অধ্যায় তেত্রিশ – বর্তমান সময়
নির্মাণাধীন ল্যাব, শাহী ঈদগাহ, সিলেট
বুদ্ধের অন্ধকার অবতার, ওরফে ব্ল্যাক বুদ্ধা,’ টমি পোদ্দার তার সামনে রাখা প্রজেক্টরে ওপেন করা ছবির দিকে তাকিয়ে শিক্ষকদের মতো ঢঙে বলে উঠল। ‘ইউরোপ-আমেরিকাতে যেমন হলি গ্রেইল, মধ্যপ্রাচ্যে আর্ক অব কভেনান্ট, তেমনি এশিয়াতে…’
’এই ছবিটা কি সেই—’ তানভীর কথা শেষ করার আগেই ওর মোবাইল বাজতে লাগল। মোবাইলের দিকে তাকিয়ে দেখল ওর মা কল করেছে। ‘সরি, এক মিনিট’ বলে ও উঠে এলো টেবিল থেকে। ‘হ্যালো, মা… হ্যাঁ নাশতা খেয়েছি, তোমার কি অবস্থা? হাঁটতে বের হয়েছিলে গতকাল?… ও আচ্ছা… গিয়েছিলে সুমন ভাইয়ের দোকানে?… হুমম… বুঝতে পেরেছি, তুমি ওষুধ খেয়ো ঠিকমতো, আর বাসার পাশের ফার্মেসিতে গিয়ে প্রেশার-ডায়বেটিসটা মাপিয়ে এসো। আমি একটা মিটিংয়ে আছি, এখন রাখি,’ বলে ও কলটা কেটে ফিরে এলো।
‘সরি,’ বলে ক্ষমাপ্রার্থনাসুলভ হাসি দিয়ে টমিকে বলল আবার শুরু করতে।
‘হুম,’ লেকচার দেয়ার সুযোগ পেয়ে টমির ভাব এখন তুঙ্গে। আগের দিনের গুরুজিরা যেভাবে হাতের বেত দিয়ে বোর্ডের দিকে তাকিয়ে পড়া বোঝাত অনেকটা সেভাবেই হাতের লেজার পয়েন্টারটা নেড়ে নেড়ে কথা বলার চেষ্টা করছে সে। টমির ভাব দেখে সুলতানের দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিল তানভীর।
বাঁ পাশের কানের লতিতে সাদা রঙের ছোটো একটা ব্যান্ডেজ লাগানো সুলতানের। গতকালের অভিযানের ফল। ডক্টর মিতায়নকে লাক্কাতুরার সেই বাংলো থেকে উদ্ধার করার পর এক দিন পার হয়েছে। এর মধ্যে বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে। ডক্টর মিতায়নকে বাংলো থেকে উদ্ধার করার পর লায়লাসহ তাকে সোজা পাঠিয়ে দেয়া হয় সিলেট ওসমানি মেডিকেল হাসপাতালে।
তানভীরসহ বাকিরা প্রাথমিক চিকিৎসা নেয়ার পর পুলিশ আর ফরেনসিক টিম বাংলোতে পৌছালে তাদের নিয়ে কাজ শুরু করে ওরা। বাংলো থেকে বেশ কিছু ডক্যুমেন্টসহ চারটা লাশ আর একজনকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। সমস্ত কাজ শেষ করে টমি সুলতান আর ইকবালকে কিছু নির্দেশনা দিয়ে নির্মাণাধীন ল্যাবে ওর কোয়ার্টারে ফিরে আসে তানভীর। ক্লান্তিতে প্রায় ভেঙে পড়া শরীরে ঘুমিয়ে যায় একটু পরেই।
সকালবেলা ওর ঘুম ভাঙে ইএএফের প্রধান বাবুল আহমেদের কল পেয়ে। বেশ প্রশংসা করে সে তানভীরের, এক দিনের ভেতরেই ডক্টর মিতায়নকে উদ্ধার করতে পারার কারণে সে বেশ খুশি। সেইসঙ্গে এও জানায় ও চাইলে কেসটা এখন ইএএফের হাতে তুলে দিতে পারে। তানভীর নির্দিষ্ট জবাব না দিয়ে জানায় ওর বস পাশা স্যারের অনুমতি না নিয়ে সে কিছুই বলতে পারবে না।
বাবুল আহমেদের সঙ্গে কথা শেষ করেই ও কল দেয় পাশা স্যারকে। পাশা স্যার ওর কল পেয়ে প্রথমেই ওকে এক দফা ঝাড়ি দেয় গতকাল প্রপার চ্যানেলের মাধ্যমে যোগাযোগ না করার কারণে। এরপর সে প্রশংসার সঙ্গে ওকে জানায়, বেশ ভালো কাজ দেখিয়েছে ও। এরপর তানভীর তাকে জানায় আর কি কি ঘটেছে, ‘ব্ল্যাক বুদ্ধা’ শব্দটা শোনামাত্রই উনি তানভীরকে একটু পরে কল করবেন বলে কল কেটে দেন।
তানভীর বেশ অবাক হয়ে ফোন রেখে ফ্রেশ হয়ে নেয়।
রেডি হচ্ছে এমন সময় পাশা স্যার কল করে ওকে পুরো ব্যাপারটা খোলা চোখে যা দেখাচ্ছে ব্যাপারটা এরকম নাও হতে পারে। তাই তানভীর যেন কেসটা ছেড়ে না দিয়ে বরং এর পরবর্তী বিষয়গুলো আপডেট করে। কারণ এই ব্যাপারটার সঙ্গে আরো ভিন্ন কিছু জড়িত থাকার সম্ভাবনা আছে। উনি টমিকে কিছু ফাইল পাঠিয়েছেন বলে ওকে ফোন রাখতে বলে নির্দেশ দেন উনাকে নির্দিষ্ট সময় পর পর কাজের অগ্রগতি জানাতে। পাশা স্যারের সঙ্গে কথা শেষ করে তানভীর টমিকে কল করে সুলতান আর ইকবালকে নিয়ে ইমিডিয়েটলি ল্যাবে আসতে বলে। সঙ্গে এও জানায় সুলতান যেন ল্যাবে এসে সবাইকে নিয়ে একটা মিটিং ডাকে।
যথাযথ নির্দেশনা দিয়ে ডক্টর মিতায়নের খবর নেয় ও। গতকাল রাতে শেষবার খবর নিয়ে জানতে পেরেছিল তার কোনো গুরুতর ক্ষতি হয়নি, সামান্য আহত হয়েছে। তাকে কোনো ধরনের ড্রাগ পুশ করা হয়েছিল—তবে সেটা বেশি ক্ষতিকর কিছু না। এখন সিডেটিভ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। গতকাল রাতেই নিরাপত্তাজনিত কারণে ইএএফের অধীনে ওসমানী মেডিকেল থেকে সম্মিলিত পুলিশ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে তাকে। ডক্টরের খবর নিয়েই মাকে কল করে ও, কিন্তু মা ওর কল রিসিভ করেনি।
নাশতা সেরে নিতে নিতেই বাকিরা চলে আসার পর পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে ল্যাবের সেই মিটিং রুমে মিটিংয়ে বসেছে ওরা। মিটিংয়ের শুরুতেই ডক্টর মিতায়নের মুখে শোনা আর বাংলোতে পাওয়া অসংখ্য ডকুমেন্টে উল্লেখ ব্ল্যাক বুদ্ধার প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা শুরু করেছে। গতদিন ডক্টর মিতায়নের মুখে কথাটা শুনে প্রথমে চমকে উঠেছিল ওরা।
ব্যাপার কি? ডক্টর জ্ঞান হারাবার আগে এটা কী বলল। পরে বাংলোতে পাওয়া ডকুমেন্টে ব্যাপারটার উল্লেখ পায় ওরা। সেগুলো থেকে প্রাথমিকভাবে এটা ধারণা করে নেয় যে ডক্টর মিতায়নরা আসামে যে অভিযান চালাচ্ছিল সেটার ভেতরে ঘাপলা ছিল।
যা বলছিলাম, ব্ল্যাক বুদ্ধা হলো আসলে একটা মূর্তি, অবশ্যই একটা বুদ্ধ মূর্তি, টমি আগের মতোই ভাব নিয়ে বলে চলেছে। তার পরনে কালো রঙের মেগাডেথের টি-শার্ট, সেটা ঠেলে বেরিয়ে আছে গোলচে ভুঁড়ি। ‘ইউরোপ আমেরিকাতে যেমন হলি গ্রেইল, আর্ব অব কভেনান্ট, আটলান্টিস ইত্যাদি ইত্যাদি আরাধ্য সব অমীমাংসিত রহস্য রয়েছে ঠিক তেমনি এশিয়ান সাবকন্টিনেন্টের সবচেয়ে আরাধ্য এবং রহস্যময় একটি আর্টিফ্যাক্টগুলোর একটি হলো এই ব্ল্যাক বুদ্ধা।’
‘এটাই কি সেই মূর্তির ছবি নাকি?’ সুলতান প্রজেক্টরে ফুটে থাকা মূর্তির ছবিটার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল। ‘ব্ল্যাক বুদ্ধা?’
বড়োদের আড্ডার আসরে বাচ্চারা হঠাৎ গুরুগম্ভীর কথা বললে মুরুব্বিরা যেভাবে তাকায় অনেকটা সেভাবেই টমি ফিরে তাকাল সুলতানের দিকে। ‘জি না, ম্যাডাম। এইটা সেই মূর্তির ছবি হলে তো ভালোই ছিল, এটা একটা কাল্পনিক ছবি,’ বলে সে অন্যদের দিকে ফিরে তাকাল। ‘ব্ল্যাক বুদ্ধা আসলে শুধু একটা মূর্তি না, তারচেয়ে অনেক বেশি কিছু। গতকাল রাতে তানভীর স্যারের সঙ্গে কথা হবার পর পাশা স্যার ইন্টারপোলের সঙ্গে যোগাযোগ করে ব্ল্যাক বুদ্ধা সংক্রান্ত বেশ কিছু তথ্য জোগাড় করেছেন। কাল প্রায় সারারাত ধরে সেগুলো ঘেঁটে আমি যা বুঝেছি তারই সার-সংক্ষেপ আপনাদের সামনে এই স্লাইডে প্রেজেন্ট করছি।’
‘তা তো বুঝলাম,’ তানভীর বলে উঠল। ‘কিন্তু তুমিই বলছো ব্ল্যাক বুদ্ধা একটা মূর্তি, আবার তুমিই বলছো ব্লা্যক বুদ্ধা আসলে একটা মূর্তি না, তারচেয়ে অনেক বেশি কিছু। এ কেমন কথা?’
‘এখানে পুরো ব্যাপারটাতে বেশ কিছু ঝামেলা আছে। এই ঘাপলাটা বুঝতে হলে আপনাদের সবাইকে ব্ল্যাক বুদ্ধার ইতিহাস জানতে হবে, মানে বুঝতে হবে ব্ল্যাক বুদ্ধার মূল পারসপেকটিভ। ব্ল্যাক বুদ্ধা হলো এমন এক মূর্তি যেটা নিয়ে সেই পুরনো সময় থেকে শুরু করে বর্তমানে এমনকি, মডার্ন পপ কালচারেও এর ব্যবহারের শেষ নেই। এর পেছনে মূল কারণ হলো ব্ল্যাক বুদ্ধা নিয়ে হাজার বছর ধরে চলে আসা নানা মিথ। পাশা স্যারের পাঠানো ফাইলগুলো ঘেঁটে আমি এটা বুঝতে পারলাম যে,’ বলেই সে বিরাট আকারের একটা হাইম ছাড়ল। ‘রাতভর গবেষণার ফসল,’ বলেই হেসে উঠল। তার সঙ্গে সঙ্গে হেসে উঠল বাকিরাও।
‘এই সব রহস্যের ক্ষেত্রে সাধারণত যা হয়, ব্ল্যাক বুদ্ধার ক্ষেত্রে ঠিক তেমনটাই ঘটেছে। এইসব রহস্যের একটা মূল বীজ রোপিত থাকে ইতিহাসের কোনো এক অধ্যায়ে, যেটা সঠিকভাবে কেউই বলতে পারে না। তারপর সেই বীজ থেকে ধীরে ধীরে লোকমুখে ছড়িয়ে পড়া গুজবের মাধ্যমে নির্মিত হতে থাকে মহীরূহ। যে মহীরূহের কিছুটা অংশ সত্য আর বেশির ভাগই মানুষের লাগাম ছাড়া কল্পনার বহিঃপ্রকাশ। এসব গাল গল্পের বেশির ভাগই হারিয়ে যায় ইতিহাসের আড়ালে। আর যেগুলো টিকে থাকে সেগুলো দিনে দিনে আকারে শুধু বৃদ্ধিই পেতে থাকে। এগুলোকেই আমরা মিথ বা লেজেন্ড বলি। এসব মিথ সত্য-মিথ্যে মিলিয়ে লোকের মুখ থেকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে অ্যাকাডেমিকদের কাগজের পাতায়, মিডিয়াতে, রহস্য উপন্যাসে। আর যে রহস্য গভীর যত পুরনো যত বিখ্যাত সেই রহস্যের সঙ্গে জড়িত আর্টিফ্যাক্টের দাম বাড়তে থাকে হু-হু করে—’
‘এই যে ভাই, লেকচার বন্ধ করেন,’ এবার সুলতান একটু রাগের সঙ্গে বলে উঠল। ‘এসব আমরা জানি, ব্ল্যাক বুদ্ধার কথা বলেন, এইটা আসলে কি? খায় না মাথায় দেয়?’
টমি আবারো সুলতানের দিকে তাকিয়ে মুরুব্বিসুলভ একটা হাসি দিল। অন্যান্য সময় সবাই তাকে নিয়ে মজা নেয়, এখন সবাইকে কৌতূহলের মধ্যে রাখতে পেরে সে বেশ মজা পাচ্ছে। ‘ধীরে ম্যাডাম, আমরা হাজার বছরের পুরনো রহস্যের জট খুলতে যাচ্ছি। সময় তো একটু লাগবেই। যাই হোক, রহস্য যত বড়োই হোক এর বীজ তো একটা থাকেই। ব্ল্যাক বুদ্ধাও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে ব্ল্যাক বুদ্ধার কিছু বিষয় একেবারেই আলাদা। এর ব্যাপারে কিছুটা তথ্য একমাত্র অ্যাকাডেমিকরা ছাড়া কেউই দিতে পারেনি। এমনকি অ্যাকাডেমিকরাও এই ব্যাপারে এসে কেন জানি বারবার খেই হারিয়ে ফেলেছে। সাদা চোখে যেটুকু প্রচলিত আছে তাতে আন্দাজ করা যায় এই রহস্যের বীজ রোপিত হয়েছিল আজ থেকে দুই হাজার বছরেরও বেশি আগে। আমাদের এই উপমহাদেশে বৌদ্ধ কমিউনিটির বসতিগুলো খেয়াল করে দেখেন,’ বলে সে দক্ষিণ এশিয়ার একটা ম্যাপ প্রদর্শন করল পরের স্লাইডে।
‘বেশির ভাগ বৌদ্ধ কমিউনিটির বসবাসের জায়গাগুলো কেমন যেন ছড়ানো ছড়ানো,’ বলে সে তার লেজারে চাপ দিতেই ম্যাপের বেশকিছু জায়গা লাল হয়ে উঠল। ‘দেখেন ভারতবর্ষের মাঝখানের অঞ্চলগুলোতে বৌদ্ধ কমিউনিটির বড়ো বসবাসের ক্ষেত্রগুলো তুলনামূলক কম, তারচেয়ে উত্তর আর দক্ষিণে বসবাসের মাত্রা অনেক বেশি। উত্তরে লাদাখ, সিকিম, তিব্বত, ভুটান, আবার দক্ষিণে শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড ইত্যাদি। এমনকি বাংলাদেশেও দেখেন, আরেকটা স্লাইড চাপতেই এবার বাংলাদেশের ম্যাপ ফুটে উঠল। সেখানেও দেখা গেল বড়ো বড়ো বৌদ্ধ মন্দির আর কমিউনিটিগুলো বেশির ভাগই দক্ষিণে। ‘দেশের মাঝামাঝি কম, বেশির ভাগই দক্ষিণে। অথচ মৌর্য শাসন আমলে বৌদ্ধরাই ছিল ভারতবর্ষের মূল শাসনের কেন্দ্রে। তাহলে তারা উত্তর আর দক্ষিণে এতটা ছড়িয়ে পড়ল কিভাবে, কেউ বলতে পারবেন?’
‘আমি যতটুকু জানি ওদের ধর্মের বিকাশ ঘটেছিল বেশির ভাগই ওসব অঞ্চলে,’ স্প্যানিশ অভিনেতার মতো দেখতে ডক্টর প্রবীর বলে উঠল ।
‘ভুল, কারণ আগেই বলেছি মৌর্য শাসন আমলে ভারতে বৌদ্ধ শাসনই মূখ্য ছিল। এই ছড়িয়ে পড়ার পেছনে একটা মূল কারণ হলো, যখন শুঙ্গদের হাতে মৌর্য শাসনের পতন হয় তখন শেষ মৌর্য রাজা বৃহদ্রথ তার ব্রাহ্মণ সেনাপতি পুশ্যমিত্রের হাতে খুন হয়েছিল। তাকে খুন করেই পুশ্যমিত্র ক্ষমতা দখল করে মৌর্য শাসন বিলুপ্ত ঘোষণা করে শুঙ্গ সাম্রাজ্য চালু করে। এই ব্রাহ্মণ সেনাপতি রাজা হবার পর সে বৌদ্ধদের গণহারে খুন করতে শুরু করে। কথিত আছে, ক্ষমতা দখলের পর রাজা পুশ্যমিত্র প্রতিটি কর্তিত বৌদ্ধ মস্তকের জন্যে শত-সহস্র স্বর্ণমুদ্রা পুরস্কার ঘোষণা করে।’
‘ধর্ম যখন লৌকিক হাতিয়ার, মৃত্যু তোলে হাহাকার,’ তানভীর আনমনেই বলে উঠল। ‘হাজার বছর কেটে গেছে অথচ চিত্রটা আজো একই।’
‘ঠিক,’ বলে টমি আরেকটা হাইম ছাড়ল। ‘ঠিক তখুনি রচিত হয়েছিল এই ব্ল্যাক বুদ্ধা মূর্তির রহস্য। ওই সময়ে আসলে কী ঘটেছিল সেটা পরিষ্কার কিছুই জানা যায়নি। তবে একটু জানা গেছে, ব্ল্যাক বুদ্ধা মূর্তিটা নাকি আসলে অদ্ভুত আর একেবারেই ব্যতিক্রম এক ধরনের কালো ধাতু দিয়ে নির্মিত। এই ধাতুটাও নাকি এক অনন্য ধাতু। কারণ যে ধাতু দিয়ে মূর্তিটা নিৰ্মিত সেটা নাকি আবার কেমিস্ট্রি মানে রসায়নের জগতের আরেক মিথ, আমি তো বিজ্ঞান অত বুঝি না কিন্তু মনে হয় এই ধাতুর অবস্থান এমনকি পর্যায় সারণিতেও নেই। তা ছাড়া মূর্তিটা আসলে দেখতে কেমন কত বড়ো এসব ব্যাপারেও সঠিকভাবে কিছু জানা যায়নি। তবে এই মূর্তি নিয়ে সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার যেটা প্রচলিত সেটা হলো, এই মূৰ্তিতে নাকি স্বয়ং বুদ্ধের অন্ধকার এক রূপকে নামিয়ে আনা হয়েছিল সেই সময়ে। এই মূর্তির মাধ্যমে নাকি স্বয়ং বুদ্ধ কথা বলেছিল তার অনুসারীদের সঙ্গে।’
এটা কি জেসাসের পুনরুত্থানের মতো কোনো ব্যাপার?’ তানভীর জানতে চাইল।
‘না, ঠিক উলটো। খেয়াল করে দেখেন যদি সত্যি স্বয়ং বুদ্ধ কথা বলে থাকেন এই মুর্তির মাধ্যমে তাহলে ব্যাপারটা ভালো হবার কথা কিন্তু সেটা মোটেই সেরকম নয়। কারণ এই মূর্তি নির্মাণ করা হয়েছিল কালো জাদুর মাধ্যমে মানুষের অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্যে। যে কারণে এই মূর্তির ভেতরে নাকি বন্দি হয়ে আছে বুদ্ধের এক অন্ধকার অবতার। আর এ কারণেই একে বলা হয় ব্ল্যাক বুদ্ধা।’
কি সব আজেবাজে কাহিনি। কালো জাদু, পর্যায় সারণি বহির্ভূত ধাতু, বুদ্ধের অন্ধকার অবতার,’ সুলতান আর ইকবালে দিকে তাকিয়ে হেসে উঠল তানভীর। ‘টমি, এই সকালবেলা এসব আজাইরা বক বক না করে আমাদেরকে কংক্রিট কিছু দাও যেটা নিয়ে আমরা কাজে নামতে পারব। প্লিজ আমাকে এসব আলতু ফালতু জিনিস বিশ্বাস করতে বলো না।’
তানভীর কথাগুলো বলে টমির দিকে তাকিয়ে রইল। সে ভেবেছিল টমি ওর কথা শুনে খুব ইমোশনাল হয়ে যাবে। কিন্তু হলো উলটো। ওর কথাগুলো শুনে টমি হেসে উঠল। ‘থ্যাঙ্কু স্যার, আমি যা বললাম তারপরে ঠিক এরকম কেউ বলবে সেটাই আশা করছিলাম। আপনি আমার মনের আশা পূরণ করে দিয়েছেন,’ বলে সে তানভীরের দিকে একটু এগিয়ে এলো।
‘স্যার, আপনি যা বললেন ঠিক এই পয়েন্টটাই অমি ধরাতে চাইছিলাম সবাইকে,’ বলে সে অন্যদের দিকে ফিরে তাকাল। ‘আমি যা বললাম এর সবই প্রচলিত কথা। সঠিক তথ্য হয়তো ডক্টর মিতায়ন বলতে পারবেন। কিন্তু আমার পয়েন্ট হলো, যে কথাগুলো তানভীর স্যার কিংবা আপনারা মানছেন না সেগুলোই লোকমুখে, বইয়ের পাতায়, মডার্ন আর্ট-কালচারে প্রচলিত আছে হাজার দুই হাজার বছর ধরে। এমনকি বর্তমান সময়ের অনেক সেলিব্রেটিদের মধ্যে এ নিয়ে তুমুল ক্রেজ বিদ্যমান। যেমন ধরেন অ্যাপেলের প্রয়াত সিইও স্টিভ জবস বুদ্ধিজমের ব্যাপারে ক্রেজি ছিলেন, এ ছাড়াও ফেসবুকের কর্ণধার মার্ক জুকারবার্গ থেকে শুরু করে অনেকেই বুদ্ধিজম নিয়ে ফ্যাসিনেটেড। তাহলে চিন্তা করেন হাজারো বছর ধরে প্রচলিত এরকম একটা রহস্যময় জিনিস সত্যি যদি কেউ আবিষ্কার করতে পারে তাহলে সেটার অ্যান্টিক ভ্যালু কতটা হবে? তাও টাকার ব্যাপারটা যদি বাদ দিই, এরকম একটা আবিষ্কার কতটা অলোড়ন সৃষ্টি করবে ভাবেন একবার।’
সবাই চুপ কেউই কিছু বলছে না।
‘আমি এই লাইনের এক্সপার্ট নই। কিন্তু পাশা স্যারের ফাইল ঘেঁটে বুঝলাম, ব্ল্যাক বুদ্ধা যদি সত্যি আবিষ্কার হয়ে থাকে তবে এটার মূল্য অপরিসীম হবে,’ বলে সে পরের স্লাইডে চাপ দিল। সেখানে একটা হিসেব দেখানো আছে। ‘এখানে ওয়ার্ল্ড আর্কিওলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের হিসেবে হলি গ্রেইল থেকে শুরু করে ইতিহাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিটি কল্পিত আর্টিফ্যাক্টের একটা তুলনামূলক দাম হিসেব করে দেয়া হয় মার্কেট প্রাইস যাচাই করে। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম যদি এই সব আর্টিফ্যাক্ট বাস্তবে খুঁজে পাওয়া যায় তবে এর বর্তমান লিগ্যাল মার্কেট প্রাইস কত হতে পারে। ওদের হিসেবে মার্কেট প্রাইস যাচাই করে এখানে ব্ল্যাক বুদ্ধার একটা দাম লেখা আছে।’
ডলারের অঙ্কটা দেখে প্রায় সবারই বলতে গেলে চোখ কপালে উঠে গেল।
সর্বনাশ, ইতা খিতা মাতরায়,’ ডক্টর প্রবীরের মুখ দিয়ে একেবারে খাস সিলেটি ভাষা বেরিয়ে এসেছে। ‘আট্টু অইলে তো…’
তার দিকে এক পা এগিয়ে গেল টমি। ‘ডিয়ার ডক্টর প্রবীর এটা অনুমেয় দাম, তাও লিস্টেড বায়ারদের জন্যে। যেকোনো প্রাইভেট কালেক্টর এর দ্বিগুণ দিতে রাজি হয়ে যাবে। আপনারা হয়তো ব্যাপারটা ঠিক ধরতে পারছেন না। একটা মূর্তিই তো, এর দাম এত হবে কিভাবে? একটা উদাহরণ দিই তাহলে বুঝতে পারবেন। ধরেন আজ যদি মোনালিসা লুভর থেকে চুরি হয়ে মার্কেটে চলে আসে, অথবা কোহিনুর হিরা টাওয়ার অব লন্ডন থেকে চুরি করে কেউ ব্ল্যাক মার্কেটে সেল করতে যায়, তবে এগুলোর দাম কি কেউ কল্পনা করতে পারবে?’ বলে সে একটু থেমে নাটকীয়ভাবে যোগ করল।
‘কিংবা ধরেন আরো প্রাচীন মিথিক্যাল রহস্যগুলোর মধ্যে একটা, মনে করেন ফিলোসফারস স্টোন যদি আবিষ্কার হয় সেটার মূল্য কত হতে পারে? কেউ বলতে পারবে? ব্ল্যাক বুদ্ধার ব্যাপারটাও অনেকটা এমন। আপনার বা আমার মতো মানুষদের কাছে এই মূর্তি কিছুই না। কিন্তু বহু মানুষ এর জন্যে জান দিয়ে দেবে। তার ওপরে এটার একটা অ্যাবস্ট্র্যাক্ট ও রিলিজিয়াস ভ্যালু আছে। কারণ কথিত আছে এটার বিশেষ ক্ষমতা আছে, আবার এটা নির্মিত এমন এক ধাতু দিয়ে, যেটা নাকি পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে বহু আগে। ব্ল্যাক বুদ্ধা খুঁজে পাওয়া গেলে পৃথিবীর বড়ো বড়ো অনেক ল্যাব এই মূর্তি নিয়ে কাজ করার জন্যে অস্থির হয়ে উঠবে। তারমানে যেকোনো অ্যাঙ্গেল থেকেই ব্ল্যাক বুদ্ধার কোনো তুলনা নেই। আমার বিশ্বাস এই কেসের সঙ্গে ওতোপ্রতভাবে জড়িয়ে আছে এই মূর্তি। এই কেস সলভ করতে হলে আমাদেরকে অবশ্যই খুঁজে বের করতে হবে ব্ল্যাক বুদ্ধা।’