ভূতোর চন্দ্রবিন্দু
বিভূতি ওরফে ভূতোকে সকলেই গোঁয়ার বলিয়া জানিত। কিন্তু সে যখন বিবাহ করিয়া বৌ ঘরে আনিল তখন দেখা গেল বৌটি তাহার চেয়েও এক কাঠি বাড়া, অর্থাৎ একেবারে কাঠ-গোঁয়ার। কাঠে কাঠে ঠোকাঠুকি হইতেও বেশী বিলম্ব হয় নাই।
ছোট শহর, সকলেই সকলকে চেনে। ভূতোকে সকলেই চিনিত এবং মনে মনে ভয় করিত। গ্যাঁটা-গোঁটা নিরেট চেহারা; কথাবাতা বেশী বলিত না। টাকাকড়ি সম্বন্ধে তাহার হাত যেমন দরাজ ছিল, তেমনি বিবাদ-বিসম্বাদ উপস্থিত হইলে মুখ ফুটিবার আগেই তাহার হাত ছুটিত। বাড়িতে তাহার এক সাবেক পিসী ছিলেন এবং বাজারে ছিল এক কাঠের গোলা; পিসী বাড়িতে ভাত রাঁধিতেন এবং গোলা হইতে সেই ভাতের সংস্থান হইত। কাঠ কিনিতে আসিয়া যে সব খদ্দের দরদস্তুর করিত তাহাদের প্রায়ই পিঠে চেলা কাঠ খাইয়া ফিরিতে হইত।
ভূতোর সম্পর্কে ‘চন্দ্রবিন্দু’ নামক একটি শব্দ খ্যাতিলাভ করিয়াছিল। একবার ফুটবল খেলিতে গিয়া ভূতো প্রতিপক্ষের এক খেলোয়াড়ের পেটে হাঁটুর গুঁতো মারিয়া তাহাকে চন্দ্রবিন্দু করিয়া দিয়াছিল। নেহাৎ খেলা বলিয়াই ভূতোর হাতে দড়ি পড়ে নাই, কিন্তু তদবধি ‘ভূতোর চন্দ্রবিন্দু কথাটা শহরে প্রবচন হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। নিজের নামের সম্মুখে চন্দ্রবিন্দু বসিবার ভয়ে ভূতোকে সহজে কেহ ঘাঁটাইত না।
যাহোক, এইসব নানা কারণে ভূতো পাড়ার ছোকরা-দলের চাঁই হইয়া উঠিয়াছিল। অর্থাৎ পাড়ায় ছেলেরা থিয়েটার করিলে খরচের অধিকাংশ সে বহন করিত এবং কাহারও সহিত ঝগড়া হাতাহাতি করিবার প্রয়োজন হইলে সকলে মিলিয়া তাহাকে সম্মুখে আগাইয়া দিত। ভূতোর অবশ্য কিছুতেই আপত্তি ছিল না; বস্তুত মারামারির গন্ধ পাইলে তাহাকে ঠেকাইয়া রাখাই দায় হইত।
ভূতোর বৌয়ের নাম বিবাহের আগে পর্যন্ত ছিল ক্ষান্ত, এখন হইয়াছে পুষ্পরানী। তাহাকে তন্বী শ্যামা শিখর-দশনা বলা চলে না, কিন্তু স্বাস্থ্য ও যৌবনের গুণে দেখিতে ভালই বলা যায়। মুখখানি গোল, বড় বড় চোখ, গাল দু’টি উঁচু উঁচু; শরীরও গোলগাল বেঁটেখাটো, দেখিলে বেশ মজবুত বলিয়া বোঝা যায়। বৌকে ভূতোর বেশ পছন্দই হইয়াছিল, কিন্তু ফুলশয্যার রাত্রে হঠাৎ দু’জনের মধ্যে ফারখৎ হইয়া গেল। কারণ অতি সামান্য। রাত্রে শয়ন করিতে গিয়া ভূতো হৃদয়ের উদারতাবশত প্রস্তাব করিয়াছিল যে বধু খাটের ডান পাশে শয়ন করুক, কারণ ডান পাশের জানালা দিয়া বাতাস আসে। ক্ষান্ত কিন্তু ডান দিকে শুইতে দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করিয়াছিল। দু’জনেই গোঁয়ার; ভূতো যতই জোর দিয়া হুকুম করিয়াছিল, ক্ষান্ত ততই মাথা নাড়িয়াছিল; ফল কথা, ভূতোর উদারতা সে-দিন সার্থক হয় নাই, ক্ষান্ত শেষ পর্যন্ত বাঁ পাশেই শুইয়াছিল। বিপরীত দিকে মাথা করিয়া শুইলেই সমস্যার সমাধান হইতে পারিত, কিন্তু গোঁয়ার বলিয়া কেহই কথাটা ভাবিয়া দেখে নাই।
সে-রাত্রে বিছানায় শুইয়া শুইয়া ভূতোর ইচ্ছা হইয়াছিল, গলা টিপিয়া বৌকে চন্দ্রবিন্দু করিয়া দেয়; কিন্তু স্ত্রীজাতির গায়ে হাত তোলা অভ্যাস ছিল না বলিয়া তাহা পারে নাই, কেবল মনে মনে তর্জন গর্জন করিয়াছিল। সকালে উঠিয়াই সে পাশের ঘরে নিজের পৃথক শয়নের ব্যবস্থা করিয়াছিল এবং বৌয়ের সঙ্গে কথা বন্ধ করিয়া দিয়াছিল। পিসী সমস্তই লক্ষ্য করিয়াছিলেন কিন্তু তিনি কাহারও কথায় থাকিতেন না; বিশেষত চন্দ্রবিন্দু হইবার ভয় তাঁহারও ছিল, তাই তিনি দেখিয়া-শুনিয়াও বাঙ্-নিষ্পত্তি করেন নাই। তাহার পর ছয়-সাত মাস কাটিয়াছে কিন্তু ভূতোর পারিবারিক পরিস্থিতি পূর্ববৎ আছে।
ক্ষান্তর মুখ দেখিয়া তাহার মনের কথা ধরা যায় না। সে কান্নাকাটি করে নাই, বাপের বাড়ি ফিরিয়া যাইতে চাহে নাই; বরঞ্চ ভূতোর সংসারটি পিসীর হাত হইতে নিজের হাতে তুলিয়া লইয়াছিল। ভূতোর জীবনযাত্রা সেজন্য কিছুমাত্র পরিবর্তিত হয় নাই। সে সকালবেলা চা খাইয়া গোলায় চলিয়া যাইত, দুপুরবেলা আসিয়া স্নানাহার করিয়া খানিক নিদ্রা দিত তারপর আবার গোলায় যাইত। রাত্রে ফিরিয়া আহার করিয়া পুনরায় নিদ্রা দিত। ক্ষান্ত নামক একটি মানুষ যে বাড়িতে আছে তাহা সে লক্ষ্যই করিত না। ক্ষান্তও বিশেষ করিয়া নিজেকে ভূতোর লক্ষ্যবস্তু করিয়া তুলিবার চেষ্টা করিত না।
ভূতোর বিবাহ-ব্যাপারটা যে ভাল উৎরায় নাই, একথা তাহার দলের সকলেই অনুমান করিয়াছিল এবং মনে মনে খুশি হইয়াছিল। সকলের মনেই ভয় ছিল, বিবাহের পর বৌয়ের খপ্পরে পড়িয়া ভূতো দলাদলি ছাড়িয়া দিবে—এমন তো কতই দেখা যায়। পুরুষের বহির্মুখী মন দাম্পত্য জীবনের স্বাদ পাইয়া অন্তর্মুখী হয়। কিন্তু দেখা গেল, ভূতো নির্বিকার; বরং তাহার দাঙ্গা করিবার স্পৃহা আরও বাড়িয়া গেল। একদিন সে এক শ্বাদন্ত কাষ্ঠক্রেতার মুখে ঘুষি মারিয়া তাহার দাঁত ভাঙ্গিয়া দিল, কিন্তু ক্রেতার দাঁতেও বিষ ছিল, ভূতোর হাত কাটিয়া গিয়া বিপর্যয় ফুলিয়া উঠিল। ডাক্তার আসিয়া ঔষধ, ফোমেন্ট, ব্যান্ডেজ ইত্যাদির ব্যবস্থা করিলেন; কয়েক দিন ভূতোকে বাড়িতেই আবদ্ধ থাকিতে হইল। ক্ষান্ত তাহার যথারীতি পরিচর্যা করিল কিন্তু দু’জনের মধ্যে একটি কথারও বিনিময় হইল না।
এইভাবে চলিতে লাগিল। ভূতো সারিয়া উঠিয়া আবার গুণ্ডামি আরম্ভ করিল। সে কদাচিৎ বাড়িতে থাকিলে দলের ছেলেরা তাহাকে ডাকিয়া লইয়া যাইত। একদিন দুপুরবেলা ভূতো ঘুমাইতেছিল, ছেলেরা একেবারে তাহার ঘরে আসিয়া উপস্থিত।
—‘ভূতোদা, দিন দিন অরাজক হয়ে যাচ্ছে। তুমি একটা কিছু না করলে আর তো পাড়ার মান থাকে না।’
জানা গেল, মাণিক নামক দলের একটি ছেলে এক বিলাতী কুকুরছানা পুষিয়াছিল। কুকুরছানাটিকে সে সযত্নে বাঁধিয়া রাখিয়াছিল, কারণ বাঁধিয়া না রাখিলে কুকুরের রোখ কমিয়া যায়। কিন্তু আজ সকালে কুকুরশাবক দড়ি কাটিয়া পলায়ন করিয়াছিল এবং মুক্তির আনন্দে একেবারে বদ্যিপাড়ায় উপস্থিত হইয়াছিল। অতঃপর বদ্যিপাড়ার নৃশংস ছোঁড়ারা তাহাকে ধরিয়া ল্যাজ ও কান কাটিয়া ছাড়িয়া দিয়াছে।
মাণিক প্রদীপ্ত কণ্ঠে বলিল—‘এ কুকুরের কান কাটা নয় ভূতোদা, আমাদের পাড়ার কান কেটে নিয়েছে ওরা। এর জবাব তুমি যদি না দাও—’
কার্তিক বলিল—‘বদ্যিপাড়ার ছোঁড়াগুলোর বড় বাড় বেড়েছে, ধরাকে সরা দেখছে। সে-দিন থিয়েটার করেছিল, লোকে একটু ভাল বলেছে কি না, অমনি আর মাটিতে পা পড়ছে না; যেন ভাল থিয়েটার আর কেউ করতে পারে না! তুমি যতক্ষণ ওদের একটাকে ধরে চন্দ্রবিন্দু না করে দিচ্ছ ততক্ষণ ওরা ঢিট হবে না ভূতোদা।’
ভূতো উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল—‘হুঁ।’ এবং লংক্লথের পাঞ্জাবিটা গলাইয়া লইয়া দলবল সহ বাহির হইয়া গেল। ক্ষান্ত পাশের ঘর হইতে সমস্তই দেখিল, শুনিল, কিন্তু মুখ টিপিয়া রহিল। কেবল তাহার বড় বড় চক্ষু দুটি অনেকক্ষণ ধরিয়া জ্বলিতে থাকিল।
এবার ব্যাপার কিছু বেশী দূর গড়াইল। ভূতোর গোলাতেই সাধারণত দলের আড্ডা বসে, কিন্তু পূর্বোক্ত ঘটনার পরদিন সকালে ভূতোর বাড়িতে দল জমিয়াছিল; মহা উৎসাহে সকলে বিগত দিনের ঘটনা আলোচনা করিতেছিল ও চা খাইতেছিল; এমন সময় থানার সব্-ইন্সপেক্টর পরেশবাবু দেখা দিলেন। ছেলের দল তাঁহাকে দেখিয়া নিমেষ মধ্যে কোথায় অন্তর্হিত হইয়া গেল। পরেশবাবু খুব খানিকটা উচ্চহাস্য করিলেন, তারপর উপবেশন করিয়া কহিলেন, ‘বিভূতিবাবু, আপনার নামে অনেক কথা আমাদের কানে এসেছে কিন্তু উড়ো খবর বলে আমরা কান দিইনি। এবার কিন্তু একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। ও-পাড়ার রতন থানায় সানা লেখাতে এসেছিল। আপনি কাল তাকে চড় মেরেছিলেন, ফলে সে আর কানে শুনতে পাচ্ছে না।’
ভূতো বলিল—‘বেশ তো, করুক না মামলা। চড় মারার জন্যে পাঁচ টাকা জরিমানা বৈ তো নয়।’
পরেশবাবু বলিলেন—‘রতন যদি সত্যিই কালা হয়ে যায় তাহলে দু’বছর ম্যাদ পর্যন্ত অসম্ভব নয়।’ তিনি উঠিয়া দাঁড়াইলেন—‘যা হোক, আপনি দুষ্টু-বজ্জাত লোক নয়, তাই আপনাকে সাবধান করে দিয়ে গেলাম। ব্যাপারটা আমি চেপে দেবার চেষ্টা করব, কিন্তু ভবিষ্যতে আপনি একটু মাথা ঠাণ্ডা রেখে চলবেন। নাচাবার লোক দুনিয়ায় অনেক আছে; কিন্তু যে নাচে পায়ে খিল ধরে তারই।’
পরেশবাবুর উপদেশের ফলেই হোক অথবা উপলক্ষের অভাবেই হোক, অতঃপর কিছু দিন ভূতো শান্তশিষ্ট হইয়া রহিল। ইতিমধ্যে সরস্বতী পূজা আগাইয়া আসিতেছিল; ভূতোর দল সরস্বতী পূজার সময় থিয়েটার করে, উদ্যোগ-আয়োজন পুরা দমে আরম্ভ হইয়াছিল। রাত্রে ভূতোর গোলায় একটা চালার নীচে মহলার আসর বসে। ভূতোর অবশ্য অভিনয় করিবার সখ নাই, কিন্তু সে অভিনেতাদের চা তামাকের ব্যবস্থা করিতে সারাক্ষণ সেইখানেই থাকে এবং প্রয়োজন হইলে গানের মহলার সঙ্গে একটু আধটু মন্দিরা বাজায়। আর্টের সঙ্গে ভূতোর সম্পর্ক ইহার বেশী নয়।
নির্দিষ্ট দিনে মহা ধুমধামের সহিত থিয়েটার হইল। অভিনয় কিন্তু শত্রুপক্ষ ছাড়া আর কাহাকেও বিশেষ আনন্দ দান করিতে পারিল না। দৈব দুর্বিপাকের উপর কাহারও হাত নাই, অভিনয়ের মাঝখানে সীনের দড়ি যদি হঠাৎ ছিঁড়িয়া যায়, হারমোনিয়ামের মধ্যে ইঁদুর ঢোকে এবং কাটা সৈনিক স্টেজের মেঝের উপর পিপীলিকার যৌথ আক্রমণে হঠাৎ লাফাইয়া উঠিয়া ‘বাপ রে’ বলিয়া পলায়ন করে, তাহা হইলে অভিনয় জমিবে কি করিয়া? শত্রুপক্ষ সদলবলে দেখিতে গিয়াছিল, তাহারা প্রাণ ভরিয়া হাততালি দিল। ভূতোর দলের মনে আর সুখ রহিল না।
ব্যাপার এইখানেই শেষ হইয়া যাইতে পারিত, কিন্তু মফঃস্বলের শহরে এক রাত্রি থিয়েটার হইলে সাত দিন ধরিয়া তাহার প্রেতকৃত্য চলে। পরদিন দুপুরবেলা বদ্যিপাড়ার কয়েকটা ব্যাদ্ড়া ছেলে ভূতোর গোলার সম্মুখে উপস্থিত হইল এবং রাস্তায় দাঁড়াইয়া নানা প্রকার টিট্কারি কাটিতে লাগিল। ভূতো গোলায় ছিল না, অভ্যাসমত বাড়ি গিয়াছিল, কিন্তু গতরাত্রের অভিনেতাদের মধ্যে কয়েক জন মচ্ছিভঙ্গভাবে সেখানে বসিয়া ছিল। বাছা বাছা বচনগুলি তাহাদের কানে যাইতে লাগিল। কাটা ঘায়ে নুনের ছিটের মতো তাহাদের সর্বাঙ্গ জ্বলিতে লাগিল।
কিন্তু ভূতো নাই, এই দুর্মুখ শিশুপালগুলাকে শায়েস্তা করিবে কে? কিছুক্ষণ অন্তরে অন্তরে জ্বলিয়া কার্তিক তাহার অনুজ গণেশকে বলিল, —‘গণশা, চুপি চুপি গিয়ে ভূতোদাকে খবর দে তো। আজ সব মিঞাকে চন্দ্রবিন্দু করিয়ে তবে ছাড়ব—’
গণেশের বয়স কম, গায়ে জোরও আছে, সে বলিল—‘কিন্তু আমরাও তো পাঁচ জন আছি—ওদের ধরে আচ্ছা করে ঠুকে দিলেই তো হয়—’।
কার্তিক চোখ পাকাইয়া বলিল—‘পাকামি করিস্নি গণশা। যার কর্ম তাকে সাজে। ঠুকে দেবার হলে আমরা এতক্ষণ দিতুম না! যা শিগ্গির ভূতোদাকে খবর দে—আমরা ততক্ষণ ঘাপটি মেরে আছি। খবর দিয়েই তুই ফিরে আসবি কিন্তু।’
ধমক খাইয়া গণেশ নিঃশব্দে খিড়কি দিয়া বাহির হইয়া গেল। ওদিকে শিশুপালদের বাক্যবাণ তখন স্তরে স্তরে আরও শাণিত ও মর্মভেদী হইয়া উঠিতেছে।
ভূতোর মনও আজ ভাল ছিল না। আহারাদির পর সে বিছানায় শুইয়া ছিল কিন্তু ঘুমায় নাই। এমন সময় গণেশ ছুটিতে ছুটিতে আসিয়া—‘ভূতোদা, তুমি শিগ্গির এস, বদ্যিপাড়ার চ্যাংড়ারা এসে গোলার সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের গালাগালি দিচ্ছে—’ বলিয়াই ছুটিয়া চলিয়া গেল, তখন ভূতোর বুকের ধিকি-ধিকি আগুন একেবারে দাউ-দাউ করিয়া জ্বলিয়া উঠিল। এমনি একটি সুযোগেরই সে প্রতীক্ষা করিতেছিল। সে আজ দেখিয়া লইবে—বদ্যিপাড়ায় চন্দ্রবিন্দুর পল্টন তৈয়ার করিবে!
তড়াক করিয়া শয্যা হইতে উঠিয়া সে একটা র্যাপার গায়ে জড়াইয়া লইল, তারপর দ্বারের দিকে পা বাড়াইয়া থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িল। ক্ষান্ত কখন অলক্ষিতে ঘরে প্রবেশ করিয়াছে এবং দ্বার বন্ধ করিয়া দ্বারে পিঠ দিয়া দাঁড়াইয়াছে।
দৃশ্যটা এতই অপ্রত্যাশিত যে, ভূতো রাগ ভুলিয়া কিছুক্ষণ সবিস্ময়ে তাকাইয়া রহিল; তারপর গভীর ভ্রূকুটি করিয়া দ্বারের কাছে আসিল। স্বামী-স্ত্রীতে ফুলশয্যার পর প্রথম কথা হইল। ভূতো বলিল—‘পথ ছাড়।’
ক্ষান্তর মুখ কঠিন, ডাগর চোখ আরও বড় হইয়াছে; সে ঘাড় নাড়িয়া বলিল—‘না, তুমি যেতে পাবে না।’
নারীজাতির এই অসহ্য স্পর্ধায় ভূতো স্তম্ভিত হইয়া গেল, সে চাপা গর্জনে বলিল—‘সর বলছি!’
ক্ষান্ত চোয়াল শক্ত করিয়া বলিল—‘না, সরব না।’
ভূতোর আর সহ্য হইল না, সে রূঢ়ভাবে ক্ষান্তকে হাত দিয়া সরাইয়া দ্বার খুলিবার চেষ্টা করিল। ক্ষান্তও ছাড়িবার পাত্রী নয়, সে পরিবর্তে ভূতোকে সবলে এক ঠেলা দিল।
এই ঠেলার জন্য ভূতো যদি প্রস্তুত থাকিত তাহা হইলে সম্ভবত কিছুই হইত না কিন্তু সে ক্ষান্তর শরীরে এতখানি শক্তির জন্য প্রস্তুত ছিল না; অতর্কিত ঠেলায় বেসামালভাবে দু’পা পিছাইয়া গিয়া সে বেবাক ধরাশায়ী হইল। ক্ষান্ত ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলিতে লাগিল, তাহার আজ গোঁ চাপিয়াছে। ভূতোকে কিছুতেই বাহিরে যাইতে দিবে না। তাই, ভূতো আবার ধড়মড় করিয়া উঠিবার উপক্রম করিতেছে দেখিয়া সে ক্ষুধিতা ব্যাঘ্রীর মতো তাহার বুকের উপর ঝাঁপাইয়া পড়িল।
ওদিকে বদ্যিপাড়ার দল দীর্ঘকাল একতরফা তাল ঠুকিয়া শেষে ক্লান্তভাবে চলিয়া গেল। গোলার মধ্যে কার্তিকের দল মুখ কালি করিয়া বসিয়া রহিল। গণেশ অনেকক্ষণ ফিরিয়া আসিয়াছে কিন্তু ভূতোর দেখা নাই। শেষে আর বসিয়া থাকা নিরর্থক বুঝিয়া কার্তিক গা-ঝাড়া দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল, তিক্ত স্বরে কহিল—‘দুত্তোর! ভূতোদারই যখন চাড় নেই তখন আমাদের কিসের গরজ। চল্ বাড়ি যাই।’
কার্তিক ভাইকে লইয়া চলিয়া গেল, কিন্তু বাকি তিনজন গেল না, হাঁটু এক করিয়া বসিয়া রহিল। দীর্ঘকাল চিন্তার পর মাণিক বলিল—‘খবর পেয়েও ভূতোদা এল না—এর মধ্যে কিছু ইয়ে আছে। জানা দরকার। —যাবি ভূতোদা’র বাড়ি?’
তিনজনে ভূতোর বাড়ি গেল। বাড়ি নিস্তব্ধ, কেহ কোথাও নাই। ভূতোর ঘরের দরজা ভিতর হইতে চাপা রহিয়াছে। মাণিক ইতস্তত করিয়া দরজায় একটু চাপ দিল। দরজা একটু ফাঁক হইল।
সেই ফাঁক দিয়া তিনজনে দেখিল, ভূতো মেঝের উপর চিৎ হইয়া পড়িয়া আছে এবং মাঝে মাঝে ঘাড় তুলিয়া বক্ষ-লীনা ক্ষান্তর মুখে চুম্বন করিতেছে।
লজ্জায় ধিক্কারে তিনজনে দরজা হইতে সরিয়া আসিল। তাহাদের বীর অধিনায়কের যে এমন শোচনীয় অধঃপাত হইবে তাহা তাহারা কল্পনা করিতেও পারে নাই। অত্যন্ত বিমর্ষভাবে বাড়ি ফিরিতে ফিরিতে তাহারা ভাবিতে লাগিল,—ভূতো এতদিনে নিজেই চন্দ্রবিন্দু হইয়া গিয়াছে।
১৮ আষাঢ় ১৩৫২