অধ্যায় পঞ্চাশ – সময় : ১৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ
জলগুহা, বিধোরীর দুর্গ, কন্নোর, ভারতবর্ষ
আত্মসমর্পণের প্রায় সঙ্গে সঙ্গে উরগ আর লিচ্ছবী সৈনিকদের কয়েকজন এগিয়ে এসে শামানের হাত থেকে কেড়ে নিল কাতানা। সেইসঙ্গে ওর পিঠে রাখা খাপ থেকেও বের করে নিল অন্য কাতানাটা। একটু আগে ঠিক যেভাবে ডুকপা লামাকে চাপ দিয়ে বসিয়ে দিয়েছিল, ঠিক সেভাবেই চাপ দিয়ে হাঁটু গেড়ে বসিয়ে দেয়া হলো ওকে।
রাজা হেমচন্দ্র আর তার পেছন পেছনে এগিয়ে এলো সেই উরগ ওঝা। শামান ওদের কারো পরোয়া না করে সরাসরি তাকিয়ে আছে ডুকপা লামার দিকে। সেও এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শামানের দিকে। শামান দেখল বুড়ো মানুষটার চোখে প্রথমে খেলে গেল অদ্ভুত এক শূন্যতা, পরমুহূর্তে শামানকে চিনতে পেরে তার মুখে ফুটে উঠল আনন্দের হাসি। শামানও মৃদু হেসে উঠল তাকে উদ্দেশ্য করে।
খুঁতনির কাছটায় সামান্য খোঁচা খেয়ে শামান মুখ তুলে তাকাল ওপরের দিকে রাজা হেমচন্দ্র নিজের হাতে ধরা তরবারিটা শামানের খুঁতনির নিচে ঠেকিয়ে ওপরের দিকে ঠেলা দিয়ে উঁচু করে ধরেছে শামানের মুখটা। তারপর ধীরে ধীরে সেটা দিয়ে শামানের মাথায় পেঁচিয়ে রাখা কাপড়টাতে টান দিয়ে সরিয়ে দিতেই শামানের লাল চুলগুলো ছড়িয়ে পড়ল মুখ আর কাঁধের ওপরে। ।
‘লাল চুলের যোদ্ধা,’ বলে উঠল রাজা হেমচন্দ্র। তার ভাষা কিছুটা ভাঙা ভাঙা হলেও শামান বুঝতে পারল। ‘কন্নোরের মাটিতে পা দেয়ার পর থেকেই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে এখানকার মাটি,’ বলে সে তলোয়ারের ডগা দিয়ে সামান্য বাড়ি মারল শামানের মুখের একপাশে। রাগের সঙ্গে শামান তাকাল রাজা হেমচন্দ্রের দিকে।
‘শশশ,’ মুখ দিয়ে অনেকটা সাপের মতোই হিসহিসে শব্দ করে সামনে এগিয়ে এসে শামানের ঠিক সামনে ওরই মতো হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল উরগদের ওঝা। সামনাসামনি লোকটাকে দেখে একটু আবাক হয়ে গেল শামান। দূর থেকে লোকটার উদ্ভট পোশাক, জটা ধরা চুল আর সাজগোজ দেখে ভেবেছিল লোকটা বুঝি আর দশটা কাপালিকের মতোই হবে, কিন্তু কাছে থেকে তাকিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক মানুষকে অবিষ্কার করল ও। সেই উদ্ভট সাজ-পোশাকের আড়ালে সম্পূর্ণ শান্ত আর বুদ্ধিমান এক জোড়া চোখ তাকিয়ে আছে ওর দিকে।
সেই চোখ জোড়ায় ভিন্ন এক ধরনের কৌতূহল। ‘লাল চুল আর নীল চোখের মানুষ সত্যিই তাহলে আছে দুনিয়াতে,’ বলে ওঝা শামানের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে তার হাতের লাঠিটা দিয়ে ওর চুলগুলোকে খানিকটা নেড়ে দেখল। শামানের হাত বন্ধ থাকার পরও রাগের সঙ্গে মুখের একপাশ দিয়ে ঝাপটা মারল ও।
‘অনেক রাগ আর জেদ এই শরীরে,’ বলে সে মুহূর্তের জন্যে চোখ বন্ধ করে বলে উঠল, ‘দেখি তো এই মাথার ভেতরে কী আছে?’ বলেই ওঝা এমন এক কাজ করল মোটেই আন্দাজ করতে পারেনি শামান। কথাটা শেষ হবার আগেই সে নিজের লম্বা লম্বা আঙুল আর হাতের তালু দিয়ে খপ করে চেপে ধরল শামানের মাথাটা। মাথাটা চেপে ধরার সঙ্গে সঙ্গেই জোরে একটা চাপ দিল সে। সূক্ষ্ম একটা ব্যথার সঙ্গে আপনাতেই চোখ বন্ধ হয়ে এলো ওর। মাথার ভেতরে কেমন জানি একটা ঘোলাটে ভাব ছড়িয়ে পড়ল, সেইসঙ্গে চোখের সামনে ভেসে উঠল সেই উপত্যকা, ঘুরে বেড়ানো লাল চুলের মানুষগুলো, ছোটোবেলায় মঠের দৃশ্যাবলি, যুদ্ধ হানাহানি।
ঝট করে হাত সরিয়ে নিল ওঝা। মুখ তুলে তাকাল শামান। ঘোরটা কেটে গেছে। এই ব্যাটা কি আসলেই ওর মন পড়ছিল নাকি সম্মোহিত করে ফেলেছিল ওকে।
ওঝা স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ‘অনেক তেজ তোমার ভেতরে, যোদ্ধা,’ বলে সে নিজের মুখটা এগিয়ে আনল শামানের দিকে। ‘তবে এগুলোর কোনোটাই মূল কথা নয়। মূল কথা হলো শূন্যতা, অসীম শূন্যতা তোমার ভেতরে যোদ্ধা,’ শামান লোকটার চোখের দিকে তাকিয়ে আবারো ঘোরের ভেতরে চলে যাচ্ছিল রাজা হেমচন্দ্রের ধমকে ঘোরটা কেটে গেল ওর।
‘এই, এত কথা কিসের?’ বলে সে নিজের লোকদের দিকে ফিরে বলে উঠল। ‘শেষ করো এইগুলারে, আর পুরা জলগুহা খুঁজে দেখো এদের সঙ্গে আরো কেউ থাকতে পারে।’
রাজা হেমচন্দ্রের শেষ কথাটা শোনামাত্রই শামানের মুখটা ঘুরে যাচ্ছিল যেদিকে ঘোষিত আর ওর লোকেরা লুকিয়ে আছে সেদিকে, কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই ওঝা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রাজার দিকে ফিরে বলে উঠল, ‘এই যোদ্ধা ওটার জন্যে এখানে আসেনি,’ বলে সে কাঠের বাক্সটা দেখাল। সে এসেছে ওর জন্যে,’ যদিও কথাটা যথেষ্ট শক্তভাবেই বলেছে কিন্তু শামানের কাছে মনে হলো ওঝা ডুকপা লামাকে দেখানোর সময়ে তার গলায় শ্রদ্ধা ফুটে উঠল। কিন্তু রাজা হেমচন্দ্রের গলায় কোনো ভাব নেই বরং সে আবারো রাগের সঙ্গে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই আবারো জলগুহার মুখের দিকে মানুষের পায়ের আওয়াজ শোনা গেল। উপস্থিত প্রায় সবাই সেদিকে ঘুরে তাকাল, শামানও ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল।
প্রথমেই চোখে পড়ল সবার মাথা ছাড়িয়ে ওপরের দিকে উঠে গেছে শান্ত-শিষ্ট গোলগাল চেহারার ধোয়ীর মাথা। তাকে দেখতে পেয়ে মুহূর্তের জন্যে খুশির ঝিলিক বয়ে গেল শামানের ভেতরে কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ওর মুখের হাসি বন্ধ হয়ে গেল ধোয়ীর হাতের দিকে চোখ পড়তে, হাতদুটো দড়ি দিয়ে বাঁধা, ঠিক তার পাশেপাশেই এগিয়ে আসছে কালন্তি, তার হাতও একইভাবে দড়ি দিয়ে বাঁধা। তাদের সঙ্গে আরো একজন বন্দি আছে। আর ওদেরকে হাঁটিয়ে নিয়ে আসছে আরো চারজন লিচ্ছবী সৈনিক।
সৈনিকেরা ওদের কাছে এসে থেমে গেল। দুই বন্দিকে দড়ি ধরে টেনে একপাশে সরিয়ে সৈনিকদের দলনেতা সামনের দিকে এগিয়ে এলো। রাজা হেমচন্দ্রের দিকে ঝুঁকে কুর্নিশ করতেই সে প্রায় গর্জন করে উঠল। ‘ব্যাপার কি? এদেরকে কোত্থেকে ধরে এনেছিস?’
‘হুজুর এরা পাতাল জলপথ দিয়ে মনে হয় ওপরে উঠে এসেছিল,’ লিচ্ছবী সৈনিকদের নেতা রাজা হেমচন্দ্রের সামনে একেবারে নত হয়ে আছে। ‘আমরা এদেরকে পাতালপথের প্রবেশদ্বারের কাছ থেকে ধরেছি।’
‘কারা এরা?’ রাজা দুই বন্দির দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল। কিন্তু কেউ জবাব দেয়ার আগেই পেছন থেকে প্রায় ছুটে সামনে এগিয়ে এলো ওঝা। সে সামনে এগিয়ে একেবারে সোজা গিয়ে দাঁড়াল কালন্তির সামনে। কথা নেই বার্তা নেই, একটানে সে কালন্তির চুল খুলে দিয়ে ওগুলো সামান্য নেড়ে কী জানি দেখল। কালন্তি ঝটকা দিয়ে নিজেকে পিছিয়ে নিল।
ওঝা কালন্তির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ রাজা হেমচন্দ্রের দিকে ফিরে বলে উঠল, ‘এই মেয়ে সাধারণ কেউ না এ অবশ্যই…’ সে কথা শেষ করতে পারল না তার আগেই কালন্তি প্রায় লাফিয়ে এগিয়ে এলো তার দিকে। নিজের হাতের দুই কবজির সঙ্গে জড়ানো দড়িটা একটানে খুলে নিয়ে ওটা দিয়ে পেঁচিয়ে ধরল ওঝার গলায়। কালন্তি এক ঝটকায় দড়িটা গলায় পেঁচিয়ে ধরে তাকে একপাশে কাত করে ফেলল, ‘তুই একদম ঠিক বলেছিস, আমি কালন্তি, থারু রাজা মানরুর মেয়ে,’ বলেই সে প্যাচানো দড়িটা দিয়ে ওঝাকে আরো জোরে চেপে ধরার আগেই খিপ্র গতিতে হাতের সরু লাঠিটা দিয়ে কালন্তির পেটে খোঁচা মরল ওঝা।
তীব্র ব্যথা পেলেও কালন্তি তাকে ছেড়ে দিল না বরং প্যাচানো দড়িটা ধরে একপাশে বিশেষ ভঙ্গিতে কোমর বাঁকিয়ে একপাশে ছিটকে ফেলল সে ওঝাকে।
ওঝা মাটিতে পড়ে যেতেই সময় যেন থমকে দাঁড়াল। কালন্তি আর ওঝার ব্যাপারটা এত দ্রুত ঘটেছে যে কেউই মুহূর্তের জন্যে বুঝতেই পারেনি আসলে কী ঘটেছে। বন্দিনী হঠাৎ এভাবে হাত বাঁধা অবস্থায় ওঝাকে আক্রমণ করল কিভাবে।
কিন্তু ওঝা মাটিতে পড়ে যেতেই প্রথমেই অচলবস্থার নিরসন ঘটাল ধোয়ী। সেও ঠিক কালন্তির মতোই হাতে নামে মাত্র পেঁচিয়ে রাখা দড়িটা হাত থেকে ফেলে দিয়ে লাফিয়ে এগিয়ে এলো শামানের দিকে। শামানকে ধরে রাখা দুই প্রহরীকে দুই হাতে শূন্যে তুলে নিয়ে তাদের প্রায় ছুড়ে মারল শামানদেরকে প্রহরারত বাকি লিচ্ছবী সৈন্যদের দিকে। সেইসঙ্গে প্রাণপণে চেঁচিয়ে উঠল সে।
একইসময়ে তীক্ষ্ণ একটা শিস বাজাল লিচ্ছবী সৈন্যদের ছদ্মবেশে থাকা শংকরাদিত্য। সঙ্গে সঙ্গে শামানের লোকেরা, ধোয়ী কলন্তি আর ঘোষিতসহ সবাই সতর্ক হয়ে উঠল। প্রত্যেকেই বের করে আনল নিজের অস্ত্র।
লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল শামান। এটাই ছিল ওদের পরিকল্পনা; কালন্তি আর শংকরাদিত্যদের দলটার ওপরে দায়িত্বই ছিল, ওরা পাতালের পথ দিয়ে প্রবেশ করে পথিমধ্যে যদি কোনো সৈন্যদলের সামনে পড়ে তবে তাদের পোশাক লুট করে দলের দুয়েকজনেকে বন্দি দেখিয়ে বাকিরা লিচ্ছবী সৈন্যদের বেশে ওরা পৌঁছে যাবে জলগুহায়। এরপরে যা করার করবে। আর বাস্তবেও ঘটেছে তাই। ওরা জলগুহার কাছাকাছি পৌঁছেই দেখতে পায় রাজা হেমচন্দ্রের লোকেরা শামানকে বন্দি করেছে। আর তাই ওভাবে প্রবেশ করে ওদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে।
শামান উঠে দাঁড়িয়েই সোজা আক্রমণের নির্দেশ দিল। ও আর ঘোষিত বাদে বাকি প্রায় সবাই সশস্ত্র। ওর নির্দেশ পাওয়া মাত্রই শংকরাদিত্য আর কালন্তির নেতৃত্বে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ল লিচ্ছবী আর উরগদের ওপরে। শামান আক্রমণের নির্দেশ দিয়েই ফিরে তাকাল ডুকপা লামাকে বন্দি করে রাখা সৈন্যদের দিকে। তিনজন সৈনিক ঘিরে আছে তাকে, তাদের মধ্যে একজন তাকে কাঁধের কাছের কাপড় ধরে টেনে তুলছে ওপরে। শামান মাটি থেকে একটা বর্শা উঠিয়ে নিল। উরগদের বর্শা, ওর কাতানার মতোই হালকা। জিনিসটা মাটি থেকে তুলে নিয়ে সেটা ছুঁড়ে মারল ডুকপা লামাকে ধরে থাকা সৈনিকের দিকে। বর্শাটা সোজা গিয়ে খুলির একপাশে গেঁথে গেল লোকটার। শামান আশপাশে তাকাল নিজের অস্ত্রের খোঁজে।
ওর জোড়া কাতানার একটা রাজা হেমচন্দ্রের হাতে. অন্যটা আরেক প্রহরীর হাতে। রাজাকে তার সৈনিকরা ঘিরে ধরেছে গোল বলয়ের মাঝে, তারপর তারা দ্রুত সরে যাবার চেষ্টা করছে জলগুহার প্রবেশ পথের দিকে। শামান একবার তাদেরকে দেখল আরেকবার দেখল ডুকপা লামাকে প্রহরারত সৈনিকদের। সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল, আগে ডুকপা লামাকে উদ্ধার করতে হবে। হাঁটুর নিচে খোপের ভেতর থেকে ছুরিটা বের করে আনল। ওর দিকে এগিয়ে আসা এক উরগ প্রহরীর পেট ফাঁসিয়ে দিয়ে সামনে এগোতে লাগল ও। কিন্তু বেশি এগোনোর আগেই ও দেখল ওদের চারপাশে যুদ্ধ চলছে কিন্তু সংখ্যায় কম হবার কারণেই হোক আর অন্য কারণেই হোক ওদেরকে দ্রুত ঘিরে ফেলছে লিচ্ছবী আর উরগ সৈনিকরা। মুখের ভেতর আঙুল পুরে দিয়ে জোরে শিস বাজাল ও। প্রতি উত্তরে গুহার এক ধার থেকে ভেসে এলো একইরকম শিসের শব্দ।
সঙ্গে সঙ্গে ওর সঙ্গে লড়াইরত এক উরগ সৈনিকের মাথায় ঢুকে গেল একটা তির। ঘোষিতের দল আক্রমণ চালিয়েছে। গুহার আড়ালে লুকিয়ে থাকা ঘোষিতের দলটা রীতিমতো হইহই করে ঝাঁপিয়ে পড়ে যোগ দিল ওদের সঙ্গে। শংকরাদিত্যকে চিৎকার করে ও নির্দেশ দিল রাজা হেমচন্দ্রকে সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করছে যে দলটা ওদেরকে ফেরাতে। শামান ফিরে দেখল ডুকপা লামাকে এখনো টেনে সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করছে দুই সৈনিক। ওর সামনে যে পড়ছে তাদেরকে মেরে-কেটে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল ও।
হঠাৎ সেই ওঝা এসে পড়ল ওর সামনে। তার হাতে সেই লাঠি। শামান মৃদু হেসে উঠল তার দিকে তাকিয়ে। কিন্তু ও সাবধান হবার আগেই লোকটা আক্রমণ চালাল। লাঠির প্রথম দুটো আঘাত শরীর বাঁকিয়ে এড়িয়ে গেল ও। কিন্তু তৃতীয় আঘাতটা এসে পড়ল ওর চিবুকের ওপরে। সঙ্গে সঙ্গে জ্বলে উঠল যেন জায়গাটা। নিশ্চয়ই এই ব্যাটা ওঝা কিছু একটা ব্যবহার করছে লাঠিতে, আর লাঠিটাও সাধারণ কিছু না। আরেকবার লাঠির আঘাত এসে পড়ার আগেই সরে গেল ও। ‘আচ্ছা তুমি তাহলে শুধু ওঝা নও, যোদ্ধাও।’
ওঝা কোনো জবাব না দিয়ে দুইবার লাঠিটাকে নিজের মাথার ওপরে ঘোরাল। তার নড়া-চড়া দেখেই বোঝা যায় কতটা দক্ষ সে।
শামান মাটিতে একটা গড়ান দিয়ে এগিয়ে গেল তার দিকে। ওর হিসেবে ওঝা সাবধান হবার আগেই নিচ থেকে ছুরি চালিয়ে ফাঁসিয়ে দেবে লোকটার পেট কিন্তু ছুরি চালানোর আগেই সে দেখল ওঝা সাবধান হয়ে গেছে। একটা হাঁটু দিয়ে পেটটা তো আগলে ফেলেছেই সেইসঙ্গে সে লাঠিটা চালিয়ে দিয়েছে শামানের গলা লক্ষ্য করে। কোনোমতে একপাশে সরে গেলেও শামান যখন উঠে দাঁড়াল তখন দেখতে পেল ওর গলা জ্বালা করছে। এবার বুঝতে পারল ঘটনা কি। ওঝার লাঠিটার সাধারণ চেহারার আড়ালে ওটা আসলে একটা অস্ত্র। ওটাকে নির্দিষ্টভাবে চালালে ওটার ভেতর থেকে ফলা বেরিয়ে আসে। আরেকটু হলেই ওঝা ফাঁসিয়ে দিয়েছিল ওর গলাটা।
রাগের সঙ্গে গলাটা একটু ডলে নিয়ে ও ওঝার দিকে চোখ তুলে তাকাল। ‘ঠিক আছে, তবে তোমার মতোই খেলা চলুক,’ বলেই ও আগের মতো লাফ দিল ও মাটিতে কিন্তু এবার এক গড়ান দিয়ে উঠে বসে আক্রমণ না চালিয়ে বরং বসা থেকেই এক লাফে উঠে গেল শূন্যে। ওপরে ঝুলতে থাকা খিলের একটা ধরে শূন্যে ঝুলে পড়ল ও। তারপর ওপর থেকে এক পা নামিয়ে আনল ওঝার কাঁধের ওপরে। ওঝার কাঁধের হাড় ভাঙার শব্দ পরিষ্কার শুনতে পেল ও। সেইসঙ্গে দেখতে পেল ওঝার শরীরের বাঁ পাশটা ঝুলে পড়ল, ডান হাতে এখনো লাঠিটা ধরা শামান এবার একপাশে সরে গিয়ে বাঁ দিক থেকে আক্রমণ চালাল। কোনোরকম চালাকির ধারেকাছে না গিয়ে চতুর লোকটার বুকের ভেতরে বসিয়ে দিল নিজের ছুরিটা তারপর লাফিয়ে সরে এলে একপাশে। ছুরিটা ঢুকে যেতেই সে ঢলে পড়ল মাটিতে, একটু আগে শামান যেভাবে হাঁটু গেড়ে বসে ছিল সেভাবে হাঁটু গেড়ে বসে সে মুখ তুলে তাকাল ওর দিকে। ঠোঁটের কোণ দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ল। ‘যোদ্ধা, তুমি জানো না, কত বড়ো বোকামি করছো,’ বলেই সে কেশে উঠল। আরো রক্ত গুঁড়িয়ে পড়ল মুখ থেকে। মাটিতে ঢলে পড়ল ওঝা।
লোকটাকে পড়ে যেতে দেখে ও ফিরে তাকাল ডুকপা লামার দিকে। এখনো তাকে দুই পাশ থেকে ধরে আছে দুই উরগ সৈন্য। তিনজনেই এতক্ষণ তন্ময় হয়ে দেখছিল ওঝা আর শামানের যুদ্ধ। ও ফিরে তাকাতেই একজন হাত তুলতে গেল কিন্তু তার আগেই লাফ দিল শামান। ওঝার বুক থেকে বের করে নেয়া ছুরিটা লোকটার দিকে ছুঁড়ে মারল। লোকটা ঘায়েল হয়ে যেতেই দ্রুত নড়ে উঠল দ্বিতীয় জন, সে হাতের তলোয়ারটা ডুকপা লামার দিকে তুলতে যাবে তার আগেই একটা তির এসে বিঁধল তার কপালে। ছিটকে পড়ে গেল সে। শামান ফিরে দেখল ঘোষিত, তার হাত থেকে নামিয়ে নিচ্ছে ধনুকটা। একবার ওর দিকে হাত নেড়ে ও এগিয়ে ধরে ফেলল ডুকপা লামাকে।
বয়স্ক মানুষটা কাত হয়ে বসে পড়ল মাটিতে। শামান গিয়ে আস্তে করে বসিয়ে দিল তাকে। ডুকপা লামা স্রোতরে মতো ঘামছেন। ‘শামান, তুমি…’ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল সে, তার আগেই সে হঠাৎ কেঁপে উঠল। শামান দেখল ছোট্ট সজারুর কাঁটার মতো চিকন ফলা বেরিয়ে আছে ডুকপা লামার বুকের একপাশ থেকে। চট করে ফিরে দেখল ওঝা আবারো উঠে বসেছে, তার হাতে ধরা সেই লাঠিটা। শামান ফিরে তাকাতেই দেখল একটা তির গিয়ে বিঁধল ওঝার বুকে। ঘোষিতের কাজ। কিন্তু ক্ষতি যা হবার হয়ে গেছে।
ডুকপা লামার দিকে ফিরে চিৎকার করে উঠল শামান। ‘না…’ প্ৰাণপণে চেঁচিয়ে উঠল ও। ডুকপা লামার মুখ পাণ্ডুর হয়ে গেছে। একটা আঙুল তুলে সে শামানকে শান্ত থাকতে বলল। ‘শামান,’ খুবই শান্ত স্বরে ডেকে উঠে চুপচাপ কথা বলে গেল সে কিছুক্ষণ। ধীরে ধীরে তার গলা জড়িয়ে আসতে লাগল। কথা শেষ হতে হতেই চুপ হয়ে গেল মানুষটা। ছোটোবেলার পর এই প্রথমবারের মতো ডুকড়ে কেঁদে উঠল শামান। পৃথিবীতে ওর একমাত্র আপনজনটাও বিদায় নিল। যাকে বাঁচাতে এসেছিল ও, পারেনি তাকে ফিরিয়ে নিতে। পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে ও। প্রিয়জন হারানোর বেদনা আর পরাজয়ের গ্লানিতে কেঁপে কেঁপে কাঁদতে লাগল ও।