ব্রজলাট
একটি পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়সের যুবক কলিকাতার কোনও বিখ্যাত মাসিক পত্র ও পুস্তক প্রকাশকের বৃহৎ দোকান হইতে বাহির হইয়া ফুটপাথে আসিয়া দাঁড়াইল।
ফাগুন মাসের অপরাহ্ন তখন ঘোলাটে হইয়া আসিতেছে, বেলা প্রায় সাড়ে পাঁচটা। যুবক ফুটপাথে দাঁড়াইয়া একটু ইতস্তত করিল, এদিক-ওদিক চাহিতে চাহিতে অদূরে একটা রেস্তোরাঁ তাহার চোখে পড়িল। অধর দংশন করিতে করিতে সে হেঁটমুখে কি ভাবিল, তারপর সংযত পদে যেন অন্যমনস্কভাবে হাতের ছড়িটা ঘুরাইতে ঘুরাইতে সেই দিকে অগ্রসর হইল।
যুবকের বেশভূষা দেখিয়া তাহাকে শৌখিন বাবু বলিয়া বোধ হয়। গায়ে ধোপদস্ত সিল্কের পাঞ্জাবি, পরিধানে দিশী ধুতি। একটা কোঁচানো চাদর বগলের নীচে দিয়া বাঁ কাঁধের উপর ফেলা রহিয়াছে। তৈলহীন ঈষৎ রুক্ষ চুল সযত্নে কপাল হইতে পিছন দিকে বুরুশ করা। পায়ে পেটেন্ট চামড়ার পাম্পসু। যুবকের মুখ বেশ সুশ্রী, একটুখানি পাতলা গোঁফ আছে। দেহ ছিপছিপে হইলেও সুগঠিত। কিন্তু ভাল করিয়া লক্ষ্য করিলে তাহার মুখে একটা অস্বাভাবিক পাণ্ডুরতা ও শীৰ্ণভাব লক্ষিত হয়। কপালে ও চোখের কোলে চুলের মত সূক্ষ্ম রেখা পড়িতে আরম্ভ করিয়াছে। যাহারা অসংযত ঘূর্তির তাগিদে দেহের উপর অতিরিক্ত অত্যাচার করে তাহাদের চোখে মুখে এইরূপ শ্রান্তির লক্ষণ প্রায়ই চিহ্নিত থাকিতে দেখা যায়।
যুবক অলস মন্থর পদে প্রায় রেস্তোরাঁর দ্বারের কাছে পৌঁছিয়াছে এমন সময় পিছন হইতে কে বলিল, ‘কি হে ব্রজলাট, কোথায় চলেছ?’
যুবক ফিরিয়া দেখিল—হিরণ। হিরণ পুঁটিমাছ শ্রেণীর একজন সাহিত্যিক; বেশভূষা নিদারুণ দৈন্যের পরিচায়ক। গায়ের কামিজটা অত্যন্ত ময়লা, একটিও বোতাম নাই; চটিজুতার পশ্চাদ্ভাগ এতই ক্ষয়গ্রস্ত হইয়াছে যে পায়ের গোড়ালি ফুটপাথ স্পর্শ করিতেছে। তাহারও বয়স পঁচিশ-ছাব্বিশ, মুখে একটা অতৃপ্ত অসন্তোষপূর্ণ বিদ্রোহের ভাব।
যুবকের পায়ের পাম্পসু হইতে মাথায় চুল পর্যন্ত নিরীক্ষণ করিয়া হিরণ বলিল, ‘কি বাবা, তরুণী মৃগয়ায় বেরিয়েছ? আজ শিকার কোনদিকে হে ব্রজলাট?’
ব্ৰজেন মুখ টিপিয়া হাসিল, বলিল, ‘তুমি কোন দিকে?’ হিরণ হাসিয়া বলিল, ‘মোল্লার দৌড় মসজিদ—আর কোনদিকে? বীরেনের আড্ডায় যাচ্ছি। যাবে নাকি?—না এনগেজমেন্ট আছে?’
দু’জনে পাশাপাশি চলিতে আরম্ভ করিল।
বীরেনের আড্ডা ক্ষুদ্র সাহিত্যিকদের একটা স্থায়ী মজলিশ। এখানে মা সরস্বতীর সঙ্গে মা লক্ষ্মীর চিরন্তন বিবাদের কথা বেশ খোলাখুলিভাবে আলোচনা হইত, ঢাক ঢাক গুড় গুড় ছিল না; এবং বীরেনের খরচে চা সিগারেট পান ধ্বংস করাই যে এ সভার মূল উদ্দেশ্য একথাও কেহ গোপন করিত না। বীরেন তাহা জানিত কিন্তু সেজন্য তাহার আতিথেয়তা কোনদিন সঙ্কুচিত হয় নাই। সে নিজে ঠিক সাহিত্যিক না হইলেও সাহিত্যের একজন পাণ্ডা ও সমজদার ছিল।
চলিতে চলিতে ব্ৰজেন হিরণের দিকে একটা বক্রদৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া বলিল, ‘হিরণ, তোমার কামিজটা ধোপার বাড়ি দেওয়া দরকার বলে কি এখনো মনে হচ্ছে না?’
হিরণ নিজের দিকে একবার দৃষ্টি নামাইয়া বলিল, ‘হচ্ছে। কিন্তু দেওয়া ঘটে ওঠেনি। কারণ কি জানো?—অর্থাভাব! কথাটার মানে তুমি বোধ হয় বুঝতে পারবে না, কিন্তু ওটা পৃথিবীতে আছে। ধোপা আমার অনেক কাপড় বিনা পয়সায় কাচবার পর এবার জবাব দিয়েছে; নগদ পয়সা না পেলে আর কামিজ কাচবে না। —কল্পনা করতে পার?’ বলিয়া ব্যঙ্গপূর্ণ চক্ষে ব্ৰজেনের দিকে চাহিল।
ব্ৰজেন মুখ না ফিরাইয়াই বলিল, ‘পারি। কিন্তু সে দোষ কি ধোপার?’
‘না—আমার, কিংবা আমার বাবার; তিনি আমার জন্যে যথেষ্ট টাকা রেখে যেতে পারেননি। চাকরিও করি না—আমি সাহিত্যিক। যদি কেরানী হতুম তাহলে বোধ হয় ফর্সা জামাকাপড় পরতে পেতুম। কিন্তু এতে আমার লজ্জা নেই ব্রজলাট—লজ্জা বরং তোমার।’
ভ্ৰু তুলিয়া ব্ৰজেন বলিল, ‘কিসে?’
‘তুমি বাপের পয়সায় বাবুয়ানি করছ, আর যে তা পারে না তাকে বিদ্রুপ করছ। নিজের প্রতিভার জোরে টাকা রোজগার করে আমার মতো ফাতুস সাহিত্যিককে যদি ব্যঙ্গ করতে তাহলেও একটা কথা ছিল। কিন্তু সে প্রবৃত্তি তখন তোমার হত না।’
ব্রজেন বিরসকণ্ঠে বলিল, ‘ব্যঙ্গ বিদ্রুপ কিছুই আমি করিনি। কিন্তু আমাদের—সাহিত্যিকদের—একটু আত্মসম্মান জ্ঞান থাকা দরকার।’
হিরণ রাস্তার উপরেই ফিরিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, “তুমি মনে কর তোমার চেয়ে আমার আত্মসম্মান জ্ঞান কম? ওটা তোমার ভুল। তুমি যাকে আত্মসম্মান মনে করেছ সেটা বস্তুত তোমার আর্থিক সচ্ছলতার অভিমান।’
হিরণ আবার চলিতে আরম্ভ করিল, ‘কিন্তু তুমি বুঝবে না ব্রজলাট। তুমি শৌখিন গল্প লেখ, ফুরফুরে কবিতা লেখ—ফোঁপরা ফুকো জিনিস নিয়ে তোমার কারবার। ক্ষুধিতের মুখ যেখানে অন্নের দিকে চেয়ে হাঁ করে আছে, অভাব যেখানে মানুষের চরিত্র থেকে মনুষ্যত্বের লক্ষণ মুছে ফেলেছে—আমরা গরিব সাহিত্যিক সেই দিকটাই বেশী করে বুঝি। তাই ছেঁড়া কামিজে আমাদের আত্মসম্মান ক্ষুন্ন হয় না।’
‘তা হবে। কিন্তু আমার মনে হয়, গরিবের আত্মসম্মান আর ধনীর আত্মসম্মান আলাদা বস্তু নয়। বরং যে ব্যক্তি গরিব তার আত্মসম্মান জ্ঞান আরো বেশী থাকা দরকার।’
এইভাবে যখন তাহারা বীরেনের আড্ডায় পৌঁছিল তখন তাহাদের তর্ক কথার সংঘর্ষে অত্যন্ত তিক্ত হইয়া উঠিয়াছে। বীরেনের ঘরে তক্তপোশের উপর গুটি পাঁচেক ছোকরা সাহিত্যিক বসিয়া ছিল; হিরণের উত্তেজিত অবস্থা দেখিয়া অন্নদা জিজ্ঞাসা করিল, ‘কি হে হিরণ, বেজায় চটেছ যে। কথাটা কি?’
হিরণ বলিল, ‘কথা সামান্যই। ব্রজলাটকে বোঝাবার চেষ্টা করছি যে পেটেন্ট লেদার পাম্পসু আর আত্মসম্মান এক বস্তু নয়।’
এ আড্ডার সকলেই ব্রজেনকে চিনিত এবং মনে মনে তাহার উপর বিরক্ত ছিল। ব্রজেনের শৌখিনতা ও চিন্তা হইতে আরম্ভ করিয়া সকল বিষয়ে বিলাসিতার আভাস অন্য সকলকে খোঁচা দিয়া যেন তাহাদের জীবনের দৈন্য চেতনাকে প্রকট করিয়া তুলিত। তাহারাও পরিবর্তে ব্রজেনকে শ্লেষ বিদ্রুপের বিষাক্ত কাঁটায় বিঁধিয়া প্রতিশোধ লইত। ‘ব্রজলাট’ নামটা এই কাঁটা গাছেরই ফুল।
প্রমোদ বলিল, ‘ব্রজলাটকে সে-তত্ত্ব বোঝাবার চেষ্টা করো না। যাদের অন্নবস্ত্রের কথা ভাবতে হয় তাদের আত্মসম্মান ঐ জুতোর সুকতলাতেই আটকে থাকে।’
ব্ৰজেন সন্তর্পণে তক্তপোশের একপাশে বসিয়া বলিল, ‘প্রমোদ, তোমার ‘ইটখোলা’ গল্পটা পড়লুম। কি রাবিশ লিখেছ? কতকগুলপ কুলিমজুরের অসহায় দুর্দশার কাহিনী লিখে কি লাভ হয় আমি তো বুঝতে পারি না। অবশ্য, তারা এই সব দুঃখ দৈন্য দমন করে মাথা তুলেছে—এ যদি দেখাতে পারতে তাহলে কোনও কথা ছিল না। কিন্তু তারা দুর্বল তারা নিপীড়িত তারা অভাবের পায়ে মনুষ্যত্ব বলি দিচ্ছে—এই কথা জোর গলায় ঘোষণা করে কি লাভ হয়?
প্রমোদ গরম হইয়া বলিল, ‘কি লাভ হয়? মানুষের ব্যথা মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়; যাদের প্রাণ আছে তারা বুঝতে পারে দেশের তথাকথিত ভদ্রলোকেরা এই গরিবদের কি করে পায়ের তলায় দাবিয়ে রেখেছে।’
ব্ৰজেন জিজ্ঞাসা করিল, ‘এই গরিবদের দুর্দশার জন্যে তাদের নিজেদের কোনও দায় দোষ নেই?’
প্রমোদ গর্জন করিয়া বলিল, ‘না—নেই। দোষ তোমার মতো বিলাসী ধনীর—যারা পরিশ্রম করে না অথচ বসে বসে তাদের মুখের অন্ন কেড়ে খায়।’
ব্ৰজেন ধীরভাবে বলিল, ‘আমি আজ পর্যন্ত কারুর মুখের অন্ন কেড়ে খেয়েছি বলে স্মরণ হচ্ছে না। তবে দু’একজনের মুখে অন্ন যুগিয়েছি বটে।’
অট্টহাস্য করিয়া প্রমোদ বলিল, ‘তুমি দাতাকর্ণ! কার অন্ন কার মুখে যুগিয়েছ একবার ভেবে দেখেছ কি?
মৃদু হাসিয়া ব্ৰজেন বলিল, ‘আমারই অন্ন, আমি খুব ভাল করে ভেবে দেখেছি।’
অন্নদা শান্ত বিজ্ঞতার কণ্ঠে বলিল, ‘ব্রজলাট, গরিবের দরদ বুঝতে হলে গরিব হওয়া চাই—বুঝলে? টাকার কাঁড়ির ওপর বসে থাকলে টাকার গরমে দরদ সব উবে যায়।’
ব্ৰজেন বলিল, ‘তাই হবে বোধ হয়। তোমাদের ভাব দেখে মনে হয় টাকা জিনিসটাকে তোমরা ভারী-ঘেন্না কর।’
প্রমোদ তীব্রস্বরে বলিল, ‘হ্যাঁ করি। টাকা আমাদের হাতের ময়লা। আমি তো নিজে গরিব বলে গর্ব অনুভব করি।’
ব্ৰজেন জিজ্ঞাসা করিল, ‘গরিব হওয়ার কোনও বাহাদুরী আছে?’
অন্নদা জবাব দিল, ‘হ্যাঁ আছে। দেশের শতকরা নিরানব্বই জনের মধ্যে আমিও একজন, এই আমার গর্ব।’
তাহার দিকে ফিরিয়া ব্ৰজেন বলিল, ‘তুমি তো লটারিতে টিকিট কেনো সেদিন বলেছিলে। কেন কেনো? আর মনে কর যদি এক লাখ টাকা পেয়ে যাও—সে টাকা কি ফেলে দেবে, না গরিবদের বিলিয়ে দেবে?’
অন্নদা হঠাৎ জবাব দিতে পারিল না। হিরণ তাহার হইয়া বলিল, ‘অন্নদা কি করবে না করবে তা তুমি কি করে জানলে ব্রজলাট? বিলিয়েও দিতে পারে। আমি নিজের কথা বলতে পারি, টাকাকে আমি ঘেন্না করিনে বটে কিন্তু টাকা বুকে আঁকড়ে ধরবার মতো জিনিস তাও আমার মনে হয় না।’
ব্ৰজেন বলিল, ‘আমারও হয় না, ওখানে আমি তোমার সঙ্গে একমত। কিন্তু তাই বলে নিজের দারিদ্র্যকে ঢাক পিটিয়ে জাহির করে বেড়ানোও আমি অত্যন্ত লজ্জাকর মনে করি।’
অন্নদার এতক্ষণে লুপ্ত কণ্ঠস্বর ফিরিয়াছিল, বলিল, ‘কি যাতনা বিষে জানিবে সে কিসে কভু আশীবিষে দংশেনি যারে! He laughs at scars that never felt a wound.’
ব্ৰজেন বলিল, ‘আচ্ছা অন্নদা, সত্যি বল, নিজেদের খেলো করতে একটুও বাধে না? এই যে। তোমরা ‘আমি হীন আমি দীন আমি নরকের কীট’ বলে রাতদিন নাকে কান্না কাঁদছ, যে ছাইপাঁশ সাহিত্য রচনা করছ সেও ওই নাকি কান্নার সুরে—এতে তোমাদের মনের দৈন্য প্রকাশ হয়ে পড়ছে না? এটা যে একটা inferiority complex তা বুঝতে পারছ না?’
অন্নদা উচ্চ অঙ্গের ঘাড় নাড়িয়া বলিল, ‘না, পারছি না। আমরা তোমার মতো snob নই। বীরেন, চা আনাও হে।’
ব্ৰজেনের চোখের দৃষ্টি প্রখর হইয়া উঠিল, সে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলিল, ‘এই যে প্রত্যহ সন্ধ্যেবেলা নিয়ম বেঁধে বীরেনের ঘাড় ভেঙে চা ইত্যাদি ধ্বংস করছ—এতেও নিজেকে ছোট মনে হচ্ছে না?’
সকলের মুখ লাল হইয়া উঠিল। বীরেন লজ্জিতভাবে বলিল, ‘আঃ, কি বলছ ব্রজলাট! বন্ধুর বাড়িতে—দোষ কি?’
ব্ৰজেন বলিল, ‘দোষ হত না, যদি এরা শুধু চায়ের লোভেই এখানে না আসত! মনের এই নির্লজ্জ দীনতাকেই আমি ঘেন্না করি।’
হিরণ বলিল, ‘এখানে চা খেতে আসাই যে আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য তা সবাই জানে, বীরেনেরও অগোচর নেই। সুতরাং ব্রজলাট, তোমার খোঁচাটা মাঠে মারা গেল, আমাদের গায়ে লাগল না।’
ব্ৰজেন উঠিয়া দাঁড়াইল, বলিল, ‘আশ্চর্য, এতবড় খোঁচাটাও তোমাদের গায়ে লাগল না! এত পুরু চামড়া নিয়ে তোমরা সাহিত্য রচনা কর কি করে?’
এই সময় চা আসিল। বীরেন বলিল, ‘কিহে—উঠলে নাকি? এক পেয়ালা খেয়ে যাও।’
‘না ভাই, আমি উঠলুম। আমার একটু কাজ আছে।’
পেয়ালায় চুমুক দিয়া প্রমোদ হিংস্র কণ্ঠে কহিল, ‘Firpo-র চা নয়, ব্রজলাটের শরীর খারাপ হতে পারে।’
অন্নদা বাঁকা হাসিয়া বলিল, ‘তা ছাড়া আত্মসম্মানের হানি হওয়াও বিচিত্র নয়। কিন্তু তোমার তো সে ভয় নেই ব্রজলাট, তুমি তো আর আমাদের মতো হা-ঘরে নয়। খাও না এক পেয়ালা, আত্মমর্যাদা চিড় খাবে না।’
‘না, তোমরা খাও’—বলিয়া ব্ৰজেন বাহির হইয়া যাইবে এমন সময় আরো দু’তিন জন আড্ডাধারী কলরব করিতে করিতে ঘরে ঢুকিল।
বিরাজ বলিল, ‘তুমুল ব্যাপার। হৈ রৈ কাণ্ড! আর তোমাদের দুঃখ রইল না—বুঝলে হে? স্বয়ং কবি-সম্রাট এবার আসরে নেমেছেন।’
সুধীর বলিল, ‘কবি-সম্রাটের মাথায় এত বুদ্ধি খেলত না বাবা, যদি এই শর্মা দিনরাত পশ্চাতে লেগে থেকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে কাজ হাসিল না করত!’
বীরেন বলিল, ‘কি ব্যাপারটা আগে বল না ছাই।’
সুধীর বলিল, ‘ব্যাপার আর কি! আমার সেই স্কীম মনে নেই? কবিকে রাজী করিয়েছি। সমিতি তৈরি হয়ে গেছে—স্বয়ং কবি তার সভাপতি। আরো অনেক বড় বড় শাঁসালো লোক আছেন। সমিতির নাম হয়েছে ‘বাণী বান্ধব সমিতি’। ছোট-বড় সব সাহিত্যিক আর সাহিত্য ব্যবসায়ীর কাছ থেকে চাঁদা তোলা হবে, বাইরে থেকে চাঁদা নেওয়া হবে না। সেই টাকায় তোমার আমার মতো যত সাহিত্যিক আছে—যাদের লেখা সহজে প্রকাশকেরা নিতে চায় না—তাদের বই ছাপিয়ে প্রকাশ করা হবে। এই দেখ আবেদন পত্র আর নামের ফিরিস্তি। স্বয়ং কবি গোড়াতেই দুশো টাকার চেক ঝেড়েছেন।’
বিরাজ বলিল, ‘শুধু তাই নয়, সমিতির অন্য উদ্দেশ্যও আছে। যদি কোনও সাহিত্যিক কষ্টে পড়েন, তাঁকে অর্থসাহায্যও করা হবে। —এখন যে যার ট্যাঁক থেকে কিছু কিছু বার কর তো দেখি। আমাদের ওপর চাঁদা তোলবার ভার পড়েছে!’
কবির স্বহস্ত লিখিত আবেদন পত্ৰটা সকলে ঝুঁকিয়া পড়িয়া দেখিতে আরম্ভ করিয়াছিল। দেখা শেষ হইলে প্রমোদ প্রকাণ্ড একটা নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, ‘যাক বাবা, এতদিনে অনাথ শিশুদের একটা হিল্লে হল। ওহে বিকাশ, তোমার সেই উপন্যাসখানা—যেটা আমাদের প্রায়ই পড়ে শোনাও—সেটা বগলে করে এবার বেরিয়ে পড়।’
সুধীর বলিল, ‘সে তো পরের কথা, এখন কে কত দেবে বল। বীরেন, তুমি কি দিচ্ছ?’
বীরেন বলিল, ‘আমি এক টাকা দিলুম। লিখে নাও।’
লিখিয়া লইয়া সুধীর বলিল, ‘এবার তোমরা। অন্নদা—কত?’
অন্নদা বলিল, ‘আমরা আবার দেব কি বাবা? আমরাই তো হলুম গিয়ে এ ফান্ডের বেনিফিশিয়ারি—আমরা তো নেব।’
ব্ৰজেনের মুখ ঘৃণায় কুঞ্চিত হইয়া উঠিল, সে বলিল, ‘নেবে? হাত পাততে লজ্জা করবে না অন্নদা?’
প্রমোদ গাহিয়া উঠিল, ‘কিসের দুঃখ কিসের দৈন্য কিসের লজ্জা কিসের ক্লেশ, সপ্তকোটি—’
সুধীর বলিল, ‘ঠাট্টা নয়, টাকা বার কর। কবিকে কথা দিয়ে এসেছি।’
প্রমোদ বলিল, ‘সুধীর, তুমি হাসালে। আমরা টাকা কোথায় পাব ভাই! পকেটে স্রেফ সুপুরি আছে। —তার চেয়ে ঐ যে টাকার কুতুব মিনার দাঁড়িয়ে আছেন, ওঁকে ধর। ওঁর হাত ঝাড়লে পর্বত—এখনি দশ বিশ টাকা বেরিয়ে পড়বে।’
সুধীর ব্রজেনের দিকে ফিরিয়া বলিল, ‘বেশ, তাহলে তুমিই আরম্ভ কর ব্রজলাট। কত দেবে?’
ব্ৰজেনের মুখে একটা কঠিন হাসি দেখা দিল, ‘আমাকেও দিতে হবে? বেশ দু’টাকা লিখে নাও।’ পকেট হইতে মনিব্যাগ বাহির করিতে করিতে বলিল, ‘দুস্থ সাহিত্যিকদের প্রতিপালন করছি ভেবেও একটু আনন্দ পাওয়া যাবে।’
মনিব্যাগে কেবল একটি দশ টাকার নোট ছিল, ব্রজেন সেটা সুধীরের সম্মুখে ফেলিয়া দিল। সুধীর বলিল, ‘খুচরো টাকা তো নেই। তোমাদের কারুর কাছে আছে? বীরেন, নোটখানা বাড়ি থেকে ভাঙিয়ে এনে দাও না।’
প্রমোদ বলিয়া উঠিল, ‘আবার ভাঙিয়ে কি হবে বাবা! ও সবটাই জমা করে নাও।’
সকলেই সানন্দে হাঁ হাঁ করিয়া সায় দিল, পরের টাকা সদ্ব্যয় হইতেছে দেখিলে কাহার না আনন্দ হয়? বিশেষত আজ ব্রজেনের কথায় সকলের গায়েই বিষম জ্বালা ধরিয়াছিল। প্রমোদ বলিল, ‘ব্রজলাট, তুমি দশ টাকার কম দিলে লোকে বলবে কি? তোমার সিল্কের পাঞ্জাবির অপমান হবে যে বাবা। তাছাড়া তোমার নিজের উপার্জনের পয়সা তো নয় যে গায়ে লাগবে। পৈতৃক পয়সা—’
ব্ৰজেন তাহার দিকে ফিরিয়া তীব্র বিদ্রুপের স্বরে বলিল, ‘তুমি ঠিক জানো এ আমার পৈতৃক পয়সা—কেমন?’
প্রমোদ বলিল, ‘তাছাড়া আর কি হতে পারে ব্রজলাট? সাহিত্য ব্যবসায়ে উপার্জন করে বাবুয়ানি কর—এ তো বিশ্বাস হয় না।’
ব্ৰজেন আর কিছু বলিল না। সুধীর আনন্দে বলিল, ‘তাহলে দশ টাকাই জমা করে নিলুম।’
ব্ৰজেন ভ্রুকুঞ্চিত করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল, তারপর ‘আচ্ছা চললুম’ বলিয়া দ্বারের দিকে অগ্রসর হইল।
হিরণ তাহাকে ডাকিয়া বলিল, ‘দাঁড়াও হে ব্রজলাট, আমিও যাব। —হাঁ হাঁ, কিছু দেব বৈকি। আট আনা লিখে নাও, কিন্তু এখন কিছু দিতে পারছি না। শিগ্গির কিছু টাকা পাবার কথা আছে—’
দু’জনে রাস্তায় বাহির হইয়া পড়িল; ব্রজেনের বাসা কাশীপুরের দিকে সকলেই জানিত বটে কিন্তু কেহ আজ পর্যন্ত সেখানে পদার্পণ করে নাই। কিছুদূর গিয়া হিরণ জিজ্ঞাসা করিল, ‘বাসায় ফিরবে নাকি?’
‘হ্যাঁ।’
‘তাহলে তুমি বাস ধর, তোমাকে আর আট্কাব না।’
‘না আমি হেঁটেই যাব। চল না যতদূর একসঙ্গে যাওয়া যায়?’
আরও কিছুদূরে নীরবে চলিবার পর হঠাৎ হিরণ বলিল, ‘দেখ, তোমার কথাগুলো শুনতে কড়া হলেও সত্যি। কিন্তু কি করবো ভাই, পেরে উঠি না। দাঁত চেপে দারিদ্র্য সহ্য করা সকলের সাধ্য নয়। তুমিও যদি আমাদের মতো অবস্থায় পড়তে—’
যে রেস্তোরাঁর সম্মুখে তাহাদের কথা হইয়াছিল সেখানে পৌঁছিয়া ব্রজেন দাঁড়াইয়া পড়িল। একবার টলিয়া নিজেকে সাম্লাইবার চেষ্টা করিল, তারপর হঠাৎ ফুটপাথের উপর সটান পড়িয়া গেল।
রেস্তেরাঁয় লোক ছিল, ব্রজেনের মূৰ্ছিত দেহ ধরাধরি করিয়া একটা বেঞ্চির ওপর শোয়াইয়া দিল। হিরণ একেবারে হতভম্ব হইয়া গিয়াছিল, সে বলিল, “কিছুই তো বুঝতে পারছি না। হঠাৎ,—মৃগীর রোগ আছে হয়তো। অ্যাম্বুলেন্সে খবর দিলে ভাল হয়।’
অ্যাম্বুলেন্স আসিলে ব্রজেনকে তাহাতে তুলিয়া দেওয়া হইল। হিরণও সঙ্গে গেল।
হাসপাতালের ডাক্তার ব্রজেনের পরীক্ষা শেষ করিয়া হিরণের কাছে আসিয়া বলিলেন, ‘আপনার বন্ধু? না এখনো জ্ঞান হয়নি; তবে শিগ্গির হবে আশা করি। —ওঁকে দেখে তো বেশ সঙ্গতিপন্ন বলেই মনে হল। অথচ—আশ্চর্য—উনি বোধ হয় এক মাস কিছু খাননি। শরীরের টিসুগুলো পর্যন্ত শুকিয়ে গেছে।…কি ব্যাপার বলুন তো?’
২৪ ফাল্গুন ১৩৩৯