প্রথম অংশ : অন্তর্ধান
দ্বিতীয় অংশ : অন্ধকারের অবতার
1 of 2

ব্ল্যাক বুদ্ধা – ৭

অধ্যায় সাত – বর্তমান সময়
পিবিআই অফিস, ধানমণ্ডি

রুমের ভেতরে পায়চারী করতে থাকা পাশা স্যারকে দৃষ্টি দিয়ে অনুসরণ করছে চিন্তিত তানভীর। হাঠাৎ পায়চারী থামিয়ে মেশিন থেকে এক মগ কফি ভরে তানভীরের দিকে এগিয়ে দিল হাবিব আনোয়ার পাশা। নিজেও ভরে নিল এক মগ।

‘পিওর ব্রাজিলিয়ান কফি, আমি নিজে ব্লেন্ড করে মেশিনে দিয়েছি,’ বলে তৃপ্তি সহকারে নিজের মগে চুমুক দিতে দিতে তানভীরের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল সে, ‘কী যেন বলছিলে তুমি?’

‘স্যার, আমি সিলেট যেতে একেবারেই আগ্রহী না, কারণ…’ বলে পরের কথাটা বলতে গিয়েও একটু অস্বস্তি বোধ করাতে কথাটা পরিবর্তন করল। কারণ, স্যার আমার তো ফিল্ড লেভেলে তেমন কোনো অভিজ্ঞতা নেই,’ শেষ কথাটা ও সরাসরি পাশা স্যারের চোখের দিকে না তাকিয়ে বরং অন্যদিকে তাকিয়ে বলে উঠল। কিন্তু একটু পরে যখন তার দিকে ফিরে তাকাল ও দেখতে পেল পাশা স্যার মুখে মৃদু হাসি নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ধরা পড়ে গেছে বুঝতে পেরে তানভীরের অস্বস্তি আরো বেড়ে গেল।

‘তানভীর, মাই বয়,’ বলে আনোয়ার পাশা ওর কাঁধে একটা হাত রাখল। ‘তুমি তো জানো আমি মানুষের সাইকোলজি খুব ভালো বুঝতে পারি। কাজেই আমাকে এসব কথা শুনিয়ে কোনো লাভ নেই। আর তা ছাড়া এই অপারেশনের ব্যাপারটা পুরোপুরি আমার হাতেও নেই। আগেই বলেছি, এই অপারেশনে তোমাকে চাওয়া হয়েছে একেবারে ওপর মহল থেকে। দ্বিতীয়ত, তোমাকে পাঠাতে পারছি এতে আমি খুশি। এর পেছনে কারণ আছে।’

আনোয়ার পাশা কফি মগ হাতে জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলে উঠল, ‘তুমি তো জানোই দীর্ঘদিন ধরে রীতিমতো সংগ্রাম করে আমি একটা নিজস্ব সংস্থা দাঁড় করানোর চেষ্টা করছি। এরই মধ্যে সেদিকে খানিকটা ধাবিতও হয়েছি। আর সেই পথে আরেকটু এগোনোর ধাপই ছিল তোমাকে আর শারিয়ারকে দেশের বাইরে ট্রেনিংয়ে পাঠানো। এ কারণেই আমি চাইছি তুমি ওখানে যা শিখে এসেছো সেটাকে কাজে লাগিয়ে ফিল্ড লেভেলে পরখ করে দেখো। আর তা ছাড়া ইএএফকে এবার সাহায্য করতে পারলে একদিকে যেমন ওদের কাছ থেকে ভবিষ্যতে আমরা সাহায্য পাব, আবার অন্যদিকে আমি চাই তুমি নিজের যোগ্যতা দিয়ে এই অপারেশনে ভালো করো, যাতে পরবর্তীতে নিজস্ব সংস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে গেলে আমরা জোর গলায় প্রমাণ দেখাতে পারি, আমাদেরও ভালো ফিল্ড এজেন্ট আছে।’

পাশা স্যারের কথা শুনে তানভীর একবার মাথা নাড়ল। ‘কিন্তু স্যার, এই ব্যাপারে তো আমি কিছুই জানি না।’

‘আমি তোমাকে ইএএফ-এর সঙ্গে কাজ করতে পাঠাচ্ছি-এর মানে এই না যে আমি তোমাকে খোলা মাঠে একা ছেড়ে দেব। আমি অবশ্যই তোমার সঙ্গে নিজের লোক পাঠাব। সিলেটে এই মুহূর্তে একটা কাজে আছে সুলতান। আমি ওকে তোমার সঙ্গে কাজে লাগিয়ে দেব। আর তা ছাড়া জালাল নামে একটা ছেলে আছে, গাজীপুরের অপারেশনে ও আমার সঙ্গে ছিল, ওকেও আমি সিলেট পাঠাব। কিন্তু ওকে পাঠাতে একটু সময় লাগবে। আর তোমাকে সব ধরনের লজিস্টিক আর আইটি সাপোর্ট দেয়ার জন্যে একজন ট্রেইনড আইটি এক্সপার্টকেও দেয়া হবে। কাজেই একবারের জন্যেও মনে করো না তুমি একা।’

তানভীর একবার বড়ো করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ‘ঠিক আছে স্যার, আমাকে কবে সিলেট যেতে হবে?’

এবার ওর প্রশ্ন শুনে হা হা করে হেসে উঠল হাবিব আনোয়ার পাশা, ‘কবে না বালক, বলো কখন?’ বলে সে কফির মগে শেষ চুমুক দিয়ে সেটা নামিয়ে রাখল টেবিলে। ‘বাইরে তোমার জন্যে স্পেশাল জিপ দাঁড়িয়ে আছে। তুমি আমার রুম থেকে বেরিয়ে মৌসুমির কাছ থেকে ‘ফাস্ট প্যাক’ নিয়ে জিপে উঠবে। তোমার জন্যে প্রয়োজনীয় সবকিছু প্যাকেই তৈরি করে রেখেছে মৌসুমি। কাজেই কোনো সমস্যা হবে না।’

‘স্যার, আমাকে কি গাড়িতে করেই…’

‘আরে নাহ, আনোয়ার পাশা চিকন লম্বা সিগারের মতো দেখতে একটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলে উঠল, ‘তুমি এখান থেকে জিপে করে এয়ারপোর্টে যাবে। সেখানে প্লেনে তোমার জন্যে সিট বুকিং দেয়াই আছে। সোজা চলে যাবে সিলেটে। আর হ্যাঁ, শাহজালাল এয়ারপোর্টে ইএএফের অফিসার তোমাকে কিছু ব্যাপারে ব্রিফ করবে। তবে তুমি বিস্তারিত জানতে পারবে সিলেট গিয়ে। আর তোমার প্রয়োজনীয় যেকোনো জিনিসের জোগানও ওরাই দেবে,’ বলে সে উঠে এলো তানভীরের কাছে।

‘তানভীর, আমি জানি সিলেটে ফিরে যাওয়াটা তোমার জন্যে কষ্টকর। বিশেষ করে সাস্ট ক্যাম্পাস নিয়ে তোমার যে বাজে স্মৃতি আছে তারপরে অবশ্যই না। কিন্তু মনে রেখো, যে কষ্ট তুমি বহন করে বেড়াচ্ছো সেই কষ্টের মোকাবেলা একটা সময় তোমাকে করতেই হবে। কাজেই যত জলদি সেটা করতে পারো ততই ভালো। আর ভালোভাবে অপারেশনটা শেষ করে ফিরে এসো। আমাদের একসঙ্গে অনেক কাজ করতে হবে,’ বলে সে মৃদু হাসল কিন্তু তানভীরের হাসি এলো না।

বর্তমান সময়
ভিআইপি টার্মিনাল,
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, ঢাকা

তানভীরের অস্ত্রটার দিকে তাকিয়ে কাস্টমস চেকিংয়ের লোকটা এমন এক ভঙ্গি করল যেন ওটা একটা পচা মাছ। লোকটা একবার জিনিসটা দেখে নিয়ে ওর দিকে ফিরে তাকাল।

তানভীর ওর আইডি কার্ডটা তুলে দেখাল। আইডি দেখেও লোকটার চেহারা কোনো পরিবর্তন হলো না। বরং আইডি দেখে সে একইরকম শুকনো মুখে জানতে চাইল, ‘আমার বিশ্বাস আপনার কাছে এটা বহন করার জন্যে একটা বিশেষ পাস কিংবা অনুমতিপত্র আছে,’ এবার লোকটার ব্যর্থ হাসি ফোটানোর চেষ্টা।

‘হ্যাঁ অবশ্যই, এক মিনিট,’ বলে তানভীর সঙ্গে নিয়ে আসা বিশেষ ব্যাকপ্যাকটা ঘাঁটতে লাগল। এই ধরনের বিশেষ ব্যাকপ্যাককে ওরা বলে ‘ফাস্ট প্যাক’। জিনিসটাকে নামকরণ করা হয়েছে ফাস্ট ফুডের সঙ্গে মিল রেখে। প্রতিটি এজেন্টের জন্যে এ ধরনের একটা ফাস্ট প্যাক অফিসে সবসময় প্রস্তুত রাখা হয়। এজেন্টের রুচি আর শারীরিক গঠনের সঙ্গে মিল রেখে তার মাপেই প্রস্তুত দু সেট কাপড় থেকে শুরু করে যথেষ্ট পরিমাণ কারেন্সি এমনকি মোবাইলের চার্জার-টুথ ব্রাশ, অতিরিক্ত অস্ত্র, প্রয়োজনীয় কমিউনিকেশন ডিভাইস, সুইস নাইফ এমনকি এক জোড়া হ্যান্ড কাপসহ প্রয়োজনীয় প্রায় সবকিছুই খুব সুন্দরভাবে রাখা থাকে, যাতে খুব ইমার্জেন্সির সময়ে চট করে এটা নিয়ে মুভ করতে পারে যেকোনো এজেন্ট। ব্যাকপ্যাকের সামনের ছোটো একটা খোপে একটা কাগজ হাতে লাগতেই ওটা বের করে স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল তানভীর। যাক পাওয়া গেছে জিনিসটা।

লোকটা মনোযোগের সঙ্গে ওর অনুমতিপত্রটা পড়ল। তারপর ওকে অপেক্ষা করতে বলে সে কোথায় জানি চলে গেল। তানভীর একটু বিরক্ত হয়েই ঘড়ি দেখল একবার। হাবিব আনোয়ার পাশা স্যারের সঙ্গে দেখা হবার পর থেকে সবকিছু এত অস্বাভাবিক দ্রুত ঘটছে ওর মস্তিষ্ক ঠিক প্রসেস করে উঠতে পারছে না।

‘এক্সকিউজ মি,’ হঠাৎ পাশ থেকে ভারী একটা কণ্ঠস্বর শুনে ফিরে তাকাল। নেভি ব্ল স্যুট, সাদা শার্ট আর লাল টাই পরা বিশালদেহী এক লোক দাঁড়িয়ে আছে। মোটা ঠোঁটের ওপরে ততধিক মোটা গোঁফ তার। ‘আপনি আমার সঙ্গে আসুন। একজন ভদ্রলোক দেখা করবেন।’

লোকটার কণ্ঠস্বর যতটা কর্কশ, আচরণ তারচেয়ে বেশি রুক্ষ। কথাটা বলে লোকটা এমনকি অপেক্ষাও করল না। তানভীরকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই সে পেছন ফিরে হাঁটতে লাগল। মুহূর্তের জন্যে দ্বিধা করে ব্যাকপ্যাকটা তুলে নিয়ে তানভীর অনুসরণ করল লাল টাইকে।

লোকটা ওকে নিয়ে ভিআইপি টার্মিনালের একটা লাউঞ্জের সামনে চলে এলো। ‘ভেতরে ইমার্জেন্সি অ্যাকশন ফোর্সের প্রধান বাবুল স্যার অপেক্ষা করছেন,’ বলে সে দরজাটা ওর সামনে মেলে ধরল লাল টাই। লাল টাইয়ের পাথরের মতো মুখের দিকে তাকিয়ে একটা ধন্যবাদসুলভ হাসি দেয়ার চেষ্টা করল তানভীর কিন্তু লাল টাই পাথরের মতোই তাকিয়ে রইল ওর দিকে। বড়ো করে একবার দম নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল তানভীর।

লাউঞ্জের ভেতরটা যেকোনো আর দশটা টার্মিনালের লাউঞ্জের মতো করেই সাজানো কিন্তু অনেক বেশি জাকজমকপূর্ণ আর আরামদায়ক। লাউঞ্জের নীল রঙের পুরু ভেলভেটের সোফায় বসে আছে দুজন মানুষ। তাদের ভেতরে বাম দিকে বসা তুলনামূলক ছোটোখাটো মানুষটাকে দেখে তানভীর চিনতে পারল, উনিই বাবুল আহমেদ। বাবুল আহমেদ শুধু একজন ল এনফোর্সমেন্ট কর্মকর্তাই নয় বরং এক সেন্সে বলতে গেলে সে মিডিয়া সেনশেসন। সোশাল মিডিয়া থেকে শুরু করে ইলেকট্রনিক মিডিয়া তো বটেই এমনকি প্রিন্ট মিডিয়াতেও তাকে নিয়ে মাতামাতির শেষ নেই। তাই সামনাসামনি না দেখলেও তাকে চিনতে এক মুহূর্ত লাগেনি তানভীরের।

বেশ দৃঢ়পায়ে তার দিকে এগিয়ে গেল তানভীর। মানুষটার সামনে গিয়ে একেবারে দাপ্তরিক কায়দায় স্যালুট করল ও।

তানভীর কিছু বলার আগেই বাবুল আহমেদ বসা অবস্থা থেকেই ওর দিকে একটা হাত বাড়িয়ে দিল। ‘তানভীর, তানভীর মালিক, কাম অন। হ্যাভ আ সিট, বলে সে তার বিপরীতে একটা সোফা দেখাল।

ব্যাকপ্যাকটাকে একপাশে রেখে পিঠ একেবারে খাড়া করে বসে পড়ল তানভীর। ‘থ্যাঙ্কু, স্যার।’

‘তোমাকে পরিচয় করিয়ে দিই, অহ্ সরি তানভীর,’ বলে মৃদু হেসে বাবুল আহমেদ বলে উঠল। ‘সরাসরি তুমি বলে ফেললাম।

‘দ্যাট’স ওকে স্যার,’ ছোটোখাটো বাবুল আহমেদকে এতদিন ভাষণ-বক্তৃতা আর টিভির টক-শোতে দেখেছে ও। কিন্তু সামনাসামনি লোকটার প্রাঞ্জল কথা-বার্তা আর ব্যক্তিত্বে রীতিমতো মুগ্ধ ও।

‘ও হচ্ছে আলীম, আলীম পাটোয়ারি,’ বাবুল আহমেদের অন্যপাশে বসা কাঁচাপাকা চুলের মধ্যবয়স্ক মানুষটার পরনে মান্ধাতার আমলের ঢোলা প্যান্ট আর শার্ট, মাথায় আবার একটা গোলটুপি। বাবুল আহমেদ তার নাম বলাতে সে খুঁতনির নিচের ছাগুলে দাড়িতে একবার হাত বুলিয়ে ওকে আপাদমস্তক দেখল। তারপর চশমার মোটা কাচের অন্যপাশ থেকে ওর দিকে তাকিয়ে সামান্য চোখ নাচিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেল নিজের কাজে। সে তার সামনে টেবিলে ওপরে কিছু একটা করতে ব্যস্ত।

‘পাটোয়ারিই তোমাকে অপারেশনের ব্যাপারে বিস্তারিত ব্রিফ করবে। কিন্তু তার আগে আমি তোমাকে কয়েকটা ব্যাপারে একটু বলে নিতে চাই।’

‘অবশ্যই স্যার, তানভীর আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই পাশ থেকে আলীম পাটোয়ারি কথা বলে উঠল।

‘আমি কিন্তুক পরায় রেডি। আপনেরা কথা শেষ করলেই আমি বিরিফ করতে পারুম,’ বলে সে আরেকবার তানভীরকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে ছাগুলে দাড়িতে হাত বুলাল।

তানভীর একটু অবাক হয়েই আবারো পরখ করল লোকটাকে। বাবুল আহমেদের মতো উচ্চপদস্থ একজন লোক কি না এরকম একটা লোককে নিয়ে এসেছে অপারেশনের ব্যাপারে ব্রিফ করার জন্যে। লোকটা এমনকি কথাও বলছে অশুদ্ধ ভাষায়। ওকে আরো এক দফা অবাক করে লোকটা তার পুরনো চামড়ার ব্যাগ থেকে বের করল চকচকে স্টিলের একটা বাক্স। সেটার ভেতরে সারি দিয়ে রাখা খিলি পান থেকে একটা তুলে মুখে পুরে চোখ বন্ধ করে হেলান দিল সোফায়। চরম বিস্মিত তানভীর ফিরে তাকাল বাবুল আহমেদের দিকে।

‘শোন, তানভীর, যে অপারেশনটায় তোমাকে পাঠানো হচ্ছে সেটার গুরুত্ব কিন্তু অপরিসীম,’ বলে সে একটা হাত তুলে বলে উঠল, ‘এর পেছনে একটা কারণ আছে। আগে তোমাকে প্রেক্ষাপটটা বলে নিই। আজ থেকে কয়েক বছর আগে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কিওলজি মানে প্রত্নতত্ত্বের এক প্রফেসর-ডক্টর মিতায়ন আহমেদের কাছে একটা বিদেশি সংস্থা থেকে প্রপোজাল আসে-বাংলাদেশ ভারত মিলিয়ে ভারতের আসামে একটা যৌথ প্রত্নতাত্ত্বিক অভিযান চালানোর। এই প্রপোজালটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল কয়েকটা কারণে। প্রথমত, প্রত্নতাত্ত্বিক অভিযানটা কী নিয়ে ছিল সেটা আমি জানি না, তবে আবিষ্কারটা করতে পারলে সেটা নাকি শতাব্দীর সেরা প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার হতে পারে। যাই হোক, এটা আমার বিবেচ্য বিষয় নয়। দ্বিতীয়ত, তখন সদ্য প্রতিষ্ঠিত আর্কিওলজি ডিপার্টমেন্টের জন্যে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। অভিযানটার গুরুত্ব তারচেয়ে বেশি ছিল কারণ আমরা এর আগে ভারতের আসামে এরকম যৌথ অভিযান চালাইনি। তুমি হয়তো ভারতের সেভেন সিস্টার্সের সঙ্গে বাংলাদেশের জিও-পলিটিক্স খানিকটা জানো,’ বলে একটা ভ্রু উঁচু করল সে।

‘উলফাদের সঙ্গে এর আগে যা হয়েছে সেটা ভুলে আমরা বহুদিন যাবৎ চাইছিলাম সেভেন সিস্টার্সের সঙ্গে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার। কাজেই এই অভিযানটা সেদিক দিয়েও বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সব মিলিয়ে এই দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনের জন্যে ডক্টর মিতায়ন ছিল সেরা মানুষ। আর উনি সেটা প্রমাণও করেন। গত দুই বছরে প্রায় ছয়টা বড়ো ধরনের অভিযান চালানোর পরে মাস তিনেক আগে তারা একটা গুরুত্বপূর্ণ সূত্র আবিষ্কার করে। এরপর থেকে গত তিনমাস ধরে ডক্টর মিতায়ন, সাউথ এশিয়ার আর্কিওলজিক্যাল অ্যাসেসিয়েশনের অন্যতম সদস্য ডক্টর টেড চ্যাঙ টানা অভিযান চালিয়ে জিনিসটা খুঁজে বের করার ব্যাপারে অনেকদূর এগিয়ে যায়। এরপরে আসামের গভীর জঙ্গলে প্রবেশ করার পর তাদের সঙ্গে আমাদের আর কোনো যোগাযোগ ছিল না। এরপরে পার হয়ে যায় প্রায় দুই মাস।’

‘এই দুই মাসে তাদের আর কোনো খোঁজখবর ছিল না?’ তানভীর চিন্তিত মুখে জানতে চাইল।

‘নাহ, তবে মাঝে মাঝে স্যাটেলাইট ফোনে আমাদের কল করত ডক্টর মিতায়ন। অপারেশনের আপডেট দিত। কিন্তু মাসখানেক আগে সেটাও বন্ধ হয়ে যায়। এরপরে দুই দিন আগে তারা বাংলাদেশে ফিরে আসে।’

‘তাই নাকি, তারা যা উদ্ধার করতে গেছিল সেটা কি….?’

তানভীর প্রশ্নটা শেষ করতে পারল না, তার আগেই বাবুল আহমেদ থামিয়ে দিল তাকে, ‘সেটা আমরা এখনো জানি না। এরপর হঠাৎ ডক্টর মিতায়ন আসামের স্থানীয় একটা মোবাইল নম্বর থেকে তার স্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করে জানায়, তাদের কাজ সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। তারা নাকি দ্রুতই বাংলাদেশে ফিরে আসবে। তার স্ত্রীকে কিছু নির্দেশনাও দেয় সে। এর কয়েকদিন পরই তাদের গাড়ি বাংলাদেশে প্রবেশ করে। বর্ডার গার্ড এই ব্যাপারটা নিশ্চিত করেছে। বাংলাদেশে প্রবেশের পর ডক্টর মিতায়নের সঙ্গে তার স্ত্রীর আবারো কথা হয়, এমনকি বাসায় ফিরে কী খাবে সেগুলোও জানায়। এরপরে তারা স্রেফ হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।’

‘মানে কি?’ তানভীর অবাক হয়ে জানতে চাইল।

‘সেটাই তোমাকে খুঁজে বের করতে হবে, মাই বয়। মানেটা যে আসলে কি— সেটা আমরা কেউই বুঝতে পারছি না। সেটাই বের করতে হবে তোমাকে। বাংলাদেশে প্রবেশ করার পর ডক্টর মিতায়ন স্রেফ হাওয়ায় মিলিয়ে গেল কিভাবে- ব্যাপারটা কিছুতেই আমাদের বোধগম্য হচ্ছে না। তুমি সিলেট যাও। তোমার যাবতীয় সাপোর্ট যা লাগে ইএএফের তরফ থেকে দেয়া হবে। তুমি সিলেট গিয়ে খুঁজে বের করবে ওখানে আসলে কী ঘটেছে।’

আনমনেই একবার মাথা নাড়ল তানভীর, ‘স্যার, কিছু মনে না করলে আমার একটা প্রশ্ন ছিল।’

‘বলো,’ প্রশ্ন করার অনুমতি দিয়ে উনি পকেট থেকে সিগারেট কেস বের করে ওটা থেকে একটা সিগারেট ঠোঁটে লাগিয়ে চকচকে সোনালি লাইটার দিয়ে আগুন দিল ওটাতে।

‘স্যার, আমি কেন?’ প্রশ্নটা করতে গিয়ে একটু অস্বস্তি বোধ করতে লাগল তানভীর। ‘মানে স্যার, আপনাদের ইএএফ-এরই তো অনেক দক্ষ আর অভিজ্ঞ ফিল্ড এজেন্ট ছিল, তাহলে আমার মতো ফিল্ডে অনভিজ্ঞ একজনকে কেন বেছে নিলেন আপনারা?’

ওর প্রশ্ন শুনে মৃদু হেসে উঠল বাবুল আহমেদ। ‘তোমাকে বেছে নেবার পেছনে কারণ যাই থাক, তোমার জন্যে তো এটা একটা বিরাট সুযোগ। সম্প্রতি একটা ট্রেনিং শেষ করে এসেছো তুমি, কাজেই সেটাকে ফিল্ড লেভেলে কতটুকু কাজে লাগাতে পারো সেটা পরীক্ষা করার জন্যে এমন গোল্ডেন অপরচুনিটি তুমি আর পাবে না। তা ছাড়া তুমি একজন ক্রিমিনাল অ্যানালিস্ট, তার ওপরে আবার এখন ফিল্ডের ট্রেনিং পেয়েছো-তো এ ধরনের সফিসটিকেটেড কেস হ্যান্ডেল করার জন্যে তুমিই উপযুক্ত ব্যক্তি। তবে আমার একটু বিরক্ত লাগল, পাশা আবার ওই সুলতান আর জালালকে এই কেসে ইনভলভড করতে গেল কেন। আমাদের ইএএফের সাপোর্ট তো ছিলই,’ বাবুল আহমেদ বিরক্তির সঙ্গে মাথা নাড়ল।

যাকগে, তোমার টিকিট রেডি আছে। পাটোয়ারির সঙ্গে ব্রিফিং শেষ করে তুমি প্লেনে উঠে যাবে। তোমার জন্যেই যাত্রীবাহী প্লেনটাকে গত আধা ঘণ্টা ধরে বসিয়ে রাখা হয়েছে। আমি এখান থেকেই বিদায় নেবো,’ বলে হাতের সিগারেটে শেষ টান দিয়ে সেটা অ্যাশট্রেতে গুঁজে উঠে দাঁড়াল বাবুল আহমেদ। তার সঙ্গে সঙ্গে তানভীরও উঠে দাঁড়িয়েছে।

বাবুল আহমেদ ওর একটা হাত ধরে শক্ত করে ঝাঁকিয়ে দিয়ে বলে উঠল, ‘আই থিঙ্ক, তুমি বুঝতে পারছো তোমার ওপরে অনেক কিছুই নির্ভর করছে। কাজেই আমি আশা করব তুমি ব্যাপারটার একটা সমাধান বের করতে পারবে।’

‘স্যার, আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করব,’ একেবারে পিঠ টানটান করে জবাব দিল ও।

সর্বোচ্চ চেষ্টায় কাজ হবে না, আমি সফলতা চাই,’ বলে গটগট করে হেঁটে রুম থেকে বেরিয়ে গেল ইমার্জেন্সি অ্যাকশন ফোর্সের প্রধান বাবুল আহমেদ।

তার গমন পথের দিকে তাকিয়ে ছিল তানভীর, হঠাৎ খিকখিক হাসির শব্দে ফিরে তাকাল সোফার দিকে। আলীম পাটোয়ারি সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ অবস্থায় খিকখিক করে হাসছে। ‘সফলতা চাই’… এতই সুজা! মাডে নাইম্মা দেখ মাদারি,’ সে চোখ বন্ধ করেই বলে উঠল।

‘সরি, আপনার কথা ঠিক বুঝতে… ‘

‘বুজতে পারো নাই তো, বুজবা, মাডে নামলেই বুজবা,’ বলে সে একবার আড়মোড়া ভেঙে সোজা হলো। ‘ভাতিজা, তুমার বয়স কত?’ প্রশ্নটা করেই সে নিজেই জবাব দিয়ে দিল। ‘ও এইহানেই তো আছে সব। তানভীর দেখল মানুষটার ল্যাপটপে ওর ফাইল ওপেন করা। ও কিছু বলার আগেই মানুষটা বলে উঠল, ‘এই লও তুমার কেইস ফাইল, এইনে সব আছে। ওই মাস্টার মিতায়ন, টেড চ্যাঙ, হেগো অবিযান থাইক্কা শুরু কইরা হের লগে সংযুক্ত সব,’ বলে সে একটা স্বচ্ছ ফোল্ডার এগিয়ে দিল তানভীরের দিকে। তানভীর ওটা ওপেন করতে যাচ্ছিল ধমকে উঠল লোকটা।

‘ওই পুলা, অইডা পরে পইরো, আগে হাত আইগাও দেহি।’

তানভীর কিছু না বলে একটু অবাক হয়েই ওর ডান হাতটা এগিয়ে দিল পাটোয়ারির দিকে।

‘আরে বেয়াক্কেল পোলা, ডাইন হাত না বাম হাত দেও। ডাইন হাতের বহুত কাম আছে সামনে,’ বলে সে তানভীরের বাম হাতটা নিজেই ধরে ফেলল। হাতের ঘড়ি আর শার্টের বোতাম খুলে কনুই পর্যন্ত গুটিয়ে দিল শার্টটা। ‘বাহ, ভাতিজা দেহি ঘড়ি তো ভালাই লাগাইছো। হাতও তো শক্ত আছে দেহি, বলে সে তার সামনে রাখা ব্যাগের ভেতর থেকে সিরিঞ্জ আর পিস্তলের মাঝামাঝি দেখতে একটা জিনিস বের করে আনল। বাম হাতের কবজি আর কনুইয়ের মাঝামাঝি জায়গায় হালকা এন্টিসেপটিক ডলে নিয়ে জিনিসটা ঠেকিয়ে ট্রিগারের মতো দেখতে বাটনটা চেপে দিল।

কোকের বোতল খুললে যেরকম ‘ফঁচ’ করে শব্দ হয়, ওরকম শব্দ করে কিছু একটা বসে গেল তানভীরের হাতে। তীব্র জ্বালা ধরানো একটা অনুভূতির সঙ্গে হাতটা ঝাঁকি খেল ওর।

‘উফ্,’ তানভীর না চাইতেও মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল ছোট্ট একটা আর্তনাদ। ট্র্যাকার, আপনি কি ট্র্যাকার বসালেন আমার হাতে?’

‘নাহ, তুমার বিয়ার মেন্দি লাগাইলাম,’ বলে সে নিজে নিজেই হাসতে হাসতে তানভীরের হাতে একটা ব্যান্ড এইডের মতো দেখতে ছোট্ট ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিল। ‘কোনো ব্যথা পাইবা না, কাইল নাগাদ ঠিক অইয়া যাইব। জিনিসটা এক্কেরেই আধুনিক, এইটা চাইরদিন পর্যন্ত অ্যাকটিভ থাকব। এরপরে ডিঅ্যাকটিভ অইয়া যাইব। আর বাইর করতেও কুনো ঝামেলা নাই। অহন দেহি তুমার পিস্তলটা,’ বলে সে হাত বাড়িয়ে দিল তানভীরের দিকে।

কোমর থেকে নিজের পিস্তলটা খুলে খাপসহ সেটা বাড়িয়ে দিল সে আলীম পাটোয়ারির দিকে। জিনিসটা হাতে নিয়ে বের করে চোখ কুঁচকে উঠল তার। ‘এই মান্ধাতার আমলের জিনিস এহনো দিয়া রাখছে।’

‘এইটাও তো ঠিকমতো চালাতে পারি না,’ তানভীর হাতের ট্র্যাকার বসানো জায়গাটা ডলছে।

ওর কথা শুনে চট করে ফিরে তাকাল আলীম পাটোয়ারী। ‘হুনো পোলা, এতদিন টেবিলের পিছে বইসা বইসা কম্পুটারে চাবি টিপতা, কিন্তুক অহন মাডে নামতাছো, একটা কথা কইয়া দেই। কহনোই নিজের দুর্বলতা কেউর সামনে ফাঁস করবা না। কহনোই না, কুনো অবস্থাতেই না,’ বলে সে তার ব্যাগের ভেতর থেকে একটা ডার্ক ট্যান রঙের বেল্ট আর খাপসহ পিস্তল বের করে আনল।

‘কি ছাতা-মাথা ব্যবহার করতা, এইডা দেহ। মাই লেটেস্ট বিউটি,’ বলে সে খাপ থেকে পিস্তলটা বের করে আনল।

তানভীর মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগল জিনিসটা। সাধারণ ল্যুগার কিংবা নাইন এমএমের চেয়ে আকারে একটু বড়ো। মাথার কাছটায় অনেকগুলো খাঁজ কাটা। ‘ডেজার্ট ঈগল,’ আনমনেই বলে উঠল ও।

‘ইয়েস মাই বয়, ডেজার্ট ফাকিং ঈগল,’ বলে সে অভ্যস্ত হাতে পিস্তলটা থেকে বের করে আনল ম্যাগজিন। ফিফটিন রাউন্ড ম্যাগজিন,’ ক্লাচ টেনে একটা বুলেট বের করে আনল। সুপার সেনসিটিভ বোল্ড এন্ড…’ লোড করে একবার ট্রিগার টেনে চেক করল সে। ‘আ ফাকিং লাইট টাচড ট্রিগার,’ তানভীর অবাক হয়ে দেখল অস্ত্রটা হাতে নিতেই মানুষটার কথা বলার ধরন থেকে শুরু করে বডি ল্যাঙ্গুয়েজ পর্যন্ত সব বদলে গেছে। আবার ম্যাগজিনে বুলেট ঢুকিয়ে লোড আনলড পরীক্ষা করে সেফটি অন করে জিনিসটা ধরিয়ে দিল তানভীরের হাতে। ‘লেটেস্ট এই মালডা দিয়া তুমার মতোন আনাড়িও রীতিমতো গান লিখতে পারব শত্রুগর উপরে। আইচ্ছা, আমি একটা জিনিস বুঝতে পারলাম না। তুমার প্রোফাইলে দেখলাম তুমি সেকেন্ড ডান বেলেক বেল্ট। কুন স্টাইলে?’

‘ব্যান্দো স্টাইলে, সেই এসএসসি পরীক্ষার পর থেকে অ্যাকাডেমিতে আন আর্মড কমব্যাট শিখতাম,’ হাসতে হাসতেই জবাব দিল তানভীর।

‘আইচ্চা, হের লাইগাই তো কই ডেস্কের পিছে থাহা অ্যানালিস্ট কেমনে বেলেক বেল্ট পাইলো, তাও এত কম সময়ে। তয় ভাতিজা তুমার শ্যুটিংয়ের রেকর্ড খুব খারাপ। এইডা তুমার ডেললপ করতে অইবো। আর এই ডেজার্ট ঈগলটার লগেও তুমার অভ্যস্ত অইতে অইবো। অহন তুমার জ্যাকেটটা খুলো দেহি?’

‘সরি?’ তানভীর পিস্তলটা হাতে নিয়ে দেখছিল পাটোয়ারীর শেষ কথাটা ঠিক ধরতে পারেনি।

পাটোয়ারী ওর কথার জবাব না দিয়ে, পকেট থেকে টিস্যু বের করে পানের রসে লাল ঠোঁট মুছে তার ব্যাগ থেকে ধূসর রঙের পাতলা ভেস্টের মতো কিছু একটা বের করে এগিয়ে দিল ওর দিকে। ‘সরি মরি না কইয়া জ্যাকেট খুইল্লা এইডা পিন্দা লও,’ বলে সে জিনিসটাতে দুটো টোকা দিয়ে বলল। ‘পলিমার দিয়া বানানো লেটেস্ট মাল।’

তানভীর এক হাতে পিস্তল সামলে জিনিসটা হাতে নিয়ে দেখল ওটা একটা বুলেট প্রুফ ভেস্ট। জিনিসটা দেখার সঙ্গে সঙ্গে ও চিনতে পেরেছে। কারণ কিছু দিন আগেই ট্রেনিংয়ে ও এরকম ভেস্ট ব্যবহার করেছে। পিস্তলটাকে হোলস্টারসহ টেবিলের ওপরে রেখে, ভেস্টটা পরে নিল শার্টের ওপরে। তারপর পিস্তলসহ হোলস্টার সেটের বেল্ট আটকে নিল ওটার ওপরে। এখন চাইলেই খুব সহজে ডান হাতে পিস্তলটা বের করে আনতে পারবে যখন খুশি। শার্ট আর হোলস্টারের ওপরে লেদার জ্যাকেটটা পরে নিয়ে চেইন টেনে দিল তানভীর।

‘আপনার সঙ্গে কি আমার কাজ শেষ?’ জ্যাকেট পরে নিয়ে একবার ঘড়ি দেখল তানভীর। প্লেনটাতে যতটা সম্ভব দ্রুত ওঠা দরকার। কাজে নামতে হবে।

আলীম পাটোয়ারী নিজের ব্রিফকেস থেকে আরেকটা জিনিস বের করে আনল। তবে সেটা তানভীরের হাতে না দিয়ে নিজের হাতেই রেখে ওকে বসার জন্যে ইশারা করল। হাতের জিনিসটা পাশে রেখে পানের বাক্স থেকে আরেকটা পান নিয়ে মুখে পুরে দিল সে।

‘শুনো ভাতিজা, তুমি হয়তো আমার কথা শুইন্না আর কাপড়-চুপর দেইখ্যা আমারে ঠিক ভক্তি করবার পারতেছো না। তয় শুইন্না রাখো আইজ বিশ বছর আমি এই লাইনে আছি। আইজ পর্যন্ত বহু এজেন্টের লগে দেশে-বিদেশে আমি কাম করছি। তয় এই অপারেশনডা কিন্তুক ব্যতিক্রম। আমি নিজে ইএএফরে লুক না হের লাইগাই কইতাছি। তুমার পাশা স্যারে তো শ্যুটার সুলতান আর জালাল ইন্সপেক্টররে পাঠাবোই। আইটি সাপোর্টের লাইগা আমার এক অফিসার টমিরেও আমি পাঠায়া দিছি সিলেট। হেরা তুমারে সাহাইয্য করব,’ তয় বলে সে এক ধাপ এগিয়ে এলো তানভীরের দিকে। ‘কেউরেই বিশ্বাস কইরো না, কেউরেই না, এমনকি নিজেরেও না। একমাত্র তাইলেই মাড়ে টিক্কা থাকতে পারবা। আর যহন সবকিছু ফেইল অইয়া যাব তহন এইডা কামে দিব,’ বলে সে হাতে ধরা জিনিসটা এগিয়ে দিল তানভীরের দিকে।

তানভীর হাতে নিয়ে দেখল। জিনিসটা একটা আধুনিক সুইচ নাইফ, এটাকে স্টিলেটোও বলে। ছুরিটা পকেটে ঢুকিয়ে আলীম পাটোয়ারির দিকে তাকিয়ে হাসি দেয়ার চেষ্টা করল ও।

পাটোয়ারী হাসল না। সে ওর দিকে তাকিয়ে গম্ভীর মুখে খুবই স্মার্ট ভঙ্গিতে বলে উঠল, ‘গুড বাই, মাই বয় অ্যান্ড গুড লাক। ওটাই এখন তোমার সবচেয়ে বেশি দরকার।’

তানভীর চিন্তিত মুখে পাটোয়ারীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফর্মালিটি সেরে প্লেনে এসে উঠল। কানে হেডফোন লাগিয়ে গান ছেড়ে দিল। প্লেন টেক অফ করছে। তবে সেই শব্দ শুনতে পাচ্ছে না ও। টেক অফের শব্দ ছাপিয়ে হেডফোনের এয়ারটাইট খুদে স্পিকারের ভেতর দিয়ে ভেসে আসছে জন ডেনভারের গলা…

মাই ব্যাগস আর প্যাকড, অ্যান্ড আ’ম রেডি টু গো…আ’ম লিভিং অন আ জেট প্লেন…’

শেষ কথাটা কানে যেতেই মৃদু হেসে উঠল তানভীর। জন ডেনভার বাস্তব জীবনে জেট প্লেনে করেই নিজের মৃত্যুর দিকে এগিয়ে গেছিল।

ও কোনো দিকে যাচ্ছে কে জানে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *