2 of 3

ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের আসন

ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের আসন

লোকান্তরিত হওয়ার পর সাধকের কি পড়ে থাকে? দণ্ড, কমণ্ডলু, আর তাঁর সাধনের আসনখানি। ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের কমণ্ডলু হলেন অমৃতনিঃস্রাবী মা সারদা। ঠাকুর মাকে বলে গেলেন, আমি যাচ্ছি, তুমি রইলে। মানুষের বড় কষ্ট, তুমি ওদের দেখো। তোমাকে আমি ভরপুর করে গেলাম। নিরন্তর আনন্দধারা তুমি বর্ষণ করে যাবে। তুমি সতেরও মা, অসতেরও মা।

দণ্ড হলেন স্বামী বিবেকানন্দ। দণ্ডের কাজ কি? শিষ্টের পালন, অশিষ্টের দমন। সে তো বাইরে। আর অন্তরে? তামসিকতাকে, জীবের জড়তা আর মূঢ়তাকে মেরে দিব্যচেতনার প্রতিষ্ঠা করবে তুমি। আমি একটি প্রার্থনাই রেখে গেলাম—তোমাদের চৈতন্য হোক, সেই চৈতন্য তুমি আনবে। প্রয়োজন হলে পেটাবে, কারোকে খাতির করবে না। রাজা, মহারাজা, প্রজা, পুরোহিত, শিক্ষিত, অশিক্ষিত, সাদা, কালো—সকলকেই চাবকাবে।

আর আসন! ভগবানের আসন কোনটি? আমাদের হৃদয়। ঠাকুর বলছেন : “ভক্তের হৃদয় ভগবানের বৈঠকখানা।” ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের বৈঠকখানা। ভগবান কে? তিনি কোথায়? কোন্ ঠিকানায় তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ হতে পারে? সাক্ষাৎ দর্শন! ঠিকানা জানা নেই আপাততঃ। কামারপুকুরে এসেছিলেন। যেভাবে পৃথিবীতে আসতে হয়—ঠিক সেইভাবে, সেই পথে। সে কেমন? ট্রেনে চলেছে শত যাত্রী, হাওড়া থেকে হরিদ্বার। সেই শত যাত্রীর মধ্যেই একটি কামরায় বসে আছেন রাষ্ট্রপতি। যেভাবে সবাই যাচ্ছে, তিনিও সেই ভাবেই যাচ্ছেন। ভগবান স্থির করলেন, নিজের সৃষ্টিতে একবার যাব। জমিদার আসছেন তালুক দেখতে, মানুষের অবস্থা দেখতে। মানুষের কাছে যেতে হলে মানুষের মতোই একটি শরীর চাই। কোথায় পাবেন সেই শরীর! নিজেরই তো তৈরি নিয়ম! অন্যরকম হয় কি করে! হঠাৎ দিগন্তের দিক থেকে পূর্ণ একটি মানবশরীর নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে এলেন। বীজের মধ্যে বট, বটের মধ্যে বীজ—এই তো নিয়ম। বিন্দু থেকে সিন্ধু, সিন্ধুরই বিন্দু।

নিয়ম যখন এই, তখন শুদ্ধ, সাত্ত্বিক, ধর্মাচারী পিতা-মাতার আশ্রয়ে আসতেই হবে। ভগবান আসছেন নরলীলায়। নরদেহেই তিনি নারায়ণ হবেন। ভগবান হবেন। ভগবানের সংজ্ঞা মানুষ নির্ধারণ করেছে, জ্ঞানাদি ষড়গুণবিশিষ্ট। কি কি গুণ! প্রথম হলো, ঐশ্বর্য অর্থাৎ ঈশ্বরত্ব। দ্বিতীয় গুণ হলো বীর্য অর্থাৎ সর্বশক্তি। এরপর যশঃ, শ্রী, জ্ঞান ও বৈরাগ্য। এই ষড়গুণেই ভূষিত ছিলেন ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ।

চৈতন্যচরিতামৃতকার মহাপ্রভু সম্পর্কে লিখেছিলেন :

“চৈতন্য-সিংহের নবদ্বীপে অবতার।
সিংহগ্রীব সিংহবীর্য সিংহের হুঙ্কার।।
সেই সিংহ বসুক জীবের হৃদয়-কন্দরে।
কল্মষ-দ্বিরদ নাশে যাহার হুঙ্কারে।।”

হৃদয়ের প্রকোষ্ঠে তাঁর পবিত্র আসনখানি পাতা রয়েছে। তিনি আসবেন, তিনি বসবেন। অন্ধকারে তিনি আলো জ্বালাবেন, আলো জ্বালা থাকলে সেটিকে আরো উজ্জ্বল করবেন। আর যদি দেখেন দুয়ার বন্ধ, তিনি অপেক্ষা করবেন। আমাদের মত্ততা, আমাদের তামসিকতায় দুঃখ পাবেন। আমার চোখে জল নেই, আমার জীবন আমাকে দুঃখিত করে না; কিন্ত তাঁর চোখ অশ্রুসিক্ত হয়। আমার চেতনার কলিং বেলে আঙুল রাখেন। দেখেন বৈদ্যুতিক যোগ বিচ্ছিন্ন। নিরেট মূঢ়সত্তা ঘরের দখল নিয়েছে। সজাগ থাকলে দেখা যেত—

“শিয়রে দাঁড়ায়ে তুমি রেতে
নির্বাক আনন, ছল ছল আঁখি
চাহ মম মুখপানে।” (‘গাই গীত শুনাতে তোমায়’ )

গুরু কে? স্বামীজী বলছেন : “যে-ব্যক্তির আত্মা হইতে অপর আত্মায় শক্তি সঞ্চারিত হয়, তাঁহাকে ‘গুরু’ বলে এবং যে-ব্যক্তির আত্মায় শক্তি সঞ্চারিত হয় তাঁহাকে ‘শিষ্য’ বলে। এইরূপ শক্তিসঞ্চার করিতে হইলে প্রথমত যিনি সঞ্চার করিবেন, তাঁহার এই সঞ্চার করিবার শক্তি থাকা আবশ্যক। আর যাঁহাতে সঞ্চারিত হইবে, তাঁহারও গ্রহণ করিবার শক্তি থাকা আবশ্যক। বীজ সতেজ হওয়া আবশ্যক, ভূমিও ভালভাবে কর্ষিত থাকা প্রয়োজন।”

রামপ্রসাদ আক্ষেপ করেছিলেন : “মনরে কৃষিকাজ জান না, এমন মানবজমিন রইল পতিত…।” পতিত কেন থাকবে! তাঁর পায়ের তলায় ফেলে দিই না কেন? হৃদয়টিকে পেতে দিই আসনের মতো করে। স্বামীজী বলছেন : “ধর্ম যে দেওয়া যাইতে পারে, তাহা আমি বাস্তবিক প্রত্যক্ষ করিলাম। একবার স্পর্শে, একবার দৃষ্টিতে একটা সমগ্র জীবন পরিবর্তিত হইতে পারে। … ধর্মদান করা সম্ভব, আর মদীয় আচার্যদেব বলিতেন, ‘জগতের অন্যান্য জিনিস যেমন দেওয়া নেওয়া যায়, ধর্ম তদপেক্ষা অধিকতর প্রত্যক্ষভাবে দেওয়া নেওয়া যাইতে পারে।’”

ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের সেই ক্ষমতা ছিল। সমস্ত হৃদয়ের দখলদারি নিয়ে প্রেম, বৈরাগ্য, ভক্তির ফুল ফোটাতে পারতেন। তবে সকলের নয়। বেনা বনে মুক্তো ছড়াতেন না। আধার দেখতেন, জমি দেখতেন। খুব বেশি অঙ্কট-বঙ্কট দেখলে নিষ্ঠুরের মতো সরিয়ে দিতেন। সংস্কার দেখতেন, ঘর দেখতেন। কেন? তাঁর পক্ষে যদি সবই সম্ভব ছিল তাহলে সকলকেই কেন চৈতন্য করলেন না? এ কি তাঁর পক্ষপাতিত্ব? অনেকে গিরিশ ঘোষ মহাশয়ের উদাহরণ টেনে আনেন। সেকালের বিশিষ্ট এক পণ্ডিত এমন কথাও লিখেছেন : “রামকৃষ্ণের জীবনের শেষ কয়েক বৎসর আমার সহিত তাঁহার খুব অল্পই দেখা হয়—অবশ্য ইহার পিছনে ছিল দুইটি কারণ। প্রথমত, এসময়ে তাঁহার নিকট কয়েকজন নতুন ভক্ত আসেন এবং তাঁহাদের মাধ্যমে তাঁহার সহিত রঙ্গমঞ্চের দু-একটি অভিনেতারও যথেষ্ট ঘনিষ্ঠতা জন্মে। উক্ত ব্যক্তিদের আমি মোটেই পছন্দ করিতাম না। সুতরাং উহাদের সহিত তাঁহার ঘনিষ্ঠতা আমার মনে তিক্ততারই সৃষ্টি করে।”[১]

[১. মহান পুরুষদের সান্নিধ্যে— শিবনাথ শাস্ত্রী, প্রাচী পাবলিকেশনস, ১৯৯৪, পৃঃ ৮৮]

স্বয়ং শ্রীরামকৃষ্ণ গিরিশ সম্পর্কে কি বলছেন : “ওগো, তোমার সংস্কার ছিল তাই হচ্ছে। সময় না হলে হয় না। যখন রোগ ভাল হয়ে এল তখন কবিরাজ বললে, ‘এই পাতাটি মরিচ দিয়ে বেটে খাও।’ তারপর রোগ ভাল হলো। তা মরিচ দিয়ে ঔষধ খেয়ে ভাল হলো, না আপনি ভাল হলো, কে বলবে!” নিজের সম্পর্কে গিরিশবাবুর খুব হীন ধারণা ছিল। ঠাকুরের সঙ্গে পরিচয়ের প্রাথমিক পর্বে স্বীকার করছেন : “আমি যে পাপী। মহাশয়, আমি যেখানে বসতাম সে-মাটি অশুদ্ধ।” পরিচয় যখন বেশ প্রগাঢ় তখন একদিন বলছেন : “রসুনের গন্ধ কি যাবে?” গিরিশ সম্পর্কে ঠাকুর একদিন বলেছিলেন : “রসুন-গোলা বাটি হাজার ধোও রসুনের গন্ধ কি একেবারে যায়?” সেদিন গিরিশবাবুর খুব অভিমান হয়েছিল। ঠাকুর এইবার বললেন : “যাবে।” কিভাবে যাবে? ঠাকুর বলছেন : “অত আগুন জ্বললে গন্ধ-ফন্ধ পালিয়ে যায়। রসুনের বাটি পুড়িয়ে নিলে আর গন্ধ থাকে না, নূতন হাঁড়ি হয়ে যায়।”

এরপরে সর্বকালের সব মানুষকে শোনাচ্ছেন আশার কথা, শক্তির কথা, বীর্যের কথা, সাইকোলজির কথা : “যে বলে ‘আমার হবে না,’ তার হয় না। মুক্ত-অভিমানী মুক্তই হয়, আর বদ্ধ-অভিমানী বদ্ধই হয়। যে জোর করে বলে ‘আমি মুক্ত হয়েছি’, সে মুক্তই হয়। যে রাতদিন ‘আমি বদ্ধ’ ‘আমি বদ্ধ’ বলে, সে বদ্ধই হয়ে যায়।” শ্রীম এই আলোচনা শুনে নিজের মন্তব্য লিখলেন : “The Lord’s message of hope for so-called sinners.“

ঠাকুরের খেলা বোঝে সাধ্য কার! গিরিশকে কৃপা করলেন, অহেতুকী কৃপা; কিন্তু ভক্ত কেদারকে সরিয়ে দিলেন। কারণ? “কেদারকে বললুম, কামিনী-কাঞ্চনে মন থাকলে হবে না। ইচ্ছা হলো, একবার তার বুকে হাত বুলিয়ে দি—কিন্তু পারলাম না। ভিতরে অঙ্কট-বঙ্কট। ঘরে বিষ্ঠার গন্ধ, ঢুকতে পারলাম না।”

কাম-কাঞ্চন হলো বিষ্ঠার গন্ধ। অন্তরের অঙ্কট-বঙ্কট। নিজেকে মার্জনা না করলে তিনি এসে আসনে বসবেন না, সে-আসন যত মূল্যবানই হোক। তুলসীদাস বলছেন :

“জঁহা রাম তহাঁ কাম নহী,
জঁহা কাম তহাঁ নহী রাম।
দুহু মিলত নহী
রব রজনী নহী মিলত একঠাম।।”

ঠাকুর যেন বলছেন—একটা ব্যাপারে আমি খুব স্বার্থপর, আমাকে যদি চাও তো আমাকেই চাও-ষোল আনা পাঁচ পো।

“মন্মনা ভব মদ্ভক্তো মদ্যাজী মাং নমস্কুরু।
মামেবৈষ্যসি সত্যং তে প্ৰতিজানে প্ৰিয়োঽসি মে।” (গীতা)

–তোমার মন আমাকে দাও, তোমার ভক্তি আমাকে দাও। তোমার পূজা, তোমার নমস্কার সব আমাকে দাও। বিনিময়ে কি পাবে? তুমি আমাকেই পাবে।

স্বামীজী বলছেন : “যদি ঈশ্বর-উপাসনার জন্য মন্দির নির্মাণ করিতে চাও বেশ, কিন্তু পূর্ব হইতেই ঐ মন্দির অপেক্ষা উচ্চতর মহত্তর মানবদেহরূপ মন্দির তো রহিয়াছে।” সেখানে পেতেছি হৃদয়াসন। ত্যাগ-বৈরাগ্যের বুরুশ দিয়ে কাম-কাঞ্চনের ময়লা ঝেড়ে ফেলেছি। তিন টানের পিদিম জ্বেলেছি। বিবেকের শঙ্খধ্বনি। আর পূজারী? স্বয়ং বৈরাগ্য। স্বামীজীর কাছে শিখেছি :

বিষয়ে বিতৃষ্ণা না হলে, কাকবিষ্ঠার ন্যায় কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগ না করলে “ন সিধ্যতি ব্রহ্মশতান্তরেঽপি”–ব্রহ্মার কোটিকল্পেও জীবের মুক্তি নেই। জপ- ধ্যান-পূজা-হোম-তপস্যা কেবল তীব্র বৈরাগ্য আনবার জন্য। তা যার হয়নি, তার জানবি—নোঙর ফেলে নৌকার দাঁড় টানার মতো হচ্ছে। “ন ধনেন ন চেজ্যয়া ত্যাগনৈকে অমৃতত্বমানশুঃ।”

যতনে হৃদয়ে রাখি আদরের ঠাকুরকে, ও মন! তুই দেখ আর আমি দেখি আর যেন কেউ নাহি দেখে।

ঠাকুরের ঘরখানিকে তুলে আনি। জীবনের সায়াহ্নে জ্বালিয়ে দিই ধুপ, ধুনো, জ্ঞানের বাতি। মৃদু করতালি দিতে দিতে ঐ যে ঠাকুর সেখানে পায়চারি করছেন। মাঝে মাঝে ঠাকুর ডাকছেন—হৃদে, ও হৃদে! সে আমার হৃদয়। মা ভবতারিণী মন্দিরে শুরু হয়েছে আরতি।

1 Comment
Collapse Comments
Mr.Avijit Chatterjee April 14, 2024 at 9:40 am

অপূর্ব

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *