2 of 3

ভাঙা দাঁত

ভাঙা দাঁত

হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেতে সোমরার চার মাস কাবার হয়ে গেল। এখনও শরীরে তেমন বল আসেনি। তাছাড়া, পায়ের হাড় জোড়া লাগলেও মনে হচ্ছে এই বুঝি ভেঙে গেল ফের। মুখচোখের কাটা দাগগুলো মিলিয়েছে। তবে কিনা চারবেলা ভালোমন্দ ঠিক সময়ে পেটে পড়ত, হাসপাতালে এইটেই আরাম। সদর হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে বাস ধরে সে যখন আবার হাতিমবাড়ি চলে এল, তখন তার পকেটে মাত্র একটি টাকা পড়ে আছে।

হাতিমবাড়ির লোকজন তাকে দেখে ভিড় করে এল। গল্পটা এখন জানাজানি হয়ে গিয়েছে। মৃত্যুর দরজায় মাথা ঢুকিয়ে এভাবে বেরিয়ে আসতে আর কাউকে দ্যাখেনি এখানকার মানুষ। এতদিন তারা গল্পটা শুনেছে অন্যের মুখে, খানিকটা অনুমানের ওপর সেটা তৈরি। সোমরাকে হাতের কাছে পেয়ে টাটকাটাটকি জানতে চায়, কি হয়েছিল, কি করে সে বেঁচে গেল।

এত মানুষ তাকে খাতির করছে দেখে প্রথমে ঘাবড়ে গিয়েছিল সোমরা। ফ্যালফ্যাল করে সে প্রথমে ভিড়টাকে দেখছিল। এদের অনেককে সে চেনে। এক সময় যারা তাকে পাত্তা দিত না, তারা কি করে আজ এত সদয় হল? দত্ত স-মিলের ম্যানেজারবাবু তাকে বাঁচাল, আঃ, কি করছেন কি আপনারা! সবে লোকটা হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেল আর সঙ্গে-সঙ্গে চেপে ধরলেন গল্প শুনবার জন্যে। আরে, সোমরা তো পালিয়ে যাচ্ছে না। তাছাড়া স্বয়ং দেবরাজের দয়া পেয়েছে ও, মিছিমিছি বিরক্ত করবেন না।

অর্ধেক কাজ হল কথাটায়। কারণ ম্যানেজারবাবু যখন তাকে আদর করে স-মিলের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলেন, কিছু মানুষ তখনও পেছন-পেছন আসছিল। সোমরার মাথায় কিছু ঢুকছিল না। পাঁচ মাস আগে এই ম্যানেজারবাবুর পা ধরেছিল সে। একটা কাজ দিতে লোকটার দয়া হয়নি। বলেছিল, মুদির দোকানে ওজন মাপিস, কাঠের কলে কাজ করবি কী করে? যা, আর একটা মুদির দোকান খুঁজে নে।

কিন্তু হাতিমবাড়িতে মুদির দোকান মাত্র দুটো। সে যেটায় কাজ করত, তার মালিকের ছেলে সাবালক হয়ে ও দোকানে বসছে বলে ছাঁটাই হতে হয়েছে তাকে। অন্যটায় কাজ খালি নেই। শেষ পর্যন্ত ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টে ক্যাজুয়াল কর্মী হিসেবে ঢুকিয়ে নিয়েছিল রেঞ্জারবাবু। সাইকেলে চেপে বিটে-বিটে ঘুরে খবর দেওয়া-নেওয়ার কাজ। পাঁচ টাকা রোজ। ওটা কোনও পাকা চাকরি নয়, রেঞ্জারবাবু দয়া করে যা দেবেন তাই নিতে হবে। কিন্তু তাতেই বেঁচে গিয়েছিল সে। মুদির দোকানে খাওয়াপরা নিয়ে পঞ্চাশ টাকার বেশি পেত না। এক মাসে এখানে একশ টাকা। হয়েছিল। রেঞ্জার সাহেবের একটা পুরোনো সাইকেল–। এই কয়মাস হাসপাতালে শুয়ে সে। সাইকেলটার কথা ভাবত। ওটা আর সারানো যাবে না। রেঞ্জার সাহেব যদি দাম ফেরত চায় তো হলে গেল! ভয়টা মাঝে-মাঝেই পাক খায় বুকের মধ্যে।

স-মিলের বারান্দায় ওকে নিয়ে বসল ম্যানেজারবাবু, এবার বল, তোর শরীর কেমন? মাথা নাড়ল সে, ভালো। কারণ উলটোটা বললে আর কাজ পাওয়া যাবে না এখানে। আমরা তো ভেবেছিলাম তুই গেলি, আর বাঁচলি না। ম্যানেজারবাবু বলল।

জান খুব কড়া। স-মিলের ক্যাশিয়ারবাবু মাথা নাড়ল।

আঃ, আমাকে জান দেখিও না। এ হল ঈশ্বরের কৃপা। নইলে ওই অবস্থা থেকে কেউ ফিরে আসতে পারে না। চা খাবি? ম্যানেজারবাবু নরম মুখে হাসল।

মাথা নাড়ল সে। চা আনার হুকুম দিয়ে ম্যানেজারবাবু বলল, এবার বল তো বাবা, ঠিক যা যা হয়েছিল বলে যা।

সোমরা কৃতার্থ হল। ম্যানেজারবাবুর দয়া হচ্ছে নিশ্চয়। তা যদি হয়, তাহলে এখানে একটা চাকরি পেয়ে যেতে পারে সে। চারপাশে কাঠের গুঁড়ি, চেরা কাঠ স্তূপ করে রাখা আছে। তার কাঁচা গন্ধ আসছে নাকে। সোমরা দেখল সবাই তার মুখের দিকে উদগ্রীব হয়ে চেয়ে আছে। নিজেকে খুব বড় লাগছে এখন। সে গল্প শুরু করল।

রেঞ্জারবাবুর দু-নম্বর সাইকেলে চেপে সব বিটে-বিটে ঘুরে খবর দেওয়া-নেওয়া করে সোমরা। সেদিন পাঁচ নম্বর বিটে চিঠি পৌঁছে দিতে বিকেল হয়ে গিয়েছিল। জঙ্গলে অনেক ঘোরাফেরা করেছে সে। এই জঙ্গলে একমাত্র হাতি আর বাইসন ছাড়া ভয়ের কিছু নেই। দুটো বুড়ো বাঘ আর কয়েকটা চিতা আছে যদিও, তাদের নজর মানুষের ওপর নেই। কিন্তু সন্ধে হলেই জঙ্গলের বুকে ছমছমে আঁধার জমে। তাই খুব দ্রুত প্যাডেল ঘোরাচ্ছিল সে। ভাবল নদীর মধ্যে দিয়ে শর্টকাট করবে। অন্তত এক মাইল রাস্তা বাঁচবে তাহলে। তা নদীতে আজ জল ছিল না এক ফোঁটা। বালি আর পাথরে বোঝাই সিকি মাইল চওড়া নদীতে সাইকেল চালানো মুশকিল। খোলা জায়গা বলে দেরিতে আঁধার নামে। কোনও মানুষের চিহ্ন নেই কোথাও। প্রায় মাঝনদীতে সে চলে এসেছে যখন তখনই চোখে পড়ল। একটা এইটুকুনি হাতি ঠিক মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে পা দিয়ে বালি ছড়াচ্ছে। বড়জোর চার ফুট লম্বা হবে কি হবে না। সোমরাকে দেখে একটুও ভয় পেল না বাচ্চাটা। কিন্তু সোমরা ভয় পেল। ওই বাচ্চা যখন ওখানে আছে তখন ওর মা-বাপও ধারেকাছে রয়েছে নিশ্চয়ই। কিন্তু ভোলা শুকনো নদীর বুকে আর কোনও প্রাণের অস্তিত্ব নেই। মরিয়া হয়ে সে প্যাডেল ঘোরাতে লাগল। বালির ওপর গতি পাচ্ছেনা চাকা দুটো। এবং পাথরে লেগে সে সাইকেল নিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ল। তেমন কিছু লাগেনি তার, সাইকেলের পেছনের চাকা পড়ে গিয়ে বোঁ-বোঁ করে ঘুরছিল আর সেটাই হল কাল।

বাচ্চাটা দৌড়ে এল সাইকেলের কাছে। এসে শুড় দিয়ে চাকাটাকে থামাল। তারপর আবার ঘোরাবার চেষ্টা করল। কিন্তু চাকা আর ঘোরে না। তখন শুড় দিয়ে সাইকেলটাকে তুলে একটু দূরে  ছুঁড়ে ফেলতেই সামান্য ঘুরল ঝাঁকুনিতে। এটাই খেলা পেয়ে গেল ও। সাইকেল তুলছে আর ছুড়ছে। সোমরা ফ্যালফ্যাল করে দৃশ্যটা দেখছিল। সে বুঝতে পারছিল এবার সাইকেল অকেজো হয়ে যাবে। তা যদি হয়, রেঞ্জারবাবু তাকে শেষ করে ফেলবে। হাতিটা যদিও খুব বাচ্চা, তবু হাতি তো। গায়ের জোরে সে পারবে কেন? এদিকে ততক্ষণে চাকা আর ঘুরছে না। সোমরা মুখে। আওয়াজ করতে বাচ্চাটা সরে দাঁড়াল। তখন সে সাহস করে দৌড়ে সাইকেলটাকে তুলে সিটে বসতেই বাচ্চাটা তার কোমর পেঁচিয়ে ধরল। পরমুহূর্তেই সোমরা দেখল সে শূন্যে ভাসছে এবং তারপরেই একটা পাথরের চাই-এর ওপর আছড়ে পড়তেই পৃথিবীটা মুহূর্তের জন্য চোখের সামনে থেকে মুছে গেল। জ্ঞান ফিরতেই পায়ে অসহ্য যন্ত্রণা। বাচ্চাটা তখন সাইকেলটাকে শুড়ে তুলে ওর দিকে এগিয়ে আসছে। উঠে বসার চেষ্টা করল সোমরা, পারল না। তার তখনই নজরে পড়ল দুটো পাহাড়ের মতো বিশাল হাতি জঙ্গল থেকে বেরিয়ে ছুটে আসছে এদিকে। সামনে এসে সাইকেলটাকে শূন্যে তুলে ধরল বাচ্চাটা। দু-হাতে মুখ ঢেকে চোখ বন্ধ করল সোমরা। আর তখনই সাইকেলটা নেমে এল বিদুৎগতিতে। মাথাটা বাঁচল, কিন্তু মনে হল সমস্ত শরীর চুরমার। হয়ে গিয়েছে। জ্ঞান হারিয়ে ফেলল সে।

যখন চেতনা হল, তখন চাঁদ উঠেছে। সোমরা বুঝতে পারল রক্তে শরীর ভেসে যাচ্ছে। সমস্ত শরীরে প্রচণ্ড যন্ত্রণা। এবং বেঁচে আছে বুঝতে পেরে চোখ খুলতেই সে আবার ঘোরের মধ্যে পড়ল। সেই কালো বিশাল হাতি দুটো তার সামনে দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টিতে তাকে দেখছে। তারপর আর তার খেয়াল নেই। জ্ঞান ফিরেছে হাসপাতালে গিয়ে।

ম্যানেজারবাবু চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ চিন্তা করল। একটা চাকর সোমরার হাতে চায়ের গ্লাস দিল। চা খাওয়া হয়ে যাওয়ার পর ম্যানেজারবাবু চোখ খুলল। ওই দুটো হাতি সাক্ষাৎ ইন্দ্রের বাহন। পরদিন হাটের লোকজন নদী দিয়ে যাওয়ার সময় দুটো হাতিকে দেখতে পায়। বাচ্চাটা একটু দুরে ঘুমোচ্ছিল। মানুষ দেখে হাতি দুটো বাচ্চাকে তুলে নিয়ে জঙ্গলে চলে যায়। এরা ভয়ে প্রথমে এগোয়নি। তারপর একজন তোকে দেখতে পেয়ে ছুটে যায়। তুই তো তখন অজ্ঞান। আশ্চর্যের ব্যাপার, তোর শরীরে একটা গাছের পাতা ছিবড়ে করে চেপে দিয়েছিল হাতি দুটো। ওই রস না লাগলে তুই বাঁচতিস না। আমার মনে হয়, হাতি দুটো সারারাত পাহারা দিয়েছিল। যাতে অন্য কোনও জন্তু তোকে না খায়। ওদের বাচ্চার অন্যায় ওরা এভাবেই শুধরে দিতে চেয়েছিল। আহা তুইকি ভাগ্যবান, সাক্ষাৎ ইন্দ্রের দয়া পেয়েছিস।

চারপাশে গুঞ্জনটা ছড়াল। ভিড় পাতলা হলে সোমরা হাতজোড় করল, ম্যানেজারবাবু, একটা কাজ দিন।

কাজ? চোখ ছোট করল ম্যানেজারবাবু, এখানে কাজ কোথায়? তাছাড়া তোর এখন ভাবনা কিসের! পুরো জেলার লোক এখন তোর কাছে হুমড়ি খেয়ে পড়বে। গল্পটা বল আর টাকা কামা। নে, নে, ওঠ। আমার অনেক কাজ পড়ে আছে।

কাকুতিমিনতিতেও কাজ হল না। শেষ পর্যন্ত রাস্তায় বেরিয়ে এল সোমরা। যে তাকে দেখছে, সে ই ডেকে বসতে বলে গল্প শুনতে চায়। কাজ দেওয়ার মানুষ একটাও নেই। একজন তো বলেই দিল, এই শরীর নিয়ে কি কাজ করাই বল, খাটতে তো পারবি না!

শেষ পর্যন্ত ভয়ে-ভয়ে ফরেস্ট অফিসে ঢুকল সোমরা। রেঞ্জারবাবু বারান্দায় বসেছিলেন। দেখামাত্র বললেন, তোমার খুব ভাগ্য, তাই বেঁচে গেলে। শুনেছি অনেকক্ষণ এসেছ এখানে। কাজ খুঁজছ। কিন্তু আমার এখানে কাজ নেই। কোনও ক্যাজুয়াল পোস্ট খালি নেই। হলে এসো, দিয়ে দেব।

বাইরে বেরিয়ে এল সোমরা। একটা বাঁচোয়া যে রেঞ্জারবাবু সাইকেলটার কথা বললেন না। কিন্তু এখন সে কী করে? দিনটা তো চোখের ওপর দিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। তিন কাপ চা ছাড়া পেটে কিছু পড়েনি। এক টাকারই মুড়ি কিনে নিল সে।

আর তখনই চাকরিটা পেয়ে গেল সোমরা। নসু রায়ের লোক তাকে ডেকে নিয়ে গেল বাড়িতে। বুড়োর নানান ব্যবসা। বন্ধকি কারবার থেকে শুরু করে ট্রাক চালকল এবং জোত। নসু রায় তাকে গল্পটা বলতে বলল। মুখ ব্যথা হয়ে গিয়েছিল এর মধ্যে, তাছাড়া বারংবার বললে গল্প বাড়ে। নসু রায় তামাক খেতে-খেতে সমস্তটা শুনে বলল, দুটো পাহাড় আর একটা বাচ্চা, তাই তো?

মাথা নাড়ল সোমরা।

কাজ করবি?

হ্যাঁ, বাবু।

বহুৎ আচ্ছা। আমার একটা জোত আছে জঙ্গলের গায়ে। যে লোকটা পাহারা দিত, সে হাতির ভয়ে থাকতে চাইছে না। মাসে একশটা টাকা দেব আর বিশ কেজি চাল। খবরদার, আমার জোতে যেন হাতি না ঢোকে! করবি?

সঙ্গে-সঙ্গে পায়ের তলায় যে মাটি জমছিল সেটা হাওয়া হয়ে গেল। হাতি তার সর্বনাশ করেছে আর হাতি তাড়াবে সে? খালি হাতে? অসম্ভব! কিন্তু একশ টাকা আর বিশ কেজি চাল। লোভ সামলাতে পারল না সোমরা।

বেশ, রাতটা আমার এখানেই থেকে যা, ভোর-ভোর রওনা হবি।নসু রায় খুশি হল।

জঙ্গলের ধার ঘেঁষে নসু রায়ের জোত। জোত না বলে রাজ্য বলাই ভালো। ভুট্টার শরীরে দুধ। জমছে। চারপাশে হাজার রকম ফলের গাছ। এখন ধানের সময় নয়। নইলে সেটাও মন্দ হয় না। জঙ্গলের গা ঘেঁষে বলে রাজ্যের পাখি জড়ো হয়েছে এখানে। খেতের মধ্যে টিন বাঁধা আছে। অনেকগুলো। দড়ি টানলে সব কটা টিন একসঙ্গে বেজে ওঠে। আম-কাঁঠালের মধ্যে একটা। টিনের ঘর। যে লোকটা সঙ্গে এসেছিল, সে দেখিয়ে বিদায় হতেই সোমরার মনে হল পৃথিবীতে আর মানুষ বেঁচে নেই।

দিনটা যত বাড়তে লাগল তত সোমরার খারাপ লাগা একটু-একটু করে কমতে শুরু করল। খারাপ কি! দুবেলা পেট পুরে ভাত খাবে আর জন্তু এলে তাড়াবে। তা ছাড়া এই গাছগুলোয়। নিশ্চয়ই ফলটল হবে। একটা গুলতি বানিয়ে নিলে ঘুঘু শিকার করলে খাওয়াটা জমবে ভালো। সেক্ষেত্রে প্রতি মাসে অন্তত আশিটা টাকা বাঁচাতে পারা যাবে। চার-পাঁচ বছর কাজ করলে। হাতিমবাড়িতে একটা দোকান নিয়ে বসতে কোনও অসুবিধে হবে না। কিন্তু মুশকিল হল সে হাতি তাড়াবে কি করে! অবশ্য হাতি যে আসবে, তার কোনও মানে নেই। কিন্তু যদি আসে! সারাদিন। ধরে অনেক কাঠ জোগাড় করল সোমরা। জঙ্গলে এই জিনিসটার অভাব নেই। তারপর ভাতেভাত ফুটিয়ে পেট পুরে খেয়ে সন্ধের আগেই আগুন জ্বেলে শুয়ে পড়ল টিনের ঘরে।

ঘুম ভাঙল মাঝরাত্তিরে। ভাঙতেই মনে হল বাইরে কেউ হাঁটছে। এই জঙ্গলে চোর-ছ্যাঁচোড় আসার কথা নয়। সন্তপর্ণে দরজা খুলে বেরিয়ে এসে এপাশ-ওপাশ তাকাতেই দমবন্ধ হয়ে গেল যেন। সেই বাচ্চা হাতিটা। তবে এখন আরও লম্বা হয়েছে। নিজের অজান্তে চিৎকার করে উঠল। সোমরা। আতঙ্কে থরথর করে কাঁপছিল সে। আর তখনই বাচ্চার পাশে এসে দাঁড়াল সেই পাহাড় দুটো। রাগি শব্দ করে সোমরার দিকে এগিয়ে আসতে-আসতে হঠাৎ থমকে দাঁড়াল দুটোই। ওদের একটা পায়ের চাপেই গুড়ো হয়ে যাবে সোমরা। মরণ সামনে অথচ পালাবার শক্তি নেই পায়ে। হঠাৎ একটা গঁড় এগিয়ে এল সামনে। চোখ বন্ধ করে তার স্পর্শ পেল সোমরা। চোখ খুলল যখন তিনটে হাতিই নেই। চারধার যেমন শান্ত তেমনি রয়েছে। বাইরের কাঠের আগুন কখন নিভে গিয়েছে। আর ঘুমোতে পারল না সোমরা। চুপচাপ মড়ার মতো পড়ে থেকে স্থির করল আগামীকাল ভোরেও যদি সে বেঁচে থাকে, তাহলে ফিরে গিয়ে নসু রায়কে বলবে, তার দ্বারা এ কাজ হবে না। আপনি বাঁচলে বাপের নাম।

জঙ্গলের অন্ধকার বেদম কালো। তখনও ভোর হয়নি, দুমদাম আওয়াজ শুনতে পেল সোমরা। কেউ বা কারা যেন কিছু ছুঁড়ছে। সোমরা ভাবল একবার দেখে আসে ব্যাপারটা কি! তার পরেই ইচ্ছেটা ত্যাগ করল। সে তো আর চাকরি করছেনা, অতএব এ নিয়ে মাথা ঘামানোর কী দরকার? ভোরের আলো ফোঁটা পর্যন্ত সে নড়ল না।

দরজা বন্ধ করে সে বাইরে খানিকটা এগিয়ে আসতেই চমকে উঠল। ওগুলো কী?কাঁচা পাকা কলার কাঁদি স্তূপ হয়ে রয়েছে সামনে। নসু রায়ের জোতে কলার চাষ হয় না। এগুলো এল। কোত্থেকে? বিব্রত সোমরা যখন কোনও কূল পাচ্ছিল না, তখন মানুষের গলার আওয়াজ পেল। চারজন লোক পথ চিনে-চিনে ভেতরে এসে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দিল। এই কলার কাঁদিগুলো নাকি গতকাল দুটো হাতি তাদের বাগান থেকে জোর করে ছিঁড়ে এনেছে। কিন্তু হাতিগুলো কলা না খেয়ে নসু রায়ের বাগানে ফেলে গেল কেন?

লোকগুলো যখন কলা নিয়ে যেতে চাইল তখন বাধা দিল সোমরা। এর মধ্যে তার মাথায় কিছু বুদ্ধি এসে গেছে। সে লোকগুলোকে সঙ্গে নিয়ে দীর্ঘপথ হেঁটে নসু রায়ের বাড়িতে পৌঁছল। ও পক্ষের বক্তব্য শুনে নসু রায় সোমরার দিকে তাকাল, হাতি কি আমার গাছ নষ্ট করেছে?

সোমরা মাথা নাড়ল, না বাবু। আমাকে দেখতে পেয়ে ভোরবেলায় ওগুলো পৌঁছে দিয়ে গেল। এখন ওগুলো ফেরত দেবেন কিনা, সেটা আপনার ইচ্ছে।

নসু রায় হাসল। তার মতলব হাসিল হয়েছে। এখন আশেপাশের সমস্ত জোতবাগানে হাতিরা অত্যাচার করবে, শুধু তারটি ছাড়া। যদ্দিন সোমরা ওই জোতে থাকবে, ততদিন হাতিরা তাকে খুশিতে রাখবার চেষ্টা করবে। লোক চারটেকে নসু রায় বলল, তোমরা তোমাদের জিনিস নিয়ে যেতে পারো, কিন্তু ঘরে রাখতে পারবে না।

কেন? ক্ষতিগ্রস্ত লোকগুলো ফুঁসে উঠল।

হাতিরা সোমরাকে প্রণামী দিয়ে গেছে। দেবরাজের অনুগ্রহ পেয়েছে সোমরা। সেই প্রণামী ফিরিয়ে নিয়ে গেলে হাতিরা রুষ্ট হবেই।নসু রায় জানাল।

লোকগুলো হতভম্ব হয়ে চলে গেল। নসু রায় তখন সোমরাকে আলাদা ডেকে বলল, আমি তোক পাঠাচ্ছি, তাদের ঘাড়ে কলাগুলো চাপিয়ে দে। আর এখন থেকেই দশদাকা মাইনে বাড়িয়ে দিলাম তোর।

খবরটা চাউর হতে বেশি সময় লাগল না। মৃত্যুর হাত থেকে দেবতা রক্ষা করেছেন, এটা বিস্ময়ের ব্যাপার। কিন্তু দেবতার নির্দেশে হাতিরা ফল পৌঁছে দিচ্ছে এটা দৈব-অনুগ্রহ ছাড়া সম্ভব নয়। খবরটা যত ছড়াল তত তাতে রং লাগল। যে দেবতার আর্শীবাদ পেয়েছে, তাকে ধরলে অনেক দুঃখকষ্ট দূর হয়ে যাবে, কারও কারও এরকম মনে হল। হাতিমবাড়ির মানুষজন তাই দিনের আলোয় কয়েকজন হেঁটে উপস্থিত হল নসু রায়ের জোতে। তাদের প্রত্যেকেই কোনও-না কোনও কারণে কষ্ট পাচ্ছে, সোমরাকে তা দূর করে দেওয়ার জন্যে দেবতাকে বলতে হবে।

দশ টাকা মাইনে বাড়ার লোভ এবং হাতিদের কাছ থেকে এক ধরনের সহযোগিতা পাওয়া যাবে। বোধ হওয়ায় জোতে ফিরে এসেছিল সোমরা। কিন্তু এত মানুষের অনুনয়-বিনয় শুনে ঘাবড়ে গেল শেষ পর্যন্ত। সে যত বোঝাতে চায় যে দেবতা অনুগ্রহ করেছেন কিনা তার জানা নেই। কারণ কোনও দেবতার দর্শন সে পায়নি। লোকগুলো একথা মানতে চায়নি। তারা ঘটনাগুলোকে নিয়ে নানান বিশ্লেষণ করছিল। শেষ পর্যন্ত সোমরা বলতে বাধ্য হল হাতি দুটোর দেখা পেলে সে ওদের কষ্টের কথা জানাবে, যাতে দেবরাজ কিছু করেন। নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্যে বলা কথাগুলোয় মন্ত্রের মতো কাজ হল। একটা জায়গায় বসে সোমরাকে সব দুঃখের কথা শুনতে হল। কারও রোগ সারছে না, কারও মামলা চলছে, কারও পুত্র হচ্ছে না। শুনতে-শুনতে সোমরার সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছিল। এর কষ্টের সঙ্গে ওর কষ্ট গুলিয়ে ফেলছিল।

এসব কাজে মানুষ খালি হাতে আসে না। সোমরা দেখল তার সামনে অনেক খাদ্যদ্রব্য ওরা নিবেদন করেছে। এই সময় জঙ্গলে শব্দ হল। একজন চিৎকার করে উঠল, ওরে হাতি বের হচ্ছে।

তৎক্ষণাৎ ছুটোছুটি শুরু হয়ে গেল। ভয়ে মুহূর্তেই জোতটা ফাঁকা হয়ে গেল। লোকজন দূরে ফাঁকা জায়গায় গিয়ে জড়ো হয়ে এদিকে উঁকিঝুঁকি মারার চেষ্টা করতে লাগল। হাতি আসছে জেনে সোমরার দুই পা কাঁপছিল। ওই লোকগুলোর সঙ্গে পালাতে পারলে সে খুশি হত। কিন্তু সেটা করলে যে সে ফালতু হয়ে যাবে এটা বোঝার ক্ষমতা তার ছিল। বসে বসেই সে দেখল সেই পাহাড় দুটো আর বাচ্চাটা জঙ্গল ছেড়ে বেরিয়ে এদিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ তাকাবার পর সোমরার ভয় কমল। যদি ওরা তাকে মারতে চাইত, তা হলে কাল রাত্রেই সেটা পারত। সোমরা পায়ে-পায়ে এগোল। তারপর চিৎকার করে বলল, মানুষের বড় কষ্ট! কেউ রোগে কষ্ট পাচ্ছে, কেউ মামলায় সর্বস্বান্ত হচ্ছে, কারও সন্তান হচ্ছে না। তোমরা এই কষ্ট দূরে করে দাও। হাতিগুলো নড়ল না।

সোমরা আর এক পা এগিয়ে ওই বাক্যগুলো বলল। এবার সে ওই সঙ্গে কয়েকটা নামও চেঁচিয়ে বলল, হঠাৎ ছোট হাতিটা শুড় বাড়িয়ে একটা ডাল ছিঁড়ে সামনের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে আবার তুলে নিল দৌড়ে। কিন্তু তার বাবা গর্জন করে উঠতেই সে ডালটাকে ফেলে সুড়সুড় করে ফিরে গেল। মায়ের কাছে। বাপ-হাতিটা শুড় তুলে সামান্য নাচিয়ে জঙ্গলে ঢুকে গেল পরিবার নিয়ে।

সোমরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। হাতি দুটো আজও তার ক্ষতি করল না। বরং বাচ্চাটা এগিয়ে আসছে। দেখে ধমক দিয়েছে। সে এগিয়ে গিয়ে ভাঙা ডালটা তুলে নিতেই মানুষের উল্লাস শুনতে পেল। আড়াল থেকে এইসব ঘটনা হাতিমবাড়ির লোকেরা দেখেছে। সোমরার কথা হাতিরা সমীহ করে শুনেছে এই দৃশ্য তাদের খুব নাড়া দিল। তারা আনন্দিত হয়ে ছুটে এল সামনে। সোমরা বিস্মিত। হয়ে দেখল মানুষগুলো তাকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করছে। তারপর একজন জোড়হাতে ভক্তিতে গদগদ হয়ে বলল, বাবা, আমাকে ওষুধ দাও।

সোমরা দেখল লোকটা রোগগ্রস্ত, কিন্তু সে ওষুধ পাবে কোথায়? এই সময় সবাই একসঙ্গে ওর হাতে ধরা ডালটিকে দেখতে লাগল। সোমরা পলকেই বুঝে ফেলল রহস্যটা। যেহেতু বাচ্চা হাতিটা তার প্রার্থনার পর ডালটাকে ছুঁড়েছিল, তাই এরা মনে করেছে ওইটি দৈবপ্রেরিত ওষুধ। সোমরা দেখল, ওরা ডালটাকে ভাগাভাগি করে খুশিমনে ফিরে গেল হাতিমবাড়িতে।

কিছুদিনের মধ্যেই নসু রায় তার বাড়িখানার শ্রী ফিরিয়ে দিল। সোমরাকে এখন আর বাগান জোত পাহারা দিতে হয় না। নসু রায় তার জন্যে আলাদা লোক রেখেছে। হাতির উপদ্রব্য অন্য জোতে হলেও এদিকে তারা ভুলেও আসে না। সোমরার জন্যে একটা সুন্দর ঘর তুলে দিয়েছে। নসু রায়। দেবরাজ ইন্দ্র ঐরাবতে বসে আছেন–এই মূর্তি শহর থেকে তৈরি করিয়ে সেই ঘরের সামনে চালা করে প্রতিষ্ঠা করেছেনসু রায়। প্রতিদিন অগণিত দু:খী মানুষ নানান উপঢৌকন নিয়ে সোমরাকে তাদের কষ্টের কথা শোনাতে আসে নদী পেরিয়ে জঙ্গল ভেঙে। ইন্দ্রের মূর্তির সামনে একটা উঁচু আসনে বাবু হয়ে বসে সোমরা সেই কাহিনিগুলো শোনে। যে গাছের ডাল হাতির বাচ্চাটা ভেঙেছিল, তার পাতা দুঃখী মানুষদের হাতে তুলে দেয়। মানুষগুলো সন্তুষ্ট হয়ে ফিরে যায় নিজেদের গ্রামে। সারাদিনের জমা হওয়া প্রণামীগুলো থেকে কিঞ্চিৎ সোমরার জন্যে রেখে নসু রায়ের লোক পুঁটুল বেঁধে নিয়ে যায় হাতিমবাড়ি। ব্যয়ের চেয়ে অনেকগুণ বেশি আয় হচ্ছে নসু রায়ের।

এখন আর খাওয়াপরার কষ্ট নেই সোমরার। নসু রায়ের দেওয়া মাইনে ছাড়াও যা জমছে তা কম নয়। কিন্তু মাঝে-মাঝেই আজকাল তার ধন্দ লাগছে। দেবতা কি সত্যি তাকে অনুগ্রহ করেছেন? সে তো কখনও দেবতাকে ডাকেনি! বাপ-মা মরে যাওয়ার পর পেটের ধান্দা করতেই তার দিন। কেটেছে। এসব ব্যাপার সে নিজেই ঠিক বুঝতে পারছে না। এত মানুষ তাকে রোজ কষ্টের কথা শোনাচ্ছে, তারা ভাবছে ওকে বললেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু হাতি দুটো আর ভুলেও বাচ্চা নিয়ে এই পথে আসবে না। প্রায় মাস দুয়েক দেখা পায়নি ওদের। এদিকে যে গাছ থেকে ডাল ছিঁড়েছিল, সেটা এখন ন্যাড়া হয়ে গিয়েছে। সোমরার মনে হচ্ছিল হাতি দুটো এদিকে না এলে তার প্রতিপত্তি কমে যাবে। হ্যাঁ, একটু-একটু করে এই অবস্থাটাকে সোমরার ভালো লেগেছে। এত মানুষ আসছে, তাকে খাতির করছে রোজ, এ তো কম কথা নয়। এমনকী নসু রায় নিজে এসে তাকে খাতির করে গিয়েছে।

তবে আর একটা ব্যাপার সোমরাকে আজকাল খুব অন্যমনস্ক করে রাখে। প্রতিদিন মানুষের। কষ্টের কথা শুনতে-শুনতে পৃথিবীতে এত দুঃখ অছে তা সে জানত না। এত কষ্ট মানুষের? তার তো শুধু খেতে না পাওয়া আর শোওয়ার জায়গা না পাওয়ার কষ্ট ছিল। এগুলোর তুলনায় ও দুটো তো কিছুই নয়। অথচ মানুষের মুখ দেখে বোঝাই যায় না প্রত্যেকে কি দুঃখ বয়ে বেড়াচ্ছে!

এর মধ্যে আর একটা ঘটনা ঘটল। ওই গাছের পাতা মাদুলিতে পুরে দুটো মানুষ প্রচণ্ড উপকার পেয়ে গেল। একজন হারা মামলা, জিতল, অন্যজন ডাক্তারের বাতিল-করা রোগ থেকে সেরে। উঠল। এই ঘটনা হাতিমবাড়ির মানুষকে নাড়িয়ে দিল। এর মধ্যে যাদের মনে সন্দেহ জন্মাচ্ছিল, তারাও বিগলিত হল। মানুষের ভিড় আরও বাড়তে লাগল এবং সোমরা বিচলিত হয়ে পড়ল।

হাতি দুটোর দেখা পাওয়া দরকার। সে অনুমানে ওই গাছের পাতা জঙ্গল থেকে ছিঁড়ে এনে দু:খী মানুষদের দিচ্ছে। কিন্তু এতে কোনও কাজ হবে বলে তার বোধ হচ্ছেনা। ভক্তদের উৎসাহে সে। মনে-মনে বিশ্বাস করে ফেলেছে যে হাতি দুটো নিশ্চয়ই ঈশ্বপ্রেরিত। এখানে যা কিছু হচ্ছে, তা ভগবানের ইচ্ছেয়; এবং তিনি অনুগ্রহ করেছেন বলে তার দেহেও ঈশ্বরের কিছু-কিছু আর্শীবাদ এসে গেছে। ইদানীং তার নিজের অজান্তেই কথাবার্তা বলার ধরন পালটে নিয়েছে। নিজেকে। সন্ন্যাসী-সন্ন্যাসী ভাবতে খুব আরাম লাগে। কিন্তু হাতি দুটোকে খুঁজে বের করা দরকার। এতদিন সে অন্য মানুষের দুঃখকষ্টের কথা বলার চেষ্টা করেছে, নিজের জন্যে কখনও চায়নি। এবার ওদের খুঁজে বের করে বলবে, আমাকে তুমি সেই ক্ষমতা দাও যাতে আমি মানুষের কষ্ট দূর করে দিতে পারি। প্রতিবারে তোমার ওপর নির্ভর করে থাকতে ভালো লাগে না।

একদিন পালকিতে বউকে চাপিয়ে নসু রায় এল। মেয়েদের এই পথ ভেঙে আসা খুবই কষ্টকর। কিন্তু ইদানীং তারাও আসছে। তারা আসার পরই সোমরার সন্ন্যাসী ভাবটা বেশি বেড়েছে। পায়ের ওপর পড়ে মেয়েরা এত কান্নাকাটি করে যে নিজেকে খুব বড় মনে না করে উপায় থাকে না।

সেদিন লোকজন কম ছিল। তাদের বিদায় করে নসু রায় এসে সোমরার সামনে বিনীত ভঙ্গিতে বসল। সোমরা লক্ষ করেছিল কিছুদিন থেকে নসু রায়ের ব্যবহারেও পরিবর্তন হয়েছে। কথাবার্তায় সমীহভাব ফুটেছে। কিন্তু এতখানি বিনয় কখনও লক্ষ করেনি। নসু রায় বলল, এত মানুষ উপকৃত হচ্ছে আর আমি চুপচাপ বসে দেখছিলাম। আমার গিন্নি রোজই তাগাদা দেন, কিন্তু ভাবতাম তুই আমার দুঃখটা বুঝতে পারবি। আমার দিকে কেন তাকাচ্ছিস না, বল?

সোমরা হকচকিয়ে গেল। নসু রায়ের আবার কি দুঃখ থাকতে পারে। নসু রায় ইশারায় তার স্ত্রীকে কাছে ডাকল। মধ্যবয়সি মহিলা মাথায় ঘোমটা দিয়ে এগিয়ে এসে আছড়ে পড়ল সোমরার পায়ে, বাবা, দয়া করো, আমাকে বাঁচাও।

তাড়াতাড়ি পা সরিয়ে নিয়ে সোমরা বলল, আহা কি করছেন মা, ছি ছি।

নসু রায় বলল, এবার কষ্টটা দূর করে দে।

কাঁপা গলায় সোমরা জিজ্ঞাসা করল, কিসের কষ্ট?

বাতের। বেশিক্ষণ হাঁটতে পারে না, অমাবস্যায় যন্ত্রণা বাড়ে। এমনকী আমাকে একটু সুখ পর্যন্ত দিতে পারে না। ওটা তুই সারিয়ে দে।নসু রায় বলল।

সঙ্গে-সঙ্গে নসু রায়ের বউ চিৎকার করে কেঁদে উঠল, না বাবা, অত বড়-বড় ছেলে যার, তার এখনও ছোঁকছোঁকুনি গেল না। আমি বাতে পড়ে আছি বলে উনি যুবতী ঝি রেখেছেন। সে মাগীর রোয়াব কত! আমার বাতটা সারিয়ে দাও, আমি সে বেটিকে ঝেটিয়ে বিদায় করে দিই।

নসু রায় বলল, ঘরের কেচ্ছা বাইরে বলে না গোলাপ। তা বলেই ফেললে যখন তখন তো আর ফেরানো যাবে না। তুমিও তো সব শুনলে, ওটা সারাও।

সোমরা হাতজোড় করল, বাবু, আমি জানি না কি করে বাত সারে!

আঃ, তুমি জানো না সেটা তো আমিও জানি। তুমি ওই হাতিদের বলো একটা কিছু উপায় বের করতে। নসু রায় উষ্ণ হল, এই ব্যাপারটার শেষ না দেখা পর্যন্ত আমরা এখান থেকে নড়ছি না। রাজ্যের লোক এসে আমাদের বলে যাচ্ছে তোমার পাতা খেয়ে উপকার পাচ্ছে, আর আমাদের। বেলায় জানি না বললে চলবে?

সোমরা ঘামতে লাগল। নসু রায় স্ত্রীকে নিয়ে টিনের বাড়িতে ঢুকলেন। তাদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা শুরু হল। সোমরা ভেবে পাচ্ছিল না সে কী করবে? অন্য লোক পাতা নিয়ে গিয়ে উপকার না পেলে ফিরে আসে না। কারণ যারা উপকার পায়, তাদের কথা ভেবে মনে করে নিজেদের কোনও গলতি ছিল। সন্দেহটা আর ব্যক্ত করতে সাহস পায় না। কিন্তু নসু রায় তার অন্নদাতা। যে কোনও উপায়েই হোক ওর উপকার করতেই হবে।

মাঝরাত্রেও ঘুম আসছিল না সোমরার। পাশেই জঙ্গল থেকে অনবরত নানান শব্দ ভেসে আসছে। হঠাৎ মনে হল চালাঘরে কেউ যেন ঘুরে বেড়াচ্ছে। নিজের আস্তানা ছেড়ে বেরিয়ে এল সোমরা। আর এসেই চমকে উঠল। সেই বাচ্চাটা! তার দরজার দিকে মুখ করে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখামাত্রই বাচ্চাটা উলটোদিকে ঘুরে হাঁটতে শুরু করল। সোমরা চারপাশে তাকাল, পাহাড় দুটোকে দেখা যাচ্ছে না। বাচ্চাটা কয়েক পা গিয়ে আবার দাঁড়িয়ে পড়েছে। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে দেখছে, আর শুড় নাড়ছে। সোমরার মনে হল বাচ্চাটা তাকে অনুসরণ করতে বলছে। সে পায়ে-পায়ে এগিয়ে গেল।

জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে টুকটুক করে ছুটছে বাচ্চাটা। পরিষ্কার চাঁদের আলোতেও তাল রাখতে পারছিল না সোমরা। বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর একটা বিরাট ঝোঁপের মধ্যে গিয়ে বাচ্চাটা দাঁড়িয়ে পড়ল। একটু এগোতেই দৃশ্যটা দেখতে পেল সোমরা। বিশাল পুরুষ-হাতিটা হাঁটু ভেঙে পড়ে আছে। তার ড় নড়ছে আর নাক দিয়ে অদ্ভুত শব্দ বের করছে মাঝে-মাঝে। বাচ্চাটা হঠাৎ ঘুরে দুদ্দাড় করে ছুটে চলে গেল জঙ্গল ভেঙে। তারপর স্থির হয়ে গেল চারপাশ। কোথাও কোনও শব্দ নেই, শুধু শায়িত হাতির নিশ্বাস ছাড়া। পায়ে-পায়ে এগিয়ে গেল সোেমরা। খুব করুণ চোখে তার দিকে তাকাল হাতিটা। ওরকম বিশাল চেহারার জন্তুটা কেমন অসহায় চোখে তার দিকে। তাকিয়ে আছে। সোমরা বুঝতে পারছিল হাতিটা খুব অসুস্থ। অসুস্থ হাতিরা মৃত্যুর আগে একা। হয়ে যায়। একটা নির্জন জায়গা বেছে নিয়ে দেহত্যাগ করে। এর বোধহয় সেই সময় উপস্থিত। হঠাৎ সোমরার মনে হল, এটাও ঈশ্বরের ইচ্ছা। সে দু-হাত জোড় করে হাঁটু গেড়ে সামনে বসল, আমাকে বাঁচাও, ওই নসু রায়ের বউ-এর বাত সারিয়ে দাও, নইলে আমার মান থাকবে না। নানান ভাষায় একই প্রার্থনা করে যেতে লাগল সোমরা কিন্তু হাতির কোনও পরিবর্তন হল না। সোমরা উঠল এবং তখনই তার চোখে পড়ল একটা বিশাল ক্ষত হাতির পেটে। এখন সেটা ঘা হয়ে গিয়েছে এবং রাজ্যের মাছি সেই জায়গাটা ঢেকে রেখেছে। অসুস্থতার কারণটা বুঝতে পারল সে। নিশ্চয়ই ওকে মেরে দল থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে কোনও নব্য যুবক হাতি। ফলে মা হাতিটাকেও এখানে চোখে পড়ছে না। সোমরা দৌড়তে লাগল।

জোতে ফিরে এসে সে প্রথমে ভেবেছিল নসু রায়কে ডেকে খবরটা দেবে। কিন্তু পরে মত পালটাল। সাপের হাত থেকে বাঁচবার জন্যে পোকামাকড় মারবার জন্যে টিন-টিন ফিনাইল এনেছিল নসু রায়। তারই একটা বড় টিন আর দুটো খালি বস্তা নিয়ে সে আবার ফিরে গেল জঙ্গলে। হাতিটা চোখ বন্ধ করে পড়েছিল। ওকে ফিরে আসতে দেখে আবার করুণ চোখে তাকাল। টিনের মুখ খুলে সোমরা সামান্য ফিনাইল ক্ষতের ওপর ছড়িয়ে দিতে মাছিগুলো উড়ল এবং কিছু মরল। হাতিটার শরীর যেন কেঁপে উঠল। একটা কাঠি নিয়ে বস্তার কোণা ফিনাইলে ভিজিয়ে সোমরা জোর করে ক্ষতের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে হাতিটা প্রতিবাদে চিৎকার করে উঠল। কিছুক্ষণ বাদে বড়-বড় সাদা পোকা গর্ত থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করল। হাতিটা তখনও চিৎকার করছে, শরীর নাড়ছে, কিন্তু উঠে দাঁড়াতে পারছে না। আধ ঘণ্টা ধরে একই চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার পর আর নতুন কোনও পোকা বের হল না। ভালো করে ফিনাইলে ভিজিয়ে বস্তা দুটো। দিয়ে ক্ষত চাপা দিল সোমরা। তারপর অনেকগুলো ডালপালা ভেঙে হাতির সামনে ফেলে দিয়ে ভোরবেলা ফিরে এল জোতে।

নসু রায়কে সকালে সোমরা বলল, না বাবু, গিন্নিমার বাত সারবে না।

তুই ঠিক জানিস সারবে না?

হঠাৎ উল্লসিত হল নসু রায়। অবাক হয়ে গেল সোমরা। তার আশঙ্কা ছিল নসু রায় খেপে যাবে। সে মাথা নাড়ল, কাল রাত্তিরে আমি হাতিদের বলেছি, তারা কোনও ওষুধ দেয়নি।

হাতি! কাল হাতি এসেছিল নাকি?

হ্যাঁ।

নসু রায় খুব ঘাবড়ে গেল, কই, আমরা তো শব্দ পাইনি!

ওই দেখুন, ওখানে ওদের পায়খানা পড়ে আছে! বাচ্চাটার মল দেখাল সোমরা, নসু রায় অবাক। গলায় বলল, হাতিগুলো তোকে খুব মান্য করে, না?

সোমরা ঘাড় নাড়ল। নসু রায় ফিরে গেল ঘরে। একটু বাদেই টিনের ঘর থেকে নসু রায়ের বউ এর কান্না শোনা গেল। তারপরই ছুটে এল নসু রায়ের বউ, আমি কী দোষ করেছি? কী পাপ করেছি আমি? আমাকে ভগবানের বাহনের কাছে নিয়ে চলো, আমি জিজ্ঞাসা করব। না, আমি এই রোগ নিয়ে ওই বাড়িতে ফিরব না। ওই গতরখাকির মুখ দেখতে চাই না আমি।

লোক আসছে, লোক যাচ্ছে কিন্তু নসু রায় স্ত্রীকে নড়াতে পারছেন না। ওদিকে খবর আসছে হাতির দঙ্গল নাকি এই জঙ্গল ছেড়ে চলে গিয়েছে। সার দিয়ে তাদের যেতে দেখেছে ফরেস্টের বাবুরা। এর ফলে পরের দিন থেকে ভিড় কমল। নসু রায় বোঝাচ্ছিলেন, হাতি না এলে যখন কাজ হবে না তখন ফিরে চলো বাড়িতে। কিন্তু বউ-এর কথা, সে ঘরে ফিরবে না। রোজ রাত্রে সোমরা যায় জঙ্গলে। ঘা-টা আর বাড়ছেনা। একটু-একটু করে চারদিনে শুকিয়ে এল ক্ষতটা। কিন্তু চেষ্টা করেও উঠতে পারছে না হাতিটা।

পঞ্চম রাতে যখন সোমরা জঙ্গলের দিকে পা বাড়াচ্ছে, তখন সামনে এসে দাঁড়াল নসু রায়ের বউ, বাবা, আমি সঙ্গে যাব।

মানে? অবাক হয়ে গেল সোমরা।

রোজ রাত্রে দেখি তুমি চুপি-চুপি জঙ্গলে ঢুকে যাও, আজ আমি ছাড়ছি না তোমাকে!

বাবু?

সে আফিঙ খেয়ে ঘুমুচ্ছে।

আপনি হাঁটতে পারবেন না।

পারব।

শেষ পর্যন্ত অনিচ্ছা সত্বেও সোমরাকে রাজি হতে হল। অনেক কষ্টে জঙ্গল পেরিয়ে নসু রায়ের বউ গিয়ে হাজির হল হাতির সামনে। আর দেখামাত্রই দৌড়ে গিয়ে লুটিয়ে পড়ল হাতির মুখের সামনে, বাবা, আমাকে সারিয়ে দাও। আমার সংসার বাঁচাও। হাতিটা কয়েকবার শুড় নাচাল। তারপর চকিতে ওই অবস্থায় নসু রায়ের বউ-এর শরীর তুলে নিল গুঁড়ে। সোমরা চিৎকার করে উঠল। হাতিটার কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। হিংস্র আক্রোশে সে শুড় দুলিয়ে যাচ্ছে। ছুটে এল। সোমরা। লাঠি দিয়ে সেরে ওঠা ক্ষত খোঁচাতে লাগল। নতুন করে রক্ত ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে এল। হঠাৎ হাতির শরীরটা নড়ে উঠল। গুঁড়টা এলিয়ে পড়তেই নসু রায়ের বউ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। লাঠিটা  ছুঁড়ে ফেলে সোমরা নসু রায়ের বউ-এর শরীরটা সরিয়ে নিল নিরাপদ দূরত্বে। পড়ে। যাওয়ার আঘাত ছাড়া অন্য কোনও চোট লাগেনি। সে এবার হাতির দিকে তাকাতেই অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পেল। হাতিটা মুখ নামিয়েছে। ওর সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপছে। দুটো চোখ। সোমরার ওপর স্থির এবং তা থেকে জলের ধারা নেমেছে। ধীরে-ধীরে চোখ দুটো বন্ধ হয়ে গেল।

আর তখনই জ্ঞান ফিরল নসু রায়ের বউ-এর। চিৎকার করে উঠল সে আতঙ্কে। সোমরা তাকে জড়িয়ে ধরে বোঝাচ্ছিল আর ভয় নেই, হাতিটা মরে গেছে। নসু রায়ের বউ-এর ভয় তবু কমে না। সোমরা জিজ্ঞাসা করল, আপনার লাগেনি তো মা? ঠিক আছে তো?

মাথা নাড়ল নসু রায়ের বউ।

তা হলে চলুন ফিরে যাই।

কয়েক পা হাঁটতেই চিৎকার করে উঠল নসু রায়ের বউ। পাগলের মতো উল্লাস ফুটে উঠল সেই চিৎকারে। প্রথমে বুঝতে পারেনি সোমরা। সে উদগ্রীব হল, কী হয়েছে মা?

আমার হাঁটতে আর কষ্ট হচ্ছে না। দেখি লা ফাঁই তো। এই যে, আমি লাফাতে পারছি। আমার বাত সেরে গেল কী করে? নেচেদে একসা হল নসু রায়ের বউ। তারপর সোমরার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি জানতে এই করলে আমি ভালো হব, না?

না, না আমি কিছু জানি না।

ঢং, সব জানো তুমি। ঠিক আছে, সে আমি পরে বুঝব। এখন তাড়াতাড়ি ফিরে চলল। নইলে বুড়োর নেশার ঘুম ভেঙে গেলে আমাকে চরিত্রহীন ভাববে। যদ্দিন বাত ছিল, সন্দেহ ছিল না। বাত ঘুচলেই সন্দেহ শুরু হবে। আমি দ্বিতীয় পক্ষ তো! দৌড়তে লাগল নসু রায়ের বউ।

পরমুহূর্তেই চিৎকার ভেসে এল, ও মা গো, আমি হাঁটতে পারছি না, পা তুলতে পারছি না। ও বাবা গো! এ কি হল গো!

আর তখনই মৃত হাতির দিকে তাকিয়ে হাউহাউ করে কেঁদে উঠল সোমরা। কাল সকালেই সবাই জানবে হাতিটা মরে গেছে। আর ভিড় হবে না এখানে। হঠাৎ তার নজর পড়ল দুটো ভাঙা দাঁতের ওপর।

তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে সে ভাবতে লাগল রাত থাকতেই এই দাঁত দুটো কী করে খুলে ফেলা যায়?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *