2 of 3

ভাঙা বারান্দা

ভাঙা বারান্দা

এমন নয় যে এই বারান্দাটায় দাঁড়ালেই সুন্দর কোনও দৃশ্য দেখা যায়। তবু তো বারান্দা। জানলার থেকে অনেকখানি বেশি। জানলার গরাদে মুখ রাখলে কয়েদীর মতন লাগে, আর বারান্দা মানে মুক্তি।

বারান্দা একটা আছে, কিন্তু সেখানে দাঁড়াবার উপায় নেই।

যতদিন ছেলেটা ছোট ছিল, ততদিন বারান্দার দিকে দরজাটা বন্ধ করে রাখতে হত সব সময়। এখন ছেলে ইস্কুলে গেলে অসীমা দরজাটা খোলে, উদাস মুখ করে তাকিয়ে থাকে বাইরের দিকে, কিন্তু বাইরে পা বাড়াতে পারে না।

বারান্দাটার রেলিং ভেঙে পড়েছিল আট বছর আগে। তাতেও এমন কিছু ক্ষতি ছিল না, বয়স্ক লোকরা সাবধানে বারান্দায় দাঁড়িয়ে নীচের ফেরিওয়ালাদের ডাকতে পারত। কিন্তু একদিন দেখা গেল বারান্দাটার মাঝখান থেকে ফেটে অনেকখানি হাঁ হয়ে গেছে। ওপরের সিমেন্ট চুরচুরে। মাঝে-মাঝেই সুরকি খসে পড়ে নীচে। ওই বারান্দা এখন আর একজন মানুষের ভারও সহ্য করতে পারবে না। তবু সুদর্শন সাহস করে একদিন পা দিতেই বেঁকে গিয়েছিল।

সেই আট বছর আগেই ওই বারান্দা নিয়ে বাড়িওয়ালার সঙ্গে ঝগড়া করেছিল সুদর্শন। তখন। সুদর্শনের চেহারা ছিল রোগা পাতলা, ডায়াবিটিস ধরেনি। মেজাজটাও ছিল তেড়িয়া। কিন্তু উগ্র স্বভাবের মানুষরাও চুনীলাল শীলের মতন বাড়িওয়ালার সঙ্গে কোনও সুবিধে করতে পারে না। কোনও গালাগালিই চুনীলাল শীলের গায়ে লাগত না। ঠান্ডা গলায় বলত, বারান্দা সারাব, সে পয়সা পাব কোথায়! দেখছেন না স্ত্রী পুত্র নিয়ে ডুবতে বসেছি। আপনার না পোয় আপনি বাড়ি ছেড়ে দিন।

পাশের ঘরে থাকতেন গুরুসদয়বাবুরা। বারান্দাটায় তাঁদেরও কিছুটা অংশ ছিল। গুরুসদয়বাবুর স্ত্রীকে অসীমা কাকিমা বলে ডাকত। বেশ ভাব ছিল দুটি পরিবারে। অসীমা অবশ্য জানে না যে ওই গুরুসদয়বাবুর মেয়ে বুলা একসময় সুদর্শনকে বিয়ে করার জন্য পাগল হয়ে উঠেছিল। সুদর্শন রাজি না হয়ে দু-পক্ষেরই বাবা-মায়েদের খুশি করেছিল। বিয়ে করার মতন কোনও যোগ্যতাই ছিল না তার।

গুরুসদয়বাবু সুদর্শনকে ওই বারান্দা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, বুঝলে থোকন, ভাড়াটে হিসেবে কি আমাদের কোনও অধিকার নেই? বারান্দা সমেত ঘর ভাড়া দিয়েছে, এখন সেই বারান্দা যদি। ভেঙে পড়ে, বাড়িওয়ালা তা সারাতে বাধ্য নয়? থানায় খবর দিতে হবে, দরকার হলে আমরা কেস করব?

সে বছরই সুদর্শনের বাবা মারা গেলেন, পয়সা-কড়ির অবস্থা খুবই খারাপ, মামলা মোকদ্দমার নামে তার ভয় হয়েছিল। সে তো অনেক টাকার ব্যাপার, সে আর গা করেনি।

বাড়ি ফিরতে সুদর্শনের বেশ রাত হয়। তাদের এ-পাড়াটা বিশেষ ভালো নয়, কাছেই পোস্তার। বাজার, সারাদিনরাত যেখানে অনেক টাকার কারবার চলে সেখানে গুন্ডা বদমাসরাও সবসময়

ঘুরঘুর করে। রাত্তিরের দিকে ছিনতাই আর ছুরি চালাচালি লেগেই আছে। অবশ্য এ-পাড়ায় সবাই সুদর্শনকে চেনে। এ-পাড়াতেই তার জন্ম। সে একটা সাধারণ হেঁজিপেজি মানুষ। গুন্ডা বদমাসরা তাকে ছোঁবে কেন?

অসীমা তবু ভয় পায়। সুদর্শন ফেরার আগে রাস্তায় কোনও একটা গোলমাল হলেই সে বারান্দার দিকের দরজাটা খোলে, কিন্তু বাইরে কী ঘটছে তা দেখবার উপায় নেই।

এক-একদিন সুদর্শনের ওপর রাগ করে অসীমার ইচ্ছে করে ওই রেলিং ছাড়া বারান্দাটাতেই গিয়ে দাঁড়াতে। ভেঙে পড়ে তো পড়ুক।

সুদর্শন ফিরলেই সে ঝাঁঝের সঙ্গে বলে ওঠে, আমি আর একদিনও এ-বাড়িতে থাকতে চাই না। তোমার দোকানের কাছাকাছি একটা বাড়ি নিতে পারো না?

ম্লান হাসি ছাড়া এ কথার কোনও উত্তর নেই। দোকানের কাছাকাছি বাড়ি, অসীমা বোঝেই না, কত ধানে কত চাল! বর্ধমানের গ্রামের মেয়ে অসীমা, তাই মনটা এখনও সাদা!

কারখানায় যখন লক আউট চলছিল তখন কয়েকজন সহকর্মীর সঙ্গে মিলে কালীঘাটের মোড়ে রাস্তার ওপর ছিট কাপড়ের দোকান খুলেছিল সুদর্শন। সে কারখানা আর কোনওদিন খুললই না। অন্য চাকরির চেষ্টা না করে সুদর্শন এ-দোকান নিয়েই লেগে রইল। মোটামুটি বেশ চলে যাচ্ছিল। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে এই পাতাল রেলের জন্য রাস্তা খুঁড়ছে ওই দিকে, এখন শোনা যাচ্ছে, যে-কোনওদিন ফুটপাথের দোকানগুলি সব তুলে দেওয়া হবে। তখন আবার জায়গা পাওয়া যাবে কোথায়?

আর বাড়ি পালটানো? সুদর্শনের বাবা ছত্রিশ বছর আগে এ বাড়িতে দেড় খানা ঘর ভাড়া নিয়েছিলেন। ভাড়া বাড়তে-বাড়তে এখন দাঁড়িয়েছে চুয়াত্তর টাকা। এই ঘর ছেড়ে অন্য যে কোনও জায়গায় এরকম দেড়খানা ঘর ভাড়া নিতে গেলে অন্তত সাড়ে তিনশো, চারশো টাকা লেগে যাবে।

অসীমা ভাত বেড়ে দেয়। অসীমার দিকে তাকিয়ে সুদর্শনের বড় মায়া লাগে। সারাদিন তার দোকানে অনেক রকম মেয়েছেলে আসে, তাদের কত রকমের চেহারা, কেউ-কেউ তো বেশ সুন্দরী, তবু রাত্তিরবেলা বাড়ি ফিরে নিজের বউকে দেখতেই সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে সুদর্শনের। তার কোনও উঁচু আকাঙ্ক্ষা নেই। সারাদিন খাটাখাটনির পর যদি বিক্রিবাটা মোটামুটি ভালো হয় তাতেই সে খুশি আর রাত্তিরে বাড়ি ফিরে বউয়ের সঙ্গে একটু গল্প করা।

কিন্তু প্রত্যেকদিনই অসীমার অনেক অভিযোগ জমা থাকে।

সুদর্শন বলে, দাঁড়াও না, আগে একটা পাকা দোকান ঘরের ব্যবস্থা করি, তারপর বাড়ি পালটাব ঠিকই। একটা সুন্দর বারান্দা থাকবে, বেশ পার্কের পাশে, ছেলেটা খেলতে পারবে।

পাশের ছোট ঘরটা থেকে গোঙানির শব্দ পাওয়া যায়। সুদর্শনের মায়ের বয়েস হয়েছে অনেক, শরীরে শক্তি নেই, এখন শুধু মৃত্যুর অপেক্ষা। কিন্তু এইসব মানুষের মৃত্যু সহজে আসে না। কোনও রাত্তিরেই মায়ের সঙ্গে দেখা করে না সুদর্শন। বাড়ি ফেরার পথে এক-একদিন তার আশা হয়, ফিরেই হয়তো মায়ের মৃত্যু-সংবাদ শুনতে পাবে!

এ-বাড়ির বাড়িওয়ালার সঙ্গে ঝগড়াটা হঠাৎ একদিন থেমে গেল। কারণ বাড়িওয়ালা বলে কেউ রইলই না। চুনীলাল শীলের ব্যাবসা বেশ খারাপ চলছিল, অনেক মামলা মোকদ্দমাতেও জড়িয়ে। পড়েছিল, হঠাৎ একদিন বিক্রি করে দিল সেই বাড়িটা। নতুন বাড়িওয়ালা যে কে হল তা বোঝাই গেল না। কানাঘুষোয় জানা গেল বটে তা কোনও মাড়োয়ারি কিনেছে, কিন্তু তাকে চোখে দেখা যায়নি একদিনও। এ-পাড়ার সব বাড়িই একে-একে মাড়োয়ারিদের দখলে চলে যাচ্ছে, কেউ বাড়ি বিক্রি করলে তা কোনও মাড়োয়ারি যে কিনবে তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে এই চারতলা বাড়িটার পুরোটাই ভাড়া, সবাই পুরোনো আমলের। এত ভাড়াটে শুষ্টু বাড়ি কিনে মাড়োয়ারীর কী লাভ হবে?

এক রবিবার সকালে সব ভাড়াটে মিলে একটা মিটিং করল। যে বাড়িওয়ালাকে দেখা যায় না, সে অতি বিপজ্জনক। মাড়োয়ারি যখন বাড়ি কিনেছে তখন ভাড়াটে তোলার চেষ্টা করবেই সে।

কোনদিক থেকে বিপদ আসবে কেউ জানে না। এ সময় সকলকে এককাট্টা হয়ে থাকতে হবে। ভাড়া বাকি পড়লে বাড়িওয়ালা সুযোগ পাবে, সুতরাং সকলেরই উচিত নিয়মিত রেন্ট কন্ট্রোলে ভাড়া পাঠানো।

খুব ভালো-ভালো কথা হল। যদিও সব ভাড়াটেদের মধ্যে মুখ দেখাদেখির সম্পর্ক নেই। মিটিং এর পর থেকে আবার ঝগড়াঝাঁটি চলতে লাগল যথা নিয়মে।

কয়েক মাস বাদে সুদর্শন শুনতে পেল বাড়িওয়ালার এক দালাল নাকি বিভিন্ন ভাড়াটেকে টাকার লোভ দেখিয়ে তুলে দেওয়ার চেষ্টা করছে। এক একজনকে পাঁচ-দশ হাজার টাকা দেবে।

কিন্তু সুদর্শনকে তো কেউ কিছু বলেনি? আবার সুদর্শন বেরিয়ে যায় সকাল সাড়ে আটটায় আর ফেরে সেই রাত নটার পর। তার দেখা পাবে কী করে?

অসীমাকে সে জিগ্যেস করে, তুমি কিছু শুনেছ? বাড়িওয়ালা নাকি টাকা দিতে চাইছে?

অসীমার গর্ভে আবার সন্তান এসেছে। তার মুখ ভার। ছেলে আজ বল খেলতে-খেলতে বারান্দায় চলে গিয়েছিল, এমন ভাবে ঝুঁকেছিল যে রাস্তার লোক হইহই করে উঠেছে। আর-একটু হলেই নীচে পড়ে যেত।

অসীমা বলল, তুমি আর কাকাবাবুরা মিলে বারান্দাটা সারিয়ে নিতে পার না? আমাদের যখন এখানেই থাকতে হবে…

সুদর্শন অবাক হয়ে বলল, কার বাড়ি তার ঠিক নেই, আমরা পয়সা খরচ করে বারান্দা সারাব?

অসীমা বলল, সব সময় ভয়ে-ভয়ে থাকতে হয়। টুকুন তো ছোট, ওকে আর দোষ দেব কী! তোমার মা-ই সকালবেলা ভুল করে বারান্দায় চলে যাচ্ছিলেন। কিছু একটা হলে আমার দোষ হত!

পাশের ঘরে মায়ের কাশির আওয়াজ শুনতে পাওয়া যাচ্ছে! মা আজকাল চোখে প্রায় কিছুই দেখতে পান না। সুদর্শন সত্যিই তার মায়ের মৃত্যু চায়। কিন্তু বারান্দা ভেঙে পড়ে মরলে লোকে সত্যিই অসীমার নামে বদনাম দেবে।

অসীমা বলল, আমার দু-গাছা চুড়ি বেচে যদি কোনওরকমে বারান্দাটা মেরামত করতে পার, তাতেও আমি রাজি আছি।

সুদর্শন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। অসীমার চুড়ি দু-গাছার কথা সে কদিন ধরেই ভাবছে।

কালীঘাটের মোড়ে ফুটপাতের ওপরে দোকান আর রাখা যাবে না। রাস্তা ভাঙতে-ভাঙতে তার দোকানের দিকে এগিয়ে আসছে। এ তো আর হকার উচ্ছেদ নয় যে পুলিশকে ঘুষ দিয়ে পার। পাওয়া যাবে? ফুটপাতই যদি না থাকে! অন্য জায়গায় আবার দোকান বসাতে গেলে টাকা খরচ করতে হবে! জায়গা পাওয়াই দারুণ শক্ত ব্যাপার। তখন অসীমার চুড়ি দু-গাছা ছাড়া আর উপায় নেই। দোকানই যদি না থাকে তাহলে বারান্দা দিয়ে কী হবে?

ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেই সুদর্শন দেখল গুরুসদয়বাবুদের বাড়ির মালপত্র তোলা হচ্ছে একটা লরিতে।

দারুণ অবাক হয়ে সে জিগ্যেস করল, কাকা, আপনারা চলে যাচ্ছেন?

গুরুসদয়বাবু গলায় খাঁকারি দিয়ে বললেন, হ্যাঁ,…আজ না হয় কাল তো যেতেই হবে… বাড়িওয়ালা এ-বাড়ি ভেঙে ফেলে দশতলা বাড়ি তুলবে শুনছি।

—আমাদের না তুলে কী করে বাড়ি ভাঙবে?

—ভাঙতে শুরু করলে আমাদের যেতেই হবে। সল্টলেকে বাড়ি করেছি একটা, কেন আর এখানে কষ্ট করে থাকা! তোমার কাকিমা বললেন এ পাড়াটাই আর ভালো লাগছে না। এ-পাড়ায় আর। বাঙালিরা থাকতে পারবে না!

সুদর্শনের ভুরু কুঁচকে গেল। গুরুসদয়বাবু সল্টলেকের জমিতে ভিত খুঁড়ে অনেকদিন ফেলে রেখেছিলেন। ওঁর বড় ছেলে আলাদা হয়ে গেছে। টাকা পয়সার নাকি খুব টানাটানি যাচ্ছিল। ইদানীং। তবে কী করে বাড়ি শেষ করলেন? হঠাৎ টাকা এল কোথা থেকে?

সুদর্শনের সন্দেহ হল। উনি বাড়িওয়ালার কাছ থেকে টাকা পেয়েছেন। নইলে এত সস্তার বাড়ি কেউ ছেড়ে চলে যায়! অন্য ভাড়াটে বসিয়ে দিলেও ভোলাভ। কিন্তু উনি একেবারে ছেড়ে দিচ্ছেন।

আস্তে-আস্তে অন্য ভাড়াটেও উঠে যেতে লাগল একজন দুজন করে। বাড়িওয়ালা নিজে আসে না। কিন্তু তার একজন দালাল ইদানীং ঘোরাঘুরি করে। টাকা দিয়েই ভাড়াটে তুলছে নির্ঘাৎ। অনেক জায়গাতেই এরকম শোনা যায়। কিন্তু সুদর্শনকে কেউ কিছু বলছে না কেন?

সন্ধের পর এ-বাড়িতে ঢুকতে এখন গা ছমছম করে। অনেক ঘরই অন্ধকার, সিঁড়ির আলো নেই। জলও মাঝে-মাঝে বন্ধ হয়ে যায়। সুদর্শন দেরি করে ফেরে, ফিরে তাকে অসীমার বিমর্ষ মুখ দেখতে হয়। আজকাল কোনও কথাই সে বলে না।

একদিন সকালবেলা সুদর্শন আবিষ্কার করল, অসীমা ওই ভাঙা বারান্দাতেই একটা ফুলের টব রেখেছে। তাতে কী যেন ফুলও ফুটেছে। বারান্দায় পা দেয় না, দরজার কাছে দাঁড়িয়েই অসীমা টবে জল দেয়।

দু-দিন ধরে সুদর্শনের দোকান উঠে গেছে। সে কথা সে অসীমাকে বলতে পারেনি। সে মুগ্ধভাবে নতুন ফোঁটা ফুলগুলো দেখে। তারপর চা মুড়ি খেয়ে বেরিয়ে পড়ে। নতুন জায়গা খুঁজে দোকান আবার চালু করতে না পারলে না খেয়ে থাকতে হবে পরের মাসে। দোকানের ক্যাপিটাল তার নিজস্ব নয়, সবই ধার।

সন্ধেবেলা পাড়ার দুটো মস্তান ছেলে তাকে ধরল। দুজনকেই চেনে সুদর্শন। এরা পোস্তা বাজারে গুন্ডামি করে। এদের মধ্যে হাবু তার সঙ্গে ক্লাস থ্রি পর্যন্ত পড়েছিল স্কুলে। এখন তাকে দাদা-দাদা বলে।

হাবু বলল, খোকনদা, শোনো, তোমার সঙ্গে একটা প্রাইভেট কথা আছে।

—কী রে হাবু, কী ব্যাপার?

বেশি সময় নষ্ট করে না হাবু। সুদর্শনের চোখের দিকে সোজা তাকিয়ে বলে, তুমি এবারে পাড়া বদলাও। এ পাড়ায় তোমার মতন কমদামি মানুষদের আর জায়গা হবে না।

—বলিস কি রে, হাবু! বাড়ি ছাড়লে আমি যাব কোথায়? জানিস তো আমার অবস্থা। নতুন করে ঘর ভাড়া নেওয়ার কি আমার সামর্থ আছে?

–কালীঘাটের দিকে কোনও বস্তিতে ঘর খুঁজে নাও!

—এতকাল এ পাড়ায় আছি। তোদের কোনও ক্ষতি করেছি কখনও? হরেন মার্ডার হওয়ার পর পুলিশ আমাকে সাক্ষী দিতে বলেছিল, তখন দিয়েছি আমি?

—ওসব জানি না। তুমি পাততাড়ি গুটোও। তুমি এখানে আর থাকতে পারবে না।

সুদর্শন ব্যাকুলভাবে হাবুর হাত জড়িয়ে ধরে বলল, তোরা আমার সঙ্গে এমন কচ্ছিস? দ্যাখ এ পাড়ায় বাঙালিদের সব বাড়িগুলো একে-একে বেহাত হয়ে যাচ্ছে। বাঙালির কোনও জায়গা থাকবে না? তুই নিজে বাঙালি হয়ে আমাকে তাড়াতে চাস?

হাবু বলল, ও সব বাঙালি-ফাঙালি আমি বুঝি না। বাঙালিদের পয়সার মুরোদ আছে? আমাদের যে পয়সা দেবে আমরা তার দিকে টানব। বাঙালি নাম কি ধুয়ে খাব? তোমাকে ভালো কথা বলে দিচ্ছি—

সুদর্শনের বুকটা একেবারে খালি হয়ে গেল। বাড়িওয়ালা তাকে নেহাত চুনোপুটি জ্ঞান করে টাকা দিয়েও তুলতে চায়নি। হাবুদের দলকে কিছু টাকা দিয়েছে, ওরাই এখন ভয় দেখিয়ে বাকি ভাড়াটেদের তুলে দেবে। কিন্তু সুদর্শন এখন যাবে কোথায়?

অসীমার সঙ্গে এ-সম্পর্কে কিছুই আলোচনা করা যায় না। অসীমা এখন বারান্দায় তিনটে টব বসিয়েছে। সাহস করে সে আজকাল ওই বারান্দাতেও গিয়ে দাঁড়ায়। সুদর্শন নিষেধ করলেও শোনে না! কী যেন হয়েছে অসীমার।

বাড়িতে ঢোকার আগে সুদর্শন কিছুক্ষণ দেওয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে কাঁদে।

হাবুর চোখ দেখেই সুদর্শন বুঝতে পেরেছে, ওরা সহজে ছাড়বে না তাকে। ওরা পয়সার লোভ পেয়েছে। সুদর্শন যখন বাড়িতে থাকবে না তখন অসীমার ওপরে হামলা করতে পারে। এ পাড়াতে কেউ অন্যের ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামায় না।

কালীঘাটে দোকান খোলার জন্য অন্য একটা জায়গা কোনওক্রমে খুঁজে পেয়েছিল সুদর্শন। সেখানেও পাড়ার মাস্তানরা এসে বাধা দিয়েছে। ও জায়গাটা এমনি-এমনি কেউ পাবে না। ওদের উপস্থিতিতে নিলাম হবে, যে বেশি টাকা দিতে পারবে সে পাবে। পাঁচ-ছহাজারের কমে কথাই নেই!

পাতাল রেলের মজুররা আজ সুদর্শনের দোকান যেখানে ছিল, সেই জায়গাটা ভাঙল। সুদর্শন। নিজে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে দেখেছে। পাতাল রেল তাকেও পাতালের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

বাড়ি ফিরে অসীমার সঙ্গে বেদম ঝগড়া হয়ে গেল সুদর্শনের। সাধারণত তার মাথা ঠান্ডা থাকে, কিন্তু আজ অসীমার একটা গায়ে বেঁধানো কথাই সে সহ্য করতে পারল না। প্রচন্ড জোরে চেঁচিয়ে বলল, মাগি তুই চুপ করবি!

অসীমা জ্বলন্ত চোখে সুদর্শনের দিকে তাকিয়ে খট করে দরজা খুলে চলে গেল বারান্দায়।

সুদর্শনের মনে হল, ও বুঝি ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছে নীচে। সে বাধা দেওয়ার জন্য এগিয়ে গিয়েও থমকে গেল। দুজনে একসঙ্গে দাঁড়ালে আর দেখতে হবে না। ভাঙা রেলিং-এর ওপর ঝুঁকে আছে অসীমা। কাঁদছে নিশ্চয়ই, তবে তা বোঝা যাচ্ছে না। তিনটে টবের গাছেই ফুল ফুটেছে। সে দিকে নির্নিমেষে তাকিয়ে রইল সুদর্শন। কী সুন্দর দেখাচ্ছে সব মিলিয়ে।

সুদর্শন যেন একটা শব্দ শুনতে পাচ্ছে, ভেঙে পড়ার শব্দ, কিন্তু ভাঙছে না। একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে অসীমা। সুদর্শনের মনে হল, সত্যি একটা বারান্দা না থাকলে বাড়ির মেয়েদের বড় কষ্ট।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *