উপন্যাস
বড়গল্প
ছোটগল্প
1 of 2

ভূতেরা ভূতদের কিছু করতে পারে না

ভূতেরা ভূতদের কিছু করতে পারে না

আমার বড়মামার অনেক উদ্ভট কাণ্ডের এটি একটি। কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন—’একটি খাঁটি ভূতের বাড়ি কিনিতে চাই। মালিক যোগাযোগ করুন।’ সাতদিন গেল, আটদিন গেল, একমাস গেল। কারুর দেখা নেই। চায়ের টেবিলে মেজোমামা বললেন, ‘ভূতের বাড়ি পাবে কোথায়। সব প্রোমোটারদের দখলে। ভূতের বাড়ি মানে পোড়োবাড়ি। পোড়োবাড়ির পড়ে থাকার উপায় আছে? ভূতদের জন্যে আমার খুব দুঃখ হয়। সব উদ্বাস্তু হয়ে কোথায়-কোথায় ঘুরছে কে জানে। আমার একটা আইডিয়া এসেছে মাথায়। বিরাট একটা জায়গা কিনে সেখানে একটা পোড়োবাড়ি তৈরি করাব।’

বড়মামা বললেন, ‘পোড়োবাড়ি আবার তৈরি করা যায় না কি? বাড়ি অনেক-অনেক দিন পড়ে থাকতে-থাকতে পোড়োবাড়ি হয়। এটা সময়ের ব্যাপার।’

মেজোমামা বললেন, ‘একালের আর্কিটেক্টরা সব পারেন। পুরনো ইট, কড়ি, বরগা, ভাঙা ফ্রেম, দরজা, জানলা কিনতে হবে। মাকড়সার জাল জোগাড় করতে হবে। ভাঙা ফার্নিচার। পুরনো বিছানা, চাদর। পয়সা ফেললে সবই হয়। একটা গ্র্যান্ড পোড়ো বাড়ি। চিলেকোঠায় বাদুড়। কিছুদিন ফেলে রাখলেই ভূতেরা এসে গৃহপ্রবেশ করবে। বউ-বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে সংসার সাজিয়ে বসবে। তুমি আমার এই প্রোজেক্টে যোগ দিতে পার। ফিফটি-ফিফটি। একটা সাকসেসফুল হলে, পরপর আমরা এইরকম ভূতের বাড়ি প্রোমোট করে যাব।’

বড়মামা বললেন, ‘পার্টনারশিপে আমি কোনও কাজ করব না। পরে লাভের টাকার ভাগাভাগি নিয়ে ভীষণ গোলমাল হবে। বাঙালির পার্টনারশিপ টেঁকে না।’

‘তুমি এর মধ্যে লাভ দেখলে কোথায়? ভূতেরা ভাড়া দেবে নাকি! এটা আমাদের একটা খেয়াল, একটা বিলাসিতা। যেমন সেকালের বড়লোকরা চিড়িয়াখানা করত, মেটিয়াবুরুজের নবাব, রাজেন মল্লিক,— আমরাও সেইরকম ভূতখানা করব।’

মাসিমা এতক্ষণ চুপ করে শুনছিলেন। এইবার বললেন, ‘তোমরা দুটোতে যে বাড়িতে থাক সেই বাড়িটাই তো ভূতখানা।’

বড়মামা, মেজোমামা দুজনেই লাজুক-লাজুক হেসে বললেন, ‘কি যে বলিস?’

মাসিমা যেন খুব একটা গৌরবের কথা বলে ফেলেছেন! ‘চাসর’ ভেঙে গেল। আবার জমবে কাল সকালে। মেজোমামা বিখ্যাত অধ্যাপক। অদ্ভুত-অদ্ভুত শব্দ তৈরি করেন। ‘চাসর’ শব্দটা তাঁরই তৈরি।

বেলা একটার সময় ঝাঁ-ঝাঁ রোদে ঘামতে-ঘামতে ভদ্রলোক এলেন। একেবারে ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট। কুচকুচে কালো রং। ধবধবে সাদা পোশাক। বড়মামা তখন চেম্বারে রুগি দেখছেন। ভদ্রলোক বসতে-বসতে বললেন, ‘আই সি। ইউ আর এ ডক্টর! বোরিং প্র্যাকটিস।’

শেষ রুগিকে শেষ করে বড়মামা ভদ্রলোককে বললেন, ‘বলুন।’

‘মাই নেম ইজ গোপাল গাঙ্গুলি। দেয়ার ইজ এ হাউস।’

‘ভূত আছে?’

‘অফ কোর্স। আছে বলেই না এসেছি।’

‘কীরকম ভূত?’

‘বেস্ট কোয়ালিটির ভূত। লাজুক নয়। বেশ ডাকাবুকো। হতাশ হওয়ার কারণ নেই।’

‘ভূতদের পরিচয়! বায়োডাটা?’

‘আমার ঠাকুরদা বেশ খেলিয়ে বাড়িটা করেছিলেন। গৃহপ্রবেশের দিন তেরপল চাপা পড়ে মারা গিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিলেন তিনজন পিওর সাহেব। আমার ঠাকুরদার বন্ধু। সেই থেকেই এঁরা পারমানেন্ট। আমরা অনেক চেষ্টা করেও বাড়িটায় থাকতে পারিনি। বিক্রি করার চেষ্টা করেও ক্রেতা পাইনি। পুলিশের ক্যাম্প হয়েছিল। তিন দিন। সব পালাল। একমাস তাদের প্রত্যেকের মাথার চুল খাড়া হয়েছিল।’

‘আমি কিন্তু যাচাই করে নোব!’

‘অফকোর্স! আজ অমাবস্যা। ইচ্ছে করলে আজই আপনি যেতে পারেন। মাত্র একঘণ্টার ড্রাইভ।’

‘তাহলে চলুন খাওয়াটা শেষ করে বেরিয়ে পড়া যাক।’

শেষ বেলায় আমরা আমাদের জায়গায় পৌঁছে গেলুম। বিরাট একটা বাগান। তার মাঝখানে বিউটিফুল একটা বাড়ি। কিছুটা দূরে রূপনারায়ণ। জায়গাটার নামও ভারি সুন্দর—গড়চুমুক।

বড়মামা মনখারাপ করে বললেন, ‘গোপালবাবু, দিস ইজ নট এ পোড়োবাড়ি।’

‘বাট এ জেনুইন ভূতের বাড়ি। একটা রাত থাকলেই ব্যাপারটা বুঝতে পারবেন। জলবৎ তরলং।’

‘ভূত বিজ্ঞান পড়ে যতটুকু জেনেছি—দে ভেরি মাচ প্রেফার পোড়োবাড়ি।’

গোপালবাবু বললেন, ‘মশাই আপনি তো যাচাই করে নেবেন! সন্তুষ্ট হলে কিনবেন, না হলে না কিনবেন। আমি তাহলে চলি। গুড লাক।’

বড়মামা বললেন, ‘জাস্ট ওয়ান প্রশ্ন—বাড়িটা এত ভালো হয়ে রইল কীভাবে?’

‘মেনটিনেনস আছে।’

‘কে করে?’

‘যারা আছে তারাই করে।’

গোপালবাবু চলে যাচ্ছিলেন, বড়মামা জিগ্যেস করলেন, ‘কোথায় আপনার দর্শন পাব?’

‘ভয় নেই, আমিই দর্শন দোব।’

ঝপঝপ করে রাত চলে এল। অমাবস্যার কুচকুচে কালো রাত। আমাদের সঙ্গে পাঁচ সেলের একটা টর্চ, মোটাসোটা কয়েকটা মোমবাতি, দেশলাই। নাইলনের দড়ি। মাসিমা রাতের খাবার সঙ্গে দিয়ে দিয়েছেন। জলের বোতল। এক ফ্লাস্ক চা। সঙ্গে মোটা একটা শতরঞ্চি, দুটো বালিশ।

গোপালবাবু গুড ম্যান। নীচের একটা ঘরে খাট-বিছানা সাজিয়ে দিয়ে গেছেন। কোথা থেকে বেঁটে মতো একজন লোক এসে হাজির হলেন; যেন মাটি ফুঁড়ে উঠলেন।

বড়মামা জিগ্যেস করলেন, ‘তুমি কি ভূত?’

‘না, আমি মানুষ। ডেকরেটারের লোক। এই খাট-বিছানা, জলের বোতল রাখার টেবিল আমার সাপ্লাই। এই খাটটা স্পেশাল খাট। তিন চারজন এই খাটে আত্মহত্যা করেছে। খুব লাকি খাট। শুলেই বুক ধড়ফড় করে। কখনও মনে হবে ভূমিকম্প হচ্ছে। আচ্ছা, আমি তাহলে আসছি। বেঁচে থাকলে কাল সকালে।’

‘কে বেঁচে থাকলে?’

‘আপনারা।’

লোকটি চলে গেলেন; যেন ভয়ে পালালেন।

বড়মামা মুখে একটা শব্দ করে বললেন, ‘ব্যাটা বক্কেশ্বর, আমাকে ভূতের ভয় দেখাতে এসেছে।’

আমি বললুম, ‘এই সুইসাইড খাটটায় না শোয়াই ভালো।’

‘ভয় পেয়েছিস মনে হচ্ছে। সব গল্পকথা। ভূতুড়ে বলে বাড়ি বিক্রি হচ্ছিল না। এইবার মওকা এসেছে—ভূতুড়ে বলেই বাড়ি বিক্রি হবে। অতএব এরা এখন ভূত ম্যানুফ্যাকচার করবে। ভূত অত সোজা রে। সব গল্প। বিকট-বিকট কল্পনা।’

‘বাড়িটা একবার ঘুরে দেখলে হয় না?’

‘না, শব্দে যেমন পাখি উড়ে যায়, আমাদের চলাফেরার শব্দে সেইরকম ভূত পালিয়ে যাবে।

ভূতের ভিজিটের জন্যে একটা পরিবেশ চাই।’

ঘরটা বেশ বড়। এ-পাশে, ও-পাশে, দোতলায় আরও অনেক ঘর। গোটাকতক বাতি জ্বেলে আমরা বসে আছি। চারপাশে জবরদস্ত অন্ধকার। হাতের কাছে টর্চ। একটা আগ্নেয়াস্ত্র থাকলে ভালো হতো। গুলি করে ভূত মারা যায় না। মানুষ একবারই মরে। দুবার মরা অসম্ভব। বদমাইশ কেউ এলে মোকাবিলা করা যেত।

বাইরে নানারকম শব্দ হচ্ছে। সে হতেই পারে। দোতলায় কি হচ্ছে কে জানে! একটা চওড়া সিঁড়ি তিন প্যাঁচ মেরে ছাদের দিকে উঠে গেছে। সিঁড়িটাই ভয়ের। কেবলই মনে হচ্ছে, কেউ নেমে আসবে। আমরা ঠিক করেছি কেউ ঘুমবো না। লুডো খেলে রাত কাটাব।

রাত এগারোটা। বাইরে চ্যাঁ-চ্যাঁ করে একটা বড় সাইজের প্যাঁচা ডাকল। প্যাঁচার ডাকের সঙ্গে ভূতের একটা যোগ আছে। কুকুরেরও আছে। প্যাঁচার ডাকে বুকটা কেমন ছাঁৎ করে উঠল। বড়মামার ছয় পড়েছে। আমার একটা ঘুঁটি কেটে যাওয়ার কথা। বাতিটা হঠাৎ খুব কাঁপছে। ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। বড়মামা বড়-বড় হাই তুলছেন। আর জানি না।

একসময় মনে হল, পায়ে দড়ি বেঁধে আমাদের টানতে-টানতে কোথাও নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। পিঠের তলায় মাটি আর ঘাসের স্পর্শ। আচ্ছন্ন অবস্থায় বেশ ভালো লাগছে। যাচ্ছি তো যাচ্ছিই। একসময় থামলুম। আবছা-আবছা দেখতে পাচ্ছি। ধবধবে সাদা তিনজন সাহেব আর একজন লম্বা চওড়া বাঙালি। একজন সায়েব একটা গানের মতো কি গাইছে—

 ডিগ, ডিগ, ডিগ,

 মেরিলি ইউ ডিগ

 ডিগ ডিগ, ডিগ।

মাটি কাটার শব্দ কানে আসছে। কানে আসছে বাংলা গান,

 খোঁড়ো খোঁড়ো খোঁড়ো

 কবর দাও, খবর দাও

 খোঁড়ো খোঁড়ো খোঁড়ো

 বড়টাকে ফেল তার ওপর ছোটটা

 স্প্লিপ স্প্লিপ স্প্লিপ

 ফর এভার ফর এভার

 ডিগ ডিগ ডিগ।।

বিশ্রী লাগছে; কিন্তু কিচ্ছু করতে পারিছ না। শুয়ে-শুয়ে নেমে যাচ্ছি নীচের দিকে। শীত করছে। বাঙালি ভদ্রলোকের প্রার্থনা কানে আসছে,

 ভূত হও, ভূত হও,

 আছি চারজন,

 হব ছয় জন,

 ভূ-ভূ ভূত হও।

এইবার কান্না আসছে। ‘মাসিমা, মাসিমা, বাঁচান-বাঁচান।’ আমার তলায় বড়মামা। জোড়া কবর। ভয় হল, যমজ ভূত হব না তো? না, তা হবে না। দুটো দু-সাইজের ভূত হবে। দুবরাজপুরের মামা-ভাগনে পাহাড়ের মতো, মামা-ভাগনে ভূত। ইতিহাসে যা কখনও হয়নি।

তিনটি সাহেব আর একটা বাঙালি সমস্বরে বলছে,

 বেরি, বেরি, বেরি

 ডিপ ইন দ্য স্প্লারি।

হঠাৎ একটা বিকট শব্দ। বিশাল চেহারার একটা কালো কুকুর আমাদের ওপর দিয়ে লাফিয়ে ওদের ঘাড়ে। সিংহের মতো গর্জন। লাল ভাঁটার মতো চোখ। বিশাল চেহারা। সাহেবদের মধ্যে একজন বললে,—দিস ইজ স্মিথস ডগ। মোস্ট ফেরোসাস।

আমাকে ঠেলে সরিয়ে বড়মামা উঠে বসে বললেন, ‘নো, দিস ইজ মাই ডগ।’ চারখানা ভূত ধোঁয়ার মতো আকাশে উড়ে গেল।

বড়মামা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘দেখলি, কুকুর মরে গেলেও কুকুর। প্রভুকে বাঁচাবার জন্যে তেড়ে এসেছে। তুই লাকিকে চিনতে পারলি না?’

বড়মামার জার্মান শেপহার্ড ডগ লাকি, তার চোদ্দো বছরের জীবন শেষ করে চলে গেছে। বাড়িতে তার সমাধি আছে। রোজ ফুল দেওয়া হয়। ভোর হয়ে গেছে, যাকে বলে প্রসন্ন সকাল। গোপালবাবু আসছেন। ‘একি আপনারা ঘাসের ওপর ঠান্ডায় শুয়ে আছেন কেন?’

বড়মামা বললেন, ‘ঘাসের ওপর নয় তো, আমরা আমাদের কবরে শুয়ে আছি। রাত্তির বেলা কখন জানি না তিনটে সায়েব ভূত আর একটা বাঙালি ভূত ঠ্যাং ধরে টানতে-টানতে এনে, এখানে কবর দিয়ে খানিক নাচানাচি করে চলে গেল, বললে, ‘ছিল চারটে হল ছ’টা।’

‘কবর থেকে বেরোলেন কী করে?’

‘তা তো জানি না।’

‘সে কি মশাই!’ গোপালবাবু ঊর্ধ্বশ্বাসে গেটের দিকে ছুটলেন—’চাচা, আপন প্রাণ বাঁচা।’

মাসিমা সব শুনে একটা কথাই বললেন, ‘ভূতরা ভূতেদের কিছু করতে পারে না। নিজেদের চিনলে তো!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *