2 of 2

ভূতাবিষ্ট – নারায়ণ সান্যাল

ভূতাবিষ্ট – নারায়ণ সান্যাল

কলকাতার হেড অফিস থেকে অরবিন্দ নাগকে বম্বে পাঠাল ওখানকার ব্রাঞ্চে অডিট করতে। উঠল গিয়ে সে এক বিলাসবহুল হোটেলে। আমিরি খানাপিনা, দামি-দামি ড্রিঙ্কস, পা বাড়ালেই ট্যাক্সি। কাজের শেষে যত ইচ্ছে বেড়াও, সিনেমায় গিয়ে ঢোকো কিংবা তৃষ্ণা মেটাতে পছন্দসই কোনও রেস্তোরাঁ অ্যান্ড বারে বসে…।

তবে রেস্তোরাঁ অ্যান্ড বারের কথা মনে হলেই তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে জোরালো নিয়ন সাইনে লেখা একটিই নাম ‘ভি ভি ভি ক্লাব’।

হোটেল থেকে অফিসে যাতায়াতের পথেই পড়ে সেটা। নিত্যই দ্যাখে অরবিন্দ। বিচিত্র নামটা তাকে কৌতূহলী করে তোলে। যোগাযোগের অভাবে ঢোকা আর হয়ে ওঠে না।

অবশেষে আট দিনের দিন আর থাকতে না পেরে, অ্যাকাউন্ট্যান্ট আয়ারকে সে জিগ্যেস করে ফেলল, ‘আচ্ছা মিস্টার আয়ার, হোটেল থেকে যাতায়াতের পথে, একটা বাড়ির সামনে ভি ভি ভি ক্লাব বলে যে-সাইনবোর্ডটা দেখা যায়, কী ওটা? জানেন কিছু?’

আয়ার মৃদু হেসে বললেন, ‘জানি বইকী। ওখানে মাঝে-মাঝে গেছিও। রেস্তোরাঁ অ্যান্ড বার হিসেবে হালফিল রীতিমতো রেসপেকটেবল হয়ে উঠেছে।’

‘কিন্তু নামটা খুব পিকিউলিয়ার নয়?’

‘মালিকটি যে আরও পিকিউলিয়ার, মিস্টার নাগ। পূর্ব জীবনে শুনেছি, কঙ্কনি হেমাদ ছিলেন একজন এক্স-কনভিক্ট—।’

‘এক্স-কনভিক্ট?’ গভীর বিস্ময়ে অরবিন্দ বলে ওঠে। ‘ইউ মিন, ওঁর কয়েদ হয়েছিল? জেল খেটেছেন?’

আয়ার ঘাড় নেড়ে বললেন, ‘শুধু খাটেনইনি, এখনও হয়তো খাটতেন, যদি না—।’

‘যদি না?’

‘যদি না পুলিশ ডিপার্টমেন্ট ওঁর সাহায্য নিতে বাধ্য হত।’

অরবিন্দের মুখের হাঁ-টা বেশ বড় হয়ে উঠল। গভীর বিস্ময়ে সে প্রশ্ন করল, ‘ওঁর সাহায্য নিতে? সাপে ব্যাং ধরার বদলে, ব্যাংই সাপ ধরল, বলছেন?’

‘এগজ্যাক্টলি।’ আয়ার আর-একটু ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে, চাপা গলায় বললেন, ‘শুনেছি, একটা আন্তর্জাতিক চোরা-চালান চক্রের সন্ধান পেয়েও পুলিশ কিছুতেই তাদের টিকিটা ধরতে পারছিল না। তখন বাধ্য হয়ে তাদের শরণাপন্ন হতে হল জেল-কয়েদি হেমাদসাহেবের। অন্ধকার জগতের উনি ছিলেন ক্রাউন প্রিন্স। তাই পুলিশ শর্ত দিল, চক্রটাকে যদি ধরিয়ে দিতে পারেন, তাহলে হাজতবাস তো হেমাদসাহেবের মকুব হবেই, সেইসঙ্গে মোটা টাকা পাবেন উনি ভবিষ্যতে সৎভাবে জীবনযাপন করবার জন্যে—।’

অরবিন্দ বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে বলে উঠল, ‘বুঝেছি। সেই টাকাতে মিস্টার হেমাদ ভি ভি ভি ক্লাব—।’

বাধা দিলেন আয়ার : ‘একটু ভুল করে ফেললেন, মিস্টার নাগ। অরিজিন্যালি ভিভিভি ক্লাব নাম ছিল না, ছিল টুটি-ফ্রুটি।’

‘তাই নাকি? কিন্তু দ্বিজ হল কেন—আই মিন, নতুন নামকরণ?’

‘অবশ্য তার ইতিহাস একটা আছে—তবে মরা ইতিহাস নয়, রীতিমতো জ্যান্ত। আমি নিজেই কয়েকবার গিয়ে দেখেছি।’

অরবিন্দ কৌতূহলের সুরে প্রশ্ন করল, ‘কী দেখেছেন? মনে হচ্ছে যেন একটা রহস্যের ছোঁয়াচ আছে?’

আয়ার টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়ে ফিসফিস করে বললেন, ‘তা তো আছেই। তবে কোনও গোয়েন্দা কাহিনির রহস্য নয়, দস্তুরমতো অলৌকিক—ভৌতিকই বলতে পারেন।’

‘ভৌতিক!’ অরবিন্দ অব্যক্ত কণ্ঠে বলে ওঠে।

‘হ্যাঁ! টুটি-ফ্রুটিতে শশী গুপ্তা বলে একজন ভদ্রলোক যেদিন থেকে ড্রিঙ্ক করতে আসতে শুরু করলেন, সেইদিন থেকেই রেস্তোরাঁটার বরাত খুলে গেল। শহরের বহু খানদানি লোক—এলিটস আসতে শুরু করলেন শুধু মিস্টার গুপ্তাকে দেখতে।’

‘স্পেশ্যাল ফিচারটা কী?’

‘সবাই স্বীকার করেছেন, তিনি ভূতাবিষ্ট।’

অরবিন্দ ঠিক বুঝতে পারে না অর্থটা। তাই প্রশ্ন করে, ‘ভূতাবিষ্ট? তার মানে—।’

আয়ার গড়গড় করে ব্যাখ্যা করতে শুরু করলেন ‘মানে, ভূতে ওঁকে ভর করে—ইংরিজিতে যাকে পজেসড বলে—।’

অরবিন্দ গম্ভীর হয়ে গেল। এক মুহূর্ত স্তব্ধ থেকে বলল, ‘আপনি নিজে বিশ্বাস করেন তা?’

‘না করে উপায় কী। আমি যে ক’দিন তাঁকে বারে মিট করেছি। সবদিনই দেখেছি, এক-একজনের প্রেতাত্মা তাঁর ওপর ভর করেছে—কোনওদিন শেক্সপিয়ার, কোনওদিন সন্ত তুলসীদাস, কোনওদিন বা মহাত্মা গান্ধী—।’

অসহ্য বিস্ময়ে অরবিন্দ বলে উঠল, ‘বলেন কী! এ যে বিশ্বাস করা মুশকিল, মিস্টার আয়ার।’

‘চলুন না আজ আমার সঙ্গে। শনিবার আছে…মিস্টার গুপ্তা নিশ্চয়ই ভি ভি ভি ক্লাবে আসবেন—নিজের চোখে দেখে সন্দেহভঞ্জন করবেন।’

অরবিন্দ যেতে রাজি হল তখনই। হেসে বলল, ‘নিশ্চয় যাব। ভি ভি ভি ক্লাবের নামকরণের কারণটি এবার বুঝেছি। ভি ভি ভি—অর্থাৎ, ভিনি ভিডি ভিসি। এলুম, দেখলুম, জয় করলুম।’

‘এগজ্যাক্টলি। শশী গুপ্তা ভূতাবিষ্ট কথাটা ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে-সঙ্গে ক্রিকেট পাগল বম্বের মেয়ে-পুরুষরা যেমন দলে-দলে আছড়ে পড়েন ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে, ঠিক সেইরকমভাবেই তাঁরা ভি ভি ভি ক্লাবে উপচে পড়েন।’

কথাটা যে তাঁর কতখানি সত্যি, সেটা অরবিন্দ মিস্টার আয়ারের সঙ্গে ভি ভি ভি ক্লাবের সামনে ট্যাক্সি থেকে নামতেই বুঝল। শুধু গাড়ির মেলা। সাদা, লাল, কালো, ছোট-বড়, দেশি-বিদেশি। ভেতর থেকে রং-বেরঙের শাড়ি, সালোয়ার, স্কার্ট, দামি স্যুট পরা নর-নারীর দল নেমে এসে ভিড় করেছেন প্রবেশপথের সামনে।

অগত্যা অরবিন্দকেও আয়ারের পিছনে লাইনে গিয়ে দাঁড়াতে হল।

কিন্তু ভেতরে পা দিতেই বিস্ময়ে সে একেবারে হতবাক হয়ে গেল। ভি ভি ভির বাইরেটা সুন্দর নিশ্চয়ই, কিন্তু ভেতরের সৌন্দর্যের বোধ করি তুলনা নেই। হেমাদসাহেব যেন কোনও ময়দানবকে দিয়ে তিলে-তিলে তিলোত্তমা গড়ে তুলেছেন।

হলটা যত লম্বা, তত চওড়া। অরবিন্দের মনে হল, কলকাতার রেসকোর্সের মতোই বিশাল। সবুজ গালচের ওপর সাজানো অজস্র টেবিল যেন শ্বেতপদ্মের মতো ফুটে রয়েছে হল জুড়ে। উত্তরদিকের শেষতম প্রান্তে মস্ত বার। সেলফে সাজানো নানা আকৃতির পানীয়ের বোতলগুলো যেন সুন্দরী যুবতীর মতো হাতছানি দিয়ে ডাকছে।

বাঁ-হাতি একটা দরজার মাথায় নিয়ন সাইনে লেখা ‘লেডিজ পার্লার’। ডানহাতি কার্পেট মোড়া সিঁড়িটা ওপরে উঠে গেছে। তার পাশেই একটু ভেতর দিকে একখানা ঘরের মাথায় নিয়ন সাইনে লেখা ‘বিলিয়ার্ড রুম’।

একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে অরবিন্দ হলের চারদিকে চোখ বুলোচ্ছিল। আয়ার কাছে এসে তাগিদ দিলেন, ‘করছেন কী! দাঁড়িয়ে থাকবেন না। ওই কোণের দিকে একখানা টেবিল এখনও খালি আছে। যে-কোনও মুহূর্তে অকুপায়েড হয়ে যেতে পারে।’

সচেতন হয়ে উঠে অরবিন্দ তাঁর পিছন-পিছন টেবিলটার দিকে এগিয়ে চলল।

দেখতে পেয়ে, বারের কাছ থেকে হাসিমুখে এগিয়ে এল কঙ্কনি হেমাদ। আয়ারকে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে বলল, ‘গরিবের ক্লাবকে কি ভুলে গেলেন, মিস্টার আয়ার? আর তো পায়ের ধুলোই পড়ে না।’

তার বাড়ানো হাতে হাত মিলিয়ে আয়ার বললেন, ‘অফিসে অডিটিং চলছে তো।…আসুন, আলাপ করিয়ে দিই। মিস্টার নাগ, কলকাতা থেকে এসেছেন অডিট করতে। আর ইনি মিস্টার হেমাদ। ভি ভি ভির মালিক।’

সৌজন্যমূলক করমর্দনটা সেরে হেমাদ মৃদু হেসে আয়ারকে জিগ্যেস করল, ‘কী খাবেন, বলুন। হুইস্কি? রাম? জিন না বিয়ার?’

আয়ার অরবিন্দের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়েই চট করে জবাব দিলেন, ‘স্মল ড্রিঙ্কস কিছু। মিস্টার নাগ রেগুলার খান না তো, কাজেই আপনার স্পেশ্যাল ব্র্যান্ড কোনও বিয়ার—।’

‘ও. কে., ও. কে., জেন্টলমেন। আমি এখনই পাঠিয়ে দিচ্ছি।’ হেমাদ দ্রুতপায়ে ফিরে গেল বার স্ট্যান্ডের দিকে।

সিগারেটের প্যাকেটটা আয়ারের দিকে এগিয়ে ধরে অরবিন্দ মন্তব্য করল, ‘আমাদের বাপ-ঠাকুরদার আমলে মদ খাওয়াটাই ছিল নিন্দের। সবাই ঘৃণার চোখে দেখত। আর এখন না খাওয়াটাই নিন্দের—সবাই পিটি করেন।’

‘শুধু ঋতুই বদলায় না, মিস্টার নাগ, রীতও তো বদলায়।’ মৃদু হেসে আয়ার সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করলেন।

একটু পরেই সুবেশধারী বয় এসে দু-বোতল বিয়ারের সঙ্গে সাজসরঞ্জামগুলো টেবিলে সাজিয়ে দিয়ে গেল।

অরবিন্দের চোখ পড়েছিল হলের প্রবেশপথের দিকে। যাঁকে দেখতে আসা, সেই ভূতাবিষ্ট ভদ্রলোক কখন আসবেন কে জানে!

আয়ার তার গ্লাসে নিজের গ্লাসটা ঠেকিয়ে হালকা সুরে বললেন, ‘প্রার্থনা করি যে, কোনও ভূত যেন অবিলম্বে শশী গুপ্তাকে এখানে তাড়না করে নিয়ে আসে।’

হেসে উঠে অরবিন্দ কী একটা বলতে যাচ্ছিল, ঠিক সেইসময় ক্লাবের সামনে থেকে একাধিক উত্তেজিত কণ্ঠ ভেসে এল, ‘এসে গেছেন…এসে গেছেন!…’ ‘কই, কোথায়?…’ ‘ওই তো ট্যাক্সি থেকে নামছেন…!’

হলের সবগুলো মুখই দরজার দিকে ঘুরে গেল। প্রথম দর্শনের কৌতূহল আর উত্তেজনায় অরবিন্দও চেয়ার ছেড়ে একদম দাঁড়িয়েই পড়ল। কিন্তু হলে যে ঢুকল, তাকে দেখে সে বেশ খানিকটা নিরাশ হল।

এই কি শশী গুপ্তা? ভূতাবিষ্ট! মনে-মনে যে-ছবিটা তার আঁকা ছিল, কোথাও তার সঙ্গে মিল খুঁজে পেল না। নেহাত অল্প বয়েস, পাতলা ছিপছিপে চেহারা, ফরসা রং, পরনের স্যুট দামি বটে, কিন্তু ইস্ত্রির বালাই নেই।

কারও দিকে না তাকিয়ে শশী গুপ্তা সোজা এগিয়ে গেল বারের দিকে সুরেলা কণ্ঠে আবৃত্তি করতে-করতে :

‘দূরাদয়শ্চক্রনিভস্য তন্বী তমালতালীবনরাজিনীলা।

আভাতি বেলা লবণাম্বুরাশের্ধারানিবদ্ধেব কলঙ্করেখা…।।’

আয়ার ফিসফিস করে অরবিন্দকে বললেন, ‘আজ দেখছি কালিদাসের প্রেতাত্মা ভর করেছে।’

অরবিন্দ মুখও ফেরাল না, কোনও জবাবও দিল না।

হেমাদসাহেবের জানা ছিল, তাই বিশেষ ধরনের হুইস্কি পরিবেশন করতে সে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। শশী গুপ্তা ঊর্ধ্বমুখে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে রঘুবংশ থেকে একটা শ্লোক আওড়াচ্ছিল ‘ত্বাং সমষ্কমধিয়োগ্য দোময়া…’ হঠাৎ থেমে গিয়ে সে হো-হো করে হেসে উঠল।

চমকে গেল কঙ্কনি হেমাদ, ফিরে তাকিয়ে জিগ্যেস করল, ‘কী হল, মহাকবি?’

‘মহাকবি!’ আর-একদফা হাসল শশী গুপ্তা। বলল, ‘আজ যাকে মহাকবি বললে, শ্রেষ্ঠী, উজ্জয়িনীর একদল ঈর্ষাকাতর নাগরিক তাকেই আখ্যা দিয়েছিল মহামূর্খ বলে। ফুলশয্যার রাত্রে, দূর থেকে উষ্ট্রের হ্রেষাধ্বনি শুনে রাজকুমারী নাকি আমাকে প্রশ্ন করেন, ওটা কী ডাকছে? —উত্তরে আমি বলেছিলুম, উট।’

হেসে উঠল শশী গুপ্তা। হেসে উঠলেন হলের আরও বহু নরনারী।

টলতে-টলতে উঠে দাঁড়ালেন সালোয়ার কামিজ পরা এক ভদ্রমহিলা। জড়িত-কণ্ঠে বললেন, ‘শুধু উজ্জয়িনীর নাগরিকদেরই দোষারোপ করছেন কেন, কবি? এই নটী বসন্তসেনার কুটিরেই আপনাদের নবরত্ন সভার এক রত্ন বলে গেছেন, কবি কালিদাসের চেয়ে মূর্খ আর হতে পারে না। গাছের যে-ডালে তিনি বসেছিলেন, সেই ডালই কুঠার দিয়ে কাটছিলেন।’

হলে একটা হাসির হররা উঠল। শশী গুপ্তা দু-হাতে মুখ ঢেকে প্রায় আর্তনাদের সুরে বলল, ‘এই হিংসা, দ্বেষ, পরশ্রীকাতরতাই একদিন মানুষের মহা সর্বনাশ ডেকে আনবে। তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে আবার সেই আদিম অরণ্য জীবনে…এ টোটাল ডেস্ট্রাকশান অফ হিউম্যানিটি।’

আয়ার অনুচ্চকণ্ঠে অরবিন্দকে বললেন, ‘কবি কালিদাসের স্পিরিট ওঁকে ছেড়ে গেলেন! এবার উনি নরম্যাল হয়ে উঠবেন।’

হোটেলে ফিরে অনেক রাত অবধি অরবিন্দ ঘুমোতে পারল না। চোখ বুজলেই ভূতাবিষ্ট শশী গুপ্তার চেহারাটা তার চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল। মহাকবি কালিদাসের প্রেতাত্মা ভর করেছিল তার ওপর। অবশ্য কবিকে অরবিন্দ দেখেনি। তবে তাঁর সম্বন্ধে যতটুকু পড়েছে এবং কলেজের অধ্যাপকদের কাছ থেকে শুনেছে, তাতে তাঁর প্রেতাত্মার ভর করা সম্বন্ধে সন্দিগ্ধ হওয়ার কিছু নেই।

নিজের অজ্ঞাতসারেই সে আবৃত্তি করতে শুরু করল ‘দূরাদয়শ্চক্রনিভস্য তন্বী…’ কোন সময় যে তার দু-চোখ ছেপে ঘুম নেমে এল, টেরও পেল না। ঘুমপাড়ানি গান নয়, ঘুমের ওষুধ খেয়েছে যেন। এ সিডেটিভ ড্রাগ।

পরদিন অফিসে গিয়ে মোটা খাতাখানা খুলতেই আয়ার হাসিমুখে কাছে এসে বসলেন। জিগ্যেস করলেন, ‘কাল ভি ভি ভি ক্লাবে শশী গুপ্তাকে দেখলেন তো, মিস্টার নাগ। কী মনে হল?’

অরবিন্দ ধীর কণ্ঠে জবাব দিল, ‘রায় দেওয়াটা আজ মুলতুবি রাখলুম। আরও দু-একদিন না দেখলে…।’

‘বেশ তো, তাহলে মঙ্গলবার চলুন। হি ইজ এ মাস্ট অন টুইসডে।’

ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়ে অরবিন্দ হিসেবের খাতায় মগ্ন হয়ে গেল।

মঙ্গলবার দিন দুজনে অবশ্য ভি ভি ভি ক্লাবে গেলেন ঠিকই, তবে একটু দেরিতে। হিসেবের অঙ্কটা কিছুতেই মিলছিল না।

হলে পা দিয়েই অরবিন্দ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল বারের দিকে নজর পড়তে। দেখল, প্রচণ্ড রোদের তাপে চারাগাছের পাতাগুলো যেমন নেতিয়ে পড়ে, ঠিক তেমনই ভাবে শশী গুপ্তা বসে আছে একখানা চেয়ারে। মাথাটা তার ঝুলে পড়েছে বুকের ওপর—হাতদুটো কোলের ওপর জড়ো করা।

অরবিন্দের মুখে উদ্বেগের ছাপ ফুটে উঠতে দেখে আয়ার অনুচ্চকণ্ঠে বললেন, ‘ঘাবড়াবেন না, মিস্টার নাগ। এর আগেই আমি একদিন ওঁকে ওই অবস্থায় দেখেছি। ওটা প্রেতাত্মা ভর করার পূর্বাভাস।’

‘তার মানে?’

‘মানে ওঁর নিজের শক্তি বলুন, ইচ্ছে-অনিচ্ছে বলুন, এখন আর কিছু নেই। যে-প্রেতাত্মা ওঁকে ভর করছে, সে-ই সবকিছু হরণ করে নিয়েছে।’

শিউরে উঠল অরবিন্দ। সর্বনাশ! তীব্র স্রোতের টানে অসহায় কুটোর মতো এমনিভাবে ভেসে চলা…। যদি…যদি…।

হেমাদকে অদূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অরবিন্দ এগিয়ে গেল। তার কাছে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘চুপ করে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? ওঁর যদি খুব কষ্ট হয়…।’

হেমাদ হিস করে একটা শব্দ করে উঠে সতর্ক করে দিল কোনও কথা না বলতে। এ-অবস্থায় কোনওরকম বাধা পেলে কষ্ট তো ওঁর আরও বাড়বেই, চাই কী ‘ডেথ’ পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে।

অরবিন্দের সর্বাঙ্গ বেয়ে তড়িৎ রেখার একটা শিহরন বয়ে গেল। অস্ফুট কণ্ঠে সে জানতে চাইল, ‘আচ্ছা, সবসময় কি গ্রেটম্যানদের, মানে মহাপুরুষদের, আত্মাই ওঁকে ভর করেন?’

‘ওঃ, নো, নো,’ করুণ হাসি হাসল হেমাদ। বলল, ‘পৃথিবীতে যেমন ভালো-মন্দ দু-জাতের লোকই আছে, প্রেতলোকেও তেমনি সাধুসন্তের সঙ্গে পাপী-তাপী, খুনে, বাটপাড়দের আত্মাও তো থাকে, স্যার।’

‘তারাও কি ওঁর ওপর ভর করে?’

‘মাত্র একদিনই দেখেছি…চম্বলের সেই বিখ্যাত ডাকাত মান সিংকে ভর করতে।’

অরবিন্দ শুধু বোবা দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রইল—কোনও কথা খুঁজে পেল না!

এইসময় সমস্ত জড়ত্ব, অবসাদ ঝেড়ে ফেলে শশী গুপ্তা সোজা হয়ে উঠে বসল। কাঁধে পড়ে থাকা উত্তরীয়খানা মাথায় পাগড়ির মতো বেঁধে নিয়ে উঠে দাঁড়াল সে। চোখদুটো দিয়ে এক দিব্যজ্যোতি যেন বিচ্ছুরিত হতে লাগল। ডান হাতখানা বুকের ওপর আড়াআড়ি রেখে সে দৃপ্তভঙ্গিতে বলতে শুরু করল :

‘হোলিনেস, পিউরিটি অ্যান্ড চ্যারিটি আর নট দি এক্সক্লুসিভ পজেশানস অফ এনি চার্জ ইন দি ওয়ার্লড—।’

অরবিন্দ আয়ারের কানে-কানে বলল, ‘এ কী! এ যে স্বামী বিবেকানন্দের কথা! আজ কি তাঁর আত্মা ভর করেছে?’

আয়ার মুগ্ধ চিত্তে বলে উঠলেন, ‘তাই তো মনে হচ্ছে।’

স্বামী বিবেকানন্দের প্রেতাত্মা এরপর শশী গুপ্তার মুখ দিয়ে অদ্বৈতবাদ সম্বন্ধে অনেক তত্ত্বই বলালেন। শঙ্করাচার্যই অদ্বৈতবাদের প্রথম উদগাতা। বিবেকানন্দের নিজের মতবাদ তারই পরিপূরক। অবশ্য অনেকে ভগবান বুদ্ধকেও অদ্বৈত মতাবলম্বী বলেন, কিন্তু শঙ্করাচার্যের সঙ্গে মূলত তাঁর একটা পার্থক্য আছে…।

তবে সে-পার্থক্য আর ব্যাখ্যা করা হল না—তার আগেই থেমে গেল শশী গুপ্তা। মুখ-চোখে তার স্বাভাবিক ভাব ফিরে এল। হেমাদ সাহেবের উদ্দেশে বলল, ‘আমার বিল…প্লিজ, কুইক।’

হেমাদ জিভ কেটে, হাতজোড় করে বলল, ‘ছিঃ, ছিঃ, আজ বিল নয়। আমরাই এন্টারটেন করছি…।’

বাধা দিয়ে শশী গুপ্তা বলল, ‘কারও কাছ থেকে অবলিগেশান আমি নিই না।’ পকেট থেকে একখানা একশো টাকার নোট বার করে টেবিলের ওপর ফেলে দিল সে : ‘আপনার বিল, বাকিটা বয়দের টিপস দিয়ে দেবেন।’ কথা শেষে দ্রুতপায়ে সে হল থেকে বেরিয়ে গেল। যেন একটা হৃদয়গ্রাহী নাটক দেখছেন, এমনিভাবে আর সকলে যে-যাঁর টেবিলে বসে রইলেন।

অতঃপর নিত্য সন্ধ্যার পর ভি ভি ভি ক্লাবে যাওয়াটা অরবিন্দের যেন একটা নেশায় দাঁড়িয়ে গেল। কোনও কারণে যাওয়া না হলে, তার মনে হত দিনটাই বৃথা গেল।

তাই সেদিন আয়ার সঙ্গ দিতে না পারলেও, সে একাই যথাসময়ে ক্লাবে এসে হাজির হল। হেমাদ অমায়িক হাসি হেসে অভ্যর্থনা করল তাকে। বলল, ‘আসুন, আসুন। আজ একলা দেখছি। আমাদের গুপ্তাসাহেবও তো আসেননি। কম্পানি দেওয়ার জন্যে কোনও মেয়েকে কি টেবিলে—।’

‘ধন্যবাদ, মিস্টার হেমাদ। কিন্তু মুশকিল হয়ে গেছে যে। আমি হচ্ছি, এ-যুগের একটি অচল নিরামিশাষী অ্যাবোমিনেবল ভেজিটেরিয়ান—।’

হেসে উঠল হেমাদ। আর ঠিক সেই মুহূর্তে দম দেওয়া পুতুলের মতোই হলে ঢুকল শশী গুপ্তা।

হেমাদ অরবিন্দকে ইশারায় বলল, ‘আপনার সময় কাটাবার খোরাক এসে গেছে।’

কিন্তু শশী গুপ্তার ওপর সেদিন কোনও প্রেতাত্মাই ভর করল না। সহজ সাধারণভাবে সে কয়েক পেগ ব্র্যান্ডি খেয়ে বিল চুকিয়ে দিল। তারপর যেমন এসেছিল ঠিক তেমনিভাবে আবার হল থেকে বেরিয়ে গেল।

অরবিন্দের মনে হল, শুধু সে একাই নয়, হলে যত নারী-পুরুষ খরিদ্দার ছিলেন, সকলেই কম-বেশি নিরাশ হলেন।

বিদায় নেওয়ার জন্য সে উঠে দাঁড়াতেই হেমাদ সহানুভূতি জানাল : ‘ব্যাড লাক, মিস্টার নাগ।’

ব্যতিক্রম তো সবকিছুতে থাকেই। এ-সত্যটুকু জানত বলেই অরবিন্দ পরদিনও যথাকালে ক্লাবে এসে হাজির হল এবং হলে পা দিয়েই চোখদুটো তার আনন্দে চকচক করে উঠল। দেখল কোণের দিকে যে-মঞ্চ ছিল, তার ওপর শশী গুপ্তা অতি ধীর পায়ে এদিক-ওদিক পায়চারি করছে। তবে মাথাটা তার আর-এক দিনের মতোই ঝুলে পড়েছে বুকের ওপর। হাতদুটো কোমরের কাছে জড়ো করা।

হেমাদ চট করে অরবিন্দের কাছে এসে দাঁড়িয়ে চাপা গলায় বলল, ‘আজ রবীন্দ্রনাথের আত্মা এসেছেন…।’

অরবিন্দ সাগ্রহে ফিসফিস করে জিগ্যেস করল, ‘কী করে বুঝলেন? কিছু বলেছেন নাকি?’

‘হ্যাঁ। ভর করার সময় তাঁর প্রেতাত্মা তো কত কথাই বললেন, আমি রবি ঠাকুর…নোবেল প্রাইজ পেয়েছি…সারা জগতের লোক আমায় বলে বিশ্বকবি…এই সেদিন আমার একশো পঁচিশ বরষের জন্মদিনে কত উৎসব হল…লোকে আমার ছবিতে মালা দিল, গান গাইল—কিন্তু কেউ জানল না, আমার মনে কত দুঃখ লুকিয়ে আছে…নিজের কাছে কীভাবে হেরে গেছি আমি…।’

‘হেরে গেছেন?’ অব্যক্ত কণ্ঠে অরবিন্দ বলে উঠল, ‘তার মানে?’

‘আর তো কিছু বললেন না। ব্যস! তারপরই ওইরকম হয়ে গেলেন…।’

অরবিন্দ শশী গুপ্তার দিকে ফিরে তাকাল। দেখল, ধীরে-ধীরে সে মাথা তুলছে। হাত দুটো ফিরে এসেছে যথাস্থানে। একসময় ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলতে-বলতে সে উঠে দাঁড়াল, ‘পাঞ্জাবে গিয়ে একদিন মুগ্ধ হয়ে লিখেছিলুম :

 পঞ্চ নদের তীরে, বেণী পাকাইয়া শিরে

 দেখিতে দেখিতে গুরুর মন্ত্রে

 জাগিয়া উঠিল শিখ

 নির্মম নির্ভীক—

সেই পাঞ্জাব আজ দু-ভাগ হয়ে গেছে…গুরুর মন্ত্র ভুলে নির্ভীক শিখরা আজ কাপুরুষের মতো খুনোখুনিতে মেতেছে…ধর্মস্থানকে ভিন্দ্রেনওয়ালের দল দুর্গ বানাচ্ছে…মুখ্যমন্ত্রী ”কোনও অন্যায় কাজ করিনি” বলেও সেই কাজের জন্যে আবার অপরের জুতো সাফ করছে প্রায়শ্চিত্ত করতে…এ যে কী লজ্জা…কতখানি আত্মপ্রবঞ্চনা—’ প্রেতাত্মার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেল।

হোক প্রেতাত্মা, তবু রবীন্দ্রনাথের এ-খেদোক্তি শুনে অরবিন্দের বুকের ভেতরেও এক চাপা কান্না যেন গুমরে-গুমরে উঠতে লাগল। হলের অনেকের চোখই নিশ্চয় শুষ্ক ছিল না।

হেমাদ প্রস্তুত হয়েই ছিল। প্রেতাত্মা যে শশী গুপ্তাকে ছেড়ে যাচ্ছে, বুঝতে পেরেই নিজের হাতে ব্র্যান্ডি পরিবেশন করল তাকে।

ধীরে-ধীরে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে পেল শশী গুপ্তা। বিল চুকিয়ে দিয়ে সে উঠে দাঁড়াতেই, অরবিন্দ দ্রুতপায়ে এগিয়ে গেল তার কাছে। ব্যগ্রকণ্ঠে জিগ্যেস করল, ‘রবীন্দ্রনাথের আত্মা যে এত দুঃখ পাচ্ছেন, ভাবতেও পারিনি, মিস্টার গুপ্তা। কবে এর শেষ হবে?’

কাঁধ দুলিয়ে শশী গুপ্তা জবার দিল, ‘যদি কোনওদিন দেবগুরু শুক্রাচার্য কি কিরোর আত্মা আমার ওপর ভর করে, তবেই এর জবাব দিতে পারব!’

অরবিন্দ বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল, ‘তাহলে আর জানবার সুযোগ আমার হবে না, মিস্টার গুপ্তা। অডিটের কাজ শেষ হয়ে গেছে। যে-কোনওদিন কলকাতায় ফিরে যেতে পারি।’

‘ওঃ! আগামীকাল নয় নিশ্চয়ই?’

‘না। সামনের সোমবার, কি মঙ্গলবার…।’

শশী গুপ্তা হেসে বলল, ‘তাই? তাহলে তো কালই আমাদের দেখা হতে পারে। শনিবার কাল। আর শনিবারটা আমি আসিই…বিশেষ করে আমাদের বন্ধু হেমাদসাহেবের কথা ভেবে। অন্যদিন না পারলেও, শহরের যত রইস আদমি এদিন ক্লাবে আসবেনই।’

হেমাদ সলজ্জ কণ্ঠে স্বীকার করল : ‘হাঁ। ইয়ে তো সাচ্চা বাত।’

‘ঠিক আছে, তাহলে কালই আবার আমাদের দেখা হচ্ছে।’ বলে অরবিন্দ বিদায় নিল তাদের কাছ থেকে।

প্রতি শনিবারই শহরবাসীর জীবনে যেন উৎসবের বান ডাকে। ঘোড়দৌড়ের মাঠে লাখ-লাখ টাকা হাওয়ায় ওড়ে। খেলার মাঠে উপচে পড়ে মানুষের ভিড়। সিনেমা হলে টিকিট ব্ল্যাকে বিক্রি হয়, যে-কোনও হোটেল-রেস্তোরাঁয় খালি টেবিল মেলা ভার।

