ভালোবাসা কারে কয় – নবনীতা দেবসেন

ভালোবাসা কারে কয় – নবনীতা দেবসেন

জগতে যতই অপ্রেম বাড়ছে প্রেম নিয়ে বাড়াবাড়ি ততই বাড়বাড়ন্ত।’প্রেম’ এখন খুবই টপিকাল এ বিষয়। প্রায় সতী’ কিংবা বধূহত্যা’র মতই। হয়তো পরস্পরের মধ্যে যোগও থাকতে পারে। প্রেমসংখ্যা’ বেরুচ্ছে পত্রপত্রিকায়। বিশ্বপ্রেম ছড়িয়ে পড়ছে পেরেস্ত্রয়িকায়। বোফর্স কেলেংকারি মেটাতে না পারুন রাজীব গান্ধী দিল্লি-বোম্বাইতে দু’জোড়া প্রেমে তাপ্পি লাগিয়ে দিয়েছেন। রাজারাজড়ার ছেলেমেয়েরাও গরিবগুবোদের মতই ঝপাঝপ প্রেমে পড়ে যাচ্ছেন, কাশ্মীরের সঙ্গে যেমন গোয়ালিয়র। “তরুণ বিপ্লবী মুখ্যমন্ত্রী” প্রেমের ম্যাজিকে “তরুণ সংসারী মুখ্যমন্ত্রী হয়ে নাড়ু খাওয়াচ্ছেন নিমন্ত্রিতদের। যেদিকে তাকাই প্রেমের ছড়াছড়ি। খবরের কাগজে প্রেম, দূরদর্শনে প্রেম। চিত্রহারে প্রেম, চিত্রমালায় প্রেম। যাত্রা থিয়েটারে প্রেম, পানমশলায় প্রেম, বিড়ি সিগারেটে প্রেম, লোহার আলমারিতে প্রেম, মশার ধূপে প্রেম, এমনকি গেঞ্জি আণ্ডারওয়্যারেও প্রেম। প্রেম বিনে বিজ্ঞাপন নেই। প্রেমের অথই বন্যায় ভাসতে ভাসতে আমরা মানিব্যাগ সামলাচ্ছি। এত প্রেম দশ দিকে, অথচ যেই একজন সম্পাদক আমাকে একটি প্রেমবিষয়ক নিবন্ধ লিখতে আদেশ করলেন, আমার মনে হল, জগৎ আলোবাতাসশূন্য হয়ে যাচ্ছে। প্রেম বিষয়টি সরল নয়, জটিল। প্রেম বিষয়টি খোলাখুলি ঢালাও আলোচনারও নয়, চুপচাপ, ফিসফাসেই তার শোভা। এখন যেন সবকিছুই কেমন খোলামেলা হয়ে যাচ্ছে। আদুড়-গা যেমন ফ্যাশন হচ্ছে, আদুড় মনপ্রাণও তেমনি যুগের ধর্ম হয়ে উঠছে। এর পর জগতে প্রেম বেচারী টিকবে কোথায়? সে বাঁচবে কেমন করে? তার একটু ছায়া চাই যে, একটু আড়াল চাই, একটু আঁধার, সে যে বিজনবিলাসী। প্রেমের নিবন্ধ? আমার তো মাথায় বজ্রপাত হয়েছে। প্রেম বিষয়টিকে কাগজেকলমে আমি, যতদূর সাধ্য পরিহার করে চলি। প্রেমের মূল তত্ত্বই হলো, যা বালকেও বোঝে, শতং করো, মা বলো। আর বলাই বাহুল্য, কদাচ মা লিখ। অথচ সম্পাদকরা ঠিক সেটাই করিয়ে নেন।

শেষটা আমার মনে হলো, চ্যালেঞ্জটা ছাড়বো কেন? নিয়েই নিই। প্রেম বিষয়ে তিনপুরুষের জ্ঞান সঞ্চয় করে ফেলতে হবে—সম্পাদক বলেছেন তিন প্রজন্মে প্রেমের বিবর্তন নিয়ে প্রবন্ধ চাই। এও বলেছেন, ইচ্ছে করলে নিজেরই পরিবারের তিন প্রজন্মের প্রেমকথা লিখতে পারি। হ্যাঁ, বাবা-মায়ের প্রচণ্ড প্রেমবিবাহ হয়েছিল বটে সেকালে। সংবাদপত্রে দারুণ দামামা বেজেছিল। দাদু দিদিমার, ঠার্কুদা ঠাকুমার প্রেমজ বিবাহ নয়, কিন্তু বিবাহজ প্রেমে শুনি দুই দম্পতিই প্রবল পরাক্রান্ত ছিলেন। কিন্তু তাঁদের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়নি। আমার নিজের বিবাহটাও অবিশ্যি বেশ ঘনঘটার “প্রেমের বিয়েই” হয়েছিল, কিন্তু শেষ দৃশ্যে কিঞ্চিৎ লঘুক্রিয়া হয়ে গেছে। ওটা নিয়ে আর ঢাক পেটানোর কিছু নেই। তবে আমার প্রজন্মের অন্য অনেকেরই অটুট, অমোঘ, অবিবল প্রেমের উদাহরণ আমার সামনে। হাতের ওপর হাত রেখে চলার অসহজ কর্মটি যাঁরা খুব সহজভাবেই করে চলেছেন। কিন্তু আমার পরের প্রজন্মটাই ঝামেলা করেছে। আমার মেয়েদের প্রেমজ বিবাহ বা বিবাহজ প্রেম কোনোটাই এখনও হয়নি, ফলে ওদের যুগচরিত্রটা ঠিকমত আমার নজরে আসেনি এখনও। তাঁদের বধিবেন যাঁরা, তাঁদের কে যে এখন কোন গোকুলে বর্ধমান তা কি আমি জানি? না তাঁরাই জানেন?

কিন্তু আমেরিকা থেকে আমি একটা জরুরি কথা শিখে এসেছি ; ‘নো প্রবলেম’। কোনো সমস্যা নেই। সেইমত কোমর বেঁধে নেমে পড়লুম ফিলডে। নো প্রবলেম। বাড়িতে যেই মেয়ের বন্ধুবান্ধব কেউ বেড়াতে আসবে, তক্কে তক্কে থেকে, ক্যাঁক করে চেপে ধরলেই হলো। তাদের প্রজন্মের কথা তাদের মুখেই শোনা যাবে। এবং সেটাই হবে নির্ভরযোগ্য তথ্য।

আমার পূর্বপ্রজন্মের কাছে তথ্য সংগ্রহের আশায় বাংলার ব্রাউনিং দম্পতি’র কপোত-কপোতীর অবশিষ্ট অঙ্গ, কপোতীকে, অর্থাৎ আমার গর্ভধারিণীকে ধরেছিলাম। মা বললেন—“প্রেম শুধুই দেয়। চায় না কিছুই। কি স্ত্রী, কি পুরুষ। দু’য়ের বেলাই এক। দিয়েই আনন্দ। প্রেমকে বিনষ্ট করতে হলে বিয়েটা করে ফেলা উচিত। সংসারের গরম বাতাসে রোমান্টিক প্রেমের সুকুমার তন্তুগুলি শুকিয়ে যায়। খসে পড়ে প্রেমের লজ্জাবস্ত্র। কেবল প্রেমহীন কর্তব্যের হিসেব-নিকেশ, সামাজিক চুক্তির দেনাপাওনার জাব্‌দা খাতা নিয়ে খাড়া থাকে বিবাহের দরোয়ান।—প্রেমকে যদি ধরে রাখতে চাও বিয়ের মধ্যে টেনে নিয়ে যেও না। একটু দূরত্ব ভালো। স্বার্থহীন না হলে প্রেম থাকে না। বিয়ে মানেই স্বার্থ। দুটো পরস্পরবিরোধী। রাধা কি শ্যামের বউ ছিলেন? ছিলেন না। থাকতে পারেন না।”

ও বাবা! এ তো ভীষণ মডার্ন! এর চেয়ে আর আলাদা কী বলবে পরবর্তী প্রজন্ম? তবু বড় মেয়েকে গিয়ে ধরলুম। কলেজে পড়ছে। তরুণ-তরুণীরা এ বাড়িতে স্রোতের মতো আসে-যায়। ও জানবে ;

“ধুৎ তেরি।” মেয়ে তেড়ে এলেন।—“পারোও বটে মা তোমরা! আচ্ছা একটা জেনারেশন বটে! উপন্যাসে, গল্পে, যাত্রায়, সিনেমায়, কবিতায়, গানে—এত দিন কেবলই প্রেম চলছিল। এবারে প্রবন্ধেও প্রেমের প্রবেশ? সর্বনাশ করেছে। বল মা তারা, দাঁড়াই কোথা?” কচি মুখখানিকে সাধ্যমত গোমড়া করে কন্যা বলেন—“জীবনে, জগতে, কত কিছুই রোজ ঘটে চলেছে মা, যা প্রেমের চেয়ে অনেক বেশি জরুরি। সেইসব নিয়ে লিখলে পারো না? আমার অন্য কাজকর্ম রয়েছে, আমি যাই। তুমি বসে বসে প্রেম নিয়ে ভাবো।” বকুনি খেয়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল।

যাব্বাবা। তাহলে এটাই এই জেনারেশনের অভিমত? প্রেম তুচ্ছতাচ্ছিল্যের জিনিস? ভাবনাচিন্তারও যুগ্যি নয়? নাকি আরো অন্য মতামত, ভিন্নরুচির তরুণ তরুণীও আছে? পড়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে, তরুণ তরুণীদের সঙ্গেই আমার চব্বিশ ঘণ্টা ওঠাবসা। কিন্তু সে তো বাইরে থেকে চেনা। চোখে যা দেখি, তাতে তো হামেশাই তাদের হাবভাব, চাউনি, অনেকটা প্রেমের মতোই দেখায়। সেসব কি তাহলে আমার চোখের ভুল? বা বোঝার ভুল? সেসব কি তাহলে প্রেম নয়, অন্য কিছু? সন্তোষকুমার ঘোষের সেই ‘কবিতা’ নয়, কিন্তু কবিতার প্রায়’ যেমন, তেমনি এও কি ঠিক প্রেম’ নয়। কিন্তু প্রেমের প্রায় কোনো সম্পর্ক? কিন্তু যাই হোক, খোলসা করে বলবে তো কেউ আমাকে? একটা জিনিস বুঝেছি। আমাদের জেনারেশনেই স্ত্রী-পুরুষে বন্ধুত্ব’ শুরু হয়েছিল। ছেলে-মেয়ে জুটি মানেই প্রেমিক-প্রেমিকা নয়। স্রেফ বন্ধু হতেই পারে। কিংবা রাজনৈতিক সহকর্মী। কিংবা ফোটোগ্রাফি ক্লাব। মাউন্টেনিয়ারিং ক্লাব। ফিল্ম সোসাইটি। কতরকমের ‘কমন ইন্টারেস্টের জন্য একসঙ্গে ঘোরে ছেলেমেয়েরা। দেখে কি বোঝা যায়?

এইরকম ভাবনাচিন্তা করছি এই সময়ে হঠাৎ আমার এক প্রাচীন সহকর্মী উত্তেজিত হয়ে এসে জানালেন, ফার্স্ট ইয়ারে ক্লাস নেবার সময় বাইরের করিডরে গীটার বাজিয়ে এমনই “জুলি আই লাভ ইউ” গান হতে লাগলো যে তাঁর সন্দেহ হলো ক্লাসেই হয়তো জুলি বলে কেউ থাকতে পারে। “জুলি বলে কেউ কি আছ? তাহলে বাইরে গিয়ে কথাটা সেরে এসো” — বলতে, জুলিয়েট ডিসুজা বলে গোয়ার মেয়েটি কাঁদোকাঁদো মুখে উঠে দাঁড়িয়ে বললে আমি ওকে সত্যি সত্যি চিনি না স্যার! আমি নতুন মেয়ে, সবে ভর্তি হয়েছি!” তখন মাস্টারমশাই উঁকি মেরে ছেলেটিকে দেখে চিনতে পারলেন। চেনা ছেলে। স্বরূপ সরখেল। জিভ কেটে, “এই যে সার, গুড মর্নিং” বললে সে গীটার নামিয়ে, ডান হাতে সেলাম করে। পিছু পিছু বেরিয়ে এসে জুলিয়েট বললে—”আপনি কি আমাকে দাদার মতো ভালোবাসতে পারেন না? আমার সত্যিই কোনো দাদা নেই—বাট আই ডু হ্যাভ আ বয়ফ্রেণ্ড অ্যাট হোম।” স্বরূপ হাস্যবদনে বললে—“হোয়াট আ সেম! কুছ পরোয়া নেই, সিস্টার! এভরিথিং উইল বি অলরাইট।” তারপর পিড়িং পিড়িং করে বাজাতে বাজাতে অন্য দিকে চলে গেল। আমার সহকর্মী রীতিমত বিচলিত। “এসব কী কাণ্ড বলুন তো?” বাড়িতে এসে মেয়েকে বললুম।—“এসব কী হচ্ছে তোদের?” —”ওঃ স্বরূপ? স্বরূপের কথা বাদ দাও। ও একটা পাগলা। সেদিন দেখলুম করিডরে চেঁচাচ্ছে : ‘ওরে ববি, ববি রে আমার, স্যান্সক্রিটের ঐ মেয়েটার নাম কী যেন?’—‘মন্দাক্রান্তা? ববি বলে দিল।—হ্যাঁ হ্যাঁ, ভেরি ডিফিকাল্ট টু রিমেমবার—ওকে প্লীজ একটু প্রক্সি দিয়ে দে না? আমি জিওলজির মেয়েটাকে একটু অ্যাটেন্ড করেই, আসছি—ওকে বল——”কি আশ্চর্য! আমি বাগ্‌রুদ্ধ।

“আশ্চর্য কিছুই নয়। স্বরূপের ছ’টা গার্লফ্রেণ্ড। ওপন সিক্রেট। সবাই হাসে। আর প্রশ্রয় দেয়। স্বরূপ ছ’জনকেই বাই টার্ন সিনেমা দেখায়, আইসক্রিম খাওয়ায়। এই তো? আপত্তির কী আছে? লুকিয়ে-চুরিয়ে তো কিছু করেনি। সবাইকে জানিয়ে শুনিয়েই ডেটগুলো ফিক্স করে। হি মীন্স নো হার্ম। সবাই সেটা বোঝে।”

“তাহলে প্রেমটা কবে কার সঙ্গে?”

প্রেম আবার কি? মোটেই প্রেম নয়।”

“তাহলে বিয়ে? বিয়েটা করবে কাকে? ছ’টা মেয়ের মধ্যে?”

“এরা কেউই স্বরূপ পাগলাকে বিয়ে করবে নাকি? মেয়েগুলোর কি বুদ্ধি বিবেচনা নেই? দে আর হ্যাভিং ফান। ওর মোবাইকে চড়ে ঘুরে বেড়ায়। ছ’জনেই ছ’জনকে চেনে। নো ওয়ান কেয়ারস্ ফর হিম।”

“ সে কি রে? মেয়েগুলোও এমনি হয়েছে আজকাল?”

“হবে না কেন? তাদের কেরিয়ার নেই? প্রেম করলেই চলবে? স্বরূপ যদি ভালো পাত্র হতো তাহলে অবশ্য অন্য কথা। তাহলে হয়তো একটু প্রবলেম হত, হয়তো কেউ কেউ সিরিয়াসলি ভবিষ্যতের কথা ভাবতো, কিন্তু আজ ইট হ্যাপেন্স, স্বরূপও সিরিয়াস নয় ওরাও নয়। যে-যার মা বাবার পছন্দ করা বরবউদেরই বিয়ে করবে বোধ হয়। আমরা সবাই যে চালু পার্টি মা। আজকাল কেউ আর তোমাদের মতো বোকা নেই।” “কেউ আর আমাদের মতো বোকা নেই’ শুনে তো আমার খুব দুশ্চিন্তা হয়ে গেল। ব্যাপারটা কী? বেশিরভাগ জোড়া-কে দেখে তো মনে হয় প্রেমিক-প্রেমিকাই? অবশ্য অনেক সময় যে উল্টোও হয় না, তাও নয়। দিব্যি হাবভাব দেখে এবং কথাবার্তা শুনে মনে হয় দুটি ভাইবোন, অথচ আসলে তারা কিন্তু ডিক্লেয়ার্ড, রেজিস্টার্ড প্রেমিক-প্রেমিকা। এমন জুটি অন্তত আধ ডজন তো ভালোভাবেই চিনি যারা বিয়েও করে ফেলেছে, আজও তুই-তোকারি চালায়। আরও একজনকে জানি, যারা বিয়ে করেনি অথচ মনে হয়েছিল, করলো-বলে! অতএব এই প্রজন্ম বড়ই প্রহেলিকাময়। কে যে কার সঙ্গে কথন-প্রেমের দ্বারা যুক্ত, তা হৃদয়ঙ্গম করা শক্ত। বন্ধু দলের অন্তরঙ্গ সদস্যরাই একমাত্র জানে। দৃশ্যত সকলেই সমান। ‘একত্রে ঘোরাঘুরি’ ছাড়াও আমাদের সময়ে কিছু টেল্‌-টেল্‌ সাইন্‌স ছিল। তুই’ বা ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’-তে সরে আসা তার মধ্যে প্রধান লক্ষণ বলে পরিগণিত হত। এখন এটাও মুছে গেছে। ‘আপনি’ মানেই যেমন শ্রদ্ধা-সম্মান দেখানো নয়, ‘তুমি’ও তেমনি অন্তরঙ্গতার পরাকাষ্ঠা প্রমাণ করে না। আবার ‘তুই’ মানেই নয় ভাই-বোনের অনাবিল প্রীতি। আর প্রেম মানেই নয় বিবাহ। আমাদের সময়ে একটা ‘কুকথা ছিল, “প্রেম করবো যেথা সেথায় বিয়ে করবো বাপের কথায়।” কেবল বদ ছেলেরাই ঐ পন্থা অবলম্বন করে থাকে, এমনতর ধারণাও চালু ছিল। এখন দেখা যাচ্ছে কি ছেলে কি মেয়ে এটা অনেকেরই স্বাভাবিক কর্মপন্থা, ‘প্রেম করাটা মোটে ‘প্রেম’ই নয়, একরকমের বিনোদন মাত্র। উত্তেজনায়, আনন্দে সময় কাটানোর সহজ উপায়। হ্যাভিং ফান।’ ইংরিজি ইস্কুল, বাংলা ইস্কুল, যে-কোনো পটভূমি থেকে এসেই কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে এই ব্যাপারটি শিখে যাচ্ছে ছেলেমেয়েরা। প্রেমে-পড়া নয়। প্রেমকরা। আমার যেমন বেণী তেমনি রবে, চুল ভিজাব না। এদের এই প্রেম করা মোটেই আমাদের সেই প্রেমে-পড়া নয়। এবং অবশ্যই নয় ইংরিজি ‘লাভ-মেকিংও। একেবারে অন্য হালকা-হালকা ব্যাপার। দিশি ‘ফান’। মোটামুটি হার্মলেস। ইংরিজি ভাষাটা এই প্রেম ভালোবাসা প্রসঙ্গে কিন্তু যারপরনাই দীনদরিদ্র। স্নেহমমতা, ভাবভালোবাসা, প্রেম-কাম, সব এক। সব ‘লাভ’। মা বাবা, কুকর বেড়াল, ভাই বোন, স্বামী স্ত্রী, ঠাকুর দেবতা সবার সঙ্গে সবার একটাই শব্দের সম্পর্ক। কী গরিব, কী গরিব ভাষা রে বাবা! আর ওরাই নাকি ডিভেলপড নেশন?

সে যাই হোক, সাহেবদের দৈন্য সাহেবরা বুঝুক, আমি প্রেম বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের অধীর পিপাসায় কর্মযজ্ঞে অবতীর্ণ হই। হাতে-কলমে অবশ্য এখনই নয়। প্রথমে বিশুদ্ধ তাত্ত্বিক আগ্রহ। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে, সাক্ষাৎকারভিত্তিক, পরিচ্ছন্ন প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে জ্ঞান সঞ্চয়। তবে হ্যাঁ, এলেবেলে হলে চলবে না। ‘বিজনেসলাইক’ হওয়া দরকার। এই প্রজন্মটার মধ্যেই কেমন একটা বিজনেসলাইক’ ভাব আছে। কাঠখোট্টা, হিসেবী (কেমন যেন)! এদের হ্যাণ্ডল করতে হলে এদের মতনই হতে হবে আমাকে। কাঠখোট্টা তো আছিই, কেবল হিসেবের ব্যাপারটায় কাঁচা। প্রথমে চাই সাক্ষাৎকারের বিষয়বস্তু।—প্রেম। তারপর প্রশ্নমালা। ওটা বরং একটু খোলামেলাই থাকুক। বাঁধাধরা লিখিত প্রশ্নমালা বড় বোরিং। এবার স্থানকালপাত্র ঠিক করে নিতে হবে।

স্থান, এই বাড়ি। কাল, যে-কোনো ছুটির দিন। পাত্র, আমার কন্যার বন্ধুর স্রোতের মধ্যে যে সামনে পড়বে সে-ই। ছুটির দিনে ডজন ডজনে আসে তারা। তাদের খালি-করা চায়ের কাপে ঘরবাড়ি ছেয়ে যায়।

যেই না রবিবার আসা অমনি আমিও রেডি। ভোরে উঠে স্নান করে খাতা বগলে ঘাপটি মেরে কলিংবেলের অপেক্ষায় কান পেতে রই। দুরুদুরু বক্ষ। কৃষ্ণের বাঁশির জন্য শ্রীরাধিকার আকুল প্রতীক্ষাও এই আমার কাছে তুশ্চু! নিজেই গোলমালটা স্বয়ং পাকিয়েছি। পিকোর পরীক্ষার জন্য ভয়ঙ্করী মূর্তি ধারণ করে বন্ধুদের মার-মার-কাট্-কাট্ শব্দে তাড়িয়েছি ক’দিন যাবৎ। বন্ধুর ফ্লোটা তাই একটু কমে গেছে। আহা তখন কি ছাই জানতুম, যে…?

তবে আজ ছুটির দিন। আজ নিশ্চয়ই আসবে ওর রেজিমেন্ট। কিন্তু কই? বেল তো বাজছে না? এমন সময়ে…বাজিল কাহার বীণা?

অবশেষে বেল বেজে উঠেছে, সঙ্গে সঙ্গে, “পিকো আছে?” শোনবামাত্র আমার অন্তরাত্মায় বিদ্যুৎ খেলে যায়। এই তো সে! এসে গেছে। পরবর্তী প্রজন্মের প্রতিনিধি! এক্ষুনি চেপে ধরতে হবে। যেন ফসকে না যায়॥

“কে? টুবলু? আয় বাবা আয়। হ্যাঁ, আছে পিকো। তা টুবলু, তুই প্রেম নিয়ে ইদানীং কী ভাবছিস?”

টুবলুর গোলগোল নাদুসনুদুস নধর মুখখানি যেন এক মিনিটে শুকিয়ে গেল। খুবই চালাকচতুর চটপটে ছেলে সে, প্রাইজ পাওয়া ডিবেটর, সুন্দর বলিয়ে কইয়ে, ফুর্তিবাজ, আড্ডাবাজ, হাসিখুশি ছেলে। টুবলুর শুকনো মুখ কখনো দেখিনি। তাকে নিরুত্তরও দেখিনি কখনো। খানিক চুপ থাকার পরে শুকনো ঠোঁট জিব দিয়ে চেটে নিয়ে টুবলু বেশ আস্তে আস্তে কথা বলল। টুবলু বলল—“মানে, নবনীতাদি, আমি কিন্তু…পিকোর কাছে” …গলা বুজে এল তার। গলা ঝেড়ে নিয়ে টুবলু বলল, “আমি ঠিক পিকোর কাছে, সেভাবে… কোনোদিনই… মানে, আপনি হয়তো ঠিক জানেন না আমাদের মধ্যে কিন্তু ঐসব, মানে একটুও কিন্তু, …ক্ষীইই আশ্ছর্জ!” টুবলু হঠাৎ চুপ করে গেল। যাকে বলে “চুপ মেরে যাওয়া” তাই। এবং টুলুর উজ্জ্বল তরুণ মুখখানি বিষাদে স্পষ্টতই প্রাণশূন্য বিবর্ণ দেখালো। তারপর টুবলু আবার বললো—”প্লীজ! বিশ্বাস করুন, আমি কিন্তু কোনোদিনই পিকোর কাছে এইসব উদ্দেশ্যে—আমি ভাবতেই পারিনি…” এতক্ষণে আমার কাছে ব্যাপারটা স্পষ্ট হল। হাঁ-হাঁ করে শুধরে নিই নিজের ভুল। যদিও হাসি আটকাতে পারি না।

“ওরে, নারে, তোর সঙ্গে যে পিকোর প্রেম হয়নি তা তুইও যেমন জানিস আমিও তেমনি জানি—”

তুচ্ছ বাক্য! কিন্তু কী বৈপ্লবিক তার শক্তি। মুহুর্তের মধ্যে টুবলুর অন্য ব্যক্তিত্ব এসে গেল। রীতিমত চেঁচিয়ে উঠলো সাগ্রহে— “শুধু আমি কেন? কারুর সঙ্গেই হয়নি! হবে কী করে? যা দজ্জাল কন্যাটি আপনার! বাপরে!”

“আহা! সে কথাও হচ্ছে না। কে কার সঙ্গে প্রেম করছে-না-করছে সেসব পার্সোনাল ডিটেইলস্ আমি চাইছি না, আমি জানতে চাই প্রেম বিষয়ে তোর ধারণাটা কী? জেনারেলি? ইন থিওরি? অ্যাজ আ মেম্বার অব ইওর জেনারেশন?”

ইতিমধ্যে সিড়ির বাঁকে পিকো অবতীর্ণ হয়ে সস্নেহে টুলুকে জানালো—“মাকে প্রেম বিষয়ে আর্টিকেল না গল্প কী যেন লিখতে হবে অথচ সেই বিষয়ে মা কিছুই জানেন না একবার দিম্মাকে, একবার আমাকে অসম্ভব বিরক্ত করছেন, ফর ইনফরমেশন, ফর ডেটা। তুই পারলে দু’একটা পয়েন্ট দিয়েই দে না বেচারীকে।” এতক্ষণে নিশ্চিন্ত হয়ে টুলুর অট্টহাস্য।

“প্রেম নিয়ে আর্টিকেল? আপনি?” যেন এর চেয়ে আজগুবি আর আবোলতাবোল জগতে কিছু হতেই পারে না। যেন আমার ত্রিভুবনে প্রেম নিয়ে কোনো অন্বেষণ থাকা অসম্ভব। হায় রে! যদি জানতিস! প্রেম বিষয়ে না হয় তাত্ত্বিক জ্ঞানটাই আমার কমসম, তা বলে প্রযুক্তিগত বিদ্যা কতটা, তা তো তোরা কেউ জানিস না? না হয় প্রেমের গল্পই আমি লিখি না, তা বলে কি প্রেমের গল্পরা আমার জীবনে ঘটে না? কিন্তু এ-সব কথা পত্রিকায় ছেপে না বলাই ভালো। কে আবার কী বুঝবে?

অতএব গুরুগম্ভীর কণ্ঠে ছোটো করে গর্জে উঠি—“অত হেসে কাজ নেই। কাজের কথাটা বল। প্রেম বিষয়ে তোর কী ধারণা?”

“ওহো, তাই তো, ‘কাজের কথাটা?” (টুবলু গলাখাকারি দেয়, আজকালকার ছেলেগুলো মহা শয়তান)—”ইয়ে, কাজের কথাটাই তবে হয়ে যাক। অর্থাৎ প্রেম তো? প্রেম অতি ভয়ানক অতীব ভয়াবহ বস্তু। বন্ধুবান্ধবরা প্রেম করা মানেই আমার ভয়ঙ্কর খরচা বেড়ে যাওয়া। তাদের চা-অমলেটের জন্য, সিনেমার টিকিটের জন্য, ট্যাক্সি ভাড়ার জন্য কেবলই ধার দিতে হয় (যেহেতু তাদের টিউশনি করার সময় থাকে না। আমি টিউশনি করি।) সেসব ধার কদাচ শোধ হয় না। তাছাড়া পড়াশুনোরও ভীষণ ক্ষতি হয়। বন্ধুরা এসে এসে অনবরত প্রেমের প্রগ্রেস রিপোর্ট শোনায়। বন্ধুরা জড়ো হয়ে পরস্পরের মধ্যে প্রেমের নোটস এক্সচেঞ্জ করে, রীতিমতো বুলেটিন বের করে, এবং আমার কাছে কেন জানি না, কেবলই উপদেশ চায়। সর্বদাই আর্জেন্ট পরামর্শ দরকার হয় তাদের। সবসময়েই একটা পিরিয়ড অফ এমার্জেন্সি চলে প্রেমে। আর আমার ভালোলাগুক-না-লাগুক খুব ধৈর্য ধরে সহানুভূতি নিয়ে সেইসব কাহিনী শুনতেই হয়। না শুনলে হয় হার্টলেস, নইলে হিংসুটে ভাববে। সাকসেসফুল প্রেম কেস ততটা খারাপ হয় না আনসাকসেসফুলে যতটা। ব্যর্থ-প্রেম’ হলে আর রক্ষে নেই। রাতের পর রাত সেও ঘুমোবে না আমাকেও ঘুমোতে দেবে ন। জানালায় টোকা মেরে পায়ের বুড়ো আঙুল নেড়ে ঘুম তাড়িয়ে ঘরে ঢুকে এসে দুঃখের পাঁচালি শোনাবেই। সব বন্ধুই এক। আমার পড়াও শেষ। ঘুমও শেষ। পয়সা তো শেষ আগেই হয়েছিলো। বন্ধুরা প্রেম করল, আমি ফেল করলুম, এ তো কাজের কথা নয়? নাঃ নবনীতাদি, প্রেম ইজ ভেরি ডেনজারাস। ভেরি হার্মফুল টু সোসাইটি। আনপ্রডাকটিভ—এক্সেপ্ট ইন আ হার্মফুল বায়োলজিকাল ওয়ে। প্রেম বড়ই সর্বনেশে, বড়ই ভয়ানক। বন্ধুরা প্রেমে পড়লেই যদি এই অবস্থা হয়, তবে নিজে যদি প্রেমে পড়ি? তাহলে তো প্রাণেই মারা পড়বো? ওরে বাবা রে। কী ভয়ঙ্কর জিনিস! আই উইশ টু হ্যাভ নাথিং টু ডু উইথ ইট। পরে হবে। পাস-টাস করে গিয়ে।” দুটো করে সিড়ি টপকে ওপরে ছুটলো টুবলু, “পিকো!” “পিকো!” হাঁক দিতে দিতে॥

টুবলু ওপরে গেছে। আমি ঘরে এসে নোট নিচ্ছি এমন সময়ে ফের বেল। বাজবামাত্র আমার প্রাণে কী আনন্দ! রে রে! করে ছুটে গেছি।

“কে রে? পিকোর বন্ধু নাকি রে? আয় আয়—”

“নবনীতা দেবসেন আছেন?” দুর! ভুল লোক? অসম্ভব বিরক্ত গলায় বলি, “আছে। কেন?”

“একটু দরকার ছিল। একটা পত্রিকা থেকে এসেছি।” অগত্যা, “ওপরে আসুন।” একটি অল্পবয়সী ছেলে। পিকোর বয়সীই হ। গ্রাম থেকে কবিতার লিটল ম্যাগ বের করে। দিতে এসেছে। অভিমত চায়। কবিতাও চায়। উল্টেপাল্টে দেখলুম, অনেক প্রেমের কবিতা আছে।

“তুমি যে প্রেমের কবিতা লেখো, নিজে প্রেমে পড়েছো?”

“আজ্ঞে?”

“তোমারই তো নাম বললে অমুক চন্দ্র তমুক?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ।”

“এটা তোমার লেখা তো?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ।”

“তবে তো তুমি প্রেমে বিশ্বাসী।”

“আজ্ঞে?”

“তুমি তো প্রেমে বিশ্বাস করো দেখছি। এসব প্রেমের কবিতা তো তুমিই লিখেছো বললে।”

“আজ্ঞে হ্যাঁ! ভালো হয়েছে?”

“তোমার সঙ্গে প্রেম নিয়ে একটু কথা বলতে চাই।”

“আজ্ঞে কী বললেন?”

“বলছি, প্রেমে পড়েছে তো? প্রেমের অভিজ্ঞতা বিষয়ে আমি তোমার মতামতটা চাইছি। মন খুলে বলো দিকিনি?”

“প্রে…প্রেমের…আমার মতামত? আজ্ঞে আমি ঠিক, ঠিক বুঝতে পারছি না!”

‘আঃহা, এতে না-বোঝার কী আছে? আমি প্রেম বিষয়ে কিছুটা আলোচনা করতে চাইছি। প্রেম বলতে তুমি কী বোঝো?”

“কী বুঝি? তার মানে?” ভয়ে তার মুখ শুকনো।

“তার মানেটাও বলে দিতে হবে? কবিতা তো দিব্যি লিখতে পেরেছে। আর প্রেম কী বস্তু বোঝে না? আমি তোমাকে বলে দেবো?”

“প্রেম? কী বস্তু? আপনি বলে দেবেন? আমাকে?”

“আরে, নাঃ। আমি নয়। তুমি, তুমি। তুমি বলবে। আমাকে। আহাঃ, এতে এত লজ্জা করবার কী আছে? আশ্চর্য! তোমার বয়েস কত?”

“আমার বয়েস কত? য্যাঃ। আপনার চাইতে অনেক কমই হবে। দিদি যে কী বলেন?” ছেলেটা কী বুঝলো কে জানে, লজ্জায় লাল হয়ে উঠে দাঁড়ালো। তক্ষুনি—”আমি বরং আজ উঠি, দিদি। কবিতাটা পরে বরং কখনো এসে—” কোনোরকমে, যেন প্রাণটা হাতে করে পালিয়ে বাঁচবার মতন দৌড়ে নিচে নেমে গেল চব্বিশ পরগনার গ্রাম থেকে আসা তরুণ কবি-সম্পাদক। কি ভয়ানক শহুরে কবিনীর পাল্লাতেই না পড়েছিল সে আজ। এমন জানলে আসে কখনও? রা-মোঃ! …এতক্ষণে সবটা সরল হলো। বেশ বুঝতে পারছি গ্রামে গিয়ে সে কী গল্প করবে।…

“প্রেমের আলোচনা করতে চাইছিল! হ্যাঁ-হ্যাঁ, তবে কি আর বলছি? আমার সঙ্গেই। রসিয়ে রসিয়ে। কিছুতেই ছাড়বে না। ডবল বয়সী ভদ্রমহিলার লজ্জাশরম বলে কিছু নেই। আবার আমাকে বলছে ‘লজ্জা করবার কী আছে? বলছে ‘মন খুলে বলল, প্রেম কী বস্তু! এদিকে কেদারবদ্রী-কুম্ভমেলা লিখছে, পেটে পেটে এত? আমাকে একা বাড়িতে পেয়েই… বলে,’তোমার বয়স কত? মানুষ বড় আশ্চর্য হয় রে ভাই!” … বলে উদাস হয়ে যাবে। বলুক গে। তীর এখন বেরিয়ে গেছে। এর পরের বার থেকে সতর্ক হতে হবে। অমন খপাৎ করে ছেলেধরার মতন ধরলে, আর কাজের কথায় নেমে পড়লে চলবে না। ধীরে সুস্থে, রইয়ে সইয়ে। চা খাইয়ে। কবি-তরুণের দোষ নেই। দোষ আমারই।

আবার রিং। এবার অন্য স্ট্র্যাটেজি। সচেতন পদক্ষেপে।

“কে রে? সুদীপ? আয় আয়। বোস। কিরে, কাজকর্ম কেমন? হ্যাঁ, আছে পিকো। একটু ব্যস্ত আছে। বরং দশ মিনিট পরে যাস ওপরে। একটু চা খেয়ে যা নিচেই। ততক্ষণে বরং আমার সঙ্গেই একটু গল্প কর। হ্যাঁরে সুদীপ, এই যে তোরা এত বইপত্তর পড়িস, ছবিটবি দেখিস, ফিল্ম তুলিস, জীবন সম্পর্কে, বিশেষ ভাবে এই প্রেম সম্পর্কে তুই কী মনে করিস রে? মানে, ইন জেনারাল তোদের জেনারেশনটা কী ভাবছে? একটু খুলে বল তো বাবা? আমি ব্যাপারটা বুঝতে চাই।”

সুদীপ কলেজ শেষ করে ফেলেছে। এদের চেয়ে সামান্য বড়। ফিল্মটি তোলে। বিদেশী বইপত্তর পড়ে, ‘চট করে অবাক হই না’ টাইপ। তার দৃঢ় বিশ্বাস, এই পার্থিব জগতে সে যথেষ্ট চালুপার্টি। ‘রাফ্-টাফ্-মাচো’ সুদীপ জামার বোতাম লাগায় নাভির কাছে, কলম গোঁজে হিপ পকেটে, মোটরবাইকে পাড়া কাঁপিয়ে বেড়ায়। যেন মোটেই ঘাবড়ায়নি, এমন ভাবে সুদীপ একটা কাঠের চেয়ারে বসে পড়ে। এবং টের্‌চা চাউনিতে আমার দিকে তাকাতে থাকে। একে বলে ‘মাপ-নেওয়া’ আমি জানি। অর্থাৎ ‘মেজার’ করা হচ্ছে ‘সিচুয়েশনটাকে। হিন্দি সিনেমাতে ভিলেনই হোক, হিরোই হোক এমনি একটা সময়ে নিজেই নিজের দু’গালে বাঁহাত বুলোতে থাকে। তারপর ডান হাতে হঠাৎ ঘুষি মারে। (শাহেনশা’তে অবশ্য উলটো।)

সুদীপ ঘুষি মারবে না, জানি।

আমিও ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করি। ভাবতে টাইম নিচ্ছে, ভালো। ভেবেচিন্তে উত্তর দিক। আমিও তো তাই চাই। সুদীপ সিরিয়াস ছেলে। ভালো রোজগারপাতি করছে। পরিশ্রমী। বাইরে ভাবখানা যাই হোক, ছেলেটা আন্তরিক প্রকৃতির। রোজ নাকি বাড়ির বাজার করে দেয় মোটরবাইকে চড়ে। ওর মতামতে কাজ হবে।

সুদীপ গালে হাত বুলোয় না। দু’হাতে চেয়ারের দুটো কাঠের হাতল চেপে ধরে টের্‌চা চোখে আমার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে। বোতাম-খোলা জামার মধ্যে থেকে তার ছটা পাঁজরাও আমার দিকে স্পষ্ট, একদৃষ্টে চেয়ে থাকে। রোগা হওয়ার সঙ্গে ‘মাচো ইমেজের যোগ নেই। ইন্টেলেকচুয়াল ‘মাচো’রা রোগাই হয়। বড় বড় ভাসা ভাসা চোখে অপলকে বেশ খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে সুদীপ ঘাড় সোজা করে। নড়েচড়ে বসে। চোখ নামিয়ে এক মুহুর্ত কী ভেবে নেয়। তারপর মাথা তুলে বলে “প্রেম?” একটু ফর্সা করে হাসে। “ধুস। প্রেম দিয়ে কী হবে? আমি প্রেমে বিশ্বাসই করি না। ওসব প্রেমট্রেম আজকাল আর চলে না, নবনীতাদি, ওসব আপনাদেরই টাইমের জিনিস ছিল। এখন অবসোলিট হয়ে গেছে। গপ্পো-উপন্যাসে-ফিলিমেই শুধু পাবেন। লাইফে নেই। আমরা র‌্যাশনাল জেনারেশন। আমরা অবজেকটিভ্‌লি লাইফটাকে দেখি। লাভক্ষতির অঙ্ক কষি। আমরা অ্যামবিশাস। কই? চা তো বললেন না? প্রেম ব্যাপারটা এখন ঠিক চলে না। কেরিয়ারটাই সবার আগে। আপনি বাঁচলে প্রেমের নাম। প্রেমের জন্য আমরা কেউ তো কেরিয়ার স্যাক্রিফাইস করবো না? না মেয়ে, না ছেলে। কেউ কিছুই স্যাক্রিফাইস করবো না—এখন সবাই স্বার্থপর। বুঝলেন তো নবনীতাদি, এখন যে যার, সে তার। ছেলেমেয়ে সবাই সেল্ফ্-সীকিং হলে আর প্রেমটা হবে কেমন করে? কে করবে? কার সঙ্গে করবে? প্রেমে কেউই আর বিশ্বাস করে না, এক বোকারা আর ন্যাকারা ছাড়া। ওটা আউটডেটেড কনসেপ্ট এখন। আমাদের এটা প্রয়োজনভিত্তিক সোসাইটি। নবনীতাদি, এখানে বিনা প্রয়োজনের কোনো জিনিস চলে না।” সুদীপ আমার সামনেই একটা সিগারেট ধরিয়ে কেমন একটু জেনুইন মমতার সঙ্গে হাসলো। চা এসে গেছে।

আমি চা আর অ্যাশট্রে এগিয়ে দিলুম। মনে মনে নোট করতে গিয়ে আমি বোকা হয়ে গেলুম—সুদীপ আসলে কী বললো? ও কি প্রেমে বিশ্বাস করে, না করে না?

নেক্সট যেই না বেল বেজেছে আমিও ঠিক স্প্রিং দেওয়া পুতুলের মতো দালানে ছিটকে এসেছি। এবং ভাঙা গলাকে যথাসম্ভব মিষ্টি করে বলেছি—

“কে রে? পিকোর বন্ধু কেউ এলি নাকি রে? ভয়ে-শীতল কচিগলায় কোরাসে উত্তর হলো নিচে থেকেই—

“ইয়ে, হেঁ-এ! মানে, না, না! আসলে আমরা টুম্পার…মানে, আর কি, আমরা থাকতে আসিনি। কেবল এক মিনিট, এক্ষুনি চলে যাবো। একটা জরুরি কাজে। এই পিকোদির কাছে। শুধু এক মিনিটের জন্যে। সত্যি সত্যি।” কেউ উপরে এলো না। পিকো একদম পড়ছে না, সামনে পরীক্ষা, আমি তাই প্রায়ই রৈ রৈ শব্দে ওর বন্ধুদের ভাগিয়ে দিই। বুঝতে পারি, এটা তারই ফলশ্রুতি। (আজকাল কেউ ‘ফল’ লেখে না। ফলশ্রুতি’ লেখাই নিয়ম।) এই পার্টি তারই প্রতিক্রিয়ায় ভুগছে। অতএব আমি তাদের মধ্যে মনোবল সঞ্চার করতে চেষ্টা করি।

“ভয় কিসের? ওপরে আয় না! কে রে তোরা? পিকোদি বাড়ি আছে।” আস্তে আস্তে সিঁড়িতে শব্দ হয়। দুটি কচিমুখের আবির্ভাব ঘটে সিড়ির মাথায়। ‘হে মাধবী-দ্বিধা-কেন আসিবে-কি-ফিরিবে-কি’র মত করে আমি বলি—”কি ব্যাপার? এত কিন্তু কিন্তু কিসের? এই কি নতুন আসছিস? নাকি তোরা রিম্ঝিম্? আর প্রতিম? আয় না ওপরে আয়, শুধু শুধু অত ভয় পাচ্ছিস কেন? বোস্ এখানে। (আমি আছি গিন্নি আছেন, আছেন আমার নয় ছেলে!) হ্যাঁ, পিকোদিকে ডেকে দিচ্ছি। আচ্ছা রিমঝিম-প্রতিম, তোরা কি এখনও প্রেমে বিশ্বাস করিস?” বলেই ‘এখনও’ কথাটা নিজেরই কানে খাপছাড়া লাগে।

“প্রেম?” সমস্বরে উচ্চারিত শব্দটি হাঁফ ছাড়ার মতো শোনালো। ততক্ষণে পায়ে পায়ে কাছে এসেছে দুটো ছেলে। একটার এখনও গোঁফদাড়ি গজায়নি তেমন, আরেকটার মুখভর্তি কচিকচি ঘাসপাতার মতো দাড়িগোঁফ। ক্ষুর চলেনি। বড় বড় চোখ দুটো নেহাত ছেলেমানুষ ছেলে। কিশোর বলাই যথার্থ। একটা ওদের মধ্যে একটু বড়। সদ্য যুবা। রিমঝিটা আমার ছোটো মেয়ে টুম্পার সতীর্থ। ছোটো মেয়ে এখন কলকাতার বাইরে পড়ছে। হস্টেলে থাকে। কুড়ি হয়নি।

“প্রেম? মাসি?” …শুধু এইটুকুনি বলেই ভয়ে-বলি-না-নির্ভয়ে-বলি মুখ করে হঠাৎ চুপ করে গেল দু’জনে। এবং পরস্পর নিদারুণ চোখাচোখি করতে লাগলো।

“ভয় কি? বল্ না?” আমি যথাসাধ্য মাভৈঃ প্রদান করি। “তোরা প্রেমে বিশ্বাস করিস তো? অ্যাঁ? প্রেম নিয়ে ভাবনাচিন্তা করিস?” দাড়িওয়ালা মুণ্ডখানি প্রতিম সজোরে নাড়ালো ডাইনে-বাঁয়ে। অর্থাৎ না। করে না। স্বল্প গোঁফের রেখা ওঠা মুখখানি প্রবলভাবে হেলিয়ে কানটা একদিকের কাঁধের সঙ্গে ঠেকিয়েই ফেললো রিমঝিম্। অর্থাৎ করে। খুব করে। আরে? এদের যে দেখি একযাত্রায় পৃথক ফল! ঠিক হ্যায়, আগে অবিশ্বাসীকেই ‘হ্যাণ্ডল’ করা হোক।

“প্রতিম? তুই বিশ্বাস করিস না প্রেমে? কেন? কী হয়েছে? তোদের না অ্যান্টনি অ্যাণ্ড ক্লিওপ্যাট্রা টেক্সট?”

“রেপ অফ দা লকও টেক্সট। তারপর, টেক্সটের মধ্যে” —প্রতিম অকস্মাৎ সিলেবাস নিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠছে দেখে, তাড়াতাড়ি থামিয়ে দিই।

“থাক, টেক্সটের কথা থাক। তোর নিজস্ব ফিলসফিটা কী? জীবনদর্শন? প্রেমে বিশ্বাস নেই কেন রে? এই বয়েসে?”

“এই বয়েস বলেই। বড্ড টাইম কনজিউমিং! ভীষণ সময় নষ্ট হয়ে যায়। প্রতিম আড়চোখে একবার রিমঝিমের দিকে তাকায়। রিমঝিমের চোখমুখে মোটেই সাপোর্টের চিহ্ন নেই। ভুরু কুঁচকে যুদ্ধং দেহি ভাবে চেয়ে আছে সে।

“এই স্টুডেন্ট লাইফে প্রেম করাটা ঠিক নয়। আগে পড়াশুনোটা শেষ করে নিয়ে, যখন হাতে সময় থাকবে” —প্রতিমের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে হঠাৎ রিমঝিম্ বলল—”একদম রিটায়ার-টিটায়ার করে গিয়ে, তখন বরং প্রেমটা তুই করিস। বুঝলি প্রতিম? তখনই হাতে প্রচুর, অঢেল অনন্ত সময় থাকবে।” বেশ নিরীহভাবেই এটা বলল রিমঝিম্।—”এখন তোর পড়াশুনো, তারপর তোর চাকরিবাকরি—”

“ইয়ারকি মারিস না, রিমঝিম। কী বুঝিস তুই প্রেমের? যা জানিস না সেই নিয়ে কথা বলবি না।” প্রতিম একটু রেগে গিয়ে সিরিয়াসলি বলে—”প্রেম তো করলেই হলো না? গার্লফ্রেণ্ডকে টাইম দিতে হয়, সমানে পারসিউ করতে হয়, জানিস? প্রেমের জন্য কিন্তু প্রচণ্ড সময় লাগে, নইলে প্রেম ছেত্রে মেতরে যায়। প্রেমে পড়লে পড়াশুনো, আড্ডা, থিয়েটার সবই মাটি। শুধু ওই একজন মেয়েকে নিয়েই সবটা সময় কেটে যায়। খেলা দেখা হয় না। অন্য বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিলেই গার্লফ্রেণ্ড চটে যায়। তাকে খাওয়াতে, তাকে সিনেমা দেখাতে, অনবরত ধারকর্জ করতে হয় ফলে বন্ধুবিচ্ছেদ হয়ে যায়।—রোজ রোজ বাড়ি ফিরতে দেরি হয়, মা-বাবাও ক্ষেপে যায়—মহা প্রবলেম। যেমন সময় নষ্ট, তেমনি পয়সা নষ্ট, —পড়াশুনোও ইনরমাসলি সাফার করে।—একদম কনসেনট্রেশন থাকে না, পড়ায় কিছুতেই মন বসে না—ওঃ সো ডিসটার্বিং। প্রেম একদম ভালো না—”

“শুনে তো মনে হচ্ছে বেশ প্র্যাকটিক্যাল এক্সপিরিয়েন্স থেকেই কথা বলছিস। রিসেন্ট এক্সপিরিয়েন্স বলেই মনে হচ্ছে? তুই তো এবছর ড্রপ দিলি? না রে?”।

“হি-হি, এসব কী আন-এথিক্যাল প্রশ্ন? আউট অব সিলেবাস হয়ে যাচ্ছে যে। নো পার্সোন্যাল ইনফর্মেশন—আমি কেবল জেনারেল থিওরি দিচ্ছি!—আমার থিওরি ছাত্রকালের প্রেম খুব খারাপ জিনিস, করলেই সমূহ বিপদ—সব দিক দিয়ে লোকসান। কেবল যদি কেউ স্বরূপের মতন ভেরি স্পেশাল পার্সন হয়, উইকলি ডাইরি মেনটেন করে, লাইব্রেরি ওয়ার্ক, রেস্তরাঁ ওয়ার্ক, সবকিছু কাজকর্ম হার্ট অ্যাণ্ড হেড, ডেইলি রুটিনে একদম ভাগ করে ফেলে, তবেই সম্ভব। নাঃ। ও একা স্বরূপই পারে। আমাদের মতো জনসাধারণের পক্ষে লে-মেনদের পক্ষে প্রেম ইজ নট প্র্যাকটিকেটল—নট আ প্র্যাকটিক্যাল প্রপোজিশন অ্যাট অল!”।

প্রতিমের মুখের কথা ছিনিয়ে নিয়ে রিমঝিম্ মেঠো বক্তৃতার সুরে বলে—“আমি কিন্তু মোটেই মনে করি না প্রেম শক্ত কিংবা প্রেম খারাপ। প্রেম খুব ভালো জিনিস। আমি খুব প্রেমে বিশ্বাস করি—আমি খুবই প্রেম করতে চাই। কিন্তু আমাকে কেউই যে কেন প্রেম করতে চায় না—”

“সে তোর গোঁফদাড়ি বেরুলেই ঠিক দেখবি মেয়েরা দুড়দাড় প্রেমে পড়বে। আসলে এখনও তোকে ওরা বাচ্চা ভাবে—” নিজের কচি কচি দাড়িগোঁফের গায়ে হাত বুলিয়ে, দাম্ভিক হাস্য দেয় প্রতিম।—“কেন? কেন ভাববে বাচ্চা?”

রিমঝিমের ক্রুদ্ধ উত্তর।—“ভাবলেই হলো? আমিও যে-ক্লাসে পড়ি, ওরাও তো সেই ক্লাসে, তবে?—তবুও আমি বাচ্চা? বললেই হলে যা হয় একটা কথা!” রিমঝিমের অভিমানে ভাঙা গলা বুজে আসে। বেশ তো মিষ্টি দেখতে রিমঝিমুকে, কেন প্রেমে পড়ে না মেয়েগুলো? ‘নওলকিশোরের সেই আইডিয়াটা আর বাংলার মাটিতেও চলছে না তাহলে? সব র‍্যাম্বো? অমিতাভ আর মিঠুন?

“হবে রে, হবে রে, তোরও হবে,” মূর্তিমতী সান্ত্বনার মতো এবার পিকোদি আবির্ভূত হয়, “বিশ্বাসে কৃষ্ণ পর্যন্ত মিলে যায়, আর তোর একটা প্রেম হবে না? তাই কখনও হয়?”

“তোর সেই বেগুনি সোয়েটার পরা গুণ্ডা মেয়েটার সঙ্গেই হয়ে যাবে, দেখিস, একটু ধৈর্য ধর”—রহস্যময় হেসে প্রতিম বলে। “সবুরে মেওয়া ফলে! মেলা তড়বড় করিসনি!” —দৌড়ঝাঁপ করতে করতে তিনজনে মিলে ওপরে উঠে যায় এবার। “চলি, মাসি?” —আমার মাথা আবার গুলিয়ে যায়। এরা তবে কে কোন্ দলের?

আপনারা ভাবতে পারেন মেয়েদের দেখা নেই কেন? কেননা মেয়েদের আমি প্রশ্ন করছি না। সম্প্রতি একটি নয়, দুটি মেয়েদের পত্রিকাতে কলকাতা ও যাদবপুরের ছাত্রীদের স্পষ্টবাদী সাক্ষাৎকারে তাদের মতামত পড়ে জেনে গিয়েছি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের মধ্যে ৯৯% প্রেমে উৎসাহী নয়। সবাই কেরিয়ারে উৎসাহী, যারা সাক্ষাৎকার দিয়েছে। প্রেমকে কেরিয়ারের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখছে তারা। অথবা একটি বিকল্প কেরিয়ার। প্রেম মানেই বিবাহ, বিবাহ মানেই কর্মজগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীনতাবঞ্চিত জীবনযাপন। বেশিরভাগ সাক্ষাৎদাত্রী চায় মুক্ত জীবন, স্বাধীন উপার্জন, কর্মজীবন। প্রেমে, বিবাহে জড়িয়ে পড়তে রাজি নয় তারা। আরেক দল বিবাহোন্মুখ। তারা বিবাহের প্রতি আগ্রহী, কিন্তু প্রেমের প্রতি নয়। সবাই চায় নিরাপত্তা। ইতিমধ্যে, যদি ইচ্ছে করে তবে প্রেম-প্রেম-খেলায় (‘হ্যাভিং ফান’) তেমন আপত্তি নেই কয়েকজনের। কিন্তু প্রেমে-পড়া? নৈব নৈব চ। মেয়েরা ‘প্রেম’ থেকে পালিয়ে গিয়ে কেরিয়ার বাঁচাতে চায়, তা সে-কেরিয়ারে ‘চাকুরি’ই হোক, আর ‘বিবাহ’ই হোক। প্রেমটা মেয়েদের ক্ষেত্রে কেরিয়ারের বালাই হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ছেলেদেরও কি তাই নয়? ছেলেদের কথা শুনেও তো তাই মনে হচ্ছে আমার। এইসব ভাবতে ভাবতে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি, ব্রিটিশ কাউন্সিলের সামনে এক ছাত্রের সঙ্গে দেখা। খুব ব্রাইট ছেলে। একটা ফাস্ট ক্লাস পেয়েছে, আরেকটার জন্যে তৈরি হচ্ছে। দেখবামাত্র আমার মুখ থেকে প্রশ্ন ছুটে গেছে—

“এই যে কুনাল! এক মিনিট দাঁড়াও তো? প্রেম কী জিনিস? একটা ডেফিনিশন দিতে পারো আমাকে?” সে-ছাত্রও সোজা পাত্র না। সুদীপেরই মতো, ‘কিছুই-আমাকে-অবাক-করেনা’ আঁতেল টাইপ। ঝোলা গোঁফ। প্রশ্ন শুনে, যেন-এটাই-আশা-করছিল এমনিভাবে বিনা বিস্ময়ে, বইখাতা বগলে পুরে প্রথমে কিছুক্ষণ, মিনিট খানেক হবে, উটমুখো হয়ে আকাশের দিকে চেয়ে রইলো। ভাবছে। ভাবুক। ভেবেচিন্তে বলুক।

তারপর কুনাল তর্জনী তুলে বললো—

“ইলেকট্রিকের বালবের মধ্যে যে সূক্ষ্ম তারটা আছে, ‘ফিলামেন’টা, যেটা কেটে যায় আর কি, দেখেছেন তো দিদি? প্রেম হলো ঠিক তাই। অথবা, ধরুন এই প্রদীপের সলতেটা। তা বলে কিন্তু মাইন্ড ইউ, প্রদীপের তেলটা, কিংবা বাল্‌বের ইলেকট্রিসিটি, ওগুলো প্রেম নয়। ওটা আবার অন্য জিনিস। বুঝেছেন তো?” বেশ অন্তরঙ্গভাবে চোখ মালো ছাত্রটি। এবার আমার ঘাবড়াবার পালা।

“অন্য জিনিস? কী জিনিস বাবা? ঠিক বুঝিনি।”

আমার সরল প্রশ্নে প্রশ্রয়ের হাসি হেসে ছাত্র আমাকে বলে, “বোঝেননি? তাহলে আরেকদিন বুঝিয়ে দেবো দিদি, আজ হাতে সময় নেই, লাইব্রেরি বন্ধ হয়ে যাবে—” ছুটতে শুরু করেই থেমে পড়ে, নাটকীয় ভাবে হাতজোড় করে জ্যাকি শ্রফ-মাকা গোঁফের তলায় নকল করে মিষ্টি হেসে কুনাল বলে—“আজি মোর দৈন্য করো ক্ষমা” —বলেই লাইব্রেরির দরজায় সেঁদিয়ে যায়। অদূরেই মনে হলো যেন একটি অপেক্ষমাণা সালোয়ার-কুর্তা নড়ে উঠলো, একটি ওড়না দুলে উঠে কুনালের দিকেই এগিয়ে এলো বাল্‌বের ফিলামেন অথবা প্রদীপের সল্তের মতো।

দুর হোকগে ছাই সম্পাদকীয় ফরমাশ। প্রেমের আবার এ-প্রজন্ম সে-প্রজন্ম কি? কেবল বাজে কথা। প্রেম তো জন্মজন্মান্তর ধরেই। যে-কে-সেই। প্রেম সব যুগেই প্রেম। প্রেম সব দেশেই প্রেম। আমিও যেমন! তিন পুরুষ আর চোদ্দ পুরুষে কিছু তফাত নেই। যাঁহা শাজাহান, তাঁহা এলিজাবেথ টেলর, টাইপগুলো কেবল আলাদা। কেউ ম্যারাথন, কেউ রিলে রেস। ছোটে সবাই প্রাণপণে। যে যেটুকু রাস্তা পারে। বাবা-মা ছুটেছেন তাঁদের মতন। আমরা আমাদের মতন। এরা ছুটবে এদের মতন।

বাড়িতে ফিরতেই করুণাসিন্ধু হয়ে এসে পিকো নিজেই বললো—“মা, দিবাকর এসেছে ভাটপাড়ার বামুন। ওকে নিয়ে তোমার স্পেসিমেন স্যাম্পলিং করবে না?”

“ও, দিবাকর এসেছিস? শোন বাবা,” আমি বসে পড়ে জুতো খুলতে-খুলতেই বলি—“বল্ দিকিনি তুই প্রেম বিষয়ে কী ভাবিস?”

“কিসুই ভাবি না?” হাস্যবদনে দিবাকর বললে ধুতিপরা পা নাচাতে নাচাতে। “ভাববার আছেটা কী?”।

“মানে?”

“মানে কক্ষনোই ভাবিনি। ভাববার কী আছে এতে?”

“প্রেমে বিশ্বাস করিস?”

“বাঃ, অবিশ্বাস করলেই হলো? এত কীর্তন, বৈষ্ণবগীতিকবিতা, মেঘদূত, গীতগোবিন্দ লেখা হয়ে গেল, রবিঠাকুর এত গান লিখলেন, অবিশ্বাস করলেই হলো? ফ্যাক্ট ইজ ফ্যাক্ট। ফ্যাক্ট থাকলেই ভাবতে হবে? পিপীলিকাভুকও তো ফ্যাক্ট। জগতে আছে—আমি কি তাই নিয়ে ভাবি?”

“কিন্তু প্রেম আর পিপীলিকাভুক!”

“থাকুক, তাতে আমার কি? আমার ওসব নিয়ে ভাবার টাইমও নেই, ইনক্লিনেশনও নেই।”

“তোদের তো বৈষ্ণববাড়ি।” ভয়ে ভয়ে বলি।

“তাতে কি হলো?” দিবাকর বলে। “বৈষ্ণববাড়ি বলে জীবহিংসা হয় না। নিরিমিষ্যি খাই। ব্যাস্। ঐ পর্যন্তই যা। প্রেম। জীবে প্রেম নিয়ে ভাবনা বলতে পারেন।”

“তোর বন্ধুবান্ধবেরা তো খুব ভাবে। ঊষা তো এন্‌গেজড হয়ে গেল।”

“ওঃ ঊষা? উষার প্রেম? তাও জানেন না বুঝি? শুনুন তবে! ঊষা আর রমেশের ব্যাপারটা হচ্ছে সিম্পল! টিউশনের এম্পায়ারটা ভাগাভাগি হয়ে যাচ্ছিল। এ পায় ছ’ হাজার, তো ও নিয়ে নেয় পাঁচ হাজার। তার চেয়ে বিয়ে করে ফেললে জয়েন্ট টিউটোরিয়াল হোম খুলে বিশ পঁচিশ হাজার তুলতে পারবে। তাই প্রেম। একে আপনি প্রেম বলবেন?”

আমি নির্বাক। আমাকে নির্বাক করতে পেরে দিবাকর খুব খুশি। বেড়ালের মতন গোঁফ নাচিয়ে হাসলো

“এসব আপনি বুঝবেন না! এরা যে-যার বিজনেস ইন্টারেস্টে পারস্পরিক সন্ধি করে নেয়। আপনারা ভাবেন, প্রেম। এর বাবার টাকা দেখে, ওর বাবার নাম-যশ-প্রতিপত্তি দেখে, কারুর ফর্সা রঙ দেখে, আরেকজনের মার্কশিট দেখে—হুঃ, এই তো এদের প্রেমের সব উৎস। দুর। ওসব আবার প্রেমে পড়া নাকি? ওতে ভুলবেন না দিদি!” দিবাকর সাবধান করে দেয়, কচি গোঁফ নেড়ে, হুলোবেড়ালের মতন।

“এ-প্রেম সে-প্রেম নয়! আপনারা যাকে প্রেম বলতেন। এ হচ্ছে অন্য মেজারমেণ্টের। আমাদের যুগের আসলে মেটিরিয়ালটা আলাদা। ঐ হয় স্বার্থের হিসেব, আর নয় তো খেলা। প্রেম বলে কিছুই এখন প্র্যাকটিসড হয় না। যা হয় সেটা একটা প্যাসটাইম। প্রেম-প্রেম খেলা। লাইক এনি আদার গেম। সময় কাটানোর প্রণালী। যেমন ক্রসওয়ার্ড পাজ্‌ল। শব্দসন্ধান। শিকার। মৃগয়া। ক্রিকেট। তেমনি। উত্তেজনা আছে। হারজিত আছে। কংকোয়েস্ট-এর মজা আছে। সবই আছে, কেবল প্রেম নেই। ও আপনাদের সময়েই ফুরিয়ে গেছে। আমাদের যুগে ছিটেফোঁটাও নেই।”

“তুমি একটা এতবড় পণ্ডিতবাড়ির ছেলে হয়ে দর্শনশাস্ত্রের ছাত্র হয়ে এমন বলছ? ছিঃ।”

“ছিঃ তো কি। যা বুঝেছি অনেস্টলি তাই তো বলবো? নাকি বানিয়ে বানিয়ে কাব্য করতে হবে?”

মন খারাপ হয়ে যায়। একের পর এক নবীন যুবক এসে প্রেমকে নস্যাৎ করে যাচ্ছে। বিশ্বের ভবিষ্যৎ তবে কী? আমার কাতরতা আর চাপতে পারি না। বলে ফেলি : “তোরা কী রে? যাকেই ধরি, সেই বলে প্রেমট্রেম সব বাজে কথা। তোদের জেনারেশনটাই—”

“আপনার যে গোড়ায় গলদ! আপনার স্যাম্পলিংয়েই ভুল হচ্ছে। র‌্যানডম তো হচ্ছে না। সবাই তো পিকোরই বন্ধু। কিছু একটা মিল না থাকলে বন্ধু হয়েছে কেন এরা? এটাই মিল। সবাই একরকম কথা তো বলবেই। আপনি বড় রাস্তার মোড়ে এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে এভরি থার্ড পথচারীকে ধরুন। সেই সাম্পলিং-এর রেজাল্টটা নির্ভরযোগ্য হবে। যদি সায়েন্টিফিক মেথড ফলো করতে চান।”

“আমি বড় রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে এভরি থার্ড পথচারীকে ধরব? ধরে জিজ্ঞেস করব—আপনি প্রেমে বিশ্বাস করেন?” তারপর আমাকেই ধরে মারবে না তো তারা? নইলে সলিসিটিংয়ের জন্য পুলিশ আমাকে জেলে পুরে দেবে না?”

দিবাকর একটু লজ্জিত হয়। আঙুল কামড়ে চিন্তিত মুখে জানায় ; “সেদিকটা অবশ্য আমার স্ট্রাইক করেনি।”

তারপর, “বরং ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে স্টুডেন্টদের মধ্যে একটা স্টেনসিল কেটে কোয়েশ্চেনেয়ার বিলিয়ে দিন—সেটাই ভালো হবে।”

“কেউ ফেরত দেবে না। কে কালেক্ট করবে? তুই করবি?”

“ওরে বাবা!”

“তবে? দ্যাখ তোদের মুখেই যত বড় বড় কথা। কেউ কোনো ভার নিতে চায় না।” বকতে-বকতেই টের পেলুম হঠাৎ আসল কথাটা বলে ফেলেছি। এটাই এদের এই প্রেম-বিমুখতার মূল কারণ! দায়হীনতার লোভ। নিদায়, নিভার, স্বাধীন, মুক্ত জীবন এদের কাম্য, কর্মময় হলেই ভালো, আলস্যময় হলেও ক্ষতি নেই (যতদিন ক্ষতি না থাকে)। প্রেম মানেই বন্ধন। মানেই দায়দায়িত্ব। হৃদয়ের, জীবনের। মর্মের, কর্মের। এরা জীবনে দেয়াল তুলতে চায় না।

এটা কি আদর্শবাদ? নাকি একেই বলে স্বার্থপরতা? প্রেমের মূলে আছে অংশগ্রহণ, ‘শেয়ার’ করা, সুখদুঃখ, মান-অপমান, হারজিত—সব ভাগ করে নেয় প্রেম। এ প্রজন্ম বোধ হয় ভাগ নেওয়াতে বিশ্বাসী নয়। সবাই যার-যার তার-তার। কে যেন বলেছিল না—যে যার সে তার? সুদীপ কি? না টুবলু? না প্রতিম? না কির? সবই একরকম শোনাতে শুরু করেছে আমার মনের মধ্যে এবারে। সত্যিই কি বদলে গেছে এই প্রজন্মে ভালোবাসার মূল্যবোধ?

ভাবছি, এমন সময়ে দিবাকর ফিরে এলো। নিচে নেমে এসে দিবাকর নিজেই বললো, “আপনি কি মন্দার সঙ্গে কথা বলেছেন? মন্দাকিনী রায়?”

“না তো?”

“বলে দেখবেন। অন্য একটা অ্যাঙ্গেল পাবেন। ওই তো ওপরে বসে আছে। ডাকবো?”

“ডাকবো? তা, পিকো তো ওকে ডাকেনি?”

“ডাকবে কেন? আপনি তো মেয়েদের মতামত চাননি? এর প্রবল ওপিনিয়ন আছে!”

“এই কি কবিতা লেখে? কলেজ ম্যাগাজিনে লিখেছিলো, দান্তে আর বিয়াত্রিচে—”

“হ্যাঁ হ্যাঁ এই সেই। মন্দা! মন্দা! নিচে আয়। ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে! ভালো স্টুডেন্ট কিন্তু!”

পরমাসুন্দরী একটি ছবির মতন মেয়ে এলো।

“কী পড়ো?”

মিষ্টি হেসে মেয়েটি বললো, “এম এ ফাস্ট ইয়ারে ঢুকেছি।” গলাটিও মধুর।

“তুমি কি প্রেমে বিশ্বাস করো, মন্দা?”

একটুও না ঘাবড়িয়ে নামঠিকানা বলার মতো সহজে—”নিশ্চয়ই!” বেশ জোরের সঙ্গেই মন্দাকিনী জানায়।

“মানে?” আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল।

“মানে? আমি মনে করি প্রেমই সব। প্রেমের জন্যেই মানুষ বাঁচে। বাঁচতে হলে তো একটা মোটিভেশন লাগে? কেউ টাকা রোজগারের জন্যে বাঁচে, কেউ নামযশ করবে বলে, আমি বাঁচি প্রেমের জন্যে।”

“প্রেম মানে? জীবে প্রেম? গান্ধীজী, বুদ্ধদেব…”

“না না, প্রেম মানে এমনি প্রেম। একজন মানুষের জন্য আরেকজন মানুষের ব্যাকুলতা। তাকে কাছে পাওয়ার জন্য, তাকে চোখে দেখার জন্য, তার কণ্ঠস্বর শোনার জন্য, তার স্পর্শ পাবার জন্য—এইসব। দিবাস্বপ্নে, নিশাস্বপ্নে, সব সময়ে তারই কথা ভাবা। সেই প্রেম।”।

“আই সী।” আমি কেমন কথা খুঁজে পাচ্ছি না। মন্দাকিনী অত্যন্ত স্পষ্টবাদিনী রোমান্টিক।

“হাতে এসে গেলেই কিন্তু গেল!” মন্দা বলে।

“অ্যাঁ, কী বললে?”

“বলছি, প্রেম যতদিন অপূর্ণতার মধ্যে, অতৃপ্তির মধ্যে, আকাঙক্ষার মধ্যে থাকে ততদিনই প্রেম বেঁচে থাকে, বৃদ্ধি পেতে থাকে। আর যেই প্রেমে প্রাপ্তি এলো, তৃপ্তি এলো, অমনি সুপ্তিও চলে আসে। তারপরে প্রেম শুকিয়ে যায়, ফুরিয়ে যায়। তখন জীবন খুব বোরিং।” মন্দা হাসে। এ তো একেবারে আমার মার কথাই বলছে! কোথায় জেনারেশন গ্যাপ?

“ঘুম থেকে উঠতেই ইচ্ছে করে না। যতদিন না আবার প্রেমের উদয় হচ্ছে।” মন্দা আরো জানায়।

“আবার উদয় হয়?”

“বাঃ! হবে না? প্রেম তো সূর্যের মতো। অনবরত অস্ত আর উদয়। উদয় আর অস্ত। পার্মানেন্টলি এমন সময় তো আসবে না, যখন সূর্য নেই। সেটা রাত্রি। রাত্রি কেটে যায়। প্রেমের ভোর হয়। প্রেমের সূর্যোদয় হয়। নতুন প্রেম আসে জীবনে।”

“তুই বুঝি অনবরত প্রেমে পড়িস? মন্দা?”

“অনবরত। আমার তো প্রেমময় জীবন!” হাসতে হাসতে মন্দাকিনী বলে—“শ্রীচৈতন্যদেবের টাইপের। মেরেছে কলসির কানা তাই বলে কি প্রেম দেব না? আমি সেই টাইপ। আপাতত দিবাকরদা কিছুতেই অ্যাটেনশন দিচ্ছে না সেটাই মুশকিল। বলুন তো একটু দিবাকরদাকে! বলছি এত করে—”

“ও, এই ব্যাপার? দিবাকর!”।

“মাপ করবেন, দয়া করে মন্দাকিনীর সঙ্গে প্রেম করতে আদেশ করবেন না। প্রেম আমার লাইন নয়। মন্দাকিনী আমাদের পাল্টি ঘর, চমৎকার মেয়ে, ছোড়দার সঙ্গে সম্বন্ধ করছি, হয়ে গেলে হয়ে যাবে। আমাকে কেন? ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি।”

আমিও মত বদলে ফেলি।

“তুমি বরং ওর ছোড়দাকেই—”

“ছোড়দা বিলেতফেরত, পাত্র ভালো, চাকরি করে, মাছ মাংস খায়, দেখতেও ভালো, মন্দার সঙ্গে ওকেই মানাবে।—তখন থেকে এটাই বোঝাচ্ছি ফের প্রেমের সূর্যোদয় হবে। এবারকার মতন এ সূর্যটাকে অস্তই নামিয়ে দে!”

আমিও বলি, “দিবাকর সুবিধের পাত্র হবে না। ছোড়দাই বেটার মনে হচ্ছে।”

মন্দাকিনী মিষ্টি হাসলো। প্রশ্রয়ের সুরে বললো : “ওভাবে তো হয় না? যতদিন দিবাকরদা এই…এরকম করবে, ততদিনই আমারও যে—”।

“তার চে, দিবাকর, তুই ওর প্রেমে পড়ে যা—তাহলেই চৌচাঁ পালাবে মন্দাকিনী! ওর সবই ওই রোমান্টিক অপ্রাপ্তি” —এবার পিকো গভীর উপদেশ দেয়। —”প্রাপ্তির একটু লক্ষণ দেখালেই মন্দা আর সেখানে নেই। ভয়ানক পুড় মেয়ে! মুখেই যত!” মন্দা মিষ্টি-মিষ্টি লজ্জা-লজ্জা হাসে।

অস্বীকার করে না। দিবাকর বলে, “দাঁড়া তোকে কালই নিয়ে যাচ্ছি সায়েন্স কলেজে ছোড়দার ল্যাবে—”।

আরেকটা দৃষ্টিকোণই বটে। মেয়েদের পত্রিকার সাক্ষাৎকারে এটা ছিলো না। এটা কি প্রেমে বিশ্বাস? না প্রেমে অবিশ্বাস? মোদ্দা কথাটা ঠিক ধরা গেল কি? ও কি আমাদের ছোটোবেলার মতন…ও কি সত্যিই রবীন্দ্রনাথের গানের মতন…রিম্ঝিম্ এক প্রবল প্রেমিক, আর এই মন্দাকিনী আর এক। অতিবড় ঘরনীরা না পায় ঘর। মন্দার প্রেমে বিশ্বাসটাকে কিন্তু ‘প্রেমে-অবিশ্বাস’ বলেই সন্দেহ হতে থাকে আমার। ওই, যাকে দিবাকর বলছিল ‘প্যাসটাইম’, সেরকম লাগছে না কি মন্দার এই সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের ব্যাপারটা?

তা কেন? অনেকেই আছে প্রেমে বিশ্বাসী। আগের মতনই। রুপোলি যেমন। মস্ত ধনীর একমাত্র আদরিণী সন্তান স্বেচ্ছায় নিম্নমধ্যবিত্ত উদ্বাস্তু একান্নবর্তী পরিবারের এক দোকানির বড় ছেলেটিকে বিয়ে করে বাঘা যতীনে খুবই শান্তিতে ঘরকন্না করছে। কে বললে প্রেম নেই? স্যাক্রিফাইস নেই? রুপোলিকে আমি দেখিনি? ওকে প্রশ্ন করতে হয়নি প্রেম সম্পর্কে ওর ধারণা কী। নওরোজকেও দেখেছি। ওই যে থাইরয়েডের অসুস্থতার কারণে স্থলাঙ্গিনী কিন্তু বুদ্ধিমতী গুণবতী চৈতালীকে বিয়ে করলো। পাঁচ বছর বাগদত্ত থাকার পর, বিলেত থেকে ফিরে এসে চৈতালীকে নিয়েই ঘর বেঁধেছে নওরোজ। ওরাও তো আমারই ছাত্রছাত্রী। সুদীপ-দিবাকরের প্রজন্ম। আর যাই হোক সাক্ষাৎকারে কেউ সত্যি কথা বলে না। খবরের কাগজকেও না, বন্ধুর মাকেও না, মাস্টারমশাইকে তো নয়ই। প্রশ্ন করে কিছু হবে না। চোখই একমাত্র সাক্ষী, চোখটাকে তীক্ষ করতে হবে। এই সুদীপকেই তো পাঁচ বছর ধরে একটাই মিষ্টিমতন মেয়েকে মোবাইকে করে নিয়ে ঘুরতে দেখেছি। সুদীপের গার্লফ্রেণ্ড। গার্লফ্রেণ্ড কাকে বলে এরা? এদের মুখের ভাষা, আর কাজের ভাষা আলাদা। দিবাকরকে ছেড়ে আমি ঘরে যাই। নোটবই খুলে প্রবন্ধ লিখতে বসি। সঞ্চিত ডেটা অ্যানালাইজ করে দেখি, আরে, মা-জননীর ঘোষিত মতামতের সঙ্গে স্বরূপের কর্মকাণ্ডের বা সুদীপের, কি দিবাকরের বজ্রনির্ঘোষের তো বিশেষ পার্থক্য নেই! কেবল মার স্টেটমেন্টটা পজিটিভ, ওদেরগুলো নেগেটিভ। দু’দলের বক্তব্যই মূলত ‘প্রেম’-বিষয়ে এক—যথা : প্রেম অতি মূল্যবান, সূক্ষ্ম, দুরূহ, মহার্ঘ, সুকুমার, দুষ্প্রাপ্য। প্রেমকে হতে হবে নিঃস্বার্থ, নিষ্কারণ। প্রেম প্রয়োজনের চাপে বাঁচে না। প্রেম মূলহারা ফুল, ভাসে জলের ‘পরে। হাতের রা ধরতে গেলে ঢেউ দিয়ে তায় দিই যে ঠেলে, ধরা দেবার ধন সে তো নয়—অধরা মাধুরী। মোটামুটি বিভিন্ন বিপরীত অ্যাঙ্গেল থেকে এই কথাই বলা হয়েছে। প্রেম অধরা মাধুরী।

মা বলছেন প্রেমকে বাঁচাতে হলে বিয়ে কোরো না। এরাও আরেকভাবে সেটাই বলছে। এদের বক্তব্য : এই অতিবাস্তব অতিস্বার্থ সংঘাতময় জীবনে প্রেমকে ধরা যাবে না। ধরতে যেও না। মানুষ বেঁটে হয়ে গেছে। প্রেম জিনিসটা আর আজকের পার্থিব মানুষের হৃদয়ের নাগালে নেই। যেমন বুকের মধ্যে ভগবানের নাগাল না পেলেই লোকে বলতে থাকে ভগবানে বিশ্বাস করি না। অথচ যন্ত্রণা, অপমান, পরাজয়ের মুহূর্তে হাত বাড়িয়ে দৈবের নাগাল পেতে চায় অবিশ্বাসীও। এরাও তেমনি। তাহলে খুব কি একটা ফারাক হয়েছে? বদল হয়েছে প্রেমের তত্ত্বে? বোধ হয় না। তত্ত্বটা একই আছে। তফাত হয়েছে প্রযুক্তিতে। প্র্যাকটিসটা বদলে যাচ্ছে। আমাদের প্রজন্ম আকছার প্রেমে-পড়ত। ‘প্রেম করত’ কম। এরা প্রেম করে, প্রেমে ‘পড়ে’ না। ‘প্রেম’-কে ভয় পায়। দায়িত্বকে ভয় পায়। হালকা হয়ে বাঁচতে চায়। এমন সময়ে একটা ফোন এলো।

এই ফোন, আর কলিং বেল। কলম ধরেছি-কি-ধরিনি, অমনি দু’দিক থেকে এই সাঁড়াশি আক্রমণ শুরু হয়ে যায়। আর যেদিন বোর হয়ে একা একা ঘরে বসে থাকি, সেদিন দুটোই নিস্তব্ধ! উঠে গিয়ে ফোন ধরি।—

“হ্যালো, আণ্টি? এনি নিউজ অব টুম্পা?”

এই তো। সেধে এসে জালে ধরা দিয়েছে। আরো একধাপ নিচের প্রজন্ম, আমার ছোটো মেয়ের বন্ধু। রিমঝিমের সঙ্গে পড়ে। ছোটো মেয়ে কলকাতার বাইরে পড়ছে। আমি খপ করে ধরি—

“হ্যালো, গীতু? তুই প্রেম বিষয়ে কী ভাবছিস?”

“হোয়াট? আর ইউ সিরিয়াস?”

“ভীষণ। প্রেম বিষয়ে তুমি কিছু ভাবছো কি?”

“প্রেম বিষয়ে কী ভাবছি? ডিড ইউ সে দ্যাট?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ। প্রেমে বিশ্বাস করিস? না করিস না?”

“ও শিওর। আন্টি! হু ডাজন্ট্?”

“সাম সে দে ডোন্ট।”

“দে ওনলি সে সো। ইভন দে ডু।” বলল গীতু সিং। এখনও কুড়ি হয়নি ওদের। “ইউ ডোন্ট বিলীভ দেম, ডু ইউ, আন্টি? জগতে কেউ নেই যে সত্যি সত্যি প্রেমে বিশ্বাস করে না। নো ম্যাটার হোয়াট দে সে?”।

“বলছিস তুই?”

“নিশ্চয়। পৃথিবীতে প্রত্যেকে প্রেমে বিশ্বাস করে। ডোন্ট ইউ?”

“আমি তো করিই।”

“তবে? তুমিই বরং নাও করতে পারতে। তোমার তো, এক্সকিউজ মাই সেইং দিস, কিন্তু তোমার পার্সোনাল এক্সপিরিয়েন্সটা তো প্রেমের খুব ভালো হয়নি, উইথ আংকল রানিং অ্যাওয়ে উইথ অ্যানাদার লেডি? স্টিল তুমিও যদি প্রেমে বিশ্বাস করো, অন্যেরা কেন করবে না? দোজ হু সে ডোন্ট, লাই। খবরদার বিশ্বাস কোরো না। ইটস ফ্যাশনেবল টু সে দ্যাট। বুলশিট!”

“ল্যাংগুয়েজ, ল্যাংগুয়েজ!”

“হোয়াট, ল্যাংগুয়েজ? যত মিথ্যেবাদী, ওদের কথা কানে তুলো না। তুমিও যেমন!”

“তাহলে তুই বলছিস যারা বলে প্রেমে বিশ্বাসী নয় তারাও আসলে বিশ্বাস করে?”

“অফ কোর্স! দে আর ওনলি ওয়েটিং ফর ইট টু হ্যাপেন টু দেম! লুক, আন্টি! সবার জীবনে তো প্রেম আসে না? ইটস আ রেয়ার ইভেন্ট। তাই না? আ মেনি স্‌প্লেনডারড থিং। তুমিই বলো? ইউ আর দা পোয়েট!”

“আর তুই মনে হচ্ছে প্রেমে পড়েছিস?”

“কে বললো?”

“কে আবার বলবে? তুইই বলছিস! তোর কথাবার্তা!”

“ওয়েল? ইউ মে বি রাইট!” সলজ্জ মৃদু হাস্যের ঝংকার শোনা যায়।

“ছেলেটা ভালো তো?”

“আই থিংক সো।”

“প্রেমে বিশ্বাস-টিশ্বাস করে তো?”

“হোয়াট ননসেন্স—তখন থেকে বলছি সব্বাই করে, এভ্রিওয়ান, তোমাকে মুখে যে যাই বলুক, মনে মনে সক্কলেই প্রেমে বিশ্বাস করে আন্টি। কে-না-কে তোমাকে এসে গ্রেপ্স আর সাওয়ারের গল্প বলে দিল, আর তুমিও সেটা দিব্যি শুনে নিলে! ওসব গুল্ খেতে নেই। খেতে নেই! ইউ পিপ্‌ল আর অ্যাবসার্ডলি গালিব্‌ল! সত্যি তোমরা বাবা-মায়েরা না,—অ্যাতো সিম্প্ল!”।

“আমরা সিম্প্ল, গালিব্‌ল, আর তোরা পাকা বুড়ি?”

“কোয়াইট। লোকের মুখের কথায় কক্ষনো বিশ্বাস করবে না। কাজটা দেখবে। ট্রাস্ট ইওর কমন সেন্স, নট ইওর ইয়ার্স, যত সব আঁতলামির কথা! কে? কে বলেছে? শুনি? নামটা বলো তো? দেখিয়ে দেবো মজা।”

গীতুর মুখখানা খুবই মিষ্টি, কিন্তু স্পষ্টবাদী। লড়াকু স্বভাব। একহাত লড়ে নিতে পারবে। সুদীপ, প্রতিম, দিবাকর, পিকো, কাউকেই তোয়াক্কা করবে না। কাউকে রেয়াত করবে না। যা গুণ্ডা মেয়ে গীতু! হঠাৎ একটা কথা বিদ্যুচ্চমকের মতো আমার মাথায় খেলে গেল।

“আচ্ছা, গীতু, তোর কি একটা বেগুনি রঙের সোয়েটার আছে?”

“বেগুনি? মভ্‌ আছে। একটু লাইট বেগুনির মতই। কেন?”

“ও কিছু না। হঠাৎ এমনি মনে হলো।”

এমন সময়ে নিচে আবার রিং হলো। পিকো খোঁচা মারলো, “ওই নাও, ফোন ছাড়ো, হয়তো আবার তোমার কোনো শিকার এসে গেছে। যাও ঝাঁপিয়ে পড়ো।”

সত্যিই একটি সুদর্শন তরুণ সরল বিশ্বাসে ওপরে উঠে এলো। একে আগে কখনও দেখিনি। লিট্ল ম্যাগাজিন, না পিকোর বন্ধু, ভাবছি, হঠাৎ পিকো চেঁচিয়ে ওঠে–

“শৈবালদা! শৈবালদা! মা ফোন ছাড়বার আগেই চটপট ওপরে পালিয়ে এসো, আমার মায়ের পাল্লায় পড়ে যেও না যেন? মা তোমাকে দেখলেই প্রেমের কথা বলতে শুরু করে দেবেন কিন্তু…মার দারুণ প্রেমরোগ হয়েছে।”

অপরিচিত তরুণের চোখের সেই উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি আমি জীবনে কোনোদিন ভুলতে পারবো না।

১৩৯৫(১৯৮৮)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *