ভূতে-মানুষে
একালের লেখকদের এই এক ঝামেলা। পুজোসংখ্যা পত্র-পত্রিকা বেরিয়ে যাওয়ার নপর থেকেই সম্পাদকমশাইদের তাগিদ শুরু হয়ে যায়, পরের বছর পুজোসংখ্যার জন্য জানুয়ারির মধ্যেই লেখা চাই। সেবার জানুয়ারি পেরিয়ে মার্চ মাস এসে গেল। কিন্তু আমার কলম যেন অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট করে বসল। আসলে মগজ একেবারে খালি। লেখা বেরুতে চায় না। প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছিলুম। কিন্তু গোদের ওপর বিষফোঁড়া। মার্চের মাঝামাঝি হঠাৎ আমার এক বন্ধু সন্দীপ এসে সোল্লাসে বলল,–কেল্লা মার দিয়া!
বললম, কী ব্যাপার?
–তোকে আমি বলেছিলুম না আগামী পুজোয় একটা পত্রিকা বের করব? টাকার জোগাড় হয়ে গেছে। এবার আর আমাকে রেখে কে? পত্রিকার নামও ঠিক করে ফেলেছি। বুঝলি?
সন্দীপ কবে পত্রিকা বের করবে বলেছিল মনে পড়ল না। বললুম,– ভালো। খুব ভালো খবর। পত্রিকার কী নাম ঠিক করলি?
সন্দীপ একগাল হেসে বলল,-ভূতভুতুম।
অবাক হয়ে বললুম, ভূতভুতুম? তার মানে, ভূতের গল্পের পত্রিকা করবি নাকি?
–হ্যাঁ। তবে শুধু গল্প নয়। প্রবন্ধ থাকবে। পদ্য থাকবে। উপন্যাস থাকবে। আর সেই উপন্যাস তোকেই লিখতে হবে। টাকার কথা ভাবিস না। লেখকদের আমরা উপযুক্ত দক্ষিণাই দেব।
ওর কথা শুনেই আমার মাথা ভেঁ-ভোঁ করছিল। সন্দীপ যেমন জেদি, তেমনই গোঁয়ার-গোবিন্দ। করুণমুখে বললুম, সন্দীপ। তোর পত্রিকায় লিখে কি টাকা নিতে পারি? কিন্তু কথাটা কী জানিস? ভূতের আর একটুও চাহিদা নেই। সেই মান্ধাতার আমল থেকে ভূত নিয়ে এত লেখা হয়ে গেছে যে, পাঠক ভূতকে আর একটুও ভয় পায় না। তাছাড়া স্বনামধন্য ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় ভূতের সার কথা লিখে গেছেন। এদিকে নতুন ভূত হলেও কথা ছিল। পুরোনো ভূতেরা বাসি হয়ে পচে গিয়ে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। কাজেই
সন্দীপ আমার কথায় বাধা দিয়ে বলল, কী যে বলিস তুই! আমার আইডিয়াটাই তো তাই অন্যরকম। তুই নতুন ভূতের কথা বললি। সেই আনকোরা নতুন ভূত নিয়েই শারদীয়া ভূতভুতুম পত্রিকা বের করতে চাই। তুই অ্যাদ্দিন অনেকরকম ভূতের গল্প লিখেছিস। এবার নতুনরকমের ভূত নিয়ে একখানা উপন্যাস তোকে লিখতেই হবে। তুই একালের ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় হয়ে যাবি।
হতাশ হয়ে বললুম, ভাই সন্দীপ! তোকে খুলেই বলি। এবার মানুষ নিয়েই কোনও লেখা আসছে না, তো ভূত।
–আহা, নতুন ভূত।
–কিন্তু নতুন ভূত পাচ্ছি কোথায়? আমার মগজ একেবারে খালি। কল্পনার যন্ত্রটা মগজের মধ্যে থাকে। সেটাই বিগড়ে গেছে। কল্পনা ছাড়া কি লেখা হয়?
সন্দীপ একটু চুপ করে থাকার পর গম্ভীর হয়ে বলল,-বুঝেছি। কলকাতায় তোর এই ঘরে বইপত্তরের আবর্জনার মধ্যে বসে কি আর লেখা আসে? তোর প্রবলেম আমি বুঝেছি। এক কাজ কর। বীরভূম জেলার ঘুমঘুমিতলায় আমার ঠাকুরদার পৈতৃক একটা বাড়ি আছে। নিরিবিলিতে দোতলা বাড়ি। পিছনে পুকুর আছে। এই বসন্তকালে প্রকৃতি-পরিবেশ আর পাখি-টাখির ডাক–মানে, ওয়ান্ডারফুল জায়গা! বিশেষ করে লেখকদের লেখার জন্য অত সুন্দর জায়গা আর কোথাও নেই। বাড়িটার কেয়ারটেকারের নাম কালাচাঁদ। আমরা যখন ওখানে বেড়াতে যাই, তাকে কালাচাঁদ-খুড়ো বলে ডাকি। ডানপিটে লোক। খুড়ো বললে খুব খুশি হয়। তুই আজই ওখানে চলে যা। একমাস দেড়মাস যদ্দিন খুশি থাকবি। লিখবি। তার চেয়ে বড় কথা, নতুন ধরনের ভূত দেখতে পাওয়ার চান্স ওখানে নাইন্টি নাইন পারসেন্ট।
সন্দীপের কথা আমার মনে ধরল। ওর পত্রিকার জন্য ভূতের উপন্যাস না লেখা হোক, স্থানবদলের দরুণ আমার মগজে কল্পনাশক্তিটা ফিরে আসবার সম্ভাবনা প্রচুর। তাই রাজি হয়ে গেলুম। সন্দীপ এস. টি. ডি. ফোনে ঘুমঘুমিতলায় তার বাবার বন্ধু এক ডাক্তারবাবুকে জানিয়ে দেবে এবং তিনি কালাচাঁদকে আমার যাওয়ার খবরটা দিয়ে রাখবেন।
হাওড়া স্টেশনে বারোটা পাঁচের ট্রেনে চেপে আমাকে নামতে হবে হিংলাডিহি স্টেশনে। সেখান থেকে বাসে চেপে ঘুমঘুমিতলা পৌঁছুব। স্টেশন থেকে আঠারো কিলোমিটার দূরত্ব। বাসস্টপে কালাচাঁদ থাকবে।
সন্দীপ চলে যাওয়ার সময় আবার বলে গেল, প্রথমে কিন্তু আমার পত্রিকার জন্য উপন্যাস লিখতে বসবি।
পরে বুঝতে পেরেছিলুম, সন্দীপ ভূতভুতুম পত্রিকার শারদীয়া সংখ্যার জন্য আমার উপন্যাস সর্বাগ্রে পেতে চায়। তাই আমাকে সে তার গাড়িতে চাপিয়ে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে দিয়েছিল এবং ট্রেনেও তুলে দিয়েছিল।
যে ট্রেনের হিংলাডিহিতে সাড়ে তিনটে নাগাদ পৌঁছুনোর কথা, সেই ট্রেন গদাইলস্করি চালে চলতে-চলতে পৌঁছুল সওয়া চারটেতে। বেরিয়ে গিয়ে বাসস্ট্যান্ডে ঘুমঘুমিতলার বাস খোঁজ করলুম। সেখানে প্রচণ্ড ভিড়। কয়েকটা বাস দাঁড়িয়ে আছে এবং সবগুলোই ভিড়ে ততক্ষণে ঠাসা হয়ে গেছে। আরও লোক গিয়ে বাদুড়ঝোলা হয়ে ঝুলছে। অবস্থা দেখে দমে গেলুম। ঘুমঘুমিতলার বাসের খোঁজ যার কাছে নিচ্ছি, সে-ই বলছে,–ওপাশে দেখুন।
আমার কাঁধে প্রকাণ্ড ব্যাগ আর হাতে ব্রিফকেস। আমার বাসটারও যদি ওইরকম অবস্থা হয়, কেমন করে আমি তাতে চাপব বুঝতে পারছিলাম না। সেইসময় বেঁটে গোলগাল চেহারার ধুতি-পাঞ্জাবিপরা এক ভদ্রলোককে দেখতে পেলুম। তাঁর কাঁধে একটা কাপড়ের নকশাকাটা ব্যাগ। তিনি একপ্রান্তে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন। মাথায় টাক। মুখে কেমন একটা হাসি। তার কাছে গিয়ে খোঁজ করতেই তিনি সহাস্যে বললেন,–একটু অপেক্ষা করুন। খবর নিয়েছি। যন্তর বিগড়ে জয় মা তারা এখন মানুবাবুর গ্যারাজে আছে। মিস্তিরিরা হাত লাগিয়েছে। বুঝলেন না? একটা ট্রিপ ফেল করলে মালিকের হেভি লস!
বুঝলুম, বাসটার নাম জয় মা তারা। ভদ্রলোকের সঙ্গে ভাব জমানোর চেষ্টা করলুম।–আপনি কোথায় যাবেন?
ভদ্রলোক মুচকি হেসে বললেন, আপনি যেখানে যাবেন। তা মশাইয়ের আসা হচ্ছে কোত্থেকে?
–কলকাতা থেকে।
–ঘুমঘুমিতলায় কাদের বাড়ি যাওয়া হবে?
–চাটুজ্যেমশাইদের বাড়ি। বাড়িটার নাম গিরিবালা ভবন।
–তাই বলুন! অবনী চাটুজ্যে এখন কলকাতায় চলে গেছে। অবনী স্কুলে আমার ক্লাসফ্রেন্ড ছিল। তা–মশাই কি অবনীর আত্মীয়?
–না। অবনীবাবুর ছেলে সন্দীপ আমার বন্ধু।
–সন্দীপ, মানে সানু আপনার সঙ্গে আসেনি?
–সে এখন ব্যস্ত। আমি একা এসেছি।
ভদ্রলোক কেন কে জানে মুচকি হাসলেন। তা ভালো। কালাচাঁদ আছে। গণ্ডগোল পড়লে সে একাই একশো।
একটু চমকে উঠেছিলুম। গণ্ডগোল মানে? কীসের গণ্ডগোল?
ও কিছু না।–বলে ভদ্রলোক রাস্তার দিকে তাকালেন, রেডি হোন! জয় মা তারা আসছে মনে হচ্ছে।
–প্লিজ আমাকে বাসে উঠতে আপনি যদি একটু সাহায্য করেন–
–আলবাত করব। আমার বাল্যবন্ধুর ছেলের বন্ধু আপনি। এক কাজ করবেন। আপনি আমার পেছনে আঠার মতো সেঁটে থাকবেন। ছেড়ে গেলেই বিপদ। সেঁটে থাকলে দেখবেন, ঠিক বাসের মধ্যিখানে পৌঁছে গেছেন। আগে থেকে সাবধান করে দিলুম।
একটা খালি বাস হর্ন দিতে দিতে এসে দাঁড়ানোমাত্র আমি সত্যিই খালি বাঁ-হাত দিয়ে ভদ্রলোকের পেটের দিকটায় জড়িয়ে ধরেছিলুম। তারপর যেন ঝড় প্লাবন মহাপ্রলয়ের মধ্যে দিয়ে অসহায় হয়ে প্রায় ভেসেই চললুম। এরপর কী ঘটল বুঝলুম না। একসময় দেখলুম, আমি সেই ভদ্রলোকের পাশে চিঁড়েচ্যাপ্টা হয়ে বসে আছি।
নাঃ! কাঁধের প্রকাণ্ড ব্যাগটা ঠিকই আছে। তবে ভদ্রলোকের পেটের ওপর আছে, এই যা। হাতের ব্রিফকেস দু-পায়ের ফাঁকে কখন ঢুকে গেছে। ভদ্রলোক শাসপ্রশ্বাসের মধ্যে বলে উঠলেন,–জয় মা তারা!
আমিও মনে মনে বললুম,–জয় মা তারা!
বাসটার মধ্যে মানুষ আর জিনিস ঠেসে প্রায় দলা পাকিয়ে আছে। পিঠে খোঁচা খেয়ে অতিকষ্টে মুখ ঘুরিয়ে দেখলুম, বাইরে বাদুড়ঝোলা হয়ে লোকেরা ঝুলছে। ভেতরের লোকেরা চ্যাঁচিচ্ছে–বাস চালাও! বাস চালাও!
বাসের ছোকরা অ্যাসিস্ট্যান্ট বাসের গায়ে থাপ্পড় মেরে হাঁক দিচ্ছে–ছেড়ে গেল! ছেড়ে গেল! বেলতলা! তেলতলা! ঝুমঝুমিতলা! ঘুমঘুমিতলা!
যাত্রীদের চ্যাঁচিমেচিতে অবশেষে বাসের চাকা গড়াল। কিন্তু এ যে দেখছি ভূমিকম্প হচ্ছে যেন! প্রচণ্ড ঝাঁকুনি আর মাঝে-মাঝে কেমন গোগো গরর-গরর বিদঘুঁটে শব্দ। জানালার বাইরে মানুষের মাথা। বাইরে কিছু দেখা যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ পরে সঙ্গী ভদ্রলোককে জিগ্যেস করলুম,–পৌঁছুতে কতক্ষণ লাগবে?
তিনি হাই তুলে বললেন, রাস্তার বেহাল অবস্থা। দু-ঘণ্টাও লাগতে পারে। তিন ঘণ্টাও লাগতে পারে। চিন্তা করবেন না। জয় মা তারা।
বলে তিনি চোখ বুজলেন এবং তার চিবুকটা বুকে বসে গেল। ঘুমিয়ে পড়লেন নাকি?
খানাখন্দে পড়ে বাসের চাকা অদ্ভুত শব্দ করছে। বাসের গতি মন্থর। তারপর লক্ষ করলুম, সেই অ্যাসিস্ট্যান্ট চিৎকার করে উঠছে। শুধু তলা শব্দটাই বুঝতে পারছি। আর বাসটা থেমে যাচ্ছে। ভাবছি, এই বুঝি বাস খালি হল। কিন্তু যতজন নামছে, তার বেশি উঠছে। জোর ধস্তাধস্তি ধাক্কাধাক্কি ঝগড়া চলেছে দু-পক্ষের মধ্যে। অবশেষে আমার চোখ বুজে এল। কী আর করা যাবে? লেখার স্বার্থে এই কষ্টটা না করে উপায় নেই। কষ্ট না করলে কি কেষ্ট মেলে?…
একসময় সঙ্গী ভদ্রলোকের খোঁচা খেয়ে চোখ খুলতে হল। তিনি আমার ব্যাগটা আমার কোলে ঠেলে দিয়ে জয় মা তারা বলে উঠে দাঁড়ালেন। বাসে তখনও যথেষ্ট। ভিড়। আমিও ভদ্রলোকের দেখাদেখি উঠে পড়লুম এবং জনাতিনেক লোক আমাদের সিটে তখনই সশব্দে বসে পড়ল। তারপর ঠেলাঠেলি করে ভদ্রলোকের পিঠে আগের মতো সেঁটে থেকে দরজার দিকে এগিয়ে গেলুম।
এতক্ষণে দেখতে পেলুম, দরজার ধারে দাঁড়িয়ে কন্ডাক্টার টিকিটের পয়সা নিচ্ছে। ভদ্রলোককে তিন টাকা দিতে দেখে আমিও তা-ই দিলুম। অ্যাসিস্ট্যান্ট তলা তলা বলে চ্যাঁচিচ্ছিল। কোন তলা তা বোঝা যাচ্ছিল না। অবশেষে বাস থামল। ভদ্রলোকের সঙ্গে আমিও নেমে গেলুম। কিন্তু আর কোনও যাত্রী নামল না। বাসটা চলে গেল।
গাছের নিচে আবছা আঁধারে দাঁড়িয়ে দেখি, ভদ্রলোক এগিয়ে যাচ্ছেন। কাছে গিয়ে বললুম,–ওঃ! একটা সাংঘাতিক অভিজ্ঞতা হল বটে! তবে আপনি না থাকলে–
ভদ্রলোক আমাকে থামিয়ে খাক শব্দে হেসে বললেন,–আরে কী কাণ্ড! আপনিও এই স্টপে নেমে পড়েছেন দেখছি।
অবাক হয়ে বললুম,-কেন? আপনিও তো ঘুমঘুমিতলায় নামবেন বলছিলেন।
–কী বিপদ! এটা তো ঝুমঝুমিতলা স্টপ! আপনি শোনেননি ঝুমঝুমিতলা বলে চ্যাঁচিচ্ছিল?
–সে কী! এটা ঝুমঝুমিতলা?
–হ্যাঁ, মশাই! এই আক্রাগণ্ডার বাজারে খামোকা বাড়তি পঞ্চাশ পয়সা খরচ করতে যাব কেন? ঘুমঘুমিতলা এই স্টপ থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটার। ওই দেখুন! চাঁদমামা উঠেছে। জ্যোৎস্নায় এটুকু পথ হাঁটতে-হাঁটতে পদ্য রচনা করব। আমি একজন কবি। বুঝলেন তো?
এ কোন পাগলের পাল্লায় পড়লুম? কিন্তু যা হওয়ার হয়ে গেছে। তাই বললুম,–দেড় কিলোমিটার জ্যোৎস্নায় হাঁটতে-হাঁটতে কল্পনাশক্তি জাগারই কথা। তা আপনি কবি?
–বলতে পারেন বইকী! স্কুলের ম্যাগাজিনে পদ্য ছাপা হতো। এখন মফস্বল শহরের পত্রিকাতেও ছাপা হয়। খানকতক পদ্য দিতেই তো হিংলাডিহি গিয়েছিলুম।
–এবার আপনার নামটা জানতে পারি?
–আমার নাম তারাচরণ যশ। আপনার বন্ধু সানু আমার পদ্য শুনে বলেছিল, যদি কখনও পত্রিকা করি, আপনার পদ্য সবার আগে ছাপব যশকাকা!
দেড় কিলোমিটার পথ হাঁটতে কথা বলাই ক্লান্তি থেকে বাঁচবার একমাত্র উপায়। তাই বললুম,–আমিও তাহলে আপনাকে যশকাকা বলব!
–বলুন! ইচ্ছে যখন হয়েছে, তখন বলুন।
–আচ্ছা যশকাকা, সানুদের বাড়িতে কী গণ্ডগোলের কথা বলছিলেন?
–এখন এই নিরিবিলি রাস্তায় রাত্রিকালে ওকথা বলা উচিত না।
–ভূতপ্রেতের গণ্ডগোল নয় তো?
তারাচরণ যশ থমকে দাঁড়ালেন।–রাম! রাম! রাম! পেছনে ঝুমঝুমিতলা। একটা বটগাছ আছে ওখানে। রাতবিরেতে পেতনি ঝুমঝুম শব্দে নূপুর বাজিয়ে নাচে। কাজেই রাম রাম রাম।
তিনি আবার পা বাড়ালেন। বললুম,–ঠিক আছে। আপনার একটা পদ্য শোনান বরং।
যশবাবু হাসলেন। কদিন থেকে একটা পদ্য লিখছি। তবে শেষ লাইনটা কিছুতেই মেলাতে পারছি না। বড় সমস্যায় পড়েছি। আপনি তো কলকাতায় থাকেন। শিক্ষিত মানুষ। একটু সাহায্য করতে নিশ্চয় পারবেন।
বেঁকের বশে বলে ফেললুম, আমি আগে পদ্যই লিখতুম। এখন অবশ্য গদ্য লিখি। শারদীয়া সংখ্যা পত্র-পত্রিকায় লেখার জন্যই নিরিবিলি জায়গা খুঁজছিলুম। সন্দীপ ওদের গ্রামের বাড়ির কথা বলল। তাই চলে এলুম।
যশবাবু যেন লাফিয়ে উঠলেন। বলেন কী? মশাইয়ের নাম?
নামটা বানিয়ে বলতে হল। আমার নাম কল্লোল গুপ্ত।
–বাঃ! অপূর্ব নাম! শুনেছি-শুনেছি মনে হচ্ছে। আপনার লেখাও পড়েছি মনে হচ্ছে।
–আপনি না বলে তুমি বললেই খুশি হব যশকাকা।
যশবাবু খুশি হয়ে বললেন,–তাই বলছি। তা–তুমি যখন পদ্য লিখতে একসময়, তখন তুমিই আমার অসমাপ্ত পদ্যটার একটা হিল্লে করতে পারবে। তাহলে বলি পদ্যটা?
–বলুন!
যশবাবু গলা ঝেড়ে চাঁদের দিকে তাকিয়ে সুর ধরে বললেন,–
পাতুবাবু ছাতু খান অতি আহ্লাদে
জল্লাদ ধরে নিয়ে যায় প্রহ্লাদে
রামবাবু রেগে লাল
সন্দেশে কেন ঝাল…
এবার যশবাবু থেমে গেলেন। শ্বাস ছেড়ে বললেন,–শেষ লাইনটা মেলাতে হবে প্রথম লাইনের সঙ্গে। কিন্তু আদে, প্রহ্লাদের সঙ্গে মিলবে এমন কোনও শব্দই খুঁজে পাচ্ছি না।
একটু ভেবে নিয়ে বললুম,–
পাতুবাবু ছাতু খান অতি আহ্লাদে
জল্লাদ ধরে নিয়ে যায় প্রহ্লাদে
রামবাবু রেগে লাল
সন্দেশে কেন ঝাল
ঝাল মেপে দেখি ওরে দাঁড়িপাল্লা দে।
যশবাবু এবার সত্যিই লাফিয়ে উঠলেন।–বাঃ! ঝাল মেপে দেখি ওরে দাঁড়িপাল্লা দে! অপূর্ব! ঝাল মেপে দেখি ওরে দাঁড়িপাল্লা দে! মুখস্থ করি। ঝাল মেপে দেখি ওরে দাঁড়িপাল্লা দে! এক্ষুনি বাড়ি গিয়ে লিখে ফেলতে হবে। নইলে ভুলে যাব। ঝাল মেপে দেখি ওরে দাঁড়িপাল্লা দে। ঝাল মেপে দেখি ওরে দাঁড়িপাল্লা দে! ঝাল মেপে দেখি ওরে–শর্টকাটে যাইরে! দাঁড়িপাল্লা দে।
সুর ধরে বলতে-বলতে তারাচরণবাবু বাঁ-দিকে ঘন কালো রঙের মধ্যে দৌড়ে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম। একটু পরে বুঝতে পারলুম, ওটা একটা আমবাগান। শর্টকাটে আমবাগানের ভেতর দিয়ে উনি বাড়ি গিয়ে এখনই লাইনটা লিখে ফেলবেন। কিন্তু কেন যে সন্দীপের ভূতভুতুম পত্রিকার কথাটা বলিনি। বললে উনি আমাকে গিরিবালা ভবনে পৌঁছে দিতেন।
নিজের বোকামিতে রাগ হচ্ছিল। ঘুমঘুমিতলায় কালাচাঁদখুডোর থাকার কথা। এখনও সেটা কতদূরে কে জানে!
কয়েক পা এগিয়েছি, হঠাৎ পাশের একটা গাছের ছায়া থেকে কেউ রাস্তায় এসে করজোড়ে প্রণাম করে বলল, মশাই কি কলকাতা থেকে আসছেন? মশাই কি সানুবাবুর বন্ধু?
বললুম, —হ্যাঁ। তুমি কি কালাচঁদ-খুড়ো?
জ্যোৎস্নায় লোকটাকে ছায়ামূর্তি বলে মনে হচ্ছিল। সে বলল, আজ্ঞে না। আমি কালাচাঁদ না। গোরাচাঁদ। কালাচাঁদের মাসতুতো ভাই। কই দিন আপনার মালপত্তর। আমি বয়ে নিয়ে যাই। আপনি আরামে হেঁটে আসুন।
গোরাচাঁদকে আমার কাঁধের ব্যাগ দিলুম। হাতের ব্রিফকেসটা সে প্রায় ছিনিয়ে নিল। কিন্তু সে এমনভাবে হাঁটতে থাকল যে আমি তার সঙ্গ ধরতে হাঁপিয়ে উঠছিলুম। তাই বললুম,–ও গোরাঠদখুড়ো! একটু আস্তে হাঁটো। এই খানাখন্দে ভরা রাস্তায় আছাড় খাব যে!
গোরাচাঁদ গতি কমিয়ে মুখ ঘুরিয়ে হাসল। জ্যোৎস্নায় মানুষের দাঁত কি অত চকচক করে? সে সহাস্যে বলল, আমাকেও খুড়ো বলছেন? বাঃ! আপনি খুব ভালো লোক। কালাচাঁদকে গ্রামের সব্বাই খুড়ো বলে। আমাকে কেউ খুড়ো বলেনি।
–আচ্ছা গোরাচাঁদখুড়ো, তারাচরণ যশমশাইকে তো তুমি চেনো।
–খুব চিনি। চিনি বলেই তো গাছপালার ছায়ার আড়ালে চুপিচুপি হাঁটছিলুম।
–কেন?
–আজ্ঞে ওঁর পদ্য শোনার ভয়ে। গত আশ্বিন মাসে এক রাত্তিরে একশো একখানা পদ্য শুনিয়ে ছেড়েছিলেন। অগত্যা কী করব? আমিও ওঁকে বাবা! নামটি আমার গোরাচাঁদ।
রসিকতা করে বললুম,–পাতব শেয়াল ধরার ফাঁদ। কাঁদবে শেয়াল হুক্কাহুয়া। যশমশাই ধরবে ধুয়া, ক্যা হুয়া ক্যা হুয়া?
গোরাচাঁদ থমকে দাঁড়িয়ে তেমনই চকচকে দাঁতে হাসল।–ওরে বাবা। আপনি যে যশমশাইয়ের কত্তাবাবা দেখছি! বাঃ। আমি এবার যশমশাইকে ছড়াটা শুনিয়ে ছাড়ব। এখনও, উনি বাড়ি পৌঁছুতে পারেননি।
বলে সে সুর ধরে আওড়াল :
নামটি আমার গোরাচাঁদ
পাতব শেয়াল ধরার ফাঁদ
কাঁদবে শেয়াল হুক্কা হুয়া
যশমশাই ধরবে ধুয়া
ক্যা হুয়া ক্যা হুয়া।।
তারপর আমাকে হতবাক করে সে এই ছড়াটা সুর ধরে বলতে বলতে রাস্তার বাঁ-দিকে গাছপালার ভেতর উধাও হয়ে গেল। সম্বিত ফিরে পেয়ে চিৎকার করে ডাকলুম,–গোরাচাঁদ খুড়ো! গোরাচাঁদ-খুড়োয়
তখনও তার ছড়াটা শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু কেমন যেন খ্যানখেনে গলার স্বর। এবার আমার মনে হল, সর্বনাশ! লোকটা ছিনতাইবাজ! চালাকি করে আমার ব্যাগ আর ব্রিফকেস হাতিয়ে নিয়ে পালিয়ে গেল।
সে যেদিকে গেছে, সেদিকে ছুটে গিয়ে তাকে ধরে ফেলা আমার পক্ষে অসম্ভব। তাই হন্তদন্ত হয়ে হাঁটতে থাকলুম। একটু পরে সামনে টর্চের আলো জ্বলে উঠল। তারপর আলোটা আমার ওপর এসে পড়ল। এবার বোধহয় ডাকাত আসছে। আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠলুম, কালাচাঁদ খুড়ো! কালাচাঁদ-খুড়ো!
ভারী গলায় লোকটা বলে উঠল, মশাই কি সানুবাবুর বন্ধু? মশাই কি কলকাতা থেকে আসছেন?
এ-ও যে গোরাঠাদের ভঙ্গিতে কথা বলছে। বললুম, হ্যাঁ। তুমি কে?
টর্চ নিভিয়ে লোকটা করজোড়ে প্রণাম করে বলল, আজ্ঞে আমিই কালাচাঁদ। বাসস্টপে আপনার জন্যে দাঁড়িয়ে ছিলুম। বাস চলে গেল। আপনি নামলেন না। তারপর আমার মনে হল, বাবুমশাই তো এ তল্লাটে নতুন আসছেন। ভুল করে ঝুমঝুমিতলায় নেমে পড়েননি তো? তাই দেখতে আসছিলুম। হঠাৎ কানে এল কেউ গোরাচাঁদ খুড়ো বলে চ্যাঁচিচ্ছে।
বললুম,–আমিই চ্যাঁচিচ্ছিলুম কালাচাঁদ-খুড়ো! গোরাচাঁদ আমাকে বলল, সে তোমার মাসতুতো ভাই। তুমিই তাকে আমার খোঁজে পাঠিয়েছ।
–কী বিপদ! তা আপনার মালপত্তর কই?
–গোরাচাঁদ-খুড়ো নিয়ে পালিয়ে গেল!
কালাচাঁদ ক্রুদ্ধস্বরে বলল, ওরে হতচ্ছাড়া। দেখাচ্ছি মজা। কথায় বলে না? স্বভাব যায় না মলে! স্বভাব বাবুমশাই!
–স্বভাব যায় না মলে মানে?
–এখন ওসব কথা থাক। চলুন। সানুদের বাড়ি এখান থেকে কাছে। আমার সঙ্গে আসুন।
সে পায়ের কাছে টর্চের আলো ফেলে হাঁটতে থাকল। বাঁ-দিকে একটা অনাবাদি মাঠের পথে আমরা হেঁটে যাচ্ছিলুম। যেতে-যেতে এতক্ষণে দেখলুম, কালাচাঁদের একহাতে লাঠি আছে। আবার ভয় পেলুম। লাঠির ঘায়ে আমাকে মেরে মানিব্যাগ হাতিয়ে নেবে না তো? এ কি সত্যি সন্দীপদের বাড়ির কেয়ারটেকার কালাচাঁদ? নাকি কোনও ডাকাত? নিরিবিলি জায়গায় নিয়ে গিয়ে লাঠি তুলবে। আমি তৈরি হয়ে হাঁটছিলুম। কিছুক্ষণ পরে একটা পুকুরের পাড়ে উঠে সে বলল,–এই পুকুরটা সানুদের। ওই দেখুন ওদের বাড়ি।
দোতলা বাড়িটাতে বিদ্যুতের আলো জ্বলছে দেখে সাহস ফিরে পেলুম। বললুম,–ঘুমঘুমিতলায় ইলেকট্রিসিটি আছে দেখছি।
–আজ্ঞে ঠা। বছর তিনেক হল ইলেকটিরি এসেছে।
জোরে শ্বাস ছেড়ে বললুম,–কিন্তু আমার ব্যাগ আর ব্রিফকেসের কী হবে। খুড়ো?
কালাচাঁদ হাসল। আজ্ঞে ও নিয়ে ভাববেন না। গোরাচাঁদ আমাকে খুব ভয় করে। বলে সে চেঁচিয়ে উঠল,–অ্যাই হতচ্ছাড়া! বাবুমশাইয়ের মালপত্তর দোতলার ঘরে রেখে তবে যে চুলোয় যাবি যা! নইলে এক্ষুনি মোনা-ওঝাকে ডেকে আনব। সেদিনের মতো তোকে সে তালগাছের ডগায় দাঁড়কাক করে বসিয়ে রাখবে।
গোরাচাঁদকে আমি দেখতে পাচ্ছিলুম না। পুকুরের পাড়ে অজস্র তালগাছ। পশ্চিমপাড় দিয়ে ঘুরে গিরিবালা ভবনের গেটে পৌঁছেছি, হঠাৎ দেখলুম একটা ছায়ামূর্তি বাড়ির পূর্বদিকে উধাও হয়ে গেল। কালাচাঁদ গেটের তালা খুলে বলল,–এ গ্রামে চোর-ডাকাত নেই বাবুমশাই! গোরাচাঁদেরও চুরি-ডাকাতি করা স্বভাব ছিল না। স্বভাব বলতে শুধু একটা। জোছনা-রাত্তিরে টো-টো করে ঘুরে বেড়ানো। আর তালগাছের ডগায়–
কথা শেষ না করে সে আমাকে দোতলায় পূর্বের একটা ঘরে নিয়ে গেল। তারপর জানালাগুলো খুলে দিয়ে বলল,–উত্তরে পুকুর। জোছনায় পুকুরের জলকেমন ঝিলমিল করছে দেখুন। পুকুরে মাছ আছে। কাল জেলে ডেকে এনে মাছ ধরাব।
উঁকি মেরে দেখে ভালো লাগল। তারপরই চোখে পড়ল আমার পাশেই টেবিলের ওপরে আমার ব্যাগ আর ব্রিফকেস রাখা আছে। ঘর তো তালাবন্ধ ছিল। ব্যাপারটা যে দেখছি একেবারে ভুতুড়ে!
কালাচাঁদ হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল ফের,–অ্যাই হনুমান! তালগাছের ডগায় আবার চড়েছিস?
আবার উঁকি মেরে কিছু দেখতে পেলুম না। কিন্তু তারপরই পুকুরের জলে ঝপাং করে কেউ ঝাঁপ দিল। বললুম,–কেউ যেন জলে ঝাঁপ দিল কালাচাঁদ-খুড়ো! গোরাচাঁদ নাকি?
আজ্ঞে হ্যাঁ। কথায় বলে, স্বভাব যায় না মলে! বলে কালাচাঁদ আমার দিকে ঘুরল।– বাবুমশাই! আপনি বাথরুমে গিয়ে হাতমুখ ধোন। ওই দেখুন বাথরুম। আমি আপনার জন্য চায়ের ব্যবস্থা করি।
সে রাতে আর কোনও গণ্ডগোল ঘটেনি। তবে শুয়ে পড়ার পর পুকুরের জলে কিছুক্ষণ অন্তর বারদুয়েক ঝপাং করে কার ঝাঁপিয়ে পড়ার শব্দ শুনেছি। কেউ তালগাছের ডগা থেকে পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ছিল তা ঠিক। গোরাচাঁদ নাকি?
ভোরে কালাচাঁদের ডাকে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। সে কথামতো বেড-টি এনেছিল। চা খেতে-খেতে ওকে গোরাচাঁদের ব্যাপারটা জিগ্যেস করেছিলুম। কালাচাঁদ হাসতে-হাসতে বলেছিল,–ওকে নিয়ে চিন্তার কারণ নেই বাবুমশাই। মোনা-ওঝার নাম করেছি। আর হতচ্ছাড়া আপনার কাছে ঘেঁষবে না। বরং একটুখানি বাইরে ঘুরে জায়গাটা দেখে আসুন। ভালো লাগবে। আমি বাজারে যাই। খুঁজে পেলে মোনা ওঝাকেও ডেকে আনব। চিন্তা করবেন না।
সত্যি ঘুমঘুমিতলার প্রাকৃতিক পরিবেশ সুন্দর। গিরিবালা ভবনের কাছাকাছি কোনও বাড়ি নেই। ঝোঁপঝাড়, জঙ্গলে লাল ফুলের শোভা আর পাখির ডাক শুনে আমার মগজের কল্পনাযন্ত্রটি চালু হয়ে গেল। বাড়ি ফিরেই লিখতে বসলুম। কালাচাঁদ তখনও ফেরেনি।
কয়েক লাইন লিখেছি, নিচে কার হাঁকডাক শোনা গেল। কালাচাঁদ! ও কালাচাঁদ-খুড়ো! আমাদের মহামান্য লেখকমশাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে এলুম। যা বাবা! গেল কোথায় কালাচাঁদ! ও কল্লোলবাবু!
বিরক্ত হয়ে কাগজ কলম রেখে বারান্দায় গেলুম। তারাচরণ যশমশাইকে দেখতে পেলুম। তাঁর হাতে একটা সুটকেস।
একটু পরে তারাচরণ যশ উঠে এসে সুটকেস হাতেই নমস্কার করে সহাস্যে বললেন, আপনি আমার কী যে উপকার করেছেন! পদ্যটা যে শুনছে, সেই বলছে খাসা পদ্য।
বলে তিনি বারান্দার মেঝেতেই বসে পড়লেন। বললুম, আহা! ওখানে কেন? ঘরে চলুন।
না মশাই! ঘরে বসে পদ্য জমবে না। বলে তিনি সুটকেস খুলে একগাদা কাগজ বের করলেন। আপনাকে শোনাব বলে এনেছি। ভুল থাকলে শুধরে দেবেন। আপনি বরং ওই চেয়ারে বসুন। আমি শুরু করি।
সর্বনাশ! এ তো ভূতুড়ে উৎপাত নয়। মানুষের উৎপাত। এ উৎপাত ভূতের চেয়ে সাংঘাতিক। অতগুলো পদ্য শুনতে হলে সারাটা দিন কেটে যাবে। সন্দীপ কেন এসব লোকের কথা আমাকে বলেনি?
যশমশাই কাগজের সাজানো স্তূপ মেঝেয় রেখে মুচকি হেসে বললেন, বলতে ভুলে গেছি। গতকাল সন্ধ্যায় সে এক কাণ্ড। হঠাৎ হতচ্ছাড়া গোরাচাঁদ গিয়ে আমার পথ আটকে বলল, এবার তার পদ্য শুনতে হবে। বেগতিক দেখে মোনা-ওঝার নাম করে শাসালুম। তখন কেটে পড়ল। গোরাচাঁদ ওই পুকুরের ধারে বেঁকে থাকা একটা তালগাছের ডগায় চেপেছিল। বুঝলেন? এই তো গত মাসের কথা। ওর মাথায় ছিট হল। তারপর কী করে তালগাছের ডগা থেকে পুকুরের ঠান্ডা জলে পড়ে অক্কা। অক্কা বোঝেন তো? পৌষমাসে এখানে প্রচণ্ড ঠান্ডা পড়ে। পুকুরের ঠান্ডা জলে পড়ে– ব্যস! গোরাচাঁদকে যখন ভোলা হল, তখন সে মড়া। পেটে জলভরা ঢোল মড়া! যাকগে ও কথা। শুরু করি।
এ বিপদের মুহূর্তে চোখ বুজে মনে-মনে যশমশাইয়ের মতো বললুম,–জয় মা তারা। কিন্তু তাতেও কাজ হল না। যশমশাই সগর্জনে পদ্য–আসলে ছড়াপাঠ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। মাথামুন্ডু বোঝা যাচ্ছিল না। এই উৎপাত থেকে বাঁচবার জন্য শেষে মরিয়া হয়ে উঠেছিলুম। মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল,–গোরাচাঁদ-খুড়ো! বাঁচাও!
অমনি এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেল। দক্ষিণ থেকে একটা জোরালো ঘূর্ণিহাওয়া এসে যশমশাইয়ের কাগজগুলো উড়িয়ে নিয়ে চলল। যশমশাই আর্তনাদ করলেন, হায়! হায়! এ কী হল, মা গো!
ততক্ষণে কাগজগুলো শুন্যে ঘুরপাক খেতে-খেতে পূর্বদিক ঘুরে উত্তরে পুকুরের জলে গিয়ে পড়ছিল। অবশ্য পরে তা দেখেছিলুম। এদিকে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে তারাচরণ যশ বারান্দা থেকে লাফ দিয়ে তার পদ্যের কাগজ ধরতে যাচ্ছিলেন। আমি তাকে টেনে ধরেছিলুম। তা না হলে উনি দোতলা থেকে নিচে পড়ে নির্ঘাত মারা যেতেন!
বাধা পেয়ে তিনি সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলেন। তাকে অনুসরণ করলুম। কালার্টাদ তখনও ফেরেনি। যশবাবুর সঙ্গে খিড়কির দরজা দিয়ে পুকুরের ঘাটে গেলুম। দেখলুম, তার পদ্যলেখা কাগজগুলো সবই ঘেঁড়া পাতার মতো জলে ভাসছে। ঘূর্ণি হাওয়াটা তখনও জলকে তোলপাড় করছে। তাই কাগজগুলো উল্টেপাল্টে ভিজে গিয়ে ডুবে যাচ্ছে।
যশমশাই জলে ঝাঁপ দিতে যাচ্ছিলেন। তাকে দু-হাতে চেপে ধরে বললুম, বরং মোনাওঝাকে ডাকুন যশমশাই!
উনি এবার চেঁচিয়ে উঠলেন,–মোনা-ওঝা কোথায় আছিস রে? ওরে মোনা, শিগগির আয় রে।
পেছনে কালাচাঁদের ডাক শোনা গেল।–যশমশাই। কী হয়েছে?
–আমার সর্বনাশ করেছে গোরাচাঁদ ব্যাটাছেলে! দেখে যা কালাচাঁদ!
কালাচাঁদ ঘাটে এল। তার সঙ্গে একজন জটাজুটধারী লোক। তার হাতে ত্রিশূল। কপাল সিঁদুরে লাল। কালাচাঁদ বলল,-বাজার করে মোনাকে ডেকে নিয়ে এলুম। কেননা হতচ্ছাড়া হনুমান গোেরাচাঁদ কলকাতার বাবুমশাইকে জ্বালাতন করতে পারে। মোনা। শীগগির ওকে সেদিনকার মতো দাঁড়কাক করে দাও।
মোনা-ওঝা লাল চোখে ওপারের তালগাছের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে যন্ত্র পড়তে থাকল। তারপর কী অদ্ভুত ব্যাপার, সত্যিই একটা দাঁড়কাক একটা তালগাছের ডগায় উড়ে এসে বসল। তারপর কর্কশ স্বরে ডেকে উঠলা! স্খা! অঁাক! খ্রাক! গ্র্যা! গ্র্যা! গ্র্যাক! গ্র্যাক!
মোনা ত্রিশূল তুলে গর্জন করল,–চো-ও-প! মুখ খুললেই আবার অক্কা হয়ে যাবি।
এবার দাঁড়কাকটা স্থির হয়ে বসে রইল। বললুম,–যশমশাই! বাড়ি গিয়ে আবার পদ্য লিখতে বসুন। অন্তত মাস দেড়েক ধরে লিখতে থাকুন। তারপর আমার কাছে নিয়ে আসবেন। শুধরে দেব। আমি এখানে দুটো মাস থাকব।
তারাচরণ যশ খালি সুটকেস হাতে চুপচাপ চলে গেলেন। আমি দোতলার ঘরে গিয়ে এবার নিশ্চিন্ত মনে লিখতে বসলুম। তবে হ্যাঁ-সন্দীপ নতুনরকমের ভূতের কথা বলেছিল। মিলে গেল। ওকে বরং এই ভূত নিয়ে একটা বড় গল্প লিখে দেব। ভূত নিয়ে উপন্যাস লেখা কি সম্ভব আমার পক্ষে? সেটা পেরেছিলেন একমাত্র ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়।…