সন্ধ্যা আটটা নাগাদ হোটেল থেকে পোশাক বদলে লিফট দিয়ে নামতে-নামতে অরবিন্দ সঙ্গী আয়ারকে বলল, ‘নেহাত সোমবারই বম্বে ছাড়ছি—শশী গুপ্তার সঙ্গে জীবনে হয়তো আর কোনওদিন দেখা হবে না। নইলে ভি ভি ভি ক্লাবের ওই উত্তাল জনসমুদ্রে পড়ে হাবুডুবু খেতে আজ কিছুতেই যেতুম না।’

আয়ার মৃদু হেসে বললেন, ‘কেন, আপনাদের বাংলাতেই তো একটা চলতি কথা আছে, কষ্ট না করলে, কেষ্ট মেলে না।’

কেষ্ট মিলবে কি না জানে না, তবে ক্লাবের হলে পা দিয়েই অরবিন্দ বুঝল, অন্তত কষ্ট কিছু তাদের করতে হবে না। তাদের আসার কথা জানা ছিল বলেই কোণের দিকে একটা টেবিলে ‘রিজার্ভড’ লেখা একখানা কার্ড হেমাদ ঝুলিয়ে রেখেছিল।

আয়ারকে নিয়ে অরবিন্দ স্বস্তির শ্বাস ফেলে বসল বটে, কিন্তু চোখদুটো তার নিরন্তর হলের একপ্রান্ত থেকে আর-একপ্রান্তে ঘুরে বেড়াতে লাগল। তার মনের কথা বুঝেই যেন বিয়ার পরিবেশন করতে এসে হেমাদ নিচু গলায় বলল, ‘গুপ্তাসাব এখনও আসেননি। মাঝে-মাঝে এরকম দেরি হয়!’

ন’টা বাজল। দশটাও বেজে গেল। ভূতে ভর করা দেখতে পাওয়ার আশা ত্যাগ করে কেউ-কেউ উঠে দাঁড়ালেন ফিরে যাওয়ার জন্যে। ঠিক সেইসময় বাইরে থেকে প্রচণ্ড উল্লাসধ্বনি ভেসে এল। যাঁরা যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁরা আবার স্ব-স্ব স্থানে বসে পড়লেন।

দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল শশী গুপ্তা। কিন্তু তার আজকের পোশাক দেখে অরবিন্দ অবাক হয়ে গেল। পরনে তার চোস্ত পায়জামা, গায়ে লক্ষ্নৌয়ের চিকনের কাজ করা পাঞ্জাবি। গলায় সোনার চেন, মাথায় গান্ধী-টুপি।

সোজা সে বারের সামনে এগিয়ে গিয়ে একটা টুলের ওপর বসে পড়ল। হেঁকে বলল, ‘হেমাদসাব!…বহুত তিয়াস…স্মোকিং সামথিং স্ট্রং…।’

তৃষ্ণা মেটাতে বেশ কয়েক পেগ শশী গুপ্তা নিঃশব্দে গলাধঃকরণ করল। কিছু হালকা ধরনের কথা বলল অরবিন্দ আর আয়ারের সঙ্গে। তারপর একেবারে মগ্ন হয়ে গেল নিজের মধ্যে।

মিনিটের পর মিনিট কাটতে থাকে। অনেকের মতো অরবিন্দও একসময় অধৈর্য হয়ে উঠল। হেমাদের কাছে গিয়ে অনুচ্চ কণ্ঠে বলল, ‘আর তো দেরি করা যাচ্ছে না, মিস্টার হেমাদ। আপনার সঙ্গে তো খুব দোস্তি—একটু জিগ্যেস করুন না কী হল ওঁর…।’

সে শেষ করার আগেই ঠোঁটে আঙুল চেপে কথা না বলতে ইশারা করল হেমাদ। তার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল, ‘সত্তনাশ! এ-সময়ে ওঁকে ডিস্টার্ব করা একদম বারণ।’

আয়ার সবিস্ময়ে বলে ওঠেন, ‘কেন?’

হেমাদ করুণ কণ্ঠে বলল, ‘আট-দশ দিন আগে এই ক্লাবে একটা ইনসিডেন্ট হয়ে গেল, স্যার। আপনারা হয়তো জানেন না, ছট্টু সিং বলে একজন নটোরিয়াস ট্রাক ড্রাইভার এ-মহল্লায় থাকে। নামে ট্রাক ড্রাইভার, আসলে লোকটা পয়লা নম্বরের গুণ্ডা। ইচ্ছে করে প্রাইভেট গাড়ির সঙ্গে নিজের ট্রাক লড়িয়ে দেবে, আওরত লোককো টিজ করবে, অর্নামেন্ট, ক্যাশ যা পাবে সার্চ করবে। সেদিন বিলকুল মাতাল হয়ে সে আমার ক্লাবে ঢুকল! চেয়ার ভাঙল, টেবিল উলটে দিল, আর যত্ত রেসপেকটেবল কাস্টমার ছিল, সব কোইকো থ্রেটেন করতে লাগল। লেকিন ফরচুনেটলি গুপ্তাসাব তখন ক্লাবেই ছিলেন। এখন যেমনভাবে বসে আছেন, ঠিক ওইভাবেই চুপটি করে বসেছিলেন…।’

অরবিন্দ বলে উঠল, ‘ওয়াজ হি ইন এ স্টুপর?’

‘হ্যাঁ। বলতে পারেন। ছট্টু সিং মাতোয়ারা ছিল তো। খেয়াল করেনি, ওঁর টেবিলের সামনে গিয়ে খিস্তি করে বলল, ”বে নবাবকো বাচ্চে, নিকালো পঁচাশ রুপাইয়া…জলদি…।” ব্যস! লাফ দিয়ে উঠে গুপ্তাসাব এমন একখানা আপার কাট ঝাড়লেন যে, ছট্টু সিং ছিটকে মেঝেয় গিয়ে পড়ল। তারপর কোনওরকমে উঠতে যাবে, আরে বাসরে বাস! এইসা একখানা কিক ঝাড়লেন গুপ্তাসাব—ঠিক পিলেকা মাফিক—।’

আয়ার বলে উঠলেন, ‘ইউ মিন পিলে, দি গ্রেট ফুটবলার?’

‘ইয়েস, স্যার,’ হেমাদ হাসি চেপে জবাব দিল, ‘নট দি সপ্লিন। ছট্টু সিং তো একদম ফ্ল্যাট হয়ে গেল। তখন গুপ্তাসাব আমাকে অর্ডার দিলেন, হারামির বাচ্চাটাকে থানায় পাঠিয়ে দাও। যদি থানায় নিতে না চায়, বলে দিয়ো এইচ. টি. ভেজা।’

অরবিন্দ কৌতূহলের সুরে প্রশ্ন করল, ‘এইচ.টি.-টা কী?’

হেমাদ সংক্ষিপ্তভাবে জবাব দিল, ‘হুডেড টেরর।’

তাতে বিশেষ কিছুই বোঝা গেল না। কিন্তু নতুন করে কোনও প্রশ্ন করার অবকাশও পেল না। কারণ এইসময় সমস্ত জড়তা ঝেড়ে ফেলে শশী গুপ্তা সোজা হয়ে উঠে বসল। দেহের পেশিগুলো তার তখন বজ্রকঠিন হয়ে উঠেছে। দু-চোখ দিয়ে ঠিকরে বেরোচ্ছে আগুনের শিখা। হলের চারদিকে একবার দৃষ্টিটা বুলিয়ে নিয়ে সে ঝপ করে টুল থেকে লাফিয়ে পড়ল। তারপর মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়ে হেমাদের দিকে তাকিয়ে কঠোর কণ্ঠে বলল, ‘আপনাদের ভালোর জন্যেই বলছি, কেউ একটা আঙুল পর্যন্ত নাড়াবার চেষ্টা করবেন না।’

কোণের দিকের একটা টেবিল থেকে খিকখিক করে হেসে উঠলেন একজন বলিষ্ঠদেহী ভদ্রলোক। সঙ্গে-সঙ্গে হিংস্র নেকড়ের মতোই ঘুরে দাঁড়াল শশী গুপ্তা। হাত দুটো দু-পাশে ঝুলিয়ে দিয়ে সে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে এগিয়ে যেতে-যেতে কর্কশ কণ্ঠে বলল, ‘এতে হাসবার কী আছে, মশাই? কাতুকুতু লাগবার মতো কিছু পেলেন নাকি? এই দেখছেন…’ হাতদুটো অকস্মাৎই সে ওপরে তুলল। দু-হাতে ধরা দুটো রিভলভার হলের তীব্র আলোয় যেন সকলের চোখগুলো ধাঁধিয়ে দিল। শশী গুপ্তা বিদ্রপের হাসি হেসে বলল, ‘এ দুটোয় বারোটা গুলি ভরা আছে। দরকার হলে আরও ডজন-ডজন ভরে নিতে পারব…।’

কোণের টেবিলে বসা সেই ভদ্রলোক যতখানি ভয় পেলেন, অরবিন্দ তাঁর দিকে চেয়ে কিছুমাত্র কম পেল না। অতি সন্তর্পণে হেমাদের দিকে ঘুরে সে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই, হেমাদ ভীতি-বিবর্ণ মুখে কোনও কথা না বলতে ইশারা করল। অর্থাৎ, বাধা দিয়ো না। যা করছে করুক।

এবার সে ফিরে তাকিয়ে বলল, ‘দোস্ত! তোমার গায়ের ওই অ্যাপ্রনটা খুলে চট করে টেবিলের ওপর বিছিয়ে ফেলো দিকিনি—তুরন্ত…।’

প্রতিবাদ করার এতটুকুও সাহস হল না হেমাদের। শশী গুপ্তার নির্দেশমতো গায়ের ঢিলে আংরাখাটা খুলে টেবিলের ওপর সে বিছিয়ে দিল। তারপর বিনীত কণ্ঠে জিগ্যেস করল, ‘এবার বলুন, কাকে কী সার্ভ করতে হবে।’

শশী গুপ্তার ঠোঁটের কোণে ক্ষীণ হাসির রেখা ফুটে উঠল। হালকা সুরে বলল, ‘মেঘনাদকে অনেকেই হুডেড টেরর বলেই চেনে।’

সারা হলঘরের প্রতিটি নর-নারীর মুখ দিয়ে একসঙ্গে বেরিয়ে এল এক অস্ফুট আর্তনাদ।

শশী গুপ্তা নীরবে উপভোগ করল সকলের মানসিক অবস্থাটা। তারপর হেমাদের দিকে তাকিয়ে অনুজ্ঞার সুরে বলল, ‘আজকের বিক্রি বাদে যা টাকা-পয়সা তোমার ক্যাশে আছে, সব বের করে নিয়ে ওই অ্যাপ্রনেতে রেখে দাও, হোটেলওয়ালা…।’

হল জুড়ে আর-একবার অস্ফুট আর্তনাদ উঠল।

সঙ্গে-সঙ্গে শূন্যে হাত তুলে হেমাদ এবার স্বয়ং সকলকে স্তব্ধ হতে অনুরোধ জানাল ‘মেঘনাদ যা বলছেন, আপনারা সবাই তাই করুন। কোনও কারণে আপত্তি করবেন না। ওঁর ওপর চড়াও হওয়ার বা ওঁকে মারধোর করবার চেষ্টাও করবেন না। কেউ যদি কোনও কৈফিয়ত চান, তাহলে যথাসময়েই পেয়ে যাবেন।’ কথা শেষে সে ড্রয়ার খুলে ক্যাশ যা কিছু টাকা-পয়সা ছিল, সব ধরে দিল অ্যাপ্রনের ওপর।

‘তুমি বুদ্ধিমান লোক, মালিক।’ বলে শশী গুপ্তা উদ্যত পিস্তল হাতে হলের চারদিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে ধীর গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘এবার একে-একে সবাই, যার কাছে যা আছে, ওয়ালেট, ভ্যানিটি ব্যাগ, হাতঘড়ি, হার, চুড়ি, হিরে, মুক্তোর টাব, নাকছাবি—সব অ্যাপ্রনে ফেলে দিন, প্লিজ, আমার সময় বড় অল্প।’

যন্ত্রচালিত পুতুলের মতো সবাই একে-একে এগিয়ে এসে নিজেদের মূল্যবান যা কিছু ছিল, সব জমা দিতে লাগলেন অ্যাপ্রনের ওপর। একপাল ভেড়া যেন।

নিরুদ্ধ জ্বালায় অরবিন্দের চোখদুটো দপদপ করে জ্বলছিল। অকস্মাৎ উঠে দাঁড়িয়ে সে বিদ্রোহ ঘোষণা করল : ‘আমরা কি তামাশা দেখতে এসেছি এখানে? আর তাই দেখতে গিয়ে নিজেদের যথাসর্বস্ব…।’

আবার বাধা দিল হেমাদ : ‘মিথ্যে বাধা দেবেন না, মিস্টার নাগ। মেঘনাদ যা বলেছে, সেই মতো কাজ করুন আপনারা। আমি বলছি, আপনাদের কারও কোনও লোকসানই হবে না।’

‘হবে না মানে? ব্যাগে আমার শুধু টাকা-পয়সাই নয়, সোমবার কলকাতায় ফেরার প্লেনের টিকিটটা পর্যন্ত আছে—।’

‘সোমবারের দেরি আছে, মিস্টার নাগ। বলছি তো, তার আগেই আবার সব ফিরে পাবেন।’

এক মুহূর্ত ইতস্তত করে অরবিন্দ প্যান্টের পকেট থেকে ওয়ালেটটা বের করে ছুড়ে দিল অ্যাপ্রনের ওপর।

‘গুড।’

নানা ধরনের মালপত্রে বোঝাই অ্যাপ্রনটা শশী গুপ্তা এবার ঝোলার মতো বেঁধে কাঁধে ঝোলাল। হাত দুটোয় ধরা রইল কিন্তু উদ্যত পিস্তল দুটো। সুললিত কণ্ঠে আবৃত্তি করতে-করতে এক-পা এক-পা করে পিছু হটতে লাগল :

 ‘ত্বয়া হৃষিকেশহৃদিস্থিতেন

 যথা নিযুক্তোহস্মি তথা করোমি।

 ত্বয়া হৃষিকেশ…।’

একসময় হল থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল সে। তবু সকলে বোবা দৃষ্টি মেলে সম্মোহিতের মতোই দাঁড়িয়ে রইলেন।

নীরবতা ভাঙল হেমাদই প্রথম : ‘কিচ্ছু ভাববেন না আপনারা। গুপ্তাসাব এখুনি ফিরে আসবেন।’

কিন্তু সে কখন? এ প্রশ্নটা সকলের মনেই। শুধু অরবিন্দ আয়ারের একখানা হাত চেপে ধরে সংশয় প্রকাশ করল ‘আপনি বিশ্বাস করেন, মিস্টার আয়ার? সত্যিকার ফিরে আসবেন?’

আয়ার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘লেটস ওয়েট অ্যান্ড সি।’

মিনিটের পর মিনিট কাটতে থাকে। আধঘণ্টা…একঘণ্টা। রাত নিশুতি হয়ে গেল। এরপর অপেক্ষা করার মতো ধৈর্য আর কারও রইল না। সকলে চড়াও হলেন হেমাদের ওপর : ‘এখনও ধৈর্য ধরতে বলেন?—যান, টেলিফোন করুন—টেলিফোন করুন পুলিশকে—।’

হেমাদ কিন্তু রাজি হল না। হাতজোড় করে বারবার বলতে লাগল, ‘এক্সকিউজ মি—মাফ করতে হবে—গুপ্তাসাব আমার রেসপেকটেবল কাস্টমার—ওঁর কোনও ক্ষতি যদি হয়—তা ছাড়া আমার ক্লাবের রেপুটেশানের কথাটাও তো ভাবতে হয়—।’

কেউ তাকে, কেউ নিজেকেই, অভিসম্পাত দিতে-দিতে ফিরে গেলেন সবাই। হোটেলে ফেরার পথে মুহ্যমান অরবিন্দকে চাঙ্গা করে তোলবার জন্য আয়ার বারংবার সান্ত্বনা দিতে লাগলেন : ‘শেষপর্যন্ত প্লেনের টিকিট যদি ফিরে না পান তো কিছু ভাববেন না। আমাদের অফিসের কুলকার্নি ঠিক ম্যানেজ করে দেবে—আর টাকা যা লাগে আমাদের অফিস থেকে লোন নিয়ে নেবেন।’

অরবিন্দ মনে-মনে শুধু বলল, ‘একেবারে জলবৎতরলং!’

পরদিন সকাল থেকেই আগের দিনের নারী-পুরুষ সব খরিদ্দারই গুটিগুটি এসে জমতে লাগলেন ভি ভি ভি ক্লাবের সামনে। সকলের চোখে-মুখে অদম্য কৌতূহল আর উত্তেজনা। আয়ারকে নিয়ে অরবিন্দও হাজির হল কোনওরকমে ব্রেকফাস্টটা সেরে।

রবিবার বলেই কঙ্কনি হেমাদ বোধকরি অনেকটা বেলায় এল। তার মুখের চেহারায় কিন্তু কোনও দুশ্চিন্তা বা উৎকণ্ঠার ছাপও ছিল না। তালা খুলে সে যবনিকার মতো মেঝেস্পর্শী. শাটারটাকে ওপরে ঠেলে দিতেই, তার নজরে পড়ল তার অ্যাপ্রনে খুব সুন্দরভাবে জড়ানো পার্সেলটা দরজার গায়ে ঝুলছে। তার ভেতর থেকে আগের রাতে খোওয়া-যাওয়া সকলের ওয়ালেট, ডায়েরি, গাড়ি চালাবার লাইসেন্স, চিঠিপত্র, প্রিয়জনের ফটো, সবকিছুই পাওয়া গেল। পাওয়া গেল না শুধু টাকাকড়ি, হিরে-মুক্তো, হাতঘড়ি, দামি পেন ইত্যাদি।

ঝাঁপিয়ে পড়ে সবাই যে-যার নিজের জিনিস তুলে নিলেন। উলটে-পালটে ঝাঁকানি দিয়ে বারবার দেখতে লাগলেন, কিন্তু কোথাও থেকে একটা ফুটো পয়সাও বেরোল না।

মাথায় হাত দিয়ে সবাই চিৎকার করে উঠলেন। রুমালে চোখ মুছতে লাগলেন অভিজাত মহিলারা।

শেষপর্যন্ত হিসেব হল, নগদে এবং জিনিসপত্রে লাখ টাকার ওপর অপহৃত হয়েছে!

হোক, তবু যতটা দুঃখ বা আঘাত পাওয়ার কথা, কেউই বোধকরি তা পেলেন না। মূল্য দিতে হয়েছে ঠিকই, কিন্তু এমন অভিনব অভিজ্ঞতার কথাটা জীবনে কেউ কোনওদিন হয়তো ভুলতে পারবেন না।

আয়ার অরবিন্দের কাঁধে হাত রেখে মৃদু কণ্ঠে বললেন, ‘ম্যান লিভস টু লার্ন। চলুন, কুলকার্নিকে টিকিটের জন্যে ধরিগে।’

কলকাতায় অবশ্য ফিরে আসতে অরবিন্দকে বেশি কাঠখড় পোড়াতে হয়নি। আয়ারের কাছ থেকে ধার করে আনা টাকাটাও তাঁকে পাঠিয়ে দিয়েছে, সেইসঙ্গে চিঠিতে লিখেছে, ‘ভূতাবিষ্টের প্রকৃত রহস্যটুকু আমার কাছে আজ পরিষ্কার হয়ে গেছে, মিঃ আয়ার। জীবন্ত কোনও মানুষের ওপর প্রেতাত্মা ভর করে না। আসলে ভর করে শশী গুপ্তার মতন একজন তুখোড় পরস্বাপহরণকারী। কী অবলীলাক্রমেই না লোকটা ভি ভি ভি ক্লাবের তাবৎ খরিদ্দারকে জারক লেবুর মতোই জারিয়ে রেখেছিল মাসের পর মাস। আর সেই কারণে ধীরে-ধীরে এগিয়ে গেছে নিজের অভীষ্ট সিদ্ধির পথে। আমার মতে, শশী গুপ্তা এ-যুগের একজন মহত্তম শিল্পী।’

মাসিক রোমাঞ্চ

পুজো সংখ্যা, ১৯৮৮

___

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *