ভূত-ভবিষ্যৎ
গভীর রাত্রে টেবিলের উপর ঝুঁকিয়া বসিয়া উপন্যাসখানা লিখিতেছিলাম। টেবিলের এক কোণে মোমবাতিটা গলদশ্রু হইয়া জ্বলিতেছিল। হঠাৎ চোখ তুলিয়া দেখি প্রেত সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে।
কলম রাখিয়া দৃঢ়স্বরে বলিলাম, ‘আমি পারব না।’
প্রেত কাতর চক্ষে আমার পানে চাহিয়া রহিল, মিনতিভরা স্বরে বলিল, ‘আপনি দয়া না করলে আমার আর উপায় নেই। মেয়েটা নষ্ট হয়ে যাবে। পাড়ার ছোঁড়াগুলো তার পেছনে লেগেছে।’
প্রেতের কণ্ঠস্বর ঘষা-ঘষা; গ্রামোফোন রেকর্ডে গান শুরু হইবার আগে যেরূপ শব্দ হয় অনেকটা সেইরকম। আমি বিরক্ত হইয়া বলিলাম, ‘তা আমি কি করব? আপনি অন্য কারুর কাছে যান না।’
প্রেত বলিল, ‘আর কার কাছে যাব? সবাই চোর। আপনি দয়া করুন।’
ভূতের কথায় মনটা একটু নরম হইল। সত্য বটে আমি দেনার দায়ে লুকাইয়া আছি, কিন্তু তবু চুরি যে করিব না—এ বিশ্বাস ভূতেরও আছে। বলিলাম, ‘আচ্ছা, আপনি ঐ মেয়েটাকে কিংবা তার বাপকে আপনার কথা বললেই পারেন, তারা নিজের ব্যবস্থা নিজেই করবে। আমাকে কেন?’
প্রেত একটি গভীর নিশ্বাস ফেলিল; মোমবাতির শিখা একটু নড়িয়া উঠিল। সে বলিল, ‘চেষ্টা কি করিনি? আমাকে দেখেই ভয়ে হাউমাউ করে উঠল। তারপর বাড়িতে রোজা ডেকে ঝাড়িয়েছে। ওদিকে আমার আর যাবার উপায় নেই।’
রাত্রি প্রায় বারোটা। আমি ফুৎকারে বাতি নিভাইয়া বিছানায় গিয়া শয়ন করিলাম। প্রেত সঙ্গে সঙ্গে আসিয়া তক্তপোশের পাশে বসিল, করুণস্বরে বলিল, ‘দয়া করুন। আপনার কল্যাণ হবে।’
বড় বিপদে পড়িয়াছি।
আমি একজন সাহিত্যিক। বাজারে নাম হইয়াছে; কিন্তু নাম হইলেই সাহিত্য-বাজারে টাকা হয় না। ফলে, একদিন যাঁহারা বন্ধু ছিলেন তাঁহারা মহাজন হইয়া দাঁড়াইয়াছেন; আমাকে দেখিলেই মুখ ভার করেন, কিংবা তাগাদা করেন।
বন্ধুত্বের দাক্ষিণ্য যখন একেবারে শুষ্ক হইয়া গেল তখন স্থির করিলাম কলিকাতা হইতে অন্তত কিছু দিনের জন্য গা-ঢাকা দিব। ভাগ্যক্রমে একজন প্রকাশক একটি উপন্যাস লেখার বরাত দিলেন; কিছু দাদনও আদায় করিলাম। সেই দাদনের টাকা লইয়া কলিকাতা হইতে সরিয়া পড়িয়াছি এবং পশ্চিমবঙ্গের একটি শহরে জীর্ণ খোলার ঘর ভাড়া লইয়া বাস করিতেছি। উপন্যাস শেষ না হইলে ফিরিব না।
আমার খোলার ঘরের জানালা ভাঙা, খাপ্রার ছাউনিও নিরবচ্ছিন্ন নয়। আসবাবের মধ্যে কীটদষ্ট তক্তপোশ, নড়বড়ে টেবিল ও একটি টুল। যিনি ঘরটি ভাড়া দিয়াছেন তিনি পাশেই পাঁচিল-ঘেরা মস্ত বাড়িতে থাকেন, মহাজনী কারবার আছে। এ জগতে মহাজনী কারবার কিংবা পুস্তক-প্রকাশকের ব্যবসা না করিতে পারিলে বাঁচিয়া সুখ নাই। মহাজন নিকুঞ্জবাবুর চোখ দুটি বড় সন্দিগ্ধ: এক মাসের ভাড়া আগাম লইয়া থাকিতে দিয়াছেন। অল্প দূরে একটি সস্তা ভোজনালয় আছে, সেইখানেই আহারাদির ব্যবস্থা করিয়াছি।
প্রথম তিনদিন বেশ নির্বিঘ্নে কাটিয়া গেল। উপন্যাস শুরু করিয়া দিয়াছি; খোলার ঘরে যে উপদেবতার যাতায়াত আছে তাহা জানিতে পারি নাই। চতুর্থ দিন রাত্রে আলো নিভাইয়া শয়ন করিলাম। আমার অভ্যাস, বিছানায় শুইয়া একটি বিড়ি সেবন না করিলে নিদ্রা আসে না। দেশলাই জ্বালিতেই চোখে পড়িল কে একজন তক্তপোশের পাশে বসিয়া আমার পানে একদৃষ্টে চাহিয়া আছে। দু’টা আগ্রহ-ভরা চোখ—
চমকিয়া বলিয়া উঠিলাম, ‘কে?’
সঙ্গে সঙ্গে মূর্তিটা মিলাইয়া গেল।
আবার দেশলাই জ্বালিলাম। কেহ নাই। ভাবিলাম ভুল দেখিয়াছি। অনেকক্ষণ ধরিয়া লিখিলে এমন হয়। চোখের ভ্রান্তি।
বিড়ি পান করিয়া ঘুমাইয়া পড়িলাম। আমার স্নায়ু দুর্বল নয়; ভূতের ভয় করি না। ভূক্ত থাকে থাক্, তাহাকে ভয় করিবার কোনও কারণ নাই; ভূতের চেয়ে মানুষকেই ভয় বেশী।
পরদিন সকালে রাত্রির কথা আর মনেই রহিল না। সারাদিন উপন্যাস লিখিলাম। উপন্যাসে প্রেমের প্রগতি দেখাইতেছি। আমার হিরো একেবারে নিম্নতম স্তর হইতে আরম্ভ করিয়াছে; এক মেথর-কন্যার প্রতি অবৈধভাবে আকৃষ্ট হইয়া তাহাকে পৈশাচ বিবাহ করিবার চেষ্টা করিতেছে। (পৈশাচ বিবাহের প্রকৃত অর্থ জানিতে হইলে অভিধান দেখুন)। কাহিনী বেশ জমিয়া উঠিয়াছে।
তারপর রাত্রে যথারীতি তক্তপোশে শয়ন করিয়া বিড়ি সেবনপূর্বক ঘুমাইবার উপক্রম করিলাম। কিন্তু ঘুমাইতে হইল না; হঠাৎ চট্কা ভাঙিয়া শুনিলাম, ঘষা-ঘষা গলায় কে বলিতেছে, ‘ঘুমোলেন নাকি?’
অন্ধকারে কিছু দেখা গেল না; কিন্তু মনে হইল যিনি প্রশ্ন করিলেন তিনি তক্তপোশের পাশে বসিয়া আছেন। কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া বলিলাম, ‘আপনি কে?’
উত্তর হইল, ‘কি বলে পরিচয় দিই? যখন বেঁচে ছিলাম তখন নাম ছিল নন্দদুলাল নন্দী।’
বলিলাম, ‘খাসা নাম! আপনি তাহলে প্রেত’
প্রেত বলিল, ‘হ্যাঁ। কিন্তু আপনি ভয় পাবেন না। আমার কোনও বদ্ মতলব নেই।’
আমি একটা হাই তুলিয়া বলিলাম, ‘বদ্ মতলব থাকলেও আপনি আমার কোনও অনিষ্ট করতে পারবেন না—আপনি তো হাওয়া। তবে আমি ভয় পেয়ে নিজে নিজের অনিষ্ট করতে পারি বটে।’
প্রেত নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, ‘তা বটে।’
মনে পড়িল দেশলায়ের বাক্সটা মাথার শিয়রেই আছে। সেই দিকে হাত বাড়াইয়া বললাম, ‘আমার সঙ্গে কিছু দরকার আছে কি?’
প্রেত বলিল, ‘দরকার এমন কিছু নয়। কথা কইবার লোক পাই না—আপনি স্বজাতি—তাই—
দেখিলাম প্রেতের অবস্থা আমারই মতো; সম্ভবত বন্ধুদের নিকট টাকা ধার লইয়াছে। বিছানায় উঠিয়া বসিয়া দেশলাই জ্বালিতে উদ্যত হইয়াছি, সে বলিল, ‘দেশলাই জ্বালবেন?’
‘কেন, আপনার আপত্তি আছে?’
‘হঠাৎ আলো জ্বাল্লে একটু অসুবিধে হয়।’
‘তবে থাক্। কাল আপনার চেহারাটা লহমার জন্যে দেখেছিলাম, ভাল ঠাহর কতে পারিনি। তা থাক্।’
কিছুক্ষণ চুপচাপ। ভাবিলাম, বেচারা কথা কহিবার লোক পায় না, স্বজাতি পাইয়া আলাপ করিতে আসিয়াছে। আমার কিছু বলা-কহা দরকার।
‘আপনি কি কাছে-পিঠে কোথাও থাকেন?’
‘পাশে পাঁচিল-ঘেরা বাগানে পুরোনো নিমগাছ আছে, তাতেই থাকি।’
‘তাই নাকি? আপনিও নিকুঞ্জবাবুর ভাড়াটে? কত ভাড়া দিতে হয়?’
প্রেত রসিকতা বুঝিল না, বলিল, ‘বাড়ি বাগান একদিন আমারই ছিল। আমার প্রপৌত্রের কাছে নিকুঞ্জ পাল কিনেছে।’
‘বটে! আপনার প্রপৌত্র বেঁচে আছেন বুঝি?’
‘হ্যাঁ। তার অবস্থা বড় খারাপ হয়ে গেছে—’
‘প্রপৌত্র! তাহলে আপনি আন্দাজ আশি-নব্বই বছর আগে ছিলেন?’
‘সিপাহী যুদ্ধের সময় আমি ছিলাম। মুচ্ছুদ্দির কাজে পয়সা করেছিলাম; ভেবেছিলাম সাতপুরুষ বসে খাবে— কিন্তু—’
প্রেতের কথা শেষ হইল না। আমি অভ্যাসবশত অন্যমনস্কভাবে একটি বিড়ি মুখে দিয়া ফস্ করিয়া দেশলাই জ্বালিলাম। প্রেতের ত্রস্ত-চকিত চেহারাখানা ক্ষণেকের জন্য দেখা গেল; তারপর সে হাওয়ায় মিলাইয়া গেল।
আবার হয়তো আসিবে ভাবিয়া কিছুক্ষণ বসিয়া বিড়ি টানিলাম। কিন্তু প্রেত আর আসিল না। তারপর কয়েক রাত্রি তাহার দেখা পাই নাই।
এদিকে আমার উপন্যাস দ্রুত অগ্রসর হইয়া চলিয়াছে। হিরো এখন এক রজক-কন্যার কৌমার্যহানির উদ্যোগ করিতেছে। এর পর আসিবে গোপ-কন্যা। স্থির করিয়াছি, এইভাবে ধাপে ধাপে তুলিয়া হিরোকে এক চিত্রাভিনেত্রীর সহিত বিবাহ দিয়া ছাড়িব। উপন্যাসের নাম রাখিয়াছি—স্বর্গের সিঁড়ি।
সেদিন রাত্রে আহারাদির পর বাতি জ্বালিয়া লিখিতে বসিয়াছিলাম। খুব মন লাগিয়া গিয়াছিল, সময়ের হিসাব ছিল না। মনোজগতে নিরঙ্কুশ ভ্রমণ করিতে করিতে হঠাৎ পা পিছলাইয়া স্থূল জগতে ফিরিয়া আসিলাম। দেখি, টেবিলের অপর পারে দাঁড়াইয়া প্রেত মিটিমিটি হাসিতেছে।
আজ প্রেতকে প্রথম ভাল করিয়া দেখিলাম। সূক্ষ্ম মূর্তি; তবু চেহারার মধ্যে অস্পষ্টতা কিছু নাই। গায়ে ফিতা-বাঁধা মেরজাই, মেটে-মেটে রং, সরু পাকানো গোঁফ; চোখ দুটি সজাগ ও প্রাণবন্ত। বয়স আন্দাজ পঞ্চান্ন! নিতান্তই সেকালের বাঙালী চেহারা।
প্রেত বলিল, ‘কি লেখেন এত?’
বলিলাম, ‘উপন্যাস।’
‘সে কাকে বলে? আমাদের সময় তো ছিল না।’
উপন্যাস কী তাহা বুঝাইয়া দিলে প্রেত সাগ্রহে বলিল, ‘ও—গোলে বকাওলির গল্প—রূপকথা! তা বলুন না শুনি।’
সংক্ষেপে গল্পটা বলিলাম। শুনিয়া ভূত বলিল, ‘ছি ছি।’
বলিলাম, ‘ছি ছি বললে চলবে কেন? এ না হলে বই কাটে না। যাহোক, ক’দিন আসেননি যে?’
প্রেত বলিল, ‘আপনি অদ্ভুত লোক। অন্য লোক ভূত দেখলে আঁৎকে ওঠে, আপনি গ্রাহ্যই করেন না।’
বলিলাম, ‘সে-রাত্রে আচম্কা দেশলাই জ্বেলেছিলাম, তাই রাগ হয়েছিল বুঝি?’
‘রাগ নয়—চম্কে গিয়েছিলাম, চম্কে গেলে আর শরীর ধারণ করা যায় না।’
খাতা টানিয়া লইয়া বলিলাম, ‘আচ্ছা, আজ আপনি আসুন, পরিচ্ছেদটা শেষ করতে হবে। মাঝে মাঝে আসবেন, গল্পসল্প করা যাবে।’
‘আচ্ছা।’—প্রেত চলিয়া গেল।
তারপর প্রেত প্রায় প্রতি রাত্রেই আসে; কিছুক্ষণ গল্পগুজব হয়, তারপর ‘আসুন’ বলিলেই হাওয়ায় মিলাইয়া যায়। এ আমার শাপে বর হইয়াছে। এখানে আসিয়া মানুষ প্রতিবেশীর সহিত ইচ্ছা করিয়াই আলাপ পরিচয় করি নাই; তৎপরিবর্তে যাহা পাইয়াছি তাহা মোটেই অবাঞ্ছনীয় নয়। প্রেতের সঙ্গে যতটুকু ইচ্ছা মেলামেশা করি, সঙ্গ-পিপাসা মিটিলেই তাহাকে চলিয়া যাইতে বলি, সে চলিয়া যায়। মানুষ প্রতিবেশীকে এত সহজে তাড়ানো যাইত না। ‘ঘণ্টা ধরে থাকেন তিনি সৎপ্রসঙ্গ আলোচনায়।’
আমার ভূতই ভাল।
একদিন ভূত জিজ্ঞাসা করিল, ‘আচ্ছা, আপনি সংসার করেছেন?’
বলিলাম, ‘সংসার? মানে, বিয়ে? সর্বনাশ, একলা শুতে ঠাঁই পায় না শঙ্করাকে ডাকে। ও কার্যটি আমাকে দিয়ে হবে না।’
ভূত একটু হাসিল। কিছুক্ষণ যেন অন্যমনস্ক থাকিয়া হঠাৎ বলিল, ‘দেখুন, আপনার সঙ্গে এ ক’দিন মেলামেশা করে বুঝেছি আপনি সজ্জন—চোর-ছ্যাঁচড় নয়। আমি অনেকদিন থেকে আপনার মতো একজন মানুষ খুঁজছি। আমার একটি অনুরোধ আছে, আপনাকে রাখতে হবে।’
ভূত যে নিছক আমার সঙ্গ লাভের জন্য নয়, একটা মতলব লইয়া আমার কাছে ঘোরাঘুরি করিতেছে তাহা এতদিন বুঝিতে পারি নাই। বোঝা উচিত ছিল; মুচ্ছুদ্দির প্রেতাত্মা বিনা প্রয়োজনে কাহারও সহিত ঘনিষ্ঠতা করিবে, মনে করাও অন্যায়।
সর্তকভাবে বলিলাম, ‘কি অনুরোধ?’
ভূত তখন টেবিলের উপর কনুই রাখিয়া নিজের ও বংশের ইতিকথা বলিতে আরম্ভ করিল। আন্দাজ করিলাম কাঁকড়াবিছার ল্যাজে যেমন হূল থাকে, অনুরোধটা আছে গল্পের শেষে।
নন্দদুলাল নন্দী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাহেবদের সঙ্গে ব্যবসা করিয়া প্রচুর উপার্জন করিয়াছিল। জমিদারী বাগান ক্ষেত বালাখানা সবই হইয়াছিল। তাহার যখন তিপ্পান্ন বছর বয়স তখন সিপাহী বিদ্রোহের গণ্ডগোল আরম্ভ হইল। এদিকে যুদ্ধবিগ্রহের সম্ভাবনা বিশেষ ছিল না; কিন্তু যাহার টাকা আছে তাহার আশঙ্কার শেষ কোথায়? একদা গভীর রাত্রিকালে নন্দদুলাল একটি পিতলের ঘটিতে একশত মোহর পুরিয়া বাগানের নিমগাছতলায় পুঁতিয়া রাখিল। আর সবই যদি যায়, একশত আকব্বরী মোহর তো বাঁচিবে।
ম্যুটিনীর হাঙ্গামা এদিকে আসিল না বটে, কিন্তু অরাজকতার সময়, হঠাৎ একদিন নন্দদুলালের বাড়িতে ডাকাত পড়িল। নন্দদুলালের হৃৎযন্ত্র দুর্বল ছিল, সে বেবাক হার্টফেল করিয়া মারা গেল। ডাকাতেরা লুটপাট করিয়া চলিয়া গেল। তারপর ক্রমে দেশ ঠাণ্ডা হইল; শান্তি শৃঙ্খলা ফিরিয়া আসিল।
নন্দদুলাল হিসাবী লোক ছিল। তাই তাহার আমলে ‘চাল’ বেশি বাড়িতে পায় নাই। তাহার পুত্র যশোদাদুলালের আমলে বাবুয়ানি বাড়িল; আগে দোল-দুর্গোৎসবের সময় হরিকীর্তন কথকতা হইত, এখন বাঈ নাচ দেখা দিল। তারপর তস্য পুত্র ব্রজদুলাল আসিয়া বিলাসিতার চরম করিয়া ছাড়িয়া দিল; জুতায় মুক্তার ঝালর লাগাইয়া, বাঈজীর পল্টন পুষিয়া, একশ’ টাকার নোটের ঘুড়ি উড়াইয়া সে যখন পৃথিবী হইতে বিদায় লইল তখন লক্ষ্মীও বিদায় লইয়াছেন। বাকি আছে শুধু বাগান-ঘেরা বাড়িখানা।
ব্রজদুলালের পুত্র গোপীদুলাল নিরীহ মানুষ। বাপের ভুক্তাবশিষ্ট এঁটো পাতায় যত দিন পারিল চালাইল; শেষ পর্যন্ত তাহাকে বাড়ি বিক্রয় করিতে হইল। তারপর গত বিশ বছর ধরিয়া গোপীদুলাল বাড়ির বিক্রয়মূল্য লইয়া এবং সামান্য কাজকর্ম করিয়া অতি দীনভাবে সংসার চালাইতেছে। তার স্ত্রীর মৃত্যু হইয়াছে; একমাত্র কন্যার বয়স একুশ, কিন্তু এখনও তাহার বিবাহ দিতে পারে নাই। উপরন্তু কয়েক বৎসর যাবৎ তাহাকে দুরন্ত হাঁপানী রোগে ধরিয়াছে।
কাহিনী শেষ হইলে জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘আপনার প্রপৌত্র মানে গোপীদুলালবাবু এখানেই থাকেন?’
প্রেত বলিল, ‘হ্যাঁ, বেনে পাড়ার এক ধারে একটা ভাঙা বাড়িতে পড়ে আছে। তারও বেশি দিন নয়, তাকে কালে ধরেছে। আর তো কিছু নয়, গোপীদুলাল ম’লে মেয়েটা ভেসে যাবে।’ বলিয়া করুণ নিশ্বাস ফেলিল।
সন্দেহ হইল প্রেত বুঝি ঘটকালি করিতেছে। মনকে দৃঢ় করিয়া বলিলাম, ‘দেখুন, আমি আগেই বলেছি বিয়ে করবার মতো অবস্থা আমার নয়। আপনি ও অনুরোধ করবেন না।’
প্রেত তাড়াতাড়ি বলিল, ‘না না, অনুরোধ করছি না। আমি বলছিলাম, আপনি যদি দয়া করে মোহরগুলো গোপীদুলালের কাছে পৌঁছে দেন তাহলে সে মেয়েটার বিয়ে দিয়ে মরতে পারে।’
আবাক হইয়া দিলাম, ‘মোহরের ঘটি কি এখনও নিমতলায় পোঁতা আছে নাকি?’
প্রেত বলিল, ‘হ্যাঁ। মরার আগে কাউকে বলে যেতে পারলাম না; যেমন পুঁতেছিলাম তেমনি পোঁতা আছে। তাই তো নিমগাছ ছাড়তে পারি না।’
কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হইয়া বসিয়া রহিলাম। আশ্চর্য এই যে, ভূতের কথায় তিলমাত্র অবিশ্বাস জন্মিল না। একশত আকব্বরী মোহর! আকব্বরী মোহরের দাম কত জানি না কিন্তু বর্তমান কালে একশত মোহরের দাম দশ হাজার টাকার কম হইবে না।
ক্ষীণকণ্ঠে বলিলাম, ‘এত সোনা! এর দাম যে অনেক।’
ভূত বলিল, ‘সেইজন্যেই তো কাউকে বিশ্বাস করতে পারিনে। এক আপনি ভরসা।’
চমকিয়া উঠিলাম, ‘আমি? আমি কি করব?’
ভূত মিনতির স্বরে বলিল, ‘ঘটিটা খুঁড়ে বার করতে হবে। বেশি খুঁড়তে হবে না, হাত খানেক খুঁড়লেই পাওয়া যাবে—’
‘কিন্তু খুঁড়বে কে? আমি?’
ভূতের চক্ষু নীরবে অনুনয় জানাইল। আমি চটিয়া বলিলাম, ‘বেশ ভূত তো আপনি! ও বাগান এখন নিকুঞ্জ পালের দখলে, সে আমাকে খুঁড়তে দেবে কেন? আর আমিই বা তাকে বলব কি? বলব, মশায়, আপনার বাগানে মোহর পোঁতা আছে তাই খুঁড়তে এসেছি?’
ভূত বলিল, ‘না না, আপনি দিনের বেলা যাবেন কেন? দুপুর রাত্রে চুপি চুপি পাঁচিল ডিঙিয়ে—নিমগাছটা বাড়ি থেকে অনেক দূরে, বাগানের এক কোণে—রাত্রে বাগানে কেউ থাকবে না—’
আমি বিড়ি ধরাইবার উপক্রম করিয়া বলিলাম, ‘মাপ করবেন, আমার দ্বারা হবে না। রাত্রিবেলা পরের বাগানে যদি ধরা পড়ি, ঠ্যাংয়ে দড়ি পড়বে। নিকুঞ্জ পাল এমনিতেই আমাকে সন্দেহের চক্ষে দেখে। আমি পারব না।’
দেশলাই জ্বালিলাম।
তারপর কয়রাত্রি উপর্যুপরি ভূতের সঙ্গে ঝুলোঝুলি চলিল। আমি অটল, ভূতও নাছোড়বান্দা। আমি যত বলি—‘পারব না’, ভূত ততই বলে—‘দয়া করুন’। যে-রাত্রির দৃশ্য লইয়া আরম্ভ করিয়াছি, তাহার পরও কয়েক রাত্রি কাটিয়া গেল। হঠাৎ দেশলাই জ্বলিয়া ভূতকে তাড়াইবার চেষ্টা করিলাম। কিন্তু ভূতের এখন দেশলাই অভ্যাস হইয়া গিয়াছে, কিছুক্ষণের জন্য অদৃশ্য হইয়া গেলেও আবার ফিরিয়া আসে এবং কাতর কণ্ঠে বলে, ‘দয়া করুন। সদ্বংশের মেয়ে, নষ্ট হয়ে যাবে।’
আমার অবস্থা সঙ্গীন হইয়া উঠিল। রাত্রে ঘুম নাই; সারারাত্রি ভূতের সঙ্গে তর্ক করিতেছি। উপন্যাস লেখা বন্ধ হইয়া গিয়াছে। একদিন মরীয়া হইয়া বলিলাম, ‘বেশ, রাজী আছি। কিন্তু আমাকেও মোহরের ভাগ দিতে হবে।’
ভূত মুচ্ছুদ্দি; সে ক্ষণেক বিবেচনা করিয়া বলিল, ‘বেশ, আপনি পাঁচ পারসেন্ট দালালি পাবেন। পাঁচখানা মোহর আপনার।’
অতঃপর আর ‘না’ বলিবার উপায় রহিল না। পাঁচখানা মোহর, মানে পাঁচশত টাকা। পাঁচশত টাকার জন্য অতি বড় দুঃসাহসিক কাজ করিবেন না এমন সাহিত্যিক কয়জন আছেন? আমার দুঃখ এই যে বাকি পঁচানব্বইটি মোহর হজম করিতে পারিব না। পেটের দায়ে কুৎসিত উপন্যাস লিখি বটে, কিন্তু চুরি করিতে পারিব না। তাছাড়া, চুরি করিয়া যাইব কোথায়, নন্দদুলাল মুচ্ছুদ্দির হাত এড়াইব কি করিয়া?
রাত্রি আড়াইটার সময় প্রেতের অনুগামী হইয়া বাহির হইলাম। আকাশে কৃষ্ণপক্ষের এক ফালি চাঁদ ছিল, তাহারই আলোয় পাঁচিল টপকাইয়া নিকুঞ্জ পালের বাগানে ঢুকিলাম। ভূত দেখিয়া যাহা হয় নাই তাহাই হইল, বুকের ভিতর দুম্দাম্ শব্দ হইতে লাগিল।
ভূত দেখাইয়া দিল, এক স্থানে কয়েকটা কোদাল শাবল খন্তা পড়িয়া আছে। একটা খন্তা তুলিয়া লইলাম। ভূত পথ দেখাইয়া নিমগাছ-তলায় লইয়া গেল। নিমগাছ-তলায় একটা স্থানে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া ভূত কোমরে হাত দিয়া দাঁড়াইয়া তদারক করিতে লাগিল, আমি খুঁড়িতে আরম্ভ করিলাম। চারিদিকে নিশুতি, কোথাও সাড়াশব্দ নাই; মনে হইল আমিও মানুষ নই, কোন্ স্বপ্নসঙ্কুল সূক্ষ্ম জগতের বাসিন্দা।
আধ ঘণ্টার মধ্যে ঘটি লইয়া নিজের ঘরে ফিরিয়া আসিলাম। ঘটির গায়ে সবুজ রঙের কলঙ্ক, কিন্তু ভিতরে একশত নিষ্কলঙ্ক আকব্বরী মোহর ঝক্মক্ করিতেছে।
ভূত আত্মাভিমানসূচক একটা ভ্রূভঙ্গি করিয়া বলিল, ‘কি বলেছিলাম!’
আমার গায়ে তখন কালঘাম ঝরিতেছে। ফস্ করিয়া দেশলাই জ্বলিয়া আমি একটা বিড়ি ধরাইলাম। ভূতকে বেশি আস্কারা দেওয়া ভাল নয়।
পরদিন সকালবেলা আবার ঘটি খুলিয়া দেখিলাম, স্বপ্ন নয়, মায়া নয়, মতিভ্রম নয়, সত্যই একশত মোহর। তাহার মধ্য হইতে পাঁচটি সরাইয়া রাখিয়া পঁচানব্বইটি পুঁটলিতে বাঁধিয়া লইয়া বাহির হইলাম। আর দেরি নয়। সোনার মোহ বড় মোহ; বেশীক্ষণ কাছে রাখিলে হয়তো লোভ সামলাইতে পারিব না।
বেনে পাড়ার একপ্রান্তে গোপীদুলালের বাড়ি খুঁজিয়া বাহির করিলাম। নোনাধরা চটা-ওঠা বাড়ি; তাহার সম্মুখে ঝাঁকড়া-চুলো একটি ছোকরা শিস্ দিতে দিতে পায়চারি করিতেছে। আমি দ্বারের কড়া নাড়িতেই ছোকরা আমার পানে অপাঙ্গ-দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া সরিয়া পড়িল।
একটি মেয়ে আসিয়া দ্বার খুলিয়া দিল; তারপর অপরিচিত ব্যক্তি দেখিয়া একটু ভিতর দিকে সরিয়া গিয়া নতনেত্রে দাঁড়াইল, স্খলিত স্বরে বলিল, ‘কাকে চান? বাবা বাড়ি নেই।’
বুঝিলাম গোপীদুলালের আইবুড় মেয়ে। গায়ের রং ফরসা, মুখখানি নরম ও সুশ্রী। সর্বাঙ্গে ভরা যৌবন। কিন্তু চোখেমুখে আতঙ্ক, যেন নিজের যৌবনের ভয়ে সর্বদা ত্রস্ত-চকিত হইয়া আছে। পরিধানে বোধ করি বাপের একখানা অধর্মলিন ধুতি; গায়ে ব্লাউজের অভাব ঢাকা দিবার জন্য আঁচলটা বুকের উপর দুইফের করিয়া জড়ানো।
আমার কণ্ঠ যেন কে চাপিয়া ধরিল। গলা ঝাড়া দিয়া বলিলাম, ‘এটা কি গোপীদুলালবাবুর বাড়ি?’
‘হ্যাঁ।’
‘তিনি বাড়ি নেই? কখন ফিরবেন?’
‘হাসপাতালে গেছেন। ফিরতে বোধ হয় দেরি হবে।’
‘ও—’ আমি একটু চিন্তা করিয়া বলিলাম, ‘তাঁর সঙ্গে আমার বিশেষ দরকার ছিল। আমি ওবেলা আবার আসব। তাঁকে বলে দিও।’
মেয়েটি চকিতে চোখ তুলিল!
‘আচ্ছা।’
আমার খোলার ঘরে ফিরিয়া গিয়া একটার পর একটা বিড়ি টানতে লাগিলাম। মাথা গরম হইয়া উঠিল; দুই বান্ডিল বিড়ি নিঃশেষ হইয়া গেল। ভয়-চকিত যৌবন, দুঃসহ অসহায় যৌবন, আপনার মাংস হরিণীর বৈরী—
ভূতের সঙ্গে পরামর্শ করিতে পারিলে ভাল হইত। কিন্তু ভূত দিনের বেলা আসে না।
অপরাহ্ণে আবার গেলাম। এবার দালালির মোহর পাঁচটিও লইয়া গেলাম। মেয়েটি দ্বার খুলিয়া দিল। বলিল, ‘বাবার শরীর বড় খারাপ, দেখা করতে পারবেন না। কী দরকার আপনার?’ তাহার ঠোঁট কাঁপিয়া উঠিল।
হঠাৎ জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘তোমার নাম কি?’
ত্রাস-বিস্ফারিত চোখ তুলিয়া হ্রস্বকণ্ঠে সে বলিল, ‘কমলা।’
আমি বলিলাম, ‘কমলা, তোমার বাবাকে বল, আমার কাছে তাঁর কিছু টাকা পাওনা আছে, তাই দিতে এসেছি।’
দ্বারের ছায়ান্ধকার হইতে সে বিহ্বল চক্ষে আমার পানে চাহিল, তারপর ছায়ার মতো অদৃশ্য হইয়া গেল। কিছুক্ষণ পরে ফিরিয়া আসিয়া বলিল, ‘আসুন।’
গোপীদুলালবাবু বিছানায় অর্ধোপবিষ্ট হইয়া হাঁপাইতেছিলেন। অকালবৃদ্ধ জীর্ণ মানুষ, চোখে উৎকণ্ঠা-ভরা ক্লান্তি। আমি পাশে বসিলে বলিলেন, ‘আপনাকে—? টাকা পাওনা আছে মনে পড়ে না তো।’
আমি বলিলাম, ‘টাকার কথা পরে বলব। এখন আমার একটা প্রস্তাব কাছে। আমি আপনার স্বজাতি, ভদ্রসন্তান। আপনার মেয়েকে বিয়ে করতে চাই।’
গোপীদুলাল দিশাহারা হইয়া গেলেন। আমি বিস্তারিতভাবে নিজের পরিচয় দিলাম; তাঁহার হাঁপানি যেন আরও বাড়িয়া গেল। শেষে বলিলেন, ‘কমলার বিয়ে দিতে পারব এ আমার আশার অতীত। আমার তো পয়সা নেই।’
‘আছে বৈকি! এই যে—’ বলিয়া আমি পুঁটুলি খুলিয়া একশত মোহর তাঁহার সম্মুখে ঢালিয়া দিলাম।
কমলাকে বিবাহ করিয়াছি। শ্বশুর মহাশয় কিন্তু টিকিলেন না, বিবাহের পরদিনই মারা গেলেন। আকস্মিক ভাগ্যোন্নতি তাঁহার সহ্য হইল না।
কলিকাতায় ফিরিয়া আসিয়া বন্ধুদের ঋণ শোধ করিয়াছি; পুস্তক-প্রকাশকের ব্যবসা ফাঁদিবার আয়োজন করিতেছি। উপন্যাসখানা ছিঁড়িয়া ফেলিয়াছি। এবার একখানা রোমান্সভরা ভদ্র উপন্যাস ধরিব; যাহা পড়িয়া কমলা লজ্জা পাইবে না।
নন্দদুলালের সহিত আর একবার মাত্র দেখা হইয়াছিল। আমি বলিয়াছিলাম, ‘কেমন, খুশি হয়েছেন তো?’
নির্লজ্জ প্রেত চোখ টিপিয়া মুচকি হাসিয়াছিল। ‘দালালি একটু বেশি নিয়েছ’ বলিয়া অদৃশ্য হইয়া গিয়াছিল।
ভূতের কৃপায় আমার ভবিষ্যৎ এখন বেশ উজ্জ্বল।
১৬ বৈশাখ ১৩৫৭।