ভুল (১)
এবার একটু গতানুগতিকভাবে আরম্ভ করি, স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরা যেভাবে পরীক্ষার খাতায় প্রবন্ধ শুরু করে ঠিক সেইভাবে একটা ইংরেজি প্রবাদবাক্য দিয়ে।
প্রবাদবাক্যটি বিখ্যাত এবং ইংরেজি জানা লোমাত্রেরই পরিচিত, To err is human. অর্থাৎ মানুষ ভুল করে।
তবে অনেকেই হয়তো জানেন না এটি একটি বাক্যের অর্ধাংশ, এর পরের অংশ হল, to forgive divine. সম্পূর্ণ বাক্যটি হল, To err is human, to forgive divine, প্রায় তিনশো বছর আগের এই বাক্যবন্ধ। রচনাকার মহামতি আলেকজান্ডার পোপ।
এরও বহু-বহুকাল আগে চিনদেশীয় দার্শনিক ও পণ্ডিত কনফুসিয়াস এই বলে মানুষকে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন যে, “ভুল করার মধ্যে লজ্জিত হওয়ার কিছু নেই।’
আসলে আমরা যাকে অভিজ্ঞতা বলি সে জিনিসটা হল, কোনও কিছু ভুল করার পরে বুঝে ফেলা যে এই ভুলটা এর আগেও একবার আমি করেছিলাম।
আরেকজনের কথা মনে পড়ছে কিন্তু তাঁর নাম মনে পড়ছে না যিনি বলেছিলেন, মানুষের সবচেয়ে বড় ভুল হল সেইটা যে ভুল থেকে সে কিছু শেখে না। এই কথাই আবার অন্যত্র অন্যভাবে পেয়েছি, সেখানে বলা হয়েছে, যে কখনও ভুল করে না সে কখনও কিছু শেখে না এবং যে কখনও ভুল করে না সে কখনও কিছু করেও না, আর কিছু না-করাটাই সবচেয়ে বড় ভুল।
লিখতে বসেছি রম্য নিবন্ধ। পাঠিকা শ্রীমতীর তাই ফরমাশ, কিন্তু ওপরের দুই অনুচ্ছেদ রীতিমতো শব্দধাঁধা বা ক্রশওয়ার্ড পাজল হয়ে গেল।
সুতরাং এবার তা হলে গল্প।
ঘটনাটির আমি প্রত্যক্ষদর্শী। রেলগাড়ির কামরায় দেখেছিলাম।
দূরপাল্লার দ্বিতীয় শ্রেণির স্লিপার কোচ। একটি ভদ্রমহিলা দুটি দুর্দান্ত বালককে নিয়ে যাচ্ছেন। সেই বালকদুটির অত্যাচারে ও চাঞ্চল্যে কামরাসুদ্ধ লোক তটস্থ। এর জিনিস ছুড়ছে, ওর জিনিস ঘাঁটছে। কুঁজোর জল ঢেলে দিচ্ছে, লোকের হাতের বই ধরে টানাটানি করছে ইত্যাদি ইত্যাদি।
অবশেষে তিতিবিরক্ত হয়ে এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক দুর্দান্ত বালকদুটির অভিভাবিকাকে প্রশ্ন করলেন, ‘মহাশয়া, এইমাত্র যে ছেলেটি লাথি মেরে আমার জুতোজোড়া বেঞ্চির নীচে ঢুকিয়ে দিয়ে তার থেকে একটা মোজা বার করে ফুঁ দিয়ে বেলুনের মতো ফোলানোর চেষ্টা করছে, সেটি কি আপনার ছেলে?’
ভদ্রমহিলা বললেন, ‘না, ও আমার ছেলে নয়, আপনি ভুল করেছেন। ও আমার বোনপো, আমার বড় বোনের ছেলে। এখন যে-ছেলেটি সামনের বাঁদিকের জানলা দিয়ে আপনার ছাতা ফেলে দিচ্ছে, সে হল আমার ছেলে।’
ভদ্রলোকের ভুলটা নিশ্চয়ই খুব মারাত্মক নয়। কিন্তু এবার এক ভদ্রমহিলার মারাত্মক ভুলের একটা বহুদিনের পুরনো কাহিনী স্মরণ করি।
ঠিক কাহিনী নয়, কাহিনী-নাটিকা।
স্থান : আদালতের বিচারকক্ষ।
বিচারক বসে আছেন। উকিল, মুহুরি, পেয়াদা, পেশকাররা রয়েছেন যেমন থাকেন আদালতে। বাঁদিকে সাক্ষীর কাঠগড়ায় এক জাঁদরেল মহিলা ডানদিকে আসামির কাঠগড়ায় এক প্রচণ্ড প্রহৃত ব্যক্তি, তার নাক ফাটা, চোখের কোণে কালশিটে, ফোলা ঠোঁটে রক্ত শুকিয়ে রয়েছে।
বিচারক : (সাক্ষী মহোদয়ার উদ্দেশে) দেখুন মহাশয়া, আপনার সাহস দেখে আমি অত্যন্ত বিস্মিত বোধ করছি। এমন একজন কুখ্যাত সিঁদেল চোর। তাকে অন্ধকার ঘরের মধ্যে ধরে ফেললেন। এমন পেটানো পেটালেন।
আসামির কাঠগড়ায় চোর : (গোঙাতে গোঙাতে) হুজুর উনি মেরে আমার হাত গুঁড়ো করে দিয়েছেন, জান কয়লা করে দিয়েছেন।
বিচারক : (আসামির দিকে মুখ করে) চুপ। (সাক্ষীর দিকে মুখ করে) সত্যি ধন্য আপনার সাহস, ধন্য আপনার শক্তি।।
সাক্ষীর কাঠগড়ায় ভদ্রমহিলা : (বিনীতভাবে) না হুজুর, এটা শক্তি বা সাহসের ব্যাপার নয়। অন্ধকারে আমি বুঝতে পারিনি, আমি ভুল করেছিলাম। আমি ভেবেছিলাম আমার স্বামী বুঝি দেরি করে বাড়ি ফিরল।
অতঃপর একটা রমণীয় ভুলের গল্প বলি।
এক বড় কোম্পানির বাৎসরিক পিকনিক হচ্ছে গঙ্গার ধারের এক বাগানবাড়িতে। বছরের এই একটা দিন, এই উৎসবে কোম্পানির বড়সাহেব থেকে সদ্যনিযুক্ত কনিষ্ঠ কেরানি সবাই একত্র হয়। অনেকেই সপরিবারে আসেন।
এই বনভোজনে এক সুরূপা, সুবেশ ভদ্রমহিলার সঙ্গে খুব আলাপ হল এক অল্পবয়সি কেরানির।
ভদ্রমহিলাকে অনেক কথা বলতে বলতে অবশেষে সে বলল, ‘ওই যে ওখানে দেখছেন মোটা মতো হুমদো একটা লোক পিছন ফিরে চুরুট টানছে, ও হল আমাদের বড়সাহেব, ওর মতো বজ্জাত, শয়তান লোক আর এই ভূভারতে নেই।’
ভদ্রমহিলা এই কথা শুনে অবাক হয়ে বললেন, ‘আপনি জানেন আমি কে?’
চমকিত হয়ে কেরানিটি বলল, ‘না। তা তো জানি না। আমি কি কোনও ভুল করলাম?’
ভদ্রমহিলা বললেন, ‘আপনি খুব বড় ভুল করেছেন। আমি ওই বড় সাহেবের স্ত্রী।’
সন্ত্রস্ত হয়ে কেরানিটি এবার প্রশ্ন করল, ‘আপনি কি জানেন আমি কে?’
ভদ্রমহিলা বললেন, একটু অবাক হয়েই বললেন, ‘না, তা তো জানি না।’
কেরানিটি তখন বলল, ‘যাক, তা হলে খুব বেঁচে গেছি। এবার তবে পালাই।’ এই বলে সে অতি দ্রুত পিকনিকের আসর পরিত্যাগ করল, যাতে বড়সাহেব জানতে না পারে যে সে কে?
অতঃপর আর একটিমাত্র ভুলের আখ্যান আপাতত বাকি আছে। সেটা একটা খুব সাধারণ ভুলের গল্প, যা আমাদের জীবনে প্রতিনিয়তই ঘটে।
রমেশবাবু পাড়ার ইলেকট্রিকের দোকানে গিয়ে জানিয়ে এলেন যে তাঁর বাড়ির কলিংবেল খারাপ হয়েছে। সারানোর জন্যে কোনও মিস্ত্রি যেন পাঠানো হয়।
দু’দিন চলে গেল, তবু কোনও মিস্ত্রি এল না দেখে রমেশবাবু আবার সেই ইলেকট্রিকের দোকানে গেলেন, গিয়ে বললেন, ‘কই, আপনার কোনও মিস্ত্রি তো দু’দিনের মধ্যে গেল না।’
দোকানদার বললেন, ‘দু’দিন অন্তত চারবার আমার লোক আপনার বাড়ি থেকে কারো সাড়া না পেয়ে ফিরে এসেছে।’
রমেশবাবু অবাক, বাসায় তো সব সময়েই কেউ-না-কেউ ছিল। ফিরে আসার তো কথা নয়। দোকানদারকে এ কথা বলতে তিনি সেই মিস্ত্রিকে ডাকলেন। মিস্ত্রি এসে বলল যে, শুধু কাল-পরশু চারবার নয়, আজ সকালেও সে একবার গিয়ে ফিরে এসেছে। কলিংবেল টিপে টিপে তার দু’হাতের তর্জনী আর বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠে ব্যথা হয়ে গেছে, কিন্তু তবু কেউ দরজা খোলেনি।