ষষ্ঠ খণ্ড (পরম পূজনীয়া পরিব্রাজিকা প্রজ্ঞা হৃদয়া করকমলে)
সপ্তম খণ্ড (স্নেহের অলোক রায়চৌধুরী ও ইন্দিরাকে)
অষ্টম খণ্ড (ডা: শ্রী বিজয়চাঁদ কুমার ও শ্রীমতী তপতী কুমার শ্রদ্ধাভাজনেষু)
5 of 6

ভরাডুবি

ভরাডুবি

রবীন্দ্রনাথ থেকে আমরা কতটা সরতে পেরেছি, তার একটা হিসেব নেবার সময় এসেছে। রাগারাগি বা মন খারাপ করার কোনও মানে হয় না। বাঙালির ওপর অভিমান করেও লাভ নেই। যা হয় তাই হয়েছে, যা হবার হবে। বাঙালির স্বভাব হল হাঁসের মতো। একবার গা ঝাড়া দিলেই পালক থেকে গচ্ছ ভাব আর ভাবনার সব জল ঝরে পড়ে যায়। অঋণী, অপরিগ্রাহী বাঙালির একটিই গর্ব, কিছুই গ্রহণ না করা, বারে বারে আদি অকৃত্রিম অবস্থায় ফিরে যাওয়া। বাঙালির সব কথাই যেন শেষ কথা। রবীন্দ্রনাথ এঁদের চিনেছিলেন। বিদ্যাসাগর এই প্রসঙ্গে লিখেছেন : আমরা আরম্ভ করি, শেষ করি না; যাহা অনুষ্ঠান করি, তাহা বিশ্বাস করি না; যাহা বিশ্বাস করি, তাহা পালন করি না; ভূরিপরিমাণ বাক্যরচনা করিতে পারি, তিলপরিমাণ আত্মত্যাগ করিতে পারি না; আমরা অহঙ্করে দেখাইয়া পরিতৃপ্ত থাকি, যোগ্যতা লাভের চেষ্টা করি না; আমরা সকল কাজেই পরের প্রত্যাশা করি, অথচ পরের ত্রুটি লইয়া আকাশ বিদীর্ণ করিতে থাকি; পরের অনুগ্রহ আমাদের সম্মান, পরের চক্ষে ধূলি নিক্ষেপ করিয়া আমাদের পলিটিকস এবং নিজের বাকচাতুর্যে নিজের প্রতি ভক্তিবিহ্বল হইয়া উঠাই আমাদের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য। এই দুর্বল, ক্ষুদ্র, হৃদয়হীন, কর্মহীন, দাম্ভিক, তার্কিক জাতির প্রতি বিদ্যাসাগরের এক সুগভীর ধিক্কার ছিল। ধিক্কারে আমাদের চেতনা হয় না। এ দেশে একাধিক মহামানব এসেছেন। জীবন দিয়ে, সাধনা দিয়ে, সৃষ্টি দিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন আমাদের জাগাতে। ‘জাগো বাঙালি, জাগো বাঙালি’—কিন্তু বাঙালি বসে থাকতে থাকতে শুয়েই পড়ল। নাসিকাধ্বনিতে বেদমন্ত্র : উত্তিষ্ঠত জাগ্রত প্রাপ্য বরাণ নিবোধত। ওরে পিপু, ভাই ফিসু।

রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, অরবিন্দ, নেতাজী সুভাষ—আমাদের জীবনে আপাতত তাঁরা প্রাত:স্মরণীয়। ছবিতে আছেন, ক্যালেন্ডারের পাতায় হাওয়ায় উড়ছেন, মূর্তি হয়ে পথ-মোহনায়, অবহেলিত পার্কে রোদে পুড়ছেন, জলে ভিজছেন। জন্মদিনে তাঁদের প্রাপ্য একটি মালা, আমাদের অতি সহজ ঋণস্বীকার পদ্ধতি।

এঁদের রচনাবলি সরকারি সংস্করণে অথবা অন্য পদ্ধতিতে আমরা দক্ষযজ্ঞ করে কিনে আনি। বসার ঘরের বুককেসে পরিপাটি সাজিয়ে রাখি। তার ওপর বাঁকুড়ার গলা লম্বা ঘোড়া কান উঁচিয়ে থাকে। কদাচিৎ পাতা উলটান। সপ্তাহে একবার ধুলো ঝাড়েন, ধুলো আর পোকা বইয়ের পক্ষে বড়ই ক্ষতিকারক। গ্রন্থের স্বাস্থ্য আর সৌন্দর্য নষ্ট করে দেয় নাস্টি ধুলো। আদরে রাখলে স্ত্রীর সৌন্দর্য খোলতাই হয়, ওরই মধ্যে একটু বেশি দিন স্থায়ী হয়। সপ্তাহে একদিন বইয়ের ধুলো ঝাড়লে বই একেবারে নতুন থাকে। যত কম হ্যান্ডল করা যায়, ততই ভালো। আজকালকার পাতা-টাতা, বাঁধাই-টাঁধাই তো তেমন ভালো নয়। আর চাবি দিয়ে রাখতেই হবে, তা না হলে হাতাই আর সাফাইয়ে পপুলেশান কমে যাবে। আর চাবিটা কোনও সময়েই সহজে পাওয়া যাবে না। ওই রোববার রোববার বই, বাথরুম, বেডকভার, আমি সাফাই করবই। তারপর তিন ‘ব’ কারের ঠ্যালায় দুপুরে বিছানায় পড়ে ব্যা-কার ছাড়ব। মিনিট মিনিটে ধুলো হাঁচি। ডাস্ট অ্যালার্জি আছে তো? বই আমার প্রাণ। রাক্ষসের প্রাণভোমরার মতো স্ফটিক স্তম্ভে গেঁথে রাখি। থরেথরে সাজানো মনীষীর চিন্তাভাণ্ডার!

মেয়ের হাত ধরে পাড়ার রবীন্দ্রসংগীত শিক্ষার স্কুলে পুরে দিয়ে আসি। এরই মধ্যে ‘জেনে শুনে বিষ করেছি পান’টা যা গাইছে না? ‘প্রমোদে ঢালিয়া দিনু’-র তালিম চলছে। মাসে বিশ-পঁচিশ টাকা খরচ সার্থক। যে মেয়ে অন্তত ছ-খানা রবীন্দ্রসংগীত গাইতে পারে না, তাকে বাংলা দেশ থেকে ঝাঁটিয়ে বিদায় করে দেওয়া উচিত! উচ্চারণ শুদ্ধি নিয়ে অত মাথা ঘামাবার কী আছে? প্রাণ ‘পান’ হোক, জ্যোৎস্না ‘জোন্না’ হোক, হৃদয় ‘হিদয়’ হোক, নেভার মাইন্ড! পঁচিশে বৈশাখ মধুছন্দা পাড়ার ফাংশানে গান গাইবে। কাশতে-কাশতে চঞ্চলবাবু বক্তৃতা দেবেন, রবীন্দ্রনাথ শুধু বাংলা কবি নন, ভারতের কবি নন, তিনি বাংলা ভারত তথা বিশ্বের কবি। তিনি বলেছিলেন, এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ, মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান!

দিকে-দিকে প্রাণ দানের মহোৎসব পড়ে গেছে। দিতে না চাও, কেড়ে নেওয়া হবে। ‘ছেলেধরা’ বলে ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ে, পেটে ভোজালি। তার পরের স্টেজে ইট দিয়ে মাথা থেঁতো, চোখ খোবলানো, অবশেষে পেট্রোল ঢেলে অগ্নি সংস্কার! তোমার ফার্স্ট এডিশান শেষ। ঈশ্বরের ছাপাখানায় সেকেন্ড এডিশান হয় তো ভালই, নয় তো সমুখে শান্তি পারাবার। মরতে-মরতে মরণটাকে শেষ করে দে একেবারে। গদিতে বসে শহিদ বেদি করিয়ে দেব নর্দমার ধারে! পরের চক্ষে ধূলি নিক্ষেপ করিয়া আমাদের পলিটিক্স! চিত্ত যেথা ভয় শূন্য, সেথা চুল্লু খেয়ে মধ্যরাতে বোমাবাজি কী এমন কঠিন কর্ম? নাগিনীরা ফেলিতেছে বিষাক্ত নি:শ্বাস! সেই নি:শ্বাস না ফেললে কবির কথা সত্য হবে কী করে। একের পর এক জালিয়ানওয়ালাবাগ করে যেতে হবে, নাইট উপাধি কারুর যদি এখনও থেকে থাকে, প্রত্যাখ্যানের এই তো সুযোগ।

সময় পেলে স্ত্রীর অনুরোধে আমার মতো বাঙালিরা ব্যাভিচারে বিক্ষত, উষ্ণ আত্মসমালোচক, উঠতি বংশধরকে একটু আবৃত্তির তালিম দিয়ে থাকেন। গানের মতো এটাও বেশ পপুলার হয়ে উঠেছে। এ বছর শালতিতে ভাসমান জন্মোৎসব হবে। আসছে বার বেলুনে। নাও, হাত মুঠো করে বলো : ওরে বিহঙ্গ, রে বিহঙ্গ মোর, হল না, হচ্ছে না, হচ্ছে না, বিহঙ্গের ‘হ’ টাকে অ উচ্চারণ কোরো না, বিঅঙ্গ নয় বিহঙ্গ, ‘হ’ টাকে একটু ঝুলিয়ে দাও। ‘পাখা’টাকে একটু ক্লান্ত করে এলিয়ে দাও। ওরে বিহঙ্গ রে বিহঙ্গ মোর, হাত পা থরথর করে কাঁপছে। বাঙালির হৃদয়বৃত্তি ছোট হলেও দেহ ক্ষুদ্র হলেও হৃদয়টি ভেতর-ভেতর বেড়ে আছে। সামান্য উত্তেজনাতেই শরীর কাঁপতে থাকে। এনলার্জড হার্ট। অন্যায় যে করে, অন্যায় যে সহে। সাধে সহ্য করি! হার্টের অবস্থা যে তেমন ভালো নয়, তা না হলে প্রতিবাদ, কি রুখে দাঁড়াতে এত ভয় পাই? ডাক্তার বলেছেন, সবরকম উত্তেজনা এড়িয়ে চলবেন। যে যা করছে করুক, আপনি জানালা বন্ধ করে, পাখির ফাঁক দিয়ে দেখবেন! দয়া করে আপনাকে আর দেশের মর‌্যাল গার্জেন হতে হবে না। গার্জেন হবার জন্যে নেতারা আছেন, তাঁদের অনুচরেরা আছেন। হম্বিতম্বি করতে হয়, ঘরে যে মহিলা আছেন, তাঁকে করুন। বাইরে বেশি লম্ভ ঝম্ভ করবেন না, হয় লাশ ফেলে দেবে, না হয় কাঁপতে-কাঁপতে নিজেই লাশ হয়ে পড়ে যাবেন।

‘ও মা দেখবে এসো, বাবা কী রকম বিহঙ্গ, বিহঙ্গ করে কাঁপছে!’

‘কাঁপছি কোথায়, আবৃত্তি করছি। কোন যুগে চলে গেছি জানো? সেই যুগে যখন সারা দেশটাই ছিল শান্তিনিকেতন। বোমা ছিল না, পাইপগান ছিল না, ক্যাডার ছিল না। মোড় ছিল, রক ছিল, রকবাজ ছিল না। ডিসকো ছিল না, জিনস ছিল না।’

‘থাক আর কাঁপতে হবে না। সেই যুগ থেকে অনুগ্রহ করে তোমার ‘রাখি’ নিয়ে ফিরে এসো। খবর এসেছে রেশনে খুব ভালো সরু আতপ চাল বেরিয়েছে।’

‘অ্যাঁ, তাই নাকি? দাও দাও ব্যাগ-ফ্যাগ কার্ড-মার্ড দাও! ওরে বিহঙ্গ, রে বিহঙ্গ মোর, এখনি অন্ধ কোরো না বস্তা!’

বাঙালি এখন লাইনের বাঙালি, বাছুর বাঙালি! ওই যে বাসের সামনের দরজা থেকে খসে পড়ল। কে পড়েছে, ও একটা বাঙালি, ধাক্কা খেয়ে পড়ে মরেছে! নড়ছেও না, চড়ছেও না, যাক বেঁচে গেছে। রূপ সাগরে ডুব দিয়েছি, অরূপ রতন আসা করি/ঘাটে-ঘাটে ঘুরব না আর ভাসিয়ে আমার জীর্ণ তরী।

জানালার ধারে চাঁদপানা মুখ করে যিনি বসে পান চিবোচ্ছিলেন, তিনি মুখ থেকে পানের চর্বিত অংশ রাস্তার জনসাধারণের দিকে ছুঁড়ে দিতে দিতে বললেন, চলিয়ে চলিয়ে, দেরি হয়ে যাচ্ছে, এমন দু-দশটা খসে পড়বেই। পপুলেশান কী বেড়েছে, এরপর মানুষ মানুষকে শুধু মারবেই না, ইংরিজি গানের তালে-তালে, নেচে-নেচে রোস্ট করে খাবে! মর্ডান ক্যানিবলস। জনম-মরণ জীবনের দুটি দ্বার।

সহযাত্রীদের নিদারুণ চাপে যানযন্ত্রণার মাঝখানে দাঁড়িয়ে ঘর্মাক্ত অনুচ্চ বারেক শুধু অনুভব করো : মাঝখানেতে সোনার কোষে/আনন্দে ভাই আছি বসে/আমায় ঘিরে ছড়ায় ধীরে/ আলোর শতদল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *