ভবরোগবৈদ্য
ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ যে-কালে আবির্ভূত হয়েছিলেন এবং যে-সময়টিকে ধরে রেখেছিলেন, সেই কালের সঙ্গে বর্তমানকালের বিশেষ কোন পার্থক্য নেই। বিলেত থেকে যন্ত্রসভ্যতার ঝাঁজ আসছে। মিশনারিরা হিন্দুদের ‘হিদেন’ বলে ঘৃণা করতে শেখাচ্ছেন। শিক্ষার মূল কেন্দ্রটিকে কবজা করে যুবকদের ভোগবাদ শেখাচ্ছেন। তাঁদের পরিষ্কার ঘোষণা – “Humanity in its worst form is Hinduism.” সেরা ছাত্ররা খ্রীস্টান হওয়ার জন্য ব্যাকুল। মাইকেল ‘অ্যালবিয়ান শোর’-এর জন্য আকুল। ‘ক্যাপটিভ লেডি’ লিখে তিনি ইংরেজ কবিকুলের সমতুল হতে চাইছেন। ডেপুটি যুবক বঙ্কিমচন্দ্র মানুষের কর্তব্য সম্পর্কে বলতে চাইছেন—আহার, নিদ্রা, মৈথুন। বিদ্যাসাগরের ভক্তি ও বিশ্বাস মিশ্রিত ধর্মে কোন আগ্রহ নেই। রামমোহন পৌত্তলিকতা পরিহার করে ব্রহ্মবাদী। দ্বারকানাথ শিল্পপতি। কুইনের ঘনিষ্ঠ। দেবেন্দ্রনাথ নতুন ধর্মের প্রবক্তা। সে-ধর্ম যেন হিন্দুধর্ম নয়। নিরাকার সগুণ ব্রহ্ম। কেশবচন্দ্র দিচ্ছেন ‘পালপিট লেকচার’, যার ইংরেজী করলে দাঁড়ায়—”Oh, Lord, thou art merciful.” পাপ-পুণ্যের বিচার। যেন মিশনারিদের উলটো পিঠ। তাঁদের খ্রীস্ট বলছেন : “আমার কাছে আইস, আমি তোমাদের পাপ হইতে উদ্ধার করিব।” ব্রাহ্মরা বলছেন : “সত্যমঙ্গল প্রেমময় তুমি ধ্রুব জ্যোতি তুমি অন্ধকারে।”
ব্রিটিশের খয়ের খাঁ, ব্যানিয়ান, মুৎসুদ্দিতে দেশ ভরপুর। হুতোমের বাবুরা কাপতেনি আর রক্ষিতা-বিলাসিতায় বিভোর। পুরোহিতরা হিন্দুধর্মের শকুন। নারীরা অন্তঃপুরে সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র। বারো ইয়ারের বারোয়ারি, জেলেপাড়ার সঙ। কালীঘাটের পটুয়াদের ব্যঙ্গচিত্র। বিলেত থেকে ধার-করা আইরিশ আন্দোলনের ছাঁচে ঢালা স্বদেশী চেতনার উঁকিঝুঁকি। মাইকেলের সংস্কৃত ও বাঙলা চৰ্চা।
ঠাকুরের একটি ফুৎকার—ধুস্ শালা মতুয়া!
দূরবীন দিয়ে কালকে দেখছেন। বর্তমান তো দেখছেনই, ভবিষ্যৎও সুস্পষ্ট। অনাগত কালের ছবি স্পষ্ট। নিজের বিশ্বাসের খোঁটাটিকে ধরে আছেন। সেই অবস্থায় থেকে ধর্মের এক-একটি পথ ধরে এগোচ্ছেন, শেষ দেখছেন। ফিরে এসে বলছেন : “যত মত তত পথ।” দূরবীনে দেখেছিলেন, ইংরেজ দ্বিজাতিতত্ত্বের ছুরি দিয়ে ভারত নামক কেকটিকে খণ্ড খণ্ড করবে। বিদ্বেষ বাড়বে, বাবরি মসজিদ ভাঙবে। দেখেছিলেন, উত্তরে ও দক্ষিণে উচ্চবর্ণের হিন্দু অচ্ছুৎ-চেতনায় আচ্ছন্ন হয়ে মহাত্মার হরিজনদের পায়ে পিষবে। প্রেমচন্দ্র লিখবেন ‘সদ্গতি’। অজগরের শ্বাসে সিমুলিয়ার অ্যাটর্নি-সন্তান, ইংরেজী শিক্ষায় শিক্ষিত নব্যযুবক নরেন্দ্রনাথকে তুলে আনলেন। স্ট্যান্ডবাই। তোর মধ্য দিয়ে আমি কাজ করব। নরেন্দ্রনাথ বিদ্রোহী। বললেন : “পারব না আমি।” ঠাকুরের ধমক : “তোর হাড় পারবে।” তোর সমাধিতে লীন হয়ে থাকার বাসনা এই আমার কাছে রইল। চাবি আমার কাছে। সময় হলে খুলে দেব। অন্য পার্ষদদের বললেন, নরেনের পরিচয় জান? পরিচয় তো সবাই জানে। কলকাতার বিখ্যাত অ্যাটর্নি সিমুলিয়ার বিশ্বনাথ দত্তের কৃতী পুত্র! সে তো তার বর্তমান জাগতিক পরিচয়। আসল পরিচয়? সপ্তর্ষিমণ্ডলের এক ঋষি। যেদিন নিজেকে জানতে পারবে সেইদিনই চলে যাবে। আমার জন্য এসেছে। আমরা একটা টিম। একটা কোম্পানি। অনাগত কালের হাতে এমন একটা ওষুধ তুলে দিয়ে যাব, যাতে ভবরোগ সেরে যায়। আমরা সেই ভবরোগবৈদ্য। ওষুধটা কি! সেটা কবিরাজি, হোমিওপ্যাথি, অ্যালোপ্যাথি না হেকিমি! সেটা হলো মন। সংসারে সুখে থাকার একটা মন তৈরি করে দিয়ে যাব। তৈরি করার ফর্মুলাটা পেটেন্ট করে রাখব না, পাবলিক করে দিয়ে যাব। কোন গুরুরই প্রয়োজন যখন থাকবে না, তখন আবার গুরুমুখী বিদ্যা কি! আধুনিক মানুষ! তোমাকে অরণ্যচারী সন্ন্যাসী, কন্দরবাসী যোগী হতে হবে না। দূরবীনে দেখেছিলেন, অরণ্য থাকবে না। যেটুকু থাকবে, সেখানে বিচরণ করবে বাঘ নয়, সন্ত্রাসবাদী সশস্ত্র মানুষ। হিমালয়ের হিমতীর্থে মানুষ যাবে সেনাবাহিনীর প্রহরায়। তাই বনের বেদান্তকে ঘরে এনে দিলেন। কঠ-উপনিষদের এই মন্ত্রটি স্মরণে রাখতে বললেন :
“অণোরণীয়ান্ মহতো মহীয়ান্ আত্মাঽস্য জন্তোনিহিতো গুহায়াম্।
তমক্রতুঃ পশ্যতি বীতশোকো ধাতুপ্রসাদান্মহিমানমাত্মনঃ।।”
উপনিষদ্, আত্মাকে বর্ণনা করছেন। কেমন তিনি! সূক্ষ্ম হতে সূক্ষ্মতর, বিশাল হতে বিশালতর। কোথায় তিনি আছেন? মন্দিরে, মসজিদে, অরণ্যে, পর্বতকন্দরে? না, প্রত্যেক জীবের হৃদয়গুহায় তিনি আছেন। তাঁর দর্শন পাব কেমন করে? অন্তঃকরণ বিশুদ্ধ করতে হবে। কামনা-বাসনা, আসক্তি, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য—কিছুই যেন না থাকে। এরূপ নিষ্কাম ব্যক্তি তাঁকে দর্শন করে কি হবেন? ঠাকুর বলছেন, সমাধিলাভ করার পর মানুষের কি দশটা হাত-পা বেরবে? আজ্ঞে না। সেই আগের মানুষটি। ধুতি-শার্ট পরে নিজের কাজে চলেছেন। কিন্তু ভিতরটা বদলে গেছে। তিনি শোকাতীত হয়েছেন।
ঐ যে,শ্রীভগবান গীতায় বলছেন, তোমার ভ্রান্তবুদ্ধিই শোক-মোহ-কৰ্তৃত্ব- ভোক্তৃত্বরূপ সংসারের কারণ। একমাত্র আত্মজ্ঞানেই এই ভ্রান্তির আত্যন্তিক নিবৃত্তি হবে। গীতায় ভগবান বললেন :
“ন ত্বেবাহং জাতু নাসং ন ত্বং নেমে জানাধিপাঃ।
ন চৈব ন ভবিষ্যামঃ সর্বে বয়মতঃপরম্।।”
যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড় করিয়েছেন পার্থকে। একটু পরেই চোখের সামনে প্রিয়জনদের মৃত্যু দেখবেন তিনি। তাই ভগবান তাঁকে আত্মদর্শন করাচ্ছেন। পূর্বে আমি কখনো ছিলাম না—এমনটি ভেবো না, তুমি কখনো ছিলে না তাও নয়। আর সামনে সমবেত রাজন্যবর্গ ছিলেন না—এটাও সত্য নয়। বর্তমানে দেহসত্ত্বেও আমরা নিত্য আত্মস্বরূপে বিদ্যমান আছি, আর দেহান্তে ভবিষ্যতেও নিত্য আত্মরূপে বিরাজমান থাকব। উচ্চারণ করলেন সেই শ্রেষ্ঠ উক্তিঃ “ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে।”
আমার ঠাকুর বললেন, দর্শন করাটাই দর্শন। শ্রুতি, স্মৃতি, ন্যায়, দর্শন, পাত্রাধার তৈল, তৈলাধার পাত্র—যাবতীয় তর্কে কিচ্ছু না। একটু শ্লেষের ধরনেই বললেন, তর্ক করতে চাও। কেশবের কাছে যাও। বিশ্বাস করতে চাও, আমার কাছে এস। আমি ফলিত। আমি বাবুর বাগানে আম খেয়েছি, ডালে ডালে কত আছে তার সংখ্যা গণনা করিনি। আমি জানি শঙ্করাচার্যের একটিমাত্র সার কথা—
*
“ভজ গোবিন্দং ভজ গোবিন্দং ভজ গোবিন্দং মূঢ়মতে!
প্রাপ্তে সন্নিহিতে মরণে, ন হি ন হি রক্ষতি ডুকুকরণে।।
যাবজ্জীবো নিবসতি দেহে কুশলং তাবৎ পৃচ্ছতি গেহে।
গতবতি বায়ৌ দেহাপায়ে ভাৰ্য্যা বিভ্যতি তস্মিন্ কায়ে।।”
শাস্ত্র, মন্ত্র, অং বং চং কিছুই তোমাকে রক্ষা করতে পারবে না, যদি না তুমি সময়ে সংসারটিকে চিনতে পার। শঙ্কর যেভাবে মূঢ়মতিদের সচেতন করতে চেয়েছিলেন, ঠাকুরও ঠিক সেইভাবেই সংসারীদের সংসারে থেকেও নির্ভয়ে শান্তিতে থাকার কৌশলটি শেখাতে চেয়েছিলেন। দূরবীনে দেখেছিলেন, সময় আরো জটিল হবে। সংসার আরো স্বার্থপর হবে। যতদিন তুমি বেঁচে আছ, ততদিনই তোমার খবরাখবর রাখবে। শঙ্কর বেঁচে থাকার সাধারণ ব্যাখ্যা করেছিলেন—যতদিন না তোমার প্রাণবায়ু নির্গত হচ্ছে। একালের ব্যাখ্যা হলো—যতদিন তোমার রোজগার, ততদিনই তোমাকে জীবিত মনে করবে সংসার। ফেল কড়ি মাখ তেল। কড়ি গেল তো সব গেল। তুমি জীবস্মৃত যতদিন তুমি টাকশাল, ততদিন তোমার কদর। এইটা তোমাকে আগেই বুঝে নিতে হবে। অহঙ্কারটাকে মারতে হবে। বিচার করে, নাম করে, অভ্যাস করে। বারে বারে প্রশ্ন—অহং কার? দেহের নয়, পদের নয়, ঐশ্বর্যের নয়, অহং কার? তোমার। তোমার অহঙ্কারে অহঙ্কৃত আমি। সব তোমার কিন্তু তুমি আমার যতক্ষণ অহঙ্কার ততক্ষণ অজ্ঞান। অহঙ্কার থাকলে মুক্তি হবে না। অসম্ভব।
মহেন্দ্রনাথকে টেনে এনেছেন টিমে। বলছেন, তোমার লক্ষণ ভাল ছিল, কিন্তু সংসারে ঢুকে পড়েছ। সন্তানাদি হয়েছে। পণ্ডিতও বটে। শিক্ষকতা কর। তা হোক। তোমাকেই আমার প্রয়োজন। কি কারণে প্রয়োজন, সেটা নরেন তোমাকে পরে লিখে জানাবে। তোমার মুখ আমার খুব চেনা। মহাপ্রভুর পার্ষদদের দলে তোমাকে আমি দেখেছি। আমার কৃপায় তোমার সত্তা পালটাবে। এখন জ্ঞানে আছ, অতঃপর প্রজ্ঞানে থাকবে। যেটুকু অঙ্কট-বঙ্কট আছে, সেটুকু আমি সোজা করে দেব। জ্ঞানহাতুড়ি দিয়ে অজ্ঞান-আখরোট ভাঙব।
সংসারে শান্তি পেলে না। সস্ত্রীক রাতেই গৃহত্যাগ। শ্যামবাজারের কাছে ঘোড়ার গাড়ির চাকা গেল খুলে। বন্ধুর বাড়িতে রাতের আশ্রয় নিতে গিয়ে তাদের বিব্রতভাব দেখে শিখলে, সুসময়ে অনেকের বন্ধু বটে হয়। অসময়ে হায়, হায়, কেউ কারো নয়। আবার সেই রাতেই গাড়ি যোগাড় করে এলে বরানগরে বোনের বাড়িতে। সেখান থেকে তোমার উদ্দেশ্যহীন বিচরণে এই প্রদোষকালে তুমি এলে এখানে। ঢোঁড়া সাপে ধরলে ব্যাঙেরও বিপদ, সাপেরও বিপদ। কিন্তু যদি ধরে কেউটে কি গোখরো সাপে, এক ছোবলে শেষ। ঠাকুর জিজ্ঞাসা করলেন : “আচ্ছা, তোমার পরিবার কেমন? বিদ্যাশক্তি না অবিদ্যাশক্তি!” উত্তর : “আজ্ঞা ভাল, কিন্তু অজ্ঞান।”
ঠাকুর দপ করে জ্বলে উঠলেন—”আর তুমি জ্ঞানী?”
বিষয়টিকে আলাদা করে রাখলেন। পুরুষের পৌরুষের অহঙ্কারে নারীশক্তিকে ছোট করে দেখা। মেয়েদের পায়ে দলানো। এটা নরেন সামলাবে। আমেরিকা থেকে ঘুরে এসে। তার আহ্বানে আসবে আইরিশ-দুহিতা মিস মার্গারেট নোবল। ইত্যবসরে আমি আরেক খেলা দেখাব, জয়রামবাটীর গ্রাম্য বালিকা সারদেশ্বরীকে সরস্বতী করব। আমার সমস্ত শক্তিকে তার পদতলে ফেলে দেব, এমনকি জপের মালাটিও।
“ত্বং স্বাহা ত্বং স্বধা ত্বং হি বষট্কারঃ স্বরাত্মিকা।
সুধা ত্বমক্ষরে নিত্যে ত্রিধা মাত্রাত্মিকা স্থিতা।।
অর্ধমাত্রা স্থিতা নিত্যা যানুচ্চার্যা বিশেষতঃ।”
মহেন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন, লেখাপড়া শিখলে, বই পড়তে পারলে জ্ঞান হয়। ঠাকুর ভুলটা ভেঙে দিলেন। অবশ্য দ্বিতীয় দর্শনে। প্রথম দর্শনটি ছিল সংক্ষিপ্ত। শোন মহেন্দ্রনাথ, ঈশ্বরকে জানার নাম জ্ঞান, ঈশ্বরকে না জানার নামই অজ্ঞান। এইবার বল, তুমি কি জ্ঞানী!
“আচ্ছা, তোমার ‘সাকারে’ বিশ্বাস, না ‘নিরাকারে’?”
মহেন্দ্রনাথ : “আজ্ঞা, নিরাকার-আমার এইটি ভাল লাগে।”
বললেন বটে, কিন্তু মন তোলপাড়। সাকারে বিশ্বাস থাকলে কি নিরাকারে বিশ্বাস হয়? ন্যায় কি বলছেন, দুটো বিরুদ্ধ অবস্থা কি করে সত্য হতে পারে! সাদা জিনিস দুধ কি আবার কালো হতে পারে?
মহেন্দ্রনাথের সংশয় প্রকাশ না পেলেও অন্তর্দর্শী ঠাকুর টের পেয়েছেন। প্রসঙ্গটা ছাড়লেন না। বললেন : “তা বেশ। একটাতে বিশ্বাস থাকলেই হলো। নিরাকারে বিশ্বাস, তা তো ভালই। তবে এ-বুদ্ধি কর না যে, এইটি কেবল সত্য আর সব মিথ্যা। এইটি জেনো যে, নিরাকারও সত্য আবার সাকারও সত্য। তোমার যেটি বিশ্বাস, সেইটিই ধরে থাকবে।”
অহঙ্কারে হাতুড়ির দুটো ঘা পড়েছে। শেষ ও তৃতীয়টি এখনো বাকি
মহেন্দ্রনাথ তর্কে এগোচ্ছেন। সহজে নিজের কোট ছাড়েন কি করে! প্রশ্ন করছেন : “আজ্ঞা, তিনি সাকার—এই বিশ্বাস যেন হলো! কিন্তু মাটির প্রতিমা তিনি তো নন।”
ঠাকুর খুব নরম করে বললেন : “মাটি কেন গো! চিন্ময়ী প্রতিমা।”
মহেন্দ্রনাথ স্বীকার করছেন, চিন্ময়ী প্রতিমা বলতে ঠাকুর কি বোঝালেন পরিষ্কার হলো না। সেই কারণে তিনি একটু খোঁচা মারলেন—”আচ্ছা, যারা মাটির প্রতিমা পূজা করে তাদের তো বুঝিয়ে দেওয়া উচিত যে, মাটির প্রতিমা ঈশ্বর নয়, আর প্রতিমার সম্মুখে ঈশ্বরকে উদ্দেশ করে পূজা করা উচিত।” সদ্যপরিচিত, শিক্ষক, ফ্রি-থিঙ্কার মহেন্দ্রনাথকে ঠাকুর ছাড়লেন না। তিনি কি কারো তোয়াক্কা করতেন! ডেপুটি বঙ্কিমকে বলেছিলেন একেবারে মুখের ওপর : “এঃ, তুমি তো বড় ছ্যাঁচড়া!” বিদ্যাসাগরের মতো বিশাল মানুষকে বললেন : অন্তরে সোনা আছে, এখনো খবর পাও নাই। একটু মাটি চাপা আছে।” কেশবচন্দ্রকে বললেন : “অন্দরমহলে মেয়েদের মধ্যে অত থাক কেন?”
মহেন্দ্রনাথ নিজের লোক হবেন। ঠাকুর সেই কারণে শাসনের সুরে বলছেন—শিক্ষক যেভাবে ছাত্রকে বলেন, বিরক্তও হয়েছেন যথেষ্ট— “তোমাদের কলকাতার লোকের ঐ এক! কেবল লেকচার দেওয়া, আর বুঝিয়ে দেওয়া। আপনাকে কে বোঝায় তার ঠিক নাই! তুমি বুঝাবার কে? যাঁর জগৎ, তিনি বুঝাবেন। যিনি এই জগৎ করেছেন, চন্দ্র, সূর্য, মানুষ, জীবজন্তু করেছেন; জীবজন্তুদের খাবার উপায়, পালন করবার জন্য মা-বাপ করেছেন, মা-বাপের স্নেহ করেছেন তিনিই বুঝাবেন। তিনি এত উপায় করেছেন, আর এ-উপায় করবেন না? যদি বুঝাবার দরকার হয় তিনিই বুঝাবেন। তিনি তো অন্তর্যামী। যদি ঐ মাটির প্রতিমাপূজা করাতে কিছু ভুল হয়ে থাকে, তিনি কি জানেন না—তাঁকেই ডাকা হচ্ছে? তিনি ঐ পূজাতেই সন্তুষ্ট হন। তোমার ওর জন্য মাথা ব্যথা কেন? তুমি নিজের যাতে জ্ঞান হয়, ভক্তি হয় তার চেষ্টা কর।”
মহেন্দ্রনাথ বলছেন, এইবার আমার অহঙ্কার একেবারে চূর্ণ হলো। অর্থাৎ তিনি ঠাকুরের স্বপাক হলেন। যেমন তিনি বিদ্যাসাগরকে বলেছিলেন : “তুমি সিদ্ধ, তাই অত কোমল, যেমন আলুসিদ্ধ, পটলসিদ্ধ।” বিদ্যাসাগর নৈয়ায়িক, তিনি ব্যতিক্রমের কথা বলতে গিয়েছিলেন—কলাইয়ের ডাল। সিদ্ধ হলে শক্ত হয়। ঠাকুর বললেন : “তুমি সে-জাতের নও।” মহেন্দ্রনাথ যে কলাইয়ের ডাল নন, ঠাকুর তা জানতেন
ঠাকুর সংসারে দুটো জাত দেখেছিলেন—বিশ্বাসী আর অবিশ্বাসী। মহেন্দ্রনাথকে বোঝালেন—ত্রিপদ হও, বিশ্বাস, জ্ঞান, ভক্তি। বিশ্বাস পাকা হলে জ্ঞান হবে। তখন তুমি দ্বিপদ মানুষ নও, আরো একটু বেশি মানহুঁশ। অবশেষে ঠাকুরের অভিযান ব্রাহ্মসমাজের দিকে। সেখানে সুবক্তা কেশবচন্দ্র ব্রহ্মভাবনার প্রসার ঘটাচ্ছেন। হিন্দুধর্মকে আচার, কদাচার, সংস্কার, কুসংস্কারের খোলা থেকে ভেঙে বের করে এনে সকলকে ব্রহ্মের মুখোমুখি করতে চাইছেন। সমাজে শিক্ষিত মানুষের সমাবেশ হচ্ছে। কেশবচন্দ্রকে বোঝাতে হবে, একলাফে ছাদে ওঠা যায় না। ‘ব্রহ্মাস্মি’ বললেই দেহবোধ যাবে না। যতক্ষণ ‘আমি’র বোধ আছে ততক্ষণ জগৎও আছে। অতএব ‘আমি ব্রহ্ম’ বলে আগে থেকেই অত লাফালাফি করো না। ভণ্ডামি বেড়ে যাবে। পথ দেখাতে গিয়ে সমাজকে বিপাকে ফেলো না। ব্রহ্মোপলব্ধি করতে গেলে সব ছাড়তে হবে। আবার সব ছাড়লেই যে হবে, তাও নয়। আবার ব্রহ্মদর্শন করলেই যে দেহবোধ চলে যাবে, তাও নয়। তোতাপুরী রোগযন্ত্রণায় আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলেন। কেশবের সভায় ঠাকুর বলছেন : “তোমরা বলছ সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয়, জীবজগৎ—এসব শক্তির খেলা। বিচার করতে গেলে এসব স্বপ্নবৎ; ব্রহ্মই বস্তু আর সব অবস্তু; শক্তিও স্বপ্নবৎ, অবস্তু। কিন্তু হাজার বিচার কর, সমাধিস্থ না হলে শক্তির এলাকা ছাড়িয়ে যাবার জো নাই। আমি ধ্যান করছি, আমি চিন্তা করছি—এসব শক্তির এলাকার মধ্যে, শক্তির ঐশ্বর্যের মধ্যে। তাই ব্রহ্ম আর শক্তি অভেদ। এককে মানলেই আরেকটিকে মানতে হয়। তাই ব্রহ্মকে ছেড়ে শক্তিকে, শক্তিকে ছেড়ে ব্রহ্মকে ভাবা যায় না। নিত্যকে ছেড়ে লীলা, লীলাকে ছেড়ে নিত্য ভাবা যায় না।”
কেশবচন্দ্রকে বলছেন বটে, মহেন্দ্রনাথ বুঝে ফেললেন।
“The Absolute, The Relative Phenomenal World.’ ব্রহ্মজ্ঞানীর ব্রহ্ম, যোগীর পরমাত্মা, ভক্তের ভগবান। যিনিই ব্রহ্ম, তিনিই আত্মা, তিনিই ভগবান। উদ্দেশ্য একটাই—জীবাত্মা ও পরমাত্মার যোগ
তাহলে এস কেশবচন্দ্র, ভক্ত হও। বিশ্বাসী হও। যা করছ কর; কিন্তু ঘর চেন। ভাগবত বলছেন, যে অস্থির-চিত্ত, অঁজিতেন্দ্রিয়, অবিনীত, যে বৃথাই নিজেকে পণ্ডিত বলে মনে করে তার শাস্ত্রাদি অধ্যয়ন, আলোচনা কি রকম, না নটের রাজবেশ পরার মতো। আসলে সে রাজা নয়। “ন গুণায় ভবন্তি স্ম নটস্যেবাজিতাত্মনঃ।”
ঠাকুর কলকাতার তার্কিক, শিক্ষিত, উন্নাসিক সমাজকেও বাগে আনলেন। দুই বিরোধী কেশবচন্দ্র, বিজয়কৃষ্ণ একই ঘাটে প্রেমবারি সেবনে এলেন। তাহলে এমন একটা আধ্যাত্মিক আরক তৈরি হলো, যা সেবনে ভবরোগ সারতে পারে।
দূরবীন কি দর্শন করাচ্ছে—বিপর্যস্ত বিশাল এক জগৎ, দুই বিশ্বযুদ্ধ, অজস্র খণ্ডযুদ্ধ, যন্ত্রের যন্ত্রণা, হট্টগোলে উদভ্রান্ত ধাবন্ত মানুষ। মূর্তি পুতুলে পরিণত। ধর্মে ব্যবসা। সম্পর্কে সনাতন স্বার্থ। মানুষ! তুমি যাবে কোথায়? মনে, বনে, কোণে। বন বাদ দাও। মনের কোণে নির্জনতা রচনা করে, মা সারদার তিনটি ‘স’-এর সাধনা। শ, ষ, স। সহ্য, সহ্য, সহ্য। “না, কর্মত্যাগ করবে কেন”, নিত্যকর্মের সঙ্গে মাত্র দুটি জিনিস যোগ কর—ঈশ্বরের চিন্তা, তাঁর নামগুণগান।