, কিন্তু গর্জন এই শীতে গা ভেজাতে মোটেই ভরসা করল না। গর্জন ঘরে ঢুকেই গা এলিয়ে দিল বিছানায়, আর সঙ্গে-সঙ্গে ঘুম। কিন্তু পনেরো মিনিটের মধ্যে শশকের ধাক্কাধাক্কিতে চোখ খুলতে হল ‘আঃ, বিরক্ত করছ কেন?’

‘স্যার, আপনার পেশেন্টের মাথা খারাপ।’

‘আমার পেশেন্ট মানে, রামকপূর্রের?’ গর্জন জিজ্ঞাসা করে চোখ কচলিয়ে নিয়ে।

‘হ্যাঁ স্যার, উলটোদিকের বারান্দায় এসে দেখুন।’

উলটোদিকের বারান্দাটা বাড়ির ভিতরের দিকে। শশক সেখানে গিয়ে ওপাশের দোতলার দিকে দেখাল। কিন্তু ওপাশের দোতলা ফাঁকা। শশক বলল, ‘এইমাত্র স্যার, ওই বারান্দায় একটা শতরঞ্চি রয়েছে দেখছেন, ওর ওপরে রামকর্পূর ডিগবাজি দিচ্ছিলেন। স্নান করে আমি একটু আগে এই বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিলুম, দেখে তো বোকা বনে গেলুম।’

‘তুমি নিজেই পাগল হয়ে গেছ, শশক। রামকর্পূর ষাট বছর বয়সে ডিগবাজি খাবে কোন দুঃখে? তুমি ভুল দেখেছ।’

শশক নিজেও ভাবল ভুলই দেখেছে।

একটু পরে জলখাবার এল। তারপর খবর এল, কাল সকালে ছোটরাজা দেখা করবেন, এখন আপনারা বিশ্রাম করুন।

জলখাবারের পরিমাণ এত বেশি ছিল যে, রাতে যখন চাকর লাল গমের রুটি, ভয়সা ঘি, আর ভেড়ার মাংস নিয়ে এল, তখন গর্জন আর শশক ঘুম থেকে উঠে সেটা স্পর্শই করল না। সেইসঙ্গে বড় দুই বাটি ভরা গরম দুধ ঠান্ডা হয়ে দই হয়ে গেল, দুজনের মাথার কাছে টেবিলে।

সকাল সাতটা নাগাদ দেখা মিলল ছোটরাজা রামকর্পূরের। সুখনলালই বোধহয় রামকর্পূরের খাস ভৃত্য। সে এসে ডেকে নিয়ে গেল চা খেতে, অন্দরে দোতলায়। গর্জন আর শশক যাওয়ার মিনিটপনেরো পরে রামকর্পূর এলেন। চোস্ত পাজামা আর টুইডের ওভারভোট পরে তাঁকে বেশ সম্রান্ত দেখাচ্ছিল। এসেই দেরি হওয়ার জন্য ক্ষমা ভিক্ষা করলেন ‘ডিগবাজি দিতে গিয়ে একটু দেরি হয়ে গেল, বুড়ো বয়েসে অসুবিধেও হয়।’

ডিগবাজির উল্লেখে শশক আর গর্জন একবার মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। হঠাৎ মুখ ফসকে শশক বলেই বসল, ‘আপনাকে বোধহয় কাল সন্ধেবেলায় এসেই আমি দেখেছি ওই পশ্চিমের বারান্দায় ডিগবাজি খেতে।’

ডিগবাজি খাওয়া ব্যাপারটা যেন একেবারে কিছুই নয়, এইভাবে বললেন রামকর্পূর, ‘আর কী, সকাল-সন্ধ্যায় ওই যা ক’টা ডিগবাজি, কীসের জোরেই বা টিকে থাকব এই বয়েসে, বলুন দেখি?’

ইতিমধ্যে চায়ের টেবিলে আরও তিনজন সমবতে হয়েছেন।

রামকর্পূর পরিচয় করিয়ে দিলেন ‘এ হল রামদুলাল, আমার ভাইপো। এর দাদা রামগোপাল বিলেতে আছে আজ পাঁচ-ছ’ বছর, গত বছরখানেক কোনও চিঠিপত্র দেয়নি। আমার দাদা রামগুলাব মারা গেছেন আজ প্রায় কুড়ি বছর। তখন থেকে আমিই গার্জিয়ান এদের। এর মা, মানে আমার বউদিকে জানানো হয়নি, তবে আমরা শুনেছি রামগোপাল বিলেতে গিয়ে ওই দেশের একটি মেয়েকে বিয়ে করে সংসার পেতেছে, আর দেশে ফিরবে না।’

গর্জন ভালো করে রামদুলালকে দেখল। সৌম্য, সুদর্শন যুবক। কথার ফাঁকে রামকর্পূর পকেট থেকে একটা সাদা রুমাল বের করে একটা কোনা পাকিয়ে নাকের ভিতরে সুড়সুড়ি দেন। গর্জন লক্ষ করল, ভাবল, ডিগবাজি খাওয়ার মতো এটাও বোধহয় ছোটরাজার একটা বদ অভ্যাসই হবে।

রামদুলালের পাশে যে-রক্তচক্ষু ভদ্রলোক বসে রয়েছেন, যাঁর মাথায় জরির পাগড়ি আর কাঁধে জামদানি চাদর, জানা গেল তিনিই গজেন্দ্রভানু। রামকর্পূরের মামা। গর্জনের মনে পড়ল এর কথাই পথে আসতে-আসতে সুখনলাল বলেছিল।

গজেন্দ্রভানুর পাশে সার্জের পাঞ্জাবি, তুষের আলোয়ান পরা ভদ্রলোক, যাঁকে দেখলে বাঙালি বলে মনে হয়, সত্যিই তিনি বাঙালি, নাম সুকুমার বসু। রামকর্পূরের এস্টেটের ম্যানেজার। এস্টেট বলতে জমিদারি এককালে ছিল—এখন সেটা নেই, তবে বৎসর-বৎসর সরকারের কাছে ক্ষতিপূরণ আদায় করার ঝামেলা রয়েছে। পাইক-বরকন্দাজ, নায়েব-গোমস্তা এখন আর কিছুই নেই, শুধু ম্যানেজার রয়েছেন। তিনিই দেখাশোনা করেন। আগে চাইবাসা কোর্টে ওকালতি করতেন। জমিদারি দখলের আগের বছর, মানে বছরদশেক হল এখানে এস্টেটের ম্যানেজার হয়ে রয়েছেন। সপরিবারে আছেন। খাই-খরচা লাগে না, আর সুকুমার বসুই বললেন, ‘আমি ছিলাম জমিদারের উকিল, জমিদারি উচ্ছেদের পর একেবারে বেকারই হয়ে গেলাম। রামকর্পূরবাবুরা আমার পুরোনো মক্কেল, উনি বললেন, আমিও চলে এলাম। এঁদের এই ক্ষতিপূরণ পাওয়ার ব্যাপারটা গুছিয়ে দিয়েই আবার প্র্যাকটিসে ফিরে যাব ভাবছি।’

গর্জন আর শশক, দুজনেরই ধারণা ছিল যে, নিশ্চয়ই এখানে একটা কিছু খুন-টুন হয়েছে—অন্তত বড় রকমের একটা চুরি। কিন্তু এখন রামকর্পূরের কথা শুনে মনে হচ্ছে, সেসব কিছুই নয়। শুধু-শুধু সাতদিন চেম্বার বন্ধ করে এই সাঁওতালি রাজার কাছে জঙ্গলের মধ্যে আসা। গর্জন বিরক্ত বোধ করছিল, শশক তো স্পষ্টতই উসখুস করছিল।

দেখা গেল, রামকর্পূর বুদ্ধিমান লোক। তিনি এদের মনের কথা বুঝতে পারছিলেন। সুতরাং আর বেশি কথায় গেলেন না, নাকের মধ্যে রুমাল দিয়ে আর-একবার সুড়সুড়ি দিয়ে শুরু করলেন, ‘দেখুন গর্জনবাবু, আপনাকে আমি এখানে যে-জন্যে ডেকেছি, এবার সেটা বলব। ব্যাপারটা জরুরি, কিন্তু গোপন নয়। সকলের সামনেই বলব, সেটাই ভালো। আজ কিছুদিন হল, আমার মনে হচ্ছে যে, কেউ বুঝি আমাকে মারতে, খুন করতে চাইছে।’

খুন ব্যাপারটাও যে ডিগবাজির মতোই তুচ্ছ, এমনভাবে খুব সহজ স্বরেই কথাটা বললেন রামকর্পূর, কিন্তু গর্জন ব্যগ্র হয়ে বসল। শশকের চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল, আর অন্য তিনজনও নড়েচড়ে বসলেন।

সুকুমারবাবু প্রশ্ন করলেন, ‘খুন করতে চাইছে?’

আর-একবার নাকে সুড়সুড়ি দিলেন রামকর্পূর ‘ঠিকই সুকুমারবাবু, সেদিন রাত্রে যে আমার পড়ার টেবিলে অতবড় ঝাড়লন্ঠনটা পড়ে গেল, বসে থাকলে তো সে-সময় আমারই থাকার কথা। দু-মিনিটের জন্যে বাথরুমে গিয়েছিলুম, হঠাৎ ভীষণ শব্দ করে ঝাড়লন্ঠনটা পড়ল একেবারে আমার চেয়ারের ওপর। অত বড় দেড়মনি ওজনের কাচের পাহাড়টা মাথায় পড়লে এই খুলিটা একেবারে গুঁড়ো-গুঁড়োই হয়ে যেত।’ একবার নিজেরই মাথায় খুব স্নেহভরে হাতটা বুলিয়ে নিলেন রামকর্পূর।

‘কিন্তু সেটা তো একটা অ্যাক্সিডেন্ট, কাকা। এর মধ্যে খুন করার ব্যাপার তুমি পেলে কোথায়?’

রামলালের কথার উত্তরে এক ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলেন গজেন্দ্রভানু, ‘সাবেকি লোহার আংটা খুলে ঝাড়লন্ঠন পড়ে কী করে? নিশ্চয়ই কারও কোনও বদ মতলব ছিল। আগে থেকে সময়মতো আংটাটা খুলে দিয়েছিল। খুব বেঁচে গেছে রামকর্পূর। সেদিন সেই অতগুলো সন্ন্যাসীকে খাওয়ালাম—তার জন্যেই আমার ভাগ্নের প্রাণ রক্ষা পেয়েছে।’

রামকর্পূর এসব কথার মধ্যে না গিয়ে যথারীতি নাকে সুড়সুড়ি দিতে লাগলেন। কথা থামলে আবার শুরু করলেন, ‘তারপর সেদিন সন্ধেবেলা বারান্দায় ডিগবাজি খেতে গেছি…।’

গর্জন আর থাকতে না পেরে জিজ্ঞাসা করল, ‘আচ্ছা, আপনি ডিগবাজি খান কেন বলুন তো?’

রামকর্পূর যেন কিঞ্চিৎ বিস্মিত হলেন, ‘কেন, আপনারা ডিগবাজি খান না! আপনার স্বাস্থ্য দেখে আমার তো মনে হয়েছিল খান। ডিগবাজি হল সেই ব্যায়াম, এতে ঘাড়, গর্দান, মাথা, পিঠ, মাজা, হাত, পা সমস্ত অঙ্গের সঞ্চালন হয়। সকাল-বিকেল কুড়িটা করে ডিগবাজি দিতে পারলে, ওষুধে-ডাক্তারে পয়সা খরচ হয় না। সাঁতার, যোগব্যায়াম যাই বলুন, ডিগবাজির মতো কিছু নয়।’

গজেন্দ্রভানু বললেন, ‘আমি তো এই সেদিন পর্যন্ত দৈনিক এক মাইল সাঁতার দিতাম। তারপর রামকর্পূরের কথামতো দুবেলা দশটা-দশটা ডিগবাজি দিয়ে বেশ ভালোই আছি।’

রামকর্পূর, গজেন্দ্রভানু—মামা-ভাগ্নে উভয়েরই স্বাস্থ্য এ-বয়সেও যথেষ্ট ভালো; গজেন্দ্রভানু সম্পর্কে মামা হলেও সম্ভবত রামকর্পূরেরই সমবয়েসি। রামদুলাল অবশ্য তেমন স্বাস্থ্যবান নয়, ডিগবাজির প্রসঙ্গে তার কিংবা সুকুমারবাবুর বিশেষ উৎসাহ দেখা গেল না। মনে হল, এরা দুজনের কেউই ডিগবাজি-ব্যায়ামে তেমন বিশ্বাসী নয়।

সে যা হোক, একটু পরে রামকর্পূর আবার প্রসঙ্গে ফিরে এলেন। রুমাল অতি সূক্ষ্ম করে নাকের মধ্যে ঘোরাতে-ঘোরাতে বললেন, ‘এই পরশুদিন সন্ধেবেলা বারান্দায় ডিগবাজি দিতে গেছি, দেখি শতরঞ্চিটা একটু সরানো। আমি প্রথমে কিন্তু খেয়াল করিনি। তারপরে হঠাৎ কী মনে হওয়াতে শতরঞ্চিটা টানতে গিয়ে দেখি শতরঞ্চিটার শেষে সিঁড়ির মাথার সর্ষের তেল অনেকটা পরিমাণ ফেলা…।’

‘সর্ষের তেল?’ শশক হঠাৎ প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, ‘সর্ষের তেল আপনাদের এখানে পাওয়া যায়? আমার ছোট মাসিমা…।’

গর্জন এক গর্জনে শশককে থামিয়ে দিয়ে রামকর্পূরকে অনুরোধ করল, ‘হ্যাঁ, তারপর বলুন?’

রামকর্পূর একটু থেমে খুব ধীর, শীতল দৃষ্টিতে একবার সুকুমারবাবু, একবার গজেন্দ্রভানু, আর-একবার রামদুলালের দিকে তাকিয়ে কী যেন স্টাডি করলেন, তারপর গর্জনকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ব্যাপারটা বুঝলেন কিছু?’

গর্জন সংক্ষিপ্ত উত্তরে বলল, ‘না।’

রামকর্পূর যেন গর্জনের এ হেন বুঝবার ক্ষমতার অভাবে বিশেষ খুশি হলেন না। তিনি কিছুক্ষণ গুম মেরে রইলেন, তারপর বললেন, ‘ডিগবাজি দিতে গিয়ে বহু সময়েই আমি ব্যালান্স না রাখতে পেরে শতরঞ্চির বাইরে গড়িয়ে পড়ি। এখন শতরঞ্চিটা সিঁড়ির মুখে সরানো আর সেখানটা তেল ঢেলে পিছল করে রাখা। মানে হল যে, ডিগবাজি দিয়ে হঠাৎ শতরঞ্চির বাইরে চলে এলে, এবং সেটা খুব অসম্ভব নয়, তৎক্ষণাৎ-ই সিঁড়ি পিছলে, এই খাড়া সিঁড়ি, ওই অবস্থায় গড়িয়ে একেবারে একতলায়, এবং খুব সম্ভব আরও গড়িয়ে পাঁচ ফুট নীচে বাঁধানো উঠোনে পড়ে যাব একতলার বারান্দা থেকে। নির্ঘাত মৃত্যু, কিন্তু হত্যা বলে প্রমাণ হবে না। সবাই বলবে…।’

রামকর্পূরের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে সুকুমারবাবু বললেন, ‘সবাই বলবে ছোটরাজা ডিগবাজি দিতে গিয়ে সিঁড়িতে গড়িয়ে পড়ে মরে গেছে।’

সব শুনে গর্জন একবার রামকর্পূরের দিকে তাকাল। কোনও উত্তেজনা নেই, রীতিমতো ঠান্ডা মাথায়, স্থিরভাবে ছোটরাজা তাঁর সাক্ষাৎ মৃত্যু থেকে অব্যাহতির বর্ণনা করলেন, কেবল যা একটু নাকের মধ্যে রুমাল দিয়ে ঘনঘন সুড়সুড়ি দিচ্ছেন। সেটাই যদি চিত্তচাঞ্চল্যের কিঞ্চিৎ লক্ষণ হয়ে থাকে, সেটুকুই যা।

ঘরের মধ্যে শশক ছাড়া আর সবাই বেশ চঞ্চল এবং একটু সন্দিগ্ধও যেন হয়ে উঠেছে। শুধু শশক জলখাবারগুলো একটা-একটা করে বেছে-বেছে খাচ্ছে, শেষে একটা পরিতৃপ্তির হাই তুলে বলল, ‘আর-এক কাপ করে চা হলে হত না?’

রামদুলাল বলল, ‘নিশ্চয়।’ বলে উঠে ভিতরের দিকে যাচ্ছিল।

রামকর্পূর সিং তাকে হাতের ইশারায় দাঁড় করালেন, তারপর বললেন, ‘চা আবার এখুনি দিয়ে যাবে। তুমি বসো, জরুরি কথা হচ্ছে।’

রামদুলাল এসে বসল, রামকর্পূর একবার কী যেন ভেবে নিয়ে তারপর আবার ধীরে-সুস্থে কথা শুরু করলেন, ‘তারপর গর্জনবাবু, আপনাকে যেজন্যে ডেকেছি। আমি বুঝতে পারছি, কেউ আমাকে খুন করতে চাইছে। আমার বাপ মারা যান তাঁর ঊনত্রিশ বছর বয়েসে, তাঁর বাবা মারা যান ছাব্বিশ বছর বয়েসে, মানে এই রামদুলালের এখন যে-বয়েস সেই বয়েসে। আমার দাদা, মানে রামদুলালের বাবা, তিনিও মারা যান, যখন তাঁর বয়েস সাতাশ। সে-জায়গায় আমার এই সাতান্ন চলছে। সুতরাং বেশ কিছুদিনই বেঁচে আছি। আমি তো ধরেই নিয়েছিলাম তিরিশ পেরুব না, কিন্তু আমাদের সন্ন্যাস রোগটা আমাকে ছুঁল না, ভাইপোদেরও না। বোধহয় দাদার সঙ্গেই শেষ হয়ে গেছে।

‘সে যা হোক, যতদিন বেঁচে থাকা উচিত, তার চেয়ে বেশিদিন বেঁচে আছি, আর তা ছাড়া আমি বিপত্নীক, নিঃসন্তান, আমার বাঁচবার মোহও নেই। কিন্তু খুন হতে যাব কেন? আর কী এমন অন্যায় করেছি যে, খুন হতে হবে? তাই গর্জনবাবু, আপনাকে ডেকেছি যদি আপনি বুদ্ধি খাটিয়ে কিছু হদিশ করতে পারেন।’

রামকর্পূরের কথার জবাবে কোনও কিছু না বলে গর্জন ‘বুদ্ধির্যস্য’ গানটা গুনগুন করে ভাঁজতে লাগল। তারপর রামকর্পূরকে বলল, ‘তাহলে এখন উঠি, নাকি কিছু বলার আছে আপনার?’

গর্জনের এই রকম আচরণে রামকর্পূর নিশ্চয় ক্ষুব্ধ হলেন, কিন্তু মুখে কিছু বললেন না। সকালের চায়ের আসল ভাঙল।

গর্জন সোজা উঠে গিয়ে নিজের ঘরে বিছানায় শুয়ে পড়ল। শশক ঘণ্টাখানেক এদিকে-ওদিকে টহল দিয়ে এল, তারপর গর্জনের পাশে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল। গর্জন চোখ বুজে ছিল, সে চোখ খুলে শশককে বলল, ‘কী খবর, শশক?’

‘স্যার, ব্যাপারটা কিছু বুঝলেন?’

‘না।’ বলে গর্জন পাশ ফিরে শুল।

আরও মিনিটপনেরো চুপচাপ। তারপর শশক বলল, ‘রামকর্পূর বোধহয় আরও কিছু বলতে পারত।’

‘তা পারত।’

গর্জনের সংক্ষিপ্ত উত্তরে শশক বলল, ‘কিন্তু আপনি না-শুনে উঠে এলেন।’

‘রামকর্পূরকে একটু ভাবতে সময় দিলাম। এতগুলো লোকের মধ্যে তার ওসব কথা তারই পক্ষে বিপজ্জনক। তার সন্দেহটা আর যাই হোক, খুব অমূল্য নয়। হয়তো এদের মধ্যেই সেই আসল হত্যাকারী রয়েছে। রামকর্পূর যা বলবে এদের সামনেই বলবে, হয়তো প্রকারান্তরে এদের সাবধান করতে চায়, হয়তো আসল লোক যে, সে বুঝতেও পেরেছে। সুতরাং, একটু ভেবে-চিন্তে না বললে ঘটনা সাংঘাতিক হতে পারে।’

শশক অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে ব্যাপারটা যেন বুঝতে চাইল, অথবা গল্পের এই জায়গাটা কীভাবে লিখবে ঠিক করতে প্লটটা মনে-মনে গুছিয়ে নিল। একটু পরে কীসব ভেবে নিয়ে বলল, ‘আচ্ছা স্যার, ওই গজেন্দ্রভানু মামাটা খুব সুবিধের নয়!’

এমন সময় বারান্দায় ঘাসের চটির আলতো শব্দ হল, দেখা গেল দরজায় স্বয়ং গজেন্দ্রভানু দাঁড়িয়ে। তিনি সোজা ঘরে ঢুকে বললেন, ‘গজেন্দ্রভানু লোকটা অসুবিধের কীসের?’

গজেন্দ্রভানুর এই অভাবিত এবং আকস্মিক অনুপ্রবেশে শশক একেবারে হতচকিত হয়ে পড়ল। গর্জন কিন্তু মোটেই বিচলিত হল না। সে সাদর অভ্যর্থনা জানাল ‘গজেন্দ্রবাবু যে! আসুন, আপনার কথাই হচ্ছিল।’

বলা বাহুল্য গজেন্দ্রভানু যথেষ্ট প্রসন্ন হলেন না। এ হেন আপ্যায়নেও তিনি তেতো গলায় বললেন, ‘আমি লোকটা অসুবিধের কীসের?’

‘আরে ওটা একটা কথার কথা। সারাবেলা দুজন অতিথি ঘরে ঠায় বসে আছি, আপনারা একবারও এদিক মাড়ালেন না। বাধ্য হয়েই বারান্দায় আপনাকে দেখে ওই একটা টোপ ফেলতে হল।’ গর্জন স্মিত হেসে গজেন্দ্রভানুকে বসতে অনুরোধ করল।

গজেন্দ্রভানু বসে গজগজ করতে লাগলেন, ‘আমার ভাগ্নেটার মাথা খারাপ হয়েছে।’

‘কী সাংঘাতিক কথা! কোন ভাগ্নে?’ গর্জন উঠে বসল।

‘কোন ভাগ্নে! আমার আবার ক’টা ভাগ্নে? দুটিই ছিল, এখন ওই কর্পূর।’

‘কর্পূর মানে, রামকর্পূর?’ এতক্ষণে শশকের গলা একটু খুলল।

‘তা ছাড়া আর কে?’ গজেন্দ্রভানুর পুনরুক্তি শোনা গেল, ‘ডাহা খ্যাপা।’

‘কেন, ওঁর কথাগুলো কি আপনার পাগলামির বলে মনে হয়?’

গর্জনের প্রশ্নের জবাবে গজেন্দ্রভানু জানালেন, ‘তা ছাড়া আর কী? ঠান্ডা নির্বিবাদী মানুষ, যাকে বলে ভালোমানুষ। ওকে কে খুন করতে চাইবে? সব ওর বানানো, মনগড়া।’

গর্জন একটা হাই তুলে খুব শান্তভাবে বলল, ‘ও, আমারও তাই মনে হচ্ছিল।’ তারপর একটু থেমে হঠাৎ বলল, ‘আচ্ছা গজেন্দ্রবাবু, এই সুকুমারবাবু সম্পর্কে আপনার ধারণা কী?’

গজেন্দ্রভানু সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলেন, ‘ছ্যাঁচোড়!’

শশক হেসে ফেলতে গিয়ে গর্জনের চোখ-রাঙানি দেখে সামলিয়ে নিল। গর্জন বলল, ‘ধরুন, রামকর্পূরবাবুর ধারণাগুলো যদি সত্যিই হয়, তবে আমরা কি সুকুমারবাবুকে সন্দেহ করতে পারি?’

উত্তরে গজেন্দ্রভানু সংক্ষিপ্ততম হলেন, ‘না।’

গর্জন ‘কেন’ জিজ্ঞাসা করতেই গজেন্দ্রভানু যেন খেপে গেলেন ‘আপনারা ভাবেন কী? খুন করার কথা ভাবা কি সোজা কথা? ওই ছ্যাঁচড়টা করবে খুন?’ তারপর তিনি গরগর করতে-করতে উঠে গেলেন।

গজেন্দ্রভানু বেরিয়ে যাওয়ার মিনিটখানেকের মধ্যে রামদুলাল এসে ঘরে ঢুকল। একটুক্ষণ ভেবে-চিন্তে সোজা গর্জনকে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনারা গোয়েন্দা-বিভাগের লোক?’

‘আজ্ঞে না, আমি দাঁতের ডাক্তার।’ গর্জন জানাল।

‘তাবে কাকা যে বললেন—’ রামদুলাল যেন একটু বিচলিত।

শশকই এবার উত্তর দিল, ‘ওই একটু গোয়েন্দাগিরিও করি। তবে সরকারি নয়, যাকে বলে শখের, পার্টটাইম।’

রামদুলাল কী যেন ভাবতে যাচ্ছিল, গর্জন ফস করে তাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘আচ্ছা, গজেন্দ্রবাবু সুকুমারবাবুর ওপর খুব চটে আছেন মনে হল?’

রামদুলাল বলল, ‘তার কারণ আছে।’

‘কারণটা কী? অবশ্য আপনার বলতে যদি অসুবিধে না থাকে—।’

‘না, অসুবিধে আর কী! এই তবে গজেন্দ্রবাবু, মানে দাদাবাবু, পঞ্চায়েত ইলেকশানের সময়, এই কিছুদিন আগে, কাকার কাছে পাঁচহাজার টাকা চেয়েছিলেন। দাদাবাবুর ধারণা, ওই সুকুমারবাবুর মন্ত্রণাতেই কাকা টাকাটা ওঁকে দেননি।’

‘আচ্ছা,’ গর্জন একটু ঠোঁট কামড়াল ‘সুকুমারবাবু সম্পর্কে আপনার কী ধারণা? অবশ্য…।’

‘অবশ্য-টবশ্য আবার কী মশায়! লোকটা একটা ছ্যাঁচড়।’ রামদুলাল উঠে দাঁড়াল।

গর্জন একটু সামলে নিয়ে বলল, ‘আপনিও কাকার কাছে কিছু টাকা-পয়সা চেয়ে পাননি নাকি ওঁর জন্যে?’

রামদুলাল একটা শুকনো উত্তর দিল, ‘আপনার এত উৎসাহ কীসের মশাই?’ তারপর কী ভেবে বেরিয়ে যেতে-যেতে ফিরে এসে বলল, ‘আমি বিলেত যাব বলে দশহাজার টাকা চেয়েছিলাম কাকার কাছে। দাদা প্রত্যেক সপ্তাহে যেতে লিখছে। তা ওই সুকুমারবাবু কাকাকে ভাংচি দিল, গেলে নাকি আমি দাদার মতো মেম বিয়ে করব, বংশ নষ্ট হয়ে যাবে।’

রামদুলাল বারান্দায় বেরিয়ে গিয়েছিল, গর্জন তাকে ঘরের ভিতরে আবার ডাকল, ‘আর একটা কথা, আপনার কাকা মারা গেলে এ-সম্পত্তি তো আপনারই প্রাপ্য।’

‘কাকা বেঁচে থাকলেও দাদার ভাগ আর আমার ভাগ মিলে বাবার অংশের অর্ধেক আমার এখনই প্রাপ্য। তবে আপনি যা ভাবলেন, আমাদের সংসারে সেসব কোনও গোলমাল নেই। কাকা গার্জিয়ান, আমাদের নাবালক থেকে সাবালক করেছেন, তার ওপরে মা বেঁচে আছেন, এসব ভাগাভাগির কথা আমরা মোটেই ভাবি না।’

‘না, না, আমি সেটা মিন করিনি।’ গর্জন তাড়াতাড়ি সামলে নেয়। রামদুলাল চলে যায়।

রামদুলাল অন্তর্হিত হওয়ার পরে গর্জন কিছুক্ষণ গুনগুন করে ‘বুদ্ধির্যস্য বলং তস্য’ গাইল। ঘরের মধ্যে কিছুক্ষণ পায়চারি করল, একসময়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে লক্ষ করল শশক কখন ঘরের বাইরে চলে গেছে। এ-ঘরের উলটোদিকে উঠোন পেরিয়ে সোজাসুজি যে-ঘরটা, সেটাই বোধহয় কাছারি-বাড়ি। কাছারি-বাড়ির বারান্দায় শশককে দেখা গেল। গর্জনও সেই দিকে এগোল।

কাছারি-ঘরের ভিতরে বসে সুকুমার বসু কীসব কাগজপত্র দেখছেন। গর্জন শশককে ইশারা করে কাছারি-ঘরের ভিতরে ঢুকে গেল। শশক একটু বিব্রত বোধ করছিল, তারও ইচ্ছে সুকুমার বসুর সঙ্গে দু-একটা কথাবার্তা বলে। এখানে আসার পরে সুকুমারবাবুই যা একমাত্র বাঙালি। সুকুমারবাবু দু-একবার বারান্দায় তাকে লক্ষ করেছেন, কিন্তু ভিতরে আসতে বলেননি। কিন্তু গর্জনকে বিনা অনুমতিতে ঢুকতে দেখে সেও ঢুকে গেল।

তাদের দুজনকে দেখে সুকুমার বসু মাথা তুলে খুব গম্ভীরভাবে বললেন, ‘বসুন।’ কিন্তু ওই পর্যন্তই, আর কোনও কথা নয়, আবার কাগজপত্র দেখতে লাগলেন।

প্রথমে শশকই কথা বলল, ‘এখানে খুব শীত।’

সুকুমার বসু দলিল পরীক্ষায় অধিকতর মনোযোগী হলেন।

গর্জন বলল, ‘তেমন কিছু নয়।’

সুকুমার বসু এবার বললেন, ‘হুঁ।’

গর্জন আর অপেক্ষা না করে জানলা দিয়ে অত্যন্ত উদাসীনভাবে বাইরের দিকে তাকিয়ে বলে বসল, ‘আচ্ছা সুকুমারবাবু, আপনি কি জানেন রামকর্পূরবাবু, তাঁকে যারা খুন করতে পারে বলে সন্দেহ করেন, তাদের মধ্যে আপনিও একজন?’

সুকুমার বসু বললেন, ‘তা হতে পারে।’ খুব কঠিন চোখে তাকিয়ে নিলেন একবার ‘তা আগে খুন হোক তো!’

গর্জন শশককে ডেকে বলল, ‘চলো।’

দুজনে ঘর থেকে বেরিয়ে গ্রামের মধ্যে পায়চারি করতে গেল।

সাঁওতাল পরগনার গণ্ডগ্রাম। কয়েক ঘর বিহারি চাষাভুষো আর অধিকাংশ সাঁওতাল। দ্রষ্টব্য কিছু নেই। একটু পরেই দুজনের খুব একেঘেয়ে মনে হল। এখনও কাহিনির মূল অংশের দেখা নেই, শশক ভাবতে লাগল, এখনও গল্পের ম্যাটার কিছু হল না, আর হবেও না। যত্তোসব উলটোপালটা ব্যাপার।

‘কবে ফিরতে পারব বলে মনে হচ্ছে, স্যার?’

শশকের প্রশ্নে গর্জন বলল, ‘ঠিক বুঝতে পারছি না,’ তারপর কীসব হিসাব করে বলল, ‘ঠিক আছে, চব্বিশ ঘণ্টা টাইম দাও।’

‘চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে কী হবে, স্যার?’

‘কিছু হলে হল, না হলে তো ফিরবই। না হওয়াই ভালো। কিন্তু ব্যাপার সুবিধের নয়। রামকর্পূর লোকটা মোটেই বোকা বা খ্যাপা নয়।’

‘আপনি বলছেন, স্যার, রামকর্পূর খুন হতে পারে?’

‘তা পারে।’

‘তাহলে আমরা?’

‘দেখি আমরা কী করতে পারি।’

দুপুরে খাওয়ার ঘরে আবার সকলের একসঙ্গে দেখা হল। রামকর্পূর এবার যেন আরও স্পষ্টভাষী। রামদুলাল, গজেন্দ্রভানু, সুকুমার বসু তিনজনেরই সামনে বসে তিনি স্পষ্টই বললেন যে, তিনি যে এতকথা বলছেন, তার কারণ হল, তিনি কিছু ঢাকাঢাকি পছন্দ করেন না। এদের তিনজনকেই তাঁর অল্পবিস্তর সন্দেহ। গজেন্দ্রভানুকে পঞ্চায়েত ইলেকশানের সময় টাকা দেননি, ভাইপোকে বিলেত যাওয়ার অনুমতি বা রসদ কিছুই দেননি, এদের তাঁর ওপর রাগ থাকতে পারে, আর রামকর্পূর সোজাসুজিই বললেন, রাগের মাথায় খুন করা একটা সাধারণ ব্যাপার। সুকুমার বসুর প্রসঙ্গে বললেন, জমিদারি গেছে কিন্তু এস্টেটটা যাতে উঠে না যায়, তাই তিনি প্রাপ্য ক্ষতিপূরণের টাকা দিয়ে একটা টাস্ট তৈরি করেছেন, তিনিই তাঁর টাস্টি, অবশ্য তাঁর অবর্তমানে সুকুমারবাবুই টাস্টি হবেন। সুতরাং তাঁর মৃত্যুতে এত বড় একটা এস্টেট সুকুমারবাবুর পরিচালনাধীনে চলে আসবে, এই স্বার্থ খুন করার পক্ষে যথেষ্ট হতে পারে।

গজেন্দ্রভানু এবং রামদুলাল দুজনেই রামকর্পূরের বলার ধরন্ধারণে অস্বস্তি বোধ করছিল, আর অস্বস্তি বোধ করারই কথা। তবে রামকর্পূর সম্ভবত আজীবন এইভাবেই কথা বলে এসেছেন, তাই কাউকে খুবই বিচলিত দেখাল না।

খেতে-খেতে বিশেষ আর কোনও কথা হল না। শুধু সুকুমারবাবু একবার বললেন, ‘একটু বেশি খাওয়া হয়ে গেল।’

শশক আর গর্জনের পক্ষে খাওয়া একটু বেশিই বটে। এত খাওয়ার পরে শশক যখন আর-একবার দই চাইল, গর্জন যেন একটু বিরক্তই বোধ করল। সে কটু চোখে শশকের দিকে তাকাতে গেল, তখন হঠাৎ শশকের ডান পাশেই বসেছিলেন রামকর্পূর, তাঁর দিকে গর্জনের দৃষ্টি পড়ল। তিনি কেমন যেন একটু অস্থির, ছটফট করছেন।

‘কী হল আপনার?’ রামকর্পূরের আর-এক পাশে বসেছেন সুকুমার বসু। তিনিও লক্ষ করেছেন। তিনিই জিজ্ঞাসা করলেন।

‘কেমন একটু অস্বস্তি বোধ করছি। বোধহয় কিছু নয়, খাওয়া বেশি হয়ে গেছে বলেই। ঠিক আছে, আপনারা ভাববেন না।’ রামকর্পূর বললেন। কিন্তু গলার স্বর কেমন ভাঙা-ভাঙা।

‘না, এ তো ভালো লক্ষণ নয়,’ বলে গর্জন উঠে দাঁড়াতেই রামকর্পূর খাওয়ার টেবিলেই টলে পড়লেন।

গর্জন রামদুলালকে বলল, ‘আপনি চট করে একজন ডাক্তার ডাকুন তো!’

ডাক্তার বলতে তিন মাইল দূরে এক হাতুড়ে হোমিওপ্যাথ। ঘণ্টাদেড়েক পরে তিনি এসে যখন পৌঁছলেন, তার আগেই রামকর্পূর যে বেঁচে নেই…এ-বিষয়ে সবাই নিশ্চিত হয়ে গেছে।

রামকর্পূর সত্যি-সত্যি মারা গেলেন। হার্টফেল, না খুন? খুন হল গর্জনের চোখের সামনে, খাবার টেবিলে, পরিষ্কার দিনের আলোয়।

পোস্টমর্টেমে কিছু বেরোল না। জেলা সদর থেকে পুলিশ এল, সব খাবার রাসায়নিক পরীক্ষা করে দেখা হল। না, বিষ-টিষের কোনও বালাই নেই। আর বিষ থাকলে, একই পাত্র থেকে সবাই নিজের-নিজের প্লেটে খাবার তুলে নিয়েছে, রামকর্পূর তার মধ্যে হঠাৎ মারা যেতে যাবেন কেন?

এসব অবশ্য অনেক পরের সংবাদ। রামকর্পূরের মৃত্যুর দিন বিকেলেই গর্জন আর শশক কলকাতায় চলে আসে।

‘আমাদের আর কিছু করার নেই।’ এই বলে গর্জন শশককে নিয়ে রওনা হয়েছিল।

শশক শুধু একবার বলেছিল, ‘কিন্তু স্যার—।’

‘আর কিন্তু-টিন্তু নয়, এবার ফেরো। এ-যাত্রায় আমরা হেরে গেছি।’ গর্জন কলকাতায় ফিরে ময়না তদন্তের একটা রিপোর্ট আনিয়েছিল। রিপোর্টে ছিল হঠাৎ শ্বাস বন্ধ হয়ে রামকর্পূর মারা যান—হার্টফেলই বলা যায়।

কলকাতায় ফেরার দিনসাতেক পরে গর্জন শশককে বলল, ‘তুমি সুকুমারবাবুকে একবার কলকাতায় আসতে বলো।’

‘সুকুমারবাবু কি আসবেন, আর কেনই বা আসবেন?’

শশক জানতে চাইলে গর্জন এক ধমক দিয়ে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘তিনি এতই বুদ্ধিমান যে, না এসে পারেন না।’

সত্যিই সুকুমারবাবু এলেন। চেম্বারে তখন গর্জন আর শশক। সুকমারবাবু আসার পর গর্জন তাঁকে বলল, ‘আপনাকে আমার একটা প্রশ্ন করার আছে, খুবই সামান্য ব্যাপার, যদি কিছু মনে না করেন—।’

‘কী প্রশ্ন?’ সুকুমারবাবু জানতে চাইলেন।

গর্জন পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে বলল, ‘আচ্ছা, এই রুমালটা কি আপনার?’

সুকুমারবাবু বললেন, ‘আপনি আমাকে এতদূর ডাকিয়ে এনে রসিকতা করছেন কেন?’

‘ব্যাপারটা যে মোটেই রসিকতা নয়, আপনি ভালো করেই জানেন। শুধু হ্যাঁ কিংবা না বলুন।’ গর্জন এই বলে সুকুমারবাবুর মুখের দিকে গম্ভীর হয়ে তাকিয়ে রইল।

সুকুমারবাবু হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন ‘যদি আমারই হয়, তাতেই বা কী?’

‘তাতে কিছু নয়, তবে আপনাকে রামকর্পূর সিংয়ের হত্যার অপরাধে পুলিশে চালান দিতে পারি।’

গর্জনের কথা শুনে একটু হেসে সুকুমারবাবু বললেন, ‘আপনার পাগলামিকে নমস্কার। এবার আসি।’ সুকুমারবাবু বেরিয়ে গেলেন।

এর পরের ঘটনা খুবই সংক্ষিপ্ত। চেম্বার থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নামার আগেই সুকুমারবাবু গ্রেপ্তার হলেন। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নিয়ে পুলিশের লোক দরজার বাইরের দিকে আগেই অপেক্ষা করছিল। গর্জন আগেই সেটার আয়োজন করেছিল।

ঘটনা এখানেই শেষ। কিন্তু শশক গল্প লেখে, তার গল্পের সুতো এখানে সে মেলাতে পারছে না। গর্জনকে যখনই সে এ-বিষয়ে কোনও প্রশ্ন করে, গর্জন গুনগুন করে, ‘বুদ্ধির্যস্য বলং তস্য…।’

সুতরাং কাহিনির রহস্য উদঘাটনের জন্য শশকের ওপর আর নির্ভর করে লাভ নেই। গর্জন বেশ কিছুদিন পরে রামদুলালকে এ-ব্যাপারে একটা চিঠি দিয়েছিল। চিঠিটা ইংরেজিতে। তার তর্জমা করে তবেই এ-হত্যা-রহস্যের গতি করা গেল।

প্রিয় রামদুলালবাবু—

আপনার খুল্লতাত আমার সম্মুখেই খুন হইয়াছিলেন, ইহা সেই মুহূর্তেই আমি বুঝিতে পারিয়াছিলাম, কিন্তু সমস্ত ব্যাপার অনুধাবন করিতে আমার কিঞ্চিৎ সময়ের প্রয়োজন পড়ে। তাহা ছাড়া যে-প্রক্রিয়ায় তাঁহাকে হত্যা করা হইয়াছিল, তাহা আপনাদের দূর গণ্ডগ্রামে বসিয়া বিশ্লেষণ করা সম্ভব ছিল না। ঘটনাটি আমার সাক্ষাতে ঘটিয়াছিল, আমি নিজে উপস্থিত থাকিয়াও ঠেকাইতে পারি নাই, ইহা আমার গভীর পরিতাপ ও লজ্জার বিষয়।

সুকুমার বসু অতি ধুরন্ধর প্রকৃতির ব্যক্তি। প্রয়োজনে পড়িয়া এবং বিষয়-সম্পত্তির প্রয়োজনে আপনার খুল্লতাত তাঁহার শরণাপন্ন হইয়াছিলেন। বস্তুত সুকুমার বসুই তাঁহাকে জমিদারি গ্রহণের পর সরকারের ঘরের নানা হাঙ্গামা হইতে রক্ষা করিয়াছিলেন। তাঁহার উপর রামকর্পূর এতই নির্ভরশীল হইয়া পড়িয়াছিলেন যে, বিশ্বাসবশতই হউক বা সুকুমার বসুর কোনও কৌশলেই হউক রামকর্পূরবাবুর অবর্তমানে তিনি আপনাদের সমস্ত সম্পত্তির টাস্টি নিয়োজিত হন।

এত বড় সম্পত্তি রামকর্পূরবাবুর অবর্তমানে তাঁহারই দখলে আসিবে, এই লোভ সুকুমারবাবুর মতো ব্যক্তির পক্ষে কিছু কম ব্যাপার নয়। এই কারণেই আপনার বিলাত যাত্রার খরচ বা শ্রীযুক্ত গজেন্দ্রবাবুর নির্বাচনী খরচের ব্যাপারে তিনি বাধা সৃষ্টি করিয়াছিলেন। তিনি ধরিয়া লইয়াছিলেন, এই টাকা চলিয়া গেলে তাঁহারই যাইবে। কেননা, রামকর্পূরকে সরাইবার পন্থা তিনি ইতিমধ্যেই স্থির করিয়াছিলেন।

আপনার খুল্লতাত বুদ্ধিমান ব্যক্তি ছিলেন, তিনি কিছু-কিছু অনুমান করিয়াছিলেন। ঝাড়লন্ঠন খুলিয়া পড়া বা ডিগবাজি দিবার শতরঞ্চির পাশে তেল পড়িয়া থাকা কোনও আকস্মিক ব্যাপার নয়, বরং হত্যার প্রচেষ্টাও হইতে পারে তিনি বুঝিতে পারিয়াছিলেন। তিনি সুকুমারবাবুকে সন্দেহও করিয়াছিলেন, এবং সম্ভবত মনে-মনে স্থির করিয়াছিলেন টাস্টির বদল করিয়া সুকুমারবাবুকে পদচ্যুত করিবেন।

সুকুমারবাবু এই সময়টুকু দিতে রাজি ছিলেন না। তাঁহার হত্যার পদ্ধতিও খুব সরল। হত্যাকে দুর্ঘটনার আকারে দেখাইতে পারিলেই তাঁহার কার্যোদ্ধার হয়। তিনি রামকর্পূরবাবুর ব্যক্তিগত অভ্যাসগুলির সঙ্গে বিশেষভাবে পরিচিত। প্রত্যেক মানুষেরই কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তিগত অভ্যাস থাকে—সেগুলিকে নিজ প্রয়োজনে ব্যবহার করিতে পারাই বুদ্ধিমান ব্যক্তির কৃতিত্ব।

রামকর্পূর একটা বিশিষ্ট সময়ে তাঁহার স্টাডিতে বসেন, সেই সময়ে ঝাড়লন্ঠন তাঁহার মাথায় খুলিয়া পড়িতে পারে। তিনি ডিগবাজি দিতে পিছলাইয়া একতলায়ও পড়িতে পারেন। কিন্তু সুকুমারবাবুর উভয় চেষ্টাই ব্যর্থ হইল।

ইতিমধ্যে আমরাও গিয়া পৌঁছাইলাম। রামকর্পূরবাবু প্রকাশ্যেই সকলকে সন্দেহ করিতে লাগিলেন। সুতরাং সুকুমারবাবু বাধ্য হইয়াই…যাহাকে বলে ডেসপারেট হইয়া পড়িলেন। তিনি এইবার একটি অতি আধুনিক পন্থা উদ্ভাবন করিলেন।

সুকুমারবাবু উকিল, কিন্তু তাঁহার স্ট্যাম্পে দেখিয়াছিলাম, তিনি এম.এ., বি.এল. নন, এম.এসসি., বি.এল.। পোস্ট-গ্র্যাজুয়েটে তাঁহার বিষয় ছিল ফলিত রসায়ন। কলিকাতায় ফিরিয়া আসিয়া কয়েক বৎসরের গেজেট দেখিয়া সুকুমারবাবু সম্পর্কে এই জ্ঞানটুকু আহরণ করি। রামকর্পূরবাবুকে হত্যা করিতে সুকুমারবাবু তাঁহার অর্জিত শিক্ষা ব্যবহার করিয়াছিলেন।

ডিজিটালিস গ্রুপের কোনও বিষ নিশ্বাসে প্রবেশ করিলে শ্বাসক্রিয়া দ্রুত হইয়া মৃত্যু হওয়া স্বাভাবিক। তদুপরি পোস্টমর্টেমে এই বিষ আবিষ্কার অতি অসম্ভব।

রামকর্পূরবাবুর একটি বদভ্যাস ছিল তিনি রুমাল বা ধুতির খুঁট পাকাইয়া সূক্ষ্ম করিয়া নাকে সুড়সুড়ি দিতেন। হত্যার দিনে সুকুমারবাবু রামকর্পূরবাবুর একপাশে বসিয়াছিলেন। সবাই তখন খাইতে ব্যস্ত—তিনি সকলের অগোচরে রামকর্পূর তাঁহার যে-রুমালটি টেবিলের উপর রাখিয়াছিলেন, তাহা পালটাইয়া দেন নিজের পকেটের একটি রুমাল রাখিয়া। এই দ্বিতীয় রুমালটির প্রতি কোণে ডিজিটালিস মাখানো ছিল। নাকে দিয়া শুঁকিবার কিছু পরেই রামকর্পূর মৃত্যুমুখে পতিত হইলেন।

মৃত্যুর সময় আমি লক্ষ করি, রামকর্পূরবাবুর কোলের উপর একটি রুমাল পড়িয়া রহিয়াছে। আমি উহা পকেটস্থ করি। তাহার পর এখানে আসিয়া রাসায়নিক পরীক্ষা করিয়া নিশ্চিন্ত হই। এদিকে সুকুমারবাবুকে আসিবার জন্য চিঠি দিই, ওদিকে আপনাদের থানায় তাঁহার অসাক্ষাতে সমস্ত জিনিস সিজ করিতে কলিকাতা পুলিশ মারফত অনুরোধ জানাই।

সুখের বিষয়, তাঁহার জিনিসপত্রের সঙ্গে রামকর্পূরবাবু যেরকম রুমাল ব্যবহার করিতেন, তাহাও একটি পাওয়া গিয়াছে। এই সামান্য প্রমাণে সুকুমারবাবুর সাজা হইবে কি না জানি না, তবে জিনিসটির জটিলতা আমি ভেদ করিতে পারিয়াছি ইহাই আমার আনন্দ।

আপনারা আমার শুভেচ্ছা জানিবেন। ইতি—

ভবদীয়

গর্জনকুমার বসু

মাসিক রোমাঞ্চ

জানুয়ারি, ১৯৬৬

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *