ভাগের অংশ
ছাইদানিতে একটা বিড়ির টুকরো দেখে দীপ্তিময় তার বউ রমাকে ডেকে জিগ্যেস করল–‘কে এসেছিল বলো তো! বিড়ি খায় এমন লোক কে!’
রমা বলল , ‘তোমার ফুলকাকা। তুমি অফিসে যাওয়ার একটু পরেই এসেছিল, বলে গেছে আবার আসবে কয়েকদিন পর।’
‘ফুলকাকা!’ ভ্রূ কুঁচকে ফুলপ্যান্টের বোতাম খুলতে–খুলতে দীপ্তিময় বলল , ‘কই, ফুলকাকা বলে কেউ ছিল এমন তো মনে পড়ছে না! কেমন লোক?
রমা একটু মুশকিলে পড়ল, ইতস্তত করে বলে, ‘বলল তো আমি দীপুর ফুলকাকা’ তোমার ওরকম কাউকে মনে পড়ছে না?’
মাথা নাড়ে দীপ্তিময়, ‘ফুলকাকা বলে কেউ ছিলই না। লোকটাকে কেমন দেখলে?’
‘রোগা, বুড়ো, গরিব। মনে রাখার মতো চেহারা নয়, রাস্তার ভিড়ে আবার দেখলে চিনতেই পারব না।’
‘আশ্চর্য! কিছু নিয়ে টিয়ে যায়নি তো! লোকটা চলে যাওয়ার পর ঘরটর ভালো করে দেখেছ?’
রমা বলে, ‘বাইরের ঘরে নিয়ে যাওয়ার মতো জিনিস আর কিই বা আছে! মিনিট কুড়ি ছিল মাত্র, তাও ওই ঘরেই। বলল বউমা চা খাওয়াও।’
‘খাওয়ালে?’ ‘খাওয়াব না কেন! চা আর বিস্কুট দিলাম।’
‘আর কিছু চাইল না?’
‘চাইল আট আনা পয়সা।
‘দিলে?’
‘দিলাম। গরিব মানুষ। বলল –রাস্তাখরচ নেই, হালতু থেকে এই উত্তরপাড়া পর্যন্ত এসেছে তোমার খোঁজ করতে। দিয়ে দিলাম আট আনা।’
দীপ্তিময় সামান্য অন্যমনস্ক থাকল, তারপর বলল , ‘সাবধানে থেকো। আমাদের চারপাশে অনেক ফুলকাকা। অচেনা লোককে হুট করে ঘরে ঢুকতে দিও না।’
রমাকে লোকটা ঠকিয়ে গেছে এমনটা রমার মনে হচ্ছিল না। সে বলল , ‘দ্যাখো লোকটা যে তোমার আত্মীয় নয় তা বোঝার কোনও উপায় ছিল না। সে তোমাদের বাড়ির অনেকের নাম জানে, চেনে। সেজভাশুরের সঙ্গে এক কলেজে পড়েছে, তখন তোমাদের ঢাকার বাড়িতেও গেছে অনেকবার। বলল তোমাকে ছোট্ট দেখেছিল। নানা কথার মধ্যে এও বলল যে তোমার কোমরে একটা ফোঁড়া অপারেশন হয়েছিল ছেলেবেলায়। সে সময়ে উনিই তোমাকে কোলে করেছিলেন, আর পুঁজে–রক্তে তার জামাকাপড় ভরে গিয়েছিল।’
ঘরে পরার পায়জামাটা কোমর পর্যন্ত টেনে দড়ি আটকাতে গিয়ে দীপ্তিময়ের হাত থেমে রইল, বলল , ‘আশ্চর্য! তবে কি আমারই ভুল হচ্ছে! ঢাকায় আমি জন্মের পর তেরো–চোদ্দো বছর কাটিয়েছি, কাজেই সব ভুলে যাওয়ার কথা নয় রমা। কিন্তু ফুলকাকা যে কে কিছুতেই মনে পড়ছে তো! সেই ফোঁড়াকাটার দাগ দ্যাখো না, এখনও কোমরে আছে।’
‘আমি তো জানি।’ রমা বলল ।
‘লোকটা ঠিকই বলেছে। অথচ আমার তো মনে পড়ছে না ওরকম কাউকে।’
রমা এবারে হাসল, ‘আমি খুব বোকাসোকা ভালোমানুষ তো নই। কাজেই যাকে তাকে বিশ্বাস করি না। এ লোকটা ঠিক জোচ্চর হতে পারে, তবে তোমাদের চেনে ঠিকই। বলে গেছে। আবার আসবে, যদি আসে তবে হয়তো সামনাসামনি দেখলে তুমি চিনতে পারবে।’
‘এসেছিল কেন?’
“ঠিক বুঝলাম না। হাবভাব দেখে মনে হল কোনও মুশকিলে পড়েছে। হয়তো তোমার কাছে। কিছু সাহায্য চাইতে পারে। আমার কাছে আট আনার বেশি চায়নি।’
দীপ্তিময় আবার ভ্রূ কোঁচকালো। সাহায্য করতে-করতে জীবন গেল। পথে ঘাটে অফিসে ঘরে সব জায়গায় কেবল হাত-পাতা মানুষ। ভালো লাগেনা!
‘তোমার আছে বলেই মানুষ চায়!’
কথাটা বলেই রমা একটু হাসল। দীপ্তিময় তার শ্যামলা মিষ্টি চেহারার বউটির দিকে তাকিয়ে
একটু কিছু বলবে বলে ঠিক করেছিল, তখনই রমা ‘তোমার চা–টা নিয়ে আসি’ বলে চলে গেল।
তখন ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে বসল দীপ্তিময়। রোজই বসে। তারপর চা খেয়ে হাতমুখ ধোয়, তারপর আবার চা খাবার খায়। বসে দীপ্তিময় রমার কথাটাই একটু-একটু ভাবল। তোমার আছে বলেই মানুষ চায়। অর্থাৎ রমা–তার বউ লক্ষ করছে যে তার অনেক আছে। ভেবে একটু শ্বাস ছাড়ে সে। আছে যে সেটা মিথ্যে নয়। আবার খুব বলার মতোও কিছু না। যা আছে তার সবটুকু কি সে উপার্জন করেনি? হাড়ভাঙা খাটুনি, একরোখা ধৈর্য। অধ্যবসায়–এসবের মূল্যেই সে যা কিছু অর্জন করেছে তাও সেটা খুব বেশি কিছু না। তবে একথা ঠিক যে, সে একটু তাড়াতাড়ি টাকা করেছে, যেটা পারেনি তার অন্য বন্ধুরা। আত্মীয়েরাও গরিব রয়ে গেছে। অথচ মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর বয়সেই সে উত্তরপাড়ায় একটি সুন্দর বাড়ির মালিক। কলকাতার ওপরে কিছু জমি কিনল কয়েকদিন আগে রমার নামে, নতুন একটা বিমাও করেছে সে। আরও অনেক কিছু করার স্থির একটা লক্ষও আছে তার। সময়ে সব হবে সে জানে। এসব নিশ্চয়ই রমারও স্বস্তির কারণ! তবে কেন রমা লক্ষ করেছে যে তার অনেক আছে!
দীপ্তিময় সহজে রাগে না, উত্তেজিত হয় না। তার স্বভাব ঠান্ডা, সে ধৈর্যশীল। তাদের স্বামী স্ত্রীর মধ্যে ঘোর যৌবনেও মান–অভিমানের খেলা খুব কম হয়েছে। কম হয়েছে দীপ্তিময়ের জন্যই। কেননা সুখে থাকা, আর সাফল্যের ব্যাপারটা নিয়েই তার সব ভাবনাচিন্তা। অনেক সময়েই রমার সূক্ষ্ম ভাবপ্রবণতাগুলো সে এড়িয়ে গেছে। আজও এড়াতে পারত। কিন্তু ফুলকাকা পরিচয় দিয়ে যে লোকটা আজ এসেছিল, তার বর্ণনা দিতে গিয়ে রমা বড় সহৃদয় হয়ে পড়েছিল। লোকটা নির্লজ্জের মতো চেয়ে চা খেয়েছে, পয়সা নিয়ে গেছে, তবু তার প্রতি একটু রাগ নেই কেন রমার?
তাই রমা চায়ে চামচ নাড়াতে–নাড়াতে যখন ঘরে ঢুকল তখন রমার দিকে স্থির চোখে চেয়ে রইল দীপ্তিময়। রমার মুখ নির্লিপ্ত, চায়ের কাপে মনোযোগী চোখ, সংসারের নানা কাজের চিন্তায় সে অন্যমনস্ক। চা দিয়ে চলে যাওয়ার সময়ে রমাকে সে ডাকল, ‘শুনে যাও একটা কথা।’
‘কী!’ বলে রমা চৌকাঠ থেকে ফিরে তাকায়!
‘তুমি কি কমিউনিস্ট?’
একটু থতমত খেয়ে রমা হেসে ফেলল। ‘ও কি কথা! কেন গো?’
দীপ্তিময় একটু সামলে গেল, বলল , ‘না! এমনিই, তুমি কাজে যাও।’
‘আচ্ছা মানুষ! আমি কমিউনিস্ট হতে যাব কেন! ওসব কি আমি বুঝি?’
‘ঠিক কথা! বড়লোকের বউয়ের ওসব হতে নেই।’ বলে দীপ্তিময় হাসে। সরল অকপট হাসি।
রমা দরজায় দাঁড়িয়ে একটু ইতস্তত করে, তারপর হঠাৎ বলে, ‘বাড়ির মঙ্গলের জন্য মানুষকে দিতে থুতে হয়। নইলে শাপ লাগে।’
রমা একথা বলেই চলে গেল।
দীপ্তিময় জানে রমা বুদ্ধিমতী। হয়তো রমা তার প্রশ্নটার নিহিত উদ্দেশ্য আন্দাজ করে নিয়েছে। চায়ে চুমুক দেওয়ার আগে চোখের সামনে কাপটা একটুক্ষণ ধরল দীপ্তিময়, ঠিক মাঝখানে ছোট্ট এক বিন্দু ফেনাকে ঘিরে একটু ঘূর্ণি। এক কণা সর ভাসছে। অন্যমনে দীপ্তিময় চেয়ে থাকে।
পরদিনটা ছুটি।
.
দীপ্তিময় তার সাত বছরের মেয়ে বুবুন আর ছয় বছরের ছেলে পিন্টুকে নিয়ে সকাল থেকেই বাগানের কাজে লাগল। প্রায় দশ কাঠা জমি নিয়ে বাড়ির ঘের। সবটাই পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। পাঁচিলের ধার ঘেঁষে ঋজু ঋজু নারিকেল আর সুপুরির চারা, চারটে আম, দুটো কাঁঠাল, একটা নিম দুটো পেয়ারার গাছ। তা ছাড়াও ছুটকো গাছ অনেক, আর আছে সুন্দর সবজির খেত। শীতকাল বলে মুলো, পালং, মটরশাক, কপি আর লাউয়ের মাচার চারপাশে উজ্জ্বল সবুজ আলো হয়ে আছে। এসব দেখাশোনা করার জন্য দুজন লোক আছে। তারা দীপ্তিময়ের বাগান দেখে, দুটো গরুর দেখাশোনা করে, গোয়াল পরিষ্কার রাখে। দীপ্তিময়রা বাগানের সবজি খায়। বারোমাস, ঘরের গরুর দুধ খায়। এর জন্য দীপ্তিময়ের বড় তৃপ্তি।
বুবুন আর পিন্টু ইচ্ছেমতো চারাগাছ লাগাল খানিকক্ষণ, এখানে ওখানে মাটি খুঁড়ল, জল দিল, তারপর দুজনে চোর-চোর খেলতে গাছপালার মধ্যে চলে গেল কোথায়। দীপ্তিময় তার দুজন মাইনে করা লোকের সঙ্গে দেখল ঘুরে-ঘুরে। দেখল গোয়ালঘরের চালের ওপর এই শীতে লকলকিয়ে উঠেছে সতেজ লাউডগা। সবুজ পদ্মফুলের মতো পাতাগুলো উত্তুরে হাওয়ায় দোল খাচ্ছে। দীপ্তিময় দেখল বড় বেশি বাড়ন হয়েছে গাছটার, ফলন ভালো হবে না। দা হাতে দীপ্তিময় ডগা কাটবার জন্য চালের ওপর উঠল। তারপর মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইল তার দশ কাঠা জমিওয়ালা সুন্দর বাড়িটার দিকে। দক্ষিণমুখো বাড়ি তার, সামনের বারান্দা লোহার গ্রিল দিয়ে ঘেরা, বড় জানালাও চারখানা মাঝারি ঘর, দোতলা হবে বলে ছাদের ওপর উঁচু হয়ে আছে লোহার শিকের গুচ্ছ। একদিন দোতলা হবে যখন তার সংসারে লোক বাড়বে। অবশ্য আপাতত লোক বাড়বার সম্ভাবনা নেই, দুটো বাচ্চা আর রমা, আর বুড়ি বিধবা মা। রমা আর ছেলেমেয়ে চায় না। দোতলাটা এখনও অনিশ্চিত। বয়স যখন বাড়বে তখন ওখানে দুটো ঘর করবে দীপ্তিময়। আর থাকবে অনেকখানি খোলা জায়গা। ইজিচেয়ারে শুয়ে দীপ্তিময় অনেকদূরে চেয়ে থাকবে। দীপ্তিময় বাগানের দিকে চোখ ফেরাল। গাছগাছালিতে কেমন নিবিড় ছায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে তার বাগান, পাখিপাখালির ডাক শোনা যায়, আর পোকা ওড়ার শব্দ। নিমগাছের উঁচু ডালে চাক গড়ছে মৌমাছি। গোয়াল ঘরের চালে সতেজ লাউডগা আর পাতার মধ্যে বসে দীপ্তিময় এক রহস্যময় আনন্দকে টের পেল। বাইরের দিকে দেওয়ালের পাশ ঘেঁষেই রাস্তা। সেদিকে চোখ ফেরালে দেখা যায় লোকজন হেঁটে যাচ্ছে, মানুষজনের চোখের আড়ালে দেওয়ালঘেরা তার সুন্দর বাড়ি আর বাগান। বড় তৃপ্তি। বাইরের পৃথিবী থেকে সে আলাদা করে নিয়েছে নিজের ছোট্ট একটু আলাদা পৃথিবী। এ সবই তার। তার নিজের। ওই বাড়ি, ওই গাছগাছালি, ওই পাখি কিংবা মৌমাছি এরা সবাই তার আপন, নিজস্ব। দেওয়ালের ওপাশে মানুষেরা হেঁটে যাচ্ছে। ওরা বাইরের মানুষ, দূরের। দীপ্তিময় চেয়ে–চেয়ে দেখল অনেকক্ষণ। তারপর পিন্টু ছুটে এসে নীচে থেকে দু-হাত বাড়িয়ে চিৎকার করে বলল , ‘বাবা, আমি চালে উঠবও-ও। আমাকে তুলে নাও।’ দীপ্তিময় হেসে ডগাপাতা কেটে তার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলল , ‘মায়ের কাছে রান্নাঘরে নিয়ে যাও। মাকে বলল বাবা বলেছে মুগের ডাল ছড়িয়ে রান্না করতে।’
কাঁঠাল গাছের তলায় পরিষ্কার জায়গায় একখানা চেয়ার পাতা। তার ওপর খবরের কাগজ। দীপ্তিময় বসে কাগজ খুলল। কিন্তু পড়ল না। চেয়ে রইল। বাড়িখানা আর একটু বড় হলে একটা পুকুর কাটত দীপ্তিময়, মাছ ছেড়ে দিত। আরও গোটা দুই ছেলেমেয়ে হলে বাড়িটা আরও একটু জমজমে হত। কত কিছু চিন্তা যে মাথার মধ্যে সারাদিন আসে যায়! দীপ্তিময় স্বপ্ন দেখে। কলতলার পাশে বাঁধানো গোলচত্বরে থালায় বড়ি শুকোতে দিয়ে ঘর রোদে জবুথুবু হয়ে মা বসে আছে। সাদা ঘোমটায় মুখ ঢাকা। মায়ের সঙ্গে আজকাল আর ভালো করে দেখাসাক্ষাৎ হয়ই না, কথাবার্তাও হয় খুবই কম। বয়সের সঙ্গে-সঙ্গে মার স্মৃতিভ্রংশ হয়েছে অনেক, কথাবার্তারও তাল থাকে না। মাকে দেখছিল দীপ্তিময়। সারা শরীর সাদা থানে ঢাকা। মুখ দেখা যায় না। হঠাৎ তার খেয়াল হল মাকে একবার জিগ্যেস করলে হয় ফুলকাকা নামে কাউকে মা চিনত কিনা। যদিও দীপ্তিময় জানে যে মা চিনবেন না। তার বড় দাদা মঙ্গলময় কাঁচড়াপাড়ায় থাকে, মাঝে-মাঝে এসে দেখা করে যায়, মা তাকেও প্রথমটায় ভালো চিনতে পারে না। এমন সুন্দর সাজানো বাড়ি তার, কিন্তু মা বাড়ির কোনকিছুই ভালো করে দেখে না। ভ্যাবলা চোখে চেয়ে থাকে।
বুবুন এসে চা দিয়ে গেল। দীপ্তিময় চা খেতে-খেতে ভাবল, ফুলকাকা যদি তাদের পরিবারের চেনা কেউই হবে তবে সে এসে মায়ের খোঁজ করেনি কেন? তাদের দেশের লোকেরা এটাই পুরোনো স্বভাব, সকলের খোঁজ নেওয়া, চেনাজানা আত্মীয়দের খুঁজে বের করা। লোকটা মার খোঁজ নেয়নি, নিলে রমা তাকে বলত। তার মানে খোঁজখবর সে পছন্দ করে না। রমা হয়তো ভাবে যে, সে অসম্ভব হিসেবি, লোভী কিংবা কৃপণ। কিন্তু দীপ্তিময় জানে যে, সে অদয়ালুও নয়। সে সাধ্যমতো ভিক্ষে দেয়, লোকে বিপদে–আপদে পড়লে দেখে, অনেক চেনাজানা লোক এবং ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আত্মীয়দের খোঁজখবর নেয়। কিন্তু সে কখনও ঠকে যেতে চায় না। রমাকে বাইরের জগতের সঙ্গে লড়াই করতে হয় না বলেই বোধহয় এসব সে ঠিক বোঝে না।
.
দুপুরে খেয়ে একটু ঘুমিয়েছিল দীপ্তিময়। বুবুন এসে ডাকল, ‘বাবা ওঠো তোমাকে একজন। ডাকছে।’ দীপ্তিময় জেগে দেখল বেলা পড়ে এসেছে। প্রায় অন্ধকার হয়ে এল। দুপুরে ঘুমোলে শরীর ভালো লাগে না। তারও শরীর অবশ লাগছিল। উঠে চোখে–মুখে জল দিল দীপ্তিময়। রমা উঠোনের তার থেকে জামা–কাপড় তুলছে। তাকে বলল দীপ্তিময়, ‘চা করো। বাইরে লোক এসেছে।’
বাইরের ঘরে এসে দেখল আলো জ্বালানো হয়নি। পশ্চিমের খোলা জানলা দিয়ে চমৎকার অদ্ভুত লাল একটা আলো এসে ঘরে পড়েছে। ঘরখানা যেন জ্বলছে সে আলোয়। দরজার দিকে পিঠ করে কুঁজো হয়ে বসে আছে, একজন লোক, তার ঘাড়ে চাদর হাতে লাঠি। মুখোমুখি হতেই দীপ্তিময় দেখল লোকটার চোখে ঘরের আলোর আভা পড়েছে। রাঙা দেখাচ্ছে দুখানা খুদে চোখ। ভাঙা চোয়ালে সদ্য দাড়ি কামানোর চকচকে ভাব, অযত্নের গোঁফ শুয়োপোকার মতো দেখাচ্ছে। পাতলা নাকখানা একটু বাঁকা, মাথায় অনেক কাঁচাপাকা চুল। সেই চুল ঘাড় পর্যন্ত লম্বা। গায়ে। সাদা শার্ট, পরনে ধুতি। লোকটার বয়স পঞ্চাশ আর ষাটের মাঝামাঝি। মুখে দারিদ্র্য আর দুশ্চিন্তার ছাপ। কিন্তু তাকানোর ভঙ্গিতে কোনও বিনয় বা দীনতা নেই। দীপ্তিময়কে দেখে সোজা হয়ে বসল–‘তুমি দীপু, না?’
দীপ্তিময় বলল , ‘হ্যাঁ, আমি দীপ্তিময়।’
দীপ্তিময় লক্ষ করল লোকটার হঠাৎ সোজা হয়ে বসার মধ্যে একটা তেজের ভঙ্গি আছে। এককালে লোকটি খুবই দাম্ভিক আর দাপুটে ছিল। এখন হয়তো সংসারের নানা ধাক্কায় খানিকটা দুর্বল হয়ে গেছে।
লোকটি হেসে বলল –’আমাকে তোমার মনে নেই। একসময়ে তোমাদের ঢাকার বাড়িতে আমি যেতাম। তোমরা আমাকে ফুলকাকা বলে ডাকতে।’
একটু অবাক হল দীপ্তিময়। ফুলকাকা বলতে যে মাগুনে চেহারার একটা লোককে ভেবে রেখেছিল সে, এ ঠিক তেমন নয়। যদিও রোগা, বুড়ো এবং চেহারা আর পোশাকে বেশ গরিব, তবু রমার বর্ণনার সঙ্গে অনেকটা তফাত তার চোখে পড়ল। তফাতটা কী বা কেমন তা সে পরিষ্কার বুঝতে পারল না। তবু আছে। লোকটাকে ভালো করে দেখার জন্য সে বাতি জ্বেলে দিল। মুখোমুখি বসল। তারপর বলল , ‘রমা–আমার স্ত্রী বলছিল। কিন্তু আমার ঠিক মনে পড়ছে না।’
‘আমার নাম হরেন গাঙ্গুলি। তোমার জ্যাঠতুতো দাদা রতনের সঙ্গে আমি জগন্নাথ কলেজে কিছুদিন পড়েছি। তখন স্বদেশি যুগ, তাই আমার বেশিদূর পড়া হয়নি।’
লোকটা গাঙ্গুলি–অর্থাৎ ব্রাহ্মণ জেনে দীপ্তিময় একবার ভাবল, উঠে একটা প্রণাম করবে কিনা। তারপর দ্বিধায় পড়ে বসেই রইল। লোকটাকে সত্যিই তার মনে নেই। সে বলল , ‘সেজদা আমার চেয়ে অনেক বড় ছিলেন। প্রায় বাইশ বছরের বড়।’
লোকটা মাথা নাড়ল–’অন্য সম্পর্কে আমি তোমার কাকা। তোমরা আজকালকার ছেলে, সেসব গোলমেলে সম্পর্ক ঠিক বুঝবে না। তা ছাড়া ও সম্পর্কের আর কোনও জোর নেই। আমাদের অনেক আপন পর হয়ে গেছে।’
দীপ্তিময়ের মনে হল লোকটা সত্যিই বড় দুঃখিত হয়ে পড়ছে সম্পর্কের দুর্বলতার কথা ভেবে। সে বিরক্ত বোধ করছিল একটু। পুরোনো আমলের কথা, সম্পর্কের কথা একবার শুরু হলে সহজে থামতে চায় না। সে সহজ স্পষ্টভাবে বোঝে যে, এ লোকটার সঙ্গে তার কোনও সম্পর্কই সত্যিকারের নেই, কেবলমাত্র একই সমাজে বসবাসকারী ছাড়া। আত্মীয়তার জটিলতা এবং তার প্রয়োজন দীপ্তিময় কখনও বোঝে না। সে ধীরে ধীরে বলল –’আমার কিছুই অবশ্য জানা নেই। মনেই নেই।’
লোকটা মাথা নাড়ল—’ঠিকই তো। গতকাল রাঙা বউদিকে প্রণাম করে যাব, কথা বলে যাব ইচ্ছে ছিল। কিন্তু বউমা বলল , উনি কাউকেই এখন চিনতে পারেন না। কথা বললে বিব্রত হন। তাই আমি আর তাঁর সঙ্গে দেখা করিনি। উনি সুস্থ থাকলে ঠিক চিনতে পারতেন।’
দীপ্তিময় এবার হাসল–’না চিনলেই বা কি? আপনি যা বলছেন তা তো আর মিথ্যে নয়।’
দীপ্তিময়ের কথাটুকুর মধ্যে একটা কিছু ছিল যাতে লোকটা একটু চুপ করে রইল! তারপর আস্তে-আস্তে বলল ,–’না, মিথ্যে নয়। আজকাল অবশ্য অনেকে নকল পরিচয় দিয়ে ঘুরে বেড়ায়।’
দীপ্তিময় এ কথার উত্তর দিল না। চেয়ে রইল। লোকটা হঠাৎ ময়লা একটা রুমাল বের করে মুখটা মুছল, চোখের কোণে একটু চেপে রাখল রুমালটা, তারপর সরিয়ে নিল। তার চোখের নীচের জায়গাটা ফোলা–ফোলা। মুখে অনেক ভাঁজ আর দাগ। লোকটা হাসল একটু–’তোমাকে আমি অনেক কোলে নিয়েছি। তুমি ছেলেবেলায় দেখতে বড় সুন্দর ছিলে। মেয়েদের মতো এক গা গয়না পরিয়ে রাখা হত তোমাকে।’
সেই কবেকার দীপ্তিময়কে মনে করতে গিয়ে লোকটা অন্যমনস্ক রইল একটু। তারপর অন্যমনে বলল , ‘তখন তোমাদের টিকাটুলির বাসায় মাঝে-মাঝে যেতাম। তারপর স্বদেশি করার জন্য জেলে চলে যেতে হল। আমার ওপর অনেক অত্যাচার হয়েছে।’ বলেই সে হাসল, ‘আমিও, অবশ্য লোকের ওপর কম অত্যাচার করিনি।’
দীপ্তিময়ের একটা সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছিল। হরেন গাঙ্গুলির সামনে সেটা খাওয়া ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছিল না। যদিও একে সমীহ করার সত্যিই কোনও মানে হয় না। নিতান্তই তুচ্ছ লোকটা। অসফল। তাছাড়া সম্পর্কেও যে তেমন কিছু নয় তা বোঝা যাচ্ছে। তবু সে সিগারেটের প্যাকেট আর দেশলাই বের করে হাতের মধ্যে নাড়াচাড়া করল। লোকটা সেদিকে চেয়েও দেখল না।
দীপ্তিময় হঠাৎ জিগ্যেস করল, ‘আমার ঠিকানা কোথায় পেলেন?’
লোকটি–হরেন গাঙ্গুলি একটু লাজুক হাসল, ‘তোমার ঠিকানা পাওয়া তো শক্ত কিছু নয়। কলকাতায় অনেকে চেনে, যাদবপুরে তোমার মেজপিসিমা থাকেন, আমি তাঁর কাছে মাঝে-মাঝে যাই। তিনি প্রথম তোমার খোঁজ দেন। তারপর তোমার অফিসেও একদিন গিয়েছিলাম। তোমার দেখা পাইনি। তারপর ভাবলাম অফিসের চেয়ে বাসায় দেখা করাটাই ভালো; অফিসে তো তোমার কথা বলার বা শোনার সময় হবে না!’
‘কথাটা কী?’ দীপ্তিময় মৃদু গলায় জিগ্যেস করল। ছোট্ট প্রশ্ন, কিন্তু তাতেই ঘরে একটা স্তব্ধতা তৈরি হয়ে গেল। লোকটা চোখ নিচু করে রইল একটুক্ষণ।
দু’হাতে ধরা লাঠিটার কাছ বরাবর মাথা নেমে এল। দু-হাতে চায়ের কাপ নিয়ে ঘরে ঢুকল। রমা, মাথায় বড় ঘোমা, পিছনে বুবুন, তার হাতে বিস্কুটের প্লেট, লোকটা মাথা নুইয়ে ছিল, তার সামনে চায়ের কাপ রেখে রমা একবার দীপ্তিময়ের দিকে চাইল। তারপর লোকটাকে বলল , ফুলকাকা, আপনার চা। সোজা হয়ে বসল হরেন গাঙ্গুলি–’এই যে বউমা, আজই চলে এলাম। ছুটির দিন। নইলে তো দীপুকে পাওয়া যেত না।’
‘বেশ করেছেন।’
লোকটা হাসল, ‘ওর আমাকে মনে নেই। থাকার কথাও নয়। সম্পর্ক তো তেমন কিছু ছিল না, যারা চিনত আমাকে তারা তো সব কে কোথায় ছড়িয়ে রয়েছে।’
অপ্রাসঙ্গিক কথা, দীপ্তিময় বিরক্ত হল, চোখের ইঙ্গিত করে রমাকে চলে যেতে বলল !
রমা হেসে বলল , ‘আপনারা কথা বলুন। আমি আসি।’
রমা চলে গেলে হরেন গাঙ্গুলি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সোজা হয়ে বসল, দীপ্তিময়ের দিকে সোজা তাকিয়ে বলল , ‘আমার বড় অভাব চলছে দীপু। এই বুড়ো বয়সে আমি দুবেলা খেতে পাই না।’
দীপ্তিময় সোজা লোকটার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। দেশজোড়া খিদের গল্প। দীপ্তিময় অনেক শুনেছে। তাই তার কোনও ভাবান্তর হল না, সে সহজ চোখেই চেয়ে রইল।
হরেন গাঙ্গুলি আবার বলল , ‘বেশি বয়সে বিয়ে করেছিলাম। আমার দুটো ছেলে নাবালক, মেয়ের বয়স ষোলো। রোজগার বলতে গেলে কিছুই করি না। সংসারে অচল। অত সব তোমার শুনে কাজ নেই। তোমার ভালোও লাগবে না। আমি তোমার কাছে কিছু ভিক্ষে চাইতে এসেছি।’
সিগারেট ধরাতে দীপ্তিময়ের আর কোনও বাধা রইল না। এখন আর লোকটাকে শ্রদ্ধা না করলেও চলে। কেননা লোকটা ভিক্ষে চাইছে। দীপ্তিময় সিগারেটটা টেবিলে ঠুকে জ্বালিয়ে নিল, লোকটা চেয়ে রইল।
দীপ্তিময় বলল , ‘আপনি কী করেন?’
‘একটা দোকান ছিল হালতুতে। মালপত্র কিনতে পারি না বলে সেটা প্রায় উঠে যাচ্ছে। সস্তা জিনিসপত্র বেচি। চলে না। এসব করার তো কোনও অভ্যাস নেই।’
দীপ্তিময় হঠাৎ বলল , ‘আমার খোঁজ না পেলে কী করতেন?
লোকটা চুপ করে কিছুক্ষণ তার কথার অর্থ বুঝবার চেষ্টা করল। তারপর বলল , ‘ভগবান তোমার খোঁজ দিয়েছেন। যোগাযোগের ওপরেই তো পৃথিবী চলছে।’
দীপ্তিময় হাসে। ‘আমারও কিন্তু এক সময়ে অভাব ছিল। সেসব দিনে আমি কারও কাছে, কোনও আত্মীয়ের কাছে গিয়ে ভিক্ষে করিনি। আমি যা করেছি সব নিজের পরিশ্রমে।’
লোকটা তাড়াতাড়ি বলল , ‘তা তো বটেই।’ তারপর একটু ফাঁক দিয়ে বলল , ‘তবে তোমার বয়স সহায় ছিল, আর ছিল ভাগ্য।’
দীপ্তিময় হেসে বলল , ‘দেশের কাজ করেছেন, কিন্তু নিজের কথা ভাবেননি? দেশ কি পরিবার ছাড়া?’
হরেন গাঙ্গুলি ম্লান হাসে, ‘ঠিক কথা। দেশের কাজ যে খুব একটা করতে পেরেছি তা নয়। কেবল অনেকদিন জেল খেটেছি, মার খেয়েছি। তবে সেসবের মধ্যেও একটা কিছু করেছি বোধ। হয়। আমরা নিজের জন্য কম ভাবতাম।’
‘কিন্তু এখন তো ভাবতে হচ্ছে। আপনি ভাগ্যের কথা বললেন, আমি কিন্তু ভাগ্য বলতে পরিশ্রম বুঝি।’
‘ঠিক।’ হরেন গাঙ্গুলি বুঝদারের মতো মাথা নাড়ে, ‘নিজের ভাগ্য বলতে আমরা কিছু বুঝতাম, দেশের ভাগ্য ফিরলে সকলের সঙ্গে আমারও ফিরবে। দীপু, আমরা ছেলেবেলায় যৌথ পরিবার দেখেছি, সেসব পরিবারে সকলে বড়লোক ছিল না, কিন্তু সকলেই খাবার আর আশ্রয়ের ভাগ পেত। অনেক হীনতা মন–কষাকষি বিবাদও ছিল অবশ্য। তবু আমাদের শিক্ষা ওখান। থেকেই। আমরা খুব দূর আত্মীয়তাও মেনে চলতাম। আমরা খাবার ভাগ করে খেতে শিখেছিলাম।’
মনে-মনে রেগে গেল দীপ্তিময়। নিজের পরিবারে বয়স্ক মানুষদের স্বার্থপরতা আর কুটিলতা সে অনেক দেখেছে। সে জানে এদের মহত্ব নামমাত্র। তবু সে মুখে রাগ দেখাল না, তর্কও করল না, কেবল বলল –’তারপর?’
‘স্বদেশি যখন করেছি তখনও ওইরকমই মনে হত। নিজের জন্য কিছু নয়। সকলের জন্য সব কিছু।’
‘তার ফলে কিছু হয়েছে?’
‘না’, মাথা নাড়ে হরেন গাঙ্গুলি কিছু হয়নি। স্বার্থপরতা আরও বেড়ে গেছে। তবু কিন্তু আমার দাবি থেকে যায়।’
‘কীসের দাবি।’
‘দেশের জন্য আমি করেছিলাম, দেশও আমার জন্য কিছু করুক।’
দীপ্তিময় হাসে-’তবে দেশই করুক।’
ব্যঙ্গটা হজম করে গেল হরেন গাঙ্গুলি, বলল , ‘তুমিও দেশেরই একজন।’ বলেই তাড়াতাড়ি হেসে সামলে নিল, ‘এসব ছেলেমানুষি কথা। তুমি কথা তুললে বলে এসে গেল। আমি প্রাক্তন দেশসেবী হিসেবে তো তোমার কাছে আসিনি। আত্মীয়তার জোরেও না। ছেলেবেলায় তোমাকে কোলেপিঠে করেছিলাম, এখন বুড়ো বয়সে আমি গরিব অসহায়, তুমি যদি দয়া করো সেই আশায় এসেছি।’
ভ্রূ কুঁচকে চায়ে চুমুক দিল দীপ্তিময়। দেখল লোকটা চা বিস্কুট এখনও ছোঁয়নি। সে বলল –’চা–টা খান। ঠান্ডা হয়ে গেল।’
চায়ের কাপ তুলে নিল হরেন গাঙ্গুলি, বলল আমি এভাবে এসেছি বলে তুমি বোধ হয় খুশি হওনি, তাই না?’
দীপ্তিময় চুপ করে থাকে। তারপর এক সময়ে বলে–’আপনি অনেক দূর থেকে এসেছেন, আপনাকে আমি কিছু ভিক্ষে দেব। তবে…’
কথা শেষ করার আগেই হরেন গাঙ্গুলি দ্রুত চায়ের কাপটা রেখে সোজা হয়ে বসে দীপ্তিময়ের দিকে কঠিন চোখে তাকাল, ‘ভিক্ষে দেবে?’
দীপ্তিময় অবাক হয়ে বলল –’আপনিই তো তা চাইলেন।’
‘আমি ভিক্ষে চাইব ঠিকই। আমার দিক থেকে ওটা ভিক্ষেই। কিন্তু তুমি ভিক্ষে হিসেবে দেবে কেন?’
উত্তরটার অর্থ ভালোবুঝল নাদীপ্তিময়, কিন্তু যথেষ্ট রেগে গেল, ‘একে ভিক্ষে ছাড়া কী বলে?’
ঘরে আর শেষবেলার লাল আলো ছিল না। তবু দীপ্তিময় দেখল লোকটার চোখে অস্তসূর্যের লাল আভা। চোয়াল শক্ত হয়ে এসেছে লোকটার, তবু শান্ত গলায় বলল , ‘ভগবান তোমাকে অনেক দিয়েছেন। জীবনে তুমি স্বার্থত্যাগ কমই করেছ, কেবল নিজের জন্যই তুমি উপার্জন করেছ, হয়তো তার সবটাই সৎ উপায়ে নয়। তোমার কাছ থেকে আর একটু বিনয় এবং শ্রদ্ধা আশা করেছিলাম। দরিদ্র দেশে তুমি সুখে আছ কিন্তু তোমার সেজন্য কোনও লজ্জা নেই কেন! আমি ভিক্ষে চাইলাম বলে তুমি ভিক্ষেই দেবে?
প্রথমটায় স্তম্ভিত হয়ে গেল দীপ্তিময়। লোকটার চেহারা, আচরণ খুব সামান্য একটু পালটে গেছে, কিন্তু তাতেই তার শরীরে আগুন ধরে গেল। সে চিৎকার করে লাফিয়ে উঠল, ‘গেট আউট! গেট আউট!’
হরেন গাঙ্গুলি কুটিল একটু হেসে উঠে দাঁড়াল, ‘যদি কখনও লোকে তোমার বুকে ছোরা ধরে যথাসর্বস্ব চায়, তখন এই মেজাজ দেখিও বাপু।’
হরেন গাঙ্গুলি আর ফিরে তাকাল না। মাথা উঁচু রেখে বেরিয়ে গেল।
.
দীপ্তিময় ব্যাপারটাকে মন থেকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করল অনেকক্ষণ। পারল না। একটা উটকো লোক, ভিখিরি, বাড়ি বয়ে এসে তাকে যা খুশি বলে গেছে–এ চিন্তা তার সুখ নষ্ট করে দিচ্ছিল। রমাকে ডেকে সে সাবধান করে দিল, ‘আমি না থাকলে কোনও অচেনা লোককে ঘরে ঢুকতে দেবে না।’ বলার দরকার ছিল না, রমা বুঝেই নিয়েছিল। সে কিছু জিগ্যেস করল না দীপ্তিময়কে। কেবল ঘাড় নাড়ল।
রাতে মা যখন ভিতরের হলঘরের এক কোণে বসে খই দুধ খাচ্ছে, তখন দীপ্তিময়ের কী খেয়াল হল, মাকে গিয়ে জিগ্যেস করল–’মা, হরেন গাঙ্গুলি বলে কাউকে চিনতে?’
ঘোমটার ভিতর থেকে মা বোকা চোখে তাকাল, বলল –’কে?’
‘হরেন গাঙ্গুলি। স্বদেশিকরত, ঢাকায়।’
খানিকক্ষণ চেয়ে রইল মা, তারপর হঠাৎ বলল ‘নাটকা? হরেন তো আমাদের সনাতন পণ্ডিতের ছেলে নাটকা।’
নাটকা শুনে দীপ্তিময় একটু চমকে গেল।
মা ঘাড় নাড়ে, ‘নাটকা ছিল ডাকাত। স্বদেশি ডাকাত। বোমা বন্দুক নিয়ে ঘুরে বেড়াত। খুব গুন্ডা ছিল। রতনের সঙ্গে পড়ত। খুন করে জেলে যায়। বেরিয়ে আবার ডাকাতি করত।’
‘লোকটা ভালো ছিল না, না?’
‘এমনিতে ভালো। তবে রাগলে খুব ভয়ঙ্কর! ওর বাবাও ছিল ওইরকম। সনাতন পণ্ডিতকেও কারা যেন খুন করেছিল বিক্রমপুরের এক গ্রামে। নাটকার তখন সতেরো–আঠারো বছর বয়স।…তারপর কী যেন হয়েছিল! কী যেন…মা সামান্যক্ষণের জন্য আবার অন্যমনস্ক হয়ে তারপর বলল –’ব্রাহ্মণ, হ্যাঁ ব্রাহ্মণ ছিল তারা।’
‘কারা?’
‘যারা সনাতন পণ্ডিতকে খুন করেছিল। ওদেরই যজমান।’
‘নাটকা কী করল?’
‘রামদা দিয়ে দুজনকে কেটেছিল মাঠের মধ্যে আর একজনকে টাকা দিয়ে। পুলিশ ওকে ধরতে পারত না।’
আর জানার দরকার ছিল না দীপ্তিময়ের। নাটকার গল্প সে অনেক শুনেছে। ছেলেবেলায় নাটকা একসময়ে তার বীর ছিল। জ্ঞান হওয়ার পর সে লোকটাকে চোখে দেখেনি। গল্প শুনত যে সেই বিখ্যাত নাটকার কোলে উঠেছে অনেকবার।
মনটা একটু দমে গেল দীপ্তিময়ের। লোকটা বলছে যোগাযোগের ওপরেই পৃথিবী চলছে। যোগাযোগটা খুবই অদ্ভুত।
লোকটা পরোক্ষভাবে তাকে দায়ী করে গেল। যে দীপ্তিময় সারাজীবন নিজের জন্যই যা কিছু করেছে। একা বাঁচতে চাইছে, ইত্যাদি।
দুরকম চিন্তা দীপ্তিময়কে আচ্ছন্ন করে রইল।
বড় হঠাৎ ঘটে গেল ব্যাপারটা। এরকমটা না হলেই ভালো ছিল যেন। তবু সে ভেবে দেখে লোকটাকে অপমান করে ভালোই করেছে। সেই বিখ্যাত ডাকাত নাটকা তো আর নেই। লোকটা এখন ভিখিরি। হয়তো বার বার তার কাছে উমেদার হয়ে আসত। হাত পেতে সাহায্য নিত, আর গরিবের দাম্ভিকতা থেকে মনে মনে তাকে অভিশাপ দিয়ে যেত। এই অভিমানটুকু হয়তো লোকটার কাজে লাগবে। হয়তো এই বুড়ো বয়সে পাপী লোকটা নিজের জন্য ভিক্ষে ছাড়া আরও কিছু করবে এবার।
রাতে পাশে শুয়ে রমা বলল , ‘আমার কেমন ভয়-ভয় করছে গো!’
‘ভয় কীসের!’
‘ওরকম বিশ্রী একটা লোক! বুড়ো হোক, যাই হোক এককালে ডাকাত ছিল–সে লোকটার সঙ্গে তোমার ঝগড়া হয়ে গেল…’
‘দূর! ওসব কিছুনা। লোকটা এখন ভিখিরি।’ বলে পাশ ফিরে রমাকে জড়িয়ে ধরল দীপ্তিময়। চুমু খেয়ে বলল , ‘গাড়িটা বোধহয় সামনের মাসেই পেয়ে যাব।’ পেলে সবাই মিলে খুব লম্বা একটা ট্যুর দেব, বুঝলে!’
.
অফিসের কাজ শেষ করতে প্রায়ই রাত হয়ে যায় দীপ্তিময়ের। যখন বেরোয় তখন প্রায়ই দেখা যায় সাতটা বেজে গেছে। ডালহৌসি থেকে ট্যাক্সি নিয়ে সে, হাওড়ায় আসে। ট্রেনে আসে উত্তরপাড়া।
একদিন অফিসের কাজ শেষ করে ঘড়ি দেখল দীপ্তিময়। দেখল রাত সাড়ে সাতটা। মাথা অল্প ধরে আছে। জলতেষ্টা পেয়েছে, সিগারেট খাওয়া হয়নি অনেকক্ষণ। মাথা ভরতি হাজার চিন্তা। ঘর থেকে করিডোরে বেরিয়ে এসে সে দেখল চারদিক ফাঁকা। অন্য সব সারি সারি অফিসগুলোর দরজায় তালা। শূন্য করিডোর। সে দারোয়ানকে ডাক দিয়ে অফিসের দরজা বন্ধ করতে বলল । তারপর সিঁড়ি বেয়ে চারতলা থেকে নামতে লাগল।
অনেক উঁচু থেকেই সে একতলা আর দোতলার মাঝামাঝি যেখানে সিঁড়িটা বাঁক নিয়েছে, সেখানে সিঁড়ির রেলিঙে হেলান দিয়ে রাপার গায়ে একটা লোক দাঁড়িয়ে। মাথা মুখ ঢাকা, তলায় ময়লা ধুতি দেখা যাচ্ছে। বোধহয় ভিখিরি।
আস্তে-আস্তে নামছিল দীপ্তিময়। গত সপ্তাহে তার রক্তের চাপ বেড়েছিল। এই অল্প বয়সেই এতটা হওয়ার কথা নয়। ডাক্তার তার খাওয়া–দাওয়ার চার্ট তৈরি করে দিয়ে গেছে। পরিশ্রম কম করতে বলে গেছে। দীপ্তিময় একটু হাসে। তার হাওড়ায় লোহার কারখানার স্ট্রাইক চলছে, সাপ্লাইয়ের ব্যাবসাতেও একটু মন্দা, তিন-চারটে সরকারি কন্ট্রাক্টের জন্যও তাকে ঘুরতে হচ্ছে খুব। বিশ্রামের উপায় নেই। সে আস্তে আস্তে সিঁড়ি বেয়ে নামে, মাথাটা একটু ঘোরে। সে রেলিঙে হাত রেখে নামতে থাকে। দূর থেকে অন্যমনে দেখে একতলা আর দোতলার মাঝখানে সিঁড়িতে হেলান দিয়ে কালো রং্যাপার মুড়ি দিয়ে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। মাঝে-মাঝে দীপ্তিময়ের মনে হয় এত লোভ বুঝি ভালো নয়। সে যথেষ্ট রোজগার করেছে, এবার অন্যদের জন্য ব্যাবসা ছেড়ে দেওয়া যাক, একটু বেড়িয়ে আসা যাক বাইরে কোথাও, মানুষের সঙ্গে আরও একটু মেশা যাক। তারপরই মনে পড়ে কলকাতায় কেনা জমিটার ওপর চমৎকার একটা ফ্ল্যাটবাড়ি তুলতে হবে। প্রতি ফ্ল্যাটের ভাড়া হবে ছশো থেকে হাজার। কিংবা এমনি আরও চিন্তা। তখনই সব ছেড়ে দেওয়ার নামে বুক কেঁপে ওঠে। না, যথেষ্ট হয়নি, একেবারেই যথেষ্ট হয়নি। আরও অনেক কিছু করার আছে… নামতে–নামতে সে দেখতে পায় ভিখিরির মতো লোকটা একতলা আর দোতলার মাঝখানে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে। সে নামতে থাকে। তিনতলা থেকে দোতলায় নেমে আসে। থেমে একটা সিগারেট ধরায়… সামনের মাসের প্রথম দিকেই গাড়িটা পাওয়া যাবে। বিদেশি গাড়ি, চল্লিশ হাজার দাম পড়ল। লম্বা একটা ট্যুর দিতে হবে এবার। চলে যাবে দেওঘর, রাঁচি, হাজারিবাগ, পরেশনাথ। সঙ্গে থাকবে রমা, পিন্টু আর বুবুন। বাড়িতে থাকার জন্য কাউকে এনে রাখতে হবে…সে সিঁড়ি ভাঙতে থাকে। তিন-চার ধাপ ওপর থেকে সে দেখে লোকটা রেলিঙে হেলান দিয়ে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কালো র্যাপারে তার মাথা মুখ শরীর ঢাকা, নীচে ময়লা ধুতি, আর পায়ে লাল রঙের কেডস দেখা যাচ্ছে। এই এজমালি অফিস বাড়িটায় সারাদিন উমেদার, ফড়ে দালালদের যাতায়াত, আর ভিখিরি। দীপ্তিময় চত্বরে নেমে অন্যমনে লোকটাকে পেরিয়ে গেল। তার গাড়িটার কথাই ভাবছিল সে। চমৎকার আকাশি নীল রং…
‘দীপ্তিময়!’ গম্ভীর গলায় কাছ থেকে কে যেন ডাকল।
চমকে ঘুরে দাঁড়াল দীপ্তিময়, কালো রং্যাপার মোড়া সেই লোকটা। ঘোমটার মধ্যে তার মুখ। ভালো বোঝা যায় না। অস্পষ্টভাবে দেখা যায় লোকটা অনেকদিন দাড়ি কামায়নি। তার বুকের মধ্যে ধক করে ওঠে। যদিও আবছা, ঢাকা মুখখানা ভালো বোঝা যায় না, তবু মনে হয় এ মুখ সে যেন কবে কোন বাল্যে বা কৈশোরে বহুবার দেখেছিল। স্পষ্ট মনে নেই। তবু মনে পড়ে।
সামান্যক্ষণের জন্য দুজনেই স্থির রইল। তারপর শীর্ণ বাঁ হাতখানা তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে লোকটা এগিয়ে এল। বাড়ানো হাতখানার দিকে অর্থহীন অবুঝ চোখে চেয়ে ছিল দীপ্তিময়, হঠাৎ দেখল চাদরের তলা থেকে বিদ্যুৎ গতিতে বেরিয়ে এল লোকটার ডানহাত। খুবই অবাক হল দীপ্তিময়। সে বড়-বড় চোখ করে দেখতে পেল লোকটা তার পেটের মধ্যে একটা ছোট্ট সুন্দর ঝকঝকে ছোরা ঢুকিয়ে দিল।
‘আঃক’ বলে দীপ্তিময় হেঁচকি ভোলার মতো একটা শব্দ করল। পরমুহূর্তেই সে ‘এটা কী? এটা কেন?’ বলে চিৎকার করতে চাইল–পারল না, বোবার শব্দের মতো সে কয়েকটা অর্থহীন শব্দ করল। দেখতে পেল ছোরার হাতলখানা তার পেটের ওপর উঁচু হয়ে আছে।…প্রথমে দেওয়ালে হেলান দেওয়ার চেষ্টা করল দীপ্তিময়…ভয়ঙ্কর বমির ভাব টের পেল…পেটের ওজন…খুব ওজন…দেওয়ালে হেলানো তার শরীর আস্তে-আস্তে গড়িয়ে পড়ল সিঁড়িতে। শূন্য চোখে দেখল কোথাও সেই কালো চাদরে ঢাকা লোকটা নেই। চলে গেছে।…যেন হঠাৎ নিজের শব্দ করার ক্ষমতা সে ফিরে পেল, চিৎকার করল ‘রমা–আ, মা–আ…।’ দেখল তোক ছুটে আসছে ওপর থেকে নীচে থেকে। পায়ের শব্দ…ভয়ে সে চোখ বোজে। ছোরার হাতলখানা উঁচু হয়ে আছে…সে টের পায় তাকে ভোলা হচ্ছে…বোধহয় একটা গাড়িতে…লোকজন চেঁচাচ্ছে…পেটের ওপর একটা ভার… একটা ওজন…নোনতা স্বাদের বমি উঠে আসছে মুখে…তার পরেই দীপ্তিময়। দেখে বাগান আলো করে সবুজ রং…তার নিজের বাড়ি…। যদিও অর্থহীন তবু তার এলোমেলোভাবে মনে হয় সে পৃথিবী থেকে আলাদা করে তার জমি নিয়ে নিচ্ছে তুলে, দিচ্ছে। ঘেরা পাঁচিল…পাঁচিলের ওপাশে এক অচেনা জগৎ…চালের ওপর বসে দেখতে পায় বাইরের অচেনা অনাত্মীয় মানুষেরা হেঁটে যাচ্ছে…ওরা তার কেউ নয়…হিংসেয় মানুষের বুকে পাথর কেটে যাচ্ছে দীপ্তিময় কেন সুখে থাকবে? দীপ্তিময় চিৎকার করে বলতে চায় কেন আমি সুখে থাকব না? …মনে পড়ে সে কারও জন্য কিছু করেনি। নিজের ঘর তৈরি করেছে কেবল…জগৎ বড় পর হয়ে আছে…অচেনা হয়ে আছে মানুষ…অনাত্মীয়…যোগাযোগ নেই…যোগাযোগ নেই…কেবল রমা, কেবল বুবুন, পিন্টু…আর সে নিজে…আমি, আমি আর আমি… আস্তে-আস্তে দীপ্তিময় ঘুমিয়ে পড়তে থাকে…কে যেন তাকে মারল…কেন মারল? …বস্তুত। কিছুই তো আর সে নিজের মতো নিতে পারল না…না ঘর, বাড়ি, বাগান…গাড়িতে চড়া হল না একবারও…ঘেরা পাঁচিলের ঘেরা পোক্ত বাড়ি তবু নিরাপদ নয়…চারদিক থেকে সাপের মতো অভিশাপ এসে বিষ ঢেলে দিয়ে যাচ্ছে…না নিরাপদ নয়…সে রমাকে সাবধান করে দেয়–সাবধান, রমা, খুব সাবধান, সদর খুলো না, কাউকে ঢুকতে দিও না…বলে আর দেখে পাঁচিল টপকে চোর ঢুকেছে…সদর ভাঙছে ডাকাত…বলছে ভাগ করে খেতে হয়। তুমি অনেক কেড়ে খেয়েছ…হাল ছেড়ে দেয় দীপ্তিময়।…দেখে তার সেই নীল সুন্দর গাড়িখানা লম্বা ট্যুরে পাড়ি দিচ্ছে। জানালায় তার মুখ তাকেই বিদায় জানাচ্ছে। দীপ্তিময় চেয়ে থাকে…