1 of 2

ভূতের ভয়

ভূতের ভয়

আবার বৃষ্টি নামল। আজ সারাদিন ধরেই বৃষ্টি এই থামে, এই নামে। মেঘের কাজল মেখে আকাশ হারিয়ে ফেলেছে তার নীলিমা। সূর্য কখন উঠেছে আর কখন আস্ত গিয়েছে কেউ জানে না। ময়লা দিনের আলো এবং তারই ভিতরে ধীরে ধীরে ঘনিয়ে উঠছে আসন্ন সন্ধ্যার বিষণ্ণ অন্ধকার।

গঙ্গার ধারে, বাড়ির তেতলার বারান্দায় বসে আছি কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে। নদীর বুকজোড়া বৃষ্টির জলছড়া দেখতে দেখতে দ্বিতীয়বার চায়ের পেয়ালা খালি করলুম। কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ।

একটা দমকা ভিজে বাতাস গায়ের উপরে হুস করে স্যাঁতসেঁতে নিশ্বাস ফেলে চলে গেল। বারান্দার কোণ ঘেঁষে সরে বসে চোখ তুলে দেখি অন্ধকার কখন নিঃশব্দে এসে গ্রাস করে ফেলেছে গঙ্গার ওপারকে। নীল গাছের সার, বেলুড় মঠের গম্বুজ, বালি ব্রিজ ও দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরচূড়া অদৃশ্য।

এপারে আমার বাড়ি ও নদীর মাঝে জনবিরল পথ হঠাৎ মুখরিত হয়ে উঠল। রাম নামের মহিমা কীর্তন করতে করতে একদল হিন্দুস্থানি শবদেহ বহন করে নিয়ে যাচ্ছে।

জনৈক বন্ধু শুধোলেন, ‘হেমেন্দ্র, এ বাড়িতে তুমি একলাই থাকো?’

—‘প্রায় তাই-ই বটে।’

—‘এখান থেকে শ্মশান খুব কাছে?’

—‘হ্যাঁ।’

—‘রোজ রাত্রেই এখান দিয়ে মড়া নিয়ে যায়?’

—‘তা যায়।’

—‘তখন তোমার একলা থাকতে ভয় হয় না?’

হেসে ফেলে বললুম; ‘কীসের ভয়?’

—‘কীসের আবার? ভূতের।’

—‘আমার ভূতের ভয় নেই।’

—‘তুমি ভূত মানো না?’

—‘ঠিক মানি না বলতে পারি না। এ দেশের আর বিদেশের বড়ো বড়ো পণ্ডিতরাও ভূত মানেন। তাঁদের কথা অবিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয় না।’

—‘তুমি তো নিজেও অনেক ভূতের গল্প লিখেছ?’

—‘হ্যাঁ, কাল্পনিক গল্প।’

—‘তুমি কখনও ভূত দ্যাখোনি তো?’

—‘আমার বাবা প্রেতিনী দর্শন করেছিলেন। তাঁর নিজের মুখে সে গল্প শুনেছি। শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব ভূত দেখেছিলেন, তাঁর জীবনী পাঠ করলেই জানতে পারবে।’

—‘কিন্তু তুমি নিজে ভূত দেখেছ?’

—‘ভৌতিক কাণ্ড দেখেছি।’

—‘কী রকম? কোথায়?’

—‘জয় মিত্র স্ট্রিটে। একত্রিশ কি বত্রিশ বৎসর আগেকার কথা। খবরের কাগজেও সেই ঘটনা নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। প্রত্যহ দলে দলে কৌতূহলী লোক ঘটনাস্থলে গিয়ে জনতার সৃষ্টি করত।’

—‘ব্যাপারটা কী?’

—‘ভৌতিক উপদ্রব। চোখের সামনে দেখেছি দুমদাম করে ইষ্টকবৃষ্টি। কিন্তু কে যে ফেলছে কিছুই বোঝা যায় না।’

—‘দুষ্ট লোকের নষ্টামি।’

—‘মোটেই নয়। দিনের বেলা। বাড়ি ঘিরে পুলিশ পাহারা, তবু ইটপড়া বন্ধ হয় না। ঘরের ভিতরে মেঝের উপরে রয়েছে বাসন-কোসন, হঠাৎ সেগুলো জ্যান্ত হয়ে পাখির মতো শূন্য দিয়ে উড়ে আর এক জায়গায় ঝন ঝন করে গিয়ে পড়ল।’

—‘কিন্তু তুমি স্বচক্ষে আসল ভূত দেখেছ কি?’

—‘আসল-নকল জানি না, একবার একটা ব্যাপার দেখেছিলুম!’

এতক্ষণে কিছু হদিশ পেয়ে বন্ধু উৎসাহিত হয়ে বললেন, ‘তাই নাকি? ব্যাপারটা শুনতে পাই না?’

—‘বলছি। কিন্তু এটা বোধহয় ভূতের গল্প নয়।’

—‘ভণিতা ছাড়ো। গল্প বলো।’

আরও জোরে বৃষ্টি এল—ঝম ঝম ঝম ঝম। গঙ্গাজল আর দেখা যায় না, কিন্তু শোনা যায় তার তরঙ্গ তান। এখনও আলো জ্বলেনি, বারান্দায় বন্ধুদের দেহগুলো দেখাচ্ছে ছায়ামূর্তির মতো। একটা নতুন সিগারেট ধরিয়ে চেয়ারের উপরে ভালো করে বসে আরম্ভ করলুম :

তেত্রিশ-চৌত্রিশ বৎসর আগেকার কথা। গঙ্গার ধারে আমার এ বাড়িখানার জায়গায় তখন ছিল খোলা জমি। আমরা বাস করতুম পাথুরিয়াঘাটার পৈতৃক বাড়িতে।

তেতলার ছাদে একপাশে আমার শয়নগৃহ। তার দক্ষিণ দিকের জানালা দিয়ে দেখা যায় বহুদূর পর্যন্ত। জানালার নীচেই একটা হাত দেড়েক চওড়া, কিন্তু বেশ খানিকটা লম্বা খানা—তার ভিতরে ছিল সাপ আর ইঁদুরের বাসা, মাঝে মাঝে সেখানে প্যাঁচারাও আনাগোনা করত।

খানার পরেই পাশাপাশি তিনখানা ছোটো ছোটো পুরানো বাড়ি। পূর্ব দিকের বাড়িখানা এ-পাড়ায় ছিল কুবিখ্যাত। আমাদের বাল্যকালে ও প্রথম যৌবনে বাড়িখানা ছিল পরিত্যক্ত। সবাই বলত সেখানা হানাবাড়ি, ভাড়া নিতে চাইত না। আমার বাবা ওই বাড়ির ছাদের উপরেই গভীর রাত্রে একটি অবগুণ্ঠনবতী নারীমূর্তি দেখেছিলেন। কিন্তু তাকে ধরতে গিয়েও ধরতে পারেননি—তাঁর চোখের সামনেই মিলিয়ে গিয়েছিল মূর্তি!

আমি যখন তেতলার ওই ঘরে গিয়ে বাসা বাঁধি, তখন বাড়িখানা সংস্কার করে ভাড়া দেওয়া হয়েছিল, যদিও রাত্রে সবাই তার দিকে সন্দিগ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করত। আমি কিন্তু বহু বৎসরেও সে বাড়ি থেকে সন্দেহজনক কিছুই আবিষ্কার করতে পারিনি।

তবে একদিনের ব্যাপারের কথা মনে আছে। আমার অভ্যাস ছিল ঘুমের আগে অন্তত মধ্যরাত্রি পর্যন্ত লেখাপড়া করা! সেদিনও তাই করছিলুম। রাত বারোটা বাজে—চারিদিক নিঝুম। আচম্বিতে সেই স্তব্ধতা বিদীর্ণ ও আকাশ-বাতাস স্তম্ভিত করে অপার্থিব নারীকণ্ঠে জেগে উঠল তীব্র ও প্রচণ্ড ক্রন্দনস্বর! তেমন ভয়াবহ চিৎকার জীবনে আর কখনও আমি শুনিনি—আমার সর্বাঙ্গ যেন আচ্ছন্ন হয়ে গেল। মাত্র একবার সেই বীভৎস কান্না শোনা গিয়েছিল বটে, কিন্তু তা শুনতে পেয়েছিল পাড়ার সমস্ত লোক। এ পাড়ায় সকলেই আমার আত্মীয়-কুটুম্ব। পরদিন সকালে উঠে খোঁজ-খবর নিয়ে বুঝলুম, কোনো বাড়ি থেকে কোনো নারীই কাল রাত্রে অমন করে ক্রন্দন করেননি। সকলেই মত প্রকাশ করলেন, আওয়াজটা এসেছিল আমাদের বাড়ির পাশের খানার ভিতর থেকেই। আমিও এই মতে সায় দিতে বাধ্য হলুম বটে কিন্তু মধ্যরাত্রে খানার ঘুটঘুটে অন্ধকারে বসে কোনো নারী যে অমন ভয়ানকভাবে কেঁদে উঠবে, এটাও সম্ভবপর বলে মনে হল না। আজ পর্যন্ত এই ক্রন্দন-রহস্যের কোনো হদিশ পাইনি।

অতঃপর যে ঘটনার কথা বলব তারও উৎপত্তি ওই খানার ভিতরেই।

সে রাত্রে ভারী গুমোট। বাইরে চাঁদ আলো ঢালছে বটে, কিন্তু বাতাসের শ্বাস একেবারে রুদ্ধ হয়ে গেছে। রাত দুটো বেজে গিয়েছে, তবু চোখে নেই ঘুম, বিছানায় পড়ে আই-ঢাই করছি।

পাশ ফিরে পাশবালিশটা জড়িয়ে ধরে দক্ষিণের জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালুম। ধবধবে জ্যোৎস্নায় ছাদের পর ছাদ ভেসে যাচ্ছে। চাঁদের আলোর ভিতরে যে ঠান্ডার আমেজটুকু আছে, এই দারুণ গুমোটে তা মনের ভিতরে গ্রহণ করবার চেষ্টা করলুম।

হঠাৎ আমার চোখ দুটো উঠল বিষম চমকে! খানার দিক থেকে জাগল দু-খানা ছোটো ছোটো হাত, তারপর চেপে ধরলে জানালার দুটো গরাদে। তারপরই দেখা গেল একটা মাথা এবং তারপরেই সমস্ত দেহটা। একটা পাঁচ-ছয় বৎসরের শিশুর দেহ! বিশেষ করে কিছুই বুঝতে পারলুম না, কারণ বাইরের চাঁদের আলোর দিকে পিছন ফিরে ছিল বলে দেহটাকে দেখাচ্ছিল যেন ঘোর কালো অন্ধকার দিয়ে গড়া।

জানালার মাঝামাঝি যে আড়াআড়ি কাঠ থাকে, মূর্তিটা তার উপরে উবু হয়ে বসল, তারপর ঊর্ধ্বোত্থিত দুই হাত দিয়ে গরাদ ধরে বোধহয় আমার পানেই তাকালে—বেশ দেখতে পেলুম তার অগ্নিময় চোখদুটো! তিন কি চার সেকেন্ড সে স্থিরভাবে বসে রইল। তারপর জানালার গরাদে ছেড়ে দেওয়াল ধরে উপর দিকে অদৃশ্য হয়ে গেল।

আমি ভীরু নই কোনোকালেই, তবু বুকের ভিতরটা ছমছম করে উঠল বইকি! প্রায় মিনিটখানেক ধরে কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মতো চুপ করে বসে রইলুম বিছানার উপর। তারপরই নিজেকে সামলে নিয়ে চট করে উঠে পড়লুম এবং ঘরের কোণ থেকে একগাছা লোহা-বাঁধানো লাঠি নিয়ে দরজা খুলে ঘরের বাইরে গিয়ে দাঁড়ালুম।

পরিষ্কার চাঁদের আলো। চারিদিকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কেউ নেই কোথাও। তেতলার ছাদে উঠলুম। মূর্তিটার এইখানেই আসবার কথা। সেখানেও কেউ নেই।

কী বলছ? আমি বানরের মূর্তি দেখেছি? প্রথমে আমারও সেই সন্দেহ হয়েছিল। কিন্তু মূর্তিটা বানরের মতো ছোটো হলেও বানর নয়। কারণ, প্রথমত, জলভরা অন্ধকার খানায় বানর থাকে না। দ্বিতীয়ত, বানররা নিশাচর জীব নয়। তৃতীয়ত, জানালার উপর ছিল মসৃণ দেওয়ালের অনেকখানি, তাই বলে কোনো বানরই টিকটিকি কি মাকড়সার মতো উপরে উঠতে পারে না।

তবে সেটা কী? জানি না। তারপরেও ওই ঘরে কাটিয়েছি অনেক বৎসর, কিন্তু মূর্তিটা আর কখনও আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেনি।

ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্টের কবলে পড়ে সেই রহস্যময় বাড়িখানা এবং সেখানকার বাড়িগুলো এখন অদৃশ্য হয়েছে। আমার কথা ফুরুল।

ঝুপুর ঝুপুর বৃষ্টি পড়ছে, হু হু করে বাতাস বইছে, ছলাৎ ছলাৎ করে গঙ্গাজল তীরে এসে আছড়ে পড়ছে, পৃথিবী অন্ধকার। বন্ধুরা স্তব্ধ।

সুইচ টিপে আলো জ্বাললুম। বন্ধুরা বিরক্ত হয়ে বললে, ‘ধেৎ, দিব্যি একটি ভূতুড়ে অ্যাটমসফিয়ার গড়ে উঠেছিল, আলো জ্বেলে সব মাটি করে দিলে!’

হেসে বললুম, ‘আমি এটা ভূতের গল্প বলে মনে করি না।’

বন্ধুরা বললে, ‘আমরা যদি নকলে আসলের সুখ পাই, তাতে তোমার কী?’

—‘বলো তো আবার আলো নিবিয়ে দি।’

—‘না, ছেঁড়া তার জোড়া লাগে না। তার চেয়ে আবার গরম চা আনাও।’

___

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *