“ভক্তি যেন ভয়ে নাহি হয়, পদানত পৃথিবীর কারো কাছে”
পৃথিবী আমাকে মেরে ফেলতে চাইছে আর আমি তিলে তিলে মরে যাচ্ছি— এই ক্লীবতার ঊর্ধ্বে কোনক্রমে উঠতে হবে। পরিব্রাজক অবস্থায় স্বামীজী যখন সারা ভারত পর্যটন করছেন যখন তাঁর সন্ন্যাসীর ঝোলায় দুখানি বই থাকত, শঙ্করাচার্যের ‘বিবেকচূড়ামণি’ আর টমাস আ কেম্পিস-এর ‘দি ইমিটেশন অফ ক্রাইস্ট’। কেম্পিস বলছেন :
“The Lord is my light and my
deliverance; whom
have I to fear? Though a whole
host were arrayed
against me, my heart would be
undaunted.”
জীবনে ভয়ের শেষ নেই। প্রকৃতিকে যতই মনে আনা যাক, প্রকৃতির এক ফুৎকারে শত শত মানুষের জীবনদীপ নির্বাপিত হতে পারে। যেকোন মুহূর্তে মারক ব্যাধি আমাদের আস্ফালন বন্ধ করে দিতে পারে। ভয় আছে জীবিকা না পাবার, পেয়ে হারাবার। আর আছে মানুষ। মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু মানুষ।
এই যে বাংলাদেশের সমুদ্রকূল ছুঁয়ে এত বড় একটা ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেল, মুছে গেল শত শত প্রাণের বেঁচে থাকার ক্লিন্ন, ক্লিষ্ট ইতিহাস। তারপর! তারপরের ইতিহাস আরো নিদারুণ। খেয়ালী প্রকৃতি মানুষের মুখ চেয়ে কাজ করে না। কিন্তু মানুষ! ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ জীব। তারা কি করছে! এখনো যাদের পুনর্বাসন হলো না। অনিকেত। অনাহার আর ব্যাধিপীড়িত, তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে জোতদারের ভাড়াটে গুণ্ডা। একখণ্ড জমির দাম, মানুষের জীবনের চেয়ে দামী।
হিরোসিমা, নাগাসাকিতে অ্যাটম বোমা পড়ার পর, যে-কজন প্রাণে বেঁচেছিলেন তাদের মধ্যে একটি বাচ্চা মেয়ে প্রশ্ন করেছিল, মানুষের ওপর মানুষ কিভাবে এমন নিষ্ঠুর হতে পারে! আমরা কি এমন করেছি যে, আমেরিকা আমাদের দুটো শহর একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দিল! ডেসমন্ড মরিস তাঁর ‘দি হিউম্যান জু’ গ্রন্থের ভূমিকায় লিখছেন : “Under normal conditions, in their natural habitants, wild animals do not mutilate themselves, masturbate, attack their offspring, develop stomach ulcers, become fetishists, suffer from obesity, form homosexual pair, bonds or commit murder.”
কিন্তু শহরবাসী সুসভ্য মানুষ কি করে! বলা নিষ্প্রয়োজন, এই সবই সেখানে নিত্য ঘটে চলেছে নির্বিচারে। মরিস প্রশ্ন করছেন, তাহলে বন্য প্রাণী আর মানুষে কি মূলগত একটা পার্থক্য বিদ্যমান! আপাতদৃষ্টিতে সেইরকমই মনে হতে পারে। আসলে তা নয়। পশুকে প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে কৃত্রিম পরিবেশে ঠেসে দিলে আজকের মানুষের মতোই আচরণ করবে। চিড়িয়াখানায় খাঁচার পশুদের মধ্যে ওই একই বিকৃত আচরণ লক্ষ্য করা যাবে। তার মানে, আমাদের আজকের শহর শুধু ‘কংক্রিট জঙ্গল’ নয়, ‘হিউম্যান জু’—মানুষের চিড়িয়াখানা।
Go back, you are heading for disaster. অন্য কোন জীবনের কথা ভাব। এ-জীবন তোমাকে মেরে ফেলবে। কে শুনবে, এই সতর্কবাণী। আমরা নিজেদের জালেই দু-ভাবে জড়িয়ে পড়েছি। এক ভূমিকায় দর্শক, অন্য ভূমিকায় অংশগ্রহণকারী। ভোক্তা। যে বাজি ধরা হয়েছে তার অঙ্ক হু হু করে বেড়েই চলেছে। The stakes are rising higher all the time, the game becoming more risky, the casualties more startling, the pace more breathless.
আমরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কালে অসউইজ, বেলসেন, ভাচাউ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে মারণযজ্ঞের কথা ভেবে এখনো আতঙ্কে শিউরে উঠি। অথচ সারা পৃথিবীটাই এখন এক বিশাল কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প। ইথিওপিয়ায় মানুষ কিভাবে মরছে। কেন মরছে! কার দোষে মরছে! জুনের প্রথম সপ্তাহের টাইম ম্যাগাজিনে যেসব ছবি ছাপা হয়েছে, দেখলে মনে হবে হিটলার ফিরে এসেছেন সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে। এক মৃত মহিলা, কঙ্কালসার, তাকে বসিয়ে কবরে দেবার আগে প্রথামতো স্নান করানো হচ্ছে। একটি শিশু, দিনের পর দিন অনাহারে যেন বৃদ্ধ। ম্যাগাজিনের পাতা থেকে করুণ চোখে তাকিয়ে আছে সভ্য দুনিয়ার দিকে। অনুচ্চারিত প্রশ্নগুলি, তোমরা কি বলবে? কয়েক যোজন দূরে ভোগের দুনিয়ায় বাফুনেরা লাট খাচ্ছে। মিয়ামি কি ফ্লোরিডার সমুদ্রসৈকতে স্কচের ফোয়ারা ছুটছে। লাইফ ম্যাগাজিনেও ইথিওপিয়ার ছবি। কঙ্কালসার মা সদ্য সন্তান প্রসব করেছেন। শিশুটি পড়ে আছে পায়ের ফাঁকে। তখনো ছিন্ন হয়নি নাড়ির যোগ। পাশেই পড়ে আছে অস্ত্রোপচারের কাঁচি। তলায় ক্যাপশন—মা যদি এবার বাঁচে, প্রসূতিসদনে থাকার অধিকার মিলল।
এ তো চূড়ান্ত দুর্ভোগের ঘটনা। এক পাশে প্রতিদিন সাধারণ মানুষের জীবনে কি ঘটছে। মানুষ আসছে লাখে লাখে। প্রতিদিনই নবজাতকের কান্না হয় এখানে নাহয় ওখানে। অথচ জীবিকা নেই। বাসস্থান নেই। প্রচ্ছন্ন দাসব্যবসা আজও চলছে। সর্বত্র শোষণ নিষ্পেষণ। কোনক্রমে ধুঁকতে ধুঁকতে বেঁচে থাকা। শিক্ষার সুযোগ কজন গ্রহণ করতে পারে! কজন পায় উন্নত চিকিৎসার সুযোগ। প্যারিসের রাজপথে নতমস্তক ভিখারি। নিউ ইয়র্কে স্যুপের লাইনে বেকারের দল। ইংল্যান্ডের ফুটবল সমর্থক বেলজিয়ামে গিয়ে মেরে দিয়ে এল একদল নিরীহ দর্শক। ধর্মের নামে ইরানী যুবক ছুটছে ইরাকে জীবন দিতে। মাইনপাতা যুদ্ধক্ষেত্রের ওপর দিয়ে হেঁটে যাবে এই আত্মোৎসর্গী যুবকেরা। মাইনমুক্ত ক্ষেত্রে ছুটে আসবে পরবর্তী ইরানী সৈন্যদল।
মধ্যযুগ শেষ হয়েছে? ক্যালেন্ডারে কত সাল চলছে? রাজা, মহারাজা, ওমরাও, অমাত্যদের যুগ কি শেষ হলো? সাধারণ মানুষ পেষাই হচ্ছে কিসে?
কবীর দাসজীর কি মনে হয়েছিল! মানুষের নিষ্পেষণ দেখে—
“চলতী চক্কী দেখিকে দিয়া কবীরা রোয়।
দুইপট ভীতর আয়কে সাবিত গয়া ন কোয়।
ভাই বীর বটাউয়া ভরি ভার নৈন ন রোয়।
জাকা থা সো লে লিযা দীনহা থা দিন দোয়।।“
বীর পথিক অমন করে অঝোরে কেঁদো না। বিখ্যাত মনস্তত্ত্ববিদ ভিক্টর ই. ফাঙ্কল অসউইজ থেকে কোনক্রমে বেঁচে ফিরে এসেছিলেন। একদিকে মৃত্যু, অন্যদিকে মনস্তত্ত্ববিদের অন্বেষা। মানুষকে পশু বানাবার শক্তিশালী চক্রান্ত। এস. এস. অফিসারের ডাইনে বামে মাথা দোলানোর ওপর নির্ভরশীল শত শত অসহায় নরনারী শিশুর মরণ-বাঁচন। গ্যাসচেম্বারে যাবার আগে বেঁচে থাকার ধরন পশুর মতো। পরিধেয়হীন উলঙ্গ দেহ। অনাহার। অকথ্য পরিশ্রম। চাবুক, বুটের লাথি। আত্মবিশ্বাস প্রায় ভেঙে পড়ে। ডাক্তার ফ্রাঙ্কল শুধু দেখে চলেছেন, এই এক্সট্রিম অবস্থায় মানুষ কি সত্যিই পশু হয়ে যায়! না, কিছু মানুষ দেহসীমা লঙ্ঘন করতে পারে। ফ্রাঙ্কল লিখছেন : “Inspite of all the enforced physical and mental primitiveness of the life in a concentration camp, it was possible for spiritual life to deepen.” স্বামীজীও তো এই একই সত্যের ইঙ্গিত দিয়েছেন—”Persecution (অন্যায় অত্যাচার) না হলে জগতে হিতকর ভাবগুলি সমাজের অন্তস্তলে সহজে প্রবেশ করতে পারে না।”