7 of 8

ব্যবসা-বাণিজ্য

ব্যবসা-বাণিজ্য

এ বিষয়ে লেখার ক্ষমতা আমার নেই। তবু, তুমি তো জানো, খেলাচ্ছলে এ যাবৎ এমন কত বিষয়ে লিখলাম, যার সম্বন্ধে আমার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই।

তখন আমি একটা ছোট কবিতার কাগজের দেখাশোনা করি। হঠাৎ ভাগ্যদোষে এক এমব্যাসির পার্টিতে এক তালেবরের সঙ্গে দেখা। তাঁর সঙ্গে আলাপ হল। তিনি বললেন, আমার কাগজ অঙ্গুলি হেলনে দাঁড় করিয়ে দেবেন।

লোভে পড়ে, আমি তাঁর সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করলাম, পরের রবিবার সকালে। শাহেনশা ব্যক্তি, তাঁকে তো আমার দীনকুটিরে আসতে বলা যায় না। সকাল দশটার সময় তাঁকে চৌরঙ্গি এলাকার একটা মহার্ঘ্য ও অভিজাত চায়ের দোকানে নিমন্ত্রণ করলাম। যথেষ্ট লাভের আশা আছে— এই ভরসা দিয়ে, গৃহিণীর কাছ থেকে অভিজাত রেস্তোরাঁয় ব্যয় করার জন্য কিছু টাকা নিলাম। তারপর সেই রেস্তোরাঁয় গিয়ে সকাল সাড়ে ৯টা থেকে তাঁর জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলাম। বেলা ১২টা পর্যন্ত তিনি এলেন না। তিন কাপ চা, দুটো কফি, দুটো কোল্ড ড্রিঙ্ক সবই মহামূল্য দোকানে বসে থাকার খেসারত হিসেবে খেতে হল।

হতাশ হয়ে বাড়িতে ফিরে আসার পর গৃহিণী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কেমন হল?’ গৃহিণীকে হতাশ হতে দিলাম না। তাঁকে বললাম, ‘ফিফটি-ফিফটি, আধা-আধি’। গৃহিণী জোর করলেন, ‘আধা-আধি’ বুঝিয়ে বলতে। পেটের মধ্যে তখন উথালপাতাল করছে বাজার খরচ থেকে সরানো গৃহিণীর কষ্টার্জিত অর্থে খাওয়া তরল ও উষ্ণ পানীয়। মিথ্যে বলতে পারলাম না। বললাম, ‘অ্যাপয়েন্টমেন্ট ঠিকই ছিল। আমি গিয়েছিলাম, তিনি আসেননি। তাই বলছি ফিফটি-ফিফটি, আধা-আধি।’

এই হাফ-হাফ, আধা-আধি ব্যাপারটা ব্যবসায়ীরা কিন্তু খুব বিশ্বাস করেন। এক ব্যবসায়ী ভদ্রলোক তাঁর কিশোরপুত্রকে ব্যবসায়ে সততার শিক্ষা দিচ্ছিলেন উদাহরণ সহযোগে—‘মনে, করো, একটা দোকান দিয়েছ তুমি আর তোমার বন্ধু দু’জনে মিলে। একদিন বন্ধু দোকানে নেই, এমন সময় একজন খদ্দের এল, জিনিসপত্র কিনে নিয়ে গেল। তখন দেখলে খদ্দের হিসেবে ভুল করে একশো টাকা বেশি দিয়ে গিয়েছে। কী করবে?’ অপাপবিদ্ধা সরল কিশোর বলল, ‘কী আর করব? সেই খদ্দেরকে খুঁজে বের করে টাকা ফেরত দিয়ে দেব।’

বাবা বললেন, ‘খোকা, খদ্দের একবার দোকান থেকে বেরিয়ে গেলে তাঁকে খুঁজে পাওয়া কঠিন কাজ। তা ছাড়া…।’ বাবা কথা শেষ করার আগেই খোকা বলল, ‘তা হলে ওই টাকা রামকৃষ্ণ মিশনে দিয়ে দেব!’

বাবা বললেন, ‘রামকৃষ্ণ মিশন?’

খোকা বলল, ‘তা না হলে মাদার টেরিজা?’

বাবা বললেন, ‘মাদার টেরিজা?’

খোকা বলল, ‘মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে দিয়ে দেব।’

বাবা বললেন, ‘এসব কিছু ঠিক কথা নয়। শোনো, খদ্দেরকে টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য কখনও খুঁজতে যাবে না। সে যদি নিজেই ফিরে আসে, কখনও স্বীকার করবে না যে, সে একশো টাকা বেশি দিয়েছে, আর ওইসব ধর্মকর্মেও টাকাটা দেবে না।’

খোকা বলল, ‘তা হলে ওই একশো টাকা আমি নিজে নিয়ে নেব?’

বাবা বললেন, ‘খোকা, অসৎ হয়ো না।’

বাবার কথা শুনে থমকিয়ে গেল খোকা। সে জানে না ওই উপরি একশো টাকা নিয়ে কী করতে হবে। তখন তার পিতৃদেব বললেন, ‘ব্যবসা সৎভাবে করতে হয়। আমি বলে দিচ্ছি, সেই বেশি টাকা-দেওয়া খদ্দেরকে খুঁজতে যাবে না, দয়া-দান, ধর্মকর্ম করতে যাবে না, কিন্তু টাকাটা তুমি নিজেও নেবে না। সেটা ব্যবসায়িক অসাধুতা হবে। তুমি পঞ্চাশ টাকা নেবে, আর পঞ্চাশ টাকা তোমার সেই অংশীদার বন্ধুকে দেবে। সে দোকানে উপস্থিত নেই বলে, তাকে ঠকাতে যাবে না।’

একেবারে মোক্ষম উপদেশ। খদ্দেরকে ঠকাতে নিষেধ নেই। তবে, অংশীদারকে বঞ্চিত করবে না।

এই যে ব্যবসা-বুদ্ধি, এই বুদ্ধি ব্যবসায়ীর সারাজীবন বর্তমান থাকে, সেই মৃত্যু পর্যন্ত। এক ব্যবসায়ী তাঁর মৃত্যুশয্যার পাশে তাঁর সব ছেলেকে দণ্ডায়মান দেখে মৃত্যুশয্যা থেকে লাফিয়ে উঠেছিলেন, ‘সবাই এখানে দাঁড়িয়ে চোখ মুছছ, তা হলে দোকান দেখছে কে?’ শোনা যায়, ওই মুমূর্ষু নিজেই দোকানে রওনা হতে গিয়ে ঘরের মেঝেতে মুখ থুবড়ে পড়ে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।

মৃত্যু-সংক্রান্ত বিষয়ে ব্যবসা-বুদ্ধির একটি রক্ত হিম করা গল্প শেষমেশের সুবাদে পাঠকেরা জানেন।

এক মাথাগরম ব্যবসায়ীর ফাঁসির হুকুম হয়েছিল। তিনি তাঁর এক অবুঝ খদ্দেরের সঙ্গে একই রকম দামদর করতে করতে শেষে এত উত্তেজিত হয়ে যান যে, দোকানের ব্যবহারের ভোঁতা কাঁচি খদ্দেরের বুকে বসিয়ে দেন। খদ্দের বেচারা মারা যান। বিচারে দোকানদারের ফাঁসির আদেশ হয়। ফাঁসির দু’দিন আগে ব্যবসায়ী ভদ্রলোক জানতে পারেন, তাঁর ফাসির বাবদ সরকারের হাজার তিনেক টাকা খরচ হবে। ফাঁসির মঞ্চ ঠিকঠাক করা, দড়ি মোম দিয়ে পাকানো, ডাক্তার-পুরুত অনেক রকম খরচ।

এই সংবাদ শুনে ওই ব্যবসায়ী জেল-কর্তৃপক্ষকে জানালেন, ‘আমার ফাঁসির জন্যে অত খরচ করতে হবে না। আমাকে এক হাজার টাকা দিন, তার থেকে দশ টাকা দিয়ে একটা পাটের দড়ি কিনে এনে আমি আত্মহত্যা করছি। সরকারেরও দু’হাজার টাকা বাঁচে, আমার নয়শো নব্বুই টাকা লাভ হয়।’

এক ঘড়ির দোকানদার তাঁর দোকানের অনেকগুলি ঘড়ি অত্যন্ত কম দামে বেচে দিলেন। প্রায় জলের দামেই বলা চলে। সাতশো টাকার ঘড়ি তিনশো টাকায়, পাঁচশো টাকার ঘড়ি দুশো টাকায়। গ্রাহকেরাও খবর পেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘড়িগুলো কিনে নিয়ে চলে গেল।

এই সব দেখে ঘড়ির দোকানির এক শুভানুধ্যায়ী জিজ্ঞাসা করলেন তাঁকে, ‘এত শস্তায় ঘডি সব বেচে দিলে, তোমার ক্ষতি হল না?

দোকানি বললেন, ‘অনেকদিন পড়েছিল দোকানে, বেচে দিয়ে ভালই হয়েছে, কিছু নগদ টাকা হাতে এল। তা ছাড়া ঘড়িগুলো সুবিধের নয়, ওগুলো সারিয়ে আমি ক্ষতি উসুল করে নেব।’

ব্যবসা-বাণিজ্যের এসব গূঢ়তত্ত্ব আমার মোটেই বোঝার কথা নয়। কিন্তু ব্যবসা সংক্রান্ত একটা জটিল উপাখ্যান আমার জানা আছে, সেটি আমি কাহিনীর আকারে পেশ করছি, তবে গল্পটা পুরোপুরি বানানো নয়।

মনুমামা আজ কয়েকদিন হল কলকাতায় কী একটা কাজে এসেছেন, আমার বাসায় এসে উঠেছেন। তাঁকে বুকে অসুখের জন্যে ডাক্তার সিগারেট খেতে বারণ করে দিয়েছেন। তাই মনুমামা নিজের বুদ্ধিতে বিড়ি খাওয়া ধরেছেন। তবে ভাল তামাকে হাতে তৈরি বিড়ি চাই।

আমাদের পাড়ায় একটা গলির মুখে থাকেন রামবাবু। তাঁর বিড়ির ব্যবসা আছে। সারাক্ষণে বসে বিড়ি পাকান। বিড়ি পাকিয়ে রঙিন সুতো দিয়ে পঁচিশটার একেকটা বান্ডিল করে বেচেন।

রামবাবু ভাল গল্প করেন। কথা বলতে বেশ ভালবাসেন। মনুমামার বিড়ি কেনার জন্যে দু’-চারদিন যাতায়াতে রামবাবুর সঙ্গে আমার বেশ সখ্যতা হয়ে গেল।

বিড়ি কিনতে তাঁর কাছে গেলে আমাকে দু’দশ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। জীবনে বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতা আছে তাঁর। জীবিকার জন্যে নানারকম কাজ করেছেন তিনি। পঞ্চাশের দশকে কলকাতায় প্রথম ধর্মতলা অঞ্চলে কাচের বয়ামে ফিরি করে ত্রিফলার চাটনি বিক্রি করা আরম্ভ করেন। তিনি সরষের তেলের ভেজালের জন্যে হাতিবাগানের কয়েকটা তেল কলে শেয়ালকাঁটার বীজ আর সজনে গাছের ছাল সরবরাহ করেছেন বেশ কয়েক বছর। পরে অবশ্য বিবেকের অমোঘ দংশনে সে ব্যবসা ছেড়ে দেন।

এর পরে রামবাবু জানান, তবে সবচেয়ে বেশি লাভ ছিল মধুর ব্যবসায়। সুন্দরবনের জঙ্গলের গভীর থেকে মধু কিনে আনতেন, কলকাতার বাজারে ডবল দামে সেই মধু বিক্রি করতেন।

আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘সে ব্যবসাটা করাই উচিত ছিল আপনার, সেই কারবারটা ছাড়তে গেলেন কেন?’

রামবাবু দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বলেন, ‘মধুর কারবার কি সাধ করে ছেড়েছি আপনার মনে হয়। সে এক মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা।’

এ রকম ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতার পূর্ণ বিবরণ না শুনে আসা যায় না। আমাকেও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রামবাবুর কথা শুনে যেতে হল। এদিকে, বিড়ি কিনে নিয়ে যেতে দেরি হয়ে যাচ্ছে। মনুমামা কিন্তু… কী করা যাবে। তবে রামবাবু দ্রুত হাতে বিড়ি বাঁধতে বাঁধতে যা বললেন তা মর্মান্তিকের চেয়েও বেশি।

একদিন তিনি মধুর সন্ধানে জঙ্গলের গভীরে চলে গেছেন। নৌকোয় বসে আছেন, কখন মৌচাক কেটে মধু নিয়ে ব্যাপারিরা আসবে, তাদের কাছ থেকে মধু কিনে নিয়ে আসবেন।

অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছেন রামবাবু, মধুর নৌকো আসছে না, রামবাবু সামনের গলুইয়ের ওপরে বসে আছেন। হঠাৎ পিছনে খালের ধারে শুকনো সুঁদরি পাতার মধ্যে খচমচ শব্দ শুনে তিন তাকিয়ে দেখেন একটা বিরাট রয়াল বেঙ্গল টাইগার সামনের পা দুটো নিচু করে তাঁর দিকে তাক করে লাফানোর জন্যে উদ্যত হয়েছে।

এই পর্যন্ত শুনে আমি স্তম্ভিত, মিনমিন করে জানতে চাইলাম, ‘তারপর কী হল?’ রাম বললেন, ‘বুঝতে পারছেন না কী হল? আমাকে দেখেও বুঝতে পারছেন না?’

আমার বোঝার ক্ষমতা চিরদিনই কম, সেকথা কবুল করে বললাম, ‘পরিষ্কার করে বলুন না, সত্যি কী হয়েছিল? বাঘটা আপনাকে মাথা ঘোরাতে দেখে লাফ না দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল?’

রামবাবু বললেন, ‘এ রকম হলেই খুব ভাল হত। কিন্তু মাথা ঘোরানো এবং মাথা ঘুরিয়ে রয়াল বেঙ্গলকে দেখতে পাওয়ার মধ্যে যে খণ্ডমুহূর্ত, সেই ক্ষণে আমি কিছু বোঝবার, অনুমান করবার আগে বিদ্যুৎ ঝলকের মতো সেই ডোরা ডোরা হলুদ বাঘটা আমার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল।’

এই অবস্থায় রুদ্ধশ্বাস হয়ে আমি জানতে চাইলাম, ‘বাঘ নিশ্চয় আপনার মাথার ওপর দিয়ে লাফিয়ে চলে গিয়েছিল।’

রামবাবু বললেন, ‘রয়াল বেঙ্গল কখনও তাক ভুল করে না।’

আমি বললাম, ‘তা হলে?’

তিনি বললেন, ‘তা হলে কী? বাঘটা খালের এপার থেকে লাফিয়ে পড়ে আমার ঘাড় মটকিয়ে মুখে করে ওপারে গিয়ে পড়ল।’

এই পর্যন্ত শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে বললাম, ‘তা হলে আপনি বেঁচে রইলেন কী করে?’

‘বেঁচে কি আছি দাদা?’ রঙিন সুতো দিয়ে পঁচিশটা বিড়ির একটা বান্ডিল বেঁধে আমার হাতে দিয়ে রামবাবু বললেন, ‘একে কি বেঁচে থাকা বলে দাদা?’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *