2 of 3

ভালোবাসার দিনগুলি

ভালোবাসার দিনগুলি

২৪ মার্চ, ১৯৮৫

আজ রাঙাদাদু এসেছিলেন। ইস, মানুষটা কী বুড়োই হয়েই গেছেন। হঠাৎ একেবারে ফোকলা, ওপরের পাটিতে মাত্র দুটো দাঁত। আগেও মাথার চুল ধপধপে সাদা ছিল, কিন্তু এক মাথা সাদা চুল, এখন আর চুল নেই-ই বলতে গেলে! চার-পাঁচ বছর আগেও রাঙাদাদুকে কী ভালোই বাসতুম। উনি এ-বাড়িতে এলেই সবসময় আমি বসে থাকতুম ওঁর পাশ ঘেঁষে। সবাই ঠাট্টা করত। পিংকি মাসি বলত, মিলি, তুই কি তোর রাঙাদাদুকে বিয়ে করবি নাকি?

আমি বলতুম, হ্যাঁ, বিয়ে করবই তো!

রাঙাদাদু আমায় জড়িয়ে ধরে বলতেন, এইটা হবে আমার রাঙা বউ!

রাঙাদাদু কী একটা জরদা খেতেন, কী সুন্দর গন্ধ বেরুত ওঁর মুখ দিয়ে। আর কত মজার-মজার গল্প বলতেন।

একটা গল্প মনে আছে। উনি একবার দক্ষিণেশ্বর থেকে নৌকোয় চেপে আসবার সময় নৌকোটা ভুস করে ডুবে গেল। রাঙাদাদু সাঁতার জানেন না। তাই শুনে সবাই জিগ্যেস করল, তারপর কী হল? রাঙাদাদু বললেন, আর কী হবে, আমি ডুবে গেলুম! সবাই আবার জিগ্যেস করল তারপর? তারপর? রাঙাদাদু বললেন, জলে ডুবে গেলে কী হয়? মানুষ মরে যায়। আমিও মরে গেলুম! আমি সত্যি-সত্যি সে কথা বিশ্বাস করে কেঁদে ফেলতে যাচ্ছিলুম, আমার ছোটমাসি বলল, বাঃ, এই যে আপনি বসে আছেন, তা হলে কি আপনি ভূত নাকি? রাঙাদাদু বললেন, ভূত কি না আমায় ছুঁয়ে দেখো! ছোটমাসি যে-ই হাত বাড়িয়ে ছুঁতে এল, আমি সেই হাতটা ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বললুম, না, না, আমি ছুঁয়ে দেখব। আমি দেখব! রাঙাদাদু হাসতে-হাসতে আমার মাথাটা বুকে টেনে নিয়ে বললেন, না রে, আমি সত্যি-সত্যি মরিনি। জলে ডুবে গেলুম ঠিকই, তারপর ভেসে উঠলুম কাশীতে! সেখানে একজন সাধু আমার চোখে ফুঁ দিতেই জ্ঞান ফিরে এল।

রাঙাদাদু আমার মায়ের মামা। ডায়মন্ড হারবার থেকে মাঝে-মাঝে বেড়াতে আসেন আমাদের বাড়িতে। এক সপ্তাহ না এলেই ছটফট করতুম আমি। মাকে বারবার জিগ্যেস করতুম, কবে আসবেন, রাঙাদাদু কবে আসবেন?

এর মধ্যে বাবা ট্রান্সফার হয়ে গেলেন বলে আমরা সবাই চলে গেলুম ডাল্টনগঞ্জ। সেই সময়টা আর রাঙাদাদুর সঙ্গে দেখা হয়নি। আমার খুব কষ্ট হত। কলকাতায় আমার কত বন্ধু, কিন্তু সবচেয়ে বেশি কষ্ট হত রাঙাদাদুর জন্য। এক বছরে মানুষ এত বদলে যায়! মাঝখানে রাঙাদাদুর নাকি কী অসুখ হয়েছিল। শুধু চেহারা খারাপ হয়ে যায়নি, গলার আওয়াজটাও কেমন যেন খোলা-খোলা হয়ে গেছে।

আমাকে ডেকে পাশে বসালেন। মার আর ভালো লাগল না। ওর মুখে সেই মিষ্টি গন্ধটাও নেই, গায়ে বিচ্ছিরি ঘামের গন্ধ। সুদীপ একবার আমাকে ডাকল, আমি উঠতে যেতেই রাঙাদাদু বললেন, রাঙাগিন্নি, কোথায় যাচ্ছ? বসো-বসো।

আজ রাঙাগিন্নি ডাকটা আমার মোটেও পছন্দ হল না। সত্যি-সত্যি ওরকম বুড়ো লোককে কেউ বিয়ে করে নাকি?

রাঙাদাদু আমায় জড়িয়ে ধরলেন, আমি ছটফটিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সুদীপের সঙ্গে চলে গেলুম বারান্দায়। সুদীপ জিগ্যেস করল, এই মিষ্টি, ওই বুড়ো লোকটা তোকে জড়িয়ে ধরে কেন

রে?

এতদিন আমি নিজেই রাঙাদাদুর গা ঘেঁষে বসেছি। আজ হঠাৎ মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, বাজে লোক!

১৬ জুন ১৯৮৫

মাধ্যমিকে সুদীপ প্রথম দশ জনের মধ্যে এসেছে।

সুদীপ পড়াশুনোয় এত ভালো, এ জন্য কেউ অবাক হয়নি। সুদীপের মা বললেন, ওর ফার্স্ট হওয়া উচিত ছিল।

ছোটমাসি সুদীপের মাকে বলল, অরুণাদি, তোমার ছেলে এত ভালো রেজাল্ট করেছে, একদিন খাওয়াও সবাইকে।

অরুণা মাসি ঠোঁট উলটে বললেন, ভালো রেজাল্ট আবার কী! অন্তত ফাস্ট-সেকেন্ড হলেও কথা ছিল। মা বললেন, অরুণা, তোর মোটেই এরকম কথা বলা উচিত না! এবারে যে ফার্স্ট হয়েছে, তাকেও তো আমরা চিনি। অঞ্জনার ছেলে দীপঙ্কর! দীপঙ্করের সঙ্গে সুদীপের কোনও তুলনা হয়? সুদীপ ব্যাডমিন্টনে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। ইস্কুলের যে নাটক হল, তাতে কী দারুণ পার্ট করেছে। সুদীপ। স্কুল ডিবেটেও ফাস্ট। ওর সঙ্গে দীপঙ্করের তুলনা হয়? দীপঙ্কর তো লেখাপড়া ছাড়া আর কিছুই জানে না। আর সুদীপ যে এত কিছু করেও স্ট্যান্ড করেছে, ওর কৃতিত্বই বেশি।

মা তো ঠিক বলেছেন। সুদীপের সঙ্গে কারুর তুলনা হয় না।

২৭ নভেম্বর ১৯৮৫

আমি, অঞ্জনা আর মণিদীপা আজ স্বভূমিতে একটা গানের জলসা শুনতে গিয়েছিলুম। এমনিতে তো শুধু আমাদের তিনজনকে যেতে দিত না, সুদীপ আমাদের সঙ্গে যেতে রাজি হল বলেই আমরা পারমিশন পেলুম।

সুদীপ প্রথমেই বলল, ট্যাক্সি করে নিয়ে যেতে পারব না। বাসে চেপে যেতে হবে কিন্তু।

আমরা তাতেই রাজি। বাসে বেশ ভিড়। আমরা তিনজন তবু বসার জায়গা পেয়ে গেলুম, সুদীপকে আগাগোড়া দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়েই যেতে হল। বাসে আরও কত লোক, তাদের সকলের চেয়েই সুদীপ যেন আলাদা। কীরকম সোজা হয়ে দাঁড়ায়। চুল আঁচড়ায় না ভালো করে, জামার বোতাম লাগায় না, তবু সুদীপকে সবকিছু মানায়।

বাস থেকে নেমে সুদীপ বলল, আমার কাছাকাছি থাকবে সবাই। কেউ হারিয়ে গেলে কিন্তু আমি খুঁজতে পারব না। সে নিজের দায়িত্বে বাড়ি ফিরবে। অঞ্জনা বলল, আহা, আমরা কি কচি খুকি নাকি? হারিয়ে গেলে বাসে উঠে বাড়ি চলে যাব।

মণিদীপা বলল, একা-একা তো যেতেই পারি। তবে একা বাড়ি ফিরলে মা যে কতরকম প্রশ্ন করবে। উফ, ভাবলেই বিচ্ছিরি লাগে!

সুদীপ হাসতে-হাসতে আমার থুতনিটা ছুঁয়ে দিয়ে বলল, এই মিন্টিটা তো সত্যিই এখনও ছোট। ওকে আমার হাত ধরে থাকতে হবে।

সুদীপ কেন এই কথা বলল, আমি জানি। ছোট বলে নয়, সুদীপ আমাকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। আর অঞ্জনাকে তবু কিছুটা পছন্দ করলেও মণিদীপাকে দেখতে পারে না। মণিদীপার সঙ্গে সব সময় ওর ঝগড়া হয়।

সুদীপ ওপরে এসে ঢোকার মুখেই আমাদের আইসক্রিম কিনে খাওয়াল। দোকানটার সামনে বেশ ভিড়, আমরা তিনজন দাঁড়িয়ে রইলুম একটু দূরে। সুদীপ এক সঙ্গে সবকটা আইসক্রিম নিয়ে এল। প্রথমটা দিল কাকে? অঞ্জনা নিজে থেকেই হাত বাড়িয়ে ছিল, তবু সুদীপ তাকে পাত্তা না দিয়ে প্রথমে আমাকেই তো দিল!

ফেরার পথে সুদীপ সবসময় আমার হাত নিজের মুঠোয় রেখে দিল।

এ মা, আমি কী করে ফেলেছি! ডায়েরি লিখতে গিয়ে অন্যমনস্কভাবে একটা পুরো পাতায় শুধু লিখে গেছি সুদীপ, সুদীপ, সুদীপ!

মা দেখলে কী বলবে। অবশ্য, আমার এই ডায়েরি কেউ দেখবে না। এমন লুকিয়ে রাখব। এটা আমার গোপন, গোপন, গোপন!

৬ অক্টোবর ১৯৮৭

গত এক মাস ধরে আমার দিনগুলো ফুরফুরে প্রজাপতির মতন কেটে যাচ্ছে। সুদীপ রোজ সন্ধেবেলা আমার পড়াশুনো দেখিয়ে দিতে আসে। রীতিমতন মাইনে দিয়ে তাকে রাখা হয়েছে।

সুদীপ আসে ঠিক সাড়ে ছটায়, সাড়ে আটটা পর্যন্ত থাকে। প্রত্যেকটা সাবজেক্ট বুঝিয়ে দেয় কী চমৎকারভাবে। আমি কোনওদিন ফার্স্ট হইনি, এবার বোধহয় আটকানো যাবে না আমাকে। কতজন যে হিংসে করবে।

সুদীপের আঙুলগুলো কী লম্বা-লম্বা। ফরসা মুখখানায় একটু-একটু গোঁফ উঠেছে। টানা টানা চোখ। কিছুতেই জামায় বুকের বোতাম আটকাবে না।

বারবার ওর বুকের দিকে আমার চোখ চলে যায়। ইচ্ছে করে ওর পুরো বুকটা দেখতে। পড়তে-পড়তে আমি অন্যমনস্ক হয়ে যাই। সুদীপ কিন্তু আমার দিকে বিশেষ তাকায় না। পড়ার সময় অন্য দিকে মন দেয় না।

মাঝে-মাঝে আমি ইচ্ছে করে ওর আঙুল ছুঁয়ে দিই।

৭ জানুয়ারি ১৯৮৮

আজ আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ দিন। হে ডায়েরি, তোমাকেও সব কথা বলা যাবে না।

৯ মার্চ ১৯৮৮

মা-বাবা বহরমপুরে গেল, আমার কিছুতেই যেতে ইচ্ছে করল না। এমনিতে আমার গাড়িতে দূরে কোথাও যেতে ভালো লাগে, আর ছোটমাসিদের বাড়িটাও ভালো, ছাদ থেকে গঙ্গা দেখা যায়, কিন্তু হঠাৎ এত গরম পড়েছে যে এখন আর কোথাও যেতেই ইচ্ছে করে না। বড্ড গরম! আমাদের গাড়ি তো এ সি নয়, জানলা বন্ধ রাখলেও খুব গরম, আর খোলা রাখলেও গরম হাওয়ায় খুব কষ্ট হয়।

মা বকুনি দিলেন সারাদিন ধরে। কিছুতেই আমাকে রেখে যেতে রাজি নন। আমি নাকি একা। থাকতে পারব না। আমি কি এখন কুচি খুকি নাকি যে একা থাকতে পারব না? আবার মা বলছে, ও বড় হয়ে যাওয়াটাই নাকি আমার দোষ! তা ছাড়া, একা কোথায়, শান্তিপিসি তো থাকছেই। রঘু থাকছে।

মা যত বকুনি দেয়, আমার ততই জেদ বাড়ে। যাব না, যাব না, কিছুতেই যাব না।

শেষ পর্যন্ত আমারই জয় হল।

মা-বাবাকে নিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিল সকাল সাড়ে নটায়। তার এক ঘণ্টা পরেই শুরু হল ঝড়, তারপর অনেকক্ষণ বৃষ্টি। গরম কমে গেল অনেকখানি। এই রকম দিনে গাড়িতে বেড়াতে যাওয়া সত্যিই আরামের। রাস্তা এখন ভালো হয়ে গেছে, চার ঘণ্টায় পৌঁছে যাওয়া যায়। একটু-একটু আফসোস হতে লাগল, আবার কবে বহরমপুরে যাব কে জানে।

কিন্তু আমি কি গরমের ভয়েই যেতে চাইনি? সত্যি কথা বলো তো? সন্ধেবেলা সুদীপ আসবে। বহরমপুর গেলে তিনদিন সুদীপের সঙ্গে দেখা হবে না। পড়াশুনোর কত ক্ষতি হবে!

বিকেলে যে-ই ছটা বেজে যায়, তারপর থেকেই একটা ছটফটানি শুরু হয়ে যায়। সুদীপ সাধারণত দেরি করে না। কিন্তু আজই এল সাতটা বাজিয়ে। সঙ্গে আবার একজন বন্ধু।

আমাদের একতলার বসবার ঘরটা পড়বার ঘর। আবার কোনও-কোনওদিন বাবার বন্ধুরা এসে পড়লে তিনতলায় আমার শোওয়ার ঘরেও চলে যেতে হয়। আজ বাবার বন্ধুরা কেউ আসবে না,

তবু তিনতলায় ঘরটা ঠিক ঠাক করে রেখেছিলাম। বেশ নিরিবিলিতে পড়াশুনো হবে। শান্তিপিসি তো সারা সন্ধে দোতলার ঘরে বসে টিভিতে পরপর সিরিয়াল দেখে। আর রঘুকে না ডাকলে তেতলায় আসবে না। এমনিতেই ডেকে-ডেকে পাওয়া যায় না।

আজই সুদীপ সঙ্গে একজন বন্ধুকে নিয়ে এল?

বসবার ঘরে এসে সুদীপ বলল, মিন্টি, আগে আমাদের দু-কাপ চা খাওয়াও তো! আমার এই বন্ধুর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিচ্ছি, এর নাম জীবনময় সেন, খুব ভালো কবি।

লোকটিকে দেখে প্রথমেই আমার অপছন্দ হল। কবি হোন আর যাই-ই হোন, দেখতে কেমন যেন অদ্ভুত! মুখে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি। তেমন লম্বা নয়, অথচ বেশ ভুঁড়ি আছে। তা ছাড়া, এই লোক। সুদীপের বন্ধু কী করে, ওর থেকে অন্তত দশ বছরের বড় বলেই তো মনে হয়।

জীবনময়বাবু প্রথমেই আমাকে দুম করে জিগ্যেস করলেন, তুমি গান গাইতে পারো?

আমি গান গাইতে পারি কি না পারি, তা একজন অচেনা বাইরের লোককে জানাতে যাব কেন? আমি বললুম, না, গান জানি না।

তিনি বললেন, কিন্তু তোমার দুচোখে গানের সুর আছে। এখনও চর্চা করলে গাইতে পারবে।

চোখে আবার গানের সুর থাকে নাকি? কী সব অদ্ভুত কথা! এসব আমার ভালো লাগে না।

জীবনময় ঘুরে ঘুরে আলমারির বইগুলো দেখতে লাগলেন।

সুদীপ চা খেতে খেতে জিগ্যেস করল, বাড়িতে আর কেউ নেই? কীরকম ফাঁকা-ফাঁকা লাগছে।

বাবা-মায়ের বহরমপুর যাওয়ার কথা জানিয়ে আমি ওর দিকে চোখের ইঙ্গিত করলুম। মানে, এই লোকটাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছ কেন?

সুদীপ আমার সে ইঙ্গিত বুঝল না।

একটু বাদে বলল, মিষ্টি, কিছু মনে কোরো না, আজ আর পড়ানো হবে না। আমার একটা কাজ পড়ে গেছে। লক্ষ্মীটি, আজ নিজে নিজে পড়ে নাও।

আমার বুকটা ধড়াস করে উঠল। বলে কী আজই ও চলে যেতে চায়? আমি এত আশা করে বসে আছি, আমার মুখ দেখে কিছুই বুঝতে পারল না?

একটাও কথা বললুম না, সুদীপ সত্যিই চলে গেল। শুধু একবার হাত রাখল আমার কাঁধে। আর ওই জীবনময় লোকটা এমন অভদ্র, যাওয়ার সময় কিছুই বলল না আমাকে। তারপর সারা সন্ধে…।

১০ মার্চ ১৯৮৮

আজ আবার বৃষ্টি নামল সন্ধেবেলা। বহরমপুরেও কি বৃষ্টি পড়ছে?

সুদীপ এল আধঘণ্টা দেরি করে। আমি আর নীচে নামিইনি, বসেছিলাম তিনতলার ঘরে। রঘু ওকে পৌঁছে দিয়ে গেল।

ঘরে ঢোকামাত্র আমি ছুটে গিয়ে…।

সুদীপও আমার…।

কীরকম যেন একটা গন্ধ পেলুম ওর মুখে। একবার গা গুলিয়ে উঠল। কিন্তু সারা শরীর এমন কাঁপছিল যে সেটা মনে রইল না।

সুদীপ আদর করলে প্রথম কিছুক্ষণ আমি কথাই বলতে পারি না।

তারপর টেবিলে এসে বসার পর জিগ্যেস করলুম, তুমি কাল চলে গেলে কেন?

সুদীপ বলল, কাল? ও হ্যাঁ, কী যেন, আমার এক বন্ধুর সঙ্গে জরুরি কথা ছিল।

কোন বন্ধু?

ওই যে আমার সঙ্গে এসেছিল। ও কিন্তু খুব নামকরা কবি। তুমি তো কবিতা পড়ো না, তা হলে বুঝতে।

ওই লোকটা অত বয়েস, তোমার বন্ধু হয় কী করে? বন্ধুত্বের সঙ্গে বয়েসের কী সম্পর্ক? আমাদের চিন্তার মিল আছে।

তুমি চলে গেলে…আমার কথা একবারও মনে পড়ল না?

তোমার কথাই তো সর্বক্ষণ মনে পড়ে, মিন্টি!

আবার আমি ওর মুখ থেকে একটা বাজে গন্ধ পেলুম।

এটা কিসের গন্ধ!

নাঃ, আর লিখতে ইচ্ছে করছে না।

২২ মার্চ ১৯৮৮

সুদীপ এখন এলাচ মুখে দিয়ে আসে। সেটা আরও বিচ্ছিরি লাগে। ওর সেই বাজে বন্ধুটা, জীবনময়, কবি না ছাই, তার পাল্লায় পড়ে সুদীপ মদ খেতে শিখেছে। এর মধ্যে তিন দিন আসেনি। মণিদীপা বলল, এরমধ্যে একদিন ও গ্লোব সিনেমায় ইভনিং শো-তে সুদীপকে মদ খেয়ে হল্লা করতে দেখেছে। মণিদীপা কার সঙ্গে সিনেমায় গিয়েছিল, তা অবশ্য বলল না।

অঞ্জনা আবার একটা অদ্ভুত কথা বলল। মণিদীপার সঙ্গে সুদীপের নাকি প্রায়ই দেখা হয়। অথচ বাইরে এমন ভাব দেখায়, যেন ওদের দুজনের খুব ঝগড়া।

আমি সুদীপের সঙ্গে একলা কোথাও বেড়াতে যেতে পারি না। আমাদের বাড়িতে সেরকম পারমিশন নেই। মা-বাবার সঙ্গে লুকোচুরি করতেও আমার ইচ্ছে করে না।

সুদীপও তো লুকিয়ে আমার সঙ্গে কোথাও দেখা করার কথা বলেনি। বাড়িতে পড়াবার সময় সুযোগ পেলেই…। কিন্তু এখন আর কাছে যেতে ইচ্ছে করে না।

২৮ জুন ১৯৯২

আমরা মাঝে-মাঝে যে শারীরিক আনন্দ পাই, তা মোটেই নিছক শারীরিক নয়। কেউ একটু হাত ছুঁলেই শিরশিরানি হয়, আবার অন্য কেউ সেই হাতটা স্পর্শ করলেই হাতটা সরিয়ে নিতে ইচ্ছে হয়।

আমরা একই মানুষ, দুবছর আগে যার স্পর্শে কেঁপে উঠতাম, এখন তাকে দেখলেই মনটা ঘিনঘিন করে। রাঙাদাদুর ব্যাপারটা অন্য রকম। ওঁর সঙ্গে তো নারী-পুরুষের সম্পর্ক ছিল না। তখন আমি কত ছোট, শরীরের অনুভূতিই ছিল না। আমি বড় হয়ে উঠতে-না-উঠতেই রাঙাদাদু বড্ড বেশি বুড়ো হয়ে গেলেন। আহা, মরেও গেলেন এর মধ্যে।

কিন্তু যে সুদীপকে আমি ভালোবেসেছিলুম, যে প্রথম পুরুষ হিসেবে আমার রক্তে উন্মাদনা জাগিয়েছিল, সেই সুদীপকেই যখন জানতে পারলুম, শুধু মদের নেশাই তাকে ধরেনি, সে হয়ে উঠেছে প্রচণ্ড মিথ্যেবাদী, আর একই সঙ্গে অনেক মেয়ের সঙ্গে…।

যে সুদীপের ছোঁয়ার জন্য আমি ব্যাকুল হয়ে থাকতুম, সেই সুদীপই একদিন আমাকে জড়িয়ে ধরতে আসতেই ওর গায়ে থুতু দিয়েছি। মণিদীপার সঙ্গে সুদীপকে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় আমি নিজে দেখেছি। অন্য কারুর কথা শুনে নয়, নিজের চোখকে তো অবিশ্বাস করা যায় না।

সুদীপকে আর কোনওদিন আমি দেখতেও চাই না।

সেদিন কী কান্না কেঁদেছি! কেন কেঁদেছি, সুদীপ তা কোনওদিন বুঝতে পারবে না। আমি ছেলেমানুষি মন নিয়ে সুদীপকে আমার জীবনের একমাত্র পুরুষ হিসেবে ধরে নিয়েছিলুম। আর কারুকে আমার দরকার নেই। সুদীপ তার মর্যাদা রাখল না।

সুদীপের সঙ্গে আর দেখা হয়নি, তবু তার খবর না রেখে পারিনি। পড়াশুনোয় অত ভালো ছিল, কিন্তু নিজেকে একেবারে নষ্ট করে ফেলল। এম-এ-তে রেজাল্ট বেশ খারাপ। শেষপর্যন্ত ডরু বি সি এস পরীক্ষা দিয়ে কোনওক্রমে ছোটখাটো একজন অফিসার হয়েছে। মণিদীপার সঙ্গে ডিভোর্স হয়ে গেল বিয়ের এক বছরের মধ্যে। এখন থাকে জলপাইগুড়ি।

প্রথম যেদিন সুদীপ আমাকে আদর করেছিল, তার সেদিনের মুখচ্ছবিটা আমার মনের মধ্যে বাঁধানো থাকবে। সে যে আমার জীবনের প্রথম পুরুষ। তার পরের দিককার চেহারাটাই অস্পষ্ট হয়ে গেছে।

আমি জীবনময়কে জিগ্যেস করেছিলুম, আপনি সুদীপকে মদ ধরালেন, ও নষ্ট হয়ে গেল, কিন্তু আপনি নিজে তো কখনও বেচাল হন না।

জীবনময় বললেন, নন্দিনী, আমি হচ্ছি শয়তান, মানুষকে ধ্বংস করাই আমার কাজ। শয়তান নিজে কি কখনও ধ্বংস হয়?

এই কথা বলার সময় জীবনময় ভুরু অনেকটা তুলে, চোখ পাকিয়ে, ঠোঁট বেঁকিয়ে মুখটা যতদূর সম্ভব বিকৃত করে শয়তান সাজবার চেষ্টা করলেন। তা দেখে আমি হেসে বাঁচি না।

জীবনময় মাঝে-মাঝেই শয়তান সাজবার চেষ্টা করেন। একদিন কোথা থেকে এলেন মাথা ফাটিয়ে, মস্ত একটা ব্যান্ডেজ বাঁধা। দেখেই আমার বুকটা ধক করে উঠল।

উনি সগর্বে বললেন, আজ কী হয়েছে জানো?

ন্যাশনাল লাইব্রেরির মাঠে আজ সকালে দেবদূত গেব্রিয়েলের সঙ্গে আমার দ্বন্দ্ব যুদ্ধের অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল। আমার মাথায় সামান্য চোট লেগেছে, কিন্তু আমি ওকে এমন ঠেঙিয়েছি যে পালাবার পথ পায় না। এখন স্বর্গের হাসপাতালে শুয়ে আছে, আর এদিকে আসবার সাহস করবে না।

জীবনময় সব সময় যেন একটা অন্য জগতে থাকেন। এই রকম কথাই বলেন। এখন আর আমি। অবাক হই না।

আমি বললুম, গ্রেবিয়েল তো ক্রিশ্চানদের দেবদূত।

সে তোমার সঙ্গে লড়াই করতে আসবে কেন?

জীবনময় বললেন, তোমাদের হিন্দুশাস্ত্রে কোনও দেবদূত আছে নাকি? যমদূত আছে। হিন্দুশাস্ত্রে তো শয়তানও নেই!

মৃত্যুর দেবতা আছে। যমরাজ।

যমরাজ আর শয়তান তো এক নয়। যম কখনও অন্যায় করেন না, সময় না ফুরোলে কারুর। কাছে আসেন না। সেই জন্যই তাঁর আর এক নাম ধর্মরাজ। এই পৃথিবীতে যত পুঞ্জীভূত অন্যায়, তার প্রভু হচ্ছে শয়তান। এখন তো তারই রাজত্ব চলছে!

আসলে পা পিছলে পড়ে গিয়ে মাথা ফাটিয়েছেন, তাই না?

নন্দিনী, আমার কখনও পদলন হয় না। মদ খেলে আমার পা টলে না। দেবতাদের রাজা ইন্দ্র একজন খুব নাম করা মাতাল জানো তো? বেদে এক জায়গায় ইন্দ্রগর্ব করে বলেছেন, উনি। তিরিশটা হ্রদ ভরতি সোমরস পান করতে পারেন। আমি একদিন ইন্দ্রকে বললুম, কমপিটিশান হয়ে যাক। এ-যুগের সোমরস হচ্ছে প্রিমিয়াম স্কচ। এক লিটার ব্ল্যাক লেবেল একজন এনে দিয়েছিল বিদেশ থেকে, তা নিয়ে দেবরাজ ইন্দ্রের সঙ্গে হল আমার আসর পানের প্রতিযোগিতা। ওমা, একেবারে পেঁচি মাতাল। বলে কিনা জল মিশিয়ে খাবে! ব্ল্যাক লেবেলে কেউ জল মেশায়? আমি বললুম, ওসব চলবে না। স্ট্রেট পান করতে পারো তো চলে এসো। ব্যাস। তিন পেগ শেষ করতে-না-করতেই অজ্ঞান। বেদে বড়-বড় বাণী ঝেড়েছে!

ইন্দ্রের সঙ্গে কমপিটিশানটা কোথায় হল? স্বর্গে?

না, না, স্বর্গ ফর্গ আমার সহ্য হয় না। উর্বশী নামে একটা থুরথুরে বুড়ি বড় জ্বালাতন করে।

আমরা বসেছিলুম ডায়মন্ডহারবারের এক বাগানবাড়ির ছাদে।

বুঝেছি, ইন্দ্র মানে ইন্দ্রজিৎ সরকার। তার বাগান বাড়ির কথা অনেক শুনেছি। একদিন আমায় নিয়ে যাবেন না?

নন্দিনী, যেসব পুরুষ মানুষ প্রেম করার নামে মেয়েদের ভুলিয়ে ভালিয়ে বাগান বাড়ি কিংবা গেস্ট হাউস কিংবা রিসর্টে নিয়ে যায়, আমাকে সেই দলে ফেলো না। আমার বুকে প্রেমও নেই, আর মেয়েদের ঠকাবার বাসনাও নেই।

৮ সেপ্টেম্বর ১৯৯৩

মাকে বলে দিয়েছি, আমার ওপর জোর করে কোনও লাভ নেই। আমি যে কোনওদিন বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে পারি। জীবনময়কে আমি বিয়ে করব কি করব না, তা পরে ভেবে দেখব। এখনও সময় হয়নি। তোমাদের আপত্তি থাকলে আমি লেডিজ হস্টেলে গিয়ে থাকব।

কাল হলদিয়া যাওয়ার জন্য একটা ব্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছিলুম, মা দরজার কাছে এসে বলল, তুই জামাকাপড় নিচ্ছিস যে, রাত্তিরে ফিরবি না?

যদি বেশি রাত হয়, তা হলে ফেরা হবে না। কাল সকালে—।

ওখানে থাকবি কোথায়?

গেস্ট হাউস বুক করা আছে।

আর কে-কে আছে?

মা, এটা কী আমাকে জেরা করা হয়ে যাচ্ছে না? আমি যথেষ্ট বড় হয়েছি। আমার কি নিজের ভালো মন্দ বোঝার ক্ষমতা নেই?

মা হঠাৎ আঁচলে চোখ চাপা দিল। কী হল? আমি এমন কি খারাপ কথা বলেছি? কাছে গিয়ে মায়ের পিঠে হাত রাখলুম।

এবারে আমারও চোখে জল এসে গেল। মাকে আমি খুবই ভালোবাসি। কিন্তু সব কথা মাকে আর । এখন বলা যায় না। আমি যে ইচ্ছে করে আঘাত দিতে চাইছি, তা নয়। এই ধরনের জীবন তো মা। কখনও কাটায়নি। তাই বুঝতে পারবে না।

একজন পুরুষের সঙ্গে যদি একদিন আমি কোথাও যাই, এমনকি রাত্তিরে এক সঙ্গে থাকি, তাতে কী এমন দোষ হয়?

হলদিয়াতে জীবনময় একটা অদ্ভুত কাণ্ড করল। কোথায় তার সেই বিদ্রোহী, বেপরোয়া কথাবার্তা তার বদলে হঠাৎ এত দুর্বল, নরম হয়ে গেল।

এর আগেও আমি জীবনময়ের সঙ্গে রাত কাটিয়েছি। কখনও ওর সঙ্গে আমার শারীরিক সম্পর্ক হয়নি। ও একবারও জোর করেনি। বন্ধুর মতন গল্প করেছি। জীবনময় যখন একটু-একটু মদ্যপান করে, তখন ওকে দেখতে আমার বেশি ভালো লাগে। মুখে যতই বারফাট্টাই করুক, ও মোটেই বেশি মদ খায় না, মাতালও হয় না। একটু-একটু নেশার সময় ও বড় সুন্দর কথা বলে, কত বিষয়ে পড়াশুনো করেছে। যখন কবিতা আবৃত্তি করে, তখন মনে হয়, এই পুরুষই তো। আসলে হ্যান্ডস্যাম।

কাল মাত্র দু-পেগ মদ খাওয়ার পর জীবনময় বললেন, নন্দিনী, তুমি আমাকে আপনি-আপনি করো কেন? আজ থেকে তুমি বলবে। আর একটা কথা, আমি টের পাচ্ছি, আমার বুকের ভেতরটাশুকিয়ে আসছে। প্রেম ছাড়া কবিতা লেখা যায় না। তুমি আমাকে রক্ষা করো। এবার থেকে আমরা একসঙ্গে থাকতে চাই। যদি তুমি চাও, আমি বিয়ে করতেও রাজি আছি…।

৮ জুন ১৯৯৮

কতদিন ডায়েরি লিখিনি। এক সাদা খাতা জমে আছে, পুরোনো লেখাগুলো আজ সেখান থেকে পড়ছিলুম। ইস, কী ছেলেমানুষটা না ছিলুম। কী কাঁচা লেখা! এগুলো ছিড়ে ফেলতে হবে।

জীবনময় আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল, তার উত্তরে আমি ঠিক কী বলেছিলুম, মনে নেই, লিখেও রাখিনি।

অদ্ভুত মজার ব্যাপার, তাই না? অমন বিদ্রোহী মানুষটা, যে নিজেকে শয়তানের সঙ্গে তুলনা করত, সে হঠাৎ বিয়ে পাগল হয়ে গেল?

আমি প্রত্যাখ্যান করার এক মাসের মধ্যে ও বিয়ে করে ফেলল অনন্যা নামের একজনকে। এর মধ্যে দুটি সন্তানের পিতা। লিখছেও খুব।

জীবনময়কে আমি বন্ধু হিসেবেই চেয়েছিলুম, স্বামী হিসেবে ওকে মানায় না। অনন্যার মতন শান্ত-শিষ্ট, গৃহিণী ধরনের মেয়েই ওর যোগ্য বউ। আমাকে এখন রিসার্চের কাজ নিয়ে দিল্লি থাকতে হয়।

একাডেমি পুরস্কার নিতে জীবনময় দিল্লি এসেছিল, বেশ কয়েকবছর পর আমার সঙ্গে দেখা। একটা বিকেল দুজনে কাটিয়ে দিলুম লোদি গার্ডেনসে। পুরোনো দিনের মতন গল্প হল। এই তো বেশ। ওর একটা কবিতার কয়েকটা লাইন মুখস্ত বলে ওকে চমকে দিলুম। ওর ধারণা ছিল, আমি কবিতা একেবারেই পড়ি না, বুঝি না।

এখন কবিতা পড়তেই আমি বেশি আনন্দ পাই। জীবনময়ের সঙ্গে বিচ্ছেদের পর থেকেই আমি কবিতার রস নিতে শিখেছি।

বংশধর

একমাত্র সেন্টুদের বাড়িতেই বিনা উপদ্রবে সিগারেট খাওয়া যায়। অন্য অনেক বাড়িতে এমনকী বাচ্চারাও এসে চোখ রাঙায়, মায়েরা বলে, প্লিজ বাইরে গিয়ে খান! মে মাস, তবু বাতাস এখনও কনকনে ঠান্ডা, ঘরের ভেতরকার উষ্ণ আরাম ছেড়ে বাইরে গিয়ে সিগারেট টানার আনন্দটাই মাটি হয়ে যায়।

সেন্টুদের বাড়িতে এই ঝামেলা নেই। বাড়িতে কোনও মহিলা নেই, বাচ্চাকাচ্চা নেই, ওরা দুই ভাই বিয়েই করেনি। বড় ভাই মিন্টুর ঠোঁটে সবসময় সিগারেট ঝোলে।

সেইজন্য প্রত্যেক শনি-রবিবার ওদের বাড়িতেই আড্ডা জমে।

আর-একটা সুবিধে, ওদের বাড়ির কাছে টিউব স্টেশন, বাসেও আসা যায়। গাড়ি পার্ক করার এত ঝামেলা যে নিউইয়র্ক শহরে অনেকেই গাড়ি নিয়ে আসতে চায় না। মিটার পার্মিং-এ খানিকটা সময় অতিরিক্ত হয়ে গেলেই একশো পাঁচ ডলার ফাইন! পুলিশগুলো ঠিক যেন ওঁত পেতে থাকে।

এখন কুইনসে সেন্টুদের বাড়িতেই শুরু হয়েছে নাটকের রিহার্সাল। চরিত্র মাত্র তেরোটি, প্রায় পঁচিশ-তিরিশ জন হাজির হয় সন্ধেবেলা। অভিনয় ছাড়াও নাটকের প্রোডাকশনের ব্যাপারে অনেক লোক লাগে। লাইট, সাউন্ডের দায়িত্ব নিজেদের, এখনকার লোক ভাড়া করতে গেলে প্রচুর খরচ, এমনকি নিজেরাই সেট বানিয়ে ফেলেছে। এদেশে থাকতে-থাকতে অনেকেরই ছুতোর মিস্তিরি, কলের মিস্তিরি, এমনকি ঘাস কাটার কাজও মিলে যায়। সব পুরুষই রান্না করতে পারে। এখানেই প্রায় রোজই বিরিয়ানি কিংবা খিচুড়ি রান্না হচ্ছে। সেন্টুদের বাড়ি এখন হট্টমেলা। রিহার্সাল ছাড়াও খাওয়া-দাওয়ার টানেও আসে অনেকে। পরিচালক রক্তিম রহমান অতি কড়া ধাতের মানুষ। মহড়ার সময় কোনও গোলমাল হলেই সে রেগেমেগে বলে, আই কুইট!

সত্যিই সে দরজার দিকে চলে গেলে তাকে আবার ধরে আনতে হয়।

মাঝে-মাঝেই সে চেঁচিয়ে ওঠে, সাইলেন্স! সাইলেন্স!

একদিন সে চন্দ্রিমাকে এমন বকুনি দিয়েছিল যে কেঁদে ফেলেছিল সে বেচারি। বড়লোকের আদুরে মেয়ে, জীবনে প্রথম বকুনি খাচ্ছে নাটক করতে এসে!

চন্দ্রিমা এখনও এ-দেশের রাস্তায় একা চলা ফেরা করতে পারে না। তবে নিয়ে আসেন বালি সাহেব, আবার ফেরত নিয়ে যান। তিনি ব্রুকলিনে চন্দ্রিমাদের প্রতিবেশি, চন্দ্রিমার বাবাকেও চেনেন অনেক দিন ধরে। রিহার্সালের সময় সর্বক্ষণ তিনি চুপ করে বসে থাকেন একটা চেয়ারে, আর পাইপ টানেন।

এই আলি সাহেবের উপস্থিতি নিয়েও প্রথম-প্রথম আপত্তি তুলেছিল রক্তিম। ভুরু কুঁচকে প্রযোজক গৌতমকে জিগ্যেস করেছিল, হু ইজ দ্যাট গাই? ওকে এখান থেকে হঠাও।

আলি সাহেব চন্দ্রিমার প্রায় অভিভাবক, তা জেনেও রক্তিম বলেছিল, অন্য ঘরে বসতে বল। কাজের সময় একজন নিষ্কর্মা লোককে দেখলে আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।

কিন্তু রক্তিমের এ-দাবি মানা সম্ভব নয়। আলি সাহেব তো নিছক চন্দ্রিমার ড্রাইভার নন, অনেকে তাঁকে চেনে, তিনি একজন বিশেষ সম্মানীয় ব্যক্তি। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজতত্বের অধ্যাপক ছিলেন, অবসর নিয়েছেন দু-বছর আগে। তিনি যেমন সুপুরুষ তেমনই নম্র, শোভন ব্যবহার অনেক ছেলেমেয়েকে গোপনে সাহায্য করেন, তা কেউ-কেউ জানে।

তাঁকে কখনও বলা যায় অন্য ঘরে একা বসে থাকতে? তা ছাড়া তিনি একটি কথাও বলেন না, আপন মনে পাইপ টানেন, মনে হয় রিহার্সালের ব্যাপারটা তিনি বেশ উপভোগ করেন।

রক্তিমকে ঠাণ্ডা করার পর আলি সাহেবকে একটি ছোটো ভূমিকায় নামার জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল। তিনি সলজ্জ ভাবে বলেছিলেন না, না, ওসব আমি পারব না।

মাস দু-একের মধ্যেই বেশ জমে উঠল রিহার্সাল। থ্যাংকস গিভিং-এর সময় প্রথম অভিনয় হবে। ম্যানহাটনে। রিহার্সালের মাঝখানে মাঝে-মাঝে তর্কাতর্কি, মত বিরোধ তো হবেই। আলি সাহেব কিন্তু এখনও বসে থাকেন নিঃশব্দে। কোনও পক্ষ নিয়ে মতামত দেন না।

নাটকটির বিষয়বস্তু ঐতিহাসিক। সিপাহী বিপ্লব এবং সম্রাট বাহাদুর শাহের অন্তিম দশা নিয়ে এর কাহিনি। সংলাপে কিছু-কিছু উর্দু আছে, তার উচ্চারণ নিয়ে রক্তিম ও গৌতম আলাদা-আলাদা মত দেয়।

একদিন রক্তিম আলি সাহেবের কাছে এসে জিগ্যেস করল স্যার, আপনি উর্দু জানেন?

ঠোঁট থেকে পাইপটা নামিয়ে আলি সাহেব বললেন, খুব জানি না, একটু-আধটু

মোটেই একটু-আধটু নয়, বোঝা গেল তিনি শুধু উর্দু নয়, আরবি ফারসি ভাষাতেও বিশেষ পণ্ডিত। সংলাপে একটা শব্দ আছে, কসবি। সেটা আসলে কসবি নয় কশবি? আলি সাহেব। বললেন শব্দটা এসেছে আরবি কসব থেকে, সুতরাং কসবি হওয়াই স্বাভাবিক, তবে বাংলায় কশবি উচ্চারণ করলেও দোষ নেই!

তেমনি নাটকে আছে রিয়াৎ, এটা কি ছাপার ভুল? রেয়াৎ হবে না? আলি সাহেব বললেন, ঠিক ছাপার ভুল নয়, আরবি শব্দটি হচ্ছে রিআয়ৎ, তার থেকে উর্দুতে রিয়াত বা রিয়াৎ, বাংলা হয়ে গেছে রেয়াৎ!

কিন্তু জিগ্যেস না করলে আলি সাহেব নিজের থেকে কিছুই বলেন না। তাঁর পাণ্ডিত্য জাহির করার কোনও চেষ্টাই নেই।

এখন আলি সাহেবকে সবাই আরও বেশি শ্রদ্ধা করে, রিহার্সালের সময় তার একধারে চেয়ারে বসে পাইপ টানার দৃশ্যটি না থাকলেই খালি-খালি লাগে।

এর মধ্যে গৌতমের বন্ধু অনিমেষ এল কলকাতা থেকে। সে একজন বিখ্যাত সাংবাদিক। রিহার্সাল দেখতে এসে প্রথমেই আলি সাহেবের দিকে চোখ পড়ায় সে বলেছিল, আরে আপনি এখানে? আপনিও নাটক করছেন নাকি?

এরা পরস্পরের পরিচিত দীর্ঘদিনের। অনিমেষ আলি সাহেবের সঙ্গে গল্প করল সর্বক্ষণ।

সেদিন রাত্তিরে গৌতমের বাড়িতে কিছুটা মদ্যপানের পর অনিমেষ বললেন, অনেকদিন পর । আলি সাহেবকে দেখলাম। তোমরা ওঁর পুরো পরিচয় জানো? গ্রেট ম্যান। এনসাইক্লোপিডিয়ার মতন অগাধ জ্ঞান। আর কত খানদানি বংশের মানুষ, মুর্শিদাবাদে নবাব প্যালেসের পাশের বাড়িটাই ওঁদের। আমি সে বাড়িতে গিয়ে থেকেছি। বাংলার এক সময়ের নবাব মিরজাফরের স্ট্রেট বংশধর।

গৌতম চমকে উঠল।

মিরজাফরের নাম শুনলে চমক লাগবেই। আমাদের জাতীয় ইতিহাসে মিরজাফর একটি অতি কলঙ্কিত নাম। দুর্বল মেরুদণ্ডহীন, বিশ্বাসঘাতক মিরজাফর বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদৌল্লাকে শেষ করে দিয়ে দেশটা তুলে দিয়েছিলেন ইংরেজদের হাতে।

গৌতম বলল, ইতিহাসে সিরাজকে যেমন ট্র্যাজিক হিরো হিসেবে দেখানো হয়, তার অনেক দোষ, শুধু মিরজাফর নন, আরও অনেকের দারুণ রাগ আর ঘৃণা ছিল সিরাজের ওপর।

সে যাই হোক, দুশো বছরের আগের ইতিহাস টেনে এনে এখনকার কোনও মানুষকে বিচার করা যায় না। যে কোনও সমাজে এখন আলি সাহেবের মতন মানুষকে আদর্শ পুরুষ বলে মনে করতে হবে।

যথেষ্ট বয়স হলেও আলি সাহেবের শরীর এখনও একটুও ভাঙেনি, সৌম্য মুখখানিতে সব সময় স্মিত হাসি লেগে থাকে। মেয়েদের প্রতিও তাঁর ব্যবহার অতি ভদ্র।

এই দলে যে কজন মেয়ে আছে, তাদের মধ্যে চন্দ্রিমাই সব চেয়ে রূপসি। সে কেমিস্ট্রিতে পি এইচ ডি করছে, ভালো গান গায়, এখনও বিয়ে করেনি। তার প্রতি ছেলেরা তরল চোখে। তাকাবে, তার কাছাকাছি থাকতে চাইবে, কেউ আলতো করে তাঁকে ছুঁয়ে দেবে। এগুলো মোটেই অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু আলি সাহেব তা দেখেও কখনও গার্জেনগিরি করার চেষ্টা করেন না। গৌতম সরকার নিজেই চন্দ্রিমার প্রতি বিশেষ দুর্বল, কিন্তু সে-ও কখনও আলি সাহেবকে ঈর্ষা করার কারণ খুঁজে পায়নি।

তবুও বংশ পরিচয় জানবার পর গৌতম আলি সাহেবকে খানিকটা অন্য চোখে দেখে। মিরজাফরের রক্ত রয়েছে এই নিপাট ভালো মানুষটির শরীরে। সে খবর নিয়ে জেনেছে, মির্জা আলি নামে পরিচিত হলেও ওঁর আসল নামটি বেশ লম্বা, আগেকার দিনের নবাব বাদশাদের যেমন হত।

একদিন সে একটু নিরিবিলিতে আলি সাহেবকে জিগ্যেস করেই ফেলল। আপনার শরীরে নাকি নবাব বংশের রক্ত আছে।

আলি সাহেব সোজাসুজি গৌতমের চোখের দিকে তাকিয়ে জবাব দিলেন, হ্যাঁ আছে বোধহয়, হোমিওপ্যাথিক ডোজে। আমাদের এক পূর্বপুরুষ কিছুদিনের জন্য বাংলার মসনদে বসেছিলেন। তাঁর নাম শুনলে অবশ্য অনেকেই ঘেন্নায় নাক কুঁচকোয়। মিরজাফর! কিন্তু আমি কী করব বলুন, আমার জন্ম তো আমার নিজের পছন্দ মতন হয়নি। তবে সিরাজ সম্পর্কে ইতিহাসে যা লেখে, আমাদের পরিবারে অন্যরকম গল্প প্রচলিত আছে। নিজের বংশকে সবাই বড়ো মনে করে। আমার বাপ-দাদারা মনে করতেন, সিরাজই আসলে বিশ্বাসঘাতক। তবে, আমি ওসব নিয়ে মাথা ঘামাই না! আট পুরুষ আগে আপনার পূর্ব পুরুষ কে ছিলেন, তা কি আপনি জানেন?

গৌতম বললেন, আট পুরুষ? আমার বাবা, ঠাকুরদা, আর তাঁর বাবা, এই তিন জনের নাম জানি, তারপর আর কারুর নামই জানি না! বিখ্যাত ফ্যামিলি না হলে কে আর হিস্ট্রি রেখে দেয়?

আলি সাহেব মুচকি হেসে বললেন, এমনও তো হতে পারে, আপনার এক পূর্বপুরুষ ছিলেন। ডাকাত কিংবা ভিখিরি।

গৌতম বলল, তা তো হতেই পারে। কিছুই জানি না যখন!

আলি সাহেব বললেন, মহাভারতের কর্ণের উক্তিটাই সার সত্য। কোন কূলে জন্ম, তা দৈবাৎ, কিন্তু আমার পৌরুষ নিজের আয়ত্তে।

আপনি কি সংস্কৃতও জানেন নাকি?

এই একটু-আধটু! ভাষা শেখা আমার শখ।

রক্তিমের ডাকাডাকি শুনে গৌতম চলে গেল।

নাটক মঞ্চস্থ করার দিন যত এগিয়ে আসছে, ততই উদ্দীপনা বাড়ছে। রক্তিম ছুটি নিয়ে ফেলেছে অফিস থেকে। অনেক রাত পর্যন্ত রিহার্সাল চলে, তার পরেও খাওয়া-দাওয়া। সেন্টুরা দু-ভাই আতিথেয়তার ব্যাপারে খুব উদার। খাদ্যপানীয়ের জন্য চাঁদা করার প্রস্তাব উঠেছিল, সেন্টু তা উড়িয়ে দিয়েছে।

আলি সাহেব রিহার্সালের পরের আয় থাকতেও চান না। তিনি মদ্যপান করেন না, খাওয়ারও বহু বাছ-বিচার আছে, লাল মাংস কিংবা বিরিয়ানি ছোঁন না।

আলি সাহেব থাকতে না চাইলে চন্দ্রিমাকেও চলে যেতে হয়। কিন্তু নায়িকা না থাকলে কি নাটকের দলের আড্ডা জমে, আলি সাহেবের বদলে অনেকেই চন্দ্রিমাকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য এক পায়ে খাড়া।

আলি সাহেব আপত্তি করেন না, শুধু তিনি চন্দ্রিমাকে জিগ্যেস করেন, তুমি পরে যাবে?

চন্দ্রিমা কিছু উত্তর দেওয়ার আগেই রক্তিম খানিকটা কর্তৃত্বের সুরে বলে, হ্যাঁ আজ চন্দ্রিমা পরে যাবে। ওর সঙ্গে আমার দরকারি কথা আছে।

রক্তিমের কথার রুক্ষতা চাপা দেওয়ার জন্য গৌতম তাড়াতাড়ি বলল, আপনি চিন্তা করবেন না, আমি চন্দ্রিমাকে ঠিক পৌঁছে দিয়ে আসব।

আলি সাহেব একা চলে যাওয়ার পর সেন্টু জিগ্যেস করল, দাদা রিটায়ার্ড লোক, তবু এত বাড়ি ফেরার তাড়া কেন? বাড়িতে কচি বউ আছে বুঝি?

চন্দ্রিমা বলল, যাঃ, উনি বিয়েই করেননি!

গৌতম বলল, সে কি, কেন?

চন্দ্রিমা বলল, লোকে কেন বিয়ে করে কিংবা করে না, তা কি অন্য কেউ বলতে পারে?

সেন্টু বলল, বোধহয় যৌবনে কোনও মেয়ের কাছে ল্যাং খেয়েছেন!

রক্তিম বলল, চন্দ্রিমা তোমাকে উনি রোজ নিয়ে আসেন, এতক্ষণ চুপ করে বসে থাকেন, অথচ নাটকে কোনও ইন্টারেস্ট নেই। তা হলে কি তোমার ওপরে কিছু আঠা আছে?

চন্দ্রিমা সপ্রতিভ মেয়ে। সে হাসতে-হাসতে বলল, তা তো থাকতেই পারে। না থাকলেই আমি অপমানিত বোধ করতুম। আমি একটা সুন্দরী মেয়ে না?

আলি সাহেবের মতন রাশভারি ব্যক্তির সামনে তাঁকে সমীহ করে কথা বলতে হয়। আড়ালে এই ধরনের মানুষকে নিয়ে ঠাট্টা ইয়ার্কি করা যৌবনের ধর্ম।

আলি সাহেব শুধু একদিন সবাইকে শুধু অবাক নয়, হতভম্ব করে দিলেন।

এটা থিয়েটারের গল্প নয়, আলি সাহেবেরই গল্প।

মন্ট্রিয়েল থেকে একদিন এল স্বপন। সে সেন্টুদের দূর সম্পর্কে আত্মীয়। নিউ ইয়র্কে এলে এই বাড়িতেই থেকে যায়। স্বপনও একজন নাট্য পরিচালক, মন্ট্রিয়েলে সে বাঙালিদের মধ্যে বেশ বিখ্যাত। নিউ ইয়র্কেও কয়েকজন তাঁকে চেনে, সবাই তাকে স্বপনভাই বলে ডাকে।

লম্বা ছিপছিপে চেহারা, এমন ফরসা রং যে বাঙালি বলে মনেই হয় না, চোখের মণি কটা। চিমনির মতন সর্বক্ষণ সিগারেট টানে। রিহার্সাল শুরু হতে-না-হতেই সে নানারকম মতামত দিতে শুরু করল।

রক্তিম কারুর ফোঁপরদালালি সহ্য করে না, কিন্তু যেহেতু স্বপন ভাইয়ের নাট্য পরিচালক হিসেবে খ্যাতি আছে, তাই তাকে মেনে নিতে হল। রিহার্সাল আগেই আরম্ভ হয়ে গেছে। চন্দ্রিমাকে নিয়ে আলি সাহেব পৌঁছলেন একটু দেরিতে।

আলি সাহেব যথারীতি বসলেন নিজের চেয়ারে। তাঁর সঙ্গে স্বপন ভাইয়ের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কথা কারুর মনে এল না।

চন্দ্রিমাকে দেখেই স্বপন বলল, বাঃ, নায়িকাটি তো ভারি বিউটিফুল, এতেই তো নাটকের অর্ধেক বাজিমাৎ! আমি তোমাকে মন্ট্রিয়েলে ইনভাইট করলে তুমি আসবে? চন্দ্রিমা বলল, ভেবে দেখব। এখন বলতে পারছি না।

আলি সাহেব ভুরু কুঁচকে স্বপনের দিকে তাকালেন।

চন্দ্রিমা সংলাপ শুরু করার একটু পরেই স্বপন বলল তোমার থ্রো ঠিকই আছে। কিন্তু এখানে হাঁটাটা ঠিক হচ্ছেনা।

রক্তিম বলল, এই সিনে আমিই খুব আস্তে-আস্তে হাঁটতে বলেছি।

স্বপন বলল, আস্তে জোরের ব্যাপার নয়। অহংকার বোঝাতে গেলে দাচিন মাস্ট বি আপ! হাঁটার সময় অন্যদের দিকে না তাকিয়ে, চিবুকটা উচু করে—

চন্দ্রিমার কাছে এসে তার চিবুকটা আঙুল দিয়ে তুলে বলল, এইরকম—

হঠাৎ যেন সেখানে বজ্রপাত হল।

আলি সাহেব হুংকার দিয়ে বলে উঠলেন, হাউ ডেয়ার ইউ!

সবাই হতচকিত, স্বপন নিজেও কিছু বুঝতে না পেরে বলল, কী হল?

আলি সাহেব উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, তুমি ওকে টাচ করলে কেন? আগে ওর পারমিশান নিয়েছ? প্রথমেই এসে ভালগার ভাবে কথা বলতে শুরু করেছ?

স্বপন এবার রক্তিমের দিকে ফিরে বলল, এ লোকটা কে?

রক্তিম আমতা-আমতা করে বলল, ইনি আমাদের মানে বিশিষ্ট একজন।

স্বপন চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, অ্যাকটিং শেখাবার জন্য পারমিশান নিতে হবে। শুধু তো চিবুকটা ছুঁয়েছি, দরকার হলে কোমর ধরেও হাঁটা শেখাতে হয়।

আলি সাহেব হিংস্র গলায় বললেন, শাট আপ! নাটকের রিহার্সাল মানে বেলেল্লা করার জায়গা নয়!

আলি সাহেবের এরকম রুদ্রমূর্তি কেউ কখনও দেখেনি।

স্বপন বলল, বেলেল্লা! আমি বেলেল্লা করছি। তুমি কে হে হরিদাস পাল? ভদ্রভাবে কথা বলতে জানো না?

আলি সাহেব এক পা এগিয়ে এসে বললেন, আমাকে তুমি ভদ্রতা শেখাবে? তুমি একটা স্কাউন্ট্রেল! দেখেই বোঝা যাচ্ছে, তুমি মেয়েদের সঙ্গে।

স্বপন চেঁচিয়ে বলল, গেট দা হেল আউট অফ হিয়ার!

আলি সাহেব বললেন, ইউ গেট আউট!

তারপরই একটা প্রচণ্ড ঘুষি কষালেন স্বপনের নাকে। স্বপন ছিটকে পড়ে গেল, তার মাথা খুব জোরে ঠুকে গেল একটা চেয়ারে। মাথা ফাটল, নাক দিয়েও গলগল করে রক্ত বেরুতে লাগল।

সবাই চেপে ধরল আলি সাহেবকে। চন্দ্রিমা কাছে এসে বলল, চাচা, এ কী করলেন?

আলি সাহেব এখনও ফুসছেন। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, বেশ করেছি। আরও মারা উচিত। ও একটা লোফার…

স্বপনকে নিয়ে যাওয়া হল পাশের ঘরে। সেন্টু ফোন করল এক চেনা ডাক্তারকে। এর মধ্যে রক্ত বন্ধ করা দরকার। এক-একজন এক-একরকম পরামর্শ দিচ্ছে। কিন্তু বাড়িতে কোনও ওষুধ নেই। ব্যান্ডেজ বাঁধার কাপড়ও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

স্বপন অজ্ঞান হয়ে যায়নি, কিন্তু আচ্ছন্নের মতন হয়ে আছে। সেই অবস্থাতেই ফিসফিস করে বলল, হারামির বাচ্চাটাকে ধরে রাখ। ওকে পুলিশে দেব। আমি কেস করব ওর নামে।

এর মধ্যেই চন্দ্রিমা বুদ্ধি করে আলি সাহেবকে প্রায় জোর করে টেনে নিয়ে বেরিয়ে গেছে।

আজ আর রিহার্সালের কোনও আশা নেই।

ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই বিমূঢ় বনে গেছে। ছোট-ছোট জটলায় কথা হচ্ছে নীচু স্বরে। সকলেই দোষ দিচ্ছে আলি সাহেবকে। স্বপন ভাই তো তেমন কিছু করেনি। সে নামকরা নাট্য পরিচালক। চন্দ্রিমা নিজেও কিছু আপত্তি করেনি, স্বপন ভাইয়ের যদিও মেয়ে ঘটিত ব্যাপারে বদনাম আছে, কিন্তু এখানে…

ডাক্তার এসে গেছে। স্বপনের মাথায় আঘাত বেশ গুরুতর।

সেন্টু আড়ালে ডেকে গৌতমকে বলল, চন্দ্রিমাকে ডেকে বলতে হবে, ওই আলি সাহেবকে আর এখানে আনা চলবে না। না হলে আমরা এখানে রিহার্সাল হতে দেব না।

গৌতম বলল, খুবই দুঃখিত ভাই। তোমার মেহমানকে এমন অপমান করা, তাও বিনা কারণে খুবই অন্যায়! চন্দ্রিমার ওপর আলি সাহেবের খুবই উইকনেস, এত জেলাস।

সেন্টু বলল, শুধু আমার মেহমান নয়, স্বপন ভাই কত খানদানি বংশের লোক তা জানো? উনি নিজে কারুকে বলতে চান না। কিন্তু আমরা তো জানি উনি নবাব আলিবর্দির ডাইরেক্ট বংশধর।

দারুণ অবাক হয়ে গৌতম বলল, কী? কার বংশধর! আলিবর্দি মানে সিরাজের?

সেন্টু বলল ইয়েস। ডকুমেন্ট আছে। স্বপন ভাইয়ের আসল নাম তো নওসের খান।

গৌতম অস্ফুট স্বরে বলল, সিরাজের বংশধর।

আলি সাহেবের বংশ পরিচয় সে কারুকে জানায়নি। আলি সাহেবও স্বপন ভাইয়ের বংশ পরিচয় জানেন না। তবু ওকে দেখামাত্রই যেন জ্বলে উঠলেন। আট পুরুষ আগেকার ঝগড়া বয়ে এনেছে রক্তের মধ্য দিয়ে, এখন তা মেটেনি?

তা হলে কি সিরাজ আর মিরজাফরের মধ্যে ঝগড়ার মূল কারণ ছিল নারীঘটিত? ইতিহাস এ ব্যাপারে নীরব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *