ব্যাকুলতা
নিজেই নিজের সবচেয়ে বড় শত্রু। কোনও সন্দেহ নেই। এক পা তাঁর দিকে এগোই তো তিন পা পেছিয়ে আসি। এমন সব জাগতিক তুচ্ছ জিনিস চেয়ে বসি যে তাঁর দেবার ক্ষমতা থাকলেও আমার প্রতি ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেন। যেমন খুব একটা ভিড় বাসে উঠে, আমি মনে-মনে বললুম, ‘ঠাকুর, আমি রোজ আপনাকে প্রাণমন দিয়ে ডাকি। আজ নিজেকে আমার ভীষণ দুর্বল লাগছে, একটা বসার আসন আপনি আমাকে পাইয়ে দিন। আমাকে এমন একটা আসনের পাশে দাঁড় করিয়ে দিন, যে আসনের যাত্রী পরের স্টপেজেই নেমে যাবেন।’ সঙ্গে-সঙ্গে মন বললে, ‘তুমি ওইখানে গিয়ে দাঁড়াও।’ আমি ধরেই নিলুম, এ হল আমার ঠাকুরের নির্দেশ। কোথায় কি! সেই আসনের দুজন যাত্রী একেবারে শেষ স্টপেজেই গিয়ে নামলেন। অথচ প্রথমে আমি যেখানে দাঁড়িয়েছিলুম, সেইখানে দাঁড়িয়ে থাকলে পরের স্টপেজেই বসার জায়গা পেয়ে যেতুম। অভিমানে আমার ঠোঁট ফুলে গেল। সিদ্ধান্তে এলুম, ঠাকুর আমাকে দুচক্ষে দেখতে পারেন না। আমি ঠাকুরের কেউ নই। ঠাকুরও আমার নেউ নন। পরে গভীর রাতে যখন নিজের মুখোমুখি হলুম, নিজের নির্বুদ্ধিতায় হেসে ফেললুম। ঠাকুরের কাছে আমি কি সামান্য জিনিসই না চেয়েছি। বাসে বসার একটি আসন। আত্মজ্ঞান নয়। বিবেকবৈরাগ্য নয়, একটা আসন। সোনার দোকানে গেছি লোহার শেকল কিনতে। মূর্খ সংসারী। প্রতিজ্ঞা করলুম, এই ভুল আমি আর কোনওদিন করব না।
সাতদিনের মধ্যেই সব ভুলে গেলুম। অফিস বেরোবার আগে আকাশ ছেয়ে এল কালো মেঘ। ঠাকুরের কাছে চেয়ে বসলুম, ঠাকুর বৃষ্টিটা একটু ধরে রাখুন। অফিসে পৌঁছাবার পর যেন নামে। কোথায় কি! তিন মিনিটের মধ্যে তেড়ে বৃষ্টি নামল। এক হাঁটু জলের তলায় তলিয়ে গেল কলকাতা। ভয়ঙ্কর অভিমানে সেই দুর্যোগের মধ্যেই নেমে পড়লাম পথে—বুঝেছি আপনি আমাকে ভেজাতে চান। গর্তে ফেলে কর্দমাক্ত করতে চান। তবে তাই হোক। আবার গভীর রাতে জ্ঞানোদয় হল, বোকা! বৃষ্টি হবে প্রকৃতির নিয়মে। ঠাকুর কি করবেন! মন বললে, কেন? ভক্তের জন্যে শ্রীকৃষ্ণ গিরি গোবর্ধন ধারণ করেছিলেন। যুক্তি বললে, মূর্খ? তোমার ভক্তি, তোমার বিশ্বাস কি অতদূর পৌঁছেছে? মন বললে, না। তবে? তুমি কি করে আশা করো, অলৌকিক কিছু একটা ঘটবে! তোমার ভেতরে কি সেই বালক জটিলের বিশ্বাস আছে! ঠাকুর যে গল্পটি ভক্তদের প্রায়ই বলতেন! বনপথে জটিল তার মধুসূদনদাদার দেখা পেয়েছিল। অথবা ঠাকুরের গল্পের সেই মেয়েটি। ঠাকুর বলছেন—’একজনের একটি মেয়ে ছিল। খুব অল্প বয়সে মেয়েটি বিধবা হয়ে গিছল। স্বামীর মুখ কখনও দেখেনি। অন্য মেয়ের স্বামী আসে দেখে। সে একদিন বললে, বাবা, আমার স্বামী কই? তাঁর বাবা বললেন, গোবিন্দ তোমার স্বামী; তাঁকে ডাকলে তিনি দেখা দেন। মেয়েটি ওই কথা শুনে ঘরে দরজা দিয়ে গোবিন্দকে ডাকে আর কাঁদে। বলে—গোবিন্দ, তুমি এস, আমাকে দেখা দাও। তুমি কেন আসছ না। ছোট মেয়েটির সেই কান্না শুনে ঠাকুর থাকতে পারলেন না। তাকে দেখা দিলেন।’ গল্প শেষ করে ঠাকুর বলছেন—’বালকের মতো বিশ্বাস। বালক মাকে দেখবার জন্যে যেমন ব্যাকুল হয়, সেই ব্যাকুলতা। এই ব্যাকুলতা হল তো অরুণোদয় হল। তারপরে সূর্য উঠবেই। এই ব্যাকুলতার পরেই ঈশ্বরদর্শন।’
সব পারি, ব্যাকুল হতে পারি না কেন? কোথায় আটকাচ্ছে? বুঝতে পেরেছি, এই পৃথিবীতে নিজেকে ঠিক ততটা অসহায় মনে করতে পারি না। জৈব অভ্যাসে যা যা প্রয়োজন, কমই পাই আর বেশিই পাই, পেয়ে তো যাচ্ছি। আপনজনেরা আমাকে ঘিরে আছে। যতই দু:খ দিক আঘাত দিক, মনের এমন অভ্যাস, কিছুতেই মানতে চায় না যে ওরা কেউই আমার আপনজন নয়। স্বার্থের টানা পোড়েনে বাঁধা।
ঠাকুর বললেন, বড় ধন্দে পড়েছিস, তাই না? যে তাঁকে ভাবে না, সে এরকম থাকে। তার বিশ্বাস মতো সে চলে, খায় দায়, সংসার করে। হাসে, কাঁদে, রাগে। তার দু:খের কারণ অন্য; তার আনন্দের কারণও অন্য; কিন্তু যার মনে তিনি ছায়া ফেলেছেন, সে মরেছে। সে বুঝতে পারছে হাতের নাগালের মধ্যেই রয়েছে অপার আনন্দের ধারা। সে-নদী বইছে। সে-নদীর শব্দ শোনা যাচ্ছে। উজ্জয়ী বাতাস বয়ে আসছে। শুধু অবগাহন করা যাচ্ছে না। সূক্ষ্ম অথচ শক্ত একটা ব্যবধান। কিছুতেই ভাসা যাচ্ছে না। উর্ত্তীণ হওয়া যাচ্ছে না মনে হচ্ছে :
তারিতে হবে না তারা হয়েছি শরণাগত।
হইয়া রয়েছি যেন পিঞ্জরের পাখির মতো।।
অসংখ্য অপরাধী আমি জ্ঞানশূন্য মিছে ভ্রমি।
মায়াতে মোহিত হয়ে বৎসহারা গাভীর মতো।।
বলো, ‘কেন? পিঞ্জরের পাখির মতো হতে যাব কেন? হ্যাক! থু! সীতার মতো করে দাও। একেবারে সব ভুল—দেহ ভুল, যোনি, হাত, পা, স্তন—কোনও দিকে হুঁশ নেই। কেবল এক চিন্তা—কোথায় রাম!’শোনো,
গর্ভে ছিলাম যোগে ছিলাম, ভূমে পড়ে খেলাম মাটি
ওরে ধাত্রীতে কেটেছে নাড়ি, মায়ার বেড়ি কিসে কাটি।।
কামিনী-কাঞ্চনই মায়া। মন থেকে ওই দুটি গেলেই যোগ। আত্মা-পরমাত্মা চুম্বক পাথর, জীবাত্মা যেন একটি সূচ—তিনি টেনে নিলেই যোগ। কিন্তু সূচে যদি মাটি মাখা থাকে, চুম্বক টানে না। মাটি সাফ করে দিলে আবার টানে। কামিনী-কাঞ্চন মাটি পরিষ্কার করতে হয়। তাঁর জন্যে ব্যাকুল হয়ে কাঁদো—সেই জল মাটিতে লাগলে ধুয়ে-ধুয়ে যাবে। যখন খুব পরিষ্কার হবে তখন চুম্বক টেনে নেবে। যোগ তবেই হবে।