ভাগ্যবন্ত
শরৎকালের আরম্ভে সাঁওতাল পরগণার প্রাকৃতিক অবস্থা বড়ই মনোরম হয়। কোনও তাপদগ্ধা সুন্দরী সায়াহ্নকালে অপর্যাপ্ত জলে সাবান মাখিয়া স্নান করিবার পর দেহে যেরূপ একটি শুচিস্নিগ্ধ লঘু প্রসন্নতা অনুভব করেন, এ যেন কতকটা সেইরূপ।
দিবা চলিয়া গিয়াছে, রাত্রি এখনও আসে নাই, মাঝের সন্ধিস্থলটি পূর্ণ করিয়া রাখিয়াছে শান্ত সোনালী একটি নিশ্চিন্ততা। এমনি সায়াহ্নে সাঁওতাল পরগণার নির্জন কঙ্করাকীর্ণ পথ দিয়া এক পথিক চলিয়াছিলেন। মাইলখানেক দূরে একটি শহর আছে, পথিকের গতি সেইদিকে। তাঁহার বয়স অনুমান পঞ্চাশ বৎসর; পরণে গেরুয়া আলখাল্লা, মুখে প্রচুর দাড়িগোঁফ, মাথায় রুক্ষ দীর্ঘ চুল—চোখের দৃষ্টিতে একটি মিষ্ট হাসি লাগিয়া আছে।
চলিতে চলিতে তিনি গুনগুন করিয়া গান গাহিতেছেন—
“আমার—কাজ ফুরলো ঘুচলো রে মোর চিন্তা!
এবার আমি গাইব রে গান নাচব তাধিন্ ধিন্তা।
কাজের বোঝা, ভাবনা-ভাবার দায়
ঠাকুর—এই রইল তোমার পায়,
এখন থেকে—খাট্বে তুমি, ভাববে তুমি,
আমি—নাচব তাধিন্ ধিন্তা।”
তাঁহাকে দেখিয়া এবং তাঁহার গান শুনিয়া মনে হয়, এই শরৎ-সন্ধ্যার মতো তিনিও অন্তরে একটি লঘু নিশ্চিন্ত প্রসন্নতা লাভ করিয়াছেন!
পথের দুইপাশে শালবন। শহরের এলাকা এখনও আরম্ভ হয় নাই। পথিক মন্থরপদে চলিতে চলিতে হঠাৎ থমকিয়া দাঁড়াইলেন, তাঁহার গানও থামিল। শালবনের ফাঁকে অপ্রত্যাশিত একটি বাড়ি—পাঁচিল দিয়া ঘেরা ছোটখাটো সুন্দর একটি বাংলো।
বাংলোর সম্মুখে বাঁধানো চাতালের উপর দুইটি ইজি-চেয়ার পাতা রহিয়াছে, তাহার একটিতে মধ্যবয়স্ক টাক মাথা একজন ভদ্রলোক বসিয়া নিবিষ্ট মনে খবরের কাগজ পড়িতেছেন।
পথিক ক্ষণেক দাঁড়াইয়া চিন্তা করিলেন। তাঁহার পা দুটি ক্লান্ত, আজ সমস্তদিন হাঁটিয়াছেন; যদি রাত্রির মতো এইখানেই আস্তানা মিলিয়া যায় মন্দ কি? তিনি ফটক খুলিয়া ভিতরে প্রবেশ করিলেন।
গৃহস্বামী খবরের কাগজে মগ্ন হইয়া গিয়াছিলেন, হঠাৎ সম্মুখে আগন্তুক দেখিয়া চমকিয়া উঠিলেন, ‘কে? কি চাই?’
পথিক সবিনয়ে বলিলেন, ‘আজ রাত্রির জন্যে আশ্রয় দেবেন কি? কাল সকালেই আমি চলে যাব।’
গৃহস্বামী ধীরে ধীরে উঠিয়া দাঁড়াইয়া বিস্ময়োৎফুল্ল নেত্রে পথিকের পানে চাহিয়া রহিলেন। এই কয়েকটি কথা শুনিয়াই তাঁহার বুঝিতে বাকি রহিল না যে, আগন্তুক ভেকধারী হইলেও আদৌ তাঁহারই সমশ্রেণীর বাঙালী ভদ্রলোক। বহুদিন অজ্ঞাতবাসের ফলে সমশ্রেণীর লোকের সহিত মেলামেশার সুযোগ তাঁহার ঘটে না। তিনি সাগ্রহে বলিলেন, ‘নিশ্চয়, নিশ্চয়! আসুন—বসুন! আপনি তো ভদ্রলোক, মশাই; সাধু-সিন্নিস্যিদের মধ্যে ভদ্রলোক বড় দেখা যায় না। মানে—’
সন্ন্যাসী ঝুলি নামাইয়া অন্য চেয়ারটির প্রান্তে বসিলেন, একটু হাসিয়া বলিলেন, ‘ভদ্রলোক ছিলাম অনেকদিন আগে, এখন ওসব হাঙ্গামা চুকে গেছে।’
গৃহস্বামী একটু অপ্রস্তুত হইয়াছিলেন, পুনশ্চ উপবেশন করিয়া বলিলেন, ‘হেঁ হেঁ,—ও হাঙ্গামা চুক্লেই ভাল। তা চায়ের অভ্যাস আছে কি?’
এখন আর নেই—তবে আপনি দিলে খাব।’
‘বেশ, বেশ। ওরে ঝড়ুয়া—’
গৃহস্বামীর হাঁকের উত্তরে, ঝড়য়া নামক সাঁওতাল ভৃত্যের পরিবর্তে একটি স্ত্রীলোক বাংলো হইতে বাহির হইয়া আসিলেন। মধ্যবয়স্কা স্ত্রীলোক, ভারিভুরি গড়ন; মুখখানি গোলাকৃতি, বড় বড় তীব্ৰ-চাহনি-যুক্ত চোখে সন্দিগ্ধ দৃষ্টি, কপালে ডগডগে সিঁদুরের ফোঁটা। তাঁহার গায়ে ভারি ভারি সোনার গহনা, পরনে চওড়াপাড় শান্তিপুরী শাড়ি। তিনি যৌবনকালে তন্বী ও রূপসী ছিলেন তাহা অনুমান করা যাইতে পারে, কিন্তু বর্তমানে মেদ ও বয়সের তলায় রূপ-লাবণ্য চাপা পড়িয়া গিয়াছে।
বাড়ির বাহিরে পা দিয়া সন্ন্যাসীকে দেখিয়াই তিনি থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িলেন, তারপর দ্রুত ফিরিয়া গিয়া বাড়ির মধ্যে ঢুকিলেন। দরজার আড়াল হইতে রুক্ষ রুষ্ট স্ত্রীকণ্ঠ শোনা গেল, ‘এসব আবার কি! মাথায় চুল নেই, কপালে তেলক। সাধু-সন্নিসি নিয়ে ঢঙ্ আরম্ভ হয়েছে—’
গৃহস্বামীর টাক ও মুখ অরুণাভ হইয়া উঠিল, তিনি ত্বরিতে উঠিয়া বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করিলেন। সন্ন্যাসী বসিয়া মিটি মিটি হাসিতে লাগিলেন, যেন তিনি মনে মনে বলিতেছেন, কৌপীনবন্তঃ খলু ভাগ্যবন্তঃ।
খানিক পরে গৃহস্বামী ফিরিয়া আসিতেই সন্ন্যাসী উঠিয়া দাঁড়াইয়া সহজ বিনয়ের কণ্ঠে বলিলেন, ‘আপনার যদি অসুবিধে হয় আমি যাচ্ছি। শহর বেশী দূর নয়, কোথাও রাত কাটিয়ে দিতে পারব।’
গোঁ-ভরে মাথা নাড়িয়া গৃহস্বামী বলিলেন, ‘না, আজ এখানেই থাকুন।—চা আসছে।’
সন্ন্যাসী আবার বসিলেন। মনে মনে আমোদ অনুভব করিলেও গৃহস্বামীর প্রতি তাঁহার অন্তরে একটু সহানুভূতিরও সঞ্চার হইল। বেচারা সংসারী! লোকটি সদাশয়, কিন্তু অন্দরমহলের প্রবল শাসনে নিজের সত্তা হারাইয়া ফেলিয়াছেন, মাঝে মাঝে বিদ্রোহ করিয়া মাথা তুলিতে চান, এই পর্যন্ত। লোকটি অবস্থাপন্ন তাহা দেখিলেই বোঝা যায়, তবে কেন লোকালয় ছাড়িয়া নির্জনে বাস করিতেছেন কে জানে! জীবনসঙ্গিনীটি সম্ভবত রণচণ্ডী খাণ্ডার—আহা বেচারা।
সোনালী সন্ধ্যা ক্রমে রূপালী রাত্রে পরিণত হইল। আজ বোধ হয় শুক্লপক্ষের অষ্টমী তিথি, মাথার উপরে আধখানা চাঁদ নীচের দিকে চাহিয়া হাসিতে লাগিল।
গৃহস্বামী গুম হইয়া বসিয়াছিলেন। ভৃত্য আসিয়া দুই পেয়ালা চা ও শালপাতার ঠোঙায় জলখাবার রাখিয়া গেল। এতক্ষণে ঈষৎ সজীব হইয়া গৃহস্বামী একটা পেয়ালা তুলিয়া লইয়া বলিলেন, ‘নিন, জলযোগ করুন।’
নীরবে জলযোগ ও চা-পান চলিতে লাগিল। বাড়ির ভিতরে তখন কেরোসিন-আলো জ্বলিয়াছে। হঠাৎ ভিতর হইতে রৈ রৈ শব্দে কে গান গাহিয়া উঠিল। প্রথমটা চমকিয়া উঠিয়া সন্ন্যাসী বুঝিলেন, সজীব মানুষের গলা নয়, কলের গান। অন্তরালবর্তিনী গ্রামোফোন বাজাইয়া বোধ করি নিজের চিত্তবিনোদন করিতেছেন।
অরণ্যানীর জ্যোৎস্না-নিষিক্ত নীরবতার উপর এ যেন পাশবিক দৌরাত্ম্য। এর চেয়ে শেয়াল-ডাকও শ্রুতিমধুর—অন্তত স্থানকালের অধিক উপযোগী। সন্ন্যাসী আড়চোখে চাহিয়া দেখিলেন, গৃহস্বামীর মুখ হতাশাপূর্ণ বিরক্তিতে কুঞ্চিত হইয়া উঠিয়াছে; সম্ভবত প্রত্যহ সন্ধ্যায় এই রেকর্ড-সঙ্গীত তাঁহাকে শুনিতে হয়।
একটু কুণ্ঠিতভাবে তিনি বলিলেন, ‘কই, আপনার বাড়িতে ছেলেপুলে—?’
‘ছেলেপুলে নেই—আমি নিঃসন্তান—’ গৃহস্বামী চায়ের খালি পেয়ালা নামাইয়া রাখিয়া নিজের চেয়ার সন্ন্যাসীর দিকে একটু সরাইয়া লইয়া বসিলেন, একটু অন্তরঙ্গভাবে প্রশ্ন করিলেন, ‘আচ্ছা, কিছু মনে করবেন না, আপনি কতদিন এই—মানে—এই গৃহত্যাগ করেছেন?’
সন্ন্যাসী চিন্তা করিয়া বলিলেন, ‘তা প্রায় বছর পঁচিশ হতে চলল।’
‘কিছু পেয়েছেন কি?’
সন্ন্যাসী একটু চুপ করিয়া বলিলেন, ‘যোগসিদ্ধি বা বিভূতির কথা যদি বলেন, তাহলে কিছু পাইনি। তবে একটা জিনিস পেয়েছি—শান্তি।’
সুদীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া গৃহস্বামী ইজি-চেয়ারের উপর চিৎ হইয়া চাঁদের পানে চাহিয়া রহিলেন। অনুমান পঁচিশ বছর আগে তাঁহার জীবনেও একটি ঘটনা ঘটিয়াছিল, তবে তাহা সন্ন্যাসগ্রহণের সম্পূর্ণ বিপরীত। তারপর প্রথম কিছুদিন মন্দ কাটে নাই। কিন্তু ক্রমে এই পঁচিশ বছরে পূষ্পমালা নিগড় হইয়া উঠিয়াছে। শান্তি! জীবনে এক মুহূর্তের জন্যও তিনি শান্তি পাইয়াছেন কি? হঠাৎ গৃহস্বামী হা হা করিয়া উচ্চকণ্ঠে হাসিয়া উঠিলেন। হাঁ, শান্তি তিনি পাইয়াছেন বৈ কি! শান্তি-নামধারিণী একটি রমণী গত পঁচিশ বছর ধরিয়া এমন দৃঢ়ভাবে তাঁহার স্কন্ধে আরোহণ করিয়া আছেন যে, কে বলিবে তিনি শান্তি পান নাই! অদৃষ্ট এমন ইতর পরিহাসও করিতে পারে!
ঘরের মধ্যে তখন গ্রামোফোনের খোনা আওয়াজে কীচক-বধ পালা অভিনয় হইতেছে।
গৃহস্বামী উঠিয়া বসিয়া ব্যঙ্গ-তিক্ত কণ্ঠে বলিলেন, ‘শুনতে পাচ্ছেন! ওদিকে কীচক-বধ শুরু হয়েছে। এদিকে আমি যে সারাজীবন ধরে কীচক-বধ হচ্ছি তা কেউ বুঝল না। কিন্তু আপনি সাধু-বৈরিগি লোক, আমার পাপতাপের কথা শুনিয়ে আপনার শান্তি নষ্ট করব না। তার চেয়ে আপনার কথাই বলুন শুনি। আপনি কেন সংসার ছাড়লেন, কি করে শান্তি পেলেন, যদি বাধা না থাকে আমায় বলুন।’
সন্ন্যাসী হাসিলেন, ‘বাধা এখন আর কিছু নেই, বরং মনে পড়লে হাসি পায়। আপনি শুনতে চান বলছি। হয়তো আমার সংসারত্যাগের কাহিনী শুনে, আমি কত বড় আঘাত কাটিয়া উঠেছি জেনে, আপনার কিছু উপকার হতে পারে।’
সন্ন্যাসী নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলিতে আরম্ভ করিলেন, ‘আজ মনে হয়, উমেশ নিয়োগী বুঝি আর কেউ ছিল; আমিই যে উমেশ নিয়োগী একথা এখন বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। দুটো মানুষ আলাদা হয়ে গেছে।’
‘উমেশ ছিল যাকে বলে মধ্যবিত্ত লোক। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাল ছাত্র ছিল, তাই একটা কলেজে দেড়শ’ টাকা মাইনের চাকরি পেয়েছিল। কলকাতাতেই থাকত।
‘উমেশের বাড়িতে এক বুড়ি মা ছিলেন। তিনিও বেশীদিন টিকলেন না, উমেশ চাকরি পাবার কিছুদিন পরেই মারা গেলেন।
‘তারপর এক সম্ভ্রান্ত বংশের মেয়ের সঙ্গে উমেশের বিয়ে হল। বংশ সম্রান্ত হলেও অবস্থা পড়ে গিয়েছিল, তাই বোধ হয় মধ্যবিত্ত উমেশের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন। মেয়েটি সুন্দরী বিদুষী—তখনকার দিনের পক্ষে আধুনিকা। একদল অভিজাত-বংশীয় তরুণ বন্ধু সর্বদা তাকে ঘিরে থাকত।
‘উমেশের মনে আনন্দে শেষ নেই; এমন স্ত্রী অনেক ভাগ্যে পাওয়া যায়। স্ত্রীর বন্ধুরা তারও বন্ধু হয়ে দাঁড়াল। যাওয়া-আসায় খাওয়া-দাওয়া পার্টি-পিকনিক চলতে লাগল। সম্রান্ত বংশের মেয়ে বলে উমেশের স্ত্রীর হাত ভারি দরাজ; বাজারে উমেশের কিছু ধার হল। কিন্তু উমেশ তা গ্রাহ্য করল না। এমনিভাবে প্রায় বছরখানেক কাটল।
‘তারপর হঠাৎ একদিন বিনামেঘে বজ্রাঘাত হল; একজন তরুণ বন্ধু উমেশের স্ত্রীকে নিয়ে উধাও হলেন।’
সন্ন্যাসী মৃদুকণ্ঠে হাসিয়া উঠিলেন। গৃহস্বামী গালে হাত দিয়া শুনিতেছিলেন, মুখ না তুলিয়াই বলিলেন, ‘তারপর?’
সন্ন্যাসী বলিলেন, ‘তারপর কিছুদিনের জন্যে উমেশ যেন পাগল হয়ে গেল, একটা ছুরি নিয়ে বন্ধুদের বাড়ি-বাড়ি চোরাই মাল খুঁজে বেড়াতে লাগল। মতলবটা এই যে, কে তার বৌ চুরি করেছে জানতে পারলেই তাকে খুন করবে। কিন্তু অভিজাত বংশীয় লোকদের মধ্যে ভারি একতা আছে, তারা কেউ কাউকে ধরিয়ে দেয় না। উমেশ তার বৌ-চোরকে খুঁজে পেলে না।
‘ক্রমে তার মনের গতি বদলে গেল। এদিকে পাওনাদারেরা টাকার তাগাদা আরম্ভ করেছিল। মানুষ জাতটার উপরেই উমেশের মন বিষিয়ে গেল; মনে হল, এমন নিষ্ঠুর পাজি জাত আর নেই। একদিন গভীর রাত্রে লোটা কম্বল নিয়ে সে বেরিয়ে পড়ল।’
‘তারপর?’
‘তারপর আর কি? পঁচিশ বছর ধরে সারা ভারতবর্ষ ঘুরে বেড়িয়েছি। অনেক সাধু-মহাজনের দর্শন পেয়েছি। সাধন ভজন বিশেষ কিছু করিনি, কিন্তু তবু বড় আনন্দে আছি। অভাব যে মানুষের কতটুকু, তা সংসার না ছাড়লে বোঝা যায় না। এতটুক সংযমের বিনিময়ে কতখানি আনন্দ পাওয়া যায়, একফোঁটা আত্মত্যাগের বদলে কি বিপুল শান্তি পাওয়া যায়—তা আপনাকে কি করে বোঝাব? আমার কোনও অভাব নেই—আমি বড় আনন্দময় শান্তি পেয়েছি। গৃহী-জীবনের কথা আর মনে পড়ে না—পড়লেও আর কষ্ট হয় না।’
আহারাদির পর সন্ন্যাসী একটি ছোট কুঠুরিতে শয়ন করিলেন। বিছানাটি ভারি নরম, এত নরম বিছানায় সন্ন্যাসী অনেকদিন শয়ন করেন নাই; তিনি অবিলম্বে গভীর নিদ্রায় অভিভূত হইয়া পড়িলেন।
প্রত্যুষে ঘুম ভাঙিয়া সন্ন্যাসী দেখিলেন, শয্যার পাশে একটি চিঠি রাখা রহিয়াছে। তিনি চিঠি খুলিয়া পড়িলেন,—
ভাই উমেশ,
তুমি কাল যে গল্প বলেছিলে তাতে একটু ভুল ছিল। তোমার স্ত্রীকে কেউ চুরি করেনি, তোমার স্ত্রীই তোমার এক বন্ধুকে চুরি করে নিয়ে পালিয়েছিলেন। সে বন্ধুটি আমি।
তুমি আমাদের চিনতে পারনি, তাতে আশ্চর্য হইনি, আমাদের সকলেরই চেহারা বদ্লে গেছে। গল্প শুনে তোমাকে চিনতে পারলুম। তুমি ভাগ্যবান পুরুষ, তোমাকে নমস্কার।
তোমার স্ত্রীর মতো এমন ভয়ানক দজ্জাল, সন্দিগ্ধমনা, স্বার্থপর স্ত্রীলোক পৃথিবীতে আর আছে কিনা আমি জানি না, কারণ অন্য কোনও স্ত্রীলোকের প্রকৃতি জানবার সুযোগ আমার ঘটেনি। দুনিয়ার লোক আমাকে লম্পট দুশ্চরিত্র বলেই জানে, তাদের চোখে আমি পরস্ত্রী-হরণকারী। কিন্তু ভগবান জানেন, আমার মতো একনিষ্ঠ সচ্চরিত্র পুরুষ আর নেই। জীবনে একটা ভুল করেছিলুম, তার জন্য সমাজ ছেড়েছি, সংসার ছেড়েছি, সন্তানসুখের আশা ছেড়েছি, আমার সমস্ত বিষয় সম্পত্তি তোমার স্ত্রীর নামে লিখে দিয়েছি। সর্বশেষে তার সন্দেহের জ্বালায় এই বনের মধ্যে বাস করছি। ভাই, আমার যথেষ্ট প্রায়শ্চিত্ত হয়েছে, আর না। এবার তোমার সম্পত্তি তুমি নাও। আমি চললুম।
তোমাকে দেখে তোমার কথা শুনে আমার বিশ্বাস হয়েছে যে তুমি শান্তি পেয়েছ; তাই আমারও লোভ হয়েছে চেষ্টা করে দেখি যদি শান্তি পাই। পঁচিশ বছর তোমার ‘শান্তি’কে বহন করবার পর এ অধিকার আমার জন্মেছে—আশা করি তুমি স্বীকার করবে।
তোমার আলখাল্লা আর ঝুলিটা নিয়ে চললুম, কিছু মনে কোরো না।
তোমার ধনপতি
১৮ কার্তিক ১৩৫৩