1 of 2

ভয়ের দুপুর – আলোক সরকার

ভয়ের দুপুর – আলোক সরকার

গল্পের বই পড়তে খুব ভালো লাগে মেঘলার। একটা না—পড়া বই হাতে পেলেই তার বুকের ভিতরটা শিরশির করে ওঠে। ইচ্ছে করে তখনি বসে পড়ে বইটা হাতে নিয়ে। শুরু করে দেয় পড়া। তেমন সুযোগ অবশ্য সবসময় ঘটে না, যতক্ষণ না ঘটে মনটা ছটফট করতে থাকে মেঘলার। বই পড়তে শুরু করে গল্পের সঙ্গে সঙ্গে তরতর করে পাতা উলটোতে উলটোতে এগিয়ে যায় মেঘলা, একদমে, মেঘলার কাছে মুহূর্তের মধ্যে শেষ হয়ে যায় বই। তারপর খুঁজে খুঁজে ভালোলাগার জায়গাগুলো আবার পড়া, বারবার পড়া। তরপর গল্পের নায়ক কেন ও—কাজ করল, না করলেই তো ভালো হত, কেন অমন ঝড়—বৃষ্টি হল সেই রাতে, না হতেও তো পারত, না হলে কী হত, এই সব ভাবতে ভাবতে কখন নিজেই গল্পের নায়ক হয়ে দুর্গম পথের পথিক হয়ে যাওয়া, তা টেরও পায় না মেঘলা।

তবু একটা বই শেষ হবার পর আরেকটা বই চাই তো। আবার নতুন ঘটনা, নতুন দেশ, তার ছায়া—ছায়া নতুন কুয়াশা—মাখা গন্ধ। অত বই পাবে কোথায় মেঘলা। তাদের পাড়ায় লাইব্রেরি আছে কিন্তু তারা ছোটোদের জন্য লেখা বই খুব বেশি রাখে না। ইস্কুলেও একটা লাইব্রেরি আছে, সেখান থেকে সপ্তাহে মাত্র একটা বই পাওয়া যায়। বই কিনে আর কত পড়া যায়, যা দাম হয়েছে বইয়ের! তার ছোটো কাকা বলে তাদের সময়ে একটা টাকা দিলে কাঞ্চনজঙ্ঘা সিরিজের দুটো বই পাওয়া যেত, ‘ভোম্বল সর্দারে’র দাম ছিল ছ—আনা মানে আজকের দিনের চল্লিশ পয়সার মতো। এখন হাতে বেশ কিছু টাকা, অন্তত কুড়িটা টাকা না নিয়ে বইয়ের দোকানে ঢোকার কথা ভাবাই যায় না।

সারা মাসে কুড়ি—পঁচিশ টাকার বেশি সংগ্রহ করেও উঠতে পারে না মেঘলা। মানে, প্রতিমাসে মাত্র একটা বই কেনা। আর মাঝে—মাঝে জন্মদিনে কিংবা পুজোর আগে কিছু বই উপহার পাওয়া।

বাধ্যত মেঘলাকে নানান উপায় ভাবতে হয়। সে সহজে অন্যের কাছ থেকে কিছু চাইবার পাত্র নয়, কিন্তু বইয়ের ব্যাপারে অন্য কথা। তার এক বন্ধু আছে, খুব কাছের বন্ধু, বলা যেতে পারে Intimate friend, তার সঙ্গে একটা চুক্তি হয়েছে। পান্থ, পান্থপ্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, আর সে ঠিক করেছে ইস্কুল থেকে পাওয়া প্রতি সপ্তাহের বইটা সপ্তাহের মাঝামাঝি তারা বদল করে নেবে। তাহলে সপ্তাহে দুটো বই পড়া হবে। পান্থও প্রতি মাসে অন্তত একটা বই কেনে। কেনা বইটাও মেঘলার প্রত্যেক মাসে কেনা বইটার সঙ্গে মাসের মাঝামাঝি পান্থর বইটা আদানপ্রদান করা যেতে পারে, যেমন উপহার পাওয়া বইগুলোও।

মেঘলার আর একটা নেশা গল্পের বই জমানো। সে নেশাও কম নয়। বরং বলা যেতে পারে অনেক অনেক বেশি। নিজের কেনা আর উপহার—পাওয়া বইগুলো পড়া হয়ে গেলে মেঘলা তার বুকশেলফ সাজিয়ে রেখে দেয়। লাইব্রেরিতে যেমন থাকে, তেমনি, প্রত্যেক বইয়ের একটা নম্বরও দিয়ে দেয় সে। বইয়ের বিষয়ও চিহ্নিত থাকে সেই নম্বরে। যেমন বইটা যদি ছোটোগল্পের হয় তাহলে নম্বর হবে ছো ৩০, উপন্যাস হলে উ ১৬— এইরকম। রবিবার দিন স্নান করতে যাওয়ার আগে বইয়ের, বুকশেলফের ধুলো পরিষ্কার করতে কোনো ভুল হয় না মেঘলার।

পান্থর বুকশেলফের সব বই সুন্দর কাগজের মলাট দিয়ে ঢাকা থাকে। মলাটের ওপর পান্থর নিজের হাতে আঁকা ছবি— সেই ছবি ভিতরের ছবিরই হুবহু অনুকরণ। পাছে আসল ছবি একটুও ময়লা হয়ে যায় সেই ভয়ে পান্থ এইভাবে বই রাখে। পান্থ প্রতিটি বইয়ের পাতার ফাঁকে নিমপাতা রাখে, এতে নাকি বইয়ে পোকা ধরে না। সাতদিন অন্তর নিমপাতা পালটে দেয় পান্থ। এ ছাড়া ন্যাপথলিন তো আছেই। পান্থের বইয়ের নম্বর আরও বিশদ। যেমন, হেমেন্দ্রকুমার রায়—এর ‘যখের ধন’—এর নম্বর হবে হে। য। ১২, বিভূতিভূষণের ‘চাঁদের পাহাড়’—এর বি। চাঁ। ২০।

—তোর কত বই হল রে মেঘলা?

—এইট্টি ফাইভ। তোর?

পান্থ ম্লান হেসে বলল— বাহাত্তর।

একশো বই জমানোর কাজ কে আগে শেষ করতে পারবে এ নিয়ে দুজনের মধ্যে এক সূক্ষ্ম প্রতিদ্বন্দ্বিতা আছে।

কেবল বই সংগ্রহ নয়, মেঘলা আর পান্থ সেই বইগুলোই জমাতে চায় যেগুলো তাদের কাছে অসাধারণ। কত বই পড়া হয়, সব বই তো জমাবার মতো নয়। বই জমাবার ব্যাপারে তারা নতুন দিনের লেখক পুরোনো দিনের লেখকের মধ্যে কোনো বাছবিচার করে না। সুকুমার দে সরকারের ‘ময়ূরকণ্ঠী বন’ নামের বইটা মেঘলার বুকশেলফে আছে, এই নিয়ে তার কম গর্ব! পান্থর আনন্দ সুনীলচন্দ্র সরকারের ‘কালোর বই’ নামের বইটা সে হঠাৎ বইমেলায় পেয়ে গিয়েছিল বলে।

সত্যি বলতে তেমন ভালো বই আর ক—টায় বা পাওয়া যায়। তেমন ভালো বই যা নিয়ে বিকেলবেলায় মাঠে পাশে বসে দুজনে অনেকক্ষণ আলোচনা করা যায়। গল্প করা যায়। গল্প করতে করতে সন্ধে হয়ে যাবে, কেউ টেরই পাবে না। খুব একলা একটা একটা পথের মতো বই। সেই বই বুকশেলফে থাকবে আর তার দিকে চোখ পড়লেই মনে হবে সন্ধে হয়ে গেছে, খুব অন্ধকার সন্ধে, আর আস্তে আস্তে, কেউ শুনতেই পাচ্ছে না এমন আস্তে একটা থামা—থামা অনেক দূর নেমে আসছে।

মেঘলার এক মাসতুতো দিদি, অনসূয়া, তারও ছিল বই পড়বার আর বই জমানোর নেশা। বিয়ে হবার পর পুনেয় চলে যাবার পর সে আর অবশ্য বইটইয়ের কথা বিশেষভাবে না। কলকাতাতেই আসে বছরে একবার, তাও ওই দু—চারদিনের জন্যে। মাসিমা ওর কলকাতার বাড়িতে রেখে—যাওয়া শখের জিনিসপত্রের সঙ্গে ওর বইয়ের আলমারি, আলমারিতে রাখা বইগুলোরও খুব যত্ন করে ঝাড়ামোছা করেন নিয়মিত। কত লোভনীয় বই যে আছে অনুদির বইয়ের আলমারিতে দেখলে চোখ জ্বলজ্বল করে ওঠে। কিন্তু মাসিমা একটা বইও কাউকে দেবেন না। সে কতবার চেয়েছে, মাসিমা কথার উত্তর না দিয়ে অন্য কথা বলতে শুরু করেছেন। এ জন্য কম কষ্ট তার মনে! মাসিমার কাছে আজকাল আর কোনো বই চায় না সে। মাসিমার বাড়ি যেতেই ইচ্ছে করে না তার। তবু মাঝে—মাঝে তো যেতেই হয়। যখনই যায় সে সোজা অনুদির বইয়ের ঘরে চলে যায়, দাঁড়ায় বইয়ের আলমারির সামনে। একদিন এমনি অনুদির বইয়ের আলমারির সামনে দাঁড়িয়ে আছে, একেবারে তন্ময় হয় মনে—মনে পড়ে যাচ্ছে একটার পর একটা বইয়ের নাম, যার কিছু পড়া হলেও, কিছু তার নিজের থাকলেও, অনেক বই—ই তার না—পড়া। একটা বইয়ের নাম ‘২৪শে এপ্রিল, চুপ’, আর একটা বইয়ের নাম ‘রূপনারায়ণের মাঝি’। না—পড়া বইগুলোর নাম পড়ছে আর বুকের মধ্যে ঝিমঝিম একটা কাঁপুনি হচ্ছে তার। এমন সময় মাসিমা ঘরে ঢুকতেই তার মুখ থেকে নিজের অজান্তেই বেরিয়ে গেল, ‘একটা বই পড়তে দিন না মাসিমা, আমি কালই ফেরত দেব।’

মাসিমা খুব গম্ভীর বিরক্তি—মেশানো গলায় বললেন, ‘না না, বারবার বই চেয়ে আমায় বিরক্ত কোরো না মেঘলা। ও অনুর বই, ও আমি কারোকে দেব না। অনু কত যত্ন করে জমিয়েছে বইগুলো।’

মাসিমার কথা শুনে মাথা নীচু করে ঘর থেকে বেরিয়ে এল মেঘলা। অভিমানে লজ্জায় চোখে জল এসে গেল তার। মেঘলাকে এইরকম শক্ত উত্তর দিয়ে মাসিমাও মনে মনে খুব কষ্ট পেয়েছিলেন নিশ্চয়। মাসিমার বাড়ি থেকে চলে আসবে বলে সবে সিঁড়িতে পা রেখেছে এমন সময় শুনতে পেল মাসিমার গলা, ‘কী খুব রাগ হয়েছে!’ মাসিমা তার পিঠে হাত রেখে বললেন, ‘চল তোকে এখনি বই দিচ্ছি।’

প্রায় জোর করে মাসিমা তাকে বইয়ের ঘরে নিয়ে এলেন। আলমারি খুলে একটা বই বার করে তার হাতে দিয়ে বললেন, ‘নিয়ে যা, তোকে আর ফেরত দিতে হবে না।’ একটু থেমে বললেন, ‘অনুর বই আমি কী করে দিই বল! অনু কতদূরে চলে গেছে।’

বইটা হাতে নিয়ে মলাটের ওপর চোখ পড়ল মেঘলার। ঘন কালো হরফে লেখা ‘ভয়ের দুপুর’। সারা মলাট জুড়ে ফিকে হলুদ রঙে আঁকা একটা দুপুরের ছবি, যে দুপুরে একটি মাত্র মানুষ হুহু ধুলোর মধ্যে বসে অনেক অনেক দূরের দিকে চেয়ে আছে।

বাড়ি এসে বইটা পড়ে ফেলল মেঘলা। আশ্চর্য বই। একেবারে নতুন পৃথিবীর বই। বৈশাখ মাসে নির্জন দুপুরের পথে কত ধরনের ভয়, কত ধরনের আলো, আলো ঘুমিয়ে পড়ছে, জেগে উঠছে আলো, হাওয়া একেবারে বোবা, ওই হাওয়ায় ছুটে পালিয়ে যাচ্ছে অন্ধকার অজানায়। বই শেষ হবার পর, একবার দুবার তিনবার শেষ হবার পর বারান্দায় গিয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল মেঘলা। তার চোখে হাজার ছবি, একটা ছবির ওপরে আর একটা ছবি, ছবির পাশে আর একটা ছবি— সব ছবি যত চেনা ঠিক ততটাই অচেনা।

এমন আশ্চর্য বই পান্থকে না—পড়লেই নয়। মেঘলা তার ইস্কুল ব্যাগের মধ্যে বইটা রেখে দিল।

পরের দিনই বইটা সে পান্থকে দিল। আর তার পরের দিনই ইস্কুলে দেখা হতেই পান্থ তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘তুই আমাকে কী বই পড়ালি মেঘলা!’

পড়াশুনো শেষ করে রাতের খাবার খাওয়ার পর ‘ভয়ের দুপুর’ পড়তে শুরু করে পান্থ। এক ঘণ্টার মধ্যে বই পড়া শেষ। আর তারপর থেকে একটা ঘোরের মধ্যে আছে পান্থ। গল্পের ছবিগুলো তার সারা মন জুড়ে বাজছে, সে গল্পের দুঃখ বিস্ময় রহস্যের মধ্যেই আছে। যেন একটা ঘন গাছের অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া, মস্ত বড়ো বাড়ির শেষের ঘরে দাঁড়িয়ে, কখনো একটা দিঘির পাশে যার রাত্রি—রং জলের ওপরের প্রতিটি ঢেউ অবিরাম হাতছানি দিয়ে এমন একজনকে ডাকছে যে কোথাও নেই। যে কোথাও কোনো দিন থাকবে না। ছবির শেষ নেই ‘ভয়ের দুপুরে’, শেষ নেই ভয়ের, যে ভয় মানুষকে চেঁচিয়ে উঠতে বলে না, বরং বলে তোমরা চুপ কর, আরও অনেক বেশি চুপ কর তোমরা।

সেদিন বিকেলে খেলার মাঠের পাশে বসে সন্ধে হওয়া পর্যন্ত ‘ভয়ের দুপুর’ নিয়ে দুজনের গল্প আর থামতেই চাইল না। বাড়ি ফেরবার পথে মেঘলা পান্থকে বলল— কাল বইটা মনে করে আনিস আর একবার পড়ব।

পরের দিন বইটা ফেরত দিয়ে পান্থ বলল— আমি আবার তোর কাছ থেকে বইটা নেব মেঘলা।

মেঘলা বইটা পান্থকে দিয়েছিল কিন্তু সাতদিন পার হবার পরও পান্থর কাছ থেকে ‘ভয়ের দুপুর’ ফেরত পেল না মেঘলা। রোজ পান্থকে বইটা পরের দিনটা আনতে বলে, রোজই বইটা আনতে ভুলে যায় পান্থ। শেষে একটু কঠিন হতেই হল মেঘলাকে: কাল তুই ঠিক বইটা আনবি পান্থ। আমি বইয়ের শেলফে নম্বর দিয়ে রাখতে পারছি না।

—তুই বইটা আমাকে একেবারে দিয়ে দিবি মেঘলা? ও বই হাতছাড়া করতে কী যে কষ্ট হবে।

—না না! তা কী করে হবে। তুই আমার বই কালই ফেরত দিবি। না হলে খারাপ হবে।

পান্থর মুখটা খুব কালো হয়ে গেছে, লক্ষ করল মেঘলা। কিন্তু সে কী করবে? এইরকম আবদার করাটাই অন্যায় হয়েছে পান্থর।

পান্থ আস্তে আস্তে মেঘলার সামনে থেকে সরে গেল।

তার কিছুদিন পর থেকে ইস্কুলে আর আসেই না পান্থ। কী হল পান্থর। অসুখ হয়েছে? মেঘলার ওপর খুব রেগে গেছে পান্থ? মেঘলার ওপর রেগে গেলে না হয় সে আর কথাই বলবে না মেঘলার সঙ্গে, তা বলে একেবারে ইস্কুলে আসা বন্ধ করে দেওয়া! পান্থর জন্য মনটা খুব খারাপ থাকে মেঘলার, খুব কষ্ট হয়। সে কখনো পান্থর বাড়ি যায়নি, পান্থর বাড়ি চেনা থাকলে যে এখনি যেত।

শেষপর্যন্ত পান্থর বাড়ির খোঁজ পাওয়া গেল। তাদের ক্লাসের অর্ঘ্যদীপ চেনে পান্থর বাড়ি। পান্থ তাদের পাড়াতেই থাকে।

পান্থর ইস্কুলে না—আসা তখন প্রায় তিনমাস হয়ে গেছে। অর্ঘ্য পান্থর বাড়ি চেনে শোনার সঙ্গে সঙ্গে সে ঠিক করল কালই সে অর্ঘ্যর সঙ্গে পান্থর বাড়ি যাবে। বাড়িতে বলে রাখবে ইস্কুল থেকে ফিরতে একটু দেরি হবে তার।

পরের দিন ইস্কুলের ছুটির পর মেঘলা পৌঁছল পান্থর বাড়ি। অর্ঘ্য সঙ্গে আছে। দরজার বেল বাজাতে দরজা খুলে দিলেন এক মহিলা।

মেঘলা বলল, আমার নাম মেঘলা, আমি পান্থর বন্ধু। পান্থ কেন আর ইস্কুলে আসে না মাসিমা?

—তুমি মেঘলা! ভদ্রমহিলা একদৃষ্টে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন মেঘলার মুখের দিকে। আস্তে নীচু গলায় বললেন— পান্থ তোমাকে কী যে ভালোবাসত!

তারপর মুখে হাত চাপা দিয়ে কেঁদে উঠে বললেন— পান্থ নেই, পান্থ চলে গেছে মেঘলা।

সারা শরীর কাঁপতে থাকল মেঘলার। মাসিমার কথার ঠিক কী মানে তাও যেন বুঝতে পারল না সে। তার চোখের সামনে কেমন একটা অন্য রং—এর আলো।

কিছুক্ষণ পরে একটু শান্ত হয়ে মাসিমা তাদের বাড়ির ভিতরে নিয়ে গেলেন, অনেকক্ষণ গল্প করলেন তাদের সঙ্গে, সবই পান্থকে নিয়ে। পান্থ কত অভিমানী ছিল, পান্থর মন কত স্বপ্ন—ভরা ছিল এ সব বলতে বলতে বললেন— চল তোমাদের পান্থর নিজের ঘরে নিয়ে যাই।

পান্থর ঘরে এসেই মেঘলার চোখে পড়ল পান্থর বইয়ের র‌্যাাক। একেবারে সামনেই একটা বই, নাম, ভয়ের দুপুর।

বইটা হাতে তুলে নিয়ে মাসিমা বললেন— তোমার কাছ থেকে এই নামের একটা বই এনেছিল। তোমাকে তাড়াতাড়ি ফেরত দিতে হবে তাই কাগজ কিনে ঠিক ‘ভয়ের দুপুর’—এর মাপের একটা খাতা তৈরি করেছিল পান্থ। ওপরে শক্ত মলাট দিয়েছিল ‘ভয়ের দুপুর’—এর মতো, ‘ভয়ের দুপুর’—এর মলাটের ছবিটাও এঁকেছিল তার ওপর ঠিক ‘ভয়ের দুপুর’—ওই যেমন আছে সেই রকম রং দিয়ে। ইচ্ছে ছিল সারা বইটায় কপি করবে বাঁধানো খাতায়। তোমার নাকি তাড়াতাড়ি দরকার বইটা, দুদিন ইস্কুলেও যায়নি কপি করার কাজ শেষ করবে বলে।— কপি শেষ হয়নি। দুদিনে আর কতটুকু কপি করা যায়!

পান্থর ‘ভয়ের দুপুর’ মাসিমা মেঘলার হাতে দিলেন।

মেঘলার কানের কাছে ঘুরে ঘুরে বাজছে— তুই বইটা আমাকে একেবারে দিয়ে দিবি, মেঘলা। তুই বইটা আমাকে একেবারে দিয়ে দিবি, মেঘলা।

পান্থর ‘ভয়ের দুপুর’ মেঘলার হাতের ওপর যেন নিজের থেকেই একপাতা দু—পাতা খুলে যাচ্ছে। মেঘলা লক্ষ করল মাত্র সতেরো পাতা পর্যন্ত কপি করতে পেরেছে পান্থ।

মাসিমা বলেই চলেছেন ‘ভয়ের দুপুর’ বইটাই কী—যে ছিল! ওর বড়ো ভালো লেগেছিল বইটা।

এসব মেঘলার ছোটোবেলার গল্প। এখন অনেক বড়ো হলেও বই পড়ার, বই জমানোর নেশা একটুও কমেনি তার। আজও বইয়ের দোকানে, বইমেলায়, পুরোনো বইয়ের দোকানে, নানান লাইব্রেরিতে বই খুঁজতে খুঁজতে কখনো কখনো তার বুকে খুব ঠান্ডা একটা ভয় বেজে ওঠে। বই খুঁজতে খুঁজতে ‘ভয়ের দুপুর’ নামের কোনো বই হঠাৎ চোখে পড়বে না তো তার! তার বই খোঁজার হাত তখন হঠাৎ শীতল হয়ে আসে। বই খোঁজা বন্ধ করে সে তাড়াতাড়ি রাস্তায় নেমে আসে। আলো—জ্বলা, ভিড়ে—ভরা রাস্তার রং খুব ঝিমানো ঠান্ডা আর চুপচাপ হয়ে নেমে আসে তার চারিদিকে।

তার কানের পাশে খুব দূর থেকে অস্পষ্ট বেজে ওঠে— তুই বইটা আমাকে একেবারে দিয়ে দিবি, মেঘলা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *