ভিজে বারুদ – প্রেমেন্দ্র মিত্র
দুটো সাইক্ল্-রিক্শ নাকি ছিল, এখন একটামাত্র চালু আছে। আরেকটা বিগড়ে গেছে কি না বলা যায় না, কিন্তু এই উচুঁনিচু পাহাড়-টিবির দেশে চড়াই-উৎরাই বেয়ে সে গাড়ি চালাবার মত জোয়ান পাওয়া যায় না। সাইক্ল্-রিক্শ চেপে তাড়াতাড়ি যাবার শখও বড় কারুর নেই। এখানে যেমন দিগন্ত-ছোঁয়া ঢেউ-খেলান মাটি তেমনি অঢেল সময়।
সেই সনাতন গরুর গাড়িতে ঢিকিয়ে ঢিকিয়ে যাওয়াই তাই এখানকার রেওয়াজ।
শহরে যদি যেতে চাও তাহলে সে গরুর গাড়িতে চড়বারও দরকার নেই। শহর বলতে তো স্টেশনের কোল ঘেঁষে একটা রাস্তা আর লাল ধুলো মাখান কটা শুকনো রুক্ষ চেহারার দোকানঘর। স্টেশন থেকে বেরিয়ে ডাকঘব আর কাছারিবাড়ি ছাড়িয়ে এসে একহাঁটু ধুলোয় পা যেখানে ডুবে যাবে সেখানেই জানবে শহর শুরু। প্রথমে শালের খুঁটির আড়তটা চোখে নাও পড়তে পারে কিন্তু তার পরেই নিউ ন্যাশন্যাল ব্যাঙ্কের সাইনবোর্ডটা লক্ষ করতেই হবে। টিনের ছাপরা হলে কি হয়, সোনার জলে রঙকরা প্রকাণ্ড সাইনবোর্ডটা কোপনি পবা কাঙালের মাথায় জবির পাগের মত বেখাপ্লাভাবে টলমল করছে। ব্যাঙ্কের উল্টোদিকে মুদীখানা, তারপর দুপাশে মনিহারি, আর হাতা কড়া বেড়ি, এলুমিনম আর কুমোরের দোকান পেরিয়ে দরজির দোকানের পাশে, ডাক্তারখানার উল্টোদিকে অন্নপূর্ণা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের সার সার পাতাভাঙা বেঞ্চিতে গিয়ে বসতে পার। চা মিষ্টি পান সিগারেট সবই দোকানে পাওয়া যায়। শহর এইখানেই প্রায় শেষ, এরপর কড়া রোদ মাথায় করে সামনের রাস্তা ধরে যাবার যদি সাহস থাকে তাহলে কিছুদূরে হয়ত কয়লার ডিপো পাবে। চালের কল পর্যন্ত যাবার শখ থাকলে কমলা নাসারির বাগানটাও দেখে আসতে পার। কিন্তু শহর এই শালপাতা-ছড়ান রাঙা ধুলো-মাখান রাস্তাটুকুতেই শেষ।
শহরের বাইরে কোথাও যাবার উৎসাহ যার নেই সে অন্নপূর্ণা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের কেরাসিন কাঠের বেঞ্চিতে বসে ছেঁড়া অয়েলক্লথ মারা টেবিলে পর পর দু কাপ চা নিয়ে যতক্ষণ সম্ভব কাটায়। সময় কাটাবার দরকার আনে দুচার জনের আছে। তারাও এদিকে-ওদিকে বসে চায়ে চুমুক দেয়, বিড়ি বা সিগারেট টানে, টেবিলের মাছি তাড়ায়, এঁটো খাবারের ঠোঙা নিয়ে রাস্তার কুকুরগুলোর ঝগড়ায় এক আধবার কান দেয়। কিন্তু নতুন অচেনা লোক বলে কারুর দিকে বিশেষ কোন মনোযোগ দেয় না।
মনোযোগ দেবার মতই বা কি আছে? যুদ্ধের বাজারে এই নেহাত নগণ্য ধুলোয় ঢাকা ঘুমোন শহরও হঠাৎ মানচিত্রের ওপর জেগে উঠেছে। এধারে-ওধারে দুটো এরোড্রাম তৈরি হচ্ছে, রাস্তা বেরুচ্ছে আচমকা মাঠ জঙ্গল ভেঙে। কনট্র্যাক্টার দালাল কুলি মজুর ব্যাপারী কত আসছে যাচ্ছে। নতুন মুখ তার মধ্যে কিছু এমন অদ্ভুত ব্যাপার নয়।
তা ছাড়া হঠাৎ চেয়ে দেখে কৌতূহলী হবার মত বিশেষত্ব কিছু নেই সে মুখে বা চেহারায়। নেহাত সাদাসিদে রুগ্ণ চেহারার আধবুড়ো একটা মানুষ, উস্কোখুস্কো কাঁচা-পাকা চুল, দাড়িটা অন্তত দিন দুয়েক কামান হয়নি, পোশাক-পরিচ্ছদও সাধারণ।
না, অঘোরকে কেউ এখানে চেনে না, চেনবার আগ্রহও কারুর নেই। আরো ঘন্টা খানেক সে এইখানে বসে কাটিয়ে দিতে পারে। খানিক বাদেই ফুলজলার বাস এসে পৌঁছাবে। দোকানের লোকের কথাবার্তায় সে জানতে পেরেছে। ইচ্ছে করলে সে সেই বাসে করেই সদরে চলে যেতে পারে। ট্রেনের জন্যে বিকেল পর্যন্ত তাহলে তাকে অপেক্ষা করতেও হবে না।
কিন্তু এত তাড়াতাড়ি সদরে যাবার জন্যে সে এখানে আসেনি। তাই সে আরো খানিকক্ষণ বসেই থাকে। চায়ের পেয়লাটায় সিগারেটের প্রান্ত আর ছাই জমতে থাকে। রাস্তার তপ্ত ধুলো দমকা হাওয়ায় মাঝে মাঝে উড়ে আসে।
তাকে কেউ যেমন চেনে না, চেনা কোন মুখও তার চোখে পড়ে না। না পড়বারই কথা। কোন, দিন এখানে সে কি ছিল? সে নিজেই বিশ্বাস করতে চায় না।
এমনি একটি রাঙাধুলোয় ময়লা রাস্তা হয়ত সে চিনত। দু-চারটে ফাঁক ফাঁক খোলায় ছাওয়া দোকানঘর তার দু’পাশে ছড়ান।
রাস্তার দু’ধারে খানা কাটা। তারই ওপর একটা ভাঙা বাঁশের সাঁকোর এখনো কোন চিহ্ন আর আছে কি!
তখনই সাইকেলটা তার ওপর দিয়ে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া যেত না, হাতে করে হাঁটিয়ে নিয়ে যেতে বেশি দূর অবশ্য যেতে হত না। সরু পায়ে-হাঁটা গলির মত রাস্তাটা দু’পাশের কটা মেটে বাড়ি পার হয়েই যেখানটায় গিয়ে পড়ত সেটা শহরের অভিযানের সামনে হটে-যাওয়া অরণ্যের শেষ প্রান্ত বলা যায়। অনেক বড় বড় গাছই সেখানে নির্মমভাবে কাটা পড়েছে তবু শাল পিয়াল মহুয়ার দল এখনও একেবারে দখল ছাড়েনি।
এই আধা-জঙ্গলের মাঝে একটি অত্যন্ত বেমানান বাঁশের-ভারা বাঁধা অর্ধ-সমাপ্ত পাকা বাড়ির সামনে এসে বাইরের একটা ভারার গায়ে সাইকেলটা হেলিয়ে রাখলেই চলত।
দূর থেকে দেখলে বাড়িটায় কেউ যে বাস করতে পারে তা মনে হবার কথা নয়। চারিধারের অরণ্য-বষ্টনীর ভয়ে কারা যেন তৈরি করতে করতে বাড়িটা ফেলে চলে গেছে বলেই মনে হওয়া স্বাভাবিক। বাঁশের ভারাগুলো খোলা হয়নি। ইঁটের দেওয়ালগুলোতে চুনবালির পলস্তারা পড়েনি, রোদে জলে এখানে-সেখানে শুধু শ্যাওলার ছোপ ধরছে। চুনমাখা বাল্টি কড়া পর্যন্ত এধারে-ওধারে ছড়ান।
বাঁশের ভারার তলা দিয়ে সাজান ইঁটের ধাপ বেয়ে তারপর ভেতরে ঢোকা যেত। ভেতরটা বাহিরের মতই অসম্পূর্ণ। গুটি চারেক মাত্র ঘর, তারও দুটিতে জানলা দরজা বসান হয়নি। বিরাট ফোকরগুলো দাঁত-বার-করা ইঁটের দেয়ালের গায়ে হাঁ করে আছে।
ওরই মধ্যে যে ঘরটি মন্দের ভালো, তার ভেতরে ঢুকে বড় তক্তপোশটার ধারে গিয়ে বসার পর একটা অস্বস্তিকর গন্ধ নাকে যেত। টার্পিন বা ঐ জাতীয় কিছু মালিশের তেলের গন্ধ। সারাক্ষণ এই ঘরটায় ও গন্ধ যেন লেগেই থাকে। জানলা দরজা ভেজান আধ-অন্ধকার ঘরটাই যেন অসুস্থ।
দিনের পর দিন ওই অস্বস্তিকর গন্ধের মধ্যে ওই বদ্ধ ঘরের ভেতরে অনেক বিকেল সে কাটিয়েছে। নীরবে তক্তপোশটির ধারে আড়ষ্টভাবে সে বসে থেকেছে। পিঠের দিকে মোটা মোটা দুটো তাকিয়া দিয়ে উঁচু করে বসান রোগীর বুকে যিনি মালিশ করছেন মাথার ঘোমটা অভ্যাসবশত একটু টেনে দিয়ে কৌতুহলহীন দৃষ্টিতে তিনি একবারটি মুখ তুলে না তাকালে মনে হত তার উপস্থিতি কেউ বুঝি লক্ষই করেনি।
কোনদিন সে অমনি নীরবে অনেকক্ষণ বসে থেকে নীরবেই উঠে বেরিয়ে গেছে। কোনদিন অমলা দেবী মালিশ শেষ করে শিশিটায় ছিপি এঁটে উঠে যেতে যেতে ইশারায় তাকে ডাক দিয়ে গেছেন।
এদিকে আর একটি মাত্র ব্যবহারযোগ্য ঘর। ঘরটা এরকম অন্ধকার নয়। কিন্তু আলোয় তার দুর্দশা আরো পরিস্ফুট। দুটি জানলার একটিতে মাত্র কাঠের পাল্লা জুটেছে আর একটিতে দরমার ঝাঁপ দিয়ে কাজ সারা হয়। একাধারে শোবারঘর বৈঠকখানা ও ভাঁড়ার। ময়লা তালি দেওয়া মশারি খাটান একটা বড় তক্তপোশ আছে এক পাশে। বাকি জায়গা হাঁড়িকুঁড়ি চুপড়ি টিন তোরঙ্গ বাক্স কাপড়ের আলনায় ভর্তি।
অঘোর যখন ঘরে গিয়ে ঢোকে অমলা দেবী তখন তক্তপোশের ওপর পানের সরঞ্জাম বিছিয়ে পান সাজতে বসে গেছেন। পান সেজে মুখে না দেওয়া পর্যন্ত তিনি কোন কথা বলেন না। তারপর অঘোরের দিকে ফিরে বেশ একটু ভূমিকা করেই শুরু করেন,—কলকাতার বাড়িটা তো এবার বিক্রি করতেই হয়, বুঝেছ অঘোর?
ডাক্তারখানায় ওষুধ নেওয়ার সূত্রে এদের সঙ্গে আলাপ হওয়া অবধি কলকাতার বাড়ির কথা সে শুনে আসছে। বলবার মত কোন কথা তার মুখে আসে না। মুখে তার কোনদিনই-বা কথা সরে।
অমলা দেবী অবশ্য তার উত্তরের জনন্য অপেক্ষা করেন না, নিজেই বলে চলেন,—আজ দশ মাস ধরে ভাড়া বাকি, দেখাশোনা করবার যখন কেউ নেই তখন ও দায় চুকিয়ে দেওয়াই ভালো। কি বল?
একটা কিছু বলা উচিত। কিন্তু অঘোর সঙ্কুচিতভাবে তক্তপোশটার ধারে বসে মাথা নিচু করেই থাকে। অমলা দেবী বহুবার শোনা কথাগুলোই আবার আবৃত্তি করে যান,—বাড়ি তো আর ছোটখাট নয়, নিচে ওপরে অমন চোদ্দখানা ঘর, বিক্রি করলে আজকের বাজারে কম করেও ষাট-সত্তর হাজার টাকা। তাতে এ বাড়িটাও শেষ করে নেওয়া যাবে, হাতেও বেশ কিছু থাকবে।
হঠাৎ সুরটা বদলে অমলা দেবী বলেন, কিন্তু এ মাসটা কি করে যে চালাই তাই ভাবছি। বাড়ি তো আর হুট বলতে বিক্রি হবে না। এ মাসে ওঁর পেন্সনটাও এখনো আসেনি।
শশধরবাবুর পেন্সনটার রহস্য অঘোর এতদিনেও বুঝতে পারেনি। আলাপ হওয়া অবধি পেন্সনের কথা সে শুনে আসছে, কিন্তু এ পর্যন্ত তার সামনে কোনদিন পেন্সনের টাকা এ বাড়িতে আসতে দেখেনি।
অঘোরের কাছে কোন সাড়া না পেয়ে অমলা দেবী এবার আসল কথাটায় না এসে পারেন না,—তুমি সেগুলোর কোনো ব্যবস্থা এখনো করতে পারনি?
কেন যে পারেনি তা বলবার মত সাহস বা শক্তি অঘোরের নেই। তবু এবার তার মুখ দিয়ে অস্ফুট দুটো কথা বার হয়। অপরাধীর মত মাথা নিচু করে সে বলে,—না মাসিমা এখনো পারিনি।
মাসিমা এবার বেশ বিরক্তই হন,—এ পোড়া দেশে কি ভালো একটা স্যাকরা নেই, সোনাও চেনে না।তুমি বোধ হয় চেষ্টাও করনি!
চেষ্টা করেছে কি না অঘোর সে কথা জানাতে পারে না। একটু ইতস্তত করে পকেট থেকে একটা খাম বার করে মাসিমার হাতে কুণ্ঠিতভাবে দিয়ে বলে,—আপাতত এইতে যদি……
বাকি কথা তার জিভে জড়িয়ে যায়।
কিন্তু তার জন্য কোন অসুবিধা হয় না। মাসিমা অঘোরের মত অত শোভনতার ধার ধারেন না। খামটা বিনা দ্বিধায় হাতে নিয়ে খুলে নোটগুলো গুনতে গুনতে মুখে অবশ্য তিনি বলেন,—কিন্তু তোমার কাছে ধার তো দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে। তোমারও তো কিছু জমিদারি নেই। ওই সামান্য চাকরিতে আর কত পারবে!
ভদ্রতার খাতিরে একটু প্রতিবাদ করাও অঘোরের ক্ষমতায় কুলোয় না। মাথা নিচু করে সে তক্তপোশের একটা পেরেকের ওপরই যেন একান্তভাবে মনোনিবেশ করে।
অঘোরের চাকরি সামান্য। কিন্তু তবু সে পেরে আসছে আজ পাঁচ মাস ধরে। পাঁচ মাস আগে আলাপ হয়েছিল একটা সামান্য ব্যাপারে। ডাক্তারবাবু একদিন ধমক দিয়ে তাকে এ-বাড়িতে তাগাদায় আসতে বলেছিলেন। দু’মাস ধরে ডাক্তারখানা থেকে ওষুধ গেছে কিন্তু একটি পয়সাও তার বদলে পাওয়া যায়নি। ধারে এতদিন ওষুধ দিয়ে যাওয়া তারই অপরাধ সন্দেহ নেই।
তাগাদায় এসে শুধু হাতেই অঘোরকে ফিরতে হয়েছিল। কিন্তু এমন কি সে নিয়ে গিয়েছিল কে জানে যার জন্যে নিত্য নিয়মিতভাবে প্রতিদিন তাকে এই বাড়িটিতে আসতে হয়েছে।
অঘোর নির্বোধ বোধ হয় নয়। যে তিনটি মানুষ এ-বাড়িতে থাকে তাদের প্রত্যেককে সে যে একেবারেই চিনতে পারে না, তাও বোধ হয় বলা যায় না। শশধরবাবু যেদিন সুস্থ থাকেন, সেদিন কথায়বার্তায় অঘোরের প্রতি তাঁর তাচ্ছিল্য ও অবজ্ঞা বিন্দুমাত্র গোপন থাকে না ; অমলা দেবী তাকে অবজ্ঞা করেন না, কিন্তু তাঁর স্নেহের পরিমাণ কতটুকু তা বোঝা খুব কঠিন নয়। তারপর বাকি থাকে শুধু লতিকা। তার দুর্নিবার আকর্ষণের মূল এইখানেই—একথা ভাবা স্বাভাবিক। কিন্তু লতিকার সঙ্গে কদিন কতক্ষণই বা তার দেখা হয়!
আর লতিকা তো তাকে মানুষ বলেই গণ্য করে না। কখনো-সখনো কথা যা কিছু বলে তা বেশিরভাগই দাঁত খিচিয়ে।
“তোমার মাথায় কি আছে বলতে পার? একটা কাজ ভুলেও ঠিকমত করতে পার না!”—কিংবা “আমার উল যদি আজ রঙ মিলিয়ে না আনতে পার, তাহলে এ বাড়িমুখো আর হোয়ো না, বুঝেছ অঘোর!”
মাসিমা বরং মৃদু প্রতিবাদ করে বলেছেন,—এ তোর বড় অন্যায় কিন্তু লাতু,—অঘোরদা কি অঘোরবাবু বলতে পারিস না! বয়সে তো তোর চেয়ে বড় ; নাম ধরে ডাকা কি?
অঘোরের তাতে লাঞ্ছনা আরো বেড়েছে। ওকে আবার অঘোরবাবু বলতে হবে?—বলে লতিকার সে কি উচ্ছ্বসিত হাসি।
অঘোর এ হাসিতে অস্বস্তি বোধ করেছে, কিন্তু রাগ করেছে বলে তো মনে পড়ে না। নিজের সম্বন্ধে কোন ভ্রান্ত বড় ধারণা তার বোধ হয় ছিল না। তার যা বিদ্যা বুদ্ধি চেহারা তাতে লতিকা তাকে বাড়ির একজন সাধারণ কর্মচারীর চেয়ে বেশি সম্মান যে করতে পারে না একথা সহজভাবে মেনে নিতে যেন তার কোন ক্ষোভ নেই।
না, এ-বাড়িতে আন্তরিকতা দূরে থাক, কোনো সৌজন্য পর্যন্ত না পেয়ে কেন যে সে দিনের পর দিন এসে নিঃশব্দে নিজেকে এদের জন্যে নিঃশেষে বিলিয়ে দিয়েছে তা বোঝা শক্ত।
সুস্থ থাকলে শশধরবাবু চটের ডেক-চেয়ারটায় হেলান দিয়ে অঘোরকে দিয়ে খবরের কাগজের টেন্ডার আর ব্যবসা সংক্রান্ত বিজ্ঞাপনগুলো পড়িয়ে শুনতে শুনতে তার ভুল ইংরিজি উচ্চারণে হঠাৎ চটে গিয়ে শেষ পর্যন্ত এই নিয়ে কতদিন ঠাট্টা করেছেন।
তুমি নাকি ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত পড়েছিলে অঘোর! ভেটেরিনারি হাসপাতালের মত ওইরকম কলেজে না কি? ঘোড়া-গুরুতে যেখানে পড়ে!
মাসিমা কাছে বসে সুতোবাঁধা চশমাটা চোখে দিয়ে বোধ হয় শশধরবাবুরই একটা জামা সেলাই করছিলেন, হেসে একটু অনুযোগের স্বরে বলেছেন,—তোমার একটু মায়াদয়া নেই বাপু, কাজকর্ম ফেলে কষ্ট করে তোমায় কাগজ পড়ে শোনাচ্ছে, তার বদলে ওর উচ্চারণ নিয়ে ঠাট্টা। অমন করলে ও আর এ-বাড়ি শেষকালে আসবে না।
আসবে না তো যাবে কোন চুলোয়!—বলে হাসতে গিয়ে শশধরবাবু কাসির ধাক্কা সামলেছেন খানিকক্ষণ ধরে, তারপর ঠাট্টার মধ্যেও অবজ্ঞাটুকু গোপন না করে বলেছেন,—যা খাতির ও এখানে পায়, কোন চুলো কোথাও থাকলে এখানে কখনো আসত! ভালো করে খোঁজ নিয়ে দেখো, ও হয় ছেলেবেলায় হারিয়ে গিয়েছিল, নয় বাড়ি থেকে ওকে তাড়িয়ে দিয়েছে।
পরিহাস করতে গিয়ে সত্যটাকেই শশধরবাবু নিজের অজ্ঞাতে ছুঁয়ে যান কিনা কে জানে!
অঘোরের সঙ্গীসাথী কিন্তু সত্যিই এ জায়গায় কোথাও কেউ নেই। বছরখানেক আগে ডাক্তারখানায় কম্পাউন্ডারির কাজ নিয়ে আবার পর থেকে কোনো আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে চিঠিপত্রেও তার কোনো সম্পর্কের পরিচয় কেউ পায়নি। আর এ-বাড়িতে শুধু নয়, মর্যাদা তার কোথাও বুঝি নেই। নতুন শহরের একমাত্র পাসকরা ডাক্তারের ডিস্পেনসারিতে সে কম্পাউন্ডারির কাজটা বজায় রেখে চলে বটে, কিন্তু উঠতে বসতে ডাক্তাবাবুর কাছে তার বকুনি খাওয়ার শেষ নেই।
প্রথম সত্যকার স্নেহ ও মর্যাদা সে পেল বুঝি দিবাকরের কাছে।
বড় রাস্তার ধারে ডিস্পেনসারির ঠিক ওপারে যে দালানটা তৈরি হচ্ছিল সেটা কলকাতার একটা বড় ব্যাঙ্কের শাখা বলে একদিন জানা গেল। দিবাকর এল সেই ব্যাঙ্কের প্রথম ম্যানেজার হয়ে। ম্যানেজার হয়ে ব্যাঙ্কটাকেই সে দু’দিনে দাঁড় করিয়ে দিলে না, সমস্ত শহরের হৃদয়ই নিলে জয় করে। এই শুকনো রাঙা ধুলোর দেশে অমন দেবদূতের মত আশ্চর্য ছেলে কেউ কখনও বুঝি আগে দেখেনি। যেমন বলিষ্ঠ সুঠাম তার চেহারা, তেমনি সরল মধুর তার চরিত্র। সবচেয়ে অদ্ভুত তার ভেতরকার দুরন্ত প্রাণের প্রাচুর্য। তার অফুরন্ত উৎসাহ সে যেন আশেপাশে সকলের মাঝে সংক্রামিত করে দিলে দু’দিনে। শহরের ধারাই গেল বদলে।
কিসে যে সে নেই তা খুঁজে পাওয়া কঠিন। হাটের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে কবিগানের ব্যবস্থা হবে, তাতেও যেমন সে অগ্রণী, সরকারী চাকুরেদের একচেটে তাসের আড্ডা ভেঙে সেখানে নতুন করে লাইব্রেরি ও খেলাধুলোর ক্লাব বসাতেও তেমনি। এসব ছোট শহরে সরকারী চাকুরেরা নকল আভিজাত্যের যে গণ্ডি টেনে নিজেদের আলাদা করে রাখে, দিবাকর তার চরিত্রের মাধুর্যে আর প্রাণের প্রাচুর্যে কখন নিঃশব্দে যে তা মুছে দিয়ে সব একাকার করে দিলে, কেউ টেরই পেল না। দিবাকর বলতে সবাই অজ্ঞান। তার ঝকঝকে মোটর বাইকটা সবেগে রাস্তায় যে ধুলোর ঝড় উঠিয়ে যায়, তাও লোকের কাছে বিরক্তির নয়, মুগ্ধ বিস্ময়ের বস্তু।
শশধরবাবুর বাড়িতেই দিবাকরের সঙ্গে প্রথম আলাপ
শশধরবাবু আজকাল অনেকটা সুস্থ হয়েছেন। ঘরে মালিশের গন্ধ এখনো লেগে আছে, কিন্তু জানলাগুলো দিনের বেলা খোলা থাকে।
বেশিরভাগ সময় চটের ডেক-চেয়ারটায় বসে তিনি হিসেবপত্র লেখালেখি করেন। কলকাতার বাড়ি বেচে সেই টাকায় এখানে একটা কাগজের কারখানা বসাবার মত কোম্পানি গড়ে তুলবেন বলে অঘোর শুনেছে। দু-চারজন বড় বড় অংশীদারও নাকি তিনি জুটিয়ে ফেলেছেন।
কিন্তু দিবাকরকে এই সূত্রে যে তিনি ডাকেননি, একথা শশধরবাবু ভালো করেই বুঝিয়ে দিয়েছেন। দিবাকরের স্বর্গত এক মাতুলের সঙ্গে তাঁর নাকি অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিল। অন্তরঙ্গ বন্ধুর ভাগনে এই বিদেশে পড়ে আছে শুনে তাকে একবার তাঁর দেখবার সাধ হয়েছে।
সাধারণ চা-জলখাবারের আয়োজন। ঘরে অসুবিধে বলে শীতের বিকেল হলেও বাইরেই খোলা জায়গায় বসবার ব্যবস্থা হয়েছে। টেবিল একটা বাড়িতেই ছিল, বেতের চেয়ারগুলো অঘোরই চেয়েচিন্তে যোগাড় করে এনেছে। লতাপাতা বোনা টেবিলের ঢাকনাটা সত্যিই চমৎকার। ও ঢাকনাটা যে এ-বাড়িতে ছিল, অঘোরের আগে কখনও জানবার সুযোগ হয়নি। লতিকার পোশাকটা সম্বন্ধেও তাই বলা যায়। নিজের রূপকে পরিচ্ছন্নভাবে ফুটিয়ে তোলার মত পোশাকের রুচি লতিকার বরাবরই আছে। এই ভারা-বাঁধা বাড়ি থেকে যে পোশাকে সে সাধারণত বার হয় তা অনেকেরই ঈর্ষার বস্তু। কিন্তু এ-দিনের পোশাক প্রসাধন তার একেবারে আলাদা, অপরূপ।
অঘোর কেন যে সেদিন আরো বেশি আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছিল কে জানে!
শশধরবাবু তখন অসুখের জন্যেই বাড়িটা যে কিছুতেই সম্পূর্ণ করতে পারছেন না দিবাকরকে সেই গল্প শোনাচ্ছিলেন। ঘর থেকে চায়ের ট্রেটা এনে টেবিলের ওপরে নামাতে গিয়ে অঘোরের আনাড়ি হাতে একটা পেয়ালা টেবিল ক্লথের ওপর উল্টে গিয়েছিল। টেবিল ক্লথটা তো নষ্ট হয়ে গিয়েছিলই, খানিকটা চা গড়িয়ে দিবাকরের জামাটার ওপরও পড়েছিল।
শশধরবাবু চেষ্টা করেও বিরক্তিটা গোপন রাখতে পারেননি।
দিলে তো জামাটার সর্বনাশ করে! তুমি মানুষের মধ্যে একটি চতুষ্পদ, বুঝেছ অঘোর! ও দুটো তোমার হাত নয়, পা। যাও শিগগির জল আর তোয়ালে নিয়ে এস ভেতর থেকে।
অঘোর শুকনো করুণ মুখে ভেতরে যাবার উপক্রম করতেই দিবাকর তার হাতটা ধরে ফেলে মধুরভাবে হেসে বলেছে,—না না, আপনাকে যেতে হবে না অঘোরবাবু। ও কিছু হয়নি। কই, আপনি বসুন!
তারপর অঘোরকে দিবাকর জোর করে তার পাশেই বসিয়েছে। শশধরবাবু ও মাসিমার চোখের ইশারা দেখেও অঘোর কিছুতেই আর ওঠবার সুযোগ পায়নি। দিবাকর প্রত্যেকবারই তাকে এ-কথায় ও-কথায় ধরে রেখেছে।
শুধু মুখের সম্মান নয়, অঘোরকে ব্যাঙ্কের চাকরিও ওই দিবাকরই দেয়।
জঙ্গলে সেই হারিয়ে যাওয়ার কেলেঙ্কারির পরদিন বোধ হয়।
ও বাড়িতে ঢোকবা মাত্র লতিকা ঘর থেকে সেজেগুজে বেরিয়ে এসে বলেছিল,—চল চল অঘোর, আমায় এগিয়ে দিয়ে আসবে চল।
বিমূঢ়ভাবে অঘোরকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, লতিকা ঝঙ্কার দিয়ে উঠেছিল,—হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছ কি? আমার সাজ কি কখনো দেখনি! বলি, আসবে?
কোথায়?—অনেক সাহস করে অঘোর জিজ্ঞাসা করেছিল।
কোথায় আবার? দিবাকরবাবুর বাড়িতে। আজ ওঁর জন্মদিন যে!
অঘোরের চোখের বিস্ময়টা লক্ষ করে লতিকা আবার বলেছিল, কিছুই জান না, না! জানবে কি করে? জন্মদিনের কথা উনি কি কাউকে জানিয়েছেন! সে পাত্রই নয়। আমরা কোন রকমে জেনে ফেলেছি। তাই হঠাৎ গিয়ে চমকে দেব।
তারপর অঘোরকে এত কথা বুঝিয়ে বলতে হওয়ার দরুনই বোধ হয় বিরক্ত হয়ে উঠে লতিকা বলেছে,—তোমাকে অত ব্যাখ্যা করবার আমার সময় নেই। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে একটা খুব তাড়াতাড়ি যাবার রাস্তা আছে। সেইটে দিয়ে যাব বলেই তোমায় ডাকছি। চেন তো রাস্তাটা?
অঘোর মাথা নেড়ে জানিয়েছে সে জানে।
শশধরবাবুদের বাড়ির ধার থেকে শুরু হয়ে জঙ্গলটা যদিও ক্রমশ গভীর হতে হতে দক্ষিণের দিগন্তের দিকে ছড়িয়ে গেছে, তবু শহরের কাছে তার যা আয়তন, তাতে এক পাড়া থেকে আর এক পাড়ায় তাড়াতাড়ি যাওয়ার সুযোগ নিতে গিয়ে তার মধ্যে পথ ভুল হবার কথা নয়।
কিন্তু সেই ভুলই কেমন করে হয়েছে কে জানে?
দিবাকরের সঙ্গে এ-বাড়ির ঘনিষ্ঠতা এই কয়দিনের ভেতরে বেশ বেড়েছে অঘোর জানে। কিন্তু লতিকার পক্ষে অযাচিতভাবে তার বাড়িতে জন্মদিনের অভিনন্দন জানাতে যাওয়ার মত গভীর সে ঘনিষ্ঠতা কবে হল ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হওয়ার দরুনই বোধ হয় অঘোর পথের দিকে ঠিক লক্ষ রাখতে পারেনি।
তাকে এক জায়গায় থেমে একটু ইতস্তত করতে দেখে লতিকা বিরক্তির সঙ্গে বলেছে,—কি? পথ ভুল করেছ নাকি? তোমার মত আহাম্মককে সঙ্গে নিয়ে আসাই আমার অন্যায় হয়েছে।
কোন উত্তর না দিয়ে অঘোর ব্যাকুলভাবে আর একদিকে এবার এগিয়ে গেছে। সঙ্গে যেতে যেতে লতিকা তাকে গালাগাল দিতে আর কিছু বাকি রাখেনি।
কিন্তু সন্ধ্যা পার হয়ে অন্ধকার নেমে আসবার পরও যখন জঙ্গল থেকে বেরুবার রাস্তা খুঁজে পাওয়া যায়নি তখন লতিকার মুখের ভৎসনা বন্ধ হয়ে গেছে। গভীর আতঙ্কে সে অঘোরের হাতটাই চেপে ধরে পাংশুকাতর মুখে ছায়ার মত তার কাছে কাছে ফিরেছে।
এই চির উদ্ধত মেয়েটির এই অসহায় কাতর নির্ভরতা অঘোরকে কিভাবে স্পর্শ করেছে বলা যায় না, কিন্তু অরণ্য থেকে বার হবার পথ সে খুঁজে বার করতে পারেনি।
রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অরণ্য যেন আরো গভীর ও নির্মমভাবে তাদের ঘিরে ধরেছে। যে দিকেই তারা যাবার চেষ্টা করুক অরণ্যের কুহক নিষ্ঠুর বিদ্রুপ তাদের একই জায়গায় ফিরিয়ে এনে দিয়েছে। ক্লান্তিতে শীতে সমস্ত শরীর তখন তাদের অবশ। পদে পদে হোঁচট ও ধাক্কা খেয়ে কাঁটালতা আর ডালপালার আঘাতে হাত-পা ক্ষতবিক্ষত।
ভাগ্যক্রমে এক কাঠুরের কুঁড়ের সন্ধান না পেলে তারা আর কখনো ফিরে আসত কিনা সন্দেহ। ও জঙ্গলে চিরকালের মত হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা যে বিরল নয়, অঘোরের তা অজানা ছিল না।
পরের দিন সকালে যখন তারা বাড়ি এসে পৌছল, তখন সারারাত্রের উত্তেজনায় দুশ্চিন্তায় অসুখ বেড়ে শশধরবাবু শয্যা নিয়েছেন আর মাসিমা তাঁরইপরিচর্যায় ব্যস্ত। বেশি কিছু ভৎসনা তাই তাকে সইতে হল না, কিন্তু ডাক্তারখানার চাকরিটা তার সেইদিনই গেল।
ডাক্তারবাবু এমনিতেই তার ওপর প্রসন্ন ছিলেন না। আগের দিনের না বলে-কয়ে কামাই করা তিনি ক্ষমা করলেন না।
এ খবরটা কোথা থেকে শুনে দিবাকর সেইদিনই তাকে ডেকে ব্যাঙ্কে কাজ দেয়।
বিশ্বাসের কাজ ; খাটুনি কম, মাইনে আশাতীত। অঘোরকে এতখানি বিশ্বাস করে অনুগ্রহ করবার মত কি তার ভেতর দিবাকর দেখেছে কে জানে!
কিন্তু এত সৌভাগ্য অঘোরের বুঝি সয় না! ব্যাঙ্কের পাকা গাঁথুনিতেই কোথায় একটা ফাটল ধরার আভাস পাওয়া যায়।
অঘোরের ব্যাঙ্কে চাকরি পাওয়ার মাস দুই পরের কথা। দিবাকরের সঙ্গে লতিকার বিয়ের কথা মোটামুটি তখন ঠিক হয়ে গেছে। পাকাপাকিভাবে দিন স্থির করবার জন্যে শশধরবাবু দিবাকরকে সেদিন ডেকে পাঠিয়েছেন।
ব্যাঙ্ক বন্ধ হওয়ার অনেক পরে দিবাকর এসে যখন শশধরবাবুর ঘরে ঢুকল তখন মুখ তার অস্বাভাবিক রকম গম্ভীর। সদাপ্রসন্ন দিবাকরের এ চেহারা আগে কখনও দেখা যায়নি।
শশধরবাবু ও মাসিমার সঙ্গে কি কথা সেদিন দিবাকরের হয়েছিল সে জানে না। বাড়ির বাইরে জঙ্গলের কাছে সে তখন পায়চারি করে কাটিয়েছে।
যাবার সময় দিবাকর যে তারই খোঁজ করবে অঘোর তা সত্যিই ভাবেনি।
জঙ্গলের ভেতরটা তখন বেশ অন্ধকার হয়ে এসেছে। কাছে এসে আঘোরের কাঁধে হাত দিয়ে দিবাকর তাকে সেই অন্ধকারের ভেতর খানিক দূর নীরবে টেনে নিয়ে গেল।
অঘোর তখন সত্যিই বোধ হয় বিমূঢ় অভিভূত। দিবাকর তাকে অহেতুকভাবে বিশ্বাস করেছে, সম্মান দিয়েছে, অনুগ্রহ করেছে, কিন্তু ঠিক এমন অন্তরঙ্গের মত ব্যবহার আগে কখনও করেনি।
নির্জন অন্ধকারে এক জায়গায় থেমে সামান্য একটু বুঝি ইতস্তত করে দিবাকর বললে,—আপনাকে একটা কথা বলে যেতে চাই অঘোরবাবু। একমাত্র আপনাকেই বিশ্বাস করে একথা বোধ হয় বলে যেতে পারি।
এক মুহূর্ত চুপ করে থাকার পর দিবাকরের গলার স্বর যেন ভারী হয়ে এল—ব্যাঙ্কের টাকাকড়ির ব্যাপারে একটা গোলমাল হয়েছে। তাই মেটাবার চেষ্টায় আমি কাল এখান থেকে চলে যাচ্ছি। ফিরতে কদিন হবে জানি না।
দিবাকর আবার থামল, তারপর এক নিশ্বাসে বলে গেল,—যদি সাত দিনের মধ্যে না ফিরি তাহলে আর ফিরব না জানবেন। লতিকাকে কিছু কিছু বলেছি, শুধু এই কথাটাই জানাতে পারিনি। যদি আর না ফিরি তাহলে আপনি আশা করি আমায় ভুল বুঝবেন না, লতিকাকেও এ কথাটা জানিয়ে আমার জন্যে অপেক্ষা করতে বারণ করবেন।
কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে দিবাকর আর সেখানে দাঁড়াল না। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে অন্ধকার অরণ্যই যেন তাকে গ্রাস করে নিয়েছে মনে হল।
অঘোর কতক্ষণ সেখানে পাথরের মত নিস্পন্দ হয়ে দাঁড়িয়েছিল বলা যায় না। ফিরে যেতে গিয়ে হঠাৎ সামনে বাধা পেয়ে সে চমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।
লতিকাই তাকে বাধা দিয়েছে। কখন যে সে এসে দাঁড়িয়েছে অঘোর টেরই পায়নি।
কি বলছিল তোমায় দিবাকর? তীক্ষকণ্ঠে লতিকা জিজ্ঞাসা করলে।
অঘোরের মুখে কোন কথা নেই।
থাক তোমায় বলতে হবে না, আমি সব জানি। কিন্তু যেমন করে থোক ওকে বাঁচাতেই হবে।
অঘোর তবু নিরুত্তর।
লতিকা উত্তরের অপেক্ষা না করে উত্তেজিতভাবে বলে চলল,—ও কি যে করতে যাচ্ছে তা তুমিও জান না। ব্যাঙ্ক থেকে হঠাৎ অনেক টাকা চুরি গেছে। কি করে গেছে কিছুই বোঝা যায়নি। সাত দিনের মধ্যে সেই টাকা পূরণ করে না দিলে ব্যাপারটা আর চেপে রাখা যাবে না। এ দুর্নাম একবার হলে এখানে ব্যাঙ্কটাই বাঁচিয়ে রাখা যাবে কিনা সন্দেহ। এ চুরির দায় ওর নিজের কাঁধে নেবার কোন দরকারই ছিল না, কিন্তু ওর আশ্রয়ে তোমার মত যারা কাজ করে, পাছে নির্দোষ হয়েও তারা এই ব্যাপারে লাঞ্ছিত হয়, তাই সমস্ত দোষ নিজের ওপর নিয়ে ও টাকার সন্ধানে যাচ্ছে। আমি ওকে ভাল করেই চিনেছি। মুখে আমায় না বলে গেলেও আমি জানি, টাকার যোগাড় না করতে পারলে ও আর ফিরবে না। সমস্ত কলঙ্ক নিজের মাথায় নিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে। কালই ওর চলে যাবার কথা। দুপুরের আগে কিন্তু কোন ট্রেন নেই। তার আগেই তোমায় একটা কাজ করতে হবে।
কি কাজ?—অঘোরের কণ্ঠের জড়তা কি এতদিন বাদে হঠাৎ কেটে গেল! নিজের স্বরের স্পষ্টতায় সে নিজেই অবাক হয়ে গেছে বোধ হয়।
লতিকা হয়ত তা লক্ষ করলে না, বললে,—কত টাকা ওর দরকার আমি জানি না, কিন্তু আমার গয়না যা আছে তার দাম বড় কম নয়। তোমায় যেমন করে তোক সে গয়না বিক্রি করে সমস্ত টাকা ওর হাতে পৌঁছে দিতে হবে। এ বিপদ থেকে ওকে বাঁচাতে হবে। আমি দিতে গেলে সে কিছুতেই নেবে না। আমি জানি। কেন জানি না তোমার ওপর তার স্নেহ ও বিশ্বাস অগাধ। তুমি কোথাও থেকে যোগাড় করেছ বললে সে হয়ত নিতে আপত্তি করবে না। দরকার হলে, তুমিই ব্যাঙ্ক থেকে এ টাকা চুরি করেছিলে একথা বলবার জন্যেও তোমায় প্রস্তুত থাকতে হবে।
হ্যাঁ, লতিকার পক্ষেই তাকে এ আদেশ করাও সম্ভব। আপত্তি সে তাই করলে না। শুধু বললে, কিন্তু তোমার গয়না কিনবে কে?
লতিকা একেবারে যেন জ্বলে উঠল,—খাঁটি মেকি যে চেনে সেই কিনবে! আমার গয়না মার মত গিল্টি করা পেতল নয়। আমি চিরকাল স্বার্থপর নির্লজ্জ। বাবার যখন দিন ভালো গেছে যা পেরেছি আমি কেড়েকুড়েও আদায় করে নিয়েছি। এত অভাবের ভেতরেও আমার গয়নায় কাউকে হাত দিতে দিইনি। এ গয়না বিক্রি করে অন্তত দশ হাজার টাকা তুমি পাবে।
কিন্তু এ-গয়না যার জন্যে দিতে যাচ্ছ সে হয়ত ভণ্ড চোর ছাড়া আর কিছু নয়। হয়ত সে নিজেই ব্যাঙ্কের টাকা চুরি করে খরচ করে এখন সামলাতে না পেরে পালাবার পথ খুঁজেছে।—এত কথা এমন স্পষ্টভাবে যার মুখ দিয়ে বার হল সে বুঝি অঘোর নয়, আর কেউ! কিংবা অন্ধকারে মুখ কারুর দেখা যায় না বলেই অঘোর হয়ত এ সাহস খুঁজে পেয়েছে।
ভণ্ড চোর যদি হয় তাতেও কিছু আসে যায় না।—লতিকার কথাগুলো যেন আগুনের স্ফুলিঙ্গ—ভণ্ড চোরের ঘরেই আমার জন্ম। আমার বাবা সারা জীবন লোক ঠকিয়ে এসেছেন। আমার মা’র সমস্ত গয়না যেমন মেকি গিল্টি, বাবার কলকাতার বাড়িও তেমনি একটা মিথ্যে ধাপ্পা। এই কাগজের কলের মত বাবার কত কারবার শূন্যে তৈরি হয়ে মিলিয়ে গেছে তার হিসেব নেই।
এই বাড়ির শিক্ষা পেয়েও, সাধু হোক, ঠক হোক, আরেক জনের জন্যে তুমি নিজের যথাসর্বস্ব বিলিয়ে দিতে যাচ্ছ!—অঘোরের গলার স্বরে আজ বিদ্রুপও ফুটছে!
লতিকা কিন্তু সে বিদ্রুপ গায়ে মাখল না। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললে,—হ্যাঁ যাচ্ছি। হয়ত সত্যিই দু’জনে একই জাত বলে, হয়ত জীবনে এমন কিছু ঘটে বলে, যা সব হিসেবের বাইরে।
এর পর আর কোন কথা হয় নি।
লতিকার ভারী ভারী দুটি গয়নার বাক্স অঘোর সেদিন গোপনে বয়ে নিয়ে গিয়েছিল।
সে গয়না অঘোর বিক্রি করেছিল কি? তার টাকা অন্তত দিবাকরের হাতে পৌঁছোয় নি। অঘোরকেও এ-শহরে আর দেখা যায় নি।
কত বছর তারপর পার হয়ে গেছে। মনের সমস্ত দাগ মুছে দিতে পারে, এত বছর।
চায়ের পেয়ালা সামনে নিয়ে এই শহরেরই একটা দোকানে আজ অঘোর বসে আছে বটে, কিন্তু অরণ্য যেখানে শেষ হয়ে এসেছে, সেখানে বাঁশের ভারা-বাঁধা একটা অর্ধসমাপ্ত বাড়ির কোন চিহ্ন আজও আছে কিনা তা দেখতে এখনো সে যায় নি। হয়ত যাবেই না শেষ পর্যন্ত।
ঝিমিয়ে থাকা দোকানটায় একটু সাড়া পড়েছে যেন! দোকানের লোকেদের ঈষৎ উত্তেজিত গুঞ্জন তার কানে আসে।
বেশ রঙচঙে উর্দিপরা একজন চাপরাশী মিষ্টি কেনবার জন্যে ভেতরে এসে দাঁড়িয়েছে। সে নাকি নতুন কাগজের কারখানার কনট্র্যাক্টার সাহেবের চাপরাশী।
এখানে কাগজের কারখানা সত্যিই তাহলে একটা হচ্ছে!
বিশেষ কোন কৌতূহল না নিয়েই অঘোর বাইরে তাকায়। মস্ত বড় জমকালো চেহারার একটা খোলা মোটর রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে। বড়সাহেব নিজেই গাড়ি চালাচ্ছেন। তাঁর পাশের মহিলাটির দিকে বুঝি দু’বার চেয়ে দেখতে হয়।
বয়সের সঙ্গে খুব মোটা হয়ে গেলে লতিকা ঠিক ওইরকম দেখতে হত কি?
হত হয়ত!
১৩৫৭ (১৯৫০)