1 of 2

ভরতের ঝুমঝুমি – পরশুরাম

ভরতের ঝুমঝুমি – পরশুরাম

হৃষীকেশ তীর্থে গঙ্গার ধারে যে ধর্মশালা আছে, তারই সামনের বড় ঘরে আমরা আশ্রয় নিয়েছি— আমি, আমার মামাতো ভাই পুলিন, আর তার দশ বছরের ছেলে পল্টু। তা ছাড়া টহলরাম চাকর আর চারটে সাদা ইঁদুরও আছে। ইঁদুর আনতে আমাদের খুব আপত্তি ছিল কিন্তু পল্টু বললে, বা রে, আমি সঙ্গে না নিলে এদের খাওয়াবে কে? বাড়ির ছটা বেরালই তো এদের খেয়ে ফেলবে। যুক্তি অকাট্য, ইঁদুরের ভাড়াও লাগে না, সুতরাং সঙ্গে আনা হয়েছে। তারা রাত্রে একটা খাঁচার মতন বাক্সে বাস করে, দিনের বেলায় পল্টুর পকেটে বা মুঠোর মধ্যে থাকে, অথবা তার গায়ের ওপর চরে বেড়ায়।

সমস্ত সকাল টো টো করে বেড়িয়েছি, এখন বেলা এগারোটা, প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে। চা তৈরির সরঞ্জাম আমরা সঙ্গে এনেছি, কিন্তু রান্নার কোনও জোগাড় নেই, তার হাঙ্গামা আমাদের পোষায় না। দোকান থেকে এক ঝুড়ি মোটা মোটা আটার লুচি, খানিকটা স্বচ্ছন্দবনজাত কচুঘেঁচুর ঘণ্ট, আর সের খানিক নুড়ির মতন শক্ত পেড়া আনানো হয়েছে। আমরা স্নান সেরে ঘরের দরজা বন্ধ করে খাটিয়ায় বসে কোলের ওপর শালপাতা বিছিয়েছি, টহলরাম পরিবেশনের উপক্রম করছে, এমন সময় বাইরে থেকে ভাঙা কর্কশ গলায় আওয়াজ এল—অয়মহং ভোঃ!

কথাটা কোথায় যেন আগে শুনেছি। দরজা খুলে বাইরে এসে দেখলুম, একজন বৃদ্ধ সাধুবাবা। রংটা বোধ হয় এককালে ফরসা ছিল, এখন তামাটে হয়ে গেছে। লম্বা, রোগা, মাথার জটাটি ছোট কিন্তু অকৃত্রিম, গোঁফ আর গালের ওপর দিকের দাড়ি ছেঁড়া ছেঁড়া, যেন ছাগলে খেয়েছে। কিন্তু থুতনির দাড়ি বেশ ঘন আর লম্বা, নীচের দিকে ঝুঁটির মতন একটি গেরো বাঁধা। দেখলে মনে হয় এই গেরোটি কোনও কালে খোলা হয় না। পরনের গেরুয়া কাপড় আর কাঁধের কম্বল অত্যন্ত ময়লা। সর্বাঙ্গে ধুলো, গলায় তেলচিটে পইতে, হাতে একটা ঝুলি আর তোবড়া ঘটি। রুদ্রাক্ষের মালা, ভস্মের প্রলেপ, গাঁজার কলকে, চিমটে, কমণ্ডলু প্রভৃতি মামুলি সাধুসজ্জা কিছুই নেই।

প্রশ্ন করলাম, ক্যা মাংতা বাবাজি? বাবাজি উত্তর দিলেন না, সোজা ঘরে ঢুকে আমার খাটিয়ায় বসে পড়লেন। টহলরাম বাঙালির সংসর্গে থেকে একটু নাস্তিক হয়ে পড়েছে, অচেনা সাধুবাবাদের ওপর তেমন ভক্তি নেই। রুখে উঠে বললে, আরে কৈসা বেহুদা আদমি তুম, উঠো খাটিয়াসে।

সাধুবাবা ভ্রুকুটি করে রাষ্ট্রভাষায় যে গালাগালি দিলেন তা অশ্রাব্য অবাচ্য অলেখ্য। পুলিন অত্যন্ত রেগে গিয়ে গলাধাক্কা দিতে গেল। আমি তাকে জোর করে থামিয়ে বললুম, কর কি, বাবাজির সঙ্গে একটু আলাপ করেই দেখা যাক না।।

প্রমোদ চাটুজ্যে মশাই বিস্তর সাধুসঙ্গ করেছেন। সাধুচরিত্র তাঁর ভাল রকম জানা আছে, যোগী অবধূত বামাচারী তান্ত্রিক অঘোরপন্থী প্রভৃতি হবেক রকম সাধক সম্বন্ধে তিনি গবেষণা করেছেন। তাঁর লেখা থেকে এইটুকু বুঝেছি যে, গরুর যেমন শিং, শজারুর যেমন কাঁটা, খট্টাশের যেমন গন্ধ, তেমনি সিদ্ধপুরুষদের আত্মরক্ষার উপায় গালাগালি। তাঁদের কটুবাক্যের চোটে অনধিকার বাজে ভক্তরা ভেগে পড়ে, শুধু নাছোড়বান্দা খাঁটি মুক্তিকামীরা রয়ে যায়। এই আগন্তুক সাধুবাবাটির মুখখিস্তির বহর দেখে মনে হল নিশ্চয় এঁর মধ্যে বস্তু আছে। সবিনয়ে বললুম, ক্যা মাংতে হুকুম কিজিয়ে বাবা।

বাবা বললেন, ভোজন মাংতা। আরে তোমরা তো দেখছি বাঙালি, বাংলাতেই বল না ছাই।

বাবাজির মুখে আমাদের মাতৃভাষা শুনে খুশি হয়ে বললুম, এই পুরি তরকারি পেড়া আপনার চলবে কি?

—খুব চলবে। কিন্তু ওইটুকুতে কি হবে। আমি আছি, তোমার তিনজন আছ, আর তোমাদের ওই রাক্ষস চাকরটা আছে। আরও সের দুই আনাও।

টহলরামকে আবার বাজারে পাঠালুম। পুলিনের পেশা ওকালতি, কিন্তু মক্কেল তেমন জোটে না, তাই বেচারা সুবিধে পেলেই যাকে তাকে সওয়াল করে শখ মিটিয়ে নেয়। বললে, আপনি বাঙালি ব্রাহ্মণ?

—সে খোঁজে তোমার দরকার কি, আমার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেবে নাকি? আমার ভাষা সংস্কৃত, তবে তোমরা তা বুঝবে না তাই বাংলা বলছি।

—আপনি কোন সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসী, গিরি পুরি ভারতী অরণ্য না আর কিছু?

—ওসব অর্বাচীন দলের মধ্যে আমি নেই। আমার আদি আশ্রম ব্রহ্মলোক, আমি একজন ব্রহ্মর্ষি।

—নামটি জিজ্ঞাসা করতে পারি কি?

—বোবা যখন নও তখন না পারবে কেন। কিন্তু বিশ্বাস করতে পারবে কি? তোমরা তো পাষণ্ড নাস্তিক। আমি হচ্ছি মহামুনি দুর্বাসা।

কিছুক্ষণ হতভম্ভ হয়ে থাকার পর প্রণিপাত করে আমি বললুম, ধন্য আমরা! চেহারা যেমনটি শুনেছি তেমনটি দেখছি বটে, কিন্তু লোকে যে আপনাকে অত্যন্ত বদরাগী বলে তা তো মনে হচ্ছে না। এই তো আমাদের সঙ্গে বেশ প্রসন্ন হয়ে কথা বলছেন।

—বদরাগী কেন হব। তবে এককালে আমার তেজ খুব বেশি ছিল বটে। কিন্তু সেই বজ্জাত মাগীটা আমার দফা সেরেছে।

হাত জোড় করে বললুম, তপোধন, যদি গোপনীয় না হয় তবে কৃপা করে এই অধমদের কৌতূহল নিবৃত্ত করুন। আপনি তো সত্য ত্রেতা দ্বাপরের লোক, এই ঘোর কলিযুগে আমাদের মতন পাপীদের কাছে এলেন কি করে?

—পিতা অত্রি আমাকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে বলেছেন, বৎস, তুমি হৃষীকেশ তীর্থে গঙ্গাতীরবর্তী ধর্মশালায় যাও, সেখানে তোমার সংকটমোচন হবে।

—আপনার আবার সংকট কি প্রভু? আপনিই তো লোককে সংকটে ফেলেন।

—সব বলব, কিন্তু আগে ভোজ সমাপ্ত হক। তোমরাও খেয়ে নাও।

পুলিন বললে, আপনি স্নান করবেন না?

—সে তো কোন কালে সেরেছি, ব্রাহ্মমুহুর্তেই গঙ্গায় একটি ডুব দিয়েছি।

—কিন্তু জটায় আর দাড়িতে যে বড় ময়লা লেগে রয়েছে প্রভু, একটু সাবান ঘষলে হত না? গায়েও দেখছি ছারপোকা বিচরণ করছে। যদি অনুমতি দেন তো একটু ডিডিটি স্প্রে করে দিই। আমাদের সঙ্গেই আছে।।

—খবরদার, ওসব করতে যেয়ো না। গুটিকতক অসহায় প্রাণী যদি আমার গাত্রে বস্ত্রে আর জটায় আশ্রয় নিয়ে থাকে তো থাকুক না। তুমি তাদের তাড়াবার কে?

টহলরাম খাবার নিয়ে এল। মহামুনি দুর্বাসার আদেশে আমরা তাঁর সঙ্গেই খাটিয়ায় বসে ভোজন করলুম। ভোজনান্তে আমি সিগারেটের টিনটি এগিয়ে দিয়ে বললুম, প্রভু, এ জিনিস চলবে কি? এর চেয়ে উঁচুদরের ধূমোৎপাদক বস্তু তো আমাদের নেই।

একটি সিগারেট তুলে নিয়ে দুর্বাসা বললেন, এতেই হবে। গঞ্জিকা আমার সয় না, বাতিক বৃদ্ধি হয়। কই, তোমরা ধূমপান করবে না?

লজ্জায় জিব কেটে বললুম, হেঁ হেঁ, আপনার সামনে কি তা পারি?

—ভণ্ডামি করো না। আমার সামনে একরাশ লুচি গিলতে বাধল না, আর যত লজ্জা ধোঁয়ায়! নাও নাও, টানতে আরম্ভ কর।

অগত্যা পুলিন আর আমিও সিগারেট ধরালুম। শোনবার জন্য আমরা উদ্‌গ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছি দেখে দুর্বাসা তাঁর ইতিহাস আরম্ভ করলেন।

শকুন্তলার কথা জান তো? কালিদাস তার নাটকে লিখেছে। মেয়েটা আমার ডাকে সাড়া দেয় নি তাই হঠাৎ রেগে গিয়ে তাকে অভিশাপ দিয়েছিলুম—তুমি যার কথা ভাবছ সে তোমাকে দেখলে চিনতে পারবে না। শকুন্তলা এমনি বেহুঁশ যে আমার কোনও কথাই তার কানে গেল না। কিন্তু তার এক সখী শুনতে পেয়েছিল। সে আমার কাছে এসে পায়ে ধরে অনেক কাকুতি মিনতি করলে। তার নাম অনসূয়া। আমার মায়েরও ওই নাম, তাই প্রসন্ন হয়ে অভিশাপ খুব হালকা করে দিলুম। কিন্তু সখীটা অতি কুটিলা, শকুন্তলার মা মেনকার কাছে গিয়ে আমার নামে লাগাল।

এই ঘটনার পর প্রায় দশ মাস কেটে গেল। তখন আমি শিষ্যদের সঙ্গে গঙ্গোত্তরীর নিকট বাস করছি। একদিন প্রাতঃকালে ভাগীরথীতীরে বসে আছি এমন সময় একজন শিষ্য এসে জানালে, একটি অপূর্ব রূপবতী নারী আমার সঙ্গে দেখা করতে চাচ্ছেন। বিরক্ত হয়ে বললুম, আঃ জালাতন করলে। নির্জনে একটু পরমার্থচিন্তা করব তারও ব্যাঘাত। কে এসেছে পাঠিয়ে দাও এখানে।

দেখেই চিনলুন মেনকা অপ্সরা। ভব্যতার জ্ঞান নেই, দাঁতন চিবুতে চিবুতে এসেছে, বোধ হয় ভেবেছে তাতে খুব চমৎকার দেখাচ্ছে। খেঁকিয়ে উঠে বললুম কি জন্য আসা হয়েছে এখানে? জান, আমি মহাতেজস্বী দুর্বাসা মুনি, বিশ্বামিত্রের মতন হ্যাংলা পাওনি যে লাস্য হাস্য ছলা কলা হাব ভাব টসক ঠমক দেখিয়ে আমাকে ভোলাবে।

মেনকা ভেংচি কেটে বললে, আ মরি মরি! জগতে তো আর কেউ নেই যে তোমাকে ভোলাতে আসব। তোমার ভালর জন্যই দেখা করতে এসেছি। তা যদি না চাও তো চললুম, কিন্তু এর পরে বিপদে পড়লে দোষ দিতে পাবে না। এই বলে মেনকা এক পায়ের গোড়ালিতে ভর দিয়ে বোঁ করে ঘুরে গেল।

মাগীর আস্পর্ধা কম নয়, আমাকে তুমি বলছে। শাপ দিতে যাচ্ছিলুম—তুই এক্ষুনি শুঁয়োপোকা হয়ে যা। কিন্তু ভাবলুম, উঁহু, ব্যাপারটা আগে জানা দরকার। বললুম, কিজন্য এসেছ বলই না ছাই।

মেনকা বললে, মহাদেব যে তোমার ওপর রেগে আগুন হয়েছেন, শকুন্তলাকে তুমি বিনা দোষে শাপ দিয়েছিলে শুনে। আর একটু হলেই তোমাকে ভস্ম করে ফেলতেন, নেহাত আমি পায়ে ধরে বোঝালুম তাই এবারকার মতন তুমি বেঁচে গেছ।

আমি দেবতা মানুষ কাকেও গ্রাহ্য করি না, কিন্তু মহাদেবকে ডরাই। জিজ্ঞাসা করলুম, কি বললে তুমি তাঁকে?

—বললুম, আহা নির্বোধ ব্রাহ্মণ, মাথার দোষও আছে, না বুঝে রাগের মাথায় শাপ দিয়ে ফেলেছে। তা শকুন্তলা তো বেশি দিন কষ্ট পাবে না, আপনি দুর্বাসা মুনিকে এবারটি ক্ষমা করুন। মহাদেব আমাকে স্নেহ করেন, তাঁর শাশুড়ির নাম আর আমার নাম একই কি না। বললেন, বেশ, ক্ষমা করব, কিন্তু আগে তুমি তাকে দিয়ে একটা প্রায়শ্চিত্ত করাও।

—কি প্রায়শ্চিত্ত করাবে শুনি?

—তোমার ভয় নেই ঠাকুর, খুব সোজা প্রায়শ্চিত্ত। শকুন্তলা এখন হেমকূট পর্বতে প্রজাপতি কশ্যপের আশ্রমে আছে। আমি খবর পেয়েছি সম্প্রতি তার একটি খোকা হয়েছে। কশ্যপ বলেছেন, এই ছেলে ভরত নামে প্রসিদ্ধ হবে এবং পৃথিবী শাসন করবে। মনে করেছিলুম গিয়ে একবার দেখে আসব, কিন্তু তা আর হল না। ইন্দ্র সব অপ্সরাদের ডেকে পাঠিয়েছেন। তাঁর ব্যাটা জয়ন্ত বিগড়ে যাচ্ছে—হবে না কেন, বাপের ধাত পেয়েছে,—তাই তাড়াতাড়ি তার বিয়ে দিচ্ছেন। দু মাস ধরে অষ্ট প্রহর নৃত্য গীত পান ভোজন চলবে। আজই আমাকে যেতে হবে। দেবতাদের ষাট দিনে মানুষের ষাট বৎসর। আমি যখন ফিরে আসব তখন শকুন্তলার ছেলে বুড়ো হয়ে যাবে। তাই তোমাকেই তার কাছে পাঠাতে চাই।

আমি ভাবলুম, এ তো কিছু শক্ত কাজ নয়। আমি যদি শকুন্তলার কাছে গিয়ে তাকে আর তার ছেলেকে আশীর্বাদ করে আসি তবে দেখতে শুনতে ভালই হবে। মেনকাকে বললুম, আমি যেতে রাজি আছি, কিন্তু প্রায়শ্চিত্তটা কি, সেখানে গিয়ে কি করতে হবে?

—একটি কাজের ভার নিয়ে তোমাকে যেতে হবে। এই ঝুমঝুমিটি খোকার হাতে দেবে আর আমার হয়ে তাকে একটু আদর করবে। কিন্তু তুমি বড় নোংরা, আগে ভাল করে হাত ধোবে তারপর খোকার থুতনিতে ঠেকিয়ে আলগোছে একটি চুমু খাবে।

আমি প্রশ্ন করলুম, সে আবার কি রকম?

—এই রকম আর কি। এই বলে মেনকা তার হাত আমার দাড়িতে ঠেকিয়ে মুখের কাছে এনে একটা শব্দ করলে—চুঃ কি থুঃ বুঝতে পারলুম না। তার পর বললে, এই নাও ঝুমঝুমি। খবরদার, হারিও না যেন, তা হলে মজা টের পাবে।

ঝুমঝুমিটা নিয়ে আমি বললুম, হারাব কেন, খুব সাবধানে রাখব। আহা, তুমি তোমার নাতিটিকে দেখতে পাবে না, বড় দুঃখের কথা। দেখ মেনকা, তুমি তো চলে যাচ্ছ, যদি আমার কাছে কোনও বর চাইবার থাকে তো এই বেলা বল।

—নাঃ, বর টর আমার দরকার নেই।

আমি বললুম, নেই কেন? যদি চাও তো আমার ঔরসে তোমার গর্ভে একটি পুত্র দিতে পারি। যদি তিন-চারটি বা শ-খানিক চাও তাও দিতে পারি।

নাক সিটকে মেনকা উত্তর দিলে, হয়েছে আর কি? তুমি নিজেকে কি মনে কর, কার্তিক না কন্দর্প? তোমার সন্তান তো রূপে গুণে একেবারে বোকা পাঁঠা হবে।

অতি কষ্টে ক্রোধ সংবরণ করে আমি বললুম, আচ্ছা আচ্ছা, বর না চাও তো আমার বড় বয়েই গেল। আমি অপাত্রে দান করি না। বেশ, এখন তুমি বিদেয় হও, একটা শুভদিন দেখে আমি শকুন্তলার কাছে যাব।

পুলিন জিজ্ঞাসা করলে, প্রভু, মেনকার বয়স কত?

দুর্বাসা বললেন, তুমি তো আচ্ছা বোকা দেখছি। অপ্সরার আবার বাস কি? জ্যোৎস্না বিদ্যুৎ রামধনু—এসবের বয়স আছে নাকি? তারপর শোন। মেনকা চলে গেল। তিন দিন পরে আমি যাত্রার জন্য প্রস্তুত হলুম। অপ্সরাই বল আর দিব্যাঙ্গনাই বল, মেনকা আসলে হল স্বৰ্গবেশ্যা, লৌকিকতার কোনও জ্ঞানই তার নেই। কিন্তু আমার তো একটা কর্তব্যবোধ আছে। শুধু ঝুমঝুমি নিয়ে গেলে ভাল দেখাবে কেন, কিছু খাদ্যসামগ্রী নিয়ে যেতেই হবে। সেজন্য আশ্রমের নিকটস্থ বন থেকে একটি সুপুষ্ট ওল আর সের-খানিক বড় বড় তিন্তিড়ী সংগ্রহ করে ঝুলির ভেতর নিলুম।

পুলিন বললে, এক মাসের খোকা বুনো ওল আর বাঘা তেঁতুল খাবে?

আমি বললুম, তা আর না খাবে কেন। সেকালের ক্ষত্রিয় খোকারা পাথর হজম করত, বিলিতি গুঁড়ো দুধের তোয়াক্কা রাখত না।

দুর্বাসা বললেন, তোমরা অত্যন্ত মূর্খ। ওল আর তেঁতুল ছেলে কেন খাবে, আশ্রমবাসী তপস্বী আর তপস্বিনীরা সবাই খাবেন। তারপর শোন। যথাকালে হেমকূটে পৌঁছে মরীচিপুত্র ভগবান কশ্যপ ও তৎপত্নী ভগবতী অদিতিকে বন্দনা করলুম, তারপর শকুন্তলার কাছে গেলুম। আমি যে শাপ দিয়েছিলুম তা বোধ হয় সে জানত না, আমাকে দেখে খুশিই হল। ওল আর তেঁতুল উপহার দিলুম, মেনকার কথামতো ছেলেকে আদর করে আশীর্বাদও করলুম। বললুম, শকুন্তলা, তোমার এই পুত্র শ্রীমান সর্বদমন-ভরত আসমুদ্র-হিমাচল সমস্ত দেশ জয় করে রাজচক্রবর্তী হবে। এর প্রজারা যে ভূখণ্ডে থাকবে তার নাম হবে ভারতবর্ষ—বর্ষং তদ্ ভারতং নাম ভারতী যত্র সন্ততিঃ। তুমিও অচিরে পতির সহিত মিলিত হবে। তার পর ট্যাঁক থেকে ঝুমঝুমি বার করতে গিয়েই চক্ষুস্থির।

আমি বললুম, বলেন কি, ঝুমঝুমি পেলেন না?

—মোটেই না। আমার পরনের কাপড় উত্তরীয় কম্বল সব ঝাড়লুম, ঝুলি ঘটি মায় জটা সব তন্ন তন্ন করে খুঁজলুম, কোথাও ঝুমঝুমি নেই। শকুন্তলার মুখটি কাঁদোকাঁদো হল, আহা, তার মায়ের দেওয়া উপহারটি হারিয়ে গেল! মেনকা যতই নচ্ছার হক, নিজের মা তো বটে। আমি বললুম, দুঃখ করো না শকুন্তলা, আরও ভাল ঝুমঝুমি এনে দেব।

দুজন বুড়ি তপস্বিনী শকুন্তলার কাছে ছিল। একজন বললে, পাগলের মতন যা তা বলো না ঠাকুর। ছেলের দিদিমার দেওয়া যৌতুক আর তোমার ছাইপাঁশ কি সমান? তুমি ভারী অলবড্যে মুনি। নিশ্চয় নাইবার সময় তোমার ট্যাঁক থেকে জলে পড়ে গেছে আর মাছে কপ করে গিলেছে। যাও, এখন রাজ্যের রুই-কাতলা ধরে ধরে পেট চিরে দেখ গে।

অন্য বুড়িটা বললে, কি বলছ গা দিদি! শুধু রুই-কাতলা কেন, মিরগেল চিতল বোয়াল কালবোস শোল শাল চাই ঢাঁই এসব মাছের পেটেও তো থাকতে পারে।

পুলিন বললে, কচ্ছপের পেটেও যেতে পারে।

আমি বললুম, হাঙর কুমির শুশুক সিন্ধুঘোটক বা জলহস্তীর পেটে যেতেও বাধা নেই।

দুর্বাসা আমাদের দিকে একবার কটমট করে চাইলেন, তারপর বলে যেতে লাগলেন।—

আমি আর দাঁড়ালুম না, কথাটি না বলে পালিয়ে এলুম। যে পথে এসেছিলুম সেই পথের সর্বত্র খুঁজে দেখলুম, কোথাও ঝুমঝুমি নেই। আমি অত্যন্ত ভুলো লোক, কিন্তু ঝুমঝুমিটা তো ট্যাঁকেই গোঁজা ছিল। নিশ্চয়ই নাইবার সময় জলে পড়ে গেছে। যেখানে যেখানে স্নান করেছিলুম সর্বত্র জলে নেমে হাতড়ে দেখলুম, কিন্তু পাওয়া গেল না। তবে বোধ হয় রুই মাছেই গিলেছে, শকুন্তলার আংটির মতন। বোয়াল কালবোস চাঁই ঢাঁইও হতে পারে। জেলেদের ডেকে ডেকে বললুম, ওরে, মাছের পেটে ঝুমঝুমি পেয়েছিস? বার করে দে, আশীর্বাদ করব। ব্যাটারা বললে, মাছের পেটে ঝুমঝুমি থাকে না ঠাকুর, পটকা থাকে। এই বলে দাঁত বার করে হাসতে লাগল। আমি অভিশাপ দিলুম, তোরা দেঁতো কুমির হয়ে যা। কিন্তু কোনও ফল হল না।

ওঃ, মেনকার কথা রাখতে গিয়ে কি সংকটেই পড়েছি! ঝুমঝুমি তুচ্ছ জিনিস, কিন্তু প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করা যে মহাপাপ। তারপর হাজার হাজার বছর কেটে গেছে, অসংখ্য বার অসংখ্য স্থানে খুঁজেছি, কিন্তু ঝুমঝুমি পাইনি। আমার আর শান্তি নেই, ব্রহ্মতেজ নেই, অভিশাপ দিলে ফলে না, আমি নির্বিষ ঢোঁড়া সাপ হয়ে গেছি। শিষ্যরা আমাকে ত্যাগ করেছে, আমি এখন ছন্নছাড়া হয়ে ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াচ্ছি।

আমি বললুম, মহামুনি, শান্ত হন, আপনি শুধু শুধু কষ্ট পাচ্ছেন। ভরত রাজা তো কবে স্বর্গলাভ করেছেন, তাঁর আর ঝুমঝুমির দরকার কি? আপনি নিশ্চিন্ত হয়ে তপস্যা করুন, যোগসাধনা করুন, হরিনাম করুন। অথবা লোকশিক্ষার নিমিত্ত জীবনস্মৃতি লিখুন, জটাশ্মশ্রুধারী উগ্রতপা মুনি-ঋষিদের সঙ্গে গ্ল্যামার গার্ল অপ্সরাদের মোলাকাত বিবৃত করুন, পত্রিকাওয়ালারা তা নেবার জন্য কাড়াকাড়ি করবে। ঝুমঝুমির কথা একেবারে ভুলে যান।

—হায় হায়, ভোলবার জো কি! ওই ঝুমঝুমিই হচ্ছে মেনকার অভিশাপ, শকুন্তলার প্রতিশোধ। আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে, যখন তখন ঝুমঝুম শব্দ শুনি।

দুর্বাসা হঠাৎ চিৎকার করে হাত পা ছুড়ে নাচতে লাগলেন। সঙ্গে সঙ্গে পুলিনের ছেলে পল্টু তাঁর পায়ের কাছে হুমড়ি খেয়ে পড়ে চেঁচিয়ে উঠল—মেরে ফেললে রে, সব কটাকে মেরে ফেললে!

ব্যাপার গুরুতর। পল্টু নিবিষ্ট হয়ে ঝুমঝুমির ইতিহাস শুনছিল সেই অবকাশে ইঁদুরগুলো তার পকেট থেকে বেরিয়ে দুর্বাসাকে আক্রমণ করেছে। দুটো তাঁর কাঁধে উঠেছে, একটা অধোবাসে ঢুকে গেছে, আর একটা কোথায় আছে দেখা যাচ্ছে না। তাঁর নাচের ঝাঁকুনিতে তিনটে ইঁদুর নীচে পড়ে গেল। পল্টু কোনও রকমে সেগুলোকে দুর্বাসার পদাঘাত থেকে রক্ষা করলে।

দুর্বাসা বললেন, তুই অতি দুর্বিনীত বালক।

পুলিন বললে, টেক কেয়ার তপোধন, আমার ছেলেকে যদি শাপ দেন তো ভাল হবে না বলছি।

দুর্বাসা বললেন, ইঁদুর পোষা মহাপাপ, চণ্ডালেও পোষে না।

পল্টু রেগে গিয়ে বললে, বা রে, আপনি যে নিজের গায়ে ছারপোকা পোষেন তা বুঝি খুব ভাল? দেখ না বাবা, ঋষি মশায়ের গা থেকে কত ছারপোকা আমাদের বিছানায় এসেছে। আর একটা ইঁদুর কোথা গেল? খুঁজে পাচ্ছি না যে—

দুর্বাসা আবার চিৎকার করে নাচতে লাগলেন। পল্টু বললে, ওই ওই, দাড়ির ভেতর একটা সেঁধিয়েছে। অনুমতি না নিয়েই পল্টু দুর্বাসার দাড়িতে হস্তক্ষেপ করে তার ভেতর থেকে ইঁদুরটাকে টেনে বার করলে। তারপর বললে, ঝুমঝুম শব্দ হচ্ছে কেন?

আমি লাফিয়ে উঠে বললুম, ঝুমঝুম শব্দ? বলিস কি রে! প্রভু, আপনার দাড়িটি একবার নাড়ুন তো।

দুর্বাসা দাড়ি নাড়লেন। সেই নিবিড় শ্মশ্রুজাল ভেদ করে ক্ষীণ শব্দ নির্গত হল—ঝুম ঝুম ঝুম। যেন নৃত্যপরা মেনকার নুপুরনিক্কণ দূরদুরান্তর থেকে ভেসে আসছে।

পুলিন দাড়ির নীচের ঝুঁটিটা একবার টিপে দেখলে, তারপর গেরো খুলতে লাগল। দুর্বাসা বললেন, আরে লাগে লাগে! কে তাঁর কথা শোনে। আমি তাঁর মাথাটি জোর করে ধরে রইলুম, পুলিন পড়পড় করে দাড়ি ছিঁড়ে ভেতর থেকে ঝুমঝুমি বার করলে। সোনার কি রুপোর কি টিনের বোঝা গেল না, ময়লায় কালো হয়ে গেছে, কিন্তু বাজছে ঠিক।

পল্টু চুপি চুপি বললে, এক্স রে করলে কোন কালে বেরিয়ে পড়ত, নয় বাবা? পল্টুর অভিজ্ঞতা আছে, বছর দুই আগে সে একটা পয়সা গিলেছিল।

দুর্বাসা একটি সুদীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন, একেই বলে গেরোর ফের। ঝুমঝুমিটি যে যত্ন করে দাড়ির গেরোর মধ্যে গুঁজে রেখেছিলুম তা মনেই ছিল না। তারপর পল্টুর মাথায় হাত দিয়ে বললেন, বৎস, আমি আশীর্বাদ করছি তুমি রাজা হবে।

আমি বললুম, ও আশীর্বাদ আর ফলবার উপায় নেই প্রভু, রাজা টাজা লোপ পেয়েছে। বরং এই আশীবার্দ করুন যেন ও মন্ত্রী হতে পারে, অন্তত পাঁচ বছরের জন্য।

—বেশ, সেই আশীর্বাদই করছি। কিন্তু রাজা না থাকলে রাজকার্য চলবে কি করে?

—আজকাল তা চলে। আধুনিক বিজ্ঞান বলে যে কর্তা না থাকলেও ক্রিয়া নিষ্পন্ন হয়।

দুর্বাসা বললেন, আমি এখন উঠি। যাঁর জিনিস তাঁকে অর্পণ করে সত্বর দায়মুক্ত হয়ে ব্রহ্মলোকে যেতে চাই।

—অর্পণ করবেন কাকে?

—কেন, মহারাজ ভরতের বংশধর নেই?

—কেউ নেই, ভরতবংশ অর্থাৎ যুধিষ্ঠির-পরীক্ষিতের বংশ লোপ পেয়েছে, তাঁদের যারা উত্তরাধিকারী—নন্দ মৌর্য শুঙ্গ অন্ধ্র গুপ্ত প্রভৃতি, তার পর পাঠান মোগল ইংরেজ, এঁরাও ফৌত হয়েছেন। ভরতের রাজ্য এখন দু ভাগ হয়েছে, বড়টি ভারতীয় গণরাজ্য, ছোটটি ইসলামীয় পাকিস্থান।

—একজন চক্রবর্তী রাজা আছেন তো?

—এখন আর নেই, দুই রাষ্ট্রে দুই রাষ্ট্রপতি বহাল হয়েছেন, একজন দিল্লিতে আর একজন করাচিতে থাকেন। আইন অনুসারে এঁরাই ভরতের স্থলাভিষিক্ত, সুতরাং ঝুমঝুমিটি এঁদেরই হক পাওনা। কিন্তু দেবেন কাকে? একজনকে দিলে আর একজন ইউএন-ও-তে নালিশ করবেন, না হয় তলোয়ার ঘুরিয়ে বলবেন, লড়কে লেঙ্গে ঝুমঝুম্মা।

দুর্বাসা ক্ষণকাল ধ্যানমগ্ন হয়ে রইলেন। তারপর মট করে ঝুমঝুমিটি ভেঙে বললেন, একজনকে দেব এই খোলটা, যাতে পাথর-কুচি আছে, নাড়লে কড়রমড়র করে। আর একজনকে দেব এই ডাঁটিটা, ফুঁ দিলে পিঁ পিঁ করে। দাও তো গোটা দশ টাকা রাহাখরচ।

টাকা নিয়ে দুর্বাসা তাড়াতাড়ি চলে গেলেন।

৭ অক্টোবর ১৯৫১

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *