ব্লেড, ক্রিম আর ঘুমের বড়ি
কর্মজীবনের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ কেসটিকে কোনও তরুণ গোয়েন্দাই ভুলতে পারে না। তার কারণ সে সময়ে সে স্বপ্ন দেখে বুঝি বা এর সফল পরিসমাপ্তির ওপরেই নির্ভর করছে তার সারা ভবিষ্যৎ। যদিও এমনতর ধারণায় সত্যের ছিটেফোঁটাও নেই। পরে অবশ্য পরিণত বুদ্ধি দিয়ে, আরও পরিষ্কারভাবে বিচারবিবেচনা করার শক্তিলাভের পর সে উপলব্ধি করতে পারে কতখানি আজগুবি আর অলীক ব্যাপারের ওপর তার সম্ভবপর সাফল্য আর ব্যর্থতা নির্ভর করেছে। এই জাতীয় অকুতোভয় স্পার্টান দর্শনবাদ সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞানলাভের পরেই সে গোয়েন্দাগিরিতে আরও পারদর্শী হয়ে উঠতে থাকে। এ জ্ঞানলাভের পথটি কিন্তু কুসুমাস্তীর্ণ নয়। আমার বেদনাময় অভিজ্ঞতা থেকেই আমি তা জেনেছি।
আজ আমি বেলগ্রেডের পুলিশ চিফ। কিন্তু এত বছর পরেও সেদিন ব্যর্থতার কামড় আমার তরুণ মনকে স্বভাবে দংশেছিল এবং যে নিদারুণ নিরাশা আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল–আজও অ ঠিক তেমনিভাবে উপলব্ধি করতে পারি। সে সময়ে বেলগ্রেডের হেড কোয়ার্টারে ছিলাম অতি কম মাইনের গোয়েন্দা হিসেবে। যুগোশ্লাভিয়ায় তখন রাজতন্ত্র-শাসন কায়েমি রয়েছে। সালটা ১৯৩৪। গ্রীষ্মকাল। আমার ঠিক ওপরকার চিফ তার ছোট্ট অফিসঘরে আমাকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন– জোসেফ, তুমি আমেরিকায় যেতে চাও?
সেদিনকার আতীব্র উত্তেজনা আজও আমি মনে করতে পারি। প্রস্তাবটা শুনেই চট করে শুধিয়েছিলাম–আপনি কি সত্যি সত্যিই যেতে বলছেন আমাকে? আমার কপাল ভালো, কিছু কিছু ইংরেজি আমি বলতে পারি।
সুযোগটা তোমাকে দেওয়া হচ্ছে শুধু ওই কারণেই। এই ফাইলটা নিয়ে যাও। খুব মন দিয়ে কাগজগুলো পড়ে ফ্যালো। বছরের পর বছর অপরাধীদের যত রেকর্ড আমরা সংগ্রহ করেছি, তার মধ্যে সবচেয়ে সম্পূর্ণ রেকর্ড হচ্ছে এটি। লোকটাকে আমি অন্য দেশের শাসনের আওতা থেকে টেনে এদেশের শাসনব্যবস্থার এখতিয়ারে ফেলতে চাই। কী করে তুমি তা করবে তা আমি জানতে চাই না। আমি শুধু চাই, বিচারের জন্যে তাকে তুমি যুগোশ্লাভিয়ার মাটিতে নিয়ে এসো। বহুদিন ধরে অনেক নারীকে শিকার বানিয়েছে সে। তার অগুন্তি (হলেও হতে পারে) বউয়ের অন্তত একজনকে যে সে খুন করেছে, সে বিষয়েও আমাদের মনে আর কোনও দ্বিধা বা সন্দেহ নেই। তার একমাত্র উপযুক্ত স্থান হচ্ছে যুগোশ্লাভ কারাগার।
আইভান পোডারজে-র অস্তিত্ব সম্বন্ধে প্রথম খবর এইভাবেই কানে পৌঁছোল আমার। জন্ম তার যুগোশ্লাভিয়ায়। পেশায় সে পয়লা নম্বরের ভণ্ড। বহু নারীকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে সে এবং ধনবতী মহিলাদের সংখ্যাই তাদের মধ্যে বেশি। তার পিছু নিয়ে ইউরোপ থেকে যেতে হয়েছে আমেরিকায়, আবার ফিরে আসতে হয়েছে ব্রিটেন, ফ্রান্সে, জার্মানিতে আর অস্ট্রিয়ায়। শেষকালে ওয়ল্টা আর প্রেটার ভায়োলেটের শহর ভিয়েনায় মুখোমুখি হয়েছিলাম তার।
কেটা হাতে নেওয়ার পরেই নিউইয়র্কে হাজির হলাম আমি। কেন্সটা সম্বন্ধে তখন কত আশা, কত স্বপ্নই না ছিল আমার মনে। ভাবতাম যে লোকটাকে গ্রেপ্তার করে আদালতে হাজির করার গুরুদায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আমার কাঁধে, তাকে হাতের মুঠোয় আনার তদন্ত-পর্বের এই বুঝি প্রথম পর্যায়। ভাবতাম, এ তদন্তের অন্তে সাফল্য থাকবেই এবং ধুরন্ধর বদমাশটাকে আমি গ্রেপ্তার করবই। কেসটা প্রাথমিক কাজ দেখেই আমার হুঁশিয়ার হওয়া উচিত ছিল। পোডারজের ধড়িবাজি আর পিছলে বেরিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা এত বেশি যে, বঁড়শিতে গাঁথা হতভাগিনীদের অর্থে সে শুধু বিলাসবহুল জীবনই যাপন করেনি, তার প্রাপ্য শাস্তিকে এক ধাপ টপকে যাওয়ার মতো বুদ্ধিমত্তা যে তার মগজে আছে, তার আমার বোঝা উচিত ছিল।
লোকটার গতিবিধি সম্বন্ধে খুবই আবছা খবর রাখত আমেরিকার ইমিগ্রেশন ডিপার্টমেন্ট। গত বছরের আগে যুগোশ্লাভ কটিনজেন্টের কেউই নাকি তাকে দেখেনি। কিন্তু নিউইয়র্কের পুলিশবাহিনীর কাছ থেকে সব সময়ে সব রকম সাহায্য আমি পেয়েছিলাম। তারাই আমাকে জানালেন, কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিপথ থেকে বেমালুম উধাও হয়ে যাওয়ার কিছু আগেই পোরজে নাকি আবার বিয়ে করেছিল। মেয়েটির নাম অ্যাগনেস টাফভারসন। শহরের নামকরা কর্পোরেশন আইনবিদ সে। বয়স প্রায় তেতাল্লিশ। দারুণ ধূর্ত। বিয়ের আগে পর্যন্ত একটু নিরিবিলি নিঃসঙ্গ জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিল সে।
মানহাট্টানে লিটল চার্চ অ্যারাউন্ড দ্য কর্নার-এর মিনিস্টারের কাছ থেকে কয়েকটি তথ্য সংগ্রহ করলাম আমি।
ভদ্রলোক বললেন–কিছুদিন আগেই এক যুগোশ্লাভদ্রলোকের বিয়ের খুঁটিনাটি তদারক করতে হয়েছে আমাকে। বিয়ের সাক্ষীরা আসলে তাকে চিনতই না। এই গ্রামেরই বাসিন্দা তারা। খুব শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হয় বিয়ের অনুষ্ঠান। তার পরেই গাড়ি হাঁকিয়ে চলে যান বর-বউ। আর তাঁদের দেখা যায়নি।
|||||||||| অন্যান্য সূত্র থেকে অ্যাগনেস টাফভারসনের কুক্ষণে-শুরু রোমান্সের কাহিনিও শুনতে পেলাম। বিয়ের কয়েকমাস আগে সে ইউরোপে গিয়েছিল ছুটি উপভোগ করতে। তখনই ফ্রেঞ্চ রিভিয়েরাতে তার সঙ্গে আলাপ হয় পোডারজে-র। মেয়েদের চিরকালই চুম্বকের মতো কাছে টেনে আনতে পারে পোডারজে। অ্যাগনেসের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটল না। পোডারজেকে ভীষণ ভালো লেগে গেল তার। অ্যাগনেসকে পোডারজে বুঝিয়ে দিলে সে যুগোশ্লাভিয়ার অবসরপ্রাপ্ত আর্মি অফিসার। নিজের সম্পত্তিও আছে যথেষ্ট। নিজস্ব কতকগুলো পেটেন্ট কৌশল প্রয়োগ করাই পছন্দ করত পোডারজে। ব্যবসা সম্পকির্ত নানাবিধ ঝুঁকি নেওয়ার সময়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারলে বিস্তর আমোদ পেত। হাবভাব রীতিমতো মার্জিত আর শিক্ষিত ছিল সে। আন্তর্জাতিক আইনকানুনও কিছু কিছু জানত। যখনই দেখা হত দুজনের, খট করে গোড়ালি ঠুকে সম্ভ্রমভাবে অ্যাগনেসের হাতে চুম্বন এঁকে দিত পোডারজে। আর তাইতেই গলে গেল অ্যাগনেসের মন! অ্যাগনেস নিজেও কিন্তু বিলক্ষণ ধূর্ত ছিল। ধীশক্তিও ছিল যথেষ্ট। কিন্তু মেয়েদের প্রতি কোনও পুরুষ যে এতখানি আদবকায়দা আর শিষ্টাচার দেখাতে পারে, তা তার আগে জানা ছিল না। অন্তত তার বরাতে এমনটি এর আগে আর জোটেনি। বিশেষ করে ওই রকম বিপজ্জনক বয়েসে, যে বয়েসে প্রেমমাত্রই একদম অন্ধ, সে বয়েসে চিত্তজয়ের এই অভিনব পন্থাটির অবশ্যম্ভাবী পরিণাম যা হবার, তা হল।
মায়াবী জাদুকরের মতোই অ্যাগনেসকে মোহমুগ্ধ করে ফেললে পোডারজে। কিন্তু প্রথম থেকেই হুঁশিয়ার হয়ে প্রেমাস্পদ সম্বন্ধে যদি একটু খোঁজ-খবর করতে। অ্যাগনেস, তাহলেই অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্যই জানতে পারত সে। চওড়া-কঁধ কেঁকড়া চুল পোডারজেকে দেখে কিন্তু তার সত্যিকারের বয়েসের চাইতে অনেক কমবয়েসি বলেই মনে হত। এই কান্তিমান প্রিয়ংবদ মানুষটি যে আসলে একটা পাকা ঠগ–তা জানতে তার বেশি সময় লাগত না। তার সন্ধানে শুধু যে তার স্বদেশের পুলিশই ঘুরছে তা নয়–বহু জায়গায় পুলিশবাহিনী বিভিন্ন ধরনের বিস্তর আইনবিগর্হিত কার্যকলাপের জন্যে তাকে খুঁজছিল। এসব অপরাধের মধ্যে গভর্নমেন্ট এবং আর্মি অফিসারের ছদ্মবেশ ধারণও আছে। কিন্তু বুদ্ধিমতী হওয়া সত্ত্বেও এই ঝামেলাটুকুর মধ্যে আর যেতে চায়নি অ্যাগনেস। তার কারণও ছিল। প্রথমত সে নারী তার ওপর প্রেমে অন্ধ। দ্বিতীয়ত মনচোর প্রিয়জনের সঙ্গে ইউরোপের বড় বড় শহরগুলো দেখতে পাওয়ার সুখ স্বপ্নেও সে তখন মশগুল। পোডারজেও হচ্ছে। সেই ধরনের লোক, যে জাতিগত সঙ্কীর্ণতার ঊর্ধ্বে সব দেশকেই যে স্বদেশ মনে করে এবং এদিক দিয়ে তার অভিজ্ঞতাও বড় কম নেই। কাজে কাজেই দেশবিদেশের হরেকরকম গল্প শুনিয়ে অ্যাগনেসের মনের আকাশে রাশি রাশি রঙের স্বপ্ন ছড়িয়ে দিতে বিন্দুমাত্র কসুর করলে না সে। ভিয়েনায় একত্সঙ্গে নাচলে ওরা দুজনে। নিউইয়র্কের রক্ষণশীল কোনও মহিলার কাছে এ অভিজ্ঞতা তো নিদারুণ রোমান্টিক মর্মস্পর্শী এবং কোনওদিনই ভুলতে পারা যায় না।
অ্যাগনেস নিউইয়র্কে ফিরে এল বন্ধুবান্ধব আর ব্যবসায়ী মহলের পরিচিত সবাই লক্ষ্য করলে। সুখ আর আনন্দ যেন উপছে তার মনের দুকূল ছাপিয়ে, ঝরে পড়ছে তার চোখে, মুখে, হাসিতে। শুধু তাই নয়। তার বয়সও যেন কমে এসেছে অনেকটা। পোরজের প্রতীক্ষায় ছিল অ্যাগনেস। কয়েকদিনের মধ্যেই রওনা হল সে। ১৯৩৩ সালের নভেম্বর মাসে যুগোশ্লাভের পুলিশ যখন তাকে তন্নতন্ন করে খুঁজছে, ঠিক তখনই জাহাজে চেপে পাড়ি দিলে সে আমেরিকার দিকে। নিউইয়র্কে পৌঁছে আস্তানা নিলে গ্ৰেমার্সি পার্কের একটা ছোট্ট হোটেলে।
পুনর্মিলনের কিছুদিন পরেই অসুস্থ হয়ে পড়ে অ্যাগনেস। সুযোগটাকে পুরোমাত্রায় কাজে লাগালে পোরজে। অ্যাগনসের প্রতি তার অনুরাগ যে কতখানি গভীর তা এই সুযোগে অন্তরস্পর্শী অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে বুঝিয়ে দিলে ও। কথাবার্তা আদবকায়দায় তো তার জুড়ি মেলা ভার। তার ওপর মনটাও যে কতখানি নরম–তা প্রমাণিত হল তখনই। সুস্থ হয়ে উঠলে ডিনার, কনসার্ট আর ব্রডওয়ে শো নিয়ে কদিন খুব ফুর্তি করল দুজনে।
ওদের প্রাকৃবিবাহ প্রেমপর্বের শেষ পর্যায়টা কিন্তু খুবই সংক্ষিপ্ত। ওই বছরের ডিসেম্বরের চার তারিখে বিয়ে হয়ে গেল ওদের। যে ফ্ল্যাটে দীর্ঘদিন একাকী নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করেছে অ্যাগনেস, বিয়ের পর পর সেই ফ্ল্যাটেই উঠে এল পোডারজে। সবকিছুই ঘটে গেল খুবই তাড়াতাড়ি। অ্যাগনেসের ফ্যামিলির সঙ্গে পোরজের কোনওদিনই দেখাসাক্ষাৎ হয়নি। বিয়ের রাতে অ্যাগনেস ডেট্রয়েটে তার বাড়িতে আর মট্রিয়ালে তার বোনকে টেলিফোন করে জানালে বিবাহসংবাদ।
কাকপক্ষীকে না জানিয়ে বিয়ে শেষ করার কারণ বোঝাতে গিয়ে অ্যাগনেস বলেছিল–ব্যাপারটা এত তাড়াতাড়ি ঘটে গেল যে তোমাদের কাউকেই আমন্ত্রণ জানাতে পারলাম না। ছঘণ্টা আগেও আমি জানতাম না যে বিয়ে করতে চলেছি আমি। কিন্তু বিশ্বাস করো মানুষটিকে দারুণ ভালোবাসি আমি। সারা দুনিয়ার এমন চমৎকার মানুষ আর দুটি নেই।
অ্যাগনেসের আত্মীয়স্বজনেরা পরে আমাকে বলেছিল পোরজেও নাকি টেলিফোনে কথা বলেছিল তাদের সঙ্গে। বলেছিল–মধুচন্দ্র যাপন করতে আমরা ইংল্যান্ড রওনা হচ্ছি। সেখান থেকে জার্মানিতে আমার এস্টেটে কয়েকটা দিন থাকব। সত্যি কথা বলতে কি মাস ছয়েকের আগে অ্যাগনেসের সঙ্গে আপনাদের আর দেখাই হবে না। জার্মানি থেকে আমরা যাব যুগোশ্লাভিয়ায়। যে দেশে আমার জন্ম, অ্যাগনেসকে আমি নিয়ে যেতে চাই সে দেশের মাটিতে।
ছমাসব্যাপী মধুচন্দ্রের প্রস্তুতি নিয়ে কিছুদিন ব্যস্ত রইল অ্যাগনেস। কেনাকাটা করা, প্যাক করা ছাড়াও টাকাকড়িরও একটা পাকাঁপোক্ত ব্যবস্থা করতে হল ওকে। ব্যাঙ্ক থেকে ২৫০০০ ডলার তুলল ও। ৫০০০ ডলার বাদে পুরো অর্থটাই তুলে দিলে তার প্রিয় ক্যাপ্টেনের হাতে। স্বামীকে সে ক্যাপ্টেন বলেই জানত। টাকা রাখা হল একটা জয়েন্ট অ্যাকাউন্টে। বাকি টাকাটা পাঠিয়ে দেওয়া হল লন্ডনে। ডিসেম্বর মাসের কুড়ি তারিখে ওদের ইংল্যান্ড রওনা হওয়ার দিন ধার্য হয়েছিল। ওদের মধ্যে, ক্যাপ্টেন আর মিসেস পোডারজের। জাহাজটার নাম হামবুর্গ। সে সময়ে নাৎসিদের পতাকা উড়ত হামবুর্গের ওপর।
যাত্রার দিনটি এগিয়ে আসতে থাকে। অ্যাগনেস একদিন জাহাজে গিয়ে কিছু মালপত্র রেখে এল তার কেবিনে। কেবিনটা শুধু তার একার জন্যেই বুক করা হয়েছিল। যাত্রীদের তালিকায় তার স্বামীর নাম ছিল না। নামটি যে কেন বাদ গেল এবং এই বাদ দেওয়ার পেছনে কোনও কুমতলব আছে কিনা–এ ধরনের কোনও সন্দেহ অ্যাগনেসের প্রণয়-নিবিড় মগজে স্থান পায়নি। স্বামীর ওপর তার অগাধ বিশ্বাস। পোডারজে বউকে কী বুঝিয়েছিল, তা কোনওদিনই জানা যায়নি। তবে অ্যাগনেসের পরিচারিকা ফ্লোরা মিলারের কাছে জানা গেছিল মিসেস পোডারজে নাকি তাকে বলেছিলেন যে ব্যবসা-সম্পর্কিত কিছু কাজকর্মের জন্যে কিছুদিন পরে রওনা হবেন তার স্বামী।
কয়েকজন সাক্ষী বললে, পোডারজে নাকি তাদের কাছে এমন একটা দোকানের ঠিকানা চেয়েছিল যেখানে দেশভ্রমণে উপযুক্ত একটা পেল্লায় ট্রাঙ্ক কিনতে পাওয়া যায়। সমস্ত জামাকাপড় সে একটা ট্রাঙ্কে রাখাই পছন্দ করে–বিশেষ করে সাগরপাড়ি দেওয়ার সময়ে। থার্ড অ্যাভিন্যুতে এমনি একটা দোকান পেয়েছিল সে। মস্ত বড় একটা পুরোনো ট্রাঙ্কও কিনেছিল। ডেলিভারি দেওয়ার পর তারই নির্দেশমতো ট্রাঙ্কটা রাখা হল বাড়ির নীচের তলায়। সেই রাতেই সেকেন্ড অ্যাভিন্যুতে সাইমন ফেইনগোল্ডের ওষুধের দোকানে গেছিল পোডারজে। ইউরোপের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা চলে দুজনের মধ্যে। ফেইনগোল্ড একবার বলেছিলেন, এ অবস্থায় পোডারজের আত্মীয়স্বজনের জীবনের আশঙ্কা পদে পদে। শুনে হেসে উঠেছিল পোডারজে। তার বিশ্বাস জার্মানির হর্তাকর্তা হিসেবে আর বেশিদিন টিকে থাকতে হবে না হিটলারকে। দশ ডলার দামের দাড়ি কামানোর ব্লেড, মুখে মাখার ক্রিম, আর ঘুমের বড়ি কিনে ছিল ও। সমুদ্রযাত্রার জন্য নাকি এগুলো তার দরকার। নিউইয়র্ক স্টেট ল-র বিধান অনুসারে ঘুমের বড়ির ক্রেতা হিসেবে রেজিস্টারে সই দিয়ে গেছিল পোরজে।
দোকান থেকে সিধে ফ্ল্যাটে বউয়ের কাছে ফিরে আসে ও। এসে দেখে অ্যাগনেসকে জিনিসপত্র গুছোতে সাহায্য করছে পরিচারিকা ফ্লোরা মিলার। অনেক রাত হয়ে গেছিল। সারাদিন বড় খাটুনি গেছিল ফ্লোরার। তাই পোরজে ওকে তখনকার মতো ছুটি দেয় এবং বলে পরের দিনও তার ছুটি রইল আজকের অতিরিক্ত খাটুনির দরুন।
একটু পরেই দরজায় টোকা শোনা যায়। টোকা দিচ্ছিলেন ওষুধের দোকানের মালিক ফেইনগোল্ট। পোডারজের কাছ থেকে বিশ ডলারের বিল নিয়ে বাকি ডলার ফেরত দেওয়ার সময়ে তিনি দুটো ডলার বেশি দিয়ে ফেলেছেন। দরজাটা সামান্য ফাঁক করে ফেইনগোল্ডের কথা শুনেছিল পোডারজে। তারপর ফাঁক দিয়ে বাড়তি ডলার ঠেলে দিয়ে রেগেমেগে দড়াম করে বন্ধ করে দিয়েছিল দরজার পাল্লা।
পরের দিন অ্যাগনেসকে দেখা গেল না। সন্ধের আগে পর্যন্ত তার স্বামীরও পাত্তা পাওয়া গেল না। সন্ধের সময়ে বাড়ি ফিরে একতলা থেকে ট্রাঙ্কটা নিজে ঘরে নিয়ে যাওয়ার জন্যে লিফ্ট-এ তুলে দিলে সে। পরের দিন সকলে উঈসবাজার ট্রান্সপোর্ট কোম্পানিকে খবর দিলে ট্রাঙ্কটা নিয়ে যাওয়ার জন্যে। হোয়াইট স্টারের জাহাজ অলিম্পিকে ট্রাঙ্কটা তুলে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল পোডারজে। পোডারজের পরিকল্পনামতো বন্দোবস্তের কিছু কিছু একজন কেরানি জানত। ও তাকে বুঝিয়েছিল–আমার স্ত্রী আগেই রওনা হয়ে গেছে। ইংল্যান্ডেই তার সঙ্গে দেখা হবে আমার। ২২ ডিসেম্বর ফ্ল্যাটে ফিরে এসেছিল পরিচারিকা ফ্লোরা মিলার। তার জন্যেও একটা গল্প বানিয়ে রেখেছিল ক্যাপ্টেন। বলছিল–কয়েক দিনের জন্যে ফিলাডেলফিয়া গেছেন মাদাম।
রওনা না হওয়া পর্যন্ত ক্যাপ্টেনের টুকিটাকি কাজ করে দিলে ফ্লোরা। অলিম্পিকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে ঊঈসবার্জার কোম্পানি তার চারটে ট্রাঙ্ক আর অন্যান্য মালপত্র বুঝে নিতে এলে, পোডারজে কিন্তু তার ক্যাপ্টেন-সুলভ পদমর্যাদা আর সম্ভ্রান্ত ঘরের অভিজাত পুরুষের চালচলনটা পুরোপুরি বজায় রাখতে পারলে না। মালপত্র বওয়ার কাজে একরকম জোর করেই নিজেও হাত লাগালে। শুধু তাই নয়। ট্রাক ড্রাইভারের সঙ্গে জেটি পর্যন্ত গেল এক গাড়িতে মালপত্রের সঙ্গে, সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মালপত্র ঠিকমতো নামানো হচ্ছে কিনা, তার তদারকি করলে। এমনকী, যেভাবে তার হুকুম-মাফিক মাল নামানো উচিত, তা ঠিকমতো তামিল না হওয়ায় দু-চারবার তো অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজও করতে ছাড়লে ।
অর্ধেক মালপত্র নিয়ে যাওয়ার হল ডেকের নীচে। বাকি মাল, তার মধ্যে বিশাল ট্রাঙ্কটাও ছিল, রাখা হল পোডারজের কেবিনে। ওর সৌভাগ্যক্রমে কি দুর্ভাগ্যক্রমে তা জানি না, পোরজের বরাতে যে কেবিনটি জুটেছিল সেটি একদম নীচের ডেকের–জলরেখার ঠিক ওপরেই। ছোট্ট কিন্তু বেজায় আরামপ্রদ কেবিনটা। পোর্ট হোলের ভেতর দিয়ে কোনও কিছু সাগরের জলে ফেলে দেওয়াটাও মোটেই কঠিন কাজ নয়।
যাত্রা শুরু হওয়ার সময় ঘনিয়ে এলে নিজের কেবিনে সেঁধিয়ে পড়ল পোডারজে। সদ্যবিবাহিত হলেও তখন সে বধূহীন। অ্যাগনেসকে কেউই দেখেনি। সে কোথায় অথবা কি অবস্থায় আছে–তা কেউ জানত না। কিন্তু পোরজের দিব্বি হাসিখুশি মেজাজে এতটুকু বৈলক্ষণ্য দেখা গেল না। বেয়ারা ধরনের কোনও প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হল না তাকে।
ছদিনের যাত্রায় কিছু চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটল না। কেবিন ছেড়ে একেবারেই বাইরে বেরোয়নি পোডারজে। তাতে অবশ্য আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। বহু প্যাসেঞ্জারই তার মতো কেবিন ছেড়ে বাইরে আসা পছন্দ করেনি সমুদ্র-পীড়ার ভয়ে।
অলিম্পিকের স্টুয়ার্ডের সঙ্গে অনেক কথা হল আমার। আমার আগেই অবশ্য নিউইয়র্ক পুলিশও তাকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করে গেছিল।
আমার প্রশ্নের উত্তরে সে বললে–ক্যাপ্টেন পোডারজে মানুষটি ভারি চমৎকার। অল্প কথা বলার স্বভাব তাঁর একেবারেই নেই। সারবিয়ান চাষা আর তাদের খাসা খানা সম্বন্ধে কথা বলতে দারুণ ভালোবাসতেন তিনি। আমার মনে হয় ইউরোপের জন্যে তার প্রাণ কেঁদেছিল বলেই ফিরে চলেছিলেন উনি। একবার কথায় কথায় আমাকে বলেছিলেন–আমেরিকা আমার জন্যে নয়। বেজায় বড় এই দেশটা। আর, এখানকার প্রতিটি লোক দিনরাত হন্যে হয়ে ছুটছে টাকার পেছনে। যে দেশে জীবনে এত সংঘাতময়, সে দেশের তোয়াক্কা করি না আমি।
স্টুয়ার্ডের কাছে পোরজে গল্প করেছিল সে নাকি একটা নতুন ধরনের সিন্দুক বিক্রি করতে এসেছিল আমেরিকায়। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে তার প্রচেষ্টা।
জিগ্যেস করেছিলাম–ট্রাঙ্কটা তাঁকে কি কোনওদিন খুলতে দেখেছেন?
ইয়েস, স্যার, হামেশাই দেখেছি। একবার ভেতর থেকে একটা নেকটাই বার করে আবার ভেতরে রেখে দিয়েছিলেন উনি।
কেবিনের মধ্যে কোনও বিটকেল গন্ধ পেয়েছিলেন কি?
না স্যার, ও ধরনের কোনও গন্ধ তো ছিল না!
পরে আমি জেনেছিলাম ক্যাপ্টেনের জন্যে আরও একজন অপেক্ষা করেছিল ইংল্যান্ডে। নাম তার মার্গারিট সুজান বাট্রান্ড পোডারজে–তার আইন-সম্মত বউ। মার্গারিটের সঙ্গে বিয়ে হয় ১৯৩৩ সালের মার্চ মাসে। শুধু তিনজন নারীকেই সারা জীবনে বিয়ে করেছিল পোডারজে–অ্যাগনেস ছিল এই তিনজনেরই একজন। এ ছাড়াও তার হবু-পত্নীর সংখ্যা বড় কম ছিল না।
যুগোশ্লাভের রেকর্ড ঘেঁটে আমি জেনেছিলাম, বেলগ্রেডের একটি মহিলাকেও বিয়ে করেছিল পোরজে। প্রচুর অর্থ পকেটস্থ করে রাতারাতি মেয়েটাকে পথে বসিয়ে যায় সে।
পোডারজের সঙ্গে বিচ্ছেদজনিত বিরহবেদনা এতটুকু স্পর্শ করেনি মার্গারিটকে। অন্তত বাইরে থেকে দেখে তো তাই মনে হয়েছিল। দুজনের স্বচ্ছলভাবে চলে যাওয়ার উপযুক্ত টাকা না আনা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বিন্দুমাত্র আপত্তি ছিল না তার। কাড়ি কাড়ি টাকা দরকার তার এবং তা যেনতেন-প্রকারেণ পেলেই হল। স্বামীকে লেখা তার একটা চিঠি পরে পেয়েছিলাম। নিউইয়র্কে ক্যাপ্টেনকে লেখা এই চিঠিটায় সে লিখেছিল ।
কীভাবে তুমি টাকা রোজগার করে এনে দাও আমাকে। এন্তার টাকা জমিয়ে যাও–যে-কোনও পন্থায় প্রচুর টাকা রোজগার করে এনে দাও আমাকে। সে টাকা কীভাবে আসছে, তা নিয়ে আমার মাথা ঘামানোর দরকার নেই। যে চালে আমরা চলতে চাই, সে চালে চলার মতো যথেষ্ট অর্থ পেলেই আমার হল।
লন্ডনে পোডারজে এসে পৌঁছেলে স্বমূর্তি ধারণ করলো মার্গারিট। অ্যাগনেসের জড়োয়া গয়নাগুলো নতুন ডিজাইনে বানিয়ে নেওয়া হল। পোশাকগুলোও নতুন করে কেটে সেলাই করা হল মার্গারেটের গায়ের মাপে। নিপাত্তা মহিলার ২৫০০০ ডলারেরও আর কোনও সন্ধান পাওয়া গেল না।
অ্যাগনেসের আত্মীয়স্বজনরা জানত স্বামীর সঙ্গেই ২০ ডিসেম্বর হামবুর্গ রওনা হয়েছে অ্যাগনেস। কয়েক হপ্তা পরে লন্ডন থেকে মনট্রিয়লে স্যালি টাফভারসনের কাছে একটা টেলিগ্রাম এসে পৌঁছোল?
এখানকার আবহাওয়া ভালো লাগছে না। ভারতবর্ষের দিকে চলেছি। পরে চিঠি লিখব। অ্যাগনেস।
তিন মাস পরে ১৯৩৪ সালের এপ্রিলের শেষাশেষি ভারতবর্ষ বা পৃথিবীর কোনও দেশ থেকে কোনও খবর এসে পৌঁছোল না পরিবারবর্গের কাছে। মহা চিন্তায় পড়লেন স্যালি টাফভারসন। না ভেবেচিন্তে তো কোনও কাজ করার অভ্যেস নেই অ্যাগনেসের। বুদ্ধি বিবেচনাও ওর প্রচুর। বোনেদের মধ্যে বয়েসে সবচেয়ে বড় বলে স্যালির সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতাটা একটু বেশি। আর তাই এরকম চুপচাপ থাকাটা তো অ্যাগনেসের পক্ষে শোভা পায় না।
নিউইয়র্কে এসে পৌঁছোলেন স্যালি টাফভারসন। দেখা করলেন নিরুদ্দেশ ব্যক্তিদের পুলিশ ব্যুরোর প্রধান ক্যাপ্টেন জন জে আয়ারস-এর সঙ্গে।
নেহাতই ছেলেমানুষি বলে মনে হয় তাই নয়? দেহ-মনে পরিপূর্ণতা লাভ করেছে যে মেয়েটি, আইনবি হিসেবেও সুনাম কিনেছে যে, সে কিনা হঠ করে বিয়ে করে বসল একজন বিদেশিকে এবং তার পরেই পা বাড়াল দেশের বাইরে। সে যাই হোক, কিন্তু এই চুপচাপ থাকাটাই যে বেজায় ভাবিয়ে তুলেছে আমায়। তিন মাস একটা খবর নেই, অদ্ভুত নয় কি? ওদেরকে খুঁজে বার করার কোনও উপায় কি নেই? ক্যাপ্টেন আয়ারকে শুধিয়েছিলেন স্যালি।
এই সাক্ষাৎকারের ফলেই বেলগ্রেডে একটা টেলিগ্রাম এসে পৌঁছোল আমাদের দপ্তরে। আইডান পোরজের কুলজি জানাতে হবে। টেলিগ্রাম পেয়েই পোডারজের ক্রিমিন্যাল রেকর্ডের খুঁটিনাটি পাঠিয়ে দিলাম আমরা। সেই সঙ্গে প্রস্তাব করলাম তদন্তে সাহায্য করার জন্যে এখান থেকে কাউকে পাঠালে ভালো হয় না কি? দীর্ঘদিন ধরে যার সন্ধানে আমরা ঘুরছি, তাকে তো আমাদেরও গ্রেপ্তার করা চাই।
আর, এইভাবেই শুরু হল একটি মানুষের পেছনে দীর্ঘদিন ধরে যাওয়ার পালা। গেলাম নিউইয়র্কে। গেলাম পৃথিবীর আরও অনেক দেশে। দেশে দেশে ঘুরেছি একটি মাত্র লক্ষ্যকে সামনে রেখে, যেভাবেই হোক জালে ফেলতে হবে পোডারজেকে। কিন্তু খুবই অল্প সংখ্যায় আসতে লাগল সূত্রগুলো। তারপর নিউইয়র্ক ত্যাগ করার সময় ঘনিয়ে এল রওনা হলাম ফ্রান্স অভিমুখে। প্যারীতে পৌঁছে গেলাম ইন্টারপোল-এর (ইন্টারন্যাশনাল পুলিশ অরগ্যানাইজেশন) অফিসে। সঙ্গে সঙ্গে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বেরিয়ে গেল ছদ্ম ক্যাপ্টেনের নামে।
কিন্তু অত্যন্ত তুখোর আর সাপের মতোই পিচ্ছিল সে। শেষকালে একটা খবর পেলাম। ভিয়েনায় মিস্টার এবং মিসেস পোডারজে নামে এক দম্পতিকে দেখা গেছে। প্রেমবুভুক্ষু হতভাগিনী মরণ-ফঁদে পা দিয়েছিল এই ভিয়েনা শহরেই। আর জানা গেল, ক্যাপ্টেন আর তার স্ত্রী নাকি বেজায় ফুর্তিতে আছে। শহরের প্রান্তে বহাল তবিয়তেই দিন কাটছে দুজনের। হামেশাই দেখা যাচ্ছে দুটিকে।
ভিয়েনা শহরটা বরাবরই ভালো লাগে আমার। তাই এ শহরে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে খুশিই হলাম। শহরে পৌঁছোনোর পর দেখলাম মিসেস পোডারজে মেয়েটি অ্যাগনেস নয়, মার্গারিট–ধুরন্ধর শিরোমণির আসল বউ। এ তথ্য আবিষ্কার করার পর কিন্তু মোটেই অবাক হইনি আমি।
দুপাশে দুজন অস্ট্রিয়ান গোয়েন্দাকে নিয়ে দেখা করলাম পোডারজের সঙ্গে। ভয় পাওয়া তো দূরের কথা, ঘাবড়ে গিয়ে আমতা আমতা করার কোনও লক্ষণই দেখলাম না তার কথাবার্তায়।
মোলায়েম স্বরে আমার প্রশ্নের উত্তরে ও বললে–অ্যাগনেস টাফভারসানকে চিনি বইকি। ভারি চমৎকার মহিলা। তাঁর কিছু উপকার করতে পেরে আমি নিজেও আনন্দ পেয়েছিলাম। লন্ডনে থাকার সময়ে তাঁর জন্যে কিছু টাকাও খরচ করেছিলাম।
বিয়ে করেননি অ্যাগনেসকে? প্রশ্নটা করলাম ফরাসি ভাষায় যাতে মার্গারেটের বুঝতে অসুবিধা না হয়।
মার্গারিটের মুখচ্ছবি দেখে স্পষ্ট বুঝলাম বিয়ে সম্পর্কে বিন্দুবিসর্গ খবর রাখে না সে। ভাবলাম দেখা যাক নিজের পাতা ফাঁদ থেকে কী করে এবার বেরোয় বাছাধন।
মিস টাফভারসনকে বিয়ে? হাসালেন যা হোক। তাঁকে যে ভালো করে চিনিই না আমি। নিউইয়র্কে বিয়ে করেছিলাম? না, না, যত সব গাঁজাখুরি গল্প শুরু করেছেন দেখছি। গ্রীষ্মের অবকাশে প্যারী গিয়ে তাঁর সঙ্গে কয়েকটা দিন বেশ আনন্দেই কেটেছিল। এখন তিনি ভারতবর্ষে রয়েছেন। এছাড়া তাঁর সম্বন্ধে আর কোনও খবরই রাখি না আমি। তাঁর সঙ্গে কেউ আছে কি, তিনি একাই দেশভ্রমণ করছেন–অত খবর আমি রাখি না।
খুব ভদ্রভাবে পোডারজেকে ধন্যবাদ জানালাম এতগুলো খবরাখবর সরবরাহ করার জন্যে। তারপর বিদায় নিলাম–এবং তাও একটা বিশেষ কারণেই। আমাদের মতলব ছিল যথেষ্ট দড়ি ছেড়ে ওকে খেলানো, তারপর এক মোক্ষম প্যাঁচে ফাঁসানো। এ ছাড়াও ওদের বিয়ের সার্টিফিকেটের একটা কপি অথবা অন্য কোনও দলিল হাতে আনতে চেয়েছিলাম আমি। এ দলিল আনতে হবে নিউইয়র্কের মিনিস্টারের কাছ থেকে এবং একটি জিনিস দিয়েই তর্কাতীতভাবে প্রমাণ করে দেওয়া যাবে যে নিউইয়র্কের লিটুল চার্চ অ্যারাউন্ড দ্য কর্নার-এ বিয়ে হয়েছিল তাদের।
দিন কয়েক পরেই ফিরে এলাম পোডারজের আস্তানায়। নিউইয়র্কের পুলিশ আর মিনিস্টারের পাঠানো টেলিগ্রামগুলো আমার হাতেই ছিল। ক্যাপ্টেন আর তার বউকে দলিলগুলো দেখালাম।
ফ্যাকাশে হয়ে গেল মার্গারিট। মিসেসের মুখ দেখে অনুনয়ের সুরে গোরজে বলে উঠল–এতে কি আসে যায়, মার্গারিট? তুমি তো সবই জানো। আমেরিকায় মেয়েগুলো এমনই নির্লজ্জ বেহায়া যে ওকে বিয়ে না করে পারিনি আমি। সাময়িক শান্তিলাভের জন্যেই বিয়েটা হয়েছিল। আমি যে বিবাহিত, সে তা জানত। কাজেই আমার আর কোনও উপায় ছিল না। ডার্লিং তুমি বিশ্বাস করো–
কিন্তু কেউই বিশ্বাস করতে পারল না ওকে। মার্গারিট তো নয়ই আমিও না।
এরপর কিন্তু আমাদের কাছে সে সবকিছুই অস্বীকার করে বসল এমন কি বিয়েটাও।
২০শে ডিসেম্বর জাহাজে ওঠার জন্যে আমরা প্রস্তুত। এমন সময়ে জেটির ওপরেই ঝগড়া হয়ে গেল ওর সঙ্গে। রক্ষিতা স্ত্রী হিসেবে আমার সঙ্গে সাগর পাড়ি দিতে চাইল না অ্যাগনেস। চাপ দিতে লাগল আনুষ্ঠানিক বিয়ের জন্যে। কিন্তু আমার পক্ষে তা সম্ভব ছিল না। কাজেই আমার সঙ্গ ত্যাগ করে চলে গেল ও। প্রথমে বলেছিল, সেই রাতেই একলা সাগর পাড়ি দেবে সে। কিন্তু ফ্ল্যাটে ফিরে আসার পরেই মনট্রিয়াল অভিমুখে রওনা হয়ে যায় সে। কথা দিয়ে গেছিল ফোন করবে। কিন্তু তা করেনি। কথা দিয়ে গেছিল লন্ডনে আমার সঙ্গে তার দেখা হবে। কিন্তু এ প্রতিশ্রুতিও সে রাখেনি। জেটির ওপর সেই ঝগড়াঝাটির পর থেকে আজ পর্যন্ত তার ছায়াটুকুও দেখিনি আমি।
জোর গলায় পোডারজে বলতে লাগল, তার এই বিয়ের ব্যাপারটা নাকি ডাহা মিথ্যে আর সাজানো ব্যাপার। ধাক্কা দিয়ে তাকে যুগোশ্লাভিয়ার মাটিতে টেনে নিয়ে যাওয়ার জঘন্য চক্রান্ত। আরও বললে–অস্ট্রিয়ায় আমি রাজনৈতিক আশ্রয়ের সুযোগ সুবিধে পাচ্ছি। বেলগ্রেডের উদ্বাস্তু আমি। কাজেই স্বদেশের মাটিতে আইনের মারপ্যাঁচ দেখিয়ে আমাকে টেনে নিয়ে যাওয়া চলবে না।
খানাতল্লাসি হল ওর বাড়িতে। কিন্তু কোনওরকম টেনেটুনে দোষারোপ করার মতো আবছা কোনও প্রমাণের চিহ্নও পেলাম না সেখানে। নিউইয়র্কেও ঘটল সেই কাণ্ড। অ্যাগনেস-নিধন (যদিও তা নিছক সন্দেহ) আর তদন্তের শুরু–এই দুইয়ের মাঝে রয়েছে বিপুল সময়ের ব্যবধান। অলিম্পিকের কেবিনটাও পরীক্ষা করা হল। কিন্তু ফলাফল হল সেই একই। পোডারজে সেখানে কয়েক রাত থাকার পর অসংখ্যবার ধোয়া মোছা হয়ে গেছে সে কেবিন। কাজেই সূত্র-টুর আর কোনও বালাই ছিল না সেখানে।
যতদূর জানা গেল, অ্যাগনেস টাফভারসনের অন্তর্ধান রহস্যের তিমিরে আলোকপাত করার মতো একটি সূত্রেরও আর অস্তিত্ব ছিল না এই দীর্ঘ কটি মাস পরে। এ রহস্যের উত্তর যে পোডারজে জানে, সে বিষয়েও আমাদের মনে তিলমাত্র সন্দেহ ছিল না। কিন্তু সে-যে তাকে খুন করেছে, তা প্রমাণ করা কোনওমতেই সম্ভব ছিল না আমাদের পক্ষে। আদালতে এ কেস উঠলেই সাক্ষ্য প্রমাণাদির দরকার হবে–নিছক অনুমান নিয়ে তো কাউকে ফাঁসিকাঠে লটকানো যায় না। সন্দেহের বশে কাউকে খুনি সাব্যস্ত করা যায় না–সে সন্দেহ যতই জোরালো আর ভয়ঙ্কর হোক না কেন। কাজেই পোরজের গায়ে আঁচড় কাটার ক্ষমতাও আমাদের রইল না।
ভিয়েনাতেও পোডারজেকে গ্রেপ্তার করা গেল না। তার কারণ, যতদূর জানা গেছিল, অস্ট্রিয়ায় কোনও বেআইনি কাজ ও করেনি। বিদেশ থেকে স্বদেশের মাটিতে তাকে আনার আয়োজন করা মানেই একটা বিলক্ষণ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। আর সে সময়ে ও রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করলেই তো আমরা নিরুপায়।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে ভিয়েনায় বসে আলোচনা চলল আমাদের মধ্যে। আলোচনার বিষয় একমেবাদ্বিতীয় এবং তা হল, লাশটাকে ও সরিয়েছে কি উপায়ে। থিওরির অভাব ছিল না। কিন্তু আইনের ঠেকা দিয়ে কোনওটিকেই খাড়া করা যাচ্ছিল না।
সম্ভবত নিউইয়র্কের ফ্ল্যাটে–অ্যাগনেসের লাশ টুকরো টুকরো করে কাটার পর বাড়ির চুল্লিতে ফেলে তা ছাই করে ফেলা হয়েছে। লাশ উধাও করার এইটাই কিন্তু সবচেয়ে সহজ উপায়। আর সম্ভাব্য থিওরি হল। পোড়ারজে হয়তো মারাত্মক ডোজের ঘুমের বড়ি খাইয়ে দিয়েছিল অ্যাগনেসকে। তারপর ওর আস্ত দেহটাকে অথবা টুকরো টুকরো দেহটাকে ট্রাঙ্কের মধ্যে ঠেসে নিয়ে গেছিল অলিম্পিকের কেবিনে। সাধারণত ফার্স্ট ক্লাসেই সাগর পাড়ি দিত ক্যাপ্টেন কিন্তু অলিম্পিকে সি ডেকের কেবিন নিতে গেল কেন সে? দশ ডলার দামের দাড়ি কামানোর ব্লেড, ঘুমের বড়ি আর মুখে মাখার ক্রিমই বা কিনল কেন?
আমার মতে লাশটাকে পাচার করার সবচেয়ে ভালো পন্থা যা তা হল এই : টুকরো টুকরো করে লাশটাকে ও কেটেছিল। তারপর আটলান্টিক মহাসাগর পেরনোর সময়ে এক একটা টুকরো ও ছুঁড়ে দিয়েছে জলের মধ্যে। অর্থাৎ সারা জনপথটায় সমানে ভোজ দিয়েছে মাংসভুক মাছেদের। ভিয়েনায় পোরজে কতখানি নিরাপদে রয়েছে তা ওর অজানা নয়। অস্ট্রিয়ার কর্তৃপক্ষকে ও জানাল, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ওকে যুগোশ্লাভিয়ায় নিয়ে যাওয়ার জন্যেই সাজানো হয়েছে টাফভারসন কেসটা এবং সমস্ত ব্যাপারটা একটা বিরাট ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই নয়। আরও একটু জুড়ে দিলে সেই সঙ্গে–সে নাকি রাজতন্ত্রের শাসন-বিরোধী। কিন্তু ইটালি আর জার্মানির ডিকটেটরশিপ শাসনব্যবস্থায় তার পূর্ণ সমর্থন আছে। আর তাই…।
অস্ট্রিয়ানদের দর্শনবাদ হল নিজে বাঁচো এবং অপরকে বাঁচতে দাও। এই ধরনের জীবনদর্শনের ওপরে ওদের শ্রদ্ধা ছিল যথেষ্ট। তাই পোডারজের ব্যাপারে নাক গলাতে চাইল না ওরা। বিশেষ করে সে যখন প্রতিশ্রুতি দিলে সে ইটালি চলে যাবে, তখন এ নিয়ে তারা আর মাথা ঘামাতে চাইল না।
এই পরিস্থিতিতে আমি ভেবে দেখলাম মাত্র একটি পন্থায় মুঠোর মধ্যে আনা যায় পোডারজেকে। আমেরিকান গভর্নমেন্টকে চাপ দিতে হবে, তারাই যেন পোডারজেকে বিদেশ থেকে স্বদেশে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে। আমার লোকের হাতে রিপোর্ট পাঠালাম ওয়াশিংটনে। অ্যাগনেস টাফভারসন আমেরিকান মহিলা। তাকে ঘিরে যে রহস্য গড়ে উঠেছে, তা তো আর উপেক্ষা করা যায় না। পোডারজেকে জোর করে নিউইয়র্কে ফিরিয়ে আনতে গেলে যে কলাকৌশলের প্রয়োজন, তা পাওয়া গেল নিউইয়র্কের এফ বি আই (ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) এবং ইমিগ্রেশন ডিপার্টমেন্ট থেকে। ১৯৩৩ সালে আমেরিকান মাটিতে পা দিয়ে একটা ফর্মের ওপর, ক্যাপ্টেন লিখেছিল, সে নাকি অবিবাহিত। আমেরিকায় পা দেওয়ার অনুমতি লাভ করতে গেলে এ ফর্মে সবাইকেই সই করতে হয়। কিন্তু মার্গারিটের সঙ্গে তার আগেই বিয়ে হয়েছিল। দরখাস্তে লেখা প্রতিটি কথাই যে সত্য সে বিষয়ে শপথ করার পরেই আমেরিকায় প্রবেশাধিকার পেয়ে ছিল সে। কাজেই, মিথ্যা শপথের দায়ে আইনের রক্তচক্ষু এবার এসে পড়ল তার ওপরে।
১৯৩৪ সালের দোসরা আগস্ট–মিথ্যা শপথের অভিযোগে পোডারজেকে অভিযুক্ত করল নিউইয়র্ক গ্র্যান্ড জুরি এবং রায় দিল তাকে স্বদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হোক। ফলে, পোডারজেকে আনা হল ভিয়েনার এক আদালতে। কিন্তু বাচ্চাতুরিতে ওস্তাদ পোডারজে সেখানে কোমল হৃদয় জুরিদের মন ভিজিয়ে দিলে এই বলে যে, স্রেফ ষড়যন্ত্র করে তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আমেরিকায়। আমেরিকা থেকে তাকে পাঠানো হবে যুগোশ্লাভিয়ায় এবং দেশদ্রোহীতার অপরাধে গুলি চালিয়ে খতম করে দেওয়া হবে তাকে। শুনে সমবেদনায় ভরে উঠল জুরিদের অন্তর। ওকে আমেরিকা পাঠাতে রাজি হল না তারা।
আরও কতকগুলো টেলিগ্রাম আসা-যাওয়া করল বেলগ্রেড আর নিউইয়র্কের মধ্যে। শেষ পর্যন্ত দুটো বিবাহের অভিযোগ আনল নিউইয়র্ক পুলিশ পোডারজের বিরুদ্ধে। এবার আর বেঁকে বসল না অস্ট্রিয়ান কোর্ট। হুকুম বেরিয়ে গেল পোডারজেকে স্বদেশে পাঠিয়ে দেওয়ার।
এ কাহিনি প্রথমেই বলেছি আমি, পোডারজে-তদন্ত আমার কর্মজীবনের প্রথম কে। যদিও এর চাইতে কঠোর পরিশ্রম আর কোনও তরুণ গোয়েন্দা ইতিপূর্বে কখনও করেনি, তবুও সেদিন আমার শিকারকে সামান্যের ওপর দিয়ে বেরিয়ে যেতে দেখে শুকনো হাসি ছাড়া আর কোনও ভাবই ফোটেনি আমার চোখে-মুখে। যে-কোনও খুনির পক্ষে ওই শাস্তি সত্যিই লঘু–অত্যন্ত লঘু। আমি ভিয়েনা ছেড়ে চলে আসার সময়ে তখনও ও ওখানকার কারাগারেই ছিল। বেশ একটু মুষড়ে গিয়ে রওনা হলাম বেলগ্রেডের দিকে। যে দায়িত্ব আমাকে দেওয়া হয়েছিল–যতদূর সম্ভব আমি তা পালন করেছি। আর কিছুই করণীয় ছিল না আমার।
নিউইয়র্কে নিয়ে যাওয়া হল পোডারজেকে। পরে শুনেছিলাম, এই ধরনের সামান্য অভিযোগের সম্মুখীন হয়ে বিন্দুমাত্র বিচলিত হয়নি ও। ঠোঁটের কোণে চিরকেলে মিষ্টি হাসিটি ঝুলিয়ে দিব্বি হাসিখুশি মেজাজ নিয়ে নিউইয়র্কে পৌঁছোয় ও। তার পরেই একটা টেলিগ্রাম পাঠায় মার্গারিটকে–এবার একটা অলৌকিক কাণ্ড ঘটবে।
১৯৩৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দুই বিবাহের অভিযোগ আনা হল তার বিরুদ্ধে। অভিযোগ স্বীকার করে নিলে সে। তবে নিজের অপরাধ লঘু করার প্রচেষ্টায় শুধু এইটুকুই সে বলছিল–অ্যাগনেস টাফভারসনই নাকি বিয়ের জন্যে পীড়াপীড়ি করেছিল তাকে। এ জাতীয় অপরাধে সবচেয়ে গুরুদণ্ড যা, অর্থাৎ আড়াই থেকে পাঁচ বছর শ্রীঘর বাস, পোরজের ক্ষেত্রে তারই বিধান দেওয়া হল। অবার্ন কারাগারে শুরু হল তার শাস্তির মেয়াদ। অন্যান্য কয়েদিদের সঙ্গে মোটামুটি মানিয়ে নিয়েছিল ও। তবে একজন ওকে দু-চক্ষে দেখতে পারত না। একদিন দারুণ মারপিট হয়ে গেল দুজনের মধ্যে। ওয়ার্ডাররা এসে পৌঁছোনোর আগেই একটা চোখ আর আটটা দাঁত হারাল পোডারজে।
উনিশ মাস কারাগার বাসের পর একটা লম্বা চিঠি লিখল ও ক্যাপ্টেন স্টাইনকে। ক্যাপ্টেন স্টাইন সে সময়ে নিরুদ্দেশ ব্যক্তিদের ব্যুরোতে ছিলেন। পোডারজে লিখল, খালাস পাওয়ার পর কর্তৃপক্ষ যদি তাকে ইউরোপে ফিরিয়ে না দেয়, তাহলে অ্যাগনেস টাফভারসনকে জীবন্ত ফিরিয়ে এনে দেবে সে। এ প্রস্তাবের কোনও উত্তর তার কাছে পাঠানো হয়নি। কারণটা খুবই সোজা। বহুদিন আগেই যে পরলোকের পথে যাত্রা করেছে অ্যাগনেস, এ বিষয়ে দৃঢ়বিশ্বাস জন্মে গেছিল কর্তৃপক্ষর। অ্যাগনেসের পরিবারবর্গের মনেও তার মৃত্যু সম্বন্ধে আর কোনও সন্দেহ ছিল না। আটলান্টিকের জলেই স্থান পেয়েছে হতভাগিনীর দেহ।
১৯৪০ সালের পয়সা ফেব্রুয়ারি জেলের বাইরে এসে দাঁড়াল পোডারজে। এতদিন পাথর ভেঙেও কিন্তু এতটুকু চিড় ধরেনি ওর গ্র্যানাইট কঠিন আত্মবিশ্বাসে। নষ্ট চোখের জায়গায় একটা কৃত্রিম চোখ বসিয়ে নিয়েছিল। মনোক্স দিয়ে সযত্নে নকল চোখটা ঢেকে রাখত। পরে ওকে যুগোশ্লাভিয়ায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। নাৎসিরা যুগোশ্লাভিয়া আক্রমণ করলে যুদ্ধের বন্যায় সে-ও গা ভাসিয়ে দেয়। তারপর অনেক বছর অতীত হয়েছে। আর তার কোনও খবর পাওয়া যায়নি। যদি সে মারাই গিয়ে থাকে তাহলে অ্যাগনেস টাফভারসনের শেষ কয়েক ঘণ্টার রহস্যের মৃত্যু ঘটেছে সেইসঙ্গে…। * জোসেফ জাগেব্রোভি (যুগোশ্লাভিয়া)–রচিত কাহিনি অবলম্বনে